ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৩৪
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
সকালের দিকে বেলী নিজ হাতে সব কিছু করে । নাস্তা বানানোর কাজে ব্যস্ত সে । বেলীর শ্বশুর আজ চলে যাবেন গ্রামে । ওনার জন্যেও রান্না করতে হবে । এদিকে ইরফানেরও অফিস আছে । সব মিলিয়ে প্রচুর ব্যস্ত সে ।
সকালের নাস্তার ঝামেলা মিটিয়ে নিয়েছে বেলী । স্বামী এবং শ্বশুর উভয়ের জন্যে নাস্তা রেডি করে টেবিলে সাজিয়ে রেখে দিয়েছে বেলী । মিনুও হাতে হাতে সাহায্য করে দিচ্ছে বেলীকে । অন্যদিকে সকালে ইরফান রেডি হবে , তবে সে তার প্রয়োজনীয় জিনিস খুৃঁজে পাচ্ছে না । সেখানেও বেলীকে তলব করে সে । বেলী আবার রান্নাঘরের কাজ ফেলেই দৌড় দেয় ইরফানের কাছে । সব মিলিয়ে ঘুড়ির মত উড়তে হয় বেলীকে সকালের সময়টা । ইদানীং ইরফান বেলী ছাড়া কিছুই বুঝে না এবং বুঝতেও চায় না । তার সব কিছুতেই বেলীকে চাই । বেলী না হলেই তার চলেই না অনেকটা ছোট বাচ্চাদের মত (তীর ছাড়া যেমন তাদের চলেই না) তেমনি ইরফানের বেলাতেও তাই হয়েছে । ইরফানের ডাকে সে রুমে আসে ।
– ডেকেছিলেন ?
– জ্বি আপনি কোথায় থাকেন ।
– আপাতত রান্নাঘরে ছিলাম ।
– আমার ওয়ালেট কোথায় ?
– ড্রয়ারে ,
– আমার লাল ফাইলটা কোথায় ?
– ড্রয়ারে কালকে তো নিজেই রাখলেন ।
– ওহ ,
– এইবার যাই ?
– নাহ , টাই বেঁধে দিয়ে যাও ।
ইরফানের ছোট ছোট আবদার গুলো বেলীকে বড্ড বেশি বিরক্ত করে তবুও সে চুপ করে থাকে । বহু কষ্টের পর ইরফানের ভালোবাসা পেয়েছে সে । এই ভালোবাসা হারাতে চায় না বেলী । তাই লক্ষী মেয়ের মত ইরফানের সামনে দাঁড়িয়ে ইরফানের বুকের উপরে হাত উঠিয়ে ইরফানের টাই ঠিক করে দেয় বেলী । আর ইরফান মনে হয় এই সুযোগটার অপেক্ষাতেই ছিল । ঝট করেই বেলীর কোমড় জড়িয়ে ধরে ইরফান । বেলী একটু নড়ে ওঠে ইরফানের এইভাবে ছোয়াতে ।
– কি হলো , কারেন্টের শক খেলে নাকি , এইভাবে কেঁপে উঠলা যে ?
– আমি তো বুঝতে পারছি ?
– কিহ ,
– আপনি এইসব করার জন্যেই আমায় দিয়ে টাই বাঁধান ।
– হা হা হা
– আবার হাসে ,
– হাসবো না , তো কি করবো কান্না করবো ?
– বেহায়া ,
– কিহহহ , আমি কি ?
– বেহায়া ,
– আর ?
– বেশরম ,
– আর ,
– বেলাজা
– সেটা কি ?
– যাদের লাজ-লজ্জা নাই ।
– হুপ ,
– এইবার তো ছাড়েন , নাস্তা করবেন কখন চলেন ।
– বাবা এসেছেন ডাইনিংয়ে ?
– তখন তো দেখি নাই , এখন এসেছেন কিনা জানি না ।
– হু ,
বেলী খেয়াল করে ইরফানের মুখটা মুহুর্তের মাঝেই কালো হয়ে যায় । ইরফানের নিশ্চয়ই কিছু মনে পড়ে গেছে তাই হয়তো হঠাৎ করেই মন টা খারাপ হয়ে গেছে । বেলী ইরফানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ,
– কি হয়েছে ?
– কিছু না ,
– বাবার কথা মনে গেছে , তাই তো ?
– নাহ , তেমন কিছু না ।
– বাবা যা বলেছেন সেটা ভুলে যান । হয়তো তিনি মনের কষ্টে বলে ফেলেছেন ।
– জানি আমি , অপরাধ করেছি আমি । তাই তো শুনতেও হয়েছে আমায় ।
– হয়েছে তো , বাদ দিন না । চলুন খেতে চলুন ।
– তুমি যাও আমি আসছি ।
– আচ্ছা ।
নাস্তার টেবিলে একপাশে রহমান আলী আরেক পাশে ইরফান বসে আছে । বেলীও পাশে বসা আছে ইরফানের । নাস্তার টেবিলে শুধুই নিরবতা বিরাজ করছে । ইরফানের নজর দিকে , সে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না তার বাবার দিকে । আর রহমান আলীও তাকায় নি ইরফানের দিকে । এক পর্যায়ে ইরফানকে উদ্দেশ্য করে রহমান আলী বলে উঠে ,
– আজকে নজর নিচু করতে হচ্ছে কেন তোমায় ?
-…………..
বাবার কথায় একদম চুপ হয়ে যায় ইরফান । তার মুখে কোন কথা নেই । কাজই করেছে সে এমন । কথা বলবে কিভাবে সে । রহমান আলী দম নিয়ে আবারও বলা শুরু করে দেয় ।
– জীবনে এমন কিছু কাজ করতে হয় যেই কাজের জন্যে মাথা উঁচু হয় এমন কাজ করা উচিত নয় যেই কাজের জন্যে নিজের মাথা এবং নজর দুটোই নিচু হয় । তুমি আজকে যা করছো তাতে তুমি যদি অনুতপ্ত হও তাহলে আলহামদুলিল্লাহ , আর না হলে কিছুই করার নাই আমার । যেখানে বেলীর মত একটা মাটির দলারে তুমি এত কষ্ট দিছো সেখানে তোমার থেকে আমি আর কি আশা করতে পারি । আমি রহমান আলী যে লোকটা কামরাঙ্গিরচরের সব বিচার করি আজ সেই আমার ছেলেই কিনা এত জঘন্য পাপ করছে । তুমি বাইচা গেছো এটা শহর বইলা এটা যদি গ্রাম হইতো তাহলে তোমারে সবাই জুতার মালা গলায় পরিয়ে গ্রাম ছাড়া করতো
রহমান আলীর কথা গুলো সোজা বুকে গিয়ে লাগে ইরফানের সাথে বেলীরও । বেলীর নজর ততক্ষনাৎ ইরফানের দিকে যায় । বেলী বেশ বুঝতে পারছে ইরফানের খাওয়া ভেতরে যাচ্ছে না । ইরফান হয়তো এখনি না খেয়েই উঠে যাবে , তাই বেলীই তার শ্বশুরের কথার মাঝে কথা বলে উঠে ,
– বাবা খাওয়ার সময় এইসব বাদ দিন । খাওয়া দাওয়া করুন বাবা ।
– এইভাবে ধামা-চাপা কতদিন দিবা বউমা । তোমাকে নরম পেয়েই তো আজকে এই কাজ করতে সাহস পাইছে । আর তুমিও তো কম যাও না বউমা । এতকিছু হয়ে গেছে মুখ থেকে একটা আওয়াজ পর্যন্ত বের করো নাই ।
– বাবা আওয়াজ বের করলে কি হতো । কথায় আছে আল্লাহ পাক যা করেন বান্দার ভালোর জন্যে করেন । সব কিছুর পরেও আমি তো আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি বাবা । তাই এইসব কথা বাদ দিন , যা হয়েছে ভুলে যান বাবা ।
ছেলের বউয়ের কথা শুনে রহমান আলী কিছুক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন । তারপর আবার বলেন ,
– বেলীর মাকে সব জানাতে হবে আমাকে ।
এই কথা শুনার পর বেলী আর ইরফান এক সাথে রহমান আলীর দিকে তাকান । বেলীর বুকে আচমকাই কামড় পড়ে যায় ।
– বাবা ভুলেও যাতে আমার মায়ের কানে যাতে এইসব না যায়৷। আমার মা মরেই যাবে বাবা ।
– তাই বলে এত বড় সত্যি জানাবো না আমি ওনাকে ?
– না বাবা ,
– কি বলো এইসব তুমি । এখন জানাইলা না ভালো কথা কিন্তু পরবর্তীতে যদি তোমার মা অন্য কারো মাধ্যমে জেনে যায় তখন কি করবা ।
– জানবে না বাবা ,
– যদি জানে তখন কি করবা ?
– যদি শব্দটার কোন অর্থ নেই বাবা , বাদ দিন এখানেই সব মাটি চাপা দিয়ে দিন । আমি চাই না আমার মা কষ্ট পাক আমি চাইনা আমার স্বামী আমার মায়ের চোখে ছোট হয়ে যাক ।
বেলীর কথায় শেষ বারের মত ইরফানকে ক্ষমা করে দেন রহমান আলী । বাবা হয়ে নিজের সন্তানকেও ছাড় দেয়ার পাত্র নন রহমান আলী । ওনার কাছে যে অন্যায় করবে সেই অপরাধী এইবার হোক সে নিজের ছেলে আর হোক সে বাহিরের অন্য কেউ । এইবারও হয়তো ইরফানকে চরম শাস্তি দিতেন তিনি । কিন্তু একমাত্র ছেলের বউয়ের জন্যে তিনি থেমে গেলেন । বেলীর আকুতি মিনুতি তার হাত পায়ে শিকল পরিয়ে দেয় । তাই তিনি এইবার ক্ষমা করতে বাধ্য হয় হোন তার ছেলে ইরফানকে ।
দুপুরের পরেই খাওয়া দাওয়া করে ঢাকা ত্যাগ করেন রহমান আলী । বেলীকে মন ভরে দোয়া করে বাসা থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান তিনি । আর এইদিকে আবার একা হয়ে যায় বেলী । যদিও ইরফান অফিসে থেকেই দুই থেকে তিন বার ফোন করে কথা বলে বেলীর সাথে । যতটা পারে বেলীকে নিজের কাছে রাখতে চায় সে । বেলীকে যতটা সম্ভব ভালো রাখা যায় যতটা সম্ভব আদরে রাখা যায় তার সবটুকু খেয়াল রাখে ইরফান ।
এভাবেই কেটে যায় প্রায় এক মাস ,
বেলীর সংসারে সুখের অভাব নেই । তার সংসারের আনাচে কানাচে ভালোবাসারা এখন লুটোপুটি খেলে । ভালোবাসা গুলো দুহাতে কুড়িয়ে নিয়ে আজ বেশ সুখে আছে বেলী আর ইরফান ।
দুজনার সংসারে সুখের কমতি নেই এখন । এর মাঝে রুবি আর ইরফানের জীবনে বিঘ্ন ঘটায় নি । রাজু নামের অতীতটাকে বেলী ভুলে গিয়ে নিজের স্বামীর সাথে সুখে শান্তিতে সংসার করায় ব্যস্ত ।
ইদানীং বেলীর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না । কিছুই খেতে পারে না সে । যা খায় তাই মনে হয় বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে । শরীরটা খুব খারাপ লাগায় অসময়ে শুয়ে থাকে বেলী । ইরফান অফিস থেকে এসে বেলীকে শুয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করে ,
– বেলী , এই বেলী ?
– কি হলো আবার ,
– তোমার কি হয়েছে , শুয়ে আছো যে ?
– আমার শরীরটা ভালো লাগছে না , তাই শুয়ে আছি । কিছু লাগবে ?
– নাহ থাক , তুমি শুয়ে থাকো । আমি ফ্রেশ হয়ে নেই ।
– হু ।
বেলী অসুস্থ শুনলেই ইরফানের কলিজায় কামড় পরে । বেলীকে অসময়ে শুয়ে থাকতে দেখে ইরফানের ভেতর টা কু ডাকতে শুরু করে দেয় । ওয়াসরুমে বেলীকে নিয়ে ভাবতে থাকে ইরফান । এরই মাঝে বেলী অনেক জোরে জোরে ওয়াসরুমের দরজায় নক করে ।
– আরে খুলেন দরজা টা , বাথরুমে এতক্ষণ কি করেন হ্যাঁ ?
– আরে ভাই , বের হচ্ছি এক মিনিট ।
– কেমন লাগে মেজাজ টা এখন । আপনি কি কাথা বালিশ নিয়ে বাথরুমে ঢুকেন নাকি , বের হোন ।
বেলীর কথায় ইরফান কোন রকম টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে ওয়াসরুমের দরজা খুলে । ইরফাম দরজা খুলেও স্থির হয় নি ওমনি ইরফানকে নামার সুযোগ না দিয়ে বেলী ওয়াসরুমের ভেতরে ঢুকে যায় । বেলীর এমন তাড়াহুড়ো দেখে ইরফান খানিকটা বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকে পাশেই । বেলী ভেতরে ঢুকেই বমি করে দেয় । দাঁড়িয়ে বমি করতে করতে এক সময় বসে পড়ে সে । ইরফান বুঝতে পারে বেলীর খুব কষ্ট হচ্ছে , তাই ইরফান পানির কল ছেড়ে দেয় আর বেলীর মাথার দু’পাশে চাপ দিয়ে ধরে রাখে । বেলীর প্রচন্ড বমি বেগ হচ্ছে । বমির বেগে তার চোখের পানি বের হয়ে গেছে তবুও বেগ কমছে না । ইরফান তখন হালকা পানি হাতে নিয়ে বেলীর মাথায় দেয় । শরীর অত্যন্ত খারাপ লাগছিল বেলীর । নিজে উঠতে পারবে না তাই ইরফানকেই বলে ,
– আমায় ধরেন , উঠান আমায় । শরীরে জোর পাচ্ছি না আমি ।
ইরফান বেলীকে ধরবে কি , সে তো হা হয়ে আছে বেলীর হঠাৎ কি হলো যে একেবারে বমি করে দিলো । এই চিন্তায় সে শেষ হয়ে যাচ্ছে ।
.
.
চলবে……………………