#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০২
নির্ঝর তাকে চুমু খেয়ে কোলে তুলে নিলো।খেয়া হা করে তাকিয়ে সব দেখছে।কিছুই তার মস্তিষ্কে ঢুকছে না।নির্ঝরের এতবড় মেয়ে আছে?তার মানে নির্ঝর যখন তাকে বিয়ের অফার দিয়েছিল তখন সে অলরেডি ম্যারিড?
কিছু বুঝে উঠার আগেই সে অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়লো!
__’বাবাই,উনি এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লেন কি করে?মাত্র আমার দিকে বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল।’
__’নুহা মা,ওকে উনি উনি করবে না।উনিকে আন্টি বলে ডাকবে আজ থেকে।মনে থাকবে লক্ষীটি?’
__’হুঁ, বাবাই।’
নুহা কোল থেকে নামতেই নির্ঝর খেয়ার দিকে তাকায়।খেয়া সোফাতে মাথা রেখেছে।তার দু চোখ বন্ধ।সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?এতদ্রুত কেউ ঘুমিয়ে পড়তে পারে? জানা ছিল না।
নুহাকে রুমে পাঠিয়ে খেয়ার পাশে বসে পড়ে সে।মেয়েটা বড্ড ক্লান্ত!এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো।আস্তে করে ডাক দেয় সে!
__’খেয়া?খেয়া? খেয়াতরী?’
খেয়া উত্তর দেয় না।নির্ঝর কিছুটা ভয় পেয়ে তাকে হালকা করে ধাক্কা দেয়।ডান হাতের উপর আলতো করে নিজের হাতটা রাখে।কতগুলো দিন পর খেয়ার স্পর্শ সে পাচ্ছে।তার চোখ দুটো ভরে উঠে!
একটা সময় এই স্পর্শ টুকুর জন্য সে কতটা ছটফট করেছে।কতটা জ্বালা যন্ত্রণা পেয়েছে।শুধুমাত্র খেয়ার সুখের কথা চিন্তা করে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।সবটা সহ্য করে গেছে।
একটু এগিয়ে এসে খেয়ার গালে হাত রাখল সে।খেয়ার কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে একটু ঝাঁকায়।পরমুহূর্তে ক্ষীপ্রপায়ে ডাইনিং থেকে গ্লাসে পানি এনে কয়েক ফোঁটা ছিটাতেই খেয়া কপাল কুঁচকায়।
নির্ঝর গ্লাস রেখে তার দুগালে হাত রেখে বলল,
__’খেয়া, ঠিক আছো তুমি?সেন্সলেস হয়ে গেছিলে নাকি?এখানে সেন্সলেস হওয়ার মতো কিছু ঘটেছে?’
খেয়া হাত দিয়ে ঠেলে নির্ঝরের হাত সরিয়ে দেয়।ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে,
__’আ-আমি ঘুমাচ্ছি জাহিদ।ডিস্টার্ব করবে না।ঘু-ঘুমাতে দাও তো!’
এটুকু বলেই খেয়া পাশ ফিরে শোয়।নির্ঝর কপাল কুঁচকে নিজের রাগ সামলানোর জন্য হাত মুঠ করে।কেন জানি সে খেয়ার মুখে তার প্রাক্তন স্বামীর নাম সহ্য করতে পারলো না।খেয়াকে তুলে এক আছাড় দেয়ার ইচ্ছে হলো।ইচ্ছেটাকে দমন করতে সে খেয়াকে নিচে রেখেই গটগট করে উপরে উঠে গেল।
নিজের রুমে গিয়ে বেশ সময় নিয়ে শাওয়ার নিল।ঘন্টা খানেক পর ট্রাউজার আর টিশার্ট পড়ে নিচে নামল সে।
খেয়া এখনো হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।তার ঘুমন্ত নিষ্পাপ বাচ্চাদের মতো ফেসটা দেখে নির্ঝরের সব রাগ যেন নিমেষে কর্পূরের মতো উবে গেল।সে হেসে ফেলল।
সে খেয়ার মুখ বরাবর হাঁটু গেড়ে বসে সোফার নিচে ঝুলে থাকা ডান হাতটা যত্ন সহকারে পেটের উপর রাখল।খেয়ার মুখটা শুকিয়ে গেছে।সারাদিন কান্না করার ফসল!
নির্ঝর পাশে থেকেও মেয়েটাকে সামলানো প্রায় দুষ্কর হয়ে উঠেছিল।কি হতো,সে যদি না থাকত?ভাগ্যিস সে খেয়ার খোঁজ খবর নিয়েছিল।না হলে তো জানতেই পারতো না যে তার সাথে এতবড় একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।খেয়ার ডিভোর্সের সংবাদ তার কাছে অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো।খবরটা শোনার পর সে মিনিট চল্লিশেক থম মেরে বসে ছিল।যেন ভুল শুনেছে।পরমুহূর্তে যখন মনে পড়ে খেয়ার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তখনই গাড়ি নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে তার খোঁজে।পেয়েও যায় দ্রুত!
সে ভেবেছিল,তাকে দেখে খেয়া প্রচন্ড রিয়েক্ট করবে।কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি।তাকে ভরসার স্থান ভেবে আরো মন উজাড় করে কেঁদেছে।একটা সময় তারা খুব ভালো বন্ধু মানুষ ছিল।আজ দেড় বছর পরে হঠাৎ সাক্ষাৎ খেয়াকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারেনি।যেন সে ধরেই নিয়েছিল আজ এই অসময়ে নির্ঝর তার পাশে থাকবে,তার অতৃপ্ত ধূসর মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে ঝরবে!
কিন্তু নির্ঝর অবাক হয়েছে।সে খেয়ার পাশে যতটা সময় রয়েছে অনেকটা আচ্ছন্নের মতো রয়েছে।তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না খেয়া, তার সেই পিচ্চি খেয়াতরী তার সাথে। তার এতটা কাছে!
খেয়ার ডিভোর্সের ব্যাপারটাতে তার মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে।খেয়ার কান্না দেখে তার খারাপ লেগেছে।কিন্তু খেয়াকে নতুন করে নিজের পাশে পাওয়ার লোভ নিমেষে তার সব খারাপ লাগা ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।সে খেয়ার গায়ে এক ফোঁটা দুঃখ পৌঁছাতে দেবে না।সে তাকে ভালো রাখবে।প্রচন্ড রকম ভালো রাখবে!
এটা সত্যি যে সে ভেবেছিল, খেয়া সুখে স্বামীর সংসার করছে।শুধুমাত্র সে হয়তো দিনে দিনে কঠিন বস্তুতে পরিণত হচ্ছে।
নুহা তার জীবনে না থাকলে সত্যি সত্যি হয়তো সে এতদিনে কঠিন বস্তু হয়ে যেত।কঠিন বস্তুতে যেমন তাপ প্রয়োগ করলে তা গলতে বাধ্য, নির্ঝরের জীবনেও নুহার ভালোবাসা,তার প্রতি দায়িত্ব তাপের মতো আচরণ করেছে।তাকে কঠিন হতে দেয়নি।
নির্ঝর দু হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিল খেয়াকে।সিঁড়ি দিয়ে উঠে তার পাশের রুমটাতে শোয়াল।গায়ের উপর চাদর টেনে নরম সুরে ডাকলো,
__’খেয়াতরী?আমার খেয়াতরী!’
খেয়া নড়েচড়ে ভালো মতো ঘুমাল।নির্ঝর তার পাশে বিছানায় বসলো।খেয়ার ঘুমন্ত চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো।তার লেখা প্রতিটা গোপন চিরকুটে সে খেয়াকে খেয়াতরী নামে ডাকতো!
তার প্রবল ইচ্ছে ছিল মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল আদুরে গলায় তাকে খেয়াতরী বলে ডাকবে।খেয়া ঘুম ঘুম চোখে লজ্জা লুকানোর জন্য তার বুকে মুখ গুঁজবে!
আজকেও খেয়াকে বুকে জড়িয়ে ঘুমানোর তীব্র ইচ্ছে হলো তার।কিন্তু ইচ্ছেদের ডানা গজিয়ে আকাশে পাখনা মেলে উড়ে বেড়ানোর আগেই তা ছেঁটে ফেলে দিল।মানুষের সব ইচ্ছেকে সবসময় প্রায়োরিটি দিতে নেই!
৩.
খেয়ার ঘুম ভাঙলো বেশ রাতে।চোখ না খুলেই বাম হাত দিয়ে বিছানায় হাতড়ে জাহিদকে খুঁজল।কিন্তু কেউ নেই সেখানে।সে ধপ করে চোখ খুলল।
আস্তে আস্তে তার সব মনে পড়ল।জাহিদ তো তার থেকে মুক্তি নিয়েছে।সে তো এখন নির্ঝরের বাসায় আছে।আবারো কয়েক মিনিট সে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিল।
নিজেকে স্বাভাবিক করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুরো রুমটাতে নজর বুলালো।রুমটা বেশ বড় এবং গোছানো।সব থেকে ভালো লাগবো রুমের সাথে দক্ষিণের দিকে লাগোয়া বেলকনিটা!
খেয়া বেশ দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে।সে নির্ঝরের এখানে থাকতে রাজি হয়ে ভুল কিছু করে নি তো?অবশ্য সঠিক কাজ কোনটা তার তার জানা নেই।এতদিন ভাবত জাহিদকে নিজের জীবনসঙ্গী করার সিদ্ধান্ত টাই তার জীবনের একমাত্র সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।নাহ!সে ভুল।
পৃথিবীতে আপন বলতে তার কেউ নেই।ভাগ্যের ফেরে তার জাহিদ আর নির্ঝরের সাথে দেখা।পরিচিত আপন মানুষ বলতে সে এই দু’জনকে চিনে!নির্ঝরের এখানে থাকা ছাড়া তার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
সে উঠে ওয়াশরুমে গেল।ওয়াশরুমে ঢুকেই চমকে উঠল।নতুন জামা কাপড়,টাওয়াল,প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র রাখা।সে নিজের ভেতর প্রশান্তি অনুভব করল।
একেবারে শাওয়ার নিয়ে নির্ঝরের কেনা মেরুন রঙের থ্রি পিস পড়ে সে বের হলো।মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই বেলকনি থেকে কবিতা আওড়ানোর মতো গুনগুন শব্দ ভেসে আসল।সে কয়েক পা এগিয়ে গেল।
“তোমার ব্যথাতে আমি কতটা পুড়ি
ব্যর্থ ভালোবাসায় বিবাগী হয়ে ঘুরি!
আমি ভালো নেই, দেখো মেলিয়া দৃষ্টি
আঁখিদ্বয় অশ্রুসিক্ত,ঝরছে অসময়ের বৃষ্টি। ”
~মুন্নী আরা সাফিয়া
খেয়া না শোনার ভান করে চলে আসতেই নির্ঝর ডাক দিল।
__’খেয়া!’
খেয়া চমকাল।রাতের নিরবতায় কেমন ঘোর লাগা,মমতা মিশ্রিত সে ডাক।কই,এর আগে জাহিদের ডাক তো এতটা আদুরে মনে হয়নি।সে কি ভাবছে এসব?ছি!
খেয়া ঘুরে জোরপূর্বক মুখে একটু হাসি টেনে বলল,
__’আপনি এখানে কি করছেন?না মানে রাত তো অনেক হয়েছে ঘুমাননি?’
__’এখানে এসে দাঁড়াও।ভয় পাচ্ছো নাকি?’
নির্ঝরের প্রশ্নে খেয়া ঘাবড়ে গেলেও আড়ষ্ট হয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ায়।বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার।আজ এত অন্ধকার কেন?
নির্ঝর বাইরের অন্ধকারে দৃষ্টি মেলে বলল,
__’পৃথিবীর ডাইমেনশনাল ডোরে কি হয় জানো খেয়া?’
__’উঁহু!’
__’পৃথিবীর ডাইনমেনশনাল ডোরে মধ্যাকর্ষণশক্তি অনুপস্থিত।সেখানে এর প্রভাব খাটে না।সেজন্য কোনো বস্তু বা জিনিস ডাইমেনশনাল ডোরে পড়লে অতলে হারিয়ে যায়।কোনোদিন আর ফিরে আসে না।বুঝতে পেরেছ?’
খেয়া ছোট্ট করে বলল,
__’বুঝলাম!’
__’বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের নাম তো শুনেছো নিশ্চয়ই।যার কাছাকাছি কোনো উড়োজাহাজ বা জাহাজ আসলে তা চুম্বকের মতো টেনে নেয়।একদম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।অনেকে মনে করে পৃথিবীর ডাইমেনশনাল ডোর ওখানে অবস্থিত।ওই ডোর দিয়েই সব অতলে হারিয়ে যায় যার জন্য আর কোনো হদিস মেলে না।’
__’অহ।’
__’তোমাকে এসব বলার কারণ পৃথিবীর ডাইমেনশনাল ডোরের মতো তুমি আমার ডাইমেনশনাল ডোর।এখানে আমার কোনো প্রভাব খাটে না।আজ থেকে তিন বছর আগে শীতের এক সকালে তোমার অতলে হারিয়ে গেছি।আর কোনোদিন নিজের মাঝে ফিরতে পারলাম না।ভবিষ্যতেও পারবো না। তুমি কি রাগ করছ এসব শুনে?’
__’না, করছি না।’
__’এই যে আমি এখন তোমার কাছাকাছি আছি আমি নিজের মধ্যে নেই।নিজের উপর কোনো কন্ট্রোল নেই।আমি তোমাকে এখন এসব কথা বলতে চাচ্ছি না।আবার নিজেকে থামাতেও পারছি না।তুমি কি নতুন করে আমার হাত ধরবে?’
__’আমি ঘুমাবো এখন।অনেক রাত হয়েছে।তাছাড়া অন্ধকারও একপ্রকার মদের মতো।যেকোনো মানুষকে মুহূর্তে নেশাগ্রস্ত করতে পারে।এখন আপনি একটা ঘোরের মধ্যে আছেন।সকালে কথা বলবো আমরা।’
একনাগাড়ে বলে খেয়া কয়েক পা এগিয়ে যেতেই নির্ঝর তাকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরলো।
(চলবে)