#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১৪
নির্ঝর এক লাফে বেড থেকে উঠে খেয়াকে এক টানে বেডে বসালো।পেছন থেকে জড়িয়ে তার ঘাঁড়ে মুখ গুঁজে দিল।খেয়া চমকে উঠলেও নির্ঝরের শরীরের উত্তাপ টের পেল।সত্যি সত্যি জ্বর এসেছে।এখন উপায়?
খেয়া নির্ঝরের হাতের উপর হাত রেখে বলল,
__’আপনার সত্যি সত্যি জ্বর আসছে।কিছু একটা খেয়ে মেডিসিন খেতে হবে।আমায় ছাড়ুন।’
নির্ঝর উল্টো তাকে শক্ত করে জড়িয়ে বলল,
__’আমি বাসায় যাব।হসপিটালের ফিনাইলের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে।’
__’আচ্ছা পাগল মানুষ তো আপনি!মানুষ অসুস্থ হলে হসপিটালে যায় নাকি হসপিটাল থেকে উল্টো বাসায় যায়?আমায় ছাড়ুন।আপনার মাথায় পানি ঢালতে হবে।’
__’কিহ?আমায় মেরে ফেলানোর ধান্দা?মাথায় পানি ঢালবে মানে?’
খেয়া জিভ টেনে বলল,
__’স্যরি।মনে ছিল না।কিছু একটা তো করতে হবে।আমায় ছাড়ুন।’
নির্ঝর এবার বাচ্চাদের মতো বলল,
__’কিচ্ছু করবো না আমি।বাসায় না গেলে তোমায় ছাড়বো না।’
__’আগে মেডিসিনটা তো খান।তারপর দেখি কি করা যায়?’
__’বাসায় গিয়ে গরম গরম স্যুপ খেয়ে মেডিসিন খাব।তার আগে নয়!’
খেয়া বিপদে পড়ে গেল।তার গলা ছেড়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।একে নিয়ে এখন কি করবে?হসপিটালের অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাবে এখন?একবার চেষ্টা করবে কি?
__’আপনি শুয়ে পড়ুন।আমি বাসায় যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।দেখি ইমার্জেন্সি কার পাওয়া যায় কি না।কিন্তু বাসায় গিয়ে যদি জ্বর বেড়ে যায় তখন?’
নির্ঝর ছাড়া ছাড়া ভাবে বলল,
__’বাড়বে না।তুমি বাসায় যাওয়ার ব্যবস্থা করো।ড্রাইভারকে রাতে এখানে থাকতে বলোনি কেন?’
__’আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন।সেজন্য ভাবলাম কাল সকালে যাব।এখন ছাড়ুন তো!’
খেয়া একপ্রকার জোর করে নির্ঝরকে ছাড়িয়ে শুইয়ে দিল।চাদর টেনে গলা পর্যন্ত ঢেকে রুমের বাইরে এলো।
নির্ঝরের কেবিনের পাশেরটাতে এক বয়স্ক মহিলা এডমিট হয়েছে।তার পাশে সারাক্ষণ একটা ফর্সামতো নার্স বসে আছে।
নার্সটার অল্প বয়স।দেখেই বোঝা যাচ্ছে সবেমাত্র পড়ালেখা শেষ করেছে।তবে ধৈর্য্য আছে বোঝা যাচ্ছে।অসুস্থ মহিলাটি একটু পর পর খুকখুক করে কাশছে।কিন্তু তাকে বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে না।
খেয়া নার্স মেয়েটার উপর কৃতজ্ঞতা অনুভব করলো।
সে দরজার উপর মৃদু শব্দ করে নার্সটার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।নার্সটার চোখে চোখ পড়তেই সে ইশারায় বাইরে বের হতে বলল।
বাইরে আসতেই খেয়া তাকে টেনে নির্ঝরের রুমে নিয়ে গেল।নির্ঝর চোখ বন্ধ করে আছে।খেয়া নার্সকে বলল,
__’দেখুন তো!মনে হয় জ্বর এসেছে।’
খেয়ার কন্ঠ কানে যেতেই নির্ঝর চোখ খুলল।তার দু চোখ অতিরিক্ত লাল হয়ে গেছে।নার্স মেয়েটা শরীরের তাপমাত্রা চেকের জন্য হাত বাড়িয়ে নির্ঝরের গাল স্পর্শ করতে নিতেই নির্ঝর ঝট করে মাথা সরিয়ে নিল।
নার্স মেয়েটা বেশ অবাক হয়ে তাকাল।নির্ঝর খেয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
__’স্যরি!আমায় স্পর্শ করবেন না।অন্য মানুষের স্পর্শ আমার ভালো লাগে না।আমার সেবা করার জন্য বউ আছে।’
নার্স মেয়েটার সাথে সাথে খেয়াও চমকাল।জ্বরের ঘোরে এসব বলছে নাকি?খেয়া নির্ঝরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
__’কিসব বলছেন?কিসের স্পর্শ?উনি ডাক্তার।’
__’তো?আমি মহিলা ডাক্তার দেখাব না।উনাকে রুমের বাইরে যেতে বলো।আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের ড্রাইভার এসে যাচ্ছে।সব ফরমালিটিজ পূরণ করে বাসায় যাব।’
নার্সটা হয়তো বেশ অপমানিত বোধ করলো।তাছাড়া এ বয়সী মেয়েদের অভিমান একটু বেশি থাকে।খেয়া তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,
__’দুঃখীত।জ্বরের ঘোরে বলছে এসব।কিছু মনে করবেন না।’
নির্ঝর বেশ কড়াভাবে বলল,
__’আমি আপাতত কোনো ঘোর টোরে নেই খেয়া।বেশ সুস্থ মস্তিষ্কে আছি।দেখো,ড্রাইভার এসে গেছে বোধ হয়।একটু আগে আমি ফোন করে তাকে আসতে বলেছি।’
নির্ঝরকে মনে মনে গালি দিতে দিতে খেয়া নার্সকে সাথে নিয়ে বাইরে বের হলো।প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাদের ড্রাইভার লতিফ চাচা এসে দাঁড়াল।
লতিফ চাচার চোখ মুখ ফোলা ফোলা।হয়তো কাঁচা ঘুম ভেঙে ড্রাইভ করে এসেছে। যদিও হসপিটাল বাসা থেকে বেশি দূরে নয়!তবুও এত রাতে মানুষটাকে জ্বালানোর জন্য খেয়ার কষ্ট হলো।
১৯.
খেয়া স্যুপ বানিয়ে নির্ঝরের রুমে গেল।নির্ঝরের গায়ের তাপমাত্রা আগের থেকে বেশ বেড়ে গেছে।একটু আগে মাপা হয়েছে।১০৪ ডিগ্রি প্রায়!
ফজরের আযানের সময় হয়ে গেছে।তার নিজের মাথাটাও কেমন ভার ভার লাগছে।মনে হচ্ছে অসুস্থ হয়ে পড়বে এক্ষুণি।একটু ঘুমাতে হবে।
নির্ঝরের গায়ে দুটো কম্বল পেঁচিয়ে দেয়া হয়েছে।তবুও একটু পর পর কেঁপে উঠছে।খেয়া তার পাশে বসলো।
__’শুনছেন?একটু উঠুন।’
নির্ঝর উত্তর দিল না।খেয়া তার গা থেকে কম্বল সরিয়ে দিল।নির্ঝর লাল লাল চোখ মেলে তাকাল।
সে অতি সাবধানে নির্ঝরকে উঠিয়ে পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে বসাল।তারপর চামচে স্যুপ নিয়ে মুখের সামনে ধরলো।নির্ঝর এক চামচ খেয়েই খেয়ার হাত থেকে স্যুপের বাটি নিয়ে বলল,
__’অসুস্থ হয়ে সত্যিই মাথার কোনো ঠিক নেই।তুমি তো সেই ওই রাতে খেয়েছো।আর কিছু খাওয়া হয়নি।কিছু একটা খাও।’
__’খিদে নেই আমার। আপনি খান তো!’
__’তুমি খাবে না?’
__’না বললাম তো।’
__’ঠিক আছে।আমিও খাবো না।’
__’আমি কিন্তু রেগে যাবো এখন।চুপচাপ খান তো।’
__’ঠিক আছে।তুমি খেয়েই রাগ করো।’
খেয়া হতাশ হয়ে নির্ঝরের হাতের বাটি থেকেই কয়েক চামচ খেল।সত্যি সত্যি তার একটু ক্ষুধা লেগেছিল।কিন্তু খাওয়ার মুড ছিল না।চামচটা স্যুপের বাটিতে দিয়ে বলল,
__’এবার খুশি তো?বাকিটুকু তাড়াতাড়ি শেষ করুন।’
নির্ঝর মুচকি হেসে পুরো বাটি ধরে এক চুমুকে সব শেষ করলো।খেয়া ট্যাবলেট খুলে খাইয়ে ওয়াশরুমে গেল।
টাওয়াল ভিজিয়ে এনে নির্ঝরের সামনে ধরে বলল,
__’হাত পা একটু মুছে ফেলুন।ভালো লাগবে।’
__’আমি পারবো না।চাইলে তুমি মুছে দিতে পারো।না হলে বাদ দাও।’
খেয়া মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে নির্ঝরের হাত পা মুছতে লাগলো।নির্ঝর তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
খেয়া বিরক্তির চোখে তাকিয়ে বলল,
__’হাসবেন না তো!বিরক্ত লাগছে।’
নির্ঝর হেসেই বলল,
__’তোমাকে বিরক্ত করতে কি যে ভালো লাগছে!
“তুমি বড় অবুঝ,
কেন তুমি হীনা রঙহীন পৃথিবীকে মনে করো সবুজ?”
বলো, লাইন দুটো কেমন?জ্বরের কারণে মাথায় শুধু কবিতার লাইন ঘুরছে।’
খেয়া কিছু বলল না।মুখ দিয়ে বিরক্তি ভাব প্রকাশ করলেও সত্যি বলতে তার নিজেরও ভালো লাগছে নির্ঝরের সেবা করতে পেরে।ইদানীং নির্ঝরের কাছাকাছি থাকলে তারও প্রচুর ভালো লাগে।কিন্তু সে নির্ঝরকে বুঝতে দিতে চায় না।নির্ঝর যদি তাকে বেহায়া ভাবে?
নির্ঝরকে পুনরায় শুইয়ে দিয়ে তার গায়ে ঠিকঠাক কম্বল টেনে দিল খেয়া।ওয়াশরুমে ঢুকে বেশ সময় নিয়ে হাতে মুখে পানি দিল।এখন একটু ফ্রেস লাগছে!
বেলকনি থেকে টাওয়াল নিয়ে হাত মুখ মুছে সে রুমে আসলো।নির্ঝরের দিকে তাকাল।আপাতত তারা রুমে দুজনই আছে।নুহা পাশের রুমে খালার সাথে ঘুমায়।
রুমের লাইট অন রেখেই এগিয়ে এসে বেডে বসলো খেয়া।নির্ঝর কম্বল পেঁচিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।মাথা৷ আঘাতটা পেছনের ডান সাইডে!
সে একটা বালিশ হাতে উঠে সোফায় গিয়ে বসলো।সোফাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল।পরমুহূর্তে কি মনে হয়ে নির্ঝরের ডান পাশে শুয়ে পড়লো।যদি কোনো প্রয়োজন পড়ে?
কয়েক মিনিট এপাশ ওপাশ করে সে নির্ঝরের মুখের এক সাইড থেকে কম্বল সরালো।কিছুক্ষণ আগে মেডিসিন খাওয়ানো হয়েছে।জ্বর কমেছে কিনা চেক করতে চাইলো।
সে সাবধানে নির্ঝরের গালে হাত রাখলো।তাপমাত্রা তো একটুও কমেনি।বরঞ্চ সময়ের সাথে আনুপাতিক হারে বেড়ে যাচ্ছে যেন!
খেয়া ভীত চোখে তার দিকে তাকাল।সঙ্গে সঙ্গে নির্ঝর চোখ খুলে কাত হয়ে তার দিকে তাকাল।তার রক্তলাল চোখের চাহনি দেখে খেয়া সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেল।
কয়েক সেকেন্ড নিরবে দুজন চেয়ে রইলো একে অপরের দিকে।তারপর ঝট করে নির্ঝর এক ধাক্কায় খেয়াকে নিজের পাশে শুইয়ে তার পেটের উপর হাত রাখলো।
তার গরম নিঃশ্বাস মুখে পড়তেই খেয়া ভীত কন্ঠে বলল,
__’ক-কি করছেন?দূরে যান।সরে যান একটু।’
নির্ঝরের যেন হুশ নেই।সে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে খেয়ার কাঁপা কাঁপা ঠোঁটের দিকে।
খেয়া বুঝতে পেরে ভয়ার্ত গলায় বললো,
__’আপনার জ্বর বেড়ে গেছে।আমায় ছাড়ুন।প্লিজ।সরে যান।’
খেয়ার কোন কথাই নির্ঝরের কানে ঢুকলো না।সে মুখটা নিচু করে খেয়ার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো।কয়েক সেকেন্ড লাগলো খেয়ার বুঝতে।পরক্ষণেই সে দুহাতে ঢেলে নির্ঝরকে সরিয়ে দিয়ে কেঁদে দিল।
নির্ঝর পুনরায় তাকে জড়িয়ে তার উপর নিজের সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দিল।বিড়বিড় করে বলল,
__’স্যরি!স-স্যরি।’
খেয়া অনেক চেষ্টা করেও নির্ঝরের মৈনাক পর্বতের মতো শরীরটাকে একচুল নিজের থেকে সরাতে পারলো না।সে নিরবে চোখের জল ফেলতে লাগলো।একটা সময় কান্না থামিয়ে চোখ বন্ধ করলো।
নির্ঝরের শরীরের সব তাপ যেন তার শরীরে স্থানান্তর হয়েছে।তারও কেমন জানি লাগছে।তারও কি জ্বর আসবে?নাকি অলরেডি এসেছে?
(চলবে)
#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১৫
২০.
সকালবেলা প্রচন্ড মাথা ব্যথার যন্ত্রণায় ঘুম ভাঙলো নির্ঝরের।সেলাইয়ের জায়গাটা কেমন ব্যথা করছে।দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করে চোখ খুলল সে।
মাথা কাত করে সে খেয়ার দিকে তাকাল।খেয়া তার হাতের উপর মাথা রেখে এলোমেলো ভাবে শুয়ে আছে।তার শাড়ির আঁচল ঠিক নেই। নির্ঝর চোখ সরিয়ে নিল।
এ বাসায় আসার পর প্রথম দিকে খেয়া থ্রি পিস পড়তো।সে নিজেই কিনে দিয়েছিল।মাঝে মধ্যে অফিস থেকে ফিরে দেখতো খেয়া শাড়ি পড়ে বসে আছে।নির্ঝরের ভাবতে ভালো লাগতো যে খেয়া তার জন্যই শাড়ি পড়েছে!
তবে তার সাথে বিয়ের পর বেশিরভাগ সময় সে শাড়ি পড়ে।কদাচিৎ অন্য ড্রেস পড়ে।খেয়াকে শাড়িতে কেমন বউ বউ লাগে।তার বউ!
খেয়ার গায়ের উপর কম্বল টেনে সাবধানে উঠে পড়লো নির্ঝর।মাথা প্রচন্ড ভারী হয়ে আছে।মনে হচ্ছে, একমণি বস্তা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে!
অতি সন্তর্পণে পা ফেলে ওয়াশরুমে গেল সে।
ফ্রেশ হয়ে বের মুখ মুছতে মুছতে বের হলো।বেডের দিকে চোখ পড়তেই তার মাথা ব্যথার যন্ত্রণা ভুলে হাসি ফুটে উঠলো।খেয়া ল্যাং মেরে কম্বল নিচে ফেলে দিয়েছে।শুয়ে আছে উল্টোদিকে।
খেয়া যে বাচ্চাদের মতো করে ঘুমায় তা নির্ঝরের অজানা নয়।খেয়া এ বাসায় আসার পর সে প্রায় রাতেই গিয়ে লুকিয়ে একবার করে দেখে আসতো।গায়ে কম্বল টেনে ঠিক করে দিত।পুরোটাই খেয়ার অজান্তে!
নির্ঝর ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় পেছন ঘুরে একবার মাথার ক্ষতটা দেখলো।তার রোমান্সের বারোটা বাজানোর জন্য বিড়বিড় করে টেবিলটাকে গালিও দিল।
পুনরায় বেডে এসে খেয়ার পাশে শুয়ে পড়লো।খেয়ার হাতটা নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে তার দিকে কাত হয়ে তাকিয়ে রইলো।খেয়া একটু নড়েচড়ে আবার ঘুমের অতলে হারিয়ে গেল।
খেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে নির্ঝর তাদের প্রথম সাক্ষাতের দিনটি স্মরণ করলো।
প্রায় তিন বছর আগে এক শীতের সকালে সে খেয়াকে প্রথম দেখে।
সেদিন প্রচুর শীত ছিল।কুয়াশায় রাস্তাঘাট তেমন পরিষ্কার ছিল না। রাস্তার পাশে সে গাড়ি থামিয়ে ফোনে কথা বলছিল।
হঠাৎ করেই তার চোখ যায় অদূরে বেঞ্চে বসে থাকা একটা মেয়ের দিকে।মেয়েটা তার কাছে থেকে একদম কুয়াশাকন্যা মনে হয়।চারপাশে থেকে কুয়াশা যেন তাকে ঘিরে রেখেছে।
নিজের লাগামছাড়া কৌতূহলকে দমন করতে না পেরে সে গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যায়।একটু কাছাকাছি হতেই সে বুঝতে পারে মেয়েটা নাক টেনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে।
সে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে যায়।পুষ্প?পুষ্প এখানে কি করছে?পরমুহূর্তে একটু গভীর দৃষ্টি দিতেই বুঝতে পারে মেয়েটা শুধু পুষ্পর মতো দেখতে।পুষ্পর মুখে কোনো সারল্যতা ছিল না।সে কঠিন ছিল।সে কখনো কান্না করতো না।
কিন্তু এই মেয়েটার সারামুখে এক ধরনের সারল্যতা,বাচ্চামো ফুটে উঠেছে।কেমন মায়া কাড়া কান্নার ভঙ্গি।নির্ঝরের বুকের ভেতর ঝড় বইতে থাকে।অন্য রকম অনুভূতির জন্ম হয় যা এর আগে কখনো হয়নি।এমনকি পুষ্পকে দেখেও নয়।
সে মেয়েটার পাশে কয়েক হাত দূরে বেঞ্চে বসে পড়ে।তার বুকের ভেতর ধুকপুক করছে।কাঁপুনি একটু কমতেই সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে,
__’আপনি কি কোনো কারণে আপসেট?’
মেয়েটা উত্তর দেয় না।একপলক তার দিকে চেয়ে আবারও কান্নায় মনোযোগ দেয়।
__’আপনি কি হারিয়ে গেছেন?ঢাকাতে নতুন?আমি কি কোনোভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
মেয়েটা এবারো কোনো উত্তর দেয় না।নির্ঝরের এবার বেশ রাগ হয়।আজব তো!কথা কেন বলছে না?এভাবে রাস্তায় কেউ কান্না করে?
সে একটু রেগে বলে উঠলো,
__’এই শর্টি, কথা বলছো না কেন?প্রশ্ন করছি কানে যাচ্ছে না?তুলে এক আছাড় দিবো!নাম কি?’
মেয়েটা একটু চমকে উঠলো তার কথায়। পরক্ষনে অবাক হয়ে বলল,
__’আপনি আমার উপর চিল্লাচ্ছেন কেন?’
__’কথা বলতে পারো না?কিছু জিজ্ঞেস করছি উত্তর দিচ্ছো না কেন?’
__’আপনার প্রশ্নের উত্তর দিবো কেন?’
__’আমি প্রশ্ন করেছি তাই!’
__’কি?আপনাকে চিনি আমি?’
__’নাহ।তবে আজ থেকে চিনবে!আমি নির্ঝর,নির্ঝর জুবায়ের।তোমার নাম কি শর্টি?’
__’আমার নাম আপনাকে বলবো কেন?আর আমাকে শর্টি শর্টি করছেন কেন?’
__’তুমি আমান চেয়ে অনেক শর্ট তাই!’
__’খবরদার আমাকে ওসব বলবেন না।আমি কিন্তু লোক জড়ো করবো।’
নির্ঝর রাগ কমানোর জন্য আশপাশে তাকাল।ফের খেয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলো খেয়ার সারা শরীরে কেমন শিশির জমেছে।মাথার চুলে ফোটা ফোটা শিশির বিন্দু।
সে মনে মনে খেয়াকে শিশিরকন্যা নাম দিল!
নিজেকে সামলে বলল,
__’কিছু কথা আছে যেগুলো পরিচিত দের কখনো বলা যায় না।কিন্তু অপরিচিতদের অকপটে বলা যায়।তোমার যদি এমন কোনো কথা থাকে তাহলে আমাকে বলতে পারো।আমি বেস্ট শ্রোতা হওয়ার চেষ্টা করবো।এতে করে তোমার কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে।এই দেখো,আমাদের মন খারাপ হলেই আমরা চাই কেউ একজন পাশে এসে বসুক,কাঁধে হাত রাখুক।কেউ একজন হাতটা ধরে বলুক “কি হয়েছে? আমায় বলো!”
জানি তাকে বললে সে সান্ত্বনা ছাড়া কিছুই করতে পারবে না।তবুও মনের প্রশান্তির জন্য, মনটাকে হালকা করার জন্য কাউকে বলা প্রয়োজন।তুমি কান্না থামিয়ে আমায় কিছু বলতে পারো।’
__’আমার নাম খেয়া!’
নির্ঝর হাসিমুখে তার দিকে তাকায়।খেয়া!খেয়াতরী!সে মনে মনে নামটা কয়েক বার আওড়ায়!
কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে,
__’তারপর?নামের আগে পড়ে কিছু নেই? ‘
খেয়া বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
__’না নেই!ছোটবেলা অতবড় নাম লিখতে পারবো না বলে মাদ্রাসায় শুধু খেয়া নাম দিয়েছিল।পরে আর পরিবর্তন করা হয়নি।’
__’নাম কে রেখেছে?’
খেয়া উত্তর দেয় না।
এভাবেই তার খেয়ার সাথে পরিচয়।এরপর মাঝে মাঝে ভাগ্যের ফেরে দেখা হতো।যত কৌতূহল জন্মে তত একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করতে থাকে।একে অপরকে জানতে থাকে।নিজের অরুভূতি গোপন রেখে একটা সময় তারা বন্ধুমানুষ হয়ে যায়।
একটা সময় মেয়েটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়।সে নানান অজুহাতে তার সাথে দেখা করতে থাকে!
খেয়া ডান হাতটা নির্ঝরের গায়ের উপর দিতেই তার ভাবনার রেশ কাটলো!
২১.
দুপুর বেলা নুহার স্কুলের সামনে গাড়ি থেকে নামলো খেয়া।আজ নুহা স্কুলে আসার সময় বায়না ধরেছে সে যেন নিতে আসে।
অগত্যা নির্ঝরকে দুপুরের মেডিসিন খাইয়ে, তাকে ঘুমাতে বলে সে এসেছে।
খেয়া ধীর পায়ে হেঁটে স্কুলের ভেতর প্রবেশ করলো।গেটের উত্তর দিকে গার্ডিয়ানের বসার জায়গায় গিয়ে বসলো।
নুহাকে নিতে যখনই আসে সেই এই জায়গাটাতেই বসে!আশপাশে প্রচুর গার্ডিয়ান এসে জড়ো হয়েছে।তার পাশে বসা নুহার ক্লাসমেট ছিনহার মাকে দেখে সে কুশল বিনিময় করলো।এর আগেও তাদের কথা হয়েছে।
প্রথম যেদিন ছিনহার মা তাকে আর নির্ঝরকে একসাথে দেখে সেদিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
__’আপনারাই তো পিচ্চি মানুষ।আপনাদের আবার এতবড় মেয়ে আছে? বিশ্বাস হতে চায় না।নিশ্চয়ই বাল্যবিবাহ ছিল।’
খেয়া সেদিন হেসে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়েছে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে স্কুল ছুটির ঘন্টা পড়লো।খেয়া যতবার এই ছুটির ঘন্টা শোনে ততবার কেমন নস্টালজিক হয়ে যায়!
তার ভাবনার মাঝে নুহা ছুটে এসে তার কোলে বসলো।খেয়া তার কপালে চুমু খেয়ে বলল,
__’আজকের ক্লাস কেমন লেগেছে?’
নুহা হাসিমুখে বলল,
__’ভালো মা!বাবাই কেমন আছে? ‘
__’একটু সুস্থ!বাবাই, তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে বলেছে।চলো!’
একটু থেমে খেয়া বলে,
__’নুহা,স্কুলে কিন্তু কারো সাথে মারামারি করবে না।কেউ মারলে আমাকে বলবে বা টিচারকে বলবে।’
নুহা মুখ ফুলিয়ে বলল,
__’মা,আমার ক্লাসের পাজি ছেলে দিশান আছে না?ক্লাসে ও আমাকে টিকটিকি বলে ক্ষেপায়।আমি নাকি টিকটিকির মতো চিকন।তুমি বলো মা,আমি কি টিকটিকির মতো দেখতে?’
নুহার মুখ ফোলানো দেখে খেয়ার হাসি পায়।ছোটবেলায় কেউ কিছু বললে সেও এভাবে মুখ ফুলিয়ে থাকতো।এটা অবশ্য সত্যি যে নুহা যত বড় হচ্ছে তত চিকন হয়ে যাচ্ছে।সে ভেবে রাখলো নির্ঝর সুস্থ হলেই নুহাকে ডাক্তার দেখাবে।
নিজেকে সামলে সে বলে,
__’মোটেই না মা!তুমি তো কি সুন্দর।কি বিউটিফুল আমার মেয়েটা!আমি দিশানকে বকে দিবো।চলো, আজ বাসায় যাই।’
নুহার হাত ধরে কয়েক পা এগিয়ে গেটের কাছে পৌঁছাতেই পেছন থেকে এক পিচ্চি কন্ঠ ভেসে আসে।সে খিলখিল করে হাসছে আর বার বার বলছে,
__’এই টিকটিকি!টিকটিকি?’
নুহা বেশ রেগে যায়।খেয়া দাঁড়িয়ে পড়ে।নুহা এর আগেও বেশ কয়েকবার তাকে দিশানের দুষ্টুমির কথা বলেছে।আজ তার গার্ডিয়ানকে বলা প্রয়োজন।
সে ঘুরে দাঁড়িয়ে তাদের থেকে কয়েক হাত দূরে হাস্যোজ্জ্বল এক বাচ্চাকে আবিষ্কার করে যে কিনা নির্ঝরের সমবয়সী এক ছেলের হাত ধরে আছে।
খেয়া কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বলল,
__’শুনছেন? আপনি কি দিশানের বাবা?’
ছেলেটা অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল।আশপাশে কিছু একটা খুঁজছে।খেয়ার দিকে না তাকিয়েই বলল,
__’আমাকে কি অত বুড়ো মনে হয়?এতবড় একটা ছেলের বাপ আমি?’
খেয়া বলল,
__’আপনি যেই হন,আপনার বাচ্চাকে বারণ করে দিবেন আমার মেয়েকে যেন না জ্বালায়।উল্টোপাল্টা নামে যেন না ডাকে।’
ছেলেটা অন্য দিকে তাকিয়েই বলল,
__’বললাম তো আমি ওর বাপ না।বাচ্চা আসবে কোথেকে?আমি ওর কাকু।’
দিশান হঠাৎ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,
__’মিথ্যে কেন বলছো বাবা?তুমিই তো আমার বাপ!আন্টি ইনিই আমার বাবা।ইনিই আমাকে বলেছে চিকন মেয়েদের টিকটিকি বলে ডাকতে হয়।’
ছেলেটা এবার বিরক্ত হয়ে দিশানের দিকে তাকায়।।দিশানের হাত চেপে বলল,
__’সবসময় দুষ্টুমি না?এক চড়ে দাঁত ফেলে দিবো বেয়াদব?কে তোর বাবা?’
খেয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
__’স্যরি, আসলে এত দু……….’
পরমুহূর্তে খেয়ার দিকে ভালো করে চোখ পড়তেই সে অবাক হয়ে বলল,
__’পুষ্প তুমি?’
(চলবে)