#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০৪
পেছন থেকে কেউ গায়ে চাদর জড়িয়ে দিতেই চমকে উঠে খেয়া।দ্রুত ঘাড় ঘুড়িয়ে নির্ঝরকে দেখে স্বস্তি পায়।সাথে একটু লজ্জাও!কেন জানি হুটহাট নির্ঝরকে দেখলেই লজ্জায় লাল,নীল,বেগুনি হয়ে যায় সে!
চাদরটা ভালো মতো গায়ে জড়িয়ে নির্ঝরের দিকে তাকায়।নির্ঝর ইতোমধ্যে ফ্লোরে বসে পড়েছে।তার সামনে ধোঁয়া উঠা গরম দু কাপ কফি।খেয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠে।
নির্ঝরের দিকে চোখে চোখ পড়তেই ইশারায় তাকেও বসতে বলে।সে বসে পড়ে।এক কাপ কফি হাতে নিয়ে তাতে চুমুক দেয়।নির্ঝরও ততক্ষণে নিজের কাপে চুমুক দিয়েছে।
খেয়া এক চুমুক খেয়ে নির্ঝরকে বলে,
__’আপনি বানিয়েছেন? নাকি জমিলা খালা?’
নির্ঝর তার দিকে ঘুড়ে বলল,
__’কেমন হয়েছে সেটা বলো আগে।’
__’ভালোই তো লাগছে।শুধু চিনি একটু কম মনে হচ্ছে।’
নির্ঝর চট করে খেয়ার হাত থেকে কাপটা নিয়ে নিজে এক চুমুক দেয়।গম্ভীর হয়ে বলে,
__’কই!চিনি তো ঠিকঠাক আছে।বেশ মিষ্টি।তুমি বরং আমারটা খাও।’
বলে নিজের কাপটা এগিয়ে দেয়।খেয়া দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে নির্ঝরের কাপটা হাতে নেয়।
__’কি হলো?খাচ্ছো না কেন?স্যরি পান করছো না কেন?নাকি আমার এঁটো জিনিস খাবে না?’
খেয়া তড়িঘড়ি করে এক চুমুক দিয়ে বলল,
__’খাচ্ছি তো!নুহাকে তো ঘুম পাড়িয়ে ছাদে এসেছি।যদি ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ? ‘
__’ভাঙবে না।ওর ঘুম অনেক ভারী।তাছাড়া আমি জমিলা খালাকে বলে এসেছি।উনি দেখবে।এবার বলো,তুমি আমার মেয়েকে জাদু করেছ নাকি?তোমায় ছাড়া কিছু বোঝে না!আমাকেই সে সময় দিচ্ছে না।ভাবা যায়? ‘
__’আমি আবার জাদু করলাম কিভাবে?’
নির্ঝর বিড়বিড় করে বলে,
__’আমি আবার জাদু করলাম কিভাবে? ন্যাকা!আমাকে সেই কোন যুগে জাদু করে বসে আছে! ‘
__’কিছু বলছেন?’
__’না।আকাশের দিকে তাকাও!’
খেয়া আকাশের দিকে তাকায়।একটানা অনেকক্ষণ আকাশের দিতে তাকিয়ে থাকলে ঘোর লাগে চোখে।চারপাশ অন্যরকম মনে হয়।মনে হয় স্পর্শের বাহিরের আকাশটা,আবছা অন্ধকারের পর্দার মধ্যে মিটিমিটি জ্বলা তারা গুলো অনেক নিচে নেমে এসেছে।হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে যেন।কিন্তু খেয়া হাত বাড়ায় না।
নির্ঝর পাশ থেকে নরম সুরে বলল,
__’একটা কবিতা শুনবে?’
খেয়া নিজের অজান্তেই হুঁ বলে।যেন এই পরিবেশে একটা কবিতা না শুনলে একদম বেমানান দেখায়।
নির্ঝর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার শহরে আমি মানা,সর্বত্র তোমার আনাগোনা
ভালোবাসায় হাতটি ধরো একবার,
গড়বো দুজনে মিলে,সুখদুঃখের প্রেম ঝিলে
#জোড়া_শালিকের_সংসার!! ”
খেয়া নাক ছিঁটকায়।নির্ঝরের দিকে না তাকিয়েই বলে,
__’এটা কোনো কবিতা হলো?কবিতার ‘ক’ ও তো আপনি জানেন না দেখছি।এটাকে বড়জোড় ছন্দ বলা যায়।’
__’তুমি যা বলো তাই।ছন্দই বলো।তবে বেশ কিছুদিন হলো সারাক্ষণ মাথার মধ্যে এলোমেলো শব্দ ঘুরপাক খেতে থাকে।যতক্ষণ না তাদের ছন্দে রূপ দিই ততক্ষণ মুক্তি নেই।তুমি বুঝতে পারছ বিষয়টা?আমার একটা রোগ হয়েছে!ছন্দ মেলানোর রোগ।ছন্দ না মেলালে অস্থির অস্থির লাগে।শান্তি পাই না।’
__’অহ।ছন্দ মেলানোর রোগ!নতুন শুনলাম।’
__’তুমি বোধ হয় আমার কথা বিশ্বাস করছো না।তোমাকে আরও কয়েকটা শোনাই।’
খেয়ার হ্যাঁ,না উত্তরের অপেক্ষা না করেই নির্ঝর বলা শুরু করলো।
“অলস আঁখি সই,মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রই
ঝরা বকুলের পানে,
একমুঠো বিচ্ছিন্ন কেনো,এই অবেলায় সে যেনো
দুঃখ ডেকে আনে!!”
~সাফিয়া
“অবশেষে বসন্ত এলো তোমার দ্বারে,
উচ্ছলতা মেখে এগিয়ে যাও,
মোর আছে যে ভগ্নহৃদয়া,বর্ষিত নয়ন
প্রহেলিকার মৃত্যু কি শুনতে পাও?”
~সাফিয়া
“লোকচক্ষুর অগোচরে,
একদিন হারিয়ে যাবো চিরতরে।
সেদিন খুঁজবে তুমি রাতের তিমিরে
এই আমাকে খুঁজো তোমার হৃদয় মন্দিরে!”
~সাফিয়া
নির্ঝর আরো বলতে নিতেই খেয়া তাকে থামিয়ে দেয়।আপাতত সে এসব দুঃখের ছন্দ শুনতে চাচ্ছে না।
নির্ঝর খেয়ার দিকে তাকায়।আজ পূর্ণিমা না হলেও অন্ধকারের যে নিজস্ব আলো আছে সেটা এসে খেয়ার মুখে পড়েছে।কি মায়াবী লাগছে থাকে।ইচ্ছে হচ্ছে বুকে জড়িয়ে নিতে!
সে খেয়ার হাতের দিকে তাকাল।ফ্লোরে রাখা।তার হাত আর খেয়ার হাতের মাঝে কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব।সে অতি সাহসিকতার একটা কাজ করতে চাইলো।
নিজের বাম হাতটা খেয়ার অজান্তে আস্তে আস্তে তার হাতের কাছে নিয়ে স্পর্শ করার আগেই খেয়া হাতটা সরিয়ে চুল বাঁধতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।নির্ঝর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।সে এবারও ব্যর্থ হলো।
একটু শীত শীত অনুভব করতে নির্ঝর খেয়ার একটু কাছে ঘেঁষে বলল,
__’বেশ শীত পড়েছে বোধ হয়।তোমার চাদরের ভাঁজে একটু জায়গা দিবে?চাদরটা অনেক বড়।একটু জড়িয়ে নেবে?’
খেয়া এক ঝটকায় নিজের গায়ের চাদরটা খুলে নির্ঝরের সামনে মেলে ধরে।কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
__’আমি আমার অভিশপ্ত জীবনের সাথে কাউকে জড়াবো না।আমার শরীরে জড়ানোর ফলে চাদরটাও অপবিত্র হয়ে গেল।এটা এখন আমার মতোই সেকেন্ড হ্যান্ড।ব্যবহৃত জিনিস।একে নিয়ে কি করবো এখন?’
__’খেয়া, ঝিনুকে মুক্তা সৃষ্টি হয় কিভাবে জানো?’
খেয়া উত্তর দেয় না।নির্ঝর কিছুক্ষণ পর আপনমনে বলে,
__’ঝিনুকের ভেতর মুক্তা সৃষ্টি হয় দূর্ঘটনাক্রমে।ঝিনুকের ভেতরের পর্দায় অর্থাৎ ম্যান্টলে যখন কোনো ধুলোবালি বা ক্ষুদ্রাকৃতির বস্তু গিয়ে আটকে পড়ে তখন ঝিনুক তাতে ইরিটেশন ফিল করে।এই ইরিটেশনকে প্রশমিত করতে ওই বস্তুটিকে ঘিরে একটা খনিজ পদার্থের আবরণ তৈরী করে।একটু একটু করে আবরণ তৈরীর পরেই সেটা একটা পূর্ণাঙ্গ মুক্তায় পরিণত হয়।
তোমার বিয়ে, ডিভোর্স এসব একেকটা দূর্ঘটনা।এসব দূর্ঘটনা তোমার অজান্তে তোমাকে মুক্তাতে পরিণত করেছে।আগে হয়তো তুমি আমার কাছে কাঁচা সোনা ছিলে।এখন তুমি আমার কাছে মুক্তা।সবচেয়ে দামী মুক্তা।’
খেয়া কোন উত্তর দেয় না।তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরছে।এই অযাচিত জল লুকানোর জন্য সে এক দৌঁড়ে নিচে নেমে যায়।
নির্ঝর তাকে আটকায় না।তার মন বলছে খেয়া ফিরবে,তার কাছে ফিরবে।তাকে ফিরতেই হবে যে!তার ভাগ্যে এই মেয়েটাই আছে।তা না হলে প্রকৃতি নতুন করে তার কাছে যাওয়ার সুযোগ করে দিতো না।
৬.
দুপুরবেলা খেয়া একটু ঘুমানোর চেষ্টা করে।বিশ মিনিটের মতো বিছানায় গড়াগড়ি করেও ঘুম রাজপুত্রের মন জয় করতে পারে না।একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বাইরে বের হয়।
নিচে নেমে ড্রয়িং রুমে সোফায় কিছুক্ষণ বসে থাকে।নুহা স্কুলে,নির্ঝর অফিসে।আজ সকালে নুহাকে সে আর নির্ঝর দুজন মিলে একসাথে স্কুলে ছেড়েছে।নুহা সে কি খুশি!
খেয়া উপরে উঠে নির্ঝরের রুমের সামনে বেশ কয়েকবার পায়চারি করলো।ভেতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।এতদিন হলো এ বাসায় থাকার পরো মাত্র একঝলক সে রুমের ভেতরটা দেখেছে।
কিন্তু নির্ঝরের রুমটা দেখার তীব্র লোভ সামলাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ঢুকেই পড়ল।নির্ঝরের অফিস থেকে ফিরতে আজ লেট হবে।
ধীরপায়ে ভিতরে প্রবেশ করে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিল সে।সারা রুমে নজর নিক্ষেপ করলো।রুমের দেয়াল পিঙ্ক কালারের।দেয়ালে বড় বড় পেইন্টিং।ড্রেসিং টেবিল সোজা উপরের দেয়াল নির্ঝর আর নুহার একত্রে বড় একটা বাঁধানো ছবি।কি মিষ্টি লাগছে দুজনকে!
বেডের ডানপাশে একটা আলমারি।আলমারিতে প্রচুর বইপত্র।যার ম্যাক্সিমাম ইংরেজিতে।তবে সব যে ফিজিক্স সম্পর্কে সেটা বুঝতে পারলো।
কয়েক পা এগিয়ে আলমারির সামনে গিয়ে পুরো আলমারি ঘাঁটা শুরু করল।উদ্দেশ্য গল্পের বই খুঁজে বের করা।
কয়েক মিনিট পর বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে রাখা বাঁধানো এক ছবির দিকে নজর গেল।খেয়া ছবিটা টেনে বের করে চোখের সামনে ধরতেই তার হাত পা কাঁপা-কাঁপি শুরু হলো।
ছবিতে সে নিজে।তার কিশোরী বয়সের ছবি।বছর চৌদ্দ বয়সের।কিন্তু তার ওতটুকু বয়সের ছবি নির্ঝর কোথায় পেল?নির্ঝরের সাথে তো তার পরিচয় বছর তিনেক হবে।এক শীতের সকালে।তাহলে?এই ছবির কি মানে?
খট করে ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই খেয়া ভয়ে লাফিয়ে উঠল।সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখে নির্ঝর তার দিকে একরাশ অবাকত্ব নিয়ে তাকিয়ে আছে।
(চলবে)
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। 🖤