টরেটক্কা -৮
বাসায় ঢুকেই আগে জুতো লুকালাম। আসলে জুতো না, জুতোর ভেতর মোজাজোড়া লুকিয়ে রাখলাম। মোজায় গন্ধ হয়েছে। আমার পা,আমার জুতো, আমার মোজা – তাতে গন্ধ হলে সেটা আমার সমস্যা। কিন্তু অন্যের সমস্যা নিজের মনে করে ত্রাহি ত্রাহি রবে ছুটে আসার জন্য বিপাশা আর দীঘি ডাইনিদুটো তো তৈরি। ওদের মতো বসে বসে পায়ে ক্রিম ঘষার আলগা সময় কি আমার আছে? ব্যস্ত মানুষ আমি, বুঝতে হবে। আর সপ্তাহে কতবার মোজা পাল্টাব?
দুপা নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে একগাদা মেয়েকন্ঠের খিলখিল হাসি শুনে ইউটার্ণ নিয়ে বিপাশার ঘরে উঁকি দিলাম। যা ভেবেছি তাই, এখানে আড্ডা বসেছে। তিনটে মেয়ে। বিপাশা, দীঘি আর একটা কে যেন আছে। আমি গম্ভীর কন্ঠে হাঁক দিলাম ‘কী রে বিপাশা, এত আওয়াজ কেন? প্রাইম মিনিস্টার আসছে নাকি? স্লোগান দিচ্ছিস?’
বোনেরা নাকি খুব ভাইভক্ত হয়। এতবড় মিথ্যা কথাটা যে আবিস্কার করেছিল তাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করে। কাছে পেলে দামড়া ব্যাটার তুলে নিতাম চামড়া। এই যে আমার কথাটা মাটিতে পড়ার সময় পেল না বিপাশা চিড়িয়াখানার খাঁচায় আটকে পড়া পাতিশেয়ালের মতো খ্যাঁক করে উঠল ‘তোকে কি আমরা লিফলেট বিলিয়ে ডেকে এনেছি? দেখছিস আমরা মেয়েরা মেয়েরা কথা বলছি, তোকে এখানে কে আসতে বলল?’
বিপাশার কথায় আমি গুরুত্ব দিলাম না। দীঘি আর বিপাশার স্বভাব একইরকম। এদেরকে পাত্তা দিলেই মাথায় উঠে উল্টোপল্টন নৃত্য করবে। তাই, এদের দুজনের একজনকেও আমি গুরুত্ব দিই না। এখন তো আরও দিলাম না। আমার দৃষ্টি অন্যদিকে। মাহী। দীঘির কাজিন। আগে কয়েকবার দেখা হয়েছে। আমি গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে চেষ্টা করেছি। বিশেষ পাত্তা পাইনি। মনে মনে মাহীকে নিয়ে একটা কবিতা ভাবার চেষ্টা করলাম, আফসোস একটা ছন্দও এলো না। মাহী, দিলে না মোরে একটা কবিতা! কবিতা না পাওয়ার আফসোস নিয়েই আমি মাহীর দিকে এগিয়ে গেলাম। বিপাশা, দীঘি, মাহী তিনজনেই আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, আমি দিগন্তবিস্তৃত হাসি দিয়ে বললাম ‘ও মাহী, ও মাহী তুমি আমার রাহী!’
মাহী হেসে ফেলল। কয়েকশো কোটি মণি-মুক্তা ঝরিয়ে বলল ‘অনেক লেইম ছিল, রাফিন ভাই। আপনার মতোই লেইম!’
‘ওহ মাহী তোমার ঠোঁটে লেইম বলে হলেও আমার নামটা শুনতেই কত ভালো লাগে, তা যদি তুমি জানতে।’
‘আপনি ফ্ল্যার্টও করতে পারেন না, রাফিন ভাই। না পারাটা সমস্যা না। সমস্যা হলো, আপনি মনে করেন আপনি খুব ভালো ফ্ল্যার্ট করেন!’
‘চমৎকার! মাহী, ও মেরি রাহী, তুমি কী ভালো বিশ্লেষণ করলে! আসলেই আমি খুব খারাপ ফ্ল্যার্ট করি। তুমি বললে এটাও ছেড়ে দেবো।’
‘এ্যাট ফার্স্ট, নামের সাথে এই ছন্দ মিলানো বন্ধ করেন।’
‘ওকে ডান! তুমি যা বলবে তাই। এবার বলো তো, এতদিন কোথায় ছিলেন, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন!”
‘জোর করেই মিলিয়ে দিলেন?’
‘মিলতেই তো চাই!’ আমি চোখ টিপে দিলাম।
‘মনের কথা এটা?’ মাহী ফিরতি চোখ টিপে দিলো।
‘মনটা যদি খুলে দেখাতে পারতাম…’ আমি চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়লাম আর এমন একটা মুখের ভাব করলাম যেন হৃদয়টা খুলে মাহীর সামনে রাখতে পারছি না বলে আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে।
‘তাহলে কী হতো? কী দেখতে পেতাম সেখানে?’ মাহীর চোখেমুখে চপল হাসি।
‘তুমি জানো না? সত্যিই তুমি জানো না?’ বিস্ময়ে চোখ কপালে নিলাম আমি।
মাহী ঠোঁট উল্টালো।
“কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো
সে কথা তুমি যদি জানতে
এই হৃদয় চিঁড়ে যদি দেখানো যেতো
আমি যে তোমার তুমি মানতে”
দুকলি গান গেয়েও দিলাম। মাহী লজ্জা পেয়ে হেসে উঠে বলল ‘রাফিন ভাই, বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!’
বিপাশাও পাশ থেকে চিৎকার করে উঠল ‘যা তো ভাইয়া। তোর কাজে যা।’
‘এখন থেকে আমার কাজ শুধু মাহী!’ আমি চোখ ফেরালাম না মাহীর দিক থেকে।
মাহীও হাসল আমার কথায় ‘রাফিন ভাই প্লিজ!’
বুঝলাম মেয়ে অর্ধেক পটে গেছে অথবা আগে থেকেই সিকিভাগ পটে কাবার, আমার এপ্রোচ করার অপেক্ষায়ই বসে ছিল।
দীঘির দিকে আড়চোখে তাকালাম। পুরাকালে ভস্মদৃষ্টি বলে একটা কথা ছিল। ব্রাক্ষ্মণকে ক্ষেপালে তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে তাকালে সামনে থাকা সাধারণ মনুষ্য সেই তেজী চোখের দৃষ্টিতেই পুড়ে ছাই হয়ে যেত। দীঘির দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো, এখন যদি সেই সত্যযুগ হতো তবে এতক্ষণে আমি রাফিনের বদলে কেজিকয়েক রাফিনপোড়া ছাই পড়ে থাকত এখানে। অভূত আনন্দ হলো আমার। আনন্দের কারণ জানি না তবে আনন্দের আতিশয্যে ভ্রম হতে থাকল পিঠের পেছন দিয়ে সত্যি সত্যিই দুটো ডানা গজিয়ে উঠেছে হয়তো। খুব ফুরফুরে লাগছে। আমার গানটা ফেরত এসেছে। “দরজা খুইলা দেখুম যারে… তারারারা…।’
তারারারা করতে করতে সোজা আম্মুর ঘরে এসে উপস্থিত হলাম। আম্মু মোবাইলের ভেতর ঢুকে আছে। অনলাইন শপের প্রডাক্ট প্রমোশন লাইভ হচ্ছে। ভাবলাম শাড়ি, কিন্তু তা না, ওই যে শারারা না গারারা না ঘাগড়া কী এক জিনিস আছে না সেই জিনিসের লাইভ। আম্মু কি এখন এই জিনিস কিনবে? নিজের জন্য? পরবে? আমি শুকনো ঢোঁক গিললাম। দীঘি আর বিপাশাকে পরতে দেখেছি ওই জামা। একদম আলিফ লায়লার মালিকা হামিরার মতো দেখায়। মাকড়সা টেনে এনে ‘আকরাম, আকরাম’ বলার অপেক্ষা শুধু।
তাও আমি কিছু বললাম না। এই বয়সে এসে শারারা গুল, সোফান ইজবা সাজার শখ হয়েছে, শখ পুরো করুক। শখের তোলা নাকি আশি টাকা। তাহলে কেজি কত? যাকগে, আপাতত ওসব ভাবাভাবির কাজ নেই আমার। আমি সটান আম্মুর পাশে শুয়ে পড়লাম। আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল ‘কী রে কিছু বলবি?’
আমি একটু নাকিস্বরে আহ্লাদ করার চেষ্টা করলাম ‘আম্মু, ও আম্মু?’
‘বল?’
‘আম্মু, বিয়ে করব!’
আম্মু বিশেষ পাত্তা দিলো না। মোবাইলে চোখে ফিরিয়েছে ততক্ষণে। সেদিকে তাকিয়েই বলল ‘বিয়ে করবি? আচ্ছা।’
‘আচ্ছা না মা। সময় নেই।’
‘সময় কোথায় যাচ্ছে?’
‘সময় কোথাও যাচ্ছে না। মানুষের হায়াত ময়ুতের কথা কি কিছু বলা যায়? এই আজ আছি কাল দেখবে নেই। আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি যে ছেলের বউ না দেখেই যদি তুমি মরে যাও, আমার আফসোসের সীমা থাকবে না। আমার বউকে পাবদা মাছের পানি পানি ঝোলের রেসিপিটা হ্যান্ডওভার করার পরে তুমি মরতে পারো, আমার সমস্যা নেই।’
আম্মু সোজা হয়ে বসল। কঠিন চোখে তাকালো আমার দিকে। এইরকম কঠিনচোখে তাকানোটা মনে হয় ফিমেল জেন্ডারের সাথে অটোইন্সটল করা। ফাংশনিংটাও মনে হয় অটোমেটিক। কথা বলে শেষ হলো না, চোখ কঠিন।
‘বিয়ে করবি, মেয়ে পছন্দ আছে তোর? আমাদের পছন্দ তো তোর পছন্দ হয় না।’
‘হুম।’
‘কে?’
‘মাহী!’
আম্মু আমার দিলে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল ‘খোকা? যাকে সামনে পাবি তাকেই বিয়ে করবি, এমন কোনো প্রতিজ্ঞা করেছিস তুই? বিয়েটাও ছেলেখেলা তোর কাছে?’
আমার ‘দরজা খুইলা দেখুম যারে… ‘ আম্মু কীভাবে বুঝে গেল আমি জানি না তবে দ্বিগুণ আহ্লাদ করে বললাম ‘কেন মা, মাহী কি ভালো না? ফুটফুটে একটা মেয়ে!’
‘তুই গতকাল রাতে বলেছিস নিচতলার নিপাকে বিয়ে করতে চাস। বলেছিলি ফুটফুটে একটা মেয়ে নিপা! সকালে অফিস যাওয়ার আগে বলে গেছিস তোর চাচার মেয়ে সুবর্ণাকে বিয়ে করবি। তাকেও তোর ফুটফুটে মেয়েই মনে হয়েছে। এখন মাহীকেও ফুটফুটে মেয়ে মনে হচ্ছে তোর কাছে। তোর সমস্যা কী আসলে?’
‘আম্মু, মাহী ফাইনাল। অফিসিয়াল ডিসিশন। তুমি লক করে দাও।’
আম্মু আমার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল ‘এমন ফাজলামো করে জীবন চলে, খোকা? তুই ঠিকঠাক সিদ্ধান্ত নে। সময় নে। আমরাও মাহীর পরিবারের সাথে কথা বলি।’
‘ভাববার সময় নেই মা। দীঘির বিয়ের আগেই আমি বিয়ে করতে চাই।’
মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেললাম কেন বুঝতে পারছি না। আম্মু চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সেভাবেই তাকিয়ে বলল ‘দীঘির সাথে তোর কী, খোকা?’
আমিও মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আসলেই তো দীঘির সাথে আমার কী? ওর বিয়ে হওয়ার সাথে আমার বিয়ের সম্পর্ক কী? দীঘি ছাড়া অন্য কিছু, অন্য কাউকে কেন ভাবতে পারি না আমি? দ্বিতীয় কোনো নারীকে ভাবতে গেলেও ভাবনার মাঝে দীঘি কেন এসে উপস্থিত হয়? জামার দোকানের পাশ দিয়ে যেতেযেতেও কোন রঙের জামাটাতে দীঘিকে মানাবে সেই প্রশ্ন কেন মনে আসবে আমার? আইসক্রিমভ্যান পাশ দিয়ে গেলেও দীঘির ফেভারিট ফ্লেভারের দিকে কেন চোখ যাবে? আমার সমস্ত চেতনাজুড়ে দীঘির সরব কোলাহল কেন?
আম্মুর কিংবা আমার মনের কৌতুহল পাশ কাটিয়ে গেলাম আমি। আম্মুর পা টিপতে টিপতে বললাম ‘পিচ্চি একটা মেয়ে, বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমার বউ হচ্ছে না। ব্যাপারটা আমাকে ভাবাচ্ছে। এটা আমার জন্য অসম্মানজনক মনে হচ্ছে। কেমন একটা এম্বারাসিং ব্যাপার যেন। আম্মু আমি মাহীকেই বিয়ে করব। তুমি আব্বুকে বলো। কথা ফাইনাল করো।’
‘আরে আস্তে আস্তে। এত তাড়া দিলে কীভাবে হবে?’
এবারে আম্মুর পায়ের উপর শুয়ে পড়লাম আমি ‘না আম্মু। আস্তে হবে না। খুব তাড়াতাড়ি। আংটিফাংটি না। একেবারে বিয়ে। কবুল। রেজিস্ট্রি।’
আম্মু আমার দিকে তাকিয়েই থাকল।
আম্মুর বিস্ময় উপেক্ষা করে আমি নিজের ঘরে চলে আসলাম। সবকিছুই আমার ইচ্ছেতেই হচ্ছে, কিন্তু বুকের কোথাও একটা টনটন করছে। ব্যথাটা টের পাচ্ছি আমি, কিন্তু ঠিক কোথায় ব্যথার উৎস সেটাই খুঁজে পাচ্ছি না…!
চলবে…