#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ২৭
#Arshi_Ayat
“তুমি দুরে দুরে আর থেকো না
এ চোখে চেয়ে দেখোনা
তুমি ভালোবেসে আমাকে ঐ রিদয়ে বেঁধে রাখোনা
তুমি দুরে দুরে আর থেকো না
আজ তোমায় আমি এনে দিবো জোছনা
তুমি কাছে এসে আমার পাশে বসনা [২]”
অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে আকাশে।পক্ষীকূল তাদের চিরচেনা নীড়ে ফিরছে।মৃদু হাওয়ায় গাছের পাতাগুলো নড়ছে।
ইয়াদ আর মধু দুজনেই ছাদে দাড়িয়ে আছে তবে বেশকিছুটা দুরুত্ব বজায় রেখে।নিজের জায়গায় দাড়িয়েই কিছুটা দুরুত্বে অবস্থিত অভিমানী মধুকে উদ্দেশ্যে গানটা গাইলো ইয়াদ।মধুর কোনো প্রতুত্তর নেই।ইয়াদ ধীর পায়ে মধুর গা ঘেঁষে দাড়ালো।তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,’ও অভিমানী।’
মধু ফিরে তাকালো ইয়াদের দিকে।ইয়াদের অস্থির চোখজোড়া মধুর অভিমানী চোখের পানে নিবদ্ধ হলো।কি সীমাহিন অভিমান নিয়ে স্থির দৃষ্টিতে মধু তাকিয়ে আছে।ইয়াদ আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না।বুকের‘পর শক্ত করে চেপে ধরলো।মধুও অভিমান ভুলে তার প্রাণপ্রিয়ের বাহুতে আবদ্ধ হলো।কিছুক্ষণ পর ইয়াদ মধুর চিবুক উঠিয়ে তার চোখের পানে চেয়ে বলল,’এতো অভিমান কেনো চোখে?’
‘আপনি আমাকে না বলেই কোথায় গিয়েছিলেন?কতো খুঁজেছি জানেন?’
‘সরি,ভাইয়ার বাসর সাজানোর জন্য আমাকে আর রাসেলকে পাঠানো হয়েছিলো বাসায়।আসার সময় তোমাকে খুঁজেছিলাম কিন্তু পাই নি।তাই ইরিনকে বলে এসেছিলাম তোমাকে যেনো বলে দেয়।ইরিন তোমাকে বলে নি?’
‘না তো।ও হয়তো ভূলে গেছে।’
ইয়াদ মৃদু হেসে বলল,’এবার কি অভিমান শেষ হয়েছে?’
মধু মিষ্টি হেসে ইয়াদের বুকের‘পর মাথা রাখলো।
—————————–
নিহাকে মাঝখানে বসিয়ে তার চারপাশ ঘিরে আত্মীয় স্বজন আর ইয়াদের কাজিনরা বসে মজা করছে।নিহাও কম যায় না।অন্যান্য বউদের চুপ করে বসে বেই।সবার সাথে তাল দিচ্ছে।বোধহয় সেই কারণেই কিছুক্ষণের মাঝে সবার মধ্যমণি হয়ে উঠেছে।বড় বউকে নিয়ে রিতীমত শ্বাশুড়ি মা বেশ প্রশংসা কুড়াচ্ছে।কিন্তু ইফাজ বাসায় এসেই কাউকে না বলে কোথায় যেনো হাওয়া হয়ে গেছে।কারো ফোনই তুলছে না।সাইদা খান এসে সবার সামনেই নিহাকে বলল,’ইফাজ কোথায় গেছে তোমাকে কিছু বলেছে?ও তো বাসায় নেই।ফোনও ধরছে না।’
অনেক্ক্ষণ ধরে নিহাও বিষয়টা খেয়াল করেছে।আর কয়েকবার ফোনও করেছে।সবার মতো নিহার ফোনটাও ইফাজ ধরে নি।এখন যদি শ্বাশুড়ি মা কে বলে যে সে কিছু জানে না তাহলে সন্দেহ হবে।তাই সবদিক বিবেচনা করে নিহা ভরসা দিয়ে বলল,’মা চিন্তা করবেন না।ইফাজ একটা জরুরি কাজে বেরিয়েছে।আপনাদের বলে যাওয়ার সময় পায় নি।আমাকে একটু আগে ফোন দিয়ে বলেছে আপনাদের চিন্তা করতে না।ও তাড়াতাড়িই ফিরবে।’
নিহার কথা শুনে উপস্থিত সবাই হাসলো।তারপর নিহার খালা শ্বাশুড়ি ওর শ্বাশুড়িকে বলল,’দেখলি তোর ছেলের কান্ড বউ পেয়ে আমাদের আর পাত্তাই নেই।এখন বউকে সব বলে।’
ওনার কথা শুনে সবাই হাসলেও নিহা একটা চাপা কষ্ট অনুভব করে বুকের মাঝে।তবুও কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে সবার সাথে তাল মেলায়।
——————-
ইরিন,ওদের কাজিনরা মিলে নিহাকে রাত দশটার সময় ঘরে দিয়ে এলো।ইফাজ আগে থেকেই ঘরে ছিলো।বাইরে থেকে কিছুক্ষণ আগেই এসেছে।ওকে আসতে দেখে সাইদা খান নিহাকে ঘরে দিয়া আসতে বলে।তার আদেশেই আজকের আড্ডার মুলতবি ঘোষণা করে নিহাকে ঘরে দিয়ে আসা হলো।ইফাজ রুমে নেই,বোধহয় ফ্রেশ হচ্ছে।নিহা দরজা আটকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে একবার ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখলো।এরমধ্যেই ইফাজ ওয়াশরুম থেকে বাইরে এসে হাত,মুখ মুছতে মুছতে নিহাকে বলল,’গয়না গুলো খুলে ফেলো।আর শাড়ি পাল্টে ফ্রেশ হয়ে নাও।’
নিহা এসব কিছুই করার লক্ষ্মণ প্রকাশ করলো না।ধীর পায়ে ইফাজের সামনে এসে দাড়ালো।কিছুক্ষণ দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিলো।কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইফাজ দৃষ্টিচ্যুত করে অন্যদিকে তাকালো আর নিহা বসে পড়লো।ইফাজকে সালাম করে উঠে দাড়ালো।তারপর বলল,’ঘুম পাচ্ছে তোমার?’
ইফাজ একটা তপ্তশ্বাস ফেলে বলল,’না,তুমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো।কথা আছে।’
নিহা বিনাবাক্যে ফ্রেশ হয়ে একটা সুতির শাড়ি পরে এলো।ইফাজ খাটে বসে ল্যাপটপে কি যেনো করছিলো!নিহাকে দেখে ল্যাপটপ’টা অফ করে ইশারা করে সামনে বসতে বলল।নিহা বসলো।ইফাজ পূর্ণদৃষ্টিতে নিহার দিকে তাকিয়ে বলল,’তোমার কি কিছু চাওয়ার আছে আমার কাছে?’
নিহা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।তারপর বলল,’যা চাইবো তাই দিবে?’
‘আমার মন’টা বাদে আমার যা আছে সব তোমার।’
নিহা ম্লান হাসলো।ওর আখিদ্বয় ছলছলিয়ে উঠলো, ব্যথিত কন্ঠে বলল,’তাহলে আর কিছুই চাই না।শুয়ে পড়ো।’
নিহা উঠে দাড়ালো।চোখের পানিগুলো আড়াল করে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।ইফাজ বারান্দায় চলে গেলো।
——————–
ঘড়িতে ৭ টা বেজে ১০ মিনিট..
নিহা আড়মোড়া ভেঙে উঠলো।দেখলো বিছানায় ইফাজ নেই।নিহা সোফা থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দেখলো ইফাজ ইজি চেয়ারে ঘুমিয়ে আছে।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে।সামনের ক’গাছি চুল থেকে থেকে উড়ছে।নিহা পরম যত্নে চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিলো।অতি সাবধানে নিজের মুখটা ইফাজের মুখের‘পর আনলো।একটা মুচকি হাসি দিয়ে কপালে আলতো চুমু দিয়ে নিজের মনোবাসনা পূর্ণ করলো।তারপর ইফাজকে ঘুম থেকে না তুলেই ফ্রেশ হতে চলে গেলো।নিহা যেতেই ইফাজ চোখ খুললো।বলাই বাহুল্য ইফাজ এতক্ষণ জেগেই ছিলো।নিহার বারান্দায় আসা থেকে শুরু করে সবকিছুই ইফাজ টের পেয়েছে কিন্তু বুঝতে দেয় নি।নিহার জন্য কষ্ট হয় ইফাজের।কেনো যে মেয়েটা এভাবে তাকে ভালোবেসে বিলীন হচ্ছে!তবে এ কথা তো তার নিজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য সে কেনো মধুকে ভালোবেসে বিলীন হচ্ছে!
নিহা ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখলো ইফাজ খাটের ওপর বসে আছে।ইফাজকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল,’শুভ প্রভাত।’
প্রতুত্তরে ইফাজও বলল,’শুভ প্রভাত।’
‘যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।আমি নিচে যাচ্ছি।’
ইফাজ বিনাবাক্য ব্যয়ে ফ্রেশ হতে গেলো।আর নিহা তার মসৃণ চুলে কয়েকবার চিরুনি চালিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো।
নিচে গিয়ে দেখলো ইফাজের বাবা,খালু,মামা এরা একসাথে বসে চা খাচ্ছে আর গল্পগুজব করছে।নিহা মাথায় ঘোমটা টেনে শ্বশুর কাছে গিয়ে বলল,’বাবা,মা কোথায়?’
‘তোর মা তো কিচেনে।’
‘আচ্ছা বাবা।’বলে নিহা কিচেনের দিকে পা বাড়াতে নিলেই ইয়াফ খান নিহাকে ডেকে বলল,’ওইদিকে পরে যাস,আগে আমার সাথে এসে বস।’
নিহা আদেশ পালন করে শ্বশুরের পাশে খালি জায়গাটায় বসলো।ইয়াফ খান প্রশংসায় নিহার মাথায় হাত রেখে বলল,’এই হলো আমার বড় মা।’
ইয়াফ খানের কথায় উপস্থিত সবাই হাসলো।তারপর সবাই মিলে নিহার প্রশংসা শুরু করলো।নিহার এখন লজ্জা লাগছে।এখান থেকে উঠে যেতে পারলে ভালো হতো কিন্তু এখন ওঠা যাবে না।হয়তো নিহার অস্বস্তি দূর করতেই ওর শ্বাশুড়ি বলল,’বউ মা আসো তো একটু এদিকে।’
নিহা স্বতঃস্ফূর্ত জবাবে বলল,’জ্বি,মা আসছি।’
নিহা শ্বশুর মশাই এর পাশ থেকে উঠে এসে শ্বাশুড়ির কাছে চলে গেলো।সাইদা খান নিহাকে বললেন,’ইফাজ উঠে নি?’
‘হ্যাঁ,মা।ফ্রেশ হচ্ছে।চলে আসবে।’
‘আচ্ছা।তুমি বসে পড়ো।নাস্তা করে ঘরে গিয়ে রেস্ট নিও।
‘ইফাজ আসুক মা।সবাই একসাথেই খাই।আলাদা খেতে ভালো লাগে না।’
‘আচ্ছা নাস্তা খেয়ে একটু রেস্ট করে নিও।পরে বেলা বাড়লে আত্নীয় স্বজন আসতে শুরু করলে কিন্তু পারবে না।আবার রেডিও হতে হবে।’
‘আচ্ছা মা।’
সাইদা বেগমের কথা শেষ হতে না হতেই ইফাজ চলে এলো।চারপাশে কয়েকবার চোখ বুলিয়েও মধুকে দেখতে পেলো না।আর কেউ না বুঝলেও নিহা বুঝতে পারলো ইফাজের অনুসন্ধানী চোখ কাকে খুঁজছে।স্বামীর চোখে অন্য নারীর প্রতি ভালোবাসা কোনো মেয়েই মেনে নিতে পারে না।তেমন নিহাও তবে ওর দৃঢ়বিশ্বাস একদিন ইফাজ ঠিকই ভালোবাসবে ওকে।
নিহা,ইফাজ,আর খালা,খালুরা একসাথে বসেই নাস্তা সেরে নিলো।নাস্তা শেষে ইফাজ কি একটা কাজের বাহানা দিয়ে বাইরে চলে গেলো আর নিহা ঘরে।ওদের নাস্তা করা শেষে ইরিন,মধু,ইয়াদ আর বাকি কাজিনরা এলো নাস্তা করতে।
——————
দুপুরের একটু আগে ইফাজ বাসায় এলো।ও আসতেই সাইদা খান বললেন,’এতো দেরি হলো কেনো?বেলা কিন্তু গড়াচ্ছে।তাড়াতাড়ি রেডি হ।’
‘আচ্ছা,মা নিহা কোথায়?’
ইফাজের কথা শেষ হতে না হতেই পেছন থেকে কেউ একজন খোঁচা মেরে বলল,’আসতে না আসতেই বউয়ের খবর চায়।কি বউ পাগলা রে।’
ইফাজের খুব কড়া করে কিছু একটা বলতে ইচ্ছা হলেও চেপে গেলো।সাইদা খান হেসে বললেন,’নিহাকে ওরা পার্লারে নিয়ে গেছে।’
‘ও,আচ্ছা।’এটা বলেই ইফাজ নিজের ঘরে চলে গেলো।
.
.
মেহমানে ভরে গেছে পুরো বাড়ি।রিসেপশন বলে কথা!মধু খাওয়া শেষ করে ইফাজ আর মধুকে যেখানে বসানো হয়েছে সেখানে চলে গেলো।এক কোণায় দাড়িয়ে সবার কান্ড কারখানা দেখছে।
কালকের মতো হঠাৎ করেই ওই ছেলেটাই কোথা থেকে যেনো এসে মধুর পাশেই দাড়ালো।মধু দেখেও চুপ করে সামনে তাকিয়ে রইলো।ছেলেটাই নির্লজ্জের মতো কথা বলা শুরু করলো।
‘হাই,কেমন আছেন?’
‘ভালো।’ মধু সামনে তাকিয়েই সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো।
‘আচ্ছা আপনি সিঙ্গেল?’
মধু এটা উত্তর দেওয়ার আগেই ইয়াদের গলা শুনতে পেলো।পাশে তাকিয়ে দেখলো ইয়াদ ছেলেটার কাঁধে হাতে দিয়ে আছে।মধুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে আবার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,’না ও সিঙ্গেল না।ওর বয়ফ্রেন্ড আছে।আমিই ওর বয়ফ্রেন্ড।সেই হিসেবে ও তোমার ভাবী হয়।সম্মান দিয়ে কথা বলবে।তুমি আমার একমাত্র ভাবীর ভাই হও তাই তোমাকে কিচ্ছু বললাম না।তা নাহলে এতক্ষণ হাসপাতালে থাকতে।’
এটা বলে ইয়াদ মধুকে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।আসলে ইয়াদও জানতো না ছেলেটা যে ওকে বিরক্ত করছে।এটা ইরিনের অবদান।কালকেও এই ছেলেটা মধুকে বিরক্ত করছিলো আবার আজকেও তাই ইরিনই গিয়ে ইয়াদকে বলেছিলো।কালকে।
চলবে….
#ডুবে_ডুবে_ভালোবাসি
#পর্বঃ২৮
#Arshi_Ayat
আজকে বিকেলে নিহার বাবা মা ওকে আর ইফাজকে নিয়ে গেছে ওদের বাড়ি।ইফাজ যেতে চায় নি কিন্তু না গেলেও ব্যাপারটা কেমন যেনো দেখায়।সেইজন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেলো।আজকে মধুরও হোস্টেলে ফেরার কথা ছিলো কিন্তু বের হবার সময়ই আকাশ কালো করে ঝুম বৃষ্টি এলো তাই আর ফিরতে পারে নি।
—————-
আজকে বৃষ্টি না থাকলেও সূর্যের তাপ নেই সকাল থেকেই।না রোদ, না বৃষ্টি এমন একটা অবস্থা।নাস্তা করে ইয়াদের সাথে বেরিয়ে পড়লো হোস্টেলের উদ্দেশ্যে।আজকে হোস্টেলে ফিরলেও কলেজে যাবে না।ইয়াদের সাথে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলো মধু।হঠাৎ রাস্তার অপর পাড়ে চোখ যেতেই মধু স্থির হয়ে গেলো।স্বয়ং আইরিন রহমান মধুর দিকে তাকিয়ে আছে।প্রায় চার/পাঁচ মাস পর দেখা।অনেক শুকিয়ে গেছে আইরিন রহমান।মধুর ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলেও নিজেকে কন্ট্রোল করে অন্যদিকে ফিরে হাঁটা ধরলো।ওইখান থেকে কিছুটা সামনে আসার পর মধু কান্না করে দিলো।ইয়াদ ওর চোখের পানি মুছে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত রাখলো।স্বান্তনার স্বরে বলল,’কেঁদো না প্লিজ।’ মধু নিজেকে সামলে নিলো।তবে চোখে মুখে যেনো বিষন্নতা জেঁকে বসেছে।হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে ইয়াদ মধুর হাত ধরে বলল,’একদম কান্নাকাটি করবে না।সাবধানে থাকবে।পারলে বিকেলে একবার আসবো।আর পড়াশোনার প্রতি সিরিয়াস হও।নিজের লক্ষ্যের কথা মনে আছে তো?’
মধু মাথা নাড়ালো।ইয়াদ মধুকে আরেকবার জড়িয়ে ধরে বিদায় দিলো।
ইফাজ নিহার রুমে বসে কফি খাচ্ছিলো।নিহা কফি ভালো বানায়।একটা আলাদা টেস্ট আছে।ইফাজ কফি খেতে খেতেই নিহার কর্মকান্ড দেখছে।নিহা লাগেজ গুছাচ্ছে।হঠাৎ করেই আজকে সকালে বলল হানিমুনে যাবে।ট্রেনের টিকিটও নাকি কেটে ফেলেছে কক্সবাজার যাবে।ইফাজ কিছু বলল না।ওর যা ইচ্ছা করুক ইফাজ বাঁধা দিবে না।
লাগেজ গুছাতে গুছাতে বলল,’ইফাজ রেডি হয়ে নাও।’
‘আচ্ছা।’
ইফাজ কফির খালি মগটা টেবিলের ওপর রেখে উঠে দাড়ালো।তারপর শাওয়ার নিয়ে রেডি হলো।এতক্ষণে নিহাও লাগেজ গুছিয়ে নিজেও রেডি হয়ে নিলো।ট্রেন ছাড়বে বারোটায়।এখন দশটা বাজে।এখনই বেরিয়ে পড়বে ওরা।যাওয়ার আগে শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে একবার দেখা করে যাবে নিহা তাই একটু তাড়াতাড়িই বের হলো।ইফাজদের বাড়িতে এসে ওর বাবা মায়ের সাথে দেখা করে স্টেশনে চলে গেলো।নিজেদের কেবিনে গিয়ে বসলো ওরা।ট্রেন কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়বে।নিহা জানে ইফাজের আসার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না।কিন্তু নিহার খুব ইচ্ছে ইফাজের সাথে কিছুটা সময় একান্তে কাটানোর।ছুটি শেষ হলেতো ইফাজকে ছাই দিয়েও ধরা যাবে না।তাই এই সুযোগটা ভালো করেই কাজে লাগালো নিহা।ব্যাপারটা ইফাজও ধরতে পেরেছে।কিন্তু সে নিরুপায়!আইনত নিহা ওর স্ত্রী!
ভেবেছিলো নিহাকে বিয়ে করলে কষ্ট কমে যাবে কিছুটা হলেও কিন্তু এ যেনো আগুনের ওপর আরো ঘি ঢালা হলো!কমছে তো নাই বরং আরো বাড়ছে!
——————
বেশকিছুদিন পরের কথা….
এইচ.এস.সি পরীক্ষার আর একমাস আছে।পড়াশোনায় আগের চেয়েও সিরিয়াস হয়েছে মধু।এখন কলেজে যায় না।হোস্টেলেই পড়ে।আর বিকলে ইয়াদ আসলে নিচে নেমে ওর সাথে পাঁচ/দশ মিনিট কথা বলে আবার ওপরে চলে যায়।
আজকে বিকেলে মধু পড়ছিলো মনোযোগ দিয়ে।কিন্তু কোথা থেকে যেনো হন্তদন্ত হয়ে আরিয়া ছুটে এলো।মধু ওকে এভাবে আসতে দেখে বলল,’কি হইছে রে তোর?কোথা থেকে আসলি এভাবে?’
আরিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’মধু আন্টি এক্সিডেন্ট করেছে।’
‘কিহ!কখন এক্সিডেন্ট করছে?কি হইছে আম্মুর?কোন হসপিটালে নিছে?’মধু উত্তেজিত কন্ঠে একের পর এক প্রশ্ন করছে।
আরিয়া কোনো কথারই উত্তর দিচ্ছে না।মধু গায়ে ওড়নাটা ভালোভাবে জড়িয়ে ওকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।হাসপাতালে পৌঁছে মধু মায়ের কেবিনে গিয়ে দেখলো মাথায় ও ডান হাতে আর দুই পায়ে ব্যান্ডেজ করা আর বাম হাতে স্যালাইন লাগানো।কয়েকজন লোক মধু আর আরিয়ার দিকে এগিয়ে আসলো।তাদের মধ্যে একজন বলল,’পেশেন্ট কি হয় আপনাদের?’
মধু চোখের পানি মুছে বলল,’আমার মা।’
‘উনি রাস্তা পার হতে গিয়ে অসাবধানতায় এক্সিডেন্ট করেছেন।তারপর আমারাই ওনাকে হসপিটালে এনেছিলাম।ওনার সাথে ফোন বা পরিচয় পত্র কিছুই ছিলো না।তাই আমরা কাউকে খবর দিতে পারি নি।’
মধু কিছু বলল না।আস্তে আস্তে গিয়ে মায়ের পাশে বসলো।আরিয়া ওনাদের ধন্যবাদ দিয়ে টিয়ে বিদায় করলো।
আসলে আরিয়াও জানতো না মধুর মায়ের এক্সিডেন্টের কথা।নিজের মায়ের সাথে হাসপাতালে আসার পর মধুর মাকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখে আরিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটেছে মধুকে খবর দিতে।
ঘুমের ঔষুধ দেওয়ায় আইরিন রহমান ঘুমাচ্ছিলো।ডাক্তার বলেছে ঘন্টা তিনেক লাগবে জ্ঞান ফিরতে।মধু আরিয়াকে আইরিন রহমানের পাশে বসিয়ে বাসায় গেলো মিলিকে নিয়ে আসতে।মিলিকে নিয়ে হাসপাতালে এসে দেখলো কেবিনের বাইরে ইয়াদ আর আরিয়া কথা বলছে।মধুকে দেখে ইয়াদ কিছুটা এগিয়ে এসে বলল,’চিন্তা করো না।আন্টি ঠিক হয়ে যাবে।’
মধু আরিয়াকে ইশারা করলো মিলিকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য।আরিয়া মিলিকে আইরিন রহমানের কাছে নিয়ে গেলো।ওরা ভেতরে যেতেই মধু ভীত বলল,’ইয়াদ আমার ভয় লাগছে।’
ইয়াদ মধুর হাত শক্ত করে ধরে বলল,’ভয় পেয়ো না।কয়েকদিন বিশ্রাম নিলে আন্টি ঠিক হয়ে যাবেন।’
‘হুম।’মধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবিনের বাইরে পেতে রাখা বেঞ্চিতে বসলো।
অবশেষে অনেক অপেক্ষার পর রাত নয়টায় আইরিন রহমানের জ্ঞান ফিরলো।মিলি বাইরে এসে মধুকে বলতেই মধু ডাক্তার ডাকলো।ডাক্তার এসে চেক আপ করে বাইরে এসে বললেন,’চিন্তা করবেন না।উনি এখন ঠিক আছেন।এখন শুধু বিশ্রাম নিতে হবে।আর ঔষুধগুলো কন্টিনিউ করতে হবে।’
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর ইয়াদ বলল,’তুমি ভেতরে গিয়ে আন্টির সাথে একবার দেখা করে আসো।’
‘না।আমি দেখা করবো না।’
‘মধু,গিয়ে দেখা করে আয়।আন্টি তোকে ডাকছে।’আরিয়াও বলল।
মধু যাবে না।কিন্তু শেষে ইয়াদ আর আরিয়ার জোরাজোরিতে ভেতরে গেলো।মধুকে দেখে আইরিন রহমান কাঁদতে কদতে বললেন,’আমাকে ক্ষমা করে দে মা।আমি তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি।আল্লাহ আমার অন্যায়ের শাস্তি আমাকে দিচ্ছে।তুই আমাকে ক্ষমা কর।’
মায়ের হাত ধরে মধু নিজের কেদে দিলো।কিন্তু তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে বলল,’বেশি কথা বলো না মা।তুমি অসুস্থ!ডাক্তার বিশ্রাম নিতে বলেছে।’
‘তুই আগে বল আমাকে মাফ করেছিস।’
মধু আইরিন রহমানকে জড়িয়ে ধরে বলল,’মা তো মা’ই।সন্তানের কাছে মা কখনো অপরাধী হয় না।তুমি ঘুমাও।’
তারপর আস্তে আস্তে মধু আবার আইরিন রহমানকে ঘুম পাড়িয়ে দিলো।অবশ্য ওষুধের ডোজের কারণেই আইরিন রহমান তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলেন।আইরিন রহমান ঘুমিয়ে যাওয়ার পর মধু বাইরে এসে ইয়াদকে বলল,’আপনি আরিয়াকে একটু ওর বাসায় পৌঁছে দিন।আমি আর মিলি আজ এখানেই থাকবো।’
‘আচ্ছা আমি আরিয়াকে পৌঁছে দিয়ে আবার আসবো।’
‘না,আপনি আর আসবেন না।বাসায় চলে যাবেন প্লিজ।’
‘আচ্ছা।’
বলে ইয়াদ আরিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।ওকে বাসায় পৌঁছে মিলি আর মধুর জন্য খবার কিনে আবার হাসপাতালে এলো।মিলি আইরিন রহমানের পাশে একটা চেয়ারে বসে ঘুমে ঢুলছে।আর মধু বাইরে পায়চারি করছে।মধু পায়চারি করতে করতেই দেখলো ইয়াদ আসছে।ইয়াদকে আসতে দেখে মধু এগিয়ে এসে বলল,’বাসায় যান নি?’
‘না,বলে দিয়েছি আজকে এখানে থাকবো।’
মধু বিরক্তি নিয়ে বলল,’আপনাকে বলি একটা করেন আরেকটা।’
‘আচ্ছা সরি,খাবার আনছি মিলিকে নিয়ে খেয়ে নাও।’
‘মিলিকে একটু আগে খেয়েছে আর এখন বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে।’
‘ও তাহলে তুমি খেয়ে নাও।’
‘খাবো,কিন্তু আপনি প্লিজ চলে যান।’
‘না,আমি এভাবে তোমাকে রেখে যেতে পারবো না।আন্টি অসুস্থ,মিলি ছোটো মানুষ ঘুমিয়ে গেছে।তুমি একা।কিছু একটা হয়ে গেলে আমার কিছু করার থাকবে না।নিজেকে স্বার্থপর মনে হবে।আমি মানতে পারবো না।তাই আমি এখানেই থাকবো।এখান থেকে না যাওয়ার অপরাধে যে শাস্তি দাও আমি মেনে নেবো।’
মধু এরপর আর কিছু বলল না।অদ্ভুত একটা ভালোলাগা কাজ করলো ইয়াদের জন্য।খাবার বেড়ে ইয়াদকে ইশারা করে খেতে বলল।ইয়াদের যদিও ক্ষুধা নেই তবুও খেলো।খাওয়া শেষ করে বলল,’তুমি ভেতরে গিয়ে বসো।আমি বাইরেই আছি।’
মধু ভেতরে গিয়ে বসলো।অনেক্ক্ষণ বসে থাকার পরও ঘুম আসছে না।এখন রাত ১টা বাজে।পুরো করিডোর ফাঁকা।শুধু ওদের কেবিনের সামনে ইয়াদ বসে আছে।মধু বেরিয়ে এসে দেখে ইয়াদ বসে বসে ফোন টিপছে।মধু পাশে এসে বসে বলল,’ঘুম আসছে না?’
ইয়াদ ফোন রেখে বলল,’না,তুমি ঘুমাও নি কেনো?’
‘ঘুম আসছে না।’
‘চা খাবে?’
‘এতো রাতে চা কোথায় পাবেন?’
‘ওয়েট তুমি বসো।আমি দেখছি।’
ইয়াদ মধুকে আর কিছু না বলতে দিয়ে চলে গেলো।ফিরলো প্রায় আধঘন্টা পর।হাত দুইকাপ চা।মধুর পাশে বসে ওকে এক কাপ বাড়িয়ে দিলো।মধু কাপটা হাতে নিয়ে বলল,’এতো রাতে চা কোথায় পেয়েছেন?’
‘নিচের তলায় বুয়াকে ঘুম থেকে তুলে তারপর ওনাকে দিয়ে বানাইছি।’
মধু চা’য়ে চুমুক দিয়ে বলল,’আপনাকে যে কেনো রামধোলাই দেয় নাই সেটাই বুঝতে পারছি না।’
‘রাম ধোলাই দিলে তুমি খুশী হতে?’
এভাবেই চা খেতে খেতে দুজনের আলাপ চলতে থাকলো।একপর্যায়ে চা শেষ হয়ে গেলেও আলাপ চলতে থাকলো।ভোর রাতের দিকে মধু ইয়াদের কাধের ওপর ঘুমিয়ে পড়লো।ইয়াদের এখনো ঘুম আসছে না।তাই ফোনে গেমস খেলতে লাগলো।
চলবে..
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)