ডুবে ডুবে ভালোবাসি পর্ব-৪৩+৪৪

0
2638

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪৩
#Arshi_Ayat

এখন দুপুর।মধু আর আইরিন রহমান রান্না করছেন রসুইঘরে।আর মিলি টিউশনি করাতে গেছে।মধুও প্রতিদিন দু’টো টিউশনি পড়ায় দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত।

আর এদিকে ইয়াদ ঘুরে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেছে।অবশ্য কালরাত থেকে একফোঁটাও ঘুমায় নি তাই তো একটু আরামের ছোয়া পেতেই দুচোখ জুড়ে নেমে এলো ঘুম।

রান্না প্রায় হয়ে গেছে।তাই আইরিন রহমান মধুকে বললেন,’তুই আগে গিয়ে গোসল করে নে।তুই বের হলে আমি যাবো।আর দেখ তো ইয়াদ কি করে?’

‘আচ্ছা।’মধু মায়ের কথার উত্তরে সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে রসুইঘর থেকে ঘরে এলো।ঘরে এসে বিছানার ওপর চোখ যেতেই দেখলো ইয়াদ ঘুমাচ্ছে।
মধু সাবধানী পায়ে বিছানার সামনে এসে হাটু গেড়ে বসলো।নিজের আচল দিয়ে সস্নেহে ওর কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামটা মুছে দিয়ে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।তারপর একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলে জামা কাপড় নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
————-
মধু গোসল করে এসে দেখলো ইয়াদ এখনো ঘুমাচ্ছে।ভেজা চুল মুছতে মুছতে বিছানার সামনে এসে ইষৎ জোর গলায় ইয়াদকে ডাক দিলো,’এই যে শুনছেন?উঠুন।’

ইয়াদ একটু নড়েচড়ে উঠে আবার ঘুমিয়ে গেলো।মধুর মুখে অজান্তেই মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।ভেজা চুলে তোয়ালে পেচিয়ে মাথায় খোপা করে নিলো তারপর ইয়াদের দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে মৃদুস্বরে বলল,’উঠুন না!’

বলা বাহুল্য মধুর কথা শেষ হতেই ইয়াদ আচমকা চোখ মেললো।আচমকা এমন হওয়ায় মধু লজ্জায় পড়ে গেলো।তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ালো।বলল,’দুপুর হয়ে গেছে।হাত মুখ ধুয়ে আসুন।খাবার দিচ্ছি।’

‘আচ্ছা।তুমিও আসো।’

মধু মাথা নেড়ে রসুইঘরে চলে গেলো।আর ইয়াদ হাত মুখ ধুতে গেলো।হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখলো মধু মেঝে তে শীতলপাটি বিছিয়ে ভাত তরকারি সাজাচ্ছে।ইয়াদ পাটির একসাইডে সুন্দর করে বসে পড়লো।সবসময় চেয়ার টেবিলে খেলেও এভাবে খাওয়ারও অভ্যাস আছে ইয়াদের।মধু ইয়াদের পাশে বসে ওকে সবকিছু বেড়ে দিলো।কিন্তু নিজে নিলো না।ইয়াদ বিষয়টা লক্ষ করে বলল,’ডায়েটে আছো নাকি?’

‘না তো।’মধুর সরল জবাব।

‘তাহলে খাচ্ছো না কেনো?’

‘আমি পরে খাবো।আম্মুর সাথে।’

‘হ্যাঁ তো আন্টি,মিলি ওদের ও ডাকো।একসাথেই খাই।’

‘মিলি পড়াতে গেছে।আরো পরে ফিরবে।আর আম্মু গোসলে গেছে।’

‘তাহলে পরেই খাবার দিতে।আচ্ছা ঢেকে রাখো।পরে একসাথে খাবো সবাই।’

এটা বলে ইয়াদ উঠে যেতে নিলেই মধু বাঁধা দিলো।বলল,’আচ্ছা আমিও খাচ্ছি আপনার সাথে।আম্মু আর মিলি পরে খাবে।’

মধুর কথায় ইয়াদ আর উঠলো।অগত্যা মধুও নিজের জন্য খাবার বাড়লো।সত্যিকার অর্থে খেতে ইচ্ছে করছিলো না মধুর কিন্তু এখন ও না খেলেও ইয়াদও খাবে না তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেতে হবে।খাওয়া শেষ করে মধু সবকিছু ঘুছিয়ে রেখে ঘরে এসে বিছানায় বসলো।একদম ইয়াদের সামনাসামনি।ইয়াদ ওর মুখভঙ্গি দেখেই বুঝে ফেললো মহারাণী সিরিয়াস কিছু বলবেন।আর সেটা যে বিয়ের ব্যাপারে ওটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।ইয়াদ ভেতরে ভেতরে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো।

মধু কিছুক্ষণ চুপ থেকে।গম্ভীর কন্ঠে বলল,’ইয়াদ বাচ্চামি ভালো লাগে না।আপনি চলে যান।আপনি যেটা চাইছেন সেটা হওয়ার নয়।’

‘কেনো হওয়ার নয় এটা ১০০ শব্দে এক্সপ্লেইন করো।’

ইয়াদের গলা শুনেই বোঝা গেছে ও মোটেও সিরিয়াস নয়।মধু তীক্ষ্ণ ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,’আ’ম সিরিয়াস।’

‘আ’ম অলসো সিরিয়াস।তুমি বলতে থাকো।’

কোন লেভেলের সিরিয়াস এটা ইয়াদের কথা দ্বারা স্পষ্ট।এভাবে বলে লাভ হবে না খুব ভালো করে বুঝে গেলো মধু।তাই উঠে চলে যেতে নিলেই ইয়াদ ওর হাত ধরে ফেলল।বলল,’বসো না!’

মধু কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’হাত ছাড়ুন।’

‘ছাড়বো না তুমি বসো।’

মধু বসলো।ইয়াদ ওর একটু কাছে এসে বসলো।তারপর বলল,’এবার বলো।’

মধু বোঝানোর ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলো,’দেখুন বিয়ে এক দুই দিনের সম্পর্ক না।এটা সারাজীবনের সম্পর্ক।তাই এটাতে হেয়ালী চলে না।আমি আপনাকে ভালোবাসি ঠিকই কিন্তু আমি চাই না আমাদের বিয়ে হোক।আমি চাই আপনি ভালো থাকুন।আপনার সুন্দর একটা সংসার হোক।কিউট কিউট বাচ্চা হোক।যাদের আপনি আদর করবেন।কিন্তু যদি আপনি আমাকে বিয়ে করেন তাহলে বাচ্চা হওয়া তো দূরে থাক আপনি শান্তিও পাবেন না।আমার গায়ে যে কলঙ্কের দাগ লেগেছে এটা নিয়ে অনেক কটুক্তি হজম করতে হবে।একটা সময় এটা নিয়ে আপনি বিরক্ত বোধ করবেন। আমাদের মাঝে ভালোবাসাটা আর বিদ্যমান থাকবে না।তাই প্লিজ আমার শেষ অনুরোধ টা রাখুন।’শেষ কথাটা মধু মরিয়া হয়ে বলল।

ইয়াদ এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনলো তারপর বলল,’এতক্ষণ তুমি বলেছ আমি শুনেছি এখন আমি বলবো তুমি শুনবে আর এর মাঝে বামহাত ঢুকাবে না।আমার বলা শেষ হলে তোমার যা বলার বলবে।’

মধু ঘাড় নেড়ে সায় দিলো।এবার ইয়াদ বলতে শুরু করলো,’একটা কথা শুনেছো হয়তো প্রবাদ বাক্য তবুও আরেকবার শোনো ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে,তব ঘৃণা তারে তৃণসম দহে।’এটার মানে হলো তুমি যদি অন্যায়কে প্রশ্রয় দাও তাহলে মানুষও তোমাকে ঘৃণা করবে।চুপচাপ সয়ে না গিয়ে প্রতিবাদ করো!কিছু না হোক নিজের কাছে অপরাধী হবে না।সারাজীবন মানুষের কাছে ঘৃণিত হয়ে থাকতে চাও?
তারপর আসো তোমার সাথে যা হয়েছে তা নিয়ে।এটা একটা এক্সিডেন্ট।ধরো,তোমার সাথে এমন কিছু ঘটলো না কিন্তু আমার সাথে ঘটলো।আমি এক্সিডেন্ট করলাম এবং সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেলাম।সবসময় আমাকে হুইল চেয়ারে কাটাতে হবে।এখন বলো তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে?

মধু ঘাড় নেড়ে না বলল।ইয়াদ মৃদু হেসে বলল,’তাহলে আমি কেনো যাবো?তারপর আসে বাচ্চা!এমন অনেক পরিবার আছে যাদের বাচ্চা হয় না।তারা আশ্রম থেকে বাচ্চা এডপ্ট করে।কয়টা বাচ্চা লাগবে তোমার?তিনটা?চারটা?ছয়টা?
তাহলে বাঁধা কোথায়?ও হ্যাঁ বাধা হলো মানুষের কথায়।শোনো আল্লাহ ওদের মুখ দিয়েছে বলার জন্য,আর আমাদের মুখ দিয়েছে উচিত জবাব দেওয়ার জন্য।এই তো সব সমস্যার সমাধান দিয়ে দিলাম।এবার বলো আর কোনো সমস্যা আছে তোমার?’

‘কিন্তু আপনার বাবা মা তো মানবে না।’

‘না মানলে মানাবো।সিম্পল!’

‘যদি তাও না মানে?’

‘এই তুমি শুধু নেগেটিভ ভাবো কেনো?পজিটিভ ভাবো!’ইয়াদ ধমকে বলল।

ইয়াদের ধমক খেয়ে মধু চুপ।এরইমধ্যে রাসেলও চলে এলো।হাতে তিনটা শপিং ব্যাগ।ঘরে এসে ব্যাগগুলো টেবিলের ওপর রেখে চেয়ার টেনে বসলো।তারপর মধুকে বলল,’ভাবী একগ্লাস পানি দিয়েন।’

মধু উঠে গেলো পানি আনতে।মধু যাওয়ার পরই রাসলে বলল,’কি কথা বলছিলি রে তোরা?’

‘ওর ক্লাস নিয়েছি এতক্ষণ।’

‘মানে?’

‘মানে সে বিভিন্ন রকম বাহানা দিয়ে বিয়ে করতে চাইছে না।তো সেটা নিয়েই দীর্ঘ বয়ান দিলাম।’

‘তো এখন মতিগতি কেমন মনে হয়?’

‘বুঝতে পারছি না।দেখা যাক।আচ্ছা যা বলেছিলাম করেছিস?’

‘হ্যাঁ কাজিকে ঠিকানা দিয়ে এসেছি।’

‘হ্যাঁ।দিয়ে আসলাম।

‘আচ্ছা শোন আরেকটা কাজ করতে হবে।’

‘কি কাজ?’

‘বাজারে গিয়ে ৮/৯ কেজি মিষ্টি নিয়ে আয়।’
ওদের কথার মধ্যেই মধু চলে এলো পানি নিয়ে।রাসেল পানি পান করে আবার বের হলো।
—————
সন্ধ্যা হতে বেশি দেরি নেই।ইয়াদ মধুকে ডেকে বলল,’যাও রেডি হয়ে নাও।একটু পরই কাজি চলে আসবে।’
মধু বিনাবাক্যে শাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো।এখন এছাড়া উপায়ও নেই।

মাগরিবের নামাজের পর কাজি এলো।আইরিন রহমান আর মিলি মধুকে রেডি করে নিয়ে আসলো।ইয়াদ আগে থেকেই রেডি ছিলো।তারপর বিয়ে পড়ানো শুরু হলো।প্রথমে কাজি মধুকে কবুল বলতে বলল।কিন্তু মধু বলল না।চুপচাপ রইলো।পাশ থেকে ইয়াদ ফিসফিস করে বলল,’তাড়াতাড়ি কবুল বলো মধু।’

মধু তারপরও বলল না।সবাই বলছে ওকে কবুল বলতে কিন্তু তবুও বলছে না।এবার ইয়াদ রেগে উঠে যেতে নিলেই মধু ওর হাত ধরে ফেললো।ধীর গলায় বলল,’কবুল,কবুল,কবুল।’

এরপর ইয়াদ কবুল বলার পর সবাই মিলে আলহামদুলিল্লাহ পড়লো।

বিয়েটা হয়েই গেলো।ইয়াদ কাজিকে সম্মানী দিয়ে বিদায় করলো। আইরিন রহমান আর মিলি মিলে আশেপাশের ঘরে মিষ্টি দিতে গেলো।রাসেল এক উছিলায় বাইরে চলে গেলো।ঘরে শুধু ইয়াদ আর মধুই আছে।মধু খাটের একপাশে চুপটি করে বসে ছিলো।ইয়াদও গিয়ে ওর পাশে বসলো।ওয়ালেট থেকে সেই রিং টা বের করলো যেটা মধু ফিরিয়ে দিয়েছিলো।রিংটা মধুর বা হাতের অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিয়ে বলল,’আর কখনো এটা খোলার সাহস করবে না।’
এটা বলেই জড়িয়ে ধরলো।মধুও ভালো মেয়ের মতো ইয়াদের বুকে মাথা রাখলো।
————
ইয়াদ ঘুমিয়ে গেছে।শুয়েছিলো একসাথেই কিন্তু ইয়াদ আগে ঘুমিয়ে গেছে এদিকে মধুর চোখে একফোঁটাও ঘুম নেই।এটা আর এমন কি!প্রতিটা রাতই এমন নির্ঘুমে কাটে মধুর।

খুব সাবধানে ইয়াদের পাশ থেকে উঠে পড়লো মধু।শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না।ঘুম না আসলে শুয়ে থাকতে ভালো লাগে না মধুর।আস্তে আস্তে হেটে গিয়ে দরজা খুলে বাইরে চলে এলো মধু।বাড়ির পেছনে একটা মাটির রাস্তা আছে।কখনো মন খারাপ হলে মধু এই রাস্তা ধরে হাটে।আজও ধীর পায়ে হাটা শুরু করলো।চারপাশে চাদের আলো থৈথৈ করছে।গাছের পাতায় চিরুনির মতো বাতাস বয়ে যাচ্ছে।ভরা জ্যোৎস্নায় হাটলে কেমন ঘোর লাগে।হাঁটতে হাঁটতে মধু ঘাটে চলে এলো।এই ঘাট’টা বাঁধাই করা।পা চুবিয়ে বসা যায়।মধু ঘাট কিনারায় বসে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত চুবিয়ে বসলো।হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চমকে পাশে তাকাতেই দেখলো ইয়াদ বসে আছে।মধু বিষ্মিত হয়ে বলল,’আপনি!আপনি না ঘুমিয়ে ছিলেন।’

‘হ্যাঁ কিন্তু বউ ছাড়া বেশিক্ষণ ঘুমানো যায় না।’

‘আপনি না আসলেই পারতেন।’

‘না আসলে যদি আবার পালিয়ে যাও!’

‘পালাতে পারলাম কোথায়!নিজের সাথে তো বেঁধেই নিলেন।’

‘কি করবো বলো তোমাকে ছাড়া তো আমার চলেই না।’

মধু কিছু বলল না।হাসলো শুধু।কিছুক্ষণ দুজনেই নিরব রইলো।তারপর নিরবতা ভেঙে মধুই বলল,’আচ্ছা আমি যদি মরে যাই তাহলে আপনি কি করবেন?’

‘কি আর করবো।এখন যা করছি তাই করবো।’

‘আর বিয়ে করবেন না?’

‘এক বউ থাকতে আবার কেনো বিয়ে করবো?’

‘আরে আমি মারা যাওয়ার পরের কথা বলেছি।’

‘আমিও তো তাই বললাম।তুমি মরে গেলেও আমারই থাকবে।তাই তোমাকে রেখে আরেকজনকে কিভাবে বিয়ে করবো আমি?’

ইয়াদের কথায় মধু হাসলো।তৃপ্তির হাসি!আনন্দের হাসি!মদু ইয়াদের কাঁধে মাথা রেখে চাদের দিকে তাকালো।চাঁদ’টা সুন্দর লাগছে!ভিষণ সুন্দর!কি জানি হয়তো প্রিয় মানুষ সাথে থাকলে সবই সুন্দর লাগে।

চলবে….

#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪৪
#Arshi_Ayat

আশেপাশে মৃদু বাতাস,চারপাশে চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে।গভীর রাতে একজোড়া কপত কপোত-কপোতী জোৎস্না বিলাস করছে।কারো মুখেই কথা নেই।দুজনেই সময়টা উপভোগ করছে।দুজনেই চাইছে সময়টা এখানেই থমকে যাক।কিন্তু সময় ও নদীর স্রোত তো কাহারো জন্য অপেক্ষা করে না!

মধু ইয়াদের কাঁধে মাথা রেখে পা দিয়ে পানি নাড়ছে আর গুনগুন করছে।ইয়াদ মধুর গুনগুন শুনে বলল,’একা একা গুনগুন না করে আমাকেও একটু শোনাও।’

মন ভালো থাকায় মধু অনুরোধটা রাখলো।গুনগুন করে যে গান টা গাইছিলো সেটাই গাইতে শুরু করলো।আগে যখনই মধু ইয়াদকে মিস করতো তখনই এটা শুনতো।

“”একলা হলেই বুঝতে পারি ভালোবাসি কত
আমি একলা হলেই বুঝতে পারি ভালোবাসি কত
একটা তুমি আছো বলে ভালো আছি এতো।।
এই জীবনে কেউতো আর হয়না তোমার মতো
একটা তুমি আছো বলে ভালো আছি এতো।।

দূরে গেলে তোমার প্রতি মায়া বাড়ে আরো
কেমন করে এমন প্রেমে বাধতে আমায় পারো।।
দিনগুলো সব তোমার নামে হোক না আমার গত
একটা তুমি আছো বলে ভালো আছি এতো।।

ইয়াদ মন দিয়ে গান শুনছিলো।আসলেই তো তার জীবনে একটা আছে বলেই তো সে এতো ভালো আছে।ইয়াদ মুগ্ধ হয়ে বলল,’এতো ভালো গাইতে পারো জানা ছিলো না।’

নিজের প্রশংসা শুনে মধু কিছু বলল না।শুধু হাসলো।তবে ইয়াদও ওর বলার অপেক্ষায় রইলো না।নিজেই আবার বলল,’আচ্ছা মধু বিয়ে তো হয়ে গেলো এখন হানিমুনটা বাকি আছে।কোথায় যাওয়া যায় বলো তো?’

‘কোথাও যাওয়া লাগবে না।’

‘তাহলে কি তুমি রুমেই হানিমুন সেরে ফেলতে চাচ্ছো?’

মধু কপট রেগে বলল,’আপনি এতো অসভ্য কবে থেকে হলেন বলেন তো?’

‘ও আচ্ছা অসভ্য হয়ে গেছি!তুমি না বললে জানতামই না।আর বিয়ের পর ছেলেরা একটু আট্টু অসভ্য হয় ই।এটা কোনো ব্যাপার না।আচ্ছা বলো না কোথায় যাওয়া যায়?’

‘এমন ভাবে জিগ্যেস করছেন মনে হচ্ছে এর আগেও আমি ৩/৪ বার হানিমুনে গিয়েছি।আপনার যেমন আইডিয়া নেই আমারও তেমন আইডিয়া নেই।’

‘হ্যাঁ তাও ঠিক।আচ্ছা গুগল করে দেখবো কোন জায়গাটা সুন্দর,নিরিবিলি একদম মনের মতো।’

‘আচ্ছা দেইখেন।এখন বাসায় চলেন।ঘুমাবেন না?’

‘তুমি যাবে না?’

‘যাবো তো।’

‘তবে চলো।’

ইয়াদ আর মধু যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো এমন সময়ে শাড়ির সাথে পা বেঁধে পানিতে পড়ে যেতে নিলেই ইয়াদ দ্রুত ধরে ফেললো।আর এদিকে মধু তো ভয়ে চোখমুখ খিচিয়ে ফেলেছিলো।তারপর আস্তে আস্তে চোখ খুলতেই দেখলো ইয়াদ ওর হাত ধরে রেখেছে।এটা দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলো কিন্তু ইয়াদ ওকে ওভাবেই ধরে রাখলো।উঠাচ্ছে না!

মধু ভ্রু কুঁচকে বলল,’কি হলো উঠান আমাকে।’

মধুর কথায় ইয়াদ হুশ আসলো।আসলে এইভাবে থাকায় মধুর ওপর চাদের আলোটা সরাসরি পড়ছিলো।চাঁদের আলোয় মধুর মুখটা দেখে ইয়াদ থমকে গিয়েছিলো!তখন একটা প্রশ্নই মনে এসেছিলো সেটা হলো মেয়েটা এতো মায়াবী কেনো?কেনো?আরেকটু কম মায়াবী হলে হতো না?

ঘোর ভাঙতেই ইয়াদ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’উঠাবো একটা শর্তে।’

‘কি শর্ত?’ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলো মধু।

‘বলো ❝আমি তোমাকে ভালোবাসি ইয়াদ❞।

‘এটা কেমন পাগলামি ইয়াদ?’

‘আমি যেটা বলতে বলছি সেটা বলো।’

মধুর বেশ ভালো ভাবেই জানা আছে ইয়াদের স্বভাব।এখন না বললে ঠাশ করে পানিতে ফেলে দেবে।তার চেয়ে ভালো মাঝরাতেপানিতে হাবুডুবু না খাওয়ার চেয়ে বলে দেওয়া ভালো।

‘আমি আপনাকে ভালোবাসি ইয়াদ।’

‘না হয় নি।বলো আমি তোমাকে ভালোবাসি নট আপনাকে।’

‘ও আচ্ছা।ঠিকাছে বলছি।আমি তোমাকে ভালোবাসি ইয়াদ।’

ইয়াদ মুচকি হেসে বলল,’এবার বলো আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যাবো না।প্রমিস।’

‘আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যাবো না।প্রমিস।’

শর্ত পূরণ হওয়ায় ইয়াদ একটানে মধুকে উঠিয়ে আনলো।মধু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ হাঁপিয়ে নিলো।তারপর মুখ বাঁকা করে বলল,’ইশ!কতো শেয়ানা।সব সময় আমার মুখ থেকে শোনে।নিজে একবারও বলে নি।’
ইয়াদ হাসলো।তারপর বলল,’বলবো।সময় হলেই বলে দেবো।’

‘হ্যাঁ।আমি মরার পর।’

এতক্ষণ মজা করলেও এবার ইয়াদ রেগে গেলো।কোনো কথা না বলে হনহনিয়ে হাটতে লাগলো।এদিকে মধু কিছুই বুঝলো না।হঠাৎ এভাবে রাগার কারণ কি?পেছন থেকে শাড়িটা একটু উঁচিয়ে ধরে প্রায় দৌড়ে এসে ইয়াদের পাশাপাশি আসলো।ওর মতিগতি বোঝার জন্য বলল,’রাগ করলে?’

ইয়াদ কোনো কথাই বলল না।চুপচাপ হাটতে লাগলো।এদিকে মধু ভাবছে কি এমন কথা বলে ফেললাম যে রাগ করলো!

ঘরে এসে বিছানার একপাশে চুপটি করে শুয়ে পড়লো ইয়াদ।মধুও ওর পাশেই শুয়েছে কিন্তু ইয়াদকে ডাকতে সাহস পাচ্ছে না।পুরো রেগে বোম হয়ে আছে।এরপর ফেটে পড়লে শেষ!কিন্তু তবুও স্বামীর রাগ ভাঙানো তো উচিত।তাই মধু পেছন থেকে ইয়াদকে জড়িয়ে ধরলো।ইয়াদের কোনো রেসপন্স নেই।মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে গেছে।কিন্তু না ঘুমায় নি।খিচ মেরে শুয়ে আছে।মধু কাতর স্বরে বলল,’কথা বলবে না আমার সাথে?বলো না,বলো না,বলো না,বলো না,বলো না!….’

এভাবে ননস্টপ চলছেই।ইয়াদ বিরক্ত হয়ে বলল,’হয়েছে,হয়েছে এবার থামো।’

মধু থামলো।ইয়াদ ওর দিকে ঘুরলো।মধুকে বুকের মধ্যে টেনে ওর চুলে হাত চালাতে লাগলো।এক মিনিট চুপ থেকে বলল,’জানো পৃথিবীতে কেউই চায় না তার ভালোবাসার মানুষ তার আগে মরে যাক।সবার ভেতরে এই ভয়টা থাকে।তারা ভালোবাসার মানুষের মৃত্যু তো দূরের কথা নাম শুনলেও ভয় পায়!আতকে ওঠে হারানোর ভয়ে!তবুও আমরা যেহেতু মানুষ আমাদের যেহেতু জন্ম আছে সেহেতু মৃত্যুও আছে।এই অপ্রিয় সত্যিটা আমাদের মানতে হবে।কিন্তু তার মানে এই না যে আমরা কথায় কথায় মরার কথায় বলবো।যতোদিন বাঁচবো একসাথে ভালোবেসে বাঁচবো।তাই আর কখনো মরার কথা বলবে না।বললে….’

এর পরের কথাটা ইয়াদ আর বলতে পারলো না।তার আগেই মধু ওর মুখ হাতে দিয়ে দিলো।তারপর নিজেই বলল,’বলবো না আর।’

ইয়াদ মধুর হাতে একটা আলতো চুমগ খেলো।তারপর এটা সেটা আলাপ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো দুজনেই।
—————-
ঘুমটা মধুর আগে ইয়াদের ভাঙলো।চোখমেলে ঘুমন্ত মধুকে দেখে আর জাগাতে ইচ্ছে হলো না।সাবধানে উঠে বাইরে এলো।এখনো আকাশ তেমন ফর্সা হয় নি।ইয়াদ কলপাড়ে গিয়ে হাতমুখ ধূয়ে ফ্রেশ হলো।

আজই,একটু পরই ওরা ঢাকায় ফিরবে।আজ শুধু মধুকে নিয়ে যাবে। এক/দুইদিন পর এসে ওর মা আর বোনকে নিয়ে যাবে।

ইয়াদ ফ্রেশ হয়ে ঘরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে নিজের ফোন বের করলো কিন্তু ওপেন করতে গিয়ে দেখলো ফোন বন্ধ।চার্জ নেই।অবশ্য থাকবেই বা কিভাবে।আসার পর থেকে তো একফোঁটাও চার্জ দেওয়া হয় নি।ফোনটাকে মধুর চার্জারে চার্জে রেখে ইয়াদ বাইরে বের হলো।ওইপাশের একটা ঘরে গিয়ে নক করলো।এই ঘরেই রাতে রাসেল শুয়েছিলো।এটা মধুর বড় চাচাদের ঘর।কালকে রাতে মধুর মা আর মিলি শুয়েছিলো মধুর ছোটো চাচাদের ঘরে রাসেলকে দিয়েছিলো বড় চাচাদের ঘরে শুতে।আর মধু ইয়াদ ওদের ঘরেই শুয়েছে।

রাসেক চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খুললো।তারপর ইয়া বড়ো একটা হাই তুলে বলল,’কি রে এতো তাড়াতাড়ি উঠে পড়লি!নাকি রাতে ঘুমাস’ই নি।’

‘ধূর শালা চুপ কর।যা হাত মুখ ধুয়ে নে।আমরা একটু পরই বের হবো।’

‘ভাবী উঠেছে?’

‘না।ঘুমাচ্ছে।একটু পর ডাকবো।’

রাসেল ফ্রেশ হলো।তারপর দুই বন্ধু মিলে কাছাকাছি একটু ঘুরে এলো।

ঘন্টাখানেক এর মধ্যে সবাই উঠে গেছে।ইয়াদ আর রাসেলও ফিরেছে।ইয়াদ ফিরেই আইরিন রহমানকে বলেছে যে ওরা আজ ফিরবে।আইরিন রহমান অবশ্য আরো দুই/একদিন থাকার জন্য বলেছিলেন কিন্তু ইয়াদ রাজি হলো না।এমনিতে কাল ভার্সিটিতে যায় নি।প্রিন্সিপালকেও জানায় নি।আজকে হাজিরা দিতেই হবে।আবার এদিকে বাসায় ফিরে সবকিছু ম্যানেজও করতে হবে।

সকাল পৌনে সাতটার দিকে মধু,ইয়াদ আর রাসেল বেরিয়ে পড়ে।দেরি হবার আশংকায় খুব দ্রুতই বেরিয়েছে ওরা।তাই নাস্তাও খাওয়া হয় নি।তবে সমস্যা নেই অন দ্য ওয়ে খেয়ে নেওয়া যাবে।

যাওয়ার সময় মধু আর আইরিন রহমান অনেক কেঁদেছিলো পরে ইয়াদ বুঝিয়ে ওকে গাড়িতে তুলেছিলো।স্টিয়ারিং এ ইয়াদ ওর পাশে মধু আর পেছনে রাসেল বসেছে।

ঢাকা পৌঁছাতে ওদের সাড়ে নয়টা বেজেছে।ইয়াদ রাসেলকে ওর বাড়ির সামনে ড্রপ করে মধুকে নিয়ে সোজা ভার্সিটিতে চলে এলো।আজ আর ক্লাস করাবে না।হাজিরা দিয়ে একসপ্তাহের ছুটি নিয়ে নিবে।গাড়ি থেকে নেমে মধু বলল,’আমার ভার্সিটির সামনে এলপ যে।’

‘ম্যাম আপনার জামাই এখনকার লেকচারার।এখন থেকে আমি আপনার টিচার প্লাস হাজবেন্ড।’এটা বলেই ইয়াদ একটা ভাব নিলো।

তারপর দুজনেই ভার্সিটিতে ঢুকলো।ইয়াদ বলল,’তুমি একটু ওয়েট করো।আমি হাজিরা দিয়েই আসছি।’

‘আচ্ছা।’
ইয়াদ চলে গেলো।আর মধু নিজের ক্লাসের সামনে এসে দাড়ালো।ভেতর থেকে আরিয়া,মিতু,লাবনী,সায়রা ওকে দেখতে পেয়ে ক্লাস রেখেই ছুটে চলে এলো।আরিয়াতো আগে থেকেই ছিলো আর ওরা ভার্সিটিতে ওঠার পর থেকেই খুব ভালো বন্ধু হয়েছে।প্রথমে লাবণী বলল,’কোথায় হারিয়েছিলি রে?’
লাবণীর পর মিতু বলল,’বিয়ে টিয়ে করে ফেলেছিস নাকি?’
তারপর সায়রা বলল,’আরে এগুলো ছাড়।শোন তুই যাওয়ার পর নতুন একজন লেকচারার এসেছে ভার্সিটিতে।আমি তো দেখেই ক্রাশ খেয়েছি।ওনার নামটাও ওনার মতো সুন্দর ‘আবরাহাম খান ইয়াদ’।আমি সব খবর নিয়েছি উনি আনম্যারিড।তার মানে আমার চান্স আছে।’এটা বলেই সায়রা খুশীতে গদগদ হয়ে গেলো।এদিকে মধু ওর খুশী দেখে মিটিমিটি হাসছে।কিন্তু আরিয়া আসার পর একটা কথাও বলে নি।তাই মধুও প্রথমে বলল,’কি রে কথা বলবি না?’

‘মিথ্যুকের সাথে কিসের কথা।কোনো কথা নেই আমার তোর সাথে।’

‘তাহলে আমি এখানে আসায় তুই ছুটে এসেছিস কেনো?’

‘আ..আমি আসি নি।ওরা জোর করেছিলো।তাই এসেছি।’আরিয়া আমতা আমতা করে বলল।কিন্তু সত্যি তো এটাই ওরা কেউই মধুকে দেখে নি।সবার আগে আরিয়া ই দেখেছিলো আর ছুটে ক্লাস থেকে বেরিয়েছিলো।তারপর ওরাও এসেছিলো।মধু আরিয়া সহ সবাইকে অবাক করে দিয়ে আরিয়াকে জড়িয়ে ধরলো।কাঁদতে কাঁদতে বলল,’সরি,রে।মাফ করে দে।আর কখনো এমন করবো না।’

আরিয়াও কাঁদছে।কিছুক্ষণ কাঁদাকাটার পর দুই বান্ধবী মান অভিমান শেষ হলো।এদিকে সায়রা হঠাৎ চাপা উত্তেজনায় চিল্লিয়ে বলল,’দেখ,দেখ আমার ক্রাশ বয় আসছে।’

সবাই তাকিয়ে দেখলো।ইয়াদ আসছে।ইয়াদ ওদের সামনে এসে দাড়ালো।তারপর আরিয়াকে দেখে বলল,’হেই,আরিয়া কেমন আছো?’

‘ভালো।আপনি?’

ইয়াদ একবার মধুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,’এতোদিন ভালো ছিলাম না।এই দুইদিন ধরে খুব ভালো আছি।’

ইয়াদের কথায় আরিয়া আর মধু হাসলো।কিন্তু বাকি তিনজন কিছুই বুঝলো না।সায়রাও বেশ কনফিউজড!

আরিয়ার সাথে দুই/একটা কথা বলে ইয়াদ মধুকে উদ্দেশ্য করে বলল,’চলো।এবার বের হই।’

‘হুম চলো।’

তারপর দুজনই গেটের দিকে এগিয়ে গেলো।এদিকে সায়রা বুঝতে না পেরে বলল,’তোর কিছু বুঝলি?’

আরিয়া বাদে বাকি দুইজন মাথা নাড়ালো।এদিকে আরিয়া ওদের কান্ড দেখে হাসতে হাসতে বলল,’আরে এখবো বুঝিস নি?ওরা কাপল।আর সায়রা তোর ক্রাশ বয় আরো চারবছর আগে থেকেই বুকিং।এই তো কালকে বোধহয় দুজনে বিয়ে করেছে।’

সায়রা অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,’ইশ!সব হ্যান্ডসাম ছেলেদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।আমার কি হবে?আল্লাহ আমার জন্য একজনকে বাঁচিয়ে রেখো প্লিজ!’

সায়রার কথায় বাকি তিনজন হাসতে হাসতে শেষ!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে