#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪৫
#Arshi_Ayat
মধুর ভয় লাগছে ইয়াদের বসায় যেতে।প্রথম প্রথম যখন ইয়াদের বাসায় যেতো তখন এমন অনুভূতি হতো পরে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়।কিন্তু আজকে ভেতরে ভেতরে প্রথম দিনের মতো কেমন যেনো জড়তা কাজ করছে।
ইয়াদ দরজায় নক করলো।দুইবার নক করতেই সাইদা খান দরজা খুললো।সাইদা খানকে দেখে মধু সালাম করলো।কিন্তু সাইদা খানের কোনো ভাবান্তর নেই।বোঝা যাচ্ছে না ভেতরে কি চলছে।ইয়াদ মধুর হাত ধরে বলল,’মা,আমরা বিয়ে করেছি।’
সাইদা খান কিছু বললেন না।ভেতরে গিয়ে ইয়াফ খানকে ডেকে নিয়ে এলেন।তারপর রাগান্বিত কন্ঠে বললেন,’বিয়ে করেছি মানে?তুই তো বলেছিলি ওকে আনতে যাবি।বিয়ে করবি তো বলিস নি।’
‘এটা বলার কি আছে মা?ওকে আমি এখানে হোক আর ওখানেই হোক বিয়ে করতাম ই।’
‘সেইজন্য কাউকে না জানিয়ে?’ইয়াফ খান গম্ভীর কন্ঠে বললেন।
‘এখানে না জানানোর কিছু তো দেখছি না আমি।তোমরা তো সব জানতে।তাহলে এতো অবাক হচ্ছো কেন?’
‘তোর কিন্তু সামিহার সাথে এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেছে ইয়াদ!’সাইদা খান রুষ্ট হয়ে বললেন।
তিন/চার দিন আগে যে মেয়েটার সাথে ইয়াদের এঙ্গেজমেন্ট হয়েছিলো ওই মেয়েটার নাম সামিহা।ইয়াদ এই প্রথম ওর নাম জানলো।অবশ্য এর আগে জানার প্রয়োজন বোধ করে নি।ইয়াদ মুখভঙ্গি স্বাভাবিক রেখে বলল,’সো হোয়াট?এঙ্গেজমেন্ট কিন্তু আমার ইচ্ছাতে হয় নি।তোমরা ব্ল্যাকমেইল করেছো আমাকে।আর এমনিতেও ওই বিয়েটা এমনিতেও করতাম না।’
‘এখন তোর জন্য আমাদের কথার খেলাফ হলো।’ইয়াফ খান গম্ভীর কন্ঠে বললেন।
‘তোমাদের বলেছে কে কথা দিতে?আমি বলেছিলাম?আমার সাথে তোমরা এই বিষয়ে কথা বলেছিলে?বলো নি।নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছো।যেখানে আমারই মত নেই সেখানে কথার খেলাফ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না।’
‘এখন কি জবাব দিবো ওদের?ইয়াফ খান প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন ইয়াদকে।
ইয়াদ ডাইনিং টেবিল থেকে একটা গ্লাস নিয়ে পানি পান করলো।তারপর রিল্যাক্স মুডে মধুর দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলল,’যেটা সত্যি সেটাই বলবে।বলবে তোমাদের ছেলে ইয়াদ তার ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করেছে।তাকে ঠকায় নি,ছেড়ে যায় নি।সবসময় পাশে ছিলো,আছে,আজীবন থাকবে।’
এবার সাইদা খান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মধুর দিকে চেয়ে বলল,’সেটা নাহয় ঠিকাছে কিন্তু এতোদিন ও কোথায় ছিলো?আর এতো নাটক করলো কেনো?’
মধু নিচের দিকে তাকিয়ে জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে আছে।ইয়াদ মধুর পাশে গিয়ে দাড়ালো।তারপর বলল,’আহা!মা।কি মুশকিল!সবে মাত্র আসলাম।এখনই তোমাদের সব কৈফিয়ত দেওয়া লাগবে?একটু ফ্রেশ হই।আর ও তো পালিয়ে যাচ্ছে না।’
সাইদা খানকে এটা বলেই ইয়াদ মধুকে উদ্দেশ্য করে বলল,’তুমি ঘরে যাও।আমি আসছি।’
এই মুহুর্তে এই কথাটার অপেক্ষাতেই ছিলো মধু।এখানে থাকতে অস্বস্তি লাগছিলো।তার ওপর কি বলবে ইয়াদের বাবা মা কে?ওনারা যদি না মানতে পারেন?এটা নিয়ে যদি ওদের সম্পর্ক খারাপ হয় তাহলে?টেনশনে মাথা কাজ করছে না মধুর।একদিকে নাছোড়বান্দা ইয়াদ অন্যদিকে ওর পরিবার।
মধু চুপচাপ স্বামীর আদেশে ঘরে চলে গেলো।ইয়াদ আসলো একটু পরে।মধু বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো।ইয়াদ বারান্দায় এসে মধুকে এমন উদাস দেখে ওর গা ঘেঁষে দাড়ালো।ইয়াদের উপস্থিতি টের পেয়ে মধু শুকনো মুখে ওর দিকে চাইলে।ইয়াদ ভরসার হাত রাখলো ওর হাতে।বলল,’চিন্তা করো না।আমি তো আছি।’
মধু ম্লান হেসে বলল,’হ্যাঁ,তুমি আছো বলেই তো আমি আছি।তুমি ছাড়া তো আমি নিজেকে কল্পনাও করতে পারি না।তবে জানো খুব চিন্তা হয় আমার!আমার জন্য সবকিছু তছনছ হয়ে যাবে না তো!’
ইয়াদ মধুকে ঘুরিয়ে এনে জড়িয়ে ধরলো।একহাত ওর মাথায় রাখলো।বলল,’কিচ্ছু হবে না।ধৈর্য রাখো।এখনো অনেক কিছু বাকি আমাদের জীবনের।ইনশাআল্লাহ জীবনের শেষ দিন অব্দি তোমার সাথে আছি।তোমার ছায়া তোমাকে ছেড়ে চলে গেলেও আমি যাবো না।নিজেই তোমার ছায়া হয়ে যাবো।’
মধু নিঃশব্দে কাঁদলো।এমন কেনো মানুষটা?এতো ভালোবাসে কেনো?এই মানুষটার জন্যই বোধহয় আরেকবার বাঁচার অনুপাতে পেলো সে।এইজীবনে কয়জনই বা এমন একজন পায়!সেদিক থেকে দেখতে গেলে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়!
ইয়াদ মধুর মুখটা তুলে ধরে চোখের পানি মছু দিয়ে বলল,’কাঁদবে না।নিজে হাসবে,অন্যকে হাসাবে।দেখবে জীবন সুন্দর।এখন যাও শাওয়ার নাও।আমি ইরিনের একটা শাড়ি এনেছি।আপাতত ওটা পরো।আমরা বিকেলে শপিং এ বের হবো।’
ইয়াদ মধুর কপালে একটা গভীর চুমু একে বাহুমুক্ত করলো।মধু শওয়ার নিতে চলে গেলো।
———–
দুপুরে খাবার টেবিলে সবাই আছে।শুধু নিহা আর ইফাজ ছাড়া।ইফাজ এখন টেবিলে খায় না কারণ নিহার সিড়ি দিয়ে নামতে কষ্ট হয়।তাই ওরা নিজেদের ঘরে খায়।আগে ইফাজ হসপিটাল থেকে দুপুরে না আসলেও এখন নিহার জন্য আসতে হচ্ছে।তবে আজ সে আসে নি কারণ দুপুরে একটা অপারেশন আছে ওর।সর্বপরি আদর্শ স্বামী হওয়ার কোনো ত্রুটি রাখে নি ইফাজ।আগের থেকে অনেক বেশি সময় দেয় নিহাকে।এতে নিহা খুশীই বটে!
খাওয়ার টেবিলে পিনপতন নিরবতা।সাইদা খান,ইরিন আর ইয়াফ খান একপাশে বসেছেন।আরেক পাশে মধু আর ইয়াদ।হঠাৎ খাওয়ার মাঝখানেই সাইদা খান বললেন,’আমাদের প্রশ্নের কিন্তু কোনো উত্তর পেলাম না ইয়াদ।’
ইয়াদ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’খাওয়া শেষ হোক।তারপর বলি?’
সাইদা খান কিছু বললেন না।কিন্তু মধুর মাথায় ঢুকছে না ইয়াদ এতো ঘুরাচ্ছে কেনো!
খাওয়া শেষে ইরিন,সাইদা খান,ইয়াফ খান এক সাথে সোফায় বসলেন।সামনাসামনি সোফায় মধু আর ইয়াদ বসল।কোনোরকম ভূমিকা না দিয়েই শুরু থেকে কি কি হয়েছে মধুর সাথে সব বলল।সব শুনে গম্ভীর মুখে সাইদা খান উঠে চলে গেলেন।আর ইয়াফ খান ইয়াদের দিকে চেয়ে বললেন,’বিয়ে করারা আগে এগুলো একবার আমাদের জানানো উচিত ছিলো।’
ইয়াদ তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,’জানালে বোধহয় শুভ কাজটা আমায় সারতে দিতে তোমরা!কবেই ব্ল্যাকমেইল শুরু করে দিতে।’
‘কাজটা ভালো করো নি তুমি।ভবিষ্যতে দেখো যেনো পস্তাতে না হয়।’গম্ভীর স্বরে কথাটা বলেই ইয়াফ খান চলে গেলো।এখন শুধু ইরিন ই বাকি।ইরিন উঠে এসে মধুর পাশে বসে বলল,’কে কি ভাবছে আমি জানি না।আমি শুধু এটুকুই জানি আমার ভাই তোমাকে ভালোবাসে।তুমি ওকে কষ্ট দিও না।আর আমি তোমাকে ভাবি হিসেবে মেনে নিলাম।তুমি আমার ছোটোভাবি।’
ইয়াদ মনে মনে ইরিনের ওপর সন্তুষ্ট হলো।যাক একজন মানুষ অন্তত ওকে বুঝেছে।
————
দুপুরের সময়টা অনেকেই ডিউটিতে থাকে আবার অনেকেই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে আর যাদের কাজ থাকে না তারা অভ্যাস মতো একটা ভাতঘুম দিয়ে নেয়।কিন্তু যদের অভ্যাস নেই ভাতঘুমের আবার কাজও নেই তাদের কাছে সময়টা বোরিং মনে হয়।এই দলে মধুও আছে।আগে যখন ভার্সিটিতে ক্লাস থাকতো,টিউশনি করতে হতো তখন ঘুমানো তো দূরে থাক শান্তিতে একদণ্ড বসারও সুযোগ পেতো না।আর আজ না ক্লাস,না টিউশনি,না ঘুম কিচ্ছু নেই।মধু উদাস হয়ে খাটের ওপর বসে আছে।আর ইয়াদ ল্যাপটপে দেখছে কোন জায়গাটা ভালো হবে।এক সপ্তাহ কি এমনিতেই কাটিয়ে দেবে নাকি?এই একসপ্তাহে ‘মধু উইথ মধুচন্দ্রিমায়’ যাওয়ার প্ল্যান আছে।ইয়াদ কয়েকটা জায়গা সিলেক্ট করে মধুকে দেখালো।মধু সবগুলোই দেখলো।সবগুলোই সুন্দর।তাছাড়া এইসব জায়গা গুলো ছবিতেই দেখেছে মধু।যাওয়ার আর ভাগ্য হয় নি।
দুজনে মিলে পরিকল্পনা করলো ওরা মেঘের শহর সাজেক যাবে।অবশ্য দুজনের পরিকল্পনা বলা ভুল!এটা মধুরই পরিকল্পনা।কারণ লোকমুখে সাজেকে এমন রসালো বর্ণনা শুনে সেখানেই যাওয়ার ইচ্ছে আছে।ইয়াদ অবশ্য এর আগেও কয়েকবার গিয়েছে।তবে তখন সিঙ্গেল ছিলো বউ ছিলো না।এবার বউ আছে।দেখা যাক বউয়ের সাথে মেঘের শহর কেমন লাগে।তাই আর মধুর কথায় দ্বিমত করলো না।হঠাৎ ইয়াদ মধুকে ডেকে বলল,’আচ্ছা তুমি আমার ওপর রেগে নেই তো?’
‘কেনো?’মধু অবাক হয়ে বলল।
‘এই যে আমার এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেছে কিন্তু আমি তোমাকে বলি নি।’
‘না রাগ লাগে নি কারণ তোমাকে বাধ্য করা হয়েছিলো।আর এমনিতেও এখন রাগ করলে কি সব কিছু ঠিক হবে?তবে শুধু শুধু রাগ করবো কেনো?’
ইয়াদ মধুর দিকে চেয়ে প্রসন্ন হাসলো।সম্পর্কে স্পষ্টতা থাকা ভালো এতে সম্পর্ক সুন্দর হয়।
দুজনের একজনও দুপুরে ঘুমায় নি।জায়গা সিলেক্ট করতে করতে আর রিসোর্ট বুকিং দিতেই সময় শেষ।তারপর বিকেলে দুজনে বের হলো।বের হওয়ার সময় ইয়াদ সাইদা খানকে বলতে এসেছিলেন কিন্তু সাইদা খান ইয়াদের কথা না শুনে রুমের দরজা আটকে দিলো।বিষয়টা মধু ইয়াদ দুজনেই লক্ষ করলো। মধুর খারাপ লাগলো বিষয়টা।ইয়াদেরও খারাপ লেগেছে কিন্তু ও বুঝতে দেয় নি বিষয়টা।বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিলো।রিকশায় উঠে মধু চুপচাপ বসে রইলো।কোনোকথা নেই।ইয়াদ নিজেই নিরবতা ভেঙে বলল,’মধু মন খারাপ করো না।ওনারা এখন একটু রেগে আছেন কিন্তু পরে ঠিক হয়ে যাবে।’
মধু কিছু বলল না।কেবল ইয়াদের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো।কি হওয়ার ছিলো আর কি হয়ে গেলো!যে মানুষগুলো একটা সময় এতো ভালোবাসতো তারা এখন ঘৃণা করে।একটা দুর্ঘটনা যেনো সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।যেখানে ওর কোনো দোষই নেই সেখানে সমাজ কিন্তু ওকেই দোষী বানাচ্ছে।আর যারা এগুলো করছে তারা সমাজে দিব্যি মাথা উঁচু করে হাঁটছে।এদের কি শাস্তি হবে না?
চলবে….
#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪৬
#Arshi_Ayat
ফুটপাত ধরে ইয়াদ আর মধু দু’জনেই হাটছে।দুজনের হাতেই শপিং ব্যাগ।শপিং শেষে ইয়াদ বলল ফুচকা খাবে।মধু না করে নি।অবশ্য না করার কোনো বিষয়ই নেই।অনেকদিন ধরে ফুচকা খাওয়া হয় না।প্রায় তিন বছর।এর আগে যখন ইয়াদ ছিলো সপ্তাহে প্রতিদিনই খাওয়া হতো।অনেকদিন পর পুরোনো স্মৃতি গুলো ভেসে উঠলো।সে সময়টা তারা প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলো আর সময়ের সাথে সাথে সম্পর্ক পাল্টে আজ ওরা স্বামী-স্ত্রী!সম্পর্কটা পূর্ণতা পেলো।মধু আনমনেই হাসলো।ইয়াদ মধুর হাসি লক্ষ করে বলল,’হাসছো যে?’
মধু হাসিটা বজায় রেখে বলল,’পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে।’
ইয়াদও হাসলো।বলল,’হ্যাঁ সময়গুলো মনে পড়ে খুব।তবে এখন থেকে মাঝেমধ্যেই বিকেলে আমরা বের হবো।ফিরে যাবো আমাদের সময়ে।’
টুকটাক কথা আর স্মৃতিচারণ করতে করতেই ওরা ফুচকার দোকানের সামনে পৌঁছে গেলো।এখন তেমন ভিড় নেই।এইদিকটায় বিকেলে প্রচন্ড ভিড় হয়।বেশিরভাগ প্রেমিকযুগল বিকেলে এখানে আসে।তিন বছর আগে ওরাও আসতো।আগে এখানে শুধু চটপটি আর ফুচকা বিক্রি হতো কিন্তু এখন তার সাথে ঝালমুড়ি,বিভিন্ন রকমের আচার,রোল,গ্রীল এগুলোও বিক্রি হয়।
ইয়াদ মধুকে জিগ্যেস করলো,’ফুচকা?চটপটি?নাকি ঝালমুড়ি?’
মধু দুষ্টু হেসে বলল,’তিনটাই।’
ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে বলল,’পেট খারাপ করবে কিন্তু!’
‘করবে না।তুমি কি খাবে?
‘আমি শুধু ফুচকা।’
ইয়াদ অর্ডার দিয়ে দিলো।হঠাৎ একটা মেয়ে এসে ইয়াদকে সালাম দিয়ে বলল,’আরে স্যার আপনি এখানে?’
ইয়াদ অবাক হলেও প্রকাশ করলো না।সালামের উত্তর দিয়ে বলল,’এইতো বেড়াতে বের হলাম।’
‘স্যার আমি ফারিয়া।২য় বর্ষের বোটানি ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট।’
ইয়াদ বোটানি ডিপার্টমেন্টে ক্লাস নিলেও স্টুডেন্ট দু একজন ছাড়া আর কাউকেই তেমন চেনে না।তাই বলার মতো কিছু না পেয়ে বলল,’ওহ!’
কিন্তু ফারিয়া এমন জাবাবে মোটেও নিরুৎসাহিত হলো না।আবার আলাপ জমাবার জন্য বলল,’তো স্যার আপনি কি একা এসেছেন?’
‘না।তোমার ম্যাম ও আছেন সাথে।’এটা বলেই ইয়াদ কিছুটা দূরে অবস্থানরত মধুকে দেখালো।আসলে মেয়েটা যখন এসে আলাপ জমাতে চেষ্টা করলো তখনই মধু একটু সটকে গেলো।তারপর মজা নেওয়া শুরু করলো।
ফারিয়া মধুর দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটাকে সে চেনে।ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট।ফারিয়ার বোনও ফাইনাল ইয়ারে পড়ে তো বোনের ক্লাসে আসা যাওয়া করতে করতে কয়েকবার চেহারাটা দেখেছিলো।এই মেয়ে ইয়াদ স্যারের বউ এটা যেনো ফারিয়ার মানতে কষ্ট হচ্ছিলো।ফারিয়া কৌতুহলী গলায় ইয়াদকে বলল,’স্যার আপনি বিয়ে করলেন কবে?’
‘কালকে।বাদ মাগরিব।আসলে বিয়েটা ঘরোয়া হওয়ায় কাউকে জানানোর সুযোগ হয় নি।’
ফারিয়ার মুখটা চুপসে গেলো।শুকনো মুখে বলল,’ও।’
ইয়াদ কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে মধুকে ডাকলো।তারপর ফারিয়াকে দেখিয়ে বলল,’ও আমার স্টুডেন্ট ফারিয়া।’
মধু ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসলো।ফারিয়াও কোনমতে সালাম দিয়ে ইয়াদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।ফারিয়া চলে যাওয়ার পর মধু মুখ ঢেকে হাসা শুরু করলো।ইয়াদ অবাক হয়ে বলল,’হাসছো কেনো?’
মধু হাসতে হাসতেই বলল,’তুমি মেয়েটার মনটাই ভেঙে দিলে।ইশ বেচারি!’
‘হ্যাঁ।এইরকম দু’চারটা মন ভাঙবেই।ওদের মন রাখতে গিয়ে আমি তোমাকে হারাতে পারবো না।’ইয়াদ ঠোঁট বাকিয়ে বলল।
‘আচ্ছা তাই।’এটা বলে মধু আবার হাসতে লাগলো।
আর ইয়াদ কৃত্রিম রাগের ভান করে বলল,’তুমি কি মধু?অন্য মেয়েদের দেখি তাদের স্বামীর সাথে কথা বলুক তো দূরের কথা তাকালেও জেলাস ফিল করে।আর তুমি দূরে দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছিলে।’
‘হ্যাঁ তো কি করবো?’
‘তোমার কি জেলাস ফিল হয় না আমায় নিয়ে?’ইয়াদ অভিমানী কন্ঠে বলল।
‘না হয় না।বিশ্বাস করি আমি তোমাকে।আমি আমাদের ভালোবাসাকে বিশ্বাস করি,আমাদের সম্পর্কটাকে বিশ্বাস করি।তুমি যদি আমার হও তাহলে কেউ তোমাকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না,আর যদি আমারই না হয় তাহলে আমি তোমাকে শত চেষ্টা করেও ছিনিয়ে আনতে পারবো না।’
ইয়াদ তৃপ্তির হাসি হাসলো।বিশ্বাস এমনই হওয়া উচিত।সম্পর্কে ভালোবাসার থেকেও বিশ্বাস জরুরী।
দোকানদার অর্ডারমতো সব খাবার দিয়ে দিলো।ইয়াদের সাথে প্রথমে ফুচকা শেষ করলো মধু।তারপর চটপটি খাওয়া শুরু করলো।মাঝেমধ্যে ইয়াদকেও শেয়ার দিলো।তারপর খাওয়া দাওয়া শেষে সেখান থেকে রিকশা নিলো।ইয়াদ রিকশার হুড নামিয়ে দিলো।বাতাসে মধুর সামনের ছোটচুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।মধু বিরক্ত হয়ে সরিয়ে দিতে নিলে ইয়াদ বাঁধা দিয়ে বলল,’প্রেমিকার এই অবাধ্য চুলগুলো সরিয়ে দেওয়া একমাত্র অধিকার শুধু প্রেমিকের।’
মধু কিছু বলল না।ঠোঁট কামড়ে হাসলো।
বাসায় ফিরে ড্রয়িং রুমে দেখলো কেউ নেই।কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দিয়েছে।আগে সবসময় সাইদা খান দরজা খুলতেন কিন্তু আজ!ইয়াদের খারাপ লাগলেও প্রকাশ করলো না কারণ পাছে মধু যদি মন খারাপ করে!যদি ভাবে ওর জন্য এসব হচ্ছে!তাই ইয়াদ নিজেকে স্বাভাবিক রেখে মধুকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।এদিকে সাইদা খান দরজার ফাক দিয়ে ছেলেকে দেখেছেন।কষ্টের কোনো লক্ষণই নেই।ভালোই আছে ছেলে!এই মেয়েটাকে পাওয়ার পর ছেলেটা বদলে গেছে ভেবে সাইদা রহমান দুঃখ পেলেন।
———–
ইফাজ বাসায় এসে সাইদা খানের কাছে সব শুনেছে।সব শুনে মা’কে বুঝিয়েছে কিন্তু কোনো লাভ হয় নি।সাইদা খান অবুঝ!তাই ইফাজ আর ব্যাক ব্যয় না করে ঘরে চলে গেলো।ঘরে এসে দেখলো নিহা শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে।ইফাজকে দেখে বই বন্ধ করে উঠতে নিলেই ইফাজ বলল,’উঠছো কেনো?পড়ো।সমস্যা নেই।আর তোমাকে না বললাম এই সময়টা বেশি নড়াচড়া করা ঠিক না।’
নিহা প্রসন্ন হেসে বলল,’আচ্ছা ডাক্তার সাহেব করবো না।এবার যাও ফ্রেশ হও।’
ইফাজ ফ্রেশ হয়ে এসে বলল,’নিহা আমি একটু ইয়াদের সাথে কথা বলতে যাচ্ছি।আধঘন্টার মধ্যে চলে আসবো।তোমার কিছু লাগলে ডাক দিয়ো বা ফোন দিও।’
‘আচ্ছা।’
ইফাজ চলে যাওয়ার পর নিহা আবারও বইয়ে মনোযোগ দিলো।
মধু মায়ের সাথে কথা বলছিলো আর ইয়াদ ল্যাপটপে কাজ করছিলো।ইফাজ দরজায় নক করলো।ইয়াদ একটু হেসে বলল,’আসো ভাইয়া।’
ইফাজ ঘরে ঢুকলো।শুধু ইফাজ ছাড়া এমন করে দরজা কেউ নক করে না।সবাই হুটহাট ঢুকে যায়।বলা যায় অনেক ভদ্র স্বভাবের একজন।এই ম্যানারস গুলোর জন্যও বাইরে যখন পড়তো তখন অনেক মেয়েই প্রোপজাল দিতো কিন্তু ইফাজ তাদের ভদ্র ভাবেই ফিরিয়ে দিতো।
ঘরে ঢুকেই প্রথমে চোখ পড়লো মধুর দিকে।একনজর দেখেই ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,’কেমন আছিস রে?’
‘এইতো ভালো।হাসপাতাল থেকে আসলে কখন?’
‘দশ/পনেরো মিনিট হবে।আচ্ছা শোন একটু আসতে পারবি তোর সাথে একটু কথা আছে।’
ইয়াদ মধুর দিকে ইশারা করে ভাইয়ের সাথে বেরিয়ে গেলো।
————–
ছাঁদের দরজা লক তিনটা চেয়ারে তিনজন বসে আছে।নিখিল,ইফাজ আর ইয়াদ।সাইদা খানের কাছে সবটা শোনার পর ইফাজের মাথা আগুন ধরে গিয়েছিলো,শরীরের প্রত্যেকটা শিরা উপশিরা বিদ্রোহ করে বলল নাহ!এতো সহজে তো ওই নরপশুগুলো ছাড়া পেতে পারে না।তাই তখনই নিখিল কে ফোন করে আসতে বলেছিলো।
এখন এই আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে কিভাবে ওদের ধরা যায়।নিখিল ইয়াদকে জিগ্যেস করলো,’আচ্ছা তোমার ওয়াইফের কি ওদের কারো চেহারা মনে আছে?’
‘না,আমি ওকে জিগ্যেস করেছিলাম কিন্তু ও বলল মনে নেই।’
‘তাহলে কোনো ক্লু অথবা কোনো কিছু যেটা দিয়ে আমরা ওদের ধরতে পারবো।’
ইয়াদ মাথা চুলকে বলল,’ও বলেছিলো ওর কাছে একটা বন্ধ ফোন আছে।আর ওই ফোনটা ওদের মধ্যেই কারো।’
ইফাজ উত্তেজিত কন্ঠে বলল,’গ্রেট।এখন এইমুহুর্তে আছে ওটা?’
‘না বোধহয়।কারণ ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসার সময় ও কিছুই আনে নি।’
নিখিল বলল,’ওটা কুইক নিয়ে আসার চেষ্টা করো।ওটা দ্বারাই ওদের ধরা সম্ভব।’
‘আচ্ছা আমরা কাল যাবো।’ইয়াদ বলল।
তারপর আলোচনা আরো কিছুক্ষণ চলার পর নিখিল বিদায় নিলো।আর ইয়াদ রুমে আসলো।মধু শুয়ে পড়েছে।হঠাৎ করেই ওর মাথা ব্যাথা উঠেছে।ইয়াদ ভেবেছিলো ওকে সব বলবে কিন্তু ওর মাথাব্যথা দেখে আর বলে নি।লাইট বন্ধ করে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে মধুর মাথাটা নিজের কোলের ওপর নিয়ে মাথা টিপে দিতে লাগলো।মধু মৃদু স্বরে বলল,’তুমি শুয়ে পড়ো।মাথা টেপা লাগবে না।’
‘চুপ করে ঘুমাও।’ইয়াদ শাসনের স্বরে বলল।
স্বামীর মিষ্টি শাসন মেনে মধু আর কিছু বলল না।আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো।একসময় ইয়াদেরও ঘুম পেয়ে গেলো।ও মধুকে বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুমিয়ে গেলো।
ইরিন খাওয়ার সময় ডাকতে এসে দেখলো ইয়াদের রুমের দরজা বন্ধ।কয়েকবার ডাকার পর ইয়াদ ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে দরজা খুললো।ইরিন বলল,’ভাইয়া খাবে না?’
‘না রে।মধুর মাথাব্যথা।ও ঘুমিয়ে গেছে।আর আমারও খেতে ইচ্ছে করছে না তুই একটু মাথাব্যথার বামটা নিয়ে আয়।’
‘আচ্ছা।আনছি।’
ইরিন বাম এনে দিলো।বামটা নিয়ে ইয়াদ আবার দরজা বন্ধ করে দিলো।বিছানায় ফিরে ঘুমন্ত মধুর ঠোঁটে আলতো একটা চুমু দিয়ে কপালে বামটা লাগিয়ে ওকে আবার পূর্বের মতো জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো।
চলবে……
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)