#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১২
খেয়া দৌঁড়ে এসেই এক লাফে নির্ঝরের গলা জড়িয়ে নিজের সম্পূর্ণ ভর তার উপর ছেড়ে দিল।আচমকা হওয়ায় নির্ঝর টাল সামলাতে না পেরে ড্রেসিং টেবিলের উপর পড়ে যায়।টেবিলের কর্ণারে মাথা ঠুকে যেতেই সে চাপা আর্তনাদ করে উঠে।
বাম হাতে খেয়াকে আগলে ওভাবেই বসে থাকে নির্ঝর।ডান হাতটা পেছনে নিয়ে মাথার আঘাতপ্রাপ্ত স্থান স্পর্শ করে।সঙ্গে সঙ্গে তার হাত ভিজে যায়।
হাতটা সামনে এনে মেলে ধরতেই টকটকে লাল রক্ত চোখে পড়ে।তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠে।সে দ্রুত দু চোখ বন্ধ করে বড় করে শ্বাস নেয়।
সে দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করে।খেয়াকে জিজ্ঞেস করে,
__’কিছু কি হয়েছে?তুমি ঠিক আছো?’
খেয়ার যেন হুশ নেই।খুশিতে সর্বাঙ্গ ঝলমল করছে।সে একগাল হেসে বলল,
__’আপনি জানেন,আমাদের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্ট দিয়েছে?আমি মাত্র আমার রেজাল্ট দেখলাম।আমি পাস করেছি নির্ঝর।সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে পাস করেছি।’
নির্ঝরের ব্যথাতুর মুখে হাসি ফুটে উঠে।সাথে বুকের ভেতর প্রশান্তির ঢেউ বয়ে যায়।আজ প্রথম খেয়া তাকে শুধু নির্ঝর,অনলি নির্ঝর বলে ডেকেছে।
সে কিছু বলতে নেয়।কিন্তু খেয়াকে জড়িয়ে রাখা তার হাতটা বার বার ঢিলে হয়ে আসতে চায়।সে ছাড়ে না।জোর করে আবার শক্ত করে ধরে।খেয়া নিজে থেকে এই প্রথমবার তাকে জড়িয়ে ধরেছে।তার কাছে এসেছে। সে কি করে তাকে দূরে ঢেলে দেবে?
সে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
__’তোমার রেজাল্টে আমি অনেক খুশি হয়েছি।তুমি খুশি হয়েছো তো?’
__’ও মা!খুশি হবো না কেন!আমি প্রচুর খুশি হয়েছি।ইচ্ছে হচ্ছে মাইক দিয়ে সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিই যে আমি পাস করেছি।আপনি তো জানেনই আমি কি অবস্থার মধ্যে পরীক্ষা দিয়েছি।’
__’তুমি চাইলে আমি মাইক ভাড়া করে সারা পৃথিবীকে জানাতে পারি।’
__’ডোন্ট ট্রাই টু বি ফানি!’
নির্ঝর কিছু বলতে চায়।কিন্তু পারে না।তার হাত দুটো ঢিলে হয়ে আসে।বিড়বিড় করে বলে,
__’খেয়াতরী, আমাকে ইমিডিয়েটলি হসপিটালে নিয়ে যাও।আমার মাথা ফেটে গেছে।’
খেয়া চমকায়।নির্ঝরের অস্পষ্ট কথায় এতক্ষণে তার হুশ ফেরে যেন।সে সরে আসতে নিতেই নির্ঝর রক্তমাখা হাত দিয়ে তার হাত চেপে ধরে।
সে হাতের দিকে চেয়ে ভয়ার্ত গলায় বলে,
__’রক্ত?আপনার হাতে ব্লাড কোথা থেকে আসলো?’
নির্ঝর আর কিছু বলতে পারে না।খেয়ার গায়ের উপর ঢলে পড়ে।সে নির্ঝরকে ধরে ফেলে।
নির্ঝরকে বেশ কয়েকবার ঝাঁকিয়ে বলে,
__’কি হয়েছে আপনার?কথা বলুন।প্লিজ কিছু বলুন।’
কিন্তু সে রেসপন্স করে না।দ্রুত নির্ঝরের মাথার পেছনের দিকে নজর দেয়।তার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠে।মাথার ব্যাক সাইড থেকে চুল বেয়ে রক্ত ঝরছে।
ভয়ে খেয়া হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।নিজের শাড়ির আঁচল চেপে ধরে আঘাতের জায়গায়।তারপর চিৎকার করে সবাইকে ডাকে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে ড্রাইভার চাচার সাহায্যে নির্ঝরকে হাসপাতালে নিয়ে যায়!
|১৭|
হসপিটালের বারান্দায় ৫০২ নাম্বার কেবিনের সামনে খেয়া পায়চারি করছে।তার শাড়ি একদম এলোমেলো হয়ে গেছে।সাথে মলিন মুখ।
একটুপর নার্সকে বলে সে নির্ঝরের কেবিনে প্রবেশ করলো।নির্ঝরকে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে।ঘন্টা খানেক পর জ্ঞান ফেরার কথা!
সে এগিয়ে গিয়ে নির্ঝরের বাম পাশের টুল টেনে বসলো।নির্ঝরের মাথায় ব্যান্ডেজ করা।মুখটা কেমন ফ্যাকাসে,পান্ডুর মতো হয়ে গেছে। বেশি ব্লাড বের হয়েছে!
খেয়া হাত বাড়িয়ে নির্ঝরের বাম হাতটা ধরলো।ডান হাতে স্যালাইন লাগানো।
নিজেকে কেন জানি তার অপরাধী মনে হচ্ছে।তার জন্যই নির্ঝর আজ হসপিটালাইজড্।ছি!সে কেমনে এমন কাজ করলো?এমন করে নির্ঝরকে জড়িয়ে ধরলো যে সে সরাসরি মাথায় আঘাত পেল?একদম হসপিটালে এডমিট হতে হলো?
খেয়া ঝরঝর করে কেঁদে দিল।কথায় আছে না,যত হাসি কত কান্না! নিজের রেজাল্ট শুনে যতটা না খুশি হয়েছিল,নির্ঝর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার সমান তো দূরে থাক,তার তিনগুণ বেশি কষ্ট হচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর খেয়ার হাতের ভাঁজে থাকা নির্ঝরের হাতটা নড়ে উঠলো।খেয়া ব্যতিব্যস্ত হয়ে নির্ঝরের দিকে তাকাল।
কয়েক সেকেন্ড পর নির্ঝর চোখ খুলল।চোখ খুলেই খেয়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।বিনিময়ে খেয়া কান্না সজল চোখে একটু হাসার চেষ্টা করলো।
ঝটপট বলল,
__’এখন কেমন লাগছে?আপনি ঠিক আছেন?’
নির্ঝর মুচকি হাসলো।হেসেই হালকা করে বলল,
__’হুঁ!’
খেয়া এই প্রথম লক্ষ্য করলো নির্ঝর হাসলে তার চোখও হাসে।সে হাসলে তার চোখও কি হাসে?একদিন আয়নাতে পরখ করতে হবে।তবে নির্ঝরের হাসির মতো তার হাসিও কি সুন্দর?নির্ঝরের হাস্যোজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি এত অপরূপ কেন?
এসব কি ভাবছে সে?তড়িৎ গতিতে নির্ঝরের হাতটা ছাড়িয়ে একটু পিছিয়ে বসলো। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ থেকে নির্ঝরের থেকে একটু দূরে থাকবে।নাহ!একটু নয়,যথেষ্ট দূরে থাকবে।
নির্ঝর বাম হাতটা দিয়ে নিজের মাথাসহ কপালের ব্যান্ডেজ স্পর্শ করলো।চোখের মণি ঘুরিয়ে একটু দেখারও চেষ্টা করলো।কিন্তু দেখতে পারলো না।
পরমুহূর্তে খেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
__’নুহা কোথায়?এখানে এসেছিল?’
__’জ্বি।এখানে থাকতে চেয়েছিল।অনেক বুঝিয়ে জমিলা খালার সাথে বাসায় পাঠিয়েছি।’
__’ভালো করেছো!’
তারপর কিছুক্ষণ দুজন চুপচাপ রইলো।খেয়া নিজে থেকে বলল,
__’রাত বেড়ে যাচ্ছে।আজকের রাতটা এখানেই থাকবেন নাকি বাসায় যাবেন?ডাক্তার কিন্তু ফুল রেস্টে থাকতে বলেছেন।’
নির্ঝর একটু হেসে বলল,
__’তুমি তো খুব সাংঘাতিক মেয়ে।প্রথম বার নিজে থেকে জড়িয়ে ধরেই হসপিটালে ভর্তি করলে।’
খেয়া কেঁদে দিল।কান্না করতে করতে বলল,
__’স্যরি!রেজাল্ট শুনে নিজের মধ্যে ছিলাম না।অনেক বেশি খুশি হয়েছিলাম।সেজন্য হুট করে……’
__’তোমার মনে হয়েছিল সারা বাংলাদেশে তুমি একাই পাস করেছো নাকি?’
__’একদম টিজ করবেন না।’
বলে খেয়া আরো জোরে কান্না শুরু করলো।নির্ঝর ছোট্ট করে ধমক দিয়ে বলল,
__’কান্না করছো কেন?কথায় কথায় কাঁদতে বারণ করেছি না?অল্পতে এই পানি নামক পদার্থটা বের করে কি শান্তি পাও বলোতো?’
খেয়া চোখের জল মুছে বলল,
__’চোখের পানি কোনো সাধারণ পানি নয়।উইলিয়াম ফ্রে নামক এক ব্যক্তি এই চোখের পানি নিয়ে ১৫ বছর গবেষণা করেছেন।তিনি বলেছেন, চোখের পানি কোনো সাধারণ পানি নয়।এটি পানি,শ্লেষ্মা,তেল ও ইলেকট্রোলাইটের জটিল মিশ্রণ।
শুধু পানি হলে এটি ঘর্ষণের ফলে চোখ জ্বালাপোড়া করতো।শীতকালে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নিচে হলে জমে বরফ হয়ে যেত।কিন্তু তা হয় না।বুঝতে পেরেছেন?জ্ঞানী জ্ঞানী কথা শুধু আপনি জানেন!আমিও কিছু কিছু জানি।’
নির্ঝর হো হো করে হেসে উঠলো।তার হাসির শব্দে বারান্দার জানালা দিয়ে দু একজন উঁকি দিয়ে চলেও গেল।
খেয়া তাকে বলল,
__’এত জোরে হাসবেন না।ব্যথা বেড়ে যাবে।’
__’মাথার আঘাতটা কি গুরুতর খেয়া?’
__’হুঁ।অতটা গুরুতর না হলেও একদম হালকা নয়।ড্রেসিং টেবিলের কোণা অনেক খানি ঢুকে গর্ত হয়ে গেছে।বেশি সেলাই লাগেনি।তিনটে সেলাই দিতে হয়েছে।কিন্তু একটু গভীর।’
__’আবার যেন মেন্টার না হয়ে যাই!’
__’দুঃখীত।ভেরি স্যরি!’
নির্ঝর হাসতে হাসতে বলল,
__’বাদ দাও তো।তোমার প্রথম হাগটা স্মরণীয় করে রাখার জন্য ধন্যবাদ।’
খেয়া মাথা নিচু করলো।হঠাৎ নির্ঝর হাসি থামিয়ে সিরিয়াস হয়ে বলল,
__’কাছে আসো!’
__’কি?’
__’বলছি কাছে এসে বসো।অত দূরে কেন বসেছো?’
__’আমি এখানেই ভালো আছি।আপনিও ভালো থাকবেন।কাছে গেলেই আবার কোথাও ব্যথা দিয়ে ফেলতে পারি।’
নির্ঝর নিজের বাম হাতটা বুকের বাঁ পাশে রেখে বলল,
__’আমার থেকে অত দূরে বসে আছো তাতে যে এখানে ব্যথা করছে, জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে সেটা কেন বুঝতে পারছো না?শুধু বাহ্যিক ব্যথাটা কেন দেখতে পাও?’
খেয়া লজ্জায় মাথা নিচু করলো।তার হার্টবিট্ আবার বেড়ে গেছে।এর শব্দ নির্ঝরের কান অবধি যদি যায়?ছি!
সে শাড়ির আঁচল টেনে ঢেকে বসলো।নির্ঝর এবার কিছুটা হুকুমের সুরে বলল,
__’কাছে আসো!’
খেয়ার সারা শরীর কাঁপছে।কাঁপা কাঁপা হাতে টুল টেনে বসতে নিতেই নির্ঝর এক হাতে টেনে তাকে বেডে বসাল।খেয়ার ডান হাতটা মুখের কাছে নিয়ে হালকা করে ঠোঁট ছোঁয়াল।
খেয়া চমকে বলল,
__’ক-কি করছেন?’
নির্ঝর উত্তর দিল না।খেয়ার হাতটা বুকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করলো।একটু পর ধরা গলায় বলল,
__’আই লাভ ইউ খেয়াতরী।’
(চলবে)
#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১৩
নির্ঝর উত্তর দিল না।খেয়ার হাতটা বুকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করলো।একটুপর ধরা গলায় বললো,
__’আই লাভ ইউ খেয়াতরী।’
খেয়া চোখ তুলে নির্ঝরের দিকে তাকাল।তার বুকের ভেতর এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করছে।অনেকটা স্রোতের মতো।তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে অন্য ভুবনে।যেখানে সে নতুন করে স্বপ্ন দেখবে।তার প্রতিটা স্বপ্নে শুধু নির্ঝর নামক মানুষটার আনাগোনা থাকবে।
তাদের ছোট্ট একটা সংসার হবে।জোড়া শালিকের মতো।একে অপরের মুখে খাবার তুলে দেবে।সংকটাপন্ন মুহূর্তে পাশে থাকবে একে অন্যের।
খেয়া গভীর আগ্রহে নির্ঝরের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই নির্ঝরের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসলো।আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।
সে নিজের হাতটা নির্ঝরের থেকে ছাড়িয়ে তার গায়ে চাদর টেনে দিল।হাতের স্যালাইন অর্ধেকের বেশি শেষ হয়ে গেছে।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে বাসায় ফোন করলো।ফোন রিসিভ করলো জমিলা খালা।
__’খালা,নুহা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?’
__’হ মা!চিন্তা কইরো না।ও আমারে অনেক পছন্দ করে।ছোডোবেলা থেইকা হাতে হাতে বড় করছি তো তাই।’
খেয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
__’খালা,কিছু খাইয়ে ঘুমিয়েছে তো?’
__’হ, খাইছে।বাবাজীর শরীল কেমন?’
__’জ্ঞান ফিরেছে।একটু সুস্থ এখন।আমরা আজ রাতে ফিরবো না।কাল সকালে রিলিজ নিয়ে ফিরবো।
__’ড্রাইভাররে দিয়া তোমাগো রাতের খাবার পাঠায় দিচ্ছি।সময় মতো খাইয়ো দুইজনে।’
__’ঠিক আছে খালা।এক বাটি স্যুপ পাঠিয়ে দিয়ো সাথে।ঘুমাও তোমরা। রাখলাম।’
খেয়া কল কেটে দিল।মোবাইলে সময় এখন রাত এগারোটা।সে হসপিটালের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।
|১৮|
গভীর রাতে পানির তৃষ্ণায় ঘুম ভাঙলো নির্ঝরের।চোখ খুলে প্রথমেই খেয়াকে খুঁজলো।খেয়া টুল টেনে বসে বেডে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।
সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।ডান হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো হাতে স্যালাইনের সুঁচ লাগানো নেই।সে অর্ধেকের মতো স্যালাইন দেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল।স্যালাইনটা যেহেতু শেষ,তার মানে রাত মোটামুটি বেশ হয়েছে।
দুহাতে ভর দিয়ে সে উঠে বসলো।মাথাটা প্রচন্ড ভারী হয়ে আছে।সাথে গা টা ম্যাজ ম্যাজ করছে।জ্বর টর আসবে নাকি?তার জ্বর আসার আগে শরীর এমন ম্যাজ ম্যাজ করে।
খেয়া এলোমেলো চুলে, অবিন্যস্তভাবে শুয়ে আছে।নির্ঝরের বুকের ভেতর কষ্ট অনুভব করলো।খেয়াকে এ অবস্থায় দেখে তার খারাপ লাগছে।রাতের বেলা বাসায় চলে গেলেই খেয়া ঠিকঠাক মতো ঘুমাতে পারতো।ধুর!
নিজেই নিজেকে গালি দিতে দিতে গায়ের চাদরটা খেয়ার শরীরে জড়িয়ে দিল।মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো বাম হাতে কানে গুঁজে দিল।
তারপর সারা রুমে ঘড়ি খুঁজলো।চোখে পড়লে না।হসপিটালে ঘড়ি থাকার কথা।এ রুমে নেই কেন?
বেড থেকে বেশ দূরে টেবিল। টেবিলের উপর প্লাস্টিকের জগে পানি রাখা।সাদা প্লাস্টিকের বাহির দিয়েই চকচকে পানি চোখে পড়ছে।নির্ঝরের তৃষ্ণা দ্বিগুণ বেড়ে গেল।
সমস্যা হলো এখন পানি পান করতে হলে তাকে হেঁটে টেবিল অবধি যেতে হবে।খেয়ার ঘুম যাতে না ভাঙে সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
সে প্রায় শব্দহীন ভাবে বেড থেকে নেমে ফ্লোরে পা রাখতেই খেয়া ঝট করে মাথা তুলে তাকাল।দ্রুত নির্ঝরকে দুহাতে ধরে একদম পরিষ্কার স্বরে বলল,
__’আপনি বিছানা থেকে নামছেন কেন?’
নির্ঝর হকচকিয়ে গেল।সে চাচ্ছিল খেয়ার ঘুম নষ্ট না করতে।অথচ, সেটাই হলো।
সে স্বাভাবিক ভাবে বলল,
__’তোমার কি ESP মানে Extra Sensory Perception বা সুপারন্যাচারাল পাওয়ার টাওয়ার আছে?এমন নিঃশব্দে উঠলাম তারপরও ঠিকই টের পেলে।’
__’আপনি কি ভেবেছিলেন আমি ঘুমিয়ে পড়েছি?’
__’ভাবাভাবির কি আছে!তুমি তো ঘুমিয়েই পড়েছিলে!তোমার চোখের সামনে আমি বেশ কয়েকবার হাত নাড়াচাড়া করে দেখেছি তুমি গভীর ঘুমে।’
খেয়া হাসলো।নির্ঝর মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো তার দিকে।কি অমায়িক হাসি!
খেয়া নির্ঝরকে পুনরায় বেডে শুইয়ে বলল,
__’আমার চোখ জাস্ট একটু লেগে এসেছিল।সেজন্য বন্ধ করেছিলাম।কিন্তু মস্তিষ্ক একদম সচল ছিল।কিছু লাগবে আপনার?পানি খাবেন?’
__’হুঁ।’
খেয়া গ্লাসে পানি ঢেলে নির্ঝরের হাতে ধরিয়ে দিল।নির্ঝর এক চুমুক খেয়েই মুখটা বিকৃত করলো।বলল,
__’পানি কেমন জানি লাগছে।মানে স্বাদ পাচ্ছি না।’
__’ডাক্তার ডাকবো?’
__’এত রাতে ডাক্তার ডেকে কি হবে?তাছাড়া সব ডাক্তার এখন রেস্ট নিচ্ছে।ইমার্জেন্সি না হলে আসবে না।ডাকলে হয়তো বড়জোর নার্স পাওয়া যাবে।’
__’তাহলে কি কোনো নার্সকে ডাকবো?’
__’নার্স দিয়ে আমি কি করবো?আমার সেবা শুশ্রূষা করার জন্য আমার ওয়ান এন্ড অনলি বউ আছে।’
নির্ঝরের মুখে বউ ডাক শুনে খেয়া লজ্জিত মুখে কয়েক পা পিছিয়ে গেল।
নির্ঝর ডান হাত বাড়িয়ে বলল,
__’হাত ধরো খেয়াতরী।’
খেয়াতরী!খেয়া মনে মনে দুবার উচ্চারণ করলো।কি সুন্দর নাম!নাকি নির্ঝর বলেছে বলে তার কাছে সুন্দর লাগছে?কোনটা?
__’কি হলো?হাত ধরতে বলেছি!’
__’ক-কেন?হাত ধরবো কেন হঠাৎ?’
__’গাধী,আমি ওয়াশরুমে যাবো।তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না আমি আরেক বার কোথাও পড়ে গিয়ে মাথা ফাটাই।’
খেয়া ইতস্তত করে নির্ঝরের হাত ধরলো।নির্ঝর তাকে এক হাতে প্রায় জড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল।খেয়ার আড়ালে সে মুচকি হাসলো।
সে যথেষ্ট সুস্থ এখন।তবুও কেন জানি খেয়াকে জ্বালাতে ভালো লাগছে।খেয়ার ছোট্ট ছোট্ট স্পর্শ গুলো পেতে মন চাইছে।সে নানান বাহানায় খেয়াকে কাছাকাছি চায়!
__’তুমিও ওয়াশরুমে ঢুকো।আমি একা বোধ হয় পারবো না।’
খেয়া বিস্ফারিত নয়নে বলল,
__’কি?’
__’হা হা।মজা করছিলাম।যাও!আমি একাই পারবো।’
নির্ঝর ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো।খেয়া সরে এসে বেডে পা তুলে বসলো।তার শীত শীত লাগছে।
মিনিট দশেক পর নির্ঝর বের হলো।দরজা খুলেই হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।খেয়া তার দিকে কেমন জানি করে যেন তাকাল।তারপর এগিয়ে এসে নির্ঝরকে ধরে বেডে শোয়াল।
__’আর কিছু লাগবে আপনার?এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করুন।ডাক্তার রাত জাগতে বারণ করেছেন।’
__’তোমার ডাক্তার আর কি কি বলেছে?মাই গড!আগে বলো তো,এই ডাক্তার ইয়াং নাকি ওল্ডম্যান?’
__’কি সব উল্টাপাল্টা কথা বলছেন?আপনার মাথা কি সত্যি সত্যি গেছে?’
__’কই যাবে?কতদূর যাবে?মাথা তো ঘুরেফিরে তোমার নামটাই জপ করবে।’
খেয়া কিছু না বলে টুলে বসলো।নির্ঝর নিজের কপালের ব্যান্ডেজকৃত অংশে একটু হাত ছুঁইয়ে বলল,
__’খেয়া আমার জ্বর আসছে মে বি।তোমার হাতটা দাও তো।একটু চেক করো।’
__’আমার হাতকে কি থার্মোমিটার মনে হয়?’
__’এর আগে তো থার্মোমিটার হিসেবে ব্যবহার করেছিলে।তাহলে আজ দোষ কোথায়?আচ্ছা যাও,আমি চোখ বন্ধ করছি।’
নির্ঝর চোখ বন্ধ করলো।খেয়া হাত বাড়িয়ে কপালের ব্যান্ডেজ স্পর্শ করলো।সম্পূর্ণ কপালই ব্যান্ডেজ করা।
নির্ঝর খপ করে খেয়ার হাত ধরে নিজের গলা স্পর্শ করাল।বলল,
__’পুরো কপালই তো ব্যান্ডেজ করা।বুঝবে কিভাবে যে গায়ের তাপমাত্রা বেড়েছে কি না?’
নির্ঝরের স্পর্শে খেয়া কেঁপে উঠলো।দ্রুত হাত সরিয়ে বলল,
__’জ-জ্বর নেই তো।’
__’জ্বর আছে।তুমি বুঝতে পারছো না।ভেতরে ভেতরে জ্বর বইছে।আমার চাদরে শীত যাচ্ছে না।তোমায় জড়িয়ে ঘুমাতে হবে।’
খেয়া ছিটকে একটু পেছনে সরে গেল।তোতলানো স্বরে বলল,
__’কি-কি বলছেন?এটা হসপিটাল, ভুলে গেছেন?’
নির্ঝর দুহাতের তালু ঘষে একটু তাপ সৃষ্টির চেষ্টা চালাল।পরক্ষণে দুহাতে গরম ফু দিয়ে বলল,
__’একদম ভুলিনি।আমি এই মুহূর্তে তোমায় জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে চাই।হসপিটালে তোমার যদি সমস্যা হয় তাহলে এক্ষুনি বাসায় যাবো।’
__’এখন কয়টা বাজে আপনার ধারণা আছে?’
__’নাহ,নেই।বলো কয়টা বাজে?যতটাই বাজুক, আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরবো মানে ধরবো।শুধু ধরবো না সাথে নিয়ে ঘুমাবো।’
__’ছি!এখন রাত তিনটের বেশি বাজে।আপনি ঘুমান তো।আমি আপনার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছি।’
__’তুমি বুঝতে কেন পারছো না আমার জ্বর এসেছে।প্রচন্ড শীত লাগছে।’
__’ব্যথা থেকে জ্বর আসবে।ডাক্তার বলেছে।আপনি কিছু খেয়ে মেডিসিন খান।’
__’কিছু খাব না,মেডিসিনও খাবো না।’
__’একদম পাগলামি করবেন না।চোখ বন্ধ করুন।’
নির্ঝর এক লাফে বেড থেকে উঠে খেয়াকে এক টানে বেডে বসাল। পেছন থেকে জড়িয়ে তার ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিল।খেয়া চমকে উঠলেও নির্ঝরের শরীরের উত্তাপ টের পেল।সত্যি সত্যি জ্বর এসেছে।এখন উপায়?
(চলবে)