টরেটক্কা -৭
দরজা খুলেই দেখুম – ব্যাপারটা এত সহজে হলো না। দরজা খুললাম, জুতো পরলাম, নিচে নেমে দীঘিদের বাসার সামনে রাখা ময়লার বালতিতে লাথি দিয়ে সেটা উলটে দিলাম, রিকশায় চড়লাম, বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে রিকশাওয়ালাকে বিশ টাকা ভাড়া দিলাম, তারপর বাসে চড়ে বসলাম, হেলপার ভাড়া চাইতে এলে একহাজারের একটা নোট বের করে দিলাম। চকচকে নোট দেখে ও ব্যাটা মুখ বেজার করে বলল ‘ভাংতি দেন!’
আমিও মাছখাওয়া বেড়ালের মত মুখ নামিয়ে বললাম ‘ভাংতি নাই!’
‘বিশ টাকার জন্য একহাজার টাকা ভাংতি দিমু? খুচরা দেন?’
‘কীসের বিশ টাকা? স্টুডেন্ট। হাফ পাস। দশ টাকা।’
হেলপার বেজির মত মুখ করে তাকালো ‘স্টুডেন? কই পড়েন?’
‘এমবিএ পড়ি!’ বিরসমুখে তাকালাম আমি।
‘কাড আছে?’
দুইবছর আগে থেকে ননভ্যালিড আইডিকার্ড বের করে দেখালাম। হেলপার চলে গেল। দশ টাকার জন্য হাজার টাকার নোট ভাংতি করে দেবে না ও।
অমনি আমাকে গালাগাল দিলেন তো? আমাকে নিয়ে সমালোচনা শুরু করে দিলেন তো? কী আর করবেন? সমালোচনা ব্যাপারটাই বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। একটু গন্ধ পেলেই হয়েছে মানুষের চরিত্রের পোস্টমর্টেম শুরু করে দেবেন। ছাড়েন এই স্বভাব বুঝেছেন? পরচর্চা না করে নিজের চর্চা করেন। জীবনে সাফল্য পাবেন। বুঝেন না, আমার কি টাকার অভাব? মাস গেলে এক তারিখে গরম গরম স্যালারি একাউন্টে জমা হয়ে যায়। ফ্রি খাই বাপের হোটেলে, থাকিও গ্যাঁট হয়ে। সমস্যাটা কোথায় জানেন? টাকা খরচের জায়গা পাচ্ছি না। একটা বউ না হলে টাকা খরচের হাতটা ঠিক আসছে না। হাজার টাকার আস্ত নোটটা রাতে আমার সাথেই বাড়ি ফিরে চামড়ার ওয়ালেটের ভাঁজে পড়ে পড়ে ঘুমোয়। বউ থাকলে এটা সম্ভব হতো বলেন? দীঘির মতো একটা ঠোঁটে ঘষার রঙের কাঠি কিনেই হাজার টাকা নামিয়ে দিতো না? এই রঙের কাঠি কেনার জন্য হলেও একটা বউ এখন মারাত্মক দরকার। দীঘি যখন সাজে, ঠোঁটে যত্ন করে লিপস্টিক দেয়, আমি তখন ওর দিকে তাকাই না। ভয়াবহ সব ইচ্ছে জাগে ওর দিকে তাকালেই। সেই ভয়ে আমি ওর লিপস্টিকরাঙা ঠোঁটের দিকে চোখ দিই না। হাজারটাকা দিয়ে একটা ঠোঁটরাঙানি কিনতে আমার কষ্ট লাগবে কিন্তু দীঘির ঠোঁটের মতো ওইরকম রাঙাঠোঁটে আদর দিতে হলেও একটা বউ আমার মারাত্নক দরকার!
রাতের গানটা মাথায় গুনগুন শুরু করে দিয়েছে ‘দরজা খুলে দেখুম যারে… তারারাররা…তারারারা….’
আমার তারারারা থামল অফিসে ঢুকেই। বুঝলাম, রাতের গানটায় কিঞ্চিৎ ভুল হয়েছে। ‘দরজা খুলে দেখুম যারে…’ এমন হবে না, গানটা হবে ‘অফিস ঢুকে দেখুম যারে, করুম তারে বিয়া! তারাররারা…!
অফিসে ঢুকেই হৃদপিণ্ড আট রিখটার স্কেলে একটা ঝাঁকি খেল। ইতিকবিতিক সুন্দরী নাদিয়াকে দেখে। নাদিয়া। কলিগ নাদিয়া ইসলাম। ভিজে চুল খুলে চেয়ারের পেছনে মেলে দিয়েছে। গোসল করে এসেছে, চুল শুকানোর আগেই বেঁধে ফেলে অফিসে এসেছে। ভেজা চুলগুলো এখন ফ্যানের বাতাসে শুকোচ্ছে। কলম কামড়াচ্ছে সাথে। মুখ চোখ কঠিন অবস্থা। কঠিন কঠিন মুখ দেখেই আমার মনে গান বাজতে শুরু হলো ‘নাদিয়া? ও নাদিয়া? তুনে মেরে দিল লে লিয়া!’
আমি একটা চেয়ার টেনে বসলাম ওর সামনে। সুন্দর করে ডাকলাম ‘ও নাদিয়ায়ায়া…’
গোমড়ামুখো নাদিয়া তাকালো না। না তাকিয়েই বলল ‘রাফিন ভাই আপনি কালকে কলম ফেরত দেন নাই। এর আগের কলমটাও ফেরত দেন নাই। কলম দেন?’
‘শোনো নাদিয়া’ আমি থামলাম।
নাদিয়া তাকালো। উফ, করাতের মত ধার চোখে। আমার হৃদয় শত শত টুকরো হতে থাকল। সেই শত শত টুকরোগুলোকে ফুলঝাড়ু দিয়ে ঝাট দিয়ে একজায়গায় এনে আমি বললাম ‘অস্তাগফিরুল্লাহ। তওবা, তওবা। আমাকে একটা সামান্য কলম দিয়ে তুমি টেনশন করছ? সামান্য একটা কলম? আগে বলোনি কেন?’
‘আচ্ছা, দেন এখন।’
‘আমি কথা শেষ করিনি নাদিয়া। আমি বলতে চেয়েছি, আমাকে কিছু দিয়ে টেনশনের কিছু নেই। আমি কিছু নিয়েছি তো নিজে দায়িত্ব নিয়ে ভুলে যাবা৷ কেননা যা আমি নিই, ফেরত দেওয়ার রেকর্ড নেই। আমি ভুলে গিয়েছি, তুমিও ভুলে যাও।’
ইতিকবিতিক সুন্দরী মুখটাকে আরও গোমড়া করে বলল ‘ফিচলামি রাখেন রাফিন ভাই। এইগুলা এখন না আপনার বয়সের সাথে যায় না আপনার ডেসিগনেশনের সাথে। এইগুলা বাদ দেন আর আঞ্জুমান আরার ফাইলটা খুঁজে বের করেন?’
আমি চিন্তিত হলাম। আঙুল দিয়ে ঠোঁট খোঁচাতে খোঁচাতে বললাম ‘কোন আঞ্জুমান আরা?’
‘ভাই, একটু তো রহম করেন? সিনিয়র সিটিজেন, ছেলেমেয়ে কেউ নেই। এক নাতনি নিয়ে বারবার আসা তার পক্ষে সম্ভব না। তার কাজটা করে দেন ভাই।’
‘ও ওই আঞ্জুমান আরা?’ আমার মনে পড়ল ‘চোখট্যারা নাতনি আছে যার? সে তো সই মিলাতে পারছে না৷ সই মিলাতে না পারলে আমি কী করব? আমি তো নিয়মের কাছে অসহায়। তুমি তো জানো আমি আপসহীন অফিসার, নীতিবান ও…’
‘থামেন রাফিন ভাই। আসল কথা আপনি ফাইলটা হারিয়ে ফেলেছেন। কোথায় আর যাবে? অফিসেই আছে। একটু হাত চালু করেন। খুঁজে ফেলেন৷’
মেয়েটা শুধু গোমড়ামুখোই না, অপ্রিয়ংবদাও বটে। আমার তারারারা হালে পানি না পেয়ে সুর কেটে গেল। নিজের ডেস্কে আসতে আসতে নাদিয়া আবার ডাকল ‘আর শোনেন এইভাবে কাউকে চোখট্যারা, কানা বলবেন না, কানে বাজে। আফটার অল আপনি শিক্ষিত একটা মানুষ। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না রাফিন ভাই, প্লিজ!’
আমার হৃদয় আবার বিগলিত হয়ে গেল। তারারারা বেজে উঠল সাতসুরে। ‘কিছু মনে করব কেন? তুমি আমাকে যা ইচ্ছা বলতে পারো। একমাত্র তুমিই আমাকে যা ইচ্ছা বলতে পারো। বলতে পারো, বকতে পারো, ঝগড়াও করতে পারো। তোমার অধিকার আছে। আমার উপরেই তোমার অধিকার আছে।’
ইতিকবিতিক সুন্দরীর চোখ আবার সরু হয়ে এসেছে ‘আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না!’
আমি দুই কাঁধ একটু উঁচু করলাম। বুঝালাম ‘বুঝলে বুঝপাতা, না বুঝলে তেজপাতা!’
‘রাফিন ভাই…’ একটু নরম যেন শুনালো নাদিয়ার গলা। কলকল ঝর্ণার নেমে যাওয়ার টুংটাং শুনতে পাচ্ছি ‘আমার কেন জানি মনে হয় আপনি এগুলো ইচ্ছে করেই করেন। এই কলম নিয়ে ফেরত দেন না, রিকশাওয়ালার সাথে পাঁচ টাকার ভাড়া নিয়ে ঝগড়া করেন, কাজের ফাইলগুলোতে উদাসীনতা দেখান, অকারণে গাছের পাতা ছেড়েন, কী একটা কথা বলেন দুনিয়া না আদুনি; এগুলো নিজেকে কুল প্রমাণ করতে করেন বলেই আমার ধারণা। আপনি লোকটা এতটাও ফটকাটাইপ নন বলেই মনে হয় আমার।’
‘কইছে তোরে!’ মনে মনে বলে, বিগলিত হয়ে গদগদ হয়ে পড়েছি একদম, এমন একটা ভাব চেহারায় ফুটিয়ে তুলে বললাম ‘আমার মনের ভেতরটা কি তুমি পড়তে পারো নাদিয়া? কীভাবে? আমাকে আর কেউ বোঝে না জানো?’
নাদিয়া এক্সট্রিম লেভেলের আবেদনময়ী একটা হাসি তুলে বলল ‘আপনাকে একটা কথা বলতে চাই রাফিন ভাই। অনেকদিন বলতে চেয়েও বলতে পারিনি। লজ্জা করেছে। সংকোচ হচ্ছে। কীভাবে বলব বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু আর না বললে হবে না বুঝতে পারছি।’
আমি চোখ বন্ধ করে দুইকান উৎকর্ণ করে শুনতে আগ্রহী হলাম। দিল নেওয়া নাদিয়া খানিক ইতস্তত করে বলল ‘আপনি টাকা ধার নিয়ে ফেরত দেন না রাফিন ভাই। চারমাস আগে নিয়েছেন পাঁচহাজার টাকা। আমার খুব দরকার ,বুঝতেই পারছেন। নইলে এইভাবে চাইতাম না।’
আমার ফুলে ওঠা হৃদয়টা সুন্দরী নাদিয়ার কথার আলতো খোঁচায় ফুস করে দম বেরিয়ে চুপসে গেল। এমন ছ্যাঁকা আমার আগে অন্য কোনো পুরুষকে হজম করতে হয়েছে কিনা জানি না। কষ্ট তো পেয়েছিই তার সাথে আরও একটু অভিনয় মিশিয়ে আমি খুবই আহত হয়েছি এমন ভঙ্গি করে বললাম ‘এই সামান্য ব্যাপার? তুমি বললে আমি আকাশের চাঁদটাও টেনে নিয়ে আসতে পারি। এতো সামান্য পাঁচ হাজার। আচ্ছা যাও, নেক্সট উইকের ডে ওয়ান ফার্স্ট আওয়ারে পেয়ে যাবা।’
আমার কথায় দিল ফেরত দিয়ে দেওয়া নাদিয়া আশ্বস্ত হলো। বলল ‘থ্যাংকিউ রাফিন ভাই।’
আমি নিজের ডেস্কে এসে বসতে বসতে নাদিয়াকে বলা সকালের কথাগুলোই মনে মনে রিপিট করলাম ‘আমি কিছু নিয়েছি তো নিজে দায়িত্ব নিয়ে ভুলে যাবা৷ কেননা যা আমি নিই, ফেরত দেওয়ার রেকর্ড নেই। আমি ভুলে গিয়েছি, তুমিও ভুলে যাও…’
চলবে…
Afsana Asha