“জ্যোৎস্নার ছল” পর্ব ১৩.
দরজার ওপাশে কে যেন টোকা দিচ্ছে। ভুল শুনলাম না তো? আমার হৃদপিন্ডের ধকধকানো যেন বেড়েই চলেছে। বাবা আবার এসেছেন। তিনি কি অবশেষে নিজের ভুল স্বীকার করছেন?
আমি তড়াক করে উঠে দরজা খুলে দিলাম। কিন্তু বাবা নয়, আমার সামনে একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে। সেই বাঁকা নাকের লোকটি।
‘ডুষার ভাই বাড়িতে আছেননি?’
আমার হাসি এলো। কিন্তু দমিয়ে রাখলাম।
‘নেই। কী বলবেন আমাকে বলুন।’
লোকটি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘কথাটা উনারেই কইতে হইব।’
‘ঠিক আছে। আপনি পরে আসুন।’
‘ডুষার ভাই নাকি এহন বাড়িতে চলি আসবে। একটু বসি?’
তাকে আমি ভেতরে বসতে দিয়ে চা দিলাম। তুষারের আসার নামগন্ধ নেই। বাসায় কোনো ফোন নেই যে, ওকে আসতে বলব। আমি জানালা দিয়ে চেয়ে থাকার পর ওকে আসতে দেখলাম। যেই আমি দরজা খুলতে গেলাম, অমনিই লোকটি জিজ্ঞেস করল, ‘ভাবি, এখানে একটু বসেন। লাগতেছে ডুষার ভাই আসব না। আমনেরে কথাখান কই।’
‘না। ও..
বাকিটা বলার আগে তুষার দরজা খোলা দেখে ভেতরে ঢুকে পড়ল। লোকটি তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন।
লোকটি তৎক্ষণাৎ দৌড়ে চলে যেতে চাইল, তুষার তার গেঞ্জি ধরে ফেলে। বলা-কওয়া ছাড়াই লোকটিকে তুষার পেটাতে শুরু করল। তাকে এতটা উত্তেজিত হতে আমি আগে কখনও দেখিনি। সে যেন হঠাৎ একটি হিংস্র পশুই হয়ে গেছে। এদিকে লোকটির মরিয়া অবস্থা।
‘তুই আমার বউয়ের উপর নজর দিছস? হারামজাদা, তোরে আজ এমন মারা মারব, জীবনে কখনও আরেকটা মাইয়ার দিকে তাকানোর সাহস পাবি না।’
‘তুষার, ছাড় উনাকে। মেরে ফেলবে নাকি?’ তাকে সহজে টেনে আনতে পারলাম না। কিছু লোক বেরুলে সে নিজেকে অবশেষে থামায়। এরপর সে আমার হাত চেপে ধরে আমাকে ভেতরে নিয়ে এলো।
‘তোমাকে আমি বলেছিলাম না অপরিচিত কারও জন্য দরজা খুলবা না?’
‘কিন্তু উনি..’
‘বলেছিলাম কি না?’
সজোরে বললাম, ‘হ্যাঁ, বলেছিলে।’
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
সে আচমকাই আমাকে মারতে তেড়ে এলো। ওর হাতটা আমার গালে লাগতে লাগতে শেষ মুহূর্তে থেমে যায়। তবু আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছি। সে ছটফট করে বিছানায় বসে পড়ল।
আমরা সারাদিন একে অপরের সাথে কথা বলিনি। যদিও সে সময়মতো না এলে অনর্থ হয়ে যেত, তার কিন্তু আমার কথা না শোনে আমাকে মারতে চাওয়া উচিত হয়নি। তুষারকে খুব আহত দেখাচ্ছে। কিন্তু আমি পাত্তা দিলাম না। ভাবছি, ওকে এখন থেকে পাত্তাই দেবো না। যে নিজের রাগের উপর নিয়ন্ত্রণ পায় না, তার সাথে আমার কোনো কথা নেই।
সে রাতে খাবারের সময় বলল, ‘তুমি কি প্রেয়সীর অর্থ জানো?’
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ‘না। কখনও শুনিনি।’
‘ঠিক আছে। এখন থেকে দরজার সামনে এলে আমি তোমাকে প্রেয়সী বলে ডাকব। তুমি বুঝে যাবে এটা আমিই।’
‘এর অর্থ কী?’
সে আমার দিকে ভোলা চোখে তাকাল, যেটা আমাকে ঠিক সাদিকের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। নিজেকেই বললাম, পাত্তা দেবে না। সে অপ্রত্যাশিত ভাবে কোমল স্বরে বলল, ‘এর অর্থ হচ্ছে লক্ষ্মী মেয়ে।’
‘আচ্ছা, ঘুষার অর্থ কী জানো?’
‘না। কী?’
‘ঘুষি দেবো ডুষার।’
‘ঘনন্যা অর্থ কী জানো?’
‘জানা লাগবে না।’
‘ঘুষ দেবো। তবু রাগ করে থেকো না ডনন্যা।’
আমি কিছু না বলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ভেবেছিলাম, সে আরও কিছু বলে রাগ ভাঙাতে চাইবে। কিন্তু সে সোজা হেঁটে ঘরের বাইরে শুতে চলে গেল। মনেই ছিল না, তার আবেগ নেই। আমি কী ভেবে উঠে তাকে দেখতে গেলাম। সে দোয়ারে বসে সিগারেট খাচ্ছে। খুব করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, আজ তো সারাদিন আমাদের কথা হয়নি। আরেকটু কথা বলো। তোমার কর্কশ কণ্ঠেও মধুর এক ভাব আছে, যা আমাকে নিঃসঙ্গ ভাবতে দেয় না।
পরক্ষণে ভাবলাম, এ আমি কী ভাবছি? এই জীবন আমার সাময়িকের। আমি এখানে আর বেশিদিন থাকব না। নিজেই সাদিকের কাছে চলে যাব। বাবাও দেখবেন, তিনি আমাকে অন্ধকার কূপে ফেলতে পারেননি। তার দেখতেই হবে, আমি এরচেয়ে ভালো কিছু ডিজার্ভ করি। এসবের মাধ্যমে আমি সুখের দেখা পাব।
পরদিনও যখন আমি তুষারের সাথে কথা বলছিলাম না, সে বলল, ‘গতকালকের জন্য খুবই দুঃখিত। আমি জানি তুমি কিছুটা ভয়ও পেয়েছ। তোমার রাগের চেয়ে আমার রাগ বেশ ভয়ানক। তখন হুঁশ থাকে না আমি সামনের মানুষের কী করছি। এই ভয়ানক রোগটা থেকে আজ দুই বছর যাবৎ পালাচ্ছি। কিন্তু এটা আমাকে ছাড়ছে না।’
তার কথায় গভীর অনুশোচনা ঝরে পড়ছে। তার প্রতি খুব মায়া হচ্ছে। আমি ওকে ক্ষমা করব ভাবলাম, কিন্তু কাঠের গন্ধটা এখন আর আমার পাশে নেই। সে মাথা ঝুঁকিয়ে চলে যাচ্ছে।
সবার সত্তায় কিছুটা ভেজাল থাকে। তাই বলে এতটা রাগ করে থাকা উচিত ছিল না। মাত্র পঁচিশ দিন আপনজন ছাড়া থেকে আমার এই করুণ অবস্থা! এই লোকটি কীভাবে এখানে একা একরোখা জীবন করছে? তার কি সত্যিই আবেগ নেই? কিন্তু আমি যে তার ওই দুই চোখে অজানা এক জগৎ দেখেছি, যেখানে কাউকে সে ঢুকতে দিতে চায় না। সাধারণ কিছু আচার-ব্যবহার দিয়ে সে তার ওই জগতের প্রবেশদ্বার ঢেকে রেখেছে। নইলে একটি লোক কীভাবে স্বয়ং স্ত্রীকে দূরে ঠেলে দেয়?
আসমা ভাবির সাথে আমি নদীর পাড়ে গেলাম। অনেক বাচ্চাই আমাদের আসার অপেক্ষা করছিল। আমি যাওয়ার পর সবাই সমস্বরে বলে উঠল, আসসালামু আলাইকুম। আমার মুখে সবসময়ের মতো আনন্দের হাসি ফুটে উঠে। আজ ওখানে বড় কাউকে বসে থাকতে দেখে আমি ভ্রূ কুঁচকিয়ে তাকালাম। এ যে তুষার!
আমি পাত্তা না দেওয়ার ভান করে পড়াতে শুরু করলাম। সে একবার একটি ছোট ব্ল্যাকবোর্ড, চক এবং ডাস্টার এনে দিয়েছিল। বলেছিল, এগুলো নাও। পরিবর্তে আমাকেও একদিন তোমার ক্লাসে বসার সুযোগ দিতে হবে। বাচ্চাদের আর আসমা ভাবিকে পড়ানোর পর তুষার রয়ে যায়।
‘বাচ্চারা এবিসিডি শিখেছে। ভাবি পার্টস অফ স্পিচ। তুমি কী শিখবে?’
‘আমি? আমি আঁকব।’
‘আমি তো আঁকতে জানি না। ঠিক আছে, তুমি কী আঁকা শিখতে চাও বলো।’
‘আমাকেই আঁক। দেখি আমি দেখতে কেমন।’
সে কিছুদূরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি তাকে দেখে দেখে আঁকলাম। নিজেরই ড্রয়িং দেখে হাসি থামিয়ে রাখতে পারলাম না। কী হাস্যকর!
‘খুব ভালো হয়েছে অনন্যা। অন্য কেউ হলে এরচেয়ে খারাপই আঁকত।’
‘আমি তো ড্রয়িং শেখাতে পারি না। তুমি কতটুকু পারো দেখি।’
সে আঁকতে না চাওয়ায় তাকে একপ্রকার জোর করে বোর্ডের কাছে নিয়ে গেলাম। এরপর আমি তার আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছি। সে এঁকে চলেছে। কিন্তু একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছে না। তার শরীরের জন্য কী আঁকছে কিছুই দেখছি না। না জানি আমাকে কতটা হাস্যকর ভাবে এঁকে ফেলছে। কিন্তু সে যখন সরে দাঁড়াল, আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম।
নিশ্চিত হতে এগিয়ে বোর্ডের কাছে যাই। আঙুল দিয়ে বোর্ড ছুঁয়ে দেখি। সাদা-কালোর মিশ্রণে সে মেয়েটিকে এঁকেছে। টানাটানা দুটো চোখ, গাম্ভীর্যে ভরা এক মুখ, লম্বা চুল, ঠোঁটের কোণে তার মৃদু এক হাসি। কী অপূর্ব! মেয়েটি আসলেই কি আমি? বিশ্বাস হয় না।
সারাটা দুপুর আমরা নীরব ছিলাম। আমার কেন যেন বলার মতো কোনো কথা নেই। সেও নিজেকে কাজে ব্যস্ত রেখেছে। এক পর্যায়ে রাতের খাবার খাওয়ার সময় সে বলল, কাল একটি মেলা আছে। ওখানে যাবে?
‘কিসের মেলা?’
‘গ্রামে যেভাবে মেলা হয়।’
‘কীভাবে হয়?’
‘ওখানে আসে মেয়েদের জিনিস, বাচ্চাদের খেলনা, গৃহিণীদের জন্য নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিস, নানা ঢঙের খাবার, কাপড়, খেলা এসব। যাবে ওখানে?’
‘মেয়েরা যায়?’
‘বেশিরভাগ মেয়েরাই তো যায়। তাদের প্রায় মেয়েদেরই দেখা যাবে পায়ে আলতা আর নূপুর দিয়েছে, চোখে মোটা করে কাজল, হাতে কাচের চুড়ি, গায়ে লাল-নীল-সবুজ-হলুদ শাড়ি।’
‘আমারও কি পরতে হবে?’
‘তুমি চাইলে পরতে পারো। আমি এসব এনে দেবো।’
‘ঠিক আছে। এনো।’
আমি তার মুখের ভাব দেখছি মন থেকে এসব বলেছে কিনা। কিন্তু তার মুখে আবেগের কোনো চিহ্ন নেই। সবসময়ের মতো তার চোয়াল শক্ত। আমার খুব করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, তোমার মনে কিছু থাকলে আমাকে বলতে পারো। তোমার মনে কি কোনো দুঃখ আছে? অনিচ্ছাসত্ত্বে সাময়িকের জন্যে হলেও আমাদের জীবন যে একসাথে জুড়ে গেছে। আমাকে বলতে পারো। তাকে মনে রাখার মতো সে অনেক কিছুই করেছে। কিন্তু আমি কী করলাম?
পরদিন শুক্রবার থাকায় কোনো কাজ নেই। আকাশে মেঘ জমেছে। শুক্রবার এলেই আমার মনে পড়ে ফরহাদ ভাইয়ার কথা। আশ্চর্যজনক ভাবে আমার কাছে তার কথাও মনে পড়ছে। দূরে গেলে বাড়ে টান। কাছে থাকলে কমে দাম। আমার এই অবস্থা। বাইরে গেলে মাঝে মাঝে কয়েকজনকে স্কুল প্রাঙ্গণের দিকে ছুটতে দেখা যাচ্ছে। ওখানেই মেলা বসানো হয়েছে। আজ নলকূপের কাছেও ভিড় নেই।
সন্ধ্যায় শরীফ ভাই একটি প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘কাসু পাঠাইছে আমনের জন্য। হে নটা-দশটার দিকে চলে আসবে। মেলায় যাইবার জন্য রেডি থাইকেন। চাইলে শরীফের বউয়ের সাথেও যাইতে পারেন।’
শাড়ি দেখে আমার গা ঘিনঘিন করে উঠল। বিয়ের রাতের মতোই লাল শাড়ি! আমার প্রিয়জন আমাকে একবার শাড়ি দিতে চেয়েছিল ঠিক সবুজ রঙের আর আজ তুষার দিয়েছে লাল রঙের। যে দুটোকে আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি।
লোকটির জন্য করুণা হওয়ায় পরে নিলাম। বাইরে বৃষ্টি শুরু হবে হবে ভাব। মাঝে মাঝে মেঘ থেকে গুড়গুড় আওয়াজ আসছে। আমার মাঝে অদ্ভুত এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। তা কেমন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তুষার কীভাবে আসবে? সে যে ছাতা নেয়নি। সে যদি আমার দিকে তাকায়, তখন আমার কেমন অনুভূতি জাগবে? দরজায় টোকা পড়ল। আমার হৃদস্পন্দনই থেমে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে। আমি তড়াক করে উঠে পড়ি।
‘অনু, আমি আসমা। দরজা খোল।’
ভাবি মাথায় ঘোমটা দিয়ে সুন্দর একটি শাড়ি পরে এসেছে।
‘ওমা, তুমি এতো সুন্দর করি সাজছ কেন?’
‘আমি..
‘থাক। আর বলা লাগবে না। আজকে তোমারে মেলায় নিতে চাইছিলাম। মেলায় যাইবা?’
‘তুমি মেলায় যাচ্ছ, সাজনি কেন?’
‘মেলায় গেলে সাজতে হয়? ওহানে পুরুষ মানুষও থাকবে। একেবারে না সাজিলেই ভালা। কেউ সাজে না। বলো, তুমি আমার লগে যাইবা?’
‘না, আমার যাওয়ার কথা ছিল না।’
‘ওমা, ঝড় আসতেছে। আমি তাড়াতাড়ি যাই অনু। নিজের খেয়াল রাইখবা।’
ভাবি তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। এরপর কেউ যেন ঝর্ণার কল ছেড়ে দিয়েছে, এভাবেই হুট করে প্রবল বেগে বর্ষণ শুরু হয়েছে। আমি জানালার বাইরে হাতটি বাড়িয়ে দিলাম। বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে মনে হচ্ছে, তা উপর থেকে যেমনটা দেখায় তেমনটা নয়। এই স্বচ্ছ পানির ভেতরও যেন আছে অনেক রহস্য।
বাইরের অন্ধকার থেকে একটি কালো অবয়বকে ছুটে আসতে দেখে আমার হৃদপিন্ড লাফ দিয়ে উঠল। তুষার ভেজা বেড়ালের মতো চপচপে শরীর নিয়ে ঘরে এসে ঢুকেছে।
‘কী বৃষ্টি! ছাতা নেওয়া উচিত ছিল। আজ তো না বেরুলেই ভালো হবে।’
সে তাকিয়ে আমাকে বিছানায় দেখতে পেল না। চোখ ঘুরিয়ে দেখল, আমি রান্নাঘরের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। সে আমার দিকে তাকিয়েই রয়েছে।
‘আকাশ কিন্তু কালরাত থেকেই মেঘলা ছিল।’
‘আমি খেয়াল করিনি। নইলে আকাশ একটু পরিষ্কার থাকতেই তোমাকে মেলায় নিয়ে যেতাম।’
‘আমার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। মেলা দেখার চেয়ে বৃষ্টি দেখতেই বেশি ভালো লাগছে।’
‘তাহলে চলো। বাইরে বসে কিছুক্ষণ বৃষ্টি দেখি।’
‘ভিজে যাব না? একটু-আধটু ছিটে অবশ্য পড়বে।’
আমি দোয়ারে বসলাম। ঝমঝম বৃষ্টির আওয়াজে আর কিছু শুনতে পাওয়া দায়। তুষার কাপড় পাল্টিয়ে এসে দোয়ারে বসল। তার কাছ থেকে আসছে সেই পরিচিত কাঠের গন্ধটা। বৃষ্টিও কি এই গন্ধ ধুয়ে নিয়ে যায়নি? নাকি আমারই মনের ভুল।
‘ছোটবেলায় আমাকে আর ইশাকে নিয়ে মা বৃষ্টিতে খুব ভিজতেন। তিনি ময়ূরের মতো নাচতেন। আমরা ছিলাম তার পিচ্চি পিচ্চি শিষ্য। অবশ্য আমি ময়ূরের মতো নাচতাম না। বানরের মতো লাফাতাম বললেই হয়তো বেশি মানানসই হবে।’
হা হা হা। সে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হয়তোবা ওর পরিবার ওকে ত্যাগ করেছে। আর এই প্রবল বৃষ্টি তার মনের কাঠিন্যকে ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমিও বৃষ্টির দিকে চেয়ে রইলাম। বৃষ্টি গন্ধটা কাঠের গন্ধের মতো লাগছে। বৃষ্টির বুঝি আবার গন্ধ থাকে?
কিছু একটা অনুভূত হতেই নিচে তাকিয়ে দেখলাম, সে আমার পায়ে আরও আলতা দিয়ে ওখানে ফুল আঁকছে। আলতার কৌটাটা দরজার কাছেই রেখে দিয়েছিলাম।
‘আপনি একটা দক্ষ কারিগর।’
‘ফার্নিচার বানাই। ফুল কাটার সময় কাজে লাগে।’
আমি হাসলাম।
সে বলল, ‘তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। মূর্তির মতো সুন্দর।’
‘ধন্যবাদ আপনাকে। এখানের মেয়েগুলো সাজতে খুব পছন্দ করে। তাই না?’
‘হ্যাঁ, আমার তো এও মনে হয়, সাজার পর তাদের মনের আবহাওয়াটাও পাল্টে যায়। ওরা যখন দল বেঁধে কোনোদিকে যায়, দেখতে খুব সুন্দর লাগে।’
তার এই কথাটি আমার কেন যেন ভালো লাগল না।
‘তুমি না বলেছ, মেয়েদের দিকে তাকাও না?’
‘ওরা সুন্দর বলে তো তাকাইনি। তুমি বুঝবে না। তোমার জ্বলছে।’
‘আমার জ্বলে না।’
‘তাও ঠিক। তুমি তো কয়দিন পর..’
তার এই কথাটিও ভালো লাগল না।
‘আমি জানি, তুমি এমনটা কেন করছ। মানুষ হিসেবেও এইজন্য বাধা দিচ্ছি না। তুমি সুখ ডিজার্ভ করো। তাছাড়া তোমার বাবার সাথে এটা তোমার ব্যক্তিগত লড়াই। তোমাকে সাদিক মেনে নেবে তো?’
‘হ্যাঁ, সে আমাকে যেকোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়ার মতো করে ভালোবেসেছে।’
‘তুমিও তাকে ততটাই ভালোবাসো?’
অনেকদিন পর এই প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ায় আমার অস্বস্তি হলো।
‘হ্যাঁ।’
আচমকাই আমার চোখে পানি এসে ভর করেছে। তুষার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে ওর কাছে দিয়ে আসব। শুধু আমায় বলবে কবে যেতে হবে।’
‘আর কয়েকদিন থাকি। বাচ্চাদের কাছে বিদায় নিয়ে যাব।’
‘ঠিক আছে। যাও, এখন ঘুমিয়ে পড়ো।’
‘বৃষ্টি পড়েছে। তুমি এই জায়গায় ঘুমোবে না।’
‘ঠিক আছে আমি ভেতরে নিচে মাদুর বিছিয়ে ঘুমাব।’
সে শোয়ার পর পর ঘুমিয়ে কুপোকাত। বৃষ্টি থেমেছিল। এখন আবার পড়ছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে রাতটি পার করছি। পাশে একটি হাত-পা ছড়িয়ে শোয়া লোকের ভারি নিঃশ্বাস পড়ছে। কাঠের গন্ধ চারিদিকে ফুলের সুভাসের মতো মৌ মৌ করছে। হুহ, অনেক দীর্ঘ একটি রাত।
(চলবে..)
লেখা: ফারিয়া কাউছার