টরে-টক্কা পর্ব-০৫

0
1005

টরে-টক্কা – ৫

‘মেয়েদের কৌটো আফিমে ভরা, প্রকৃতি শয়তানি তার জোগান দেয়।’ এই তো পুরো কথাটা না শুনেই রেগে গেলেন? এই কথা কিন্তু আমি বলিনি। রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন। যারা জানেন না, তাদেরকে বলি, এই অকাট কিন্তু সর্বনাশী, ব্যাপকবিধ্বংসী বাক্যটা কবিগুরুর শেষের কবিতা নামক গ্রন্থ থেকে চয়ন করেছি! আমি রাফিন বললে বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু এখন রবীন্দ্রনাথ বলেছে বললে আপনারা আর কিছুই বলবেন না। বোবা হয়ে যাবেন। নারীকে হেয় করার অপবাদে চুড়ান্ত নারীবাদীরাও আমার ফাঁসি চাইতে পারবে না। আর কবিগুরু অত্যন্ত সঠিক কথা বলেছেন। তার প্রমাণ এই যে আমার সামনে। ইঞ্জিনিয়ার সৌরভ খন্দকার। এই গন্ধগোকুল পুরো খন্দকার বাড়ি উঠিয়ে নিয়ে এসেছে দীঘিদের বাসায়। আমরাও এই বাসার অঘোষিত সদস্য, তাই আমার এখানে উপস্থিত থাকাটাও খুবই স্বাভাবিক। সৌরভের মা, বাবা, বোন, দুলাভাই, মামা, মামি, ফুফু আরও কে কে জানি এসেছে। ঘরে জায়গা সংকুলান হচ্ছে না। আমার বসার জায়গাটাও বেদখল হয়েছে। কোমর ডুবে যাওয়া সোফাটায় এখন স্বয়ং গন্ধওয়ালা মর্তমান হয়েছে। আমার আক্ষেপ হচ্ছে। আমার জিনিস এই গন্ধওয়ালা কেন নেবে? আমার সবজিনিস এই ছেলে কেন নিয়ে নিচ্ছে? আমার আর কী কী নিয়েছে ও ভেবে বের করতে পারলাম না, তবে বসার জায়গাটাতো নিয়েছে। এত জায়গা থাকতে আমার বসার জায়গাটাতেই কেন তোকে বসতে হবে?

এখানে আসবার আগে এই গন্ধগোকুল আমাকে ফোন করেছে। ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করেছে ‘ভাইয়া, দীঘি কী পছন্দ করে?’
‘তুমি ফিসফিস করছ কেন?’
‘দীঘিকে সারপ্রাইজ দিতে চাই। ও অবাক হয়ে যাবে ওর সব পছন্দ আমি কীভাবে জেনে গেলাম! আপনার সাথে আমার কথা হচ্ছে এটা ও জেনে গেলে তো সারপ্রাইজ থাকবে না।’
‘তাহলে ফিসফিস করব আমি। তুমি কেন?’ আমিও ওর মতো ফিসফিস করে বললাম।
সৌরভের স্বর স্বাভাবিক হলো ‘ভাইয়া প্লিজ বলুন না, কী কী পছন্দ করে ও!’
আমি জানি এটা। কিন্তু একটু ভাব নিলাম। কেউ কিছু জানতে চাইলে সাথেসাথেই উত্তর দিতে নেই। প্রশ্নের সাথে সাথে উত্তর দিলে লোকে ভাববে উত্তরটা সহজ ছিলো। তাই একটু সময় নিয়ে, উল্টেপাল্টে ভাবের ওজন বাড়িয়ে তারপর উত্তর দিতে হয়৷ দশ মিনিট ফোন কানে নিয়ে ভাবলাম আমি। ভেবে ভেবে, অনেক ভেবে তারপর বললাম ‘তুমি আনবে লাল মিষ্টি, লাল গোলাপ, বম্বে সুইটসের চানাচুর আর আপেলরঙের শাড়ি।’
‘চমৎকার। কী সুন্দর চয়েস দীঘির। ওর মতোই এক্সক্লুসিভ! কিন্তু আপেলরঙটা কীভাবে চিনব?’
‘যেকোনো হাসপাতালের সামনে চলে যাও। সেখান থেকে এককেজি আপেল কিনে শাড়ির দোকানে যাবে। আপেলের রঙের সাথে ম্যাচ করে কিনে ফেলবে।’
‘কোন রঙের আপেল? লালটা নাকি সবুজটা?’
‘দুটোই নিয়ে আসো। সমস্যা কোনো?’
‘না না না কোনো সমস্যা নেই। মিক্সড কালার পেলে সেটাও একটা নিয়ে আসি। হয়তো ওটাই বেশি ফেভারিট হবে ওর!’

গাধা! এর নাম গন্ধগোকুল না হয়ে হবে গন্ধগাধা। গন্ধওয়ালা গাধা সমান গন্ধগাধা।
এই গন্ধগাধাকে লালমিষ্টি বলেছিলাম, ভেবেছিলাম সে আমার প্রিয় গোলাপজাম নিয়ে আসবে। কিন্তু সে নাকি বোঝেনি তাই লাল চমচম, কালোজাম, বালুসাই, পেড়া সব নিয়ে এসেছে, শুধু গোলাপজামই আনেনি।
এর একটাও দীঘির পছন্দ না। ও পছন্দ করে রসগোল্লা। রসে ভেজানো চুপচুপে নরম রসগোল্লা। আর ধবধবে সাদা মালাইচপ। গোলাপে ওর এলার্জি আছে। সব ফুলেই এলার্জি। বম্বে সুইটসের চানাচুর খেলে নাকি ওর মুখমিষ্টি হয়ে যায়। মনে হয় ভাজা আটা চিবিয়ে খাচ্ছে। ও পছন্দ করে ঝালঝাল রুচি বারবিকিউ চানাচুর। আর আপেল ওর দুইচোখের বিষ। আপেলের রঙও ওর অপছন্দ। আপেলরঙা জামা থেকেও নাকি হাসপাতালের গন্ধ পায় ও। আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘হাসপাতালের আবার গন্ধ কী রে?’
‘হয়তো ফিনাইল আর ওষুধের ঘ্রাণ। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় অসুস্থতার একটা ঘ্রাণ আছে। হাসপাতালের বাতাসে ওড়ে সেটা।’
ওর মনখারাপ করা গলা মনে পড়তেই আমারও মন খারাপ হয়ে গেল।

সর্বনাশের মাথায় বাড়ি!
এই মেয়ে করেছে কী? তুই কালো মেয়ে তুই পরবি কালো শাড়ি। তোকে গোলাপি শাড়ি কে পরতে বলেছে? আর এই শাড়িতে তোকে এত চমৎকার লাগতে হবে কেন? আমি বলি আপনাদেরকে, ওকে কেমন দেখাচ্ছে?
সকালের সূর্যটা ওঠার সময় যেমন আলো কেটে নরম হয়ে উঠে আসে, ঠিক তেমন দেখাচ্ছে দীঘিকে। আম্মু আর আন্টি ওর সাথে, ও আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে ওঘর থেকে এদিকে, আমার মনে হচ্ছে এদিকের সন্ধেটা মিলিয়ে গিয়ে এখনি ভোর হয়ে যাবে। দোয়েল শিস দেবে, মাছরাঙা ফিউ বলে উড়ে যাবে, দুটো ছোট্ট চড়ুই প্রভাতীসঙ্গীত গেয়ে উঠবে। মৃদু বাতাসে এখনি গন্ধগাধার হাতের বুকেটাতে আটকে থাকা ফুলগুলো নেচে নেচে ছড়িয়ে যাবে চারপাশে!

আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। এত নরম সকালসন্ধে একসাথে দেখে আমার বুকে ব্যথা হচ্ছে। চিনচিন চিনচিন একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি, বুকের বাঁপাশে। গোলাপি রঙের সাথে হৃদয়ের কী কোনো সম্পর্ক আছে?

আমার দিকে তাকালো দীঘি। এই মেয়ের চোখভরা জল কেন? ওর নাম দীঘি বলে? নামটা নদী হলে ভালো হতো। আমি ছলাৎ ছলাৎ একটা শব্দও শুনতে পাচ্ছি। চিনচিন করছে। গতকাল রাতেও এমনটা করেছিল। বুকের বাঁপাশে।

আমি ছাদে দাঁড়িয়েছিলাম। দীঘি এসেছিল খুব চুপিচুপি। কতটা চুপিচুপি জানেন? ও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আমি টেরই পাইনি। ফোঁস করে নাক টানার শব্দ পেয়ে লাফিয়ে উঠেছিলাম, এত ভয় পেয়েছিলাম। ইচ্ছে করেই মেয়েটা এগুলো করে। আমার সাথেই যত শয়তানি ওর। নাক টেনে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবি তো এত চুপিচুপি কেন আসতে হবে তোকে? ওর উদ্দেশ্য ছিলো আমাকে ভয় দেওয়া, সার্থক হয়েছে। আমি বুকে ফুঁ দিয়ে, তিনকুল পড়ে একটা ঝাড়ি মারলাম ‘ওই, তুই এখানে কেন?’
দীঘি তাকালো ওর টলটলে দুইচোখ নিয়ে। কচুপাতায় শিশিরফোঁটার মতো এক ফোঁটা জলও গড়িয়ে গেল ‘রাফিন, ওরা আমাকে পছন্দ করেছে।’
‘ভেরি গুড!’
‘গুড? আমি বিয়েটা করে নেবো?’
‘করবি না?’
‘তুই বললেই করে নেবো!’
আমি অবাক হলাম। আমাকে এত সম্মান দেওয়ার কারণ খুঁজে পেলাম না। নিশ্চয়ই কোনো ফাঁদ। আমি কি গাধা নাকি? আমি সব বুঝি। এগুলো হচ্ছে টরেটক্কা। মোর্স কোড। আপনি যদি জানেন কোডটা তাহলে যেকোনো মেসেজ চুটকিতে পড়ে ফেলতে পারবেন। আর যদি না জানেন, ঘোড়ার ডিমটাও বুঝবেন না। আমি তো বুদ্ধিমান ছেলে, সহজেই দীঘির টরেটক্কা ডিকোড করে ফেললাম। এটা হলো দোষ চাপানোর খেলা, পরে যদি সৌরভের সাথে বনিবনা না হয়, তখন যেন আমার ঘাড়ে দোষ চাপাতে পারে তাই এই ব্যবস্থা। কাঁদতে কাঁদতে নাক টানতে টানতে এসে চিকন সুরে মিহিগলায় বলবে ‘রাফিইইইন, তোর কথা শুনেই এই অবস্থা হলো আমার। তুই বলেছিলি সৌরভ ভালো ছেলে। তোর কথাতেই বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম! এখন আমার কী হলো! সব তোর দোষ!’

হু হু, আমি কি এত বোকা যে এই ফাঁদে পা দেবো? আমি বললাম ‘তুই ভাবনাচিন্তা করে দেখ। সৌরভের সাথে মেশ, কথাটথা বল কয়েকদিন।’
‘এই?’
‘আর কী?’
‘তুই কি আমাকে আর কিছু বলবি না রাফিন?’
‘কী বলব?’
‘আমাকে তোর কিছুই বলার নেই?’ অবাকগলায় বলেছিল দীঘি।
আমি তার চাইতেও বেশি অবাক হয়ে বলেছিলাম ‘আর কী বলব?’
নেমে আসার আগে সিঁড়িঘরের মুখে দাঁড়িয়ে ও আবার বলেছিল ‘রাফিন, ভেবে দেখ তুই কি আমাকে কিছু বলতে চাস?’
আমি নিশ্চিতভাবে তীব্রগতিতে ডানেবামে মাথা নাড়িয়েছিলাম ‘নাহ! না তো, কী বলব?’
কিন্তু কেন জানি না একটা নদীর ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দটা বুকের বাঁপাশে এসে ধাক্কা দিচ্ছিলো। চিনচিনে একটা ব্যথার মত।
দীঘির সাথে এই চিনচিনে ব্যথার কী সম্পর্ক?আপনারা ব্যাখ্যা করতে পারবেন?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে