টেস্টটিউব ৩য়_পর্ব
#লিখা:#Nilufar_Nijhum
আবির, তোর সাথে একটু কথা আছে,
– হ্যাঁ আম্মা বলো কি বলবা।
– বলছি, আমার তো বয়স হলো বাবা , এবার তো তুই ঘরে বউ নিয়ে আয়, আমিও নাতী নাতনীর মুখ দেখে যাই।
– কি যে বল আম্মা! এত তাড়াতাড়ি কই যাইবা তুমি? অনেক বছর বাঁচবে তুমি, বুঝছ?
– পাগল ছেলের কথা শোনো, আল্লাহ্র ডাক আসলে কারর কি আর থাকার জো আছে?
– তবুও তুমি এসব বলবানা। আমার ভাল্লাগেনা শুনতে। আমার আম্মা আমাকে রেখে কোথাও যাবেনা।
– আচ্ছা সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু এবার আমি সত্যি সত্যি ঘরে বউ আনতে চাই। তুই আর না করতে পারবিনা। তুই ভেবে দেখতো? তুই সকালে অফিস যাস, আসিস সন্ধ্যায়। আমার একা একা বাসায় কি করে সময় কাটে! এই বয়সে কি একা একা ভাল্লাগে? তাছাড়া এখন তো ভাল চাকরীও করছিস। আর তো কোন সমস্যা হওয়ার কথা না, তেমন হলে আমরা মেয়ে খুঁজি, আর যদি তোর খোঁজে থাকে বলতে পারিস।
– আম্মা তুমি এত বিয়ে বিয়ে করে পাগল হচ্ছো কেন!
– ও তুই বুঝবিনা! তার আগে বল, তোর চেনাজানায় কোন মেয়ে আছে কিনা ?
– আচ্ছা আম্মা,তোমার কি এখন বিয়ে দেয়ায় লাগবে? আর কয়টা দিন যাক না!
– নাহ, আমি আর একদিন ও অপেক্ষা করতে চাইনা। ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাবা মায়ের কত স্বপ্ন থাকে তুই বুঝবিনা।
– তাই বলে এত তাড়া!
– তোর এসব না না আমি আর শুনছিনা, অনেক হয়েছে আর নয়। এখন বল, তোর খোঁজে কি মেয়ে আছে? থাকলে বল, না থাকলেও বল। আমি তাহলে সেইভাবে খবর নিবো।
– আম্মা আছে, ও ভার্সিটিতে পড়ছে। ওরা চাইছিল পড়া শেষ করে বিয়ে দিতে। তাই বলছিলাম।
– তাতে কি! বিয়ের পরেও পড়বে। বিয়ের পরে কি কেউ পড়াশোনা করে না?
– তা নয়।
– তাহলে? শোন, ভালই হলো, মেয়ে যখন দেখায় আছে, আমরা শুধু গিয়ে দেখে, মেয়ের মা বাবার সাথে কথা বলে, উনাদের মতামত থাকলে পাকা দিন তারিখ করে আসি। তুই বাসার ঠিকানা টা দে , আমি তোর মামাকে আর ছোট কাকাকে নিয়ে যাব।
– এটা ওর বাসার ঠিকানা। তুমি গিয়ে পরিচয় দিবে। মেয়েটির নাম নীলা। আর ওর আম্মু সব জানে। তোমরা যেও কোন সমস্যা হবেনা।
তারপর দেখাশোনা শেষে, বিয়ের তারিখ ঠিক হয়। বিয়ে নিয়ে নীলার অনেক স্বপ্ন ছিল, রোজ রোজ স্বপ্ন দেখতো, কিভাবে বিয়ে হবে , কি রঙ এর শাড়ি পড়বে, আমি কি কি পরবো, সবকিছু! ওর পছন্দমতই ওর জন্য সবকিছু কেনাকাটা করা হয়।
বিয়ের দিন সারাদিনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে যখন ওকে বাসর ঘরে দেখি, মনে হয় একটা পুতুল বসে আছে! হালকা ঘোমটায় ওকে আরো বেশি মোহনিয়া করে তুলেছিল!
ও বাসর ঘরে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো, আমি রুমে ঢুকতেই বলে উঠে-
– এতক্ষণে আপনার আসার সময় হলো! সেই কখন থেকে একা একা বসে আছি!
– রাগ হয়েছে বুঝি? খুব তো বরকে আপনি আপনি বলা হচ্ছে!
– ঠিক ই বলছি।
– এখন তাহলে কি উপায়?
– জানিনা।
– আচ্ছা জানোনা যখন তখন আর কি! পাশের ঘরে গিয়ে ঘুমাই।
– খবরদার বলছি। এক পা গেলে খবর আছে।
– আচ্ছা যাচ্ছিনা তাহলে, হাজার হলেও দশ টা নয় পাঁচ টা নয় আমার একটা মাত্র বউ, তার কথা কি না শুনে পারি!
– আবার মজা করছো? আর দশ টা পাঁচ টা মানে? বউ আবার কয়টা হয়!
– কয়টা আবার?একটাই তো হয়।
– তুমিই তো এইমাত্র বললা!
– ও তো কথার কথা বলেছি! মজা বুঝোনা?
– হুম্ম তোমার ব্যাপারে আমি সব সময় সিরিয়াস, সুতরাং বুঝে মজা করবা, বুঝেছো?
– হু, হু সারাজীবন একটাই থাকবে।
– হু দুটোর কথা ভাবলে মেরে ফেলবো। মনে থাকে যেন?
– ওরে বাবা, এ কেমন বউ? বিয়ের রাতে বরকে মেরে ফেলার ভয় দেখায়!
– শোনো, এখন তো ভয় দেখাইতেছি, তেমন হলে আরো কিছু করতে পারি। তাছাড়া এতদিন যত জালাইছো, সব তার সুদে আসলে তুলে নিবো।
– আচ্ছা, ভালোবাসা টাও সুদে আসলে দিও তাহলে?
– ভেবে দেখবো।
ও এমনি ছেলেমানুষ ছিলো, সব সময় ওর কথার মধ্যে একটা দুষ্টুমি থাকতো- যা ওকে ভালবাসতে আমাকে বাধ্য করতো!
সেদিন যখন ওকে বলি-
– আচ্ছা শোনো, তোমাকে একটা কথা বলার আছে।
– একটা কথা কেন! হাজার টা বলো, আমিতো শোনার জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করে আছি।
– আসলে এটা তোমার বা আমার কথা নয়, এটা আম্মাকে নিয়ে।
– কি কথা?
– তুমিতো জানো, আম্মা তো একা মানুষ, বয়স ও হয়েছে। আব্বু মারা যাওয়ার পর উনি নিজের সুখ আহ্লাদের কথা ভাবেন নাই, মামারা চেয়েছিলেন আম্মা আবার সংসার করুক কিন্তু শুধুমাত্র আমার মুখের দিকে চেয়ে উনি কিছুই করেন নাই। বাবার কেনা এই বাড়িটা আর আমাকে সম্বল করে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন, এইগুলো মামা- মামীদের মুখে শুনেছি। তাই তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, তুমি আম্মাকে কখনো কষ্ট দিওনা। উনি বয়স্ক মানুষ কখনো কিছু ভুল বললে তার জন্য কষ্ট পেওনা। কারণ এতে আমার খারাপ লাগবে। এই কথাগুলো বলার কারণ হচ্ছে, তোমরা দু’জন মানুষই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তুমি কষ্ট পেলে যেমন আমি কষ্ট পাবো, তেমনভাবে আম্মা কষ্ট পেলেও কষ্ট পাবো। তোমার কাছে আমার এইটুকুই চাওয়া।
– আচ্ছা, চিন্তা করোনা, তুমি না বললেও আমি কখনো উনাকে কষ্ট দিতাম না। তাছাড়া তোমার মা তো এখন থেকে আমারো মা। আজকের পর আমি উনার কোন অযত্ন হতে দিবোনা। উনার সকল দায় দায়িত্ব এখন থেকে আমার।
নীলা সেদিন কথা দিয়েছিল, এবং সে কথা আজ পর্যন্ত সে রেখেছে। ও আজ পর্যন্ত আম্মাকে নিয়ে কোন অভিযোগ তোলেনি। আবার আম্মাও তাই।
কিন্তু ইদানীং এর ওর কথা শুনে আম্মা একটু বিচলিত বেশ বুঝতে পারি। আসলে উনার জায়গায় যে কেউ হলে আরো বেশিই করতেন। এই বয়সে নাতী নাতনীর জন্য অস্থির হবেন সেটাই স্বাভাবিক। উনি যে নীলা কে কম ভালবাসেন তা নয়। ভালবাসেন বলে বিয়ের এত বছরে বাচ্চা হচ্ছেনা দেখেও কখনো নীলা কে কটুক্তি করে কিছু বলেননি।
– আবির?
– হুম্মম, কি হলো, ঘুম ভেঙে গেল তোমার?
– হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কি সারারাত জেগেই ছিলে?
– নাহ, এমনি আর কি। তুমি উঠলে কেন! আর একটু ঘুমালেও তো পারতে?
– নাহ হঠাত কেন জানি ঘুমটা ভেঙে গেল! তাকিয়ে দেখি তুমি এখনো জেগে! আমাকে ঘুমাতে বলে নিজেই তো ঘুমাওনি। কি নিয়ে এত চিন্তা করছো বলতো?
– তেমন কিছুনা। তোমার আমার অতীতের স্মৃতিগুলো মনে পড়ে গেছিলো। কত সুন্দর ছিল দিনগুলো!
– হুম্মম ঠিক,অতীত-ই ভাল ছিল, কোন সমস্যা ছিলনা।
– আবার শুরু করলে? শোন, অতীতের কথা ভাবলে, আমার একটাই জিনিস পেতে ইচ্ছে করে,
– কি সেটা?
– আমার সেই আগের নীলাকে। যে সারাক্ষণ হাসতো, ছুটাছুটি করতো ,যে চঞ্চল মেয়েটিকে আমি ভালবেসেছিলাম, আমি ওকে খুব মিস করি।
– ওহ এই কথা! তারমানে আমি এখন সেকেলে হয়ে গেছি? আমাকে আর ভাল্লাগেনা?
– তা কেন! তবে অমন হলে ভাল হতো।
– ধুর, কি যে বল! এখন কি ওইসব ছেলেমানুষি করার বয়স আছে?
– কি এমন বয়স হয়েছে? তুমি আমার কাছে সব সময় আমার সেই পাগলিটাই থাকবে।
– সেটাই তো সমস্যা! ছাড়তে চেয়েও পারিনা। মায়ায় পড়ে যাই বারবার!
– বরের প্রতি মায়া থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
– কিন্তু তবুও নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয়, মনে হয় আমি শুধু নিজের সুখের কথায় ভাবছি!
– শোনো, এমনটা কখনো ভাববেনা। তুমিই আমার সকল পূর্ণতা।
– না আবির, তুমি যা বলছো তা ঠিক নয়,সন্তান একটা সংসারের সেতুবন্ধন, সেটা স্বামী-স্ত্রী বলো, আর শ্বশুর শাশুড়ি বল, এটাই সত্যি। তারচেয়ে, তুমি আমার কথা বুঝার চেষ্টা করো। আমার যতই কষ্ট হোক, তোমার ভালোর কথা ভেবে, এই সংসারের ভবিষ্যৎ এর কথা ভেবে, আমি মেনে নিব। তুমি বিয়ে কর, প্লিজ। আম্মাকে, মামাদের মেয়ে দেখতে বলো, আমি আম্মুদের বাড়ি চলে যাব। তারপর দেখে শুনে একটা চাকরী নিব, দিব্বি আমার জীবনটা কেটে যাব। তোমার সামনে থাকলে তোমার আমার দুইজনের কষ্ট হবে তার চেয়ে-
– কি বললে তুমি? নীলা এমন পাগলামি কথাবার্তা যদি সবসময় বলতে থাকো আমি সত্যি সত্যি কোথাও চলে যাব। আমাকে তখন খুঁজলেও আর পাবেনা।
– চুপ এমন কথা কখনো বলবেনা! কোথায় যাবে তুমি? তুমি গেলে আম্মাকে কে দেখেবে? তেমন হলে সবার ভালর জন্য আমিই যাব।
– তুমি কোথায় যাবে শুনি?
– কোথায় আর যাব। আমার তো যাওয়ার জায়গা ওই একটাই, বাবার বাড়ি। তুমি রেগে যেওনা। আমি বলছিলাম তুমি যদি আর একটাবার ভেবে দেখো-
– আমার যা ভাবার ভাবা হয়ে গেছে-
– কি ভেবেছো!
– তুমি আমি ডাক্তারের কাছে যাবো, ডাক্তারের পরামর্শ নিবো। দেখো নিশ্চয় ভাল কিছুই হবে।
– আবির আদৌ কি তা সম্ভব!
– কেন সম্ভব নয়? ডাক্তার তো নিজেই আমাকে বলেছেন সেই কথা? তুমি আম্মাকে ডাকো, আম্মাকে সবকিছু বলতে হবে।
– উনি কি এটা মেনে নিবেন!
– কেন নিবেন না? অবশ্যই নিবেন। যাও আম্মাকে ডেকে নিয়ে আসো- আমি রাতেই ফোন দিয়ে ডাক্তারের সিরিয়াল নিয়ে রেখেছি,যাও দেরি করোনা।
– আজকে অফিস যাবেনা?
– নাহ, ছুটি নিয়েছি।
– ওমা কখন?
– রাতেই।
– এতকিছু কখন করলে?
– ওইতো রাতেই। যাও আর কথা বাড়িও না। নাস্তা সেরে তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। উনাকে সব বলা আছে। প্রথম সিরিয়ালে তোমাকেই উনি দেখবেন।
– উনি কি মহিলা ডাক্তার?
– হুম্ম গাইনী বিশেষজ্ঞ।
– কিন্তু আমার কেন জানিনা ভয় করছে!
– কিসের ভয়?
#চলবে…