“জ্যোৎস্নার ছল”পর্ব ১৬ (শেষ পর্ব)
নিজের সম্বন্ধে খারাপ কথা কেউ সহ্য করতে পারে না। আমারও একই দশা। তবে যে নিজের সম্বন্ধে অপ্রীতিকর সত্য শুনতে পারে না, সে কখনও নিজ সত্তাকে জয় করাতে পারে না। শাহনাজ আপার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমি চোখ মুছে তার দিকে তাকালাম। কিন্তু তিনি সামনে নেই! বিছানায়ই তো বসেছিলেন। পরক্ষণে আরসিতে ফরহাদ ভাইয়ার বলা কথাগুলো মনে পড়ল।
ভাইয়া বললেন, ‘যাও তার কাছে। সে কোথায় থাকে? কে সে?’
‘আমার আর সালমার ঘরে থাকেন। শাহনাজ আপা।’
ভাইয়া ভ্রূ কুঁচকিয়ে তাকাল, ‘একবার তোমার বাসায় নামাজি-কালামি একজন ভদ্রমহিলা এসেছিলেন। তিনি না এই শাহনাজ আপা?’
‘হ্যাঁ।’
‘তার সাথে তো তোমার তেমন দেখা হয়নি। কীভাবে বুঝতে পারলে যে তিনিই তোমাকে ভালো উপদেশ দেবেন? শোন, তুমি কি খুব বেশি ডিপ্রেশনে থাক?’
‘না তো।’
‘জানো, যারা খুব বেশি ডিপ্রেশনে থাকে, তারা নিজেদের আপন এক জগত তৈরি করে ফেলে, যেখানে তাদের তৈরি কাল্পনিক চরিত্রও থাকে। তারা সেই কল্পনার সাথে কথা বলতে থাকে। এই ভদ্রমহিলাকে তুমি একবার দেখেছিলে তোমার ছোট মায়ের বাপের বাড়ি যাওয়ার পর। আরেকবার তাকে দেখেছিলে তোমার বাসায়। তিনি থাকতে তো এসেছিলেন। কিন্তু আমাদের গান-বাজনায় খারাপ লাগায় তিনি পরদিনই চলে গিয়েছিলেন অনু। আমার লাগছে তুমি যার সাথে কথা বলো, সে এই শাহনাজ আপা না, তোমারই অপর একটি চরিত্র।’
আমি দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইলাম।
‘তিনি আমার জন্য একটি কোরআন শরীফ রেখে গিয়েছিলেন।’
‘আমার মনে হয়, তার থেকেই তোমার ধারণার সৃষ্টি।’
‘আচ্ছা একটি কথা বলবেন?’
‘বলো।’
‘প্রেয়সী অর্থ কী?’
‘প্রিয়জনকে প্রেয়সী বলা হয়।’
‘ঠিক আছে। আমি আসি। আপনাকে ধন্যবাদ।’
আমি উঠলে তিনি বললেন, ‘অনু, একবার হলেও নিজের বাসায় যেয়ো। তুমি কি জানো, একবার তোমার বাবা উপদেশ নিতে আমার কাছে এসেছিলেন? আমিই তাঁকে তোমার কাছে যেতে বলেছিলাম। অনু, তোমার বাবার মনের অবস্থা ঠিক নেই। খুব নম্র হয়ে গেছেন। খুব কম কথা বলেন। আমার লাগছে তোমার সাথে যা করেছেন, তার জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছেন। ক্ষমা কিন্তু অনেক ক্ষমতা রাখে অনু। অনেক পরিবর্তনও আনতে পারে।’
বাবা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছেন। আমি গিয়ে তার হাত ধরলাম। এই প্রথমবারের মতো তার কাছে একটি আবদার করে বসলাম।
‘বাবা, আমাকে কি তুষারের কাছে নিয়ে যাবেন?’
বাবা কোমল কণ্ঠে বললেন, ‘কেন নয়? অবশ্যই নিয়ে যাব। চলো।’
আমি তার হাত ধরে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। সারাটি পথ আমার মস্তিষ্কে ফরহাদ ভাইয়ার বলা আরেকটি কথা প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। ‘তোমার এই সমস্যাগুলোকে ফেস করে সমাধান করো অনু। মূল থেকে মূলে আরও যাও। নইলে তোমার সমস্যা খারাপ কোনো দিকে ধাবিত হবে। বুঝেছ আমার কথা?’
হ্যাঁ, বুঝেছি, এইজন্যই আমি গিয়ে তুষারের বাসার সামনে হাজির হলাম। কিন্তু দরজায় তালা লাগানো। সে সম্ভবত এখনও বাইরে। সন্ধ্যা তো প্রায় হয়েই গেছে। যেকোনো মুহূর্তে সে চলে আসবে। পাশের বাসা থেকে আসমা ভাবি বেরুনোর পর আমাকে দেখতে পেয়ে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। আমরা তার ঘরে বসলাম। তার ছোট মেয়েটি আমাকে দেখতে পেয়ে সালাম দিলো।
‘অনু, তুমি কেন চলি আইলা?’
‘তুমি কি জানো আমি কেন গিয়েছিলাম?’
‘জানার কী প্রয়োজন? বুঝান যায়, কেন তুমি হেই লোকটারে ছাড়ি গেইলা।’
‘আমি কিছু বুঝিনি।’
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
‘তুমি এতো সুন্দর আর সুন্দর মনের মাইয়া, তোমার নসিব এমন হইল দেখি আমার বহুত খারাপ লাগে।’
‘শরীফরে কিছুই কয়নি হেই হারামজাদা।’ বাসায় কবে শরীফ ভাইয়া ঢুকলেন বুঝতে পারিনি। ‘বদমাইশ একটা। আত্মগোপন করতে আইছিল নাকি। এমন বাজে লোক আমাদের এহানে তাহে জানলে কহনই এই গেরামের মুখ দেহাইতাম না।’
‘এভাবে কেন বলছেন ওর সম্বন্ধে?’
‘সাফের ছোবল মারতে দেরি লাগে না বইন। হে একটা সাফ ছিল সাফ। এই দেখ, আমার চোখের এই দাগ। গাছের উপর হেরে লই বসে থাকতাম বলে হে আমার চোখের নকশাই পালটায় দিছে। এমন ডেঞ্জারাস মানুষ আমি আর দেহি নাই। ভালা হয়ছে, হেরা তারে লইয়া গেছে। আপদ গেল।’
‘কারা তাকে নিয়ে গেছে?’
‘তুমি যেদিন চলি গেইলা, সেদিন আইছিল একঝাঁক লোক। দশ-পনেরো জন গুণ্ডা মতো লোক। হেরাই কইল কাসেদ হেগো লোক। বিশ্বাস করো, আমার বুঝতে এক মিনিট লাগে নাই হেরা মিথ্যা কইতেছে না। হেরা ওরে ধরে-পিটে লই গেছে।’
‘কী? তুষার এখন নেই? কোথায় ওকে নিয়ে গেছে?’
‘যেমন যেমন লোক ছিল, বেঁচে থাকিলেই বড় কথা।’
আসমা ভাবি বললেন, ‘তুমি কিছু জানতা না? আমি ভাবলাম, বলাকওয়া ছাড়া এইজন্যই তারে ছাড়ি চইলা গেলা।’
‘বাবা, তুষারকে ওরা কোথায় নিয়ে যেতে পারে? আপনাকে ছোট মা কিছু বলেনি?’
‘আমি জানতাম না, তুষারের সম্বন্ধে। আরমিন কেবল বলেছে, ও তোমাকে শাসনে রাখবে।’
‘ছোট মা জানতেন। ওয়াজেদ ভাই বিয়ের আগেই তুষারের সম্বন্ধে সব তাকে বলেছে। আমাকেও বলতে গেলেন..’ আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। গলায় যেন কিছু আটকে পড়েছে।
‘শান্ত হও অনু। মা শান্ত হও। তুষারকে খুঁজে বের করব। এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না।’
আমি কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়লাম, ‘আমি ছাড়া ওর কেউ ছিল না বাবা। ওর আপনজনেরা ওকে ছেড়ে দিয়েছে। সে প্রায়শ্চিত্ত করতে এসেছিল। সে ভালো মানুষ হতে চেয়েছে। কেউ বুঝেনি। আমরা ওকে কোথায় পাব বাবা?’
বাবা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে জবাব দিলেন, ‘এমন লোকের দল কখনও কোনো সদস্যকে দল থেকে বেরুতে দিতে চায় না, তাদের ধরিয়ে দেবে ভেবে। তুষার হয়তো তার গ্যাং-এর জন্য বিপদজনক ছিল। বেশিদিন আত্মগোপন করে থাকতে পারেনি।’
‘ছিল পারেনি এসব বলবেন না বাবা। ও বর্তমান আছে। আমার স্বামী জীবিত আছে।’
‘শান্ত হও অনু। যা হইবার হইয়া গেছে। এই নাও, এই চাবিটা। তুমি ওর বউ ছিলা। এহন বাসাটার চাবি তুমি রাখ।’
আসমা ভাবি বাসাটির অন্য একটি চাবি আমাকে ধরিয়ে দিলেন। আমি এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে ছুটে গেলাম আমার আর তুষারের সংসার পাতা ছোট্ট ঘরটিতে। কিছু জিনিস এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের সাথে কি সে এমনভাবে ধস্তাধস্তি করেছে? আমি ঘরের কি রান্নাঘরের প্রতিটি জায়গায় যেন তাকে দেখতে পাচ্ছি। তার অস্তিত্ব চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। হঠাৎ আমার একটি কাগজের কথা মনে পড়ল। আমি ড্রেসিং টেবিলের নিচের ড্রয়ারে খুঁজে দেখে ডকুমেন্টের কাগজটি পেলাম। তার দিকে বেশ কিছুক্ষণ আমি চেয়ে রয়েছি।
‘এটা কী অনু?’
খুব শান্ত ভঙ্গিতে বললাম, ‘একটি জায়গার উইল। বাবা আমাকে ওখানে নিয়ে যাবেন? ও এটার দায়িত্ব আমাকেও দিয়েছে।’
বাবা আমার কাঁধে হাত রাখলেন। আমরা বাসাটি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ভাবলাম, নদীর ঢেউ যেভাবে দূরে কোথাও গিয়ে মিলিয়ে যায়, আমিও ঠিক সেভাবে জীবনের কোনো এক জায়গায় মিলিয়ে যাব। আমার জীবন সমান্তরাল হয়ে যাবে। ভাগ্যে কি এভাবেই সমান্তরাল হওয়া লেখা ছিল?
‘এটা ওয়াজেদের বাসা।’ বাবা বললেন, ‘আমি যখন এখানে এসেছিলাম, তখন কিছু লোক কারে করে এসেছিল।’
‘আপনার পাশের প্লেটটিতে দেখুন, তুষার নিবাস লেখা আছে।’
‘আমি তো খেয়ালই করিনি।’
‘বাবা, আপনি চলে যান। আমি একা থাকতে চাই।’
বাবা রাস্তায় আমাকে রেখে আর কিছু না বলে চলে গেলেন। আমি খুব ধীরে পা ফেলে ওই বাসাটিতে গিয়ে কলিং বেল বাজালাম। সুন্দর এক মহিলা দরজা খুললেন। তাকে আমার পরিচিত লাগছে। তিনি আমার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছেন। না, আমার চোখগুলোর দিকে।
‘আপনিই কি তুষারের বোন? ইশা?’
তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ।’
‘আমি কি ভেতরে একটু ঢুকতে পারি?’
‘হ্যাঁ আসো। ভেতরে আসো।’
ওয়াজেদ ভাইয়া বাসায় নেই। আমার এই বাসায় তেমন একটা ভালো লাগছে না। তবু চারিদিকটা দেখতে লাগলাম।
‘চা খাবে?’
‘না। একটু পানি খাব।’
তিনি আমাকে পানি এনে দিলেন। আমার চোখে প্রশ্ন দেখে তিনি বললেন, ‘আমি আমার স্বামীর কাছে শুনেছি সে টানাটানা চোখের একটি মেয়েকে সাময়িকের জন্য বিয়ে করেছে। এই বাসাটি আমাদের মূল বাসা না। ভাইয়ার নামে মা এটি বানিয়েছিলেন। নইলে আমরা ঢাকায় থাকতাম। উপরের তলায় ভাইয়ার ঘর। দেখতে পারো। আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারি।’
ইশা তার আগে আমাকে একটি দেয়ালের সামনে আনলেন। দেয়ালে একটি বড় পেইন্টিং টাঙানো আছে। একটি বড় ময়ূর সদৃশ মেয়ে বৃষ্টিতে নাচছে, তার পাশে ছোট একটি তার মতোই মেয়ে ছোট ছোট পায়ে নাচছে। তাদের পাশে আছে একটি বানর। আমি অজান্তেই হেসে ফেললাম।
‘ভাইয়া সম্ভবত তার পড়ালেখা নিয়েও তোমায় মিথ্যা বলেছে। সে অনার্সের তৃতীয় বর্ষের পর আর পড়েনি। এটুকু পর্যন্ত ভাইয়ার পেইন্টিং-এর শখ ছিল। কিন্তু.. বাবার মতোই খারাপ পথে যাওয়ার পর সে এসব ছেড়ে দিয়েছে। আমার মা ছিলেন এই পশুগুলোর মাঝে একমাত্র মানুষ। খুব করে ভাইয়াকে ধরে রাখতে চেয়েছেন। পারেননি।’
তিনি আমাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন। আবার বলতে শুরু করলেন, ‘কিন্তু আমি বোধ হয় পেরেছি।’
আমি তার দিকে তাকালাম। তার চোখে পানি টলমল করছে।
‘একবার আমি দুর্ভাগ্যক্রমে ভাইয়ার গ্যাং-এর কিছু লোকের লালসার শিকার হয়েছিলাম। ওরা জানতই না কার বোনকে ওরা রেপ করতে নিয়েছে। ভাইয়া শুনেছে। কিন্তু জানত না, ওটা আমিই ছিলাম। যখন জানতে পেরেছে, তখন আমার সর্বনাশ হতে হতে আমি বেঁচে ফিরেছি। আমি এতটাই বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলাম যে, ওকে আর ভাইয়া বলে ডাকিনি। মা তো তাকে ছেড়ে দিয়েছেনই। আমিও.. সম্ভবত এইদিক থেকেই তার শিক্ষা হয়েছে। সে আর বাজে কাজে থাকতে চাইল না। কিন্তু সব সহজ নয়। সে আত্মগোপন করে নিজেকে শোধরাতে পালিয়ে গেছে, আমার কাছে ওয়াজেদকে পাঠিয়ে। সম্ভবত তাকে আমাকে বিয়ে করার বিনিময়ে এখানে থাকতে দিয়েছিল ভাইয়া।’ তিনি দীর্ঘ একটি শ্বাস ফেললেন। আমরা উপরে উঠে এলাম।
‘কিছুদিন আগে বাসায় কিছু লোক এসেছে। ওরা জেনেছে, ওয়াজেদ তুষারের একমাত্র বন্ধু, যে কিনা তার ঠিকানা জানে। ওয়াজেদকে খুব মারধর করে তারা ভাইয়ার ঠিকানা জেনে নিয়েছে। ও তাড়াতাড়ি ভাইয়াকে সাবধান করতে চলে গেছে। শুনেছি, ভাইয়া সেদিন তোমাকে বিদায় দিচ্ছিল। তোমাকে কিছুই জানায়নি, যাতে তুমি যদি তাকে সামান্যও পছন্দ করে থাক তবে যেন কষ্ট না পাও।’
আমি আর শুনতে পারছিলাম না। বলতে ইচ্ছে করল, থামুন, আমি আর কিছু শুনতে চাই না। তখন তুষারের ঘরের দরজার কাছে এসে পড়লাম।
‘আমি জানতাম না, ভাইয়া কাউকে কোনোদিন সত্যিকার ভাবে ভালোবাসতে জানবে, সে সত্যিকার ভাবে প্রায়শ্চিত্ত করবে। সেদিন জানার পর ওয়াজেদ মিনতি করেছিল, প্লিজ তোমার বাবাকে বলো কিছু একটা করতে, আমার বন্ধুকে বাঁচাতে বলো। প্লিজ। নিজের ছেলের জন্য কি তিনি এটুকু করতে পারবেন না? আমি বললাম, যে বাবার পথ দুই বছর আগে ছেড়ে দিয়েছে, তাকে কি তিনি ক্ষমা করবেন? আমি তবু ভাইয়ার কথা ভেবে বাবার কাছে হাতজোড় করেছি। তিনি ওই লোকগুলোকে কিছু টাকা দিয়ে দমিয়ে দিয়েছেন।’
আমি তার দিকে ঘুরে তাকালাম। তিনি ম্লান হেসে দরজাটি খুলে দিলেন।
‘ভাইয়া, আমার তো মনে হয়, তুমি এই মেয়েকেই ডিজার্ভ করো।’
তুষার সোফায় বসে বই পড়ছিল। একটি হাত তার গলার সাথে ঝুলে আছে। তার পাশে একটি ক্র্যাচ। সে আমাকে দেখে ক্র্যাচ ধরে উঠে দাঁড়াল।
‘অনন্যা। তুমি?’
‘ঘুষার। বলেছিলাম তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই।’
ইশা কবে চলে গেলেন খেয়াল করিনি। আমি তুষারের দিকেই অপলক তাকিয়ে রয়েছি।
‘তোমার এখানে আসা ঠিক হয়নি অনন্যা। তুমি ভালো কাউকে ডিজার্ভ করো।’
‘আরেকবার বলো এই কথা। তোমার যে গালটি ফুলেনি, ঘুষি মেরে ফুলিয়ে দেই।’
সে হাসল। এটির কারণে আমার মনের মাঝে এখন যে আরও বেশি তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে সে কি জানে? সে কি জানে, যে ঢেউ আমাকে একূলে এনে দিয়েছে, তাকে সহস্র ধন্যবাদ দিয়ে এই কূলেই ঘর বাঁধতে চাই?
‘আমি কেন আসব না? তোমার রাতে পানি খাওয়ার অজুহাতে আমাকে দেখতে আসাটা কি মিথ্যা ছিল? নাকি তোমার আড়চোখে আমার দিকে চাওয়াটা? নাকি সেইরাতে আমাকে লাল শাড়ি পরে একবার তোমার দেখতে চাওয়াটা? এসব করে আসার পর তুমি বলছ, তোমার কাছে আসাটা ঠিক হয়নি?’
সে কিছু বলতে পারল না। আমি কেবল তার হাত ধরে একটি কথাই বলতে পারলাম।
‘আমার অনেক প্রশ্নের জবাবদিহিতা করতে হবে। স্বপ্নাকে বলতে হবে আমি অবশেষে কোন পথে গিয়েছি, বাবাকে বলতে হবে তোমার দেখা কোথায় পেয়েছি, সাদিককে বলতে হবে কেন আমি তাকে বিয়ে করব না। এতগুলো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। চলো, কয়েকদিনের জন্য দূরে কোথাও চলে যাই, যেখানে প্রশ্ন করার কেউ থাকবে না।’
‘একটি প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাবে। আমরা কোথায় গিয়েছি।’
আমরা সত্যিই নিরুদ্দেশ হয়ে যাব। এমন একটি জায়গায়, যেখানে তুষার কাঠের গন্ধ বয়ে বেড়াবে। আমি যাব নদীর পাড়ে বাচ্চা পড়াতে। মাঝে মাঝে পড়াব একটি বড় বাচ্চাকেও। যেখানে তুষার দরজার কাছে এসে বলবে, প্রেয়সী দরজা খোল। আমরা থাকব ওই গাছটির নিচে। তুষারকে বলব, দেখ দেখ ওই যে সুন্দরি ডাক্তার তোমার দিকে চেয়ে আছে। তুষার লজ্জিত হয়ে মুখ লুকাবে। আমরা যাব মাছ ধরতে। সারারাত মাছ ধরে মালিকের বকুনি খেয়ে বাসায় ফিরব। সবই আগের মতো হয়ে যাবে। কেবল থাকবে না আমার জেদটা। চেয়ে দেখব, স্বেচ্ছায় তৈরি করা সম্পর্ক বেশিদিন টিকে না। কিন্তু অপ্রত্যাশিত সম্পর্কের টান বেশি, এটিই দীর্ঘস্থায়ী।
(সমাপ্ত..)
লেখা: ফারিয়া কাউছার
(গল্পটি কেমন লেগেছে জানাবেন।)