#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪১
#Arshi_Ayat
‘তুমি যাকে ভালোবাসো
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো
তার জীবনে ঝড়
তোমার কথার শব্দ দূষণ
তোমার গলার স্বর
আমার দরজায় খিল দিয়েছি
আমার দারুণ জ্বর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর’
‘প্রাক্তন’ ছবির এই গানটা মধু বারান্দার গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে শুনছে।অবশ্য শুনছে বললে ভুল হবে।ওটা নিজের মতো বাজছে কিন্তু মধুর কানে এর কথা,সুর,তাল কিছুই ঢুকছে না।অবশ্য ঢুকবেই বা কিভাবে যার জীবনের সুর,তালই ঠিক নেই তার আবার গান!
রাত যতো বাড়ে,দুঃখ ততই গভীর হয়।রাতের নিস্তব্ধতা মনে করিয়ে দেয় সেই ভয়াল রাতের কথা।চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে নিজের সর্বনাশের দৃশ্য!দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না মধু!
——————-
ছেলেরা নাকি সহজে কাঁদতে পারে না।অনেক ধৈর্য তাদের কিন্তু আজ বোধহয় সে ধৈর্যও ভেঙে গেলো।মধু ফোন কাটার পর ইয়াদের আর্তনাদে পুরো রেডিও স্টেশন কেঁপে উঠে। অভিসহ অফিসের অন্যান্য সদস্য মিলে ইয়াদকে স্বান্তনা দিচ্ছে কিন্তু কোনো স্বান্তনার বাণী ইয়াদের কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে না।মন বলছে এখনি মধুর কাছে ছুটে যেতে।আজ মস্তিষ্কও মনের বিরুদ্ধে কথা বলছে না।শরীরের প্রত্যেকটা ইন্দ্রিয় বলছে মধুকে চাই,চাই মানে চাই।ইয়াদ চোখ মুছে অভির থেকে মধুর নাম্বারটা কালেক্ট করলো।তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পড়লো রেডিও অফিস থেকে।বাসার দিকে যেতে যেতে রাসেল কে ফোন দিলো।রাসেল ওর হবু বউয়ের সাথে কথা বলে মাত্রই শুয়েছিলো তখনই ইয়াদের কল আসে।রাসেল ঘড়ির দিকে তাকালো।রাত ১২ টা বাজে।তারপর ফোন ধরে বলল,’হ্যাঁ,বল।’
‘ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া যাবো।বের….’ ইয়াদের পুরো কথা শেষ করা লাগে নি এর আগেই রাসেল উত্তর দিলো,’বাসায় চলে আয়।আমি নামছি।ওখান থেকে রওনা দেবো।’
‘আচ্ছা।’
রাসেল ফোন রেখে ওয়াশরুমে গেলো শাওয়ার নিতে।দশমিনিটে শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে একটা শার্ট আর একটা জিন্স নিয়ে নিলো।রাসেল ট্রাভেল করতে পছন্দ করে।মানে ওকে ট্রাভেলের জন্য চব্বিশ ঘন্টা পাওয়া যাবে আর আরেক হিসেবে ইয়াদ ওর বেষ্ট ফ্রেন্ড আর বেষ্ট ফ্রেন্ড মানে ভাইয়ের থেকে কম না।আর ভাইয়ের জন্য তো জানও কোরবান শুধু গার্লফ্রেন্ড ছাড়া!
ইয়াদ বাসায় পোঁছে দেখলো ওর মা বসে আছে সোফায়।ইয়াদ দেখেও না দেখার ভান করে ওপরে চলে যেতে নিলে ওর মা ডেকে বলল,’ইয়াদ খেতে আয়।’
‘ক্ষিধে নেই।’
‘মানে কি ইয়াদ!খাওয়া দাওয়ার একদম ছিঁড়ি নেই।আজকে সকালের পর আর খেয়েছিস কিছু?দিনের পর দিন নিজেকে কষ্ট দিয়ে কি মজা পাস।এদিকে তুই নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখ যার জন্য নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস সে তোকে ভাবেও না।মনে হয় এতোদিন বিয়ে করে সুখেই আছে।’
এবার আর ইয়াদ মুখ না খুলে থাকতে পারলো না।মায়ের মুখোমুখি এসে দাড়ালো বলল,’না মা বিসর্জন দিয়েছে ও বিসর্জন দিয়েছে নিজের সুখ তোমার ছেলেকে সুখে রাখতে।কিন্তু ও এটাই জানে না আমার জীবনের সুখের অপর নাম মধু।’
ইয়াদের গলার উচ্চ আওয়াজে ইফাজ,ইরিন,ইয়াফ খান সবাই রুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন।নিহা ঘুমিয়ে পড়েছে তাই বোধহয় শুনতে পায় নি।ইফাজ এসে ইয়াদের কাঁধে হাত দিয়ে বলল,’কি হয়েছে রে?’
ইয়াদ ছলছল চোখে বলল,’ভাইয়া আমি মধুকে খুজে পেয়েছি।ওকে আনতে যাচ্ছি।’
ইফাজ বিষ্মিত হলো তবে খুশিও হলো।এতোদিন কম চেষ্টা করে নি মধুকে খোঁজার কিন্তু পাচ্ছিলো না।ইফাজ ইয়াদের কাঁধে ভরসার হাত রেখে বলল,’যা নিয়ে আয় ওকে।’
সাইদা খান কিছু বলতে নেওয়ার আগেই ইফাজ আবার বলল,’আম্মু,আব্বু এখন কিছু বলো না।ওরা আসুক তারপর শুনবো।’
ইয়াফ খান তবুও বললেন,’কিন্তু ওর তো এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেছে।আর আমি ওদের কথাও দিয়ে ফেলেছি।’
ইয়াদ কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু কষ্ট করে ওকে কিছু বলতে হয় নি ইফাজ ই বলল,’বাবা প্লিজ দয়া করে এসব কথা রাখো।জোর করে কিচ্ছু হয় না।আজকে তুমি জোর করে ইয়াদকে বিয়ে দিবে কিন্তু এরজন্য ইয়াদ যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলে তার জন্য কিন্তু তুমি দায়ী থাকবে আর যার সাথে বিয়ে দিবে ওই মেয়েটাও তো জানে না ইয়াদের জীবনেও কেউ আছে।শুধু শুধু মেয়েটাকে কেনো ঠকাচ্ছ তুমি?যাক বাদ দাও।’
ইফাজের কথার পর সাইদা খান আর ইয়াফ খান কেউই কিছু বললেন না।ইয়াদ ইফাজের গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।ইয়াদের সাথে যাওয়ার একটা তীব্র ইচ্ছা ইফাজের মনে জেগেছিলো কিন্তু নিহাকে এ অবস্থায় রেখে যাওয়া ঠিক হবে না যতোই হোক নিহা ওর স্ত্রী আর ওর বাচ্চার মা।একটু হলেও ওর প্রতি মায়া এসেছে ইফাজের এটা মানতেই হবে কিন্তু মন তো এখনো তাকেই চায়।কিন্তু সবসময় মানুষ যা চায় তা পায় না,আর যা চায় না তা ভুল করে পেয়ে যায়।
ইয়াদ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।রাসেলের বাসার সামনে গিয়ে ওকে পিক করবে তার পর ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়ার দিকে রওনা হবে।আর মধু লোকেশন ট্র্যাক করার জন্য নিখিল হেল্প করবে।ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া পৌঁছানোর পর ইয়াদ নিখিলকে কল দিয়ে মধুর নাম্বারটা দিলেই হবে।
গাড়িতে উঠে রাসেল একটু পানি খেয়ে বোতলটা পিছনে রেখে বলল,’হঠাৎ এতো রাতে ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া কেনো যাবি?’
ইয়াদ গাড়িয়া স্টিয়ারিং এ হাত রেখে বলল,’মধু ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া আছে।’
রাসেল একটু অবাক হয়ে বলল,’ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া গেছে কেনো মধু?’
ইয়াদ বলল,’বাংলা রেডিওর ইউটিউব চ্যানেলে গিয়ে একটু আগের একটা লাইভ কল রেকর্ড শোন।সব বুঝতে পারবি।’
‘এতো কষ্ট করার কি দরকার তুই বল।’
‘আমি বলতে পারবো না।’ইয়াদ থমথমে গলায় বলল।
ইয়াদকে আর না ঘেটে রাসেল ইয়াদের কথা মতো কল রেকর্ডটা শুনতে শুরু করলো।পুরোটা শুনে দীর্ঘক্ষণ চুপ ছিলো রাসেল।এক পর্যায়ে মুখ খুলেই ফেললো।বলল,’ভাই,কিভাবে মেয়েটা এতো কষ্ট সহ্য করলো বল তো!আমার তো শুনেই আমার হাত পা কাঁপছে।’
ইয়াদ কিছু বলল না।বাম হাত দিয়ে চোখ মুছলো।তারপর গাড়িটা সাইড ভেজা গলায় বলল,’তুই ড্রাইভ কর।আমি করলে এক্সিডেন্ট হতে পারে।আমি চাই না আর কিছু হোক।’
রাসেল ইয়াদের কথা মতো ড্রাইভিং সীটে বসলো।ইয়াদ পাশের সীটে বসে ঘনঘন চোখ মুচছে।নিজেকে শান্ত রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।কিন্তু শক্ত রাখতে হবে মধুর জন্য হলেও নিজেকে শক্ত রাখতে হবে।
————-
ভোরের আলো ফুটছে,বাতাস বইছে।বৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা।ইয়াদ’রা চলে প্রায় চলে এসেছে ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়ার কাছাকাছি।অনেক্ক্ষণ রাসেল ড্রাইভ করার পর ইয়াদ বসলো ড্রাইভিং সীটে।
সকাল ৭.০০ টায় ওর ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া সদরে পৌঁছে গেছে।ইয়াদ পৌঁছে নিখিলকে কল দিলো,’হ্যালো,নিখিল ভাইয়া।’
‘হ্যাঁ,ইয়াদ তুমি একটু অপেক্ষা করো।আমি অফিসে পৌঁছে লোকেশন ট্র্যাক করছি।’
‘আচ্ছা ভাইয়া।’
পাঁচ মিনিট পরই নিখিল লোকেশন ট্র্যাক করে ইয়াদকে নির্দেশনা দেওয়া শুরু করলো।গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে একটা গ্রামে ঢুকে পড়লো ইয়াদ।এরপর নিখিল নির্দেশনা অনুযায়ী যাচ্ছে কিন্তু কিছুদূর এগিয়েই বিপত্তিতে পড়লো।সামনে আর গাড়ি যাবে না।রাস্তা চিকন।এখানে গাড়ি ঢুকানো যাবে না।রাস্তার দুপাশে পুকুরও আছে।ইয়াদ আর রাসেল গাড়ি থেকপ নেমে সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলো।হাঁটতে হাটতে বাজারে চলে এলো।এদিকে নেটওয়ার্ক নেই তাই ফোন ডিসকানেক্ট হয়ে যায়।ইয়াদ কয়েকবার নিখিল কে ফোন দেয় কিন্তু ফোন ঢুকছে না।এখন আর কি করার যেহেতু এতোটুকু পথ এসেই পড়েছে সেহেতু মধুকে না নিয়ে এখান থেকে এক পা ও নড়বে না।কিন্তু এখন খুঁজবে কি করে।বাজারের কাউকে কি জিগ্যেস করবে?আর জিগ্যেস করলেও কি জিগ্যেস করবে?ইয়াদের মাথায় কিছু আসছে না।এদিকে রাসেলের প্রচুর ক্ষিধে পেয়েছে।কিছু খাওয়া দরকার তাই বলল,’দোস্ত চল কিছু খেয়ে নেই।তারপর খুজি।’
‘তুই খা।আমাকে বিরক্ত করিস না।’
‘আচ্ছা ঠিকাছে তোকে খেতে হবে না এটলিস্ট আমার সাথে তো একটু আসতে পারিস।’
‘আচ্ছা চল।’
ইয়াদ আর রাসেল বাজারের একটা হোটেলে ঢুকলো।রাসেল নাস্তা করলেও ইয়াদ এক গ্লাস পানি ছাড়া কিছু খায় নি।রাসেলের নাস্তা করা শেষে ইয়াদ আর রাসেল হোটেল থেকে বের হলো।তারপর আশেপাশে কয়েকটা দোকানে মধুর নাম বলল কিন্তু তারা কিছু বলতে পারছে না ওর বাবার নাম বললে হয়তো কেউ চিনবে কিন্তু মধুর বাবার নামটা মনে পড়ছে না।একবার না দুইবার মধু বলেছিলো কিন্তু এখন মনে পড়ছে না।এমনই হয় দরকারের সময় কিছু মনে থাকে না।অনেক্ক্ষণ চিন্তা করার পর একপর্যায়ে মন পড়লো ওর বাবার নাম তো মিরাজ।ইয়াদ তৎক্ষনাৎ একটা দোকানে ওর বাবার নাম বলল।দোকানদার লোকেশন বলে দিলো।ইয়াদ আর রাসেল সেই লোকেশন বরাবর গিয়ে অনেকগুলো বাড়ি দেখতে পেলো।এখন কোনটা মধুদের ঘর কে জানে!ইয়াদকে কনফিউজড দেখে রাসেল বলল,’এতো ভাবছিস কেনো?মধু বলে জোরেজোরে চিল্লাতে থাক।’
ইয়াদ বিরক্ত কন্ঠে বলল,’চুপ থাকবি তুই।’
ইয়াদের ধমকে রাসেল চুপ হয়ে গেলো।হঠাৎ ওদের চোখ গেলো বা পাশের ঘর থেকে বের হওয়া একটা মহিলার ওপর।ইয়াদ দ্রুত গিয়ে মহিলার পথ রোধ করে বলল,’আন্টি,মধুদের বাসা কোনটা?’
‘আইরিন ভাবীদের বাসা?’মহিলাটা জিগ্যেস করলো
‘জ্বি আন্টি।’
‘ওই যে ওইপাশের ঘরটাই আইরিন ভাবীদের বাসা।তা বাবা তুমি কে?’
ইয়াদ এই কথার উত্তর দিলো না পাশের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।কিন্তু রাসেল মহিলার উত্তরে বলল,’আপনার ভাবীর মেয়ের জামাই।’
এটা বলেই রাসেল ইয়াদের পেছনে ছুটলো।ঘরের সামনে এসে দরজায় নক করলো ইয়াদ।ঘরে মধু ছাড়া কেউ নেই।আইরিন রহমান আর মিলি কোথায় যেনো গেছেন।অগত্যা দরজা মধুকেই খুলতে হলো।দরজা খুলতেই ইয়াদকে দেখে মধুর জানে পানি নেই।ইয়াদকে দেখে দ্রুত দরজা বন্ধ করতে নিলেই ইয়াদ দরজা ঠেলা শুরু করলো।ওদিক থেকে মধু ঠেলছে এদিক থেকে ইয়াদ ঠেলছে কিন্তু মধু বেশিক্ষণ ধরে রাখাতে পারে নি ইয়াদ ঘরে ঢুকেই পড়লো।
চলবে….
#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ৪২
#Arshi_Ayat
ইয়াদ ঘরে ঢোকার পর মধু এক সেকেন্ডেও দেরি করে নি দৌড়ে অন্যরুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো ইয়াদ আসার আগেই।দরজা আটকে দরজার সামনে থম মেরে বসে রইলো।বুকটা অস্বাভাবিক ভাবে ওঠানামা করছে!মাথা কাজ করছে না!ও খবর পেলো কোথায়!আসলোই বা কি ভাবে!এগুলোই মধুর মাথায় ঘুরছে।এদিকে ইয়াদ দরজা ধাক্কানো শুরু করেছে।কয়েকবার ধাক্কানোর পরেও যখন খুললো না তখন ইয়াদ গলা হাঁকিয়ে বলল,’মধু ভালো হচ্ছে না কিন্তু!বেরিয়ে এসো বলছি!রাগ উঠালে কিন্তু দরজা ভেঙে ঢুকবো।’
মধু নিশ্চুপ!ইয়াদের এবার সত্যিই রাগ হলো।দুই/তিন লাথি দিয়ে দরজাটা সত্যি সত্যি ভেঙে ফেললো।প্লাস্টিকের দরজা হওয়ায় ভাঙতে বেশি কসরত করতে হয় নি!দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকতেই মধু আবার দৌড় লাগালো ওয়াশরুমে ঢোকার জন্য।কিন্তু এবার আর রেহাই পেলো না।ইয়াদ ধরেই ফেললো।নিজের এক হাত দিয়ে মধুর দুইহাত পিঠের পেছনে বন্দী করে আরেক হাতে ওর থুতনি চেপে ধরে বলল,’পালাচ্ছো কোথায়?’
মধু অনেক মোচড়ামুচড়ি করেও যখন হাত ছাড়াতে পারলো না তখন বলল,’আপনি কেনো এসেছেন এখানে।প্লিজ চলে যান।আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে!তারপরেও কেনো এসেছেন?’
মধুর কথা শুনে ইয়াদ ওর হাতের বাধন আলগা করে দিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,’ও আচ্ছা তাই নাকি!তা তোমার স্বামী কোথায়?’
মধু নিচের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল,’ও ও বাজারে গেছে।’
ইয়াদ মধুর একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে মধুর মুখটা তুলে ধরলো।তারপর বলল,’তাহলে চোখে পানি কেনো?নাকি তোমার স্বামী তোমাকে আমার মতো ভালোবাসে না।’এটা বলেই ইয়াদ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো।
মধু ইয়াদের সামনে দাড়িয়ে কৃত্রিম অনুনয়ের সুরে বলল,’আপনি প্লিজ চলে যান ও এসে দেখলে সমস্যা হবে।’
মধুর কথা শুনে ইয়াদ রেগে গিয়ে ওকে নিজের সাথে চেপে ধরলো।তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলল,’একের পর এক মিথ্যে বলছো!একবারও কি বুক কাপছে না এতোগুলো মিথ্যে বলতে।’
মধু অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,’মিথ্যে বলছি না আমি সব সত্যি।’
‘তাই?আচ্ছা তাকাও আমার দিকে।’
মধু তাকালো না।ইয়াদ আবার ধমকের সুরে বলল,’মধু,তাকাও বলছি।’
মধু এবার তাকালো।চার চোখ এক হলো।ইয়াদ মধুর গালে হাত দিয়ে বলল,’এবার বলো।কোনটা সত্যি?’
মধু কিছু বলল না।চুপচাপ তাকিয়ে রইলো।চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে।ইয়াদ ওর চোখের পানি মুছে জড়িয়ে ধরলো।মধু ইয়াদের বুকের ওপর মাথা রেখে কাঁদছে।ইয়াদের চোখেও পানি কিন্তু সেটা মধু দেখার আগেই মুছে ফেললো সে।কিছুক্ষণ পর মধু নিজেকে সামলে নিলো।ইয়াদের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে চোখের পানি মুছে বলল,’আমার বিয়ে হয় নি সত্যি কিন্তু আমি আপনার সাথে যেতে পারবো না।’
‘তাহলে আমি এখানে থেকে যাবো না।’ইয়াদের গলায় দৃঢ়তা।
‘পাগলামি করছেন কেনো?ফিরে যেতে বলছি আমি।’
‘তুমি বললেই আমি শুনবো কেনো?আমি যাবো না।আঠার মতো লেগে থাকবো তোমার সাথে।কিছুতেই ছুটাতে পারবে না তুমি।’
মধু এবার মরিয়া হয়ে উঠলো।কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,’প্লিজ বাচ্চামো করবেন না।আপনি জানেন না আমি কেনো এমন করছি।জানলে হয়তো চাইবেন না!’
ইয়াদ মধুর সামনের ক’গাছি চুল পেছন গুঁজে দিতে দিতে বলল,’সব জানি।সব জেনেও শত সহস্রবার তোমাকেই চাই।’
মধু বিষ্মিত হলো!সব জানে মানে?কিভাবে?ও তো কাউকে কিছু বলে নি।মধু ইয়াদের দিকে জিগ্যাসু দৃষ্টিতে তাকালো।ইয়াদ মুচকি হাসলো।কাল রাতের ঘটনাটা সংক্ষেপে বলল।সব শুনে মধু নিজের ওপরেই ক্ষেপে গেলো।ইশ!কি দরকার ছিলো রেডিও তে বলার।আগে জানলে এই ভুল কোনোক্রমেই করতো না মধু।
সবশুনেও মধুকে চুপ থাকতে দেখে ইয়াদ বলল,’এখন নিজেকে গালাগাল করে লাভ নেই।যা হয়েছে বেশ হয়েছে।’
মধু কিছু বলল না।ঘর থেকে বের হয়ে যেতে নিলেই ইয়াদ বলল,’আবার কোথায় পালাচ্ছো?’
মধু ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,’পালাচ্ছি না।বসুন।আসছি।’
‘হুম।তাড়াতাড়ি এসো।’মধু বের হতেই ইয়াদ খাটের ওপর আরাম করে বসলো।
রুমের চারদিকে একটু চোখ বুলাতে লাগলো।আসার পর দেখার সময় হয় নি।রুমে বেশি কিছু নেই।একটা খাট,একটা খাঠের আলমারি আর একটা ড্রেসিং টেবিল।ইয়াদ উঠে গিয়ে বিছানার পাশের জানালাটা খুলে দিলো।ঘরে এই একটাই জানালা।এটা না খুললে কেমন যেনো অন্ধকার,অন্ধকার লাগে।জানাল খুলে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলো মধু এসে পড়েছে।হাতে পরোটার প্লেট আর আলুভাজি।দু’টো প্লেট টেবিলের ওপর রেখে ইয়াদের সামনে এসে দাড়ালো।তারপর বলল,’আপনি একাই এসেছেন নাকি আরো কেউ আছে?’
‘রাসেল এসেছে।বোধহয় বাইরে আছে।’
‘কই,বাইরে তো কাউকে দেখলাম না।’
‘ওহ!হয়তো আশেপাশে কোথায় আছে।’
‘ওনাকে ডেকে আনুন।নাস্তা খাবেন।’
এটা বলে মধু চলে যেতে নিলেই ইয়াদ হাত ধরে ফেললো।শান্ত চোখে চেয়ে বলল,’তুমি খেয়েছো?’
মধু কিছু বলল না।কারণ ইয়াদকে ও মিথ্যা বলতে পারে না।কিভাবে যেনো ধরে ফেলে।তাই শুধু শুধু বাক্যব্যয় করে লাভ নেই।মধুর উত্তর না পেয়ে ইয়াদ যা বোঝার বুঝে গেলো। বলল,’পরোটা কয়টা এনেছো এখানে?’
‘চারটা।’সংক্ষিপ্ত জবাব দিলো মধু।
‘আচ্ছা যাও হাত মুখ ধুয়ে এসো।একসাথে খাবো।’
‘কিন্তু আমি তো আপনাদের জন্য এনেছি।’
‘রাসেল নাস্তা করেছে সকালেই।ওর আর করা লাগবে না।তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো।’
মধু ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে কলপাড়ে চলে গেলো।আর ইয়াদ এই রুমের সাথে লাগোয়া ওয়াশরুমে গেলো ফ্রেশ হতে।
মধু হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখলো ইয়াদ ওর জন্য অপেক্ষা করছে। চুপচাপ এসে ইয়াদের পাশে বসলো।মধু মনে মনে ভাবছে ঝামেল না বাড়িয়ে কোনোমতে বুঝিয়ে ইয়াদকে বাড়ি পাঠিয়ে দিবে।অবশ্য এটা এতো সহজও না।ইয়াদকে শুধু ইয়াদ নিজেই বোঝাতে পারে।তবুও চেষ্টা তো করতে হবে।ওর কথায় গলে পড়া যাবে না।আর এদিকে ইয়াদের মনে মনে চলছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিয়েটা সারলে কেমন হয়?আচ্ছা এতো দ্রুত কাজি কোথায় পাওয়া যাবে আর কিছু কেনাকাটাও তো করতে হবে!দুজনের চিন্তাভাবনাই সাংঘর্ষিক!
নাস্তা করতে করতে ইয়াদ টুকটাক কথা বলছে আর মধু সেগুলো উত্তরে হ্যাঁ,হু বলছে।খাওয়া শেষ হতে হতে আইরিন রহমান আর মিলিও চলে এসেছে।ইয়াদ আইরিন রহমানকে সালাম দিলো আর মিলির সাথেও টুকটাক কথা বলল।মিলি এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে কিন্তু ঢাকা থেকে চলে আসায় কলেজ যাওয়া হচ্ছে না।তবে সামনের মাসে সে হোস্টেলে শিফট হবে।এই তো এমনই টুকটাক কথা হলো ইয়াদের সাথে। এদিকে মধু চিন্তায় পড়ে গেছে কি করবে এটা ভেবে।ইয়াদের স্বভাব চরিত্র ভালো ভাবেই জানা আছে।হয়তো মনে মনে এখন বিয়ের প্ল্যান করছে!
মধু কলপাড়ে এসেছে পানি ভরতে আইরিন রহমানও ওর পাশে এসে দাড়ালো।বলল,’কি করবি মধু?’
‘ওনাকে এখান থেকে ফেরাতে হবে।উনি যেটা চাইছে সেটা সম্ভব না।’
‘ও কি সব জানে?’
‘হুম সব জানে।’
‘সব জেনেও যদি চায় তাহলে আপত্তি কোথায়?’
‘না মা।আমার স্বার্থের জন্য কাউকে ঠকাতে পারবো না আমি।’
‘তুই ঠকাচ্ছিস কোথায়?ও তো সব জানেই।সব জেনেশুনেই তোকে বিয়ে করতে চাইছে।আমার মনে হয় না তোর এখানে আপত্তি করা ঠিক হচ্ছে।’
মধু কলসিটা কোমরে উঠিয়ে বলল,’মা তুমি বুঝবে না।শুধু উনি রাজি হলেই হবে না।ওনারা পরিবার আছে।ওনার মা,বাবা যদি না রাজি হয় তাহলে কিভাবে সম্ভব?তারপর যদিও রাজি হয় বিয়ের পর মত পাল্টাবে না তার গ্যারান্টি কি?একে তো আমি রেপড তার ওপর আমার বাচ্চাও হবে না এমন
মেয়েকে কে নিজের ছেলের বউ করতে চাইবে?কেউ চাইবে না।আমি এখন বাঁচা মরা সমান।তাই মা আবেগ দিয়ে না ভেবে বিবেক দিয়ে ভাবো। ভবিষ্যৎ চিন্তা করো।’
এটা বলেই মধু কলসি নিয়ে চলে গেলো।আসলেই কথাগুলো কিন্তু ভুল বলে নি কিন্তু মেয়েটা কি সারাজীবন এভাবেই থাকবে?জিন্দালাশ হয়ে?আইরিন রহমানের মনটা আনচান করে উঠলো।
—————–
মধু ঘরে এসে দেখলো ইয়াদ শুয়ে শুয়ে গেমস খেলছে।মধুকে ঘরে আসতে দেখে বলল,’এতক্ষণে আসার সময় হলো!সেই কখন বের হলে।’
‘তে কি আপনার কোলে উঠে বসে থাকবো?আমার কি কাজ নেই?’
মধুর কথা শুনে ইয়াদ বলল,’হ্যাঁ অবশ্য বিয়ের পর আমি তোমাকে কোলে নিয়েই বসে থাকবো।’
‘এহ!ঢং রাখেন।বাইরে গিয়ে রাসেল ভাইয়াকে নিয়ে আসেন।’
‘ধূর ও এমনিতেই আসবে।তুমি বলো তুমি কি রঙের শাড়ি নেবে?আপাতত ক্যাশ তত নেই।হালকা পাতলা কেনাকাটা করতে পারবো।’
‘আমার কিছু লাগবে না।’
‘আরে নাহ!বিয়েতে শাড়ি না পরলে কেমন যেনো লাগবে!একটা শাড়ি আরেকটা পাঞ্জাবি আর কিছু কসমেটিকস হলেই চলবে তাই না?’
‘আপনি কিনলে কিনুন কিন্তু আমার জন্য প্লিজ কিছু কিনবেন না।’
‘আচ্ছা দেখা যাক।’
এরমধ্যেই রাসেল চলে এলো।ঘরে ঢুকে মধুকে সালাম দিয়ে বলল,’মধু কেমন আছো?’
মধু উত্তর দেওয়ার আগেই ইয়াদ বলল,’ধূর শালা তোর ভাবি হয়।ভাবি বল।নাম ধরে ডাকবি না।নাম ধরে তো শুধু আমি ডাকবো।’
ইয়াদের কথা শুনে মধু চোখ পাকিয়ে বেরিয়ে গেলো।আর রাসেল হাসতে হাসতে বিছানায় বসলো।মধু যাওয়ার পর ইয়াদ বলল,’দোস্ত একটু কেনাকাটা করা লাগবে।একটা নীল পাঞ্জাবি আর নীল রঙের একটা শাড়ি আনবি।আর আসার সময় কাজি কে ঠিকানা দিয়ে বলে আসবি ঝড়,তুফান,জলোচ্ছ্বাস,ভুমিকম্প যাই হয়ে যাক না কেনো সন্ধ্যার সময় যেনো হাজির হয়।’
‘আচ্ছা কিন্তু ভাবি কি বলল।’
‘যতোদূর বুঝলাম ও আমাকে ভাগানোর প্ল্যান করছে।কিন্তু এটা হতে দেওয়া যাবে না।’
রাসেল উঠে দাড়ালো।বলল,’তুই আমার সাথে যাবি?’
‘পাগলে পেয়েছে আমাকে?একবার বহুত কষ্ট করে খুঁজে পেয়েছি এখন আমি বের হয়ে যাওয়ার পর যদি আবার ভেগে যায়!আমি এই ব্যাপারে রিস্ক নিবো না।’
ইয়াদের কথা শুনে রাসেল হাসলো।তারপর বেরিয়ে গেলো কার্য সম্পাদন করতে।
চলবে….
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)