টরেটক্কা-৩
‘রাফিন তুই দশমিনিটে কী কী খেয়েছিস জানিস? একটা দুইজনের স্যুপ, চারটে অন্থন, দুইমগ কফি। আশ্চর্য। এখন একটা লোক আসবে, যাকে কোনোদিন দেখিনি। পরিচয় নেই কোনো। সে এসে তোর ফেলানো এই মেস দেখবে?’
‘তুই খাচ্ছিস না তো আমি কী করব? আর তাড়াতাড়ি টেবিল ক্লিন করার জন্যই তো তোরটাও খেয়ে নিলাম। জানিস তো, নার্ভাস হলে আমার খিদে পায় বেশি।’
‘তুই কেন নার্ভাস হবি? নার্ভাস লাগার কথা আমার। কই আমি তো মোটেও নার্ভাস না।’
আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, মেয়েটা তিরতির করে কাঁপছে, হাতের তালু ঘামছে, নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বারবার টিসুতে ঘেমে যাওয়া নাক মুছছে। অথচ মুখে স্বীকার করবে না। না করল! ওর টাকায় খাচ্ছি এটাই অনেক। এর জন্য খানিকসময় ওর রঙঢঙ দেখে নিতে আপত্তি নেই। এই যে ক্রিমি ক্রিমি দুইমগ কফি সেঁটে দিলাম এটাকে আমি দীঘির ঘেমে যাওয়া নাক মোছার দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখার পারিশ্রমিক হিসেবেই নিলাম।
দীঘি কাঁপতে থাকল, আমি পা নাচাতে থাকলাম। পা নাচাচ্ছি, হাত নাড়ছি, মিনিট দুইয়ের মাঝে একটা ছেলে এসে আমাদের টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। আচ্ছা, একটা ছেলে যখন একটা মেয়ের দিকে তাকায়, কী দেখে সবার আগে? যাহ, কী ডার্টি মন আপনাদের! ট্রিটমেন্ট করান তো! মানসিক স্বাস্থ্য অনেক জরুরি বিষয়। অবহেলা করা একদমই ঠিক না। শুধু পচা কথাই ভেবে যে নিলেন, আপনাদের মানসিক স্বাস্থ্যের রুগ্নদশা অনুমান করে আমার তো রীতিমতো আতঙ্ক হচ্ছে! আসলে ওরকম কিছু না। আমরা ছেলেরা সবার আগে দেখি মেয়েদের চোখ। চোখে চোখ রাখি। কিছু কিছু চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিই আর কিছু চোখে চোখ পড়লে চোখ ফেরানো দায়। এই দ্বিতীয় দলে দীঘিকে ফেলে দেওয়া যায়। এমন কোমল আর জন্মকাজলটানা চোখে টুপ করে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে যেন কোনো কাকচক্ষু পুকুর! এই ছেলেটাও মনে হয় ডুবে গেল, আমাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে দীঘির দিকে তাকিয়ে বলল ‘হ্যালো, আমি সৌরভ। আর যদি ভুল না করি আপনি দীঘি। আমাদের এখানে মিট করার কথা। আমি কি বসতে পারি?’
ছেলের নাম সৌরভ। হতেই হবে। ভুরভুর করে পারফিউমের ঘ্রাণ আসছে। হুহ, সে তো আমার ড্রয়ারেও তো ওয়ান ম্যান শোএর পুরো একটা বোতল আছে। আমি এমন টপাটপ মেয়েদের মতো সুগন্ধি মেখে বেড়াই কখনো?
দীঘি চট করে সালাম দিলো ‘আসসালামু আলাইকুম।’ দীঘির কন্ঠ এত রিনরিন করে বাজল যে আমি অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে, আসলে দীঘিই কি আমার পাশে? এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে ও? আমার ধারণা ছিলো ওর প্রতি একটা কথার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে একইসাথে একটা করে বজ্রপাত হয়। কড়াৎ!
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি বসতে পারি এখানে?’ সুগন্ধওয়ালা জানতে চাইল। আরে বেটা আগে একবার অনুমতি চেয়েছিস তো। না বলেনি মানে অনুমতি পেয়ে গিয়েছিস। তুই তো ব্রিটিশদের চাইতেও বেশি ফরমাল! এত ফরমালিটি নিয়ে কী করিস তুই? পু করে ফ্ল্যাশ করার আগে কমোডের ফেলা জিনিসগুলোকেও বাই বাই, গুড বাই বলিস নাকি?
হাতে কাঁটাচামচ নিয়ে খেলছিলাম, তাড়াতাড়ি জায়গামতো রেখে দিলাম। নইলে এই ব্রিটিশ সুগন্ধওয়ালা আমাকে অসভ্য ভেবে বসতে পারে। আপনারা এইটুকুতে ভাববেন না যেন এই গন্ধওয়ালা অতিসভ্য কেউ। সে যে অতি অসভ্য সেটা তার পরের কথাতেই আমি বুঝে গেলাম। মুখে টানটান হাসি আর চোখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে এই গন্ধওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে বলল ‘উনি?’
আমি কিছু বলার আগেই দীঘি বলল ‘আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে।’
যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর। দেখছেন আপনারা এই মেয়ের সাথে সিকিউরিটি গার্ডের মতো বসে আছি আর এই মেয়ে ফরমাল ইনট্রোডাকশন তো দিলোই না। শুনুন পরের কথাটা কী বলল? আপনারা বিচার করবেন কিন্তু! আমার দিকে না তাকিয়ে মিষ্টি ডাবল ইনফিনিটি হাসি দিয়ে বলল ‘রাফিন ভাইকে নিয়ে সংকোচের কোনো কারণ নেই। আপনি যা ইচ্ছে বলতে পারেন। যেমন ইচ্ছে জানতে চাইতে পারেন। মনে করবেন এখানে সে নেই। সে থাকা আর না থাকা একইরকম। তাই না রাফিন ভাই?’
আমার দিকে তাকিয়ে এই মেয়েটা এবার যে হাসিটা দিলো, একে মিষ্টি টু দ্য পাওয়ার ইনফিনিটি ইনফিনিটি বলে দেওয়া যায়। এত মিষ্টি হাসি কোথা থেকে আসে তোর? তুই কি টুথপেস্টের ব্র্যান্ড এম্বাসেডর। তোর বাপের মিষ্টির দোকান আছে? চিনিস না জানিস না, একটা লোকের সামনে দাঁত বের করে খিকখিক খিকখিক! ফিকফিক ফিকফিক!
গন্ধওয়ালা তাড়াতাড়ি বলল ‘আসসালামু আলাইকুম, রাফিন সাহেব। ভালো আছেন আপনি? আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল। আমি সৌরভ খন্দকার। ইঞ্জিনিয়ার সৌরভ খন্দকার।’
নামের আগে ইঞ্জিনিয়ার লাগাইলি কেন ব্যাটা গন্ধওয়ালা? তো আমি কী বলব? আমি রাফিন। বাড়িওয়ালা রাফিন আহমেদ? কিন্তু সেটা তো বলা যায় না। আমি ভদ্র মানুষ। আপনারা তো এতক্ষণে সেটা বুঝেই গেছেন, তাই না? এত বেশি ভদ্র বলেই করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে বললাম ‘আমি রাফিন। রাফিন আহমেদ। ফ্যামিলি। দীঘির বন্ধু।’
সৌরভ কথা বলতে ইতস্তত করছে। আমার উঠে যাওয়া উচিত। কিন্তু কেন জানি উঠতে ইচ্ছে করছে না। গন্ধওয়ালার যা মনে আসে ভেবে নিক, যা ইচ্ছে হয়, ভাবুক। আমার এখানেই বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। মাথার ভেতর কিছু একটা জ্বলছে। অদ্ভুত একটা জ্বালাপোড়া হচ্ছে। আশেপাশের কোলাহল ভালো লাগছে না। সবকিছুই কেমন অসহ্য লাগছে। কেন এরকম হচ্ছে বুঝতে পারছি না। আপনারা কি বুঝতে পারছেন কিছু? আমার এমন কেন লাগছে? আচ্ছা, এমন না তো ব্যাপারটা? আয়হায় আমি কি ঠিক ভাবছি? এটা কীভাবে হয়? এটা আমি কী ভাবছি?
হুম, কী ভাবছি বলি আপনাদেরকে? আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা শাড়িতে। মানে দীঘি যে শাড়িটা পরে আমার এবং এই গন্ধওয়ালার সামনে বসে আছে। সমস্যা এই শাড়িতে। আই মিন শাড়ির রঙে!
কমলা রঙের একটা শাড়ি পরে আছে দীঘি। আপনারাই বলেন, কমলা কোনো রঙ হলো? কমলা হলো একটা ফল। খোসা ছিলবি। বিচিগুলো ফেলে দিয়ে টপাটপ গিলে ফেলবি। লবণ আর কাঁচামরিচ দিয়ে ডলে কী একটা ভর্তা বানায় বিপাশা, মেয়েলি খাবার যদিও কিন্তু বেশ লাগে।
নাহয় ভর্তা করেই খেয়ে ফেলতি। কিন্তু তুই একটা আস্ত ফল পরে কেন বসে থাকবি? ফল কি পরার জিনিস? ওরে গাধা, ফল খেতে হয় বুঝেছিস?
কী মনে হচ্ছে আমার এখন, বলি? মনে হচ্ছে একটা কমলালেবু চোখের সামনে বসে আছে!
না, ভাবুন একবার, কল্পনা করে দেখুন তো, একটা কমলালেবু, গোলগাল, টসটসে একটা সুস্বাদু কমলালেবু আপনার সামনে বসে আছে আর হাত নাড়িয়ে, চোখ নাড়িয়ে কথা বলছে। মাঝে মাঝে মিষ্টি টু দ্য পাওয়ার ইনফিনিটি ইনফিনিটি টাইপ হাসি দিচ্ছে। হাসির ছটায় কানের দুলের পাথর ঝিকিমিকি করছে। কেমন ক্রিপি না ব্যাপারটা? চোখ বন্ধ করে ভেবে দেখে বলবেন। তখন বুঝবেন আমার এখনকার অবস্থাটা!
বললে বিশ্বাস করবেন না, এই মিষ্টি কমলালেবু আবার শাড়ি মিলিয়ে কপালে টিপ দিয়েছে। আরিব্বাস মাথার খোঁপায় কতকগুলো মুক্তোও লাগিয়েছে। এই বড় বড় মুক্তো। টিকটিকির ডিমের চাইতে বড় সাইজের। মানে কী? ঝিনুক কত কষ্ট করে বুকের ভেতরে মুক্তো পোষে। গানটা শুনেছেন না আপনারা? ওই যে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর লেখা
“পুষে রাখে যেমন ঝিনুক
খোলসের আবরণে মুক্তোর সুখ”
সেই অতি কষ্টের মুক্তোর দানাগুলো মাথায় লাগিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ফ্যাফ্যা করে হাসতে পারে কোনো মানুষ? পারে, মানুষের জায়গায় কমলালেবু হলে পারে!
দীঘির এই শাড়িটা চুরি করব আমি। তারপর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেবো। পোড়ানোই উচিত। এরকম কমলালেবুর মতো কেন লাগতে হবে ওকে? মেয়েরা হবে মেয়েদের মতো, সে কেন কমলালেবুর মতো সুন্দর হবে?
এই রূপসী কমলালেবুটার দিকে তাকালে আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ করছে।
একটা গোটা কমলালেবু বসে বসে কমলার জুসে চুমুক দিচ্ছে, এই দৃশ্যটা দেখেই আমার মাথার ভেতর তুষের আগুন গুনগুন করে জ্বলছে, তাই না বলেন আপনারা? ঠিক তাই। অন্য আবার কী হবে?
চলবে…
Afsana Asha