“জ্যোৎস্নার ছল” পর্ব ৫.
আসমা ভাবিকে শুরুতে যতটা বিরক্তিকর লেগেছিল, ততটা বিরক্তিকর তিনি নন। রুবী ভাবির মতোই মিশুক ধরনের। তবে একটি ব্যাপার ভালো লাগল না। তিনি কথায় কথায় আমায় নতুন বউ হয়ে আসাটা উপলব্ধি করান, যদিও আমার ওরকম কিছু এখনও ফিল হচ্ছে না। এই যেমন, তিনি ভেতরে আসার জন্য দরজার মাঝের তক্তাটি তুলে পাশে রাখলে তিনি বললেন, ওমা ভাইজান বুঝি নতুন বউয়ের সুরক্ষার ব্যবস্থা করি গেলেন।
আবার রান্নার কাজে সাহায্য করার সময় বললেন, নতুন বউকে রান্না করে শ্বশুরবাড়িতে খাওয়াতে হয়। তোমার তো শুধু জামাই আছে ভাই। তাই তুমি তারে রান্না করে খাওয়াইবা বুঝলা?
সঙ্গী হিসেবে তিনি চমৎকার। যেসব কথা বলতে অনাগ্রহ দেখাই, সেসব জানতে তার মাঝে জোর দেখা যায় না। তিনি জিজ্ঞেস করায় আমি তাকে আমার কলেজ জীবনের সম্বন্ধে বললাম। বলতে লাগলাম রঙধনু সংগঠনের ইতিহাসটিও। তাকে বলার সময় সবকিছুই যেন নতুনভাবে ঘটে যাচ্ছে।
মন খারাপের একটি দিনের কথা। স্বপ্না আমার মন ঠিক করার জন্য বলল, চল, শপিং করতে যাই।
‘কিসের জন্য?’
‘এমনিই। কেনাকাটা করব। ভালো লাগবে।’
‘এভাবে অহেতুক টাকার অপচয় করা ঠিক না। কী নেই তোর শুনি?’
‘তাহলে ওই টাকায় কী করব?’
‘জানিস, আমরা কতই না সুখে আছি। ওইদিকে কিছু মানুষ এমন আছে, যারা একটি টাকাকেও আল্লাহর পাঠানো অমৃতের ন্যায় মনে করে। আমরা কী করছি? সামান্য দুটো টাকা তাদের দিতে পারি না। অথচ হাজার হাজার টাকার শপিং করতে পারি। কোয়ালিটির নামে দামি জিনিস কিনতে পারি। আমি তো বলি, দান করে দে।’
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
‘তোর এসব কথা অনেক শুনেছি। দান করতে আমার ইচ্ছে হয় না। আমার মনে হয়, এই টাকা অনেক সময় ভুল হাতে পড়ে যায়। এতে করে যার প্রাপ্য সে বঞ্চিত হলো, আমারও কিছু টাকা শপিং ছাড়াই ওয়াস্ট হলো।’
‘আমি যখন অতিরিক্ত টাকায় একটি বইও কিনতে চাই, তখন আমার বিবেক বলে উঠে, এই টাকার পরিমাণ হয়তোবা হতে পারে কারও কয়েকদিনের খাবারের খরচের সমান। আমার আর বই কেনা হয় না। আমি নাহয় একটি অভিযানে নাই গেলাম, কেউ একজন হয়তো পরিবারকে নিয়ে সুখে দু’মুঠো ভাত খেতে পারবে। এসএসসি পরীক্ষার পর আমার কিছু টাকা জমানো হয়েছে। কলেজে উঠার পর তোকে বলব বলব করে বলা হয়নি। আমি এমন একটা কাজ করতে চাই, যেখানে বেশ কয়েকজনের মাধ্যমে অনেক টাকা উঠবে। আর বিশ্বস্ত কারও মাধ্যমে ওই টাকার সঠিক ব্যবহার করতে পারব।’
স্বপ্না নাক সিঁটকে বলল, ‘অনেক ঝামেলার ব্যাপার।’
‘ঝামেলা নেই। একবার করতে শুরু করলে ভালো লাগবে। কোনো কাজ শুরুতে ঝামেলার অবশ্যই লাগে। আমরা দিনে যদি কমপক্ষে পাঁচ টাকা জমা রাখি, তা মাস শেষে দেড়শ টাকা দাঁড়াবে। আমরা অন্তত দু’জন কাজটি করলে তিনশ টাকা উঠবেই। এরপর সেই টাকা কেউ একজন সঠিক জায়গায় দান করিয়ে দেবে।’
সে বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে দেখি আজ কয়েকজনকে বলে।’
‘যদি কেউ ইন্টারেস্টেড না হয়, তবে আমরাই কাজটি করে যাব। কী বলিস? আচ্ছা, তোর ভাইকে বলে দেখ।’
‘ভাইয়া এসবে খুব একটা চালু না। এধরনের উদ্যোগে সাহায্য করতে পারবে এমন তো পরিচিত একজনই আছে।’ সে ভীত চোখে আমার দিকে তাকাল।
আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই বললাম, ‘সাদিক ভাই?’
তার ওইদিকটা দেখেই যে তার প্রতি আমার ভালো লাগার জন্ম হয়। একবছর আগে ভাইয়াকে আমরা কেবল রাকিব স্যারের বন্ধুদের মধ্যে দেখতাম। এরপর তিনি আস্তে ধীরে সুযোগ করে কিছু বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য রাকিব স্যারের কাছ থেকে একঘণ্টা সময় বের করে নিলেন। আমার এও মনে আছে, সাদিক ভাইয়ের সেই ব্যাচে দরিদ্র হওয়ার কারণে সত্তর পার্সেন্ট স্টুডেন্ট ফ্রিতেই পড়ে। মাঝে মাঝে এটিকে একটি ক্লাসরুমের মতো দেখায়।
সে আমাকে নীরব থাকতে দেখে বলল, ‘বাদ দে। অন্য কাউকে খুঁজতে হবে।’
‘তার প্রয়োজন নেই। আমি এতোটা নরমও নই। আমি তার কাছে যাব। নিশ্চয় সাহায্য করতে চাইবেন।’
সে এইবার শয়তানি হাসি না হেসে বলল, ‘তবে তোর সাথে কাল কলেজে দেখা হচ্ছে।’
পরদিন ঠিক আগের মতোই ক্লাস না থাকলেও কোচিং সেন্টারে গিয়ে হাজির হলাম। সাদিক ভাই হালকা সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পরে এসেছে। স্টুডেন্টদের পড়তে দিয়ে নিজে হাতদুটো ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে। আমাকে দেখতে পেয়ে সে এইবার কিছু বলল না। আমার আজ বসার কোনো প্ল্যান নেই। দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলাম।
পাঁচ মিনিট পর বাচ্চাগুলোর ছুটি হলো। প্রতিবারের মতো সে তাদের আগে বেরুয়নি। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। সে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চাবি বের করলে বললাম, ‘আপনার সাথে একটি কথা ছিল।’
সে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল, যেন এই কথাটি আশা করেনি।
‘হ্যাঁ বলো।’
‘আমি আসলে একটি সংগঠন খুলতে চাচ্ছিলাম। তেমন বড় নয়। আগ্রহী হলে যে কেউ এই কাজটি করতে পারবে।’ আমি পরিকল্পনাটি তাকে বললাম। সে বলল, ‘আইডিয়াটা দারুণ। ভেবে দেখ, এই দলে যদি দশজনও থাকে, তবে সংগঠনটি কোথায় গিয়ে পৌঁছবে।’
কথাটি সে এতোই উৎফুল্ল হয়ে বলল যে, আমি তার দিকে তাকাতে পারলাম না। চোখ নামিয়ে ফেললাম। তার এভাবে কথা বলার ভঙ্গি আমাকে কেন এতোটা প্রভাবিত করে বুঝি না। আমি চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলে সে বলে উঠল, ‘তুমি কি এটাই এতদিন বলতে চেয়েছিলে?’
‘না তো।’
‘ওহ্, আমিই সম্ভবত ভুল বুঝেছি।’
আমার বলতে ইচ্ছে হলো, আমি ওইদিনগুলোতে কতকিছুই না বলতে আসতাম। কখনও সাহস হতো না, কখনওবা সুযোগ হতো না। কিন্তু বলা দূরে থাক, আমার আর নড়তেও ইচ্ছে হলো না। যতই সময় অতিবাহিত হচ্ছে, ততই আমার আবেগ বেরিয়ে আসতে টগবগ করছে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, আপনি ওই মেয়েটিতে কী পেয়েছেন? আমাকে কি আপনার ভালো লাগে না?
খেয়াল করলাম সে এখনও যায়নি। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওহ্, আজ কোনো স্যার তো পড়াবে না। তাকেই দরজায় তালা লাগাতে হবে।
‘অনন্যা, তোমাদের রাকিব স্যার তো কাল আসবে। কাল পর্যন্তই কি এখানে অপেক্ষা করতে থাকবে?’
তার সারা মুখে ঈষৎ হাসি ছড়িয়ে আছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম, ‘আমার এখন কোনোদিকে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ভয় করছে।’
‘আর আমি থাকলে কি সেই ভয়টা কাটবে?’
‘প্রতিবার আপনি থাকেন বলে ভয় পাই না। আপনি থাকলে অবশ্যই কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারব।’
‘কলেজ নেই তোমার?’
‘না।’
‘তাহলে আমারও আজ কলেজ বন্ধ। শুধু আমার না, মনে হচ্ছে, আজ পৃথিবীর প্রতিটি কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।’
এরপর আমরা বেশ কিছুক্ষণ নীরব রইলাম। নীরবতা ভেঙে সে নম্র স্বরে বলল, ‘এতদিন আসোনি কেন?’
‘এসেছি তো।’
‘রাকিবের কাছেই পড়তে এসেছ। আমাকে তো দেখা দাওনি। কেন বলো তো?’
‘এমনিই।’
‘বলো।’
আমি বেশ কিছুক্ষণ নীরব রইলাম।
‘ওই মেয়েটি কে ছিল?’
‘কোন মেয়েটি?’
‘সেদিন যে মেয়েটি আপনার হাত ধরেছিল?’
সে হাসল, ‘তুমি ভুল বুঝেছ। আমার এক বন্ধুর সাথে ওর ঝগড়া হয়েছে। এই নিয়ে ও আমাকে রিকোয়েস্ট করছিল, যাতে সব ঠিক করে দেই।’
‘আপনি সম্পর্ক ঠিক করতে জানেন বুঝি?’
‘বন্ধুরা তো তাই বলে, আমার বুঝানোর ক্ষমতা অনেকটাই কার্যকরী।’
‘হয়তো ওরা সত্য বলে।’
‘বলুক। আমার মনে হয় না, এই ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ আমি কখনও আসতে দেবো।’
‘আচ্ছা, আপনার মা কেমন?’
‘খুব ফ্রেন্ডলি। সবকথাই তার সাথে শেয়ার করা যায়। কিন্তু মনে হচ্ছে, প্রেম করতে যাওয়ার ব্যাপারটা লুকাতে হবে।’ সে মুচকি হাসল।
আমার মনের ভেতর অসময়ে যে ঝড়টা শুরু হলো তা ব্যক্ত করার মতো নয়। এই ঝড় বুঝি কখনও থামবে না। আকাশটা আর একরোখা থাকবে না। মাটিতে ফাটল পড়বে না। কেবল ইচ্ছা করল স্বপ্নাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরি। সে যদি ওর নামটা না নিত, তবে আজকের এই বিশেষ দিন আর অনুভূতির দেখা আমি হয়তোবা কখনও পেতাম না। সাদিককে না দেখার জেদ নিয়ে বসে থাকতাম।
স্বপ্নাকে তার বাসায় গিয়ে সত্যিই জড়িয়ে ধরলাম। নাহিদ ভাইয়া সোফায় বসেছিল, অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। উত্তেজনায় খেয়ালও করলাম না স্বপ্নার মুখ ফ্যাকাসে।
‘কী হয়েছে? আমার তোকে একটা খবর দিতে হবে।’
নাহিদ ভাইয়া তার আগে বলে উঠল, ‘ছেলেটি বুঝি সাহায্য করবে?’
স্বপ্নার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘উনাকে কি ব্যাপারটা তুই বলেছিস?’
‘হ্যাঁ, এমনিই কথার ছলে বলে দিলাম।’
‘নো প্রবলেম। ভেতরে চল, তোকে আরেকটা খবর দেবো।’
নাহিদ ভাইয়া আবারও বলে উঠল, ‘কী খবর?’
‘আপনি জেনে কী করবেন? এটা আমাদের মাঝের বিষয়। আর হ্যাঁ, আপনি চাইলে ওই সংগঠনে নাম লেখাতে পারেন। আপনি ইনভাইটেড।’
তার কঠিন চেহারা দেখে আমি মনে করেছিলাম, তিনি আমার কথাটি ইগনোর করবেন। কিন্তু তিনদিন পর দেখা গেল, আমাদের পর সংগঠনে তিনিই নাম দিয়েছেন। কোচিং-এর দু’জন টিউটর রাকিব স্যার ও জুয়েল স্যারও তাতে নাম দিয়েছেন। এই সংগঠনের কাজ ভালোভাবেই শুরু হয়েছে দেখে আমরা এটির একটি নাম রেখেছি, রঙধনু। আমি কেবল আশা করেছিলাম এই সংঘে কেবল দু’জনই থাকব। স্বপ্না বলল, হ্যাঁ রে আমার কিন্তু টাকা জমাতে খুব ভালো লাগছে। মাস শেষে যখন সবাই টাকা জমা রাখব তখন কেমন অনুভূত হবে একটু ভেবে দেখ। আমরা একটি বাক্স কিনলাম। তার সামনে যে তালাটি লাগানো হবে তাতে খুব সুন্দর করে স্বপ্না ‘রঙধনু ক্লাব(RC)’ লিখেছে। নিচে লিখেছে ‘স্থাপনকাল: ২০০৮’।
পরের শনিবার দিনটি অসাধারণ ভাবে কাটল। স্বপ্না একটুও এধার-ওধারের কথা বলেনি। আমরা কেবল রঙধনু নিয়েই কথা বলেছি। সে তার পাকনা কথায় ইতোমধ্যে দুটো মেয়েকে যুক্ত করে ফেলেছে। তারা সোমবার ‘হেডকোয়ার্টারে’ এসে নাম লিখিয়ে যাবে। স্বপ্না কোচিং সেন্টারের দ্বিতীয় ছোট্ট ঘরটিকে রঙধনুর হেডকোয়ার্টার বলে, যেটিতে সাদিক বাচ্চাদের পড়ায়।
রঙধনুতে ম্যাজিকের মতো সদস্য সংখ্যা এবং মাসিক টোটাল সেভিং রেংক বাড়তে থাকায় আমি সাদিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘লোকের সংখ্যা এভাবে কে বাড়াচ্ছে?’
‘কেন? আমি।’
‘তুমি?’
‘হ্যাঁ, আমার কতগুলো লোকের সাথে পরিচিতি আছে তুমি জানো না।’
সে ঘরের মধ্যে থাকা টেবিলের ড্রয়ার থেকে সদস্যের লিস্টের কপি বের করে আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘এইযে, একুশ নাম্বারটা দেখছ? হাসান মাহমুদ? ইনি মাস শেষে এক হাজার টাকা করে রঙধনুতে দান করবেন। এইযে, এই লোকটি, ইনি সাতশ টাকা প্রতিমাসে দেবেন।’
আমি হা করে শুনে রইলাম।
‘কী দেখছ এভাবে?’
‘কিছু না। আমার খুব খুশি লাগছে। এই খুশিতে কি আমি তোমার চুল ধরতে পারি?’
‘চুল?’
‘ভাইয়ার সাথে আমার যখন রাগারাগি হয় তখন তার চুল ধরে টানি। এখন খুশি লাগছে বলে তোমারগুলো..’
‘টানবে?’
‘না না টানব কেন? রাগারাগির ব্যাপার তো নেই।’
সে হেসে তার মাথাটি আমার মুখ বরাবর এগিয়ে দিলো। আমি তার চুলে হাত বুলিয়ে দেখলাম। আসলেই ছেলেদের আর মেয়েদের চুলের মধ্যে পার্থক্য আছে। এটা উপলব্ধি করার জন্যই যে তার চুল ধরলাম তা তাকে জানাইনি। কেবল এটুকুই তাকে বুঝতে দিলাম যে, আমি ওই মুহূর্তটায় হারিয়ে গেলাম। তাকে বলতে ইচ্ছে হলো, তুমি সেই মেয়ের মন নিয়েছ, যার মনে ভালোবাসার প্রচুর জায়গা আছে। এখানে কেউ কখনও আসেনি। তাই এই জায়গাটি সম্পূর্ণ তোমার দখলে। জায়গাটিকে পেলেও পেতে পারো আকাশের চেয়ে বড়। আমার ইচ্ছে জেগেছিল, সেও যেন আমার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। আমার মুখের কাছে আসা চুলগুলো যেন কানের পেছনে গুঁজে দেয়। কিছু ইচ্ছে অপূর্ণ থাকাই বোধ হয় ভালো। এবং অপূর্ণই রইল।
রঙধনুর প্রথম মাসের ধারণাতীত সেভিং উপলক্ষে বিরিয়ানির আয়োজন করা হলো। এই সংঘের প্রতিটি সদস্য আয়োজনে উপস্থিত ছিল। এমন মুহূর্ত আমার জীবনে আগে কখনও আসেনি। বেশিরভাগ সদস্য জিজ্ঞেস করল, এই সংঘের আইডিয়া কার ছিল। স্বপ্না আর সাদিক একসঙ্গে উত্তর দিলো, অনন্যার। সেদিনের উচ্চারণে আর নিয়মিত উচ্চারণে আকাশ-পাতাল তফাৎ লক্ষ করেছি।
জমানো টাকাগুলো যেদিন রাকিব স্যাররা দান করে এলেন, এর পরদিন সাদিক আমাকে একটি চাবি এবং অ্যালবাম দিলো। চাবিটি ছিল রঙধনু ক্লাবের সাদিকের কাছে থাকা দুটো চাবির একটি। সে অ্যালবামটি দেখিয়ে বলল, ‘এটি তোমার পাওনা।’
সেটি খুলে দেখলাম প্রথম পৃষ্ঠায় চারটি ছবি লাগানো আছে। রঙধনুর প্রথম দানের ছবিটির দিকে আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছি।
সে বলল, ‘এখানে স্মৃতিগুলো আবদ্ধ করে রাখলে, একদিন যখন অ্যালবামটা পূর্ণ হয়ে যাবে, তখন ছবিগুলো একসাথে দেখতে খুব ভালো লাগবে। ওই একদিনের পর হয়তোবা আমরা আমাদের অ্যালবাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ব। এটিকে সময় দিতে দিব না।’
রঙধনুর পরিসর খুব সুন্দরভাবেই বাড়ছিল। মাঝখানে একদিন আমি এমন একটি গোলমাল করে বসলাম যে, সবাই তার জন্য আমাকে দোষারোপ করতে লাগল। আমি মনে করেছিলাম, ফরহাদ ভাইয়া রসিক ধরনের মানুষ। তিনি এখানে যুক্ত হলে নতুনভাবে এর গতি হবে। কিন্তু আমার ধারণামতো কিছুই হয়নি। বরং উল্টোটাই হলো।
তিনি এসে রঙধনুর নিচের এক্সট্রা লাইন “স্টার্ট সেভিং- দান সমতা আনতে পারে”-এর নিচে আরেকটি লাইন সংযোজন করলেন। “আপনার সুখে-দুঃখে আপনাকে উপদেশ দিতে এবং যেকোনো সমস্যায় রঙধনু সদা আপনার সাহায্যের জন্য তৎপর থাকিবে। রোজ শুক্রবার রঙধনুর হেডকোয়ার্টার যে-কারও জন্য খোলা থাকিবে।” এমনকি সাদিকও আমায় এ নিয়ে কথা শুনিয়েছে। আমি কি এসব ধারণা করেছিলাম? ভাইয়া সিনিয়র হওয়ায় এবং তার অনেক কাজিনকে সংঘে যুক্ত করায় কেউ কিছু বলতে পারছে না। সবাই আমার উপর নারাজ। শুক্রবার দিনটির জন্য ভাইয়া অনেক কথা শুনেছেন। তবু রাকিব স্যার তাকে সেদিনের জন্য চাবি দিতে বাধ্য হয়েছেন। আমার কাছে থাকা চাবিটি তাকে শুক্রবারে দিতে হবে।
কেবল এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। নিচের লাইনটি সহ তিনি অনেকদিকে পোস্টারও লাগিয়েছেন। ভাগ্য ভালো, অনেকে হয়তো একে সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। শুক্রবার ফরহাদ ভাইয়া হেডকোয়ার্টারে বসে থাকেন। তার সাথে দিই আমি আর স্বপ্না। স্বপ্না বকবক করতে থাকে ভাইয়ার সাথে। আর আমার প্রচুর সময় থাকায় বই পড়তে শুরু করি। কেউ আসে না। কিন্তু ফরহাদ ভাইয়া এ নিয়ে খুব আশাবাদী।
একদিন সত্যিই একজন লোক এসেছে। সেদিনের মতো হাস্যকর ব্যাপার আগে কখনও দেখিনি। যাইহোক, ভাইয়ার দু’জন সহকারী হিসেবে আমরা ছিলাম। ভাইয়া আর লোকটির মাঝের কথাবার্তা কিছুটা এমন ছিল।
‘আসসালামু আলাইকুম। আপনিই কি ফরহাদ ভাই? এটাই কি রঙধনুর হেডকোয়ার্টার?’
‘জ্বি। নিচের গলিতে ঢোকার সময় কিংবা সিঁড়ি বেয়ে উঠার সময় অথবা সামনের ঘরটি অতিক্রম করার সময় প্রতিটি জায়গায় রঙধনুর একটি করে প্লেট আছে। আপনি কি দেখেননি?’
‘আসলে ভাই মন-মেজাজ ঠিক নেই। তাই কেমন কেমন প্রশ্ন করে ফেলেছি।’
‘তা আপনার কেমন উপকারে আসতে পারি?’
‘ভাই, আমার স্ত্রী আমার সাথে রাগ করে বাপের বাড়িতে চলে গেছে। এই জীবনে আমার প্রথম এমন এক্সপিরেন্স। তাকে অনেকবার মানাতে গেলাম, কিন্তু সে আসছে না। আপনি বলুন ভাই আমার কী করা উচিত।’
আমি আর স্বপ্না একে অপরের দিকে অবিশ্বাসের সাথে তাকালাম। ভাইয়ার মাঝে তেমন একটা ভাবান্তর দেখা যায়নি। লোকটি যতটা হাবাগোবা ধরনের, দেখতে ততটা নয়।
‘জটিল সমস্যা দেখছি। তা এর পেছনের কারণটা বলুন। মানে কী কারণে মহাশয়া রাগ করেছেন।’
‘আসলে আমার হাত থেকে পড়ে ওর মেকআপ বক্স ভেঙে গেছে। সে আরেকটি কিনে দেওয়ার জন্য বায়না ধরল। কিন্তু আমি বললাম, তোমার মেকআপের প্রয়োজন নেই। তুমি এমনিতেই বিউটিফুল। শুধু একটু ঘ্যানঘ্যান কর। এটুকুই আমার অপরাধ ছিল ভাই।’
আমি আর স্বপ্না জোরপূর্বক হাসিকে দমিয়ে রাখলাম।
‘আই সি। দারুণ একটা সমস্যা। আপনি উনাকে হার্ট করেছেন। আমার স্ত্রীর সাথে যতই ঝগড়া হোক না কেন এমন কথা আমি তাকে ভুলেও বলি না। তখন যে প্রলয়টা হবে তা আমাদের মতো পুরুষের সহ্য করার ক্ষমতা খুব কম। আপনি তাকে আনতে গিয়ে তাকে শুনিয়ে কারও সামনে তার প্রশংসা করবেন। দেখবেন কাজ হয় কিনা।’
লোকটি চলে গেলেন। আমি আর স্বপ্না আর আত্মসংবরণ করতে পারলাম না। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। ফরহাদ ভাইয়া বিরক্তি দেখালেন, যেন নিতান্ত সাধারণ ব্যাপার।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার