টরেটক্কা – ৪
কী নাম এই গাছের কে জানে। না নারকেল গাছ, না খেঁজুর গাছ, না কলাগাছ। নিচের থেকে দেখলে মনে হয় নারকেল গাছ, উপরে কলাপাতা মাথা দুলায়ে নাচে। তা নাচুক কিন্তু রেস্টুরেন্টে এই গাছের কাজ কী? নৃত্য পরিবেশন করবে? আমি এখনি এই গাছের ম্যানেজারকে ডেকে জানতে চাইব ‘হোয়াই? এই গাছ এইখানে কেন? হোয়াট? এই গাছের কাজ কী?’
এই গাছের জন্য কমলালেবু আর গন্ধওয়ালাকে দেখতে পাচ্ছি না। ওদেরকে প্রাইভেসি দিয়ে আমি একটু দূরে একটা টেবিলে বসে আছি। মুখ দেখতে পাচ্ছি না কারো, এই নারকেল নাকি খেঁজুর নাকি কলাগাছের জন্য। মুখ না দেখলেও হাত নাড়ছে এটা দেখতে পাচ্ছি। কমলালেবু হাতে চুড়িও পরেছে। বোঝেন অবস্থা!
একেবারে হাতভরে। পরবি পর, শখ হইছে চুড়ি পরার, দুইহাতে মিলায়ে দুটো চারটে নাহয় পরলি। শখ মেটানোর দরকার আছে। তাই বলে এভাবে কনুই পর্যন্ত চুড়ি পরে হাত নাড়ানোর কী দরকার? মেয়েটার স্বভাব খারাপ হলেও মিষ্টি আছে। হাতটাও নাড়ছে কী মিষ্টি করে। একবার চুড়িগুলো সব কনুইতে গিয়ে আটকাচ্ছে আবার হাত ঘুরালে কব্জিতে এসে থেমে যাচ্ছে! অতীব মিষ্টি দৃশ্য। আমার চোখ আটকে আছে। দুষ্টু নারীর সব কাজই মিষ্টি। এই মিষ্টি কাজের দুষ্টু নারীর ফাঁদে ওই গন্ধওয়ালা আটকে যাচ্ছে। বেশ মজাই লাগছে আমার। আমি বেঁচে যাচ্ছি যে ফাঁদে সেই ফাঁদে অন্য কেউ আটকে যাচ্ছে, নিজের বুদ্ধিতে আনন্দ হবে না, বলেন?
এখন জানতে চাইতে পারেন আমি কীভাবে বুঝলাম, গন্ধওয়ালা আটকে যাচ্ছে? পুরো তেতাল্লিশ মিনিট দুজনে বকবক করেই যাচ্ছে। আটকে না গেলে এতক্ষণ কথা বলতে পারে কেউ?
ওরে, কত কথা বলেরে এরা। কথার ফ্যাক্টরি আছে না কি পেটের ভেতর? বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে…। যেন কৃষ্ণার শাড়ি, ব্যাটা দুঃশাসন টানছে, খুলছে, খুলছে, টানছে – কিন্তু সখা মাধব তো, কাপড়ের কল সেট করে দিয়েছে তার সখির গায়ে, দুর্যোধনের একশো ভাই এসে টানলেও ও শেষ হওয়ার নয়! তেমনি এদের কথাও শেষ হচ্ছে না।
তেতাল্লিশ মিনিটে আমি চার বোতল কোল্ড ড্রিংকস শেষ করে ফেলেছি। চার নম্বর বোতলের তলায় একটুখানি পেপসি অবশিষ্ট আছে। স্ট্রটা ঢুকিয়ে আমি সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে বাতাস টেনে খেতে খেতে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
এইযে ভুল ধরার জন্য বসে আছেন তো? আচ্ছা যান, ওদের দিকে তাকিয়ে নেই আমি ওই কমলালেবুর হাতের দিকে তাকিয়ে আছি। চুড়ির নাচানাচি দেখছি।
চুড়ি কিন্তু এই মেয়ে সবসময় পরে না। আজকেই পরে এসেছে। এই পু বিদায়দেওয়া ব্রিটিশ সভ্য ব্যাক্তিকে পটাতে। সেদিনও সোহরাওয়ার্দীতে ঢুকেছিল একটা মেয়ের সাথে। সেদিন কিন্তু চুড়ি পরেনি। মিথ্যা বলব না, আমি মাঝেমাঝেই ওকে স্টক করি। পাশাপাশি বাড়ির মেয়ে। আমার ছোটো বোনটারই বয়সী। কই যায়, কী করে এসব একটু দেখার চেষ্টা করি। এসবে আপনারা কিন্তু কিছু আবার অন্য কিছু ভেবে নেবেন না। একদম না, না মানে নো, নেভার!
তো সেদিনও গেলাম। দেখি কি একটা বান্ধবিকে বগলদাবা করে নিয়ে সোহরাওয়ার্দীতে ঢুকছে ওই খান্ডারনি। ঠিক বগলদাবা না পাশাপাশি। আমিও পিছুপিছু গেলাম। পিছু নেওয়ার কারণ আছে। সাথে ছুকড়ি কিন্তু আমি শিওর ছোকড়াঘটিত কোনো ব্যপার আছে। নইলে, দুটো মেয়ে এতজায়গা বাদ দিয়ে গাছের আড়াল, ঝোপঝাড় খুঁজতে কেন যাচ্ছে? একবার যদি হাত
হাতেনাতে ধরতে পারি তো, সকালবিকাল আব্বু আম্মু যে ওর পা ধোয়া পানি খাওয়ায় আমাকে সেইটা বন্ধ হবে। খুশিতে আমি হাততালি দিয়ে উঠলাম। সেটাই কাল হলো। ওর হচ্ছে ডাইনির কান। পাতার সরসর শব্দেও বলে দিতে পারে কোনদিকে হাওয়া বইছে। ওরা দুজনে ঘাসের উপর জুতো রেখে বসার আয়োজন করেছিল, ডাইনিটা উঠে এলো আমার দিকে। কটকটি রাণীর মতো চোখ পাকিয়ে বলল ‘ওই রাফিন, তুই এখানে কী করিস?’
আচ্ছা বাড়িতে যা করে, করল। তুইতোকারি করতে মন চায় করে। আমি কিছু মনে করি না। একটা অতি সভ্য আর ভদ্র ছেলে আমি। কিন্তু খোলামাঠের ভেতর দাঁড়িয়েও তুই আমাকে তুই বলবি? চারবছরের বড় আমি তোর থেকে। আপনারা বিচার করবেন কিন্তু!
কিন্তু নিজের ভদ্রতার খাতিরে রাগটাকে শান্ত করে বললাম ‘এসেছি?’
‘কেন এসেছিস সেটাই তো জানতে চাচ্ছি?’ চোখের উপর হাত নাচালো ও। জানেন না আপনারা, আস্ত একটা বেয়াদব মেয়ে তো!
এবারে আমার মনে নর্তনকুঁদন শুরু হলো। ভয় পেয়েছে শঙখিনিটা। হেসে বললাম ‘তোর কাহিনির রেকর্ড টেলিকাস্ট করব বলে!’
‘আমি আমার বান্ধবীর সাথে এসেছি। তোর কী সমস্যা? এখানে রেকর্ড করার কী আছে?’
‘এত জায়গা থাকতে ঝোঁপের আড়ালে? বান্ধবী রিপ্লেস হয়ে বন্ধু হতে কতক্ষণ? হিহিহি!’ কটকটির মুখটা দেখে আমার এত হাসি পাচ্ছিল!
‘আমি এক থেকে তিন গুণব এর ভেতর তুই তোর লম্বা পাগুলো নিয়ে চলে যাবি।’
‘হুহ! না গেলে কী করবি?’
‘কী করব? কী করব?’ রাগে টমেটোর মতো ফুলছিল ও। কিছু না পেয়ে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে বলল ‘এটা তোর মাথায় ঢালব।’
আমি দাঁত বের করে হাসতে থাকলাম। এখন আর রেকর্ড করার মতো কিছু হবে না এখানে। ওরা সাবধান হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি কেন যাব? আমি গেলেই তো ছোকরাটা এসে যাবে আর ওদের ইঞ্চিমিঞ্চি শুরু হয়ে যাবে। আমি গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
‘এক দুই…’ কটকটি গুণছে।
‘হেহ!’ মুখ ভেঙিয়ে হাসলাম আমি।
‘রাফিন আমি তিন গুণব। যাবি তুই?’
‘গুণে ফেল। পারিস না? আমি গুণে দিচ্ছি… তিন!’
এই যে বললাম না মেয়েটা এত মিষ্টি আসলে মিথ্যা কথা। একেবারে মিনারেল ওয়াটারের মতো টেস্টলেস মেয়ে। এই টেস্টলেস মিনারেল ওয়াটার সত্যি সত্যি আমার মাথায় পানি ঢেলে দিলো। আমি হাত দিয়ে মুখের পানিটা মুছে ওর বোতলটা ওর হাত থেকে নিয়ে পুরো বোতল ওর মাথার উপর উপুর করে দিয়ে, দৌড়ে বের হয়ে গেলাম সোহরাওয়ার্দী থেকে।
আচ্ছা বাইরের ঝগড়া তুই বাইরেই রেখে আয়। সোহরাওয়ার্দীর পানিখেলা তুই বাড়ি বয়ে আনবি? তা সবটা নিয়ে আয়। অর্ধেক কেন বললি? আব্বু আমাকে ডেকে বলল ‘তুই কি গাধা আছিস রাফিন? একটা মেয়েকে হুমকি দিয়ে বলা যায়, পানি ঢেলে দেবো কিন্তু তুই সত্যি সত্যিই ওর মাথায় পানি ঢেলে দিলি? রাস্তায় ও কতটা লজ্জা পেয়েছে ভাবতো! সবাই তাকিয়ে দেখছিল ওকে!’
বোঝেন, মেয়ে হয়েছে বলেই তালগাছ ওর? রাস্তায় মানুষ আমার দিকে, আমার ভেজা টিশার্টের দিকে তাকিয়ে ছিলো না? হুহ!
তালগাছ তো নিয়েছেই এখন এই কলা-খেঁজুর-নারকেল গাছটাকেও আড়াল বানিয়ে আড্ডা দিয়েই চলেছে। ওকে কেউ ছোটোবেলায় শেখায়নি, অচেনা মানুষের সাথে এত কথা বলতে নেই?
বাসা থেকেও ফোন আসছে পাঁচমিনিট পরপর। আম্মু ফোন করে জিজ্ঞেস করল ‘এই রাফিন কী করছেরে ওরা?’
‘কথা বলছে।’
‘কী বলছে?’
‘আমি কি শুনছি না কি?’
বিপাশা ফোন করেছে ‘ভাইয়া কী করছে রে ওরা?’
‘কথা বলছে।’
‘কী বলছে শুনতে পাচ্ছিস?’
‘হ্যাঁ। মাইক লাগিয়েছে তো!’
আন্টি মানে দীঘির মা ফোন করল ‘আব্বু,ওরা কী করছে?’
আমি হাই তুলে বললাম ‘কথা বলছে।’
‘কী মনে হচ্ছে, পছন্দ করবে?’
‘ভালোই তো, লম্বা আছে, চেহারাও খারাপ না। পছন্দ না করার তো কিছু নেই। তবে যদি সত্যি বলতে বলেন তো এতটাও ভালো না। মানে আমার আশেপাশে এই ছেলে কিছুই না। আমি যেমন ম্যানলি, স্মার্ট, হ্যান্ডসাম। এই ছেলেতো ফর্সা। ছেলেরা আমার মত ডার্কটোনড না হলে মানায় বলেন? এই ছেলে তো সাদা। মেয়েদের মতো সাদা। সাদা রঙটা ছেলেদের সাথে যায় না। ছেলেরা হবে শ্যামলা, কালো…’
‘আব্বু, দীঘিকে কি সৌরভ পছন্দ করবে?’
‘কী বলেন আন্টি এইটা? দীঘিকে পছন্দ করবে না কেন?’
‘কী বলছে ওরা কিছু শুনতে পাচ্ছ?’
‘না আন্টি, আমার জায়গা থেকে কিছু শোনা যাচ্ছে না।’ উদাস হলাম আমি।
‘আল্লাহ ভরসা। ছেলেটা ভালো হবে তাই না?’
আমি ফোন কেটে দিলাম। পিচ্চি একটা মেয়ে। মাত্র অনার্স শেষ হলো, এই মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য এত ব্যস্ত হলো কেন এরা কে জানে? আর মেয়েটাও আছে, বাপ মা বিয়ে ঠিক করেছে বলেই ঢ্যাঙঢ্যঙ করে ছেলে দেখতে চলে এলি? অচেনা একটা ছেলে। চেনা হলেও কথা ছিলো। চেনা ছেলেদের ভেতর থেকে যে কাউকে চোখবন্ধ করে বিয়ে করে ফেলা যায়!
দীঘিকে নিয়ে বাসায় ফিরেছি, রাত একটায় সৌরভ ফোন করল ‘ভাইয়া, দীঘি কি কিছু বলেছে?’
ঘুমজড়ানো গলায় বললাম ‘দীঘি একটা বাচাল মেয়ে। সারাদিন বকবক করা ওর প্রধান কাজ। ও কিছু নয়, অনেককিছুই বলে ফেলেছে। আপনি কি স্পেসিফিক কিছু জানতে চাইছেন?’
‘না মানে আমার কথা কিছু বলেছে? আমাকে পছন্দ করেছে?’
খাইছে, মনে মনে বললাম, এই ছেলে তো অলরেডি লাট্টু হয়ে গেছে। বালিশ কোলে নিয়ে উঠে বসলাম ‘সৌরভ, আপনি কি দীঘিকে পছন্দ করেছেন?’
‘ভাইয়া আমাকে তুমি করে বলবেন।’
আচ্ছা বললাম ‘সৌরভ তুমি কি দীঘিকে বিয়ে করতে চাও?’
‘ভাইয়া, দীঘিকে না পেলে আমি মরে যাব।’
তো মরে যা! এমন মেজাজ খারাপ হলো আমার। আপনারা বলেন রাতদুপুরে একটা প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে যদি এমন ছ্যাবলামি করে তাহলে মেজাজ খারাপ হয় না? আপনাদের হতো না?
মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করে বললাম ‘তাহলে আমাকে না বলে দীঘিকে বলো, তোমার বাবা মাকে বলো। একটা সিক্রেট শেয়ার করি তোমার সাথে। দীঘিকে যতটা ভালো দেখেছ ও এতটা ভালো না। বেশি বলব না, একটা দোষ বলি শুধু। শি চেঞ্জেস হার মাইন্ড, এজ অফেন এজ উই ব্লিংক আওয়ার আইজ! বুঝেছ?’
‘জি ভাইয়া।’
‘এসব মেয়ের উপর মোটেও ভরসা করা যায় না। বিয়েতে রাজি, নেচে নেচে বিয়ের শপিং করতে যাবে। এক শাড়ি, দুই শাড়ি, তিন শাড়ি। আর্টিস্ট ওয়াটার কালার প্যালেটের মতো চোখের পাতা রঙ করার প্যালেট কিনে ঘর ভরে ফেলবে কিন্তু এন্ড মোমেন্টে গিয়ে বলবে বিয়ে করব না। মুডসুইং হচ্ছে! এদেরকে ভরসা করা খুব শক্ত। আমার কি মনে হয় জানো?’
‘বলেন ভাইয়া!’
‘এইসব মেয়েদেরকে বিয়ে করাই ঠিক না। ইনফ্যাক্ট কোনো মেয়েকেই বিয়ে করা ঠিক না। বিয়ে করাই উচিত না। বুঝেছ?’
আমি জানি এই গন্ধগোকুল আমার কথা কিছুই বোঝেনি। আপনারা কি বুঝতে পারছেন, আমি কী বলতে চাইছি? কী বোঝাতে চাইছি?’
চলবে…
Afsana Asha