#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মু্ন্নী_আরা_সাফিয়ামু্ন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০১
১.
__’আমি কখনো মা হতে পারবো না বলে আমার বজ্জাত স্বামী দেড় বছরের সংসার ভেঙে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে।খুশি হয়েছেন এবার, মি. নির্ঝর জুবায়ের?আপনার তো খুশি হওয়ার কথা!আমাকে প্রোপোজ করেছিলেন,বিয়ের জন্য অফার করেছিলেন। কিন্তু আমি আপনাকে রিজেক্ট করে আমার ভালোবাসার মানুষটিকে বিয়ে করেছিলাম।আপনি তাতে কষ্ট পেয়েছিলেন।
আমার সেই ভালোবাসার,ভরসার একমাত্র মানুষটি আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে।এই দেখুন, আমি ভালো নেই! আমি কষ্টে আছি।আমার বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।আপনি এবার খুশি তো?আমাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন।আ-আপনার অভিশাপেই আমার সাথে এমন হয়েছে।এবার খুশি হয়েছেন!’
বলেই কান্নাতে ভেঙে পড়ল খেয়া।দুহাতে মুখ ঢেকে অবিরত কান্না করে যাচ্ছে সে।
নির্ঝর এদিক ওদিক তাকায়।তারা আপাতত একটা পার্কের বেঞ্চে বসে আছে।জায়গাটা মোটেই নির্জন নয়।মোটামুটি জনবহুল একটা জায়গা।আশপাশের বহু মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।তাদের চোখে হাজারো প্রশ্ন।
একটা মেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বিরতিহীন ভাবে কান্না করে যাচ্ছে।পাশে একটু দূরে একটা যুবক নিশ্চল হয়ে বসে আছে, কান্না থামানোর মেয়েটাকে সান্ত্বনা দেয়ার কোনো চেষ্টাই করছে না।ব্যাপারটা তাদের কাছে মোটেই সুখকর নয়।
তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবেই।এটা বিদেশ নয় যে দেখেও না দেখার ভান করবে।এটা বাংলাদেশ।সবাই দেখবে,দু একজন দুঃখ পাবে,কেউ কেউ কাছে এসে ‘কি হয়েছে?’ জিজ্ঞেসও করবে।
নির্ঝর খেয়ার দিকে তাকালো।খেয়ার পরণে সবুজ রঙের ফিনফিনে শাড়ি।সবুজ শাড়িতে কি সুন্দর লাগছে তাকে!আজও মেয়েটার কান্নাসজল দৃষ্টি তাকে ঘায়েল করতে সক্ষম। সে চোখ সরিয়ে নিল।
একটু ভেবে নির্ঝর নিজের গায়ের ব্লেজারটা খুলে খেয়ার মুখ ঢেকে দেয়।যেন তার কান্নারত মুখ পৃথিবীর মানুষ থেকে আড়াল করছে।সামান্য এগিয়ে বসে।কেউ যেন চট করে করে বুঝতে না পারে যে খেয়া একা!সম্পূর্ণ একা!
প্রায় আধ ঘন্টা পর নির্ঝর খেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
__’আর ইউ অকে?’
খেয়া উত্তর দিল না।এখনো ব্লেজার দিয়ে মুখ ঢেকে আছে।নির্ঝরই আবারো মুখ খুলল।
__’সকালে তো মে বি কিছু খাওনি।এখন খাবে কিছু?’
খেয়া ছোট্ট করে ‘না’ বলল।
__’চলো আমার সাথে।সামনে একটা রেস্টুরেন্ট আছে।কিছু খাবে।লাঞ্চের টাইম শেষ হয়ে যাবে।আমারো দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি।’
__’বললাম তো খাবো না।জোর করছেন কেন?আর আপনি এখানে কি করছেন?এতক্ষণ যাবত আমার কষ্ট উপভোগ করলেন তাতে মন ভরলো না?আরো উপভোগ করতে চান?নিজের চোখে আমার নিষ্ঠুর পরিণতি অবলোকন করতে চান?করুন তাহলে! ‘
__’লিসেন,খেয়া!আমি জানি তোমার কাছে বর্তমানে কোনো টাকা নেই।থাকার কথা নাহ!তাছাড়া তোমার যাওয়ার জায়গা নেই।আমি যা বলি তাই শুনো। আপাতত আমার সাথে কিছু খাবে চলো।না হলে না খেয়েই মরে যাবে।তখন তোমার কষ্ট বেশিদিন উপভোগ করতে পারবো না।সত্যি বলতে,আমি ভীষণ ভাবে তোমার কষ্ট উপভোগ করছি।তোমার এই ন্যাকা সুরের কান্না উপভোগ করতে চাইলেও তোমাকে বছরের পর বছর বাঁচতে হবে।লেটস গো!’
নির্ঝর উঠে দাঁড়ালো।খেয়া নির্ঝরের কথা শুনে আবারও কান্না শুরু করলো।নির্ঝর তার দিকে এক পলক তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
খেয়ার সাথে যেদিন তার প্রথম দেখা হয় সেদিনও এভাবে নাক টেনে কান্না করছিল।আজও একই জিনিস।প্রকৃতি সব জিনিসই নাকি দুবার করে ঘটায়।তার কাছেও তাই মনে হচ্ছে।তবে ডিফারেন্সটা হচ্ছে আজকের খেয়া আর সেদিনের খেয়ার মাঝে বিস্তর তফাৎ।
খেয়ার কান্না কিছুতেই থামছে না।সেই সকাল থেকে দেখে যাচ্ছে সে। অল্পতে কেঁদে দেয়ার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে খেয়া।অতি সামান্য কথাতেও যে সে কেঁদে টেদে এক করে ফেলে সব তা নির্ঝরের অজানা নয়।কিন্তু এত কান্না করলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে।
নির্ঝর কিছুটা বিরক্ত হয়েই ধমক দিল।
__’স্টপ ক্রাইং!কেউ মরে গেছে? ‘
খেয়া ব্লেজারে নাক মুছে টেনে টেনে বলল,
__’আমার প্রেম মরে গেছে।ও আপনি বুঝবেন না।’
__’বোঝার মতো কিছু থাকলে তো বুঝবো।তুমি কান্না করছো কেন?
__’আমার ইচ্ছে হয়েছে কান্না করছি।তাতে আপনার কি?’
__’তাতে আমার কি মানে?আমি বিরক্ত হচ্ছি।’
__’আপনাকে বিরক্ত হতে বলেছে কে?’
__’আশ্চর্য!এটা কি ধরনের প্রশ্ন।একদম কান্না করবে না।তুলে আছাড় দিবো।মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে আমার তোমার প্যানপ্যানানি শুনতে শুনতে।’
খেয়া আবারো কান্না শুরু করল।কাঁদতে কাঁদতে বলল,
__’আপনি আমার উপর রেগে যাচ্ছেন কেন?’
__’খেয়া, আমার কি এখন রাগ করা স্বাভাবিক নয়?’
__’না,একদম স্বাভাবিক নয়।আপনি অপ্রকৃতস্থদের মতো আচরণ করছেন।তাছাড়া আপনার বিরক্তি বা রাগের জন্য মোটেই আমি বা আমার কান্না দায়ী নয়।এর জন্য দায়ী আপনার মস্তিষ্ক, মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস!’
নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে তাকালো।সে একটা কঠিন কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল।আবার নতুন করে কান্না জুড়ে দিবে।একে নিয়ে সে কিভাবে সামনের দিনগুলো পাড়ি দিবে তা কে জানে!
তবে আজকের ধাক্কাটা অতি কঠিন ব্যক্তির জন্যও সামলানো দুঃসাধ্য ব্যাপার।ডিভোর্সের মতো রাশভারী শব্দ বহন করার মতো ক্যাপাবিলিটি সবার থাকে না।খেয়ার মতো নরম মেয়ে পারবে তো সামলে উঠতে?
নির্ঝর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।সে খেয়ার পাশে৷ থাকবে।তাকে থাকতে হবে যে।
সে একটানে খেয়াকে দাঁড় করিয়ে ব্লেজারটা ভালো মতো গায়ে জড়িয়ে দিল।তারপর হাত ধরে কিছুটা টেনে নিয়েই গাড়িতে উঠালো।
খেয়া হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
__’টানাটানি করবেন না তো!হাত ছাড়ুন।হাত ধরেছেন কেন?’
নির্ঝর নিজের সিটে ঠিকমতো বসে হাতটা আরো চেপে ধরে বলল,
__’ইচ্ছে হয়েছে তাই ধরেছি!তাতে তোমার কি?’
__’অ্যাঁহ?আমার কি মানে?সরকারি হাত পেয়েছেন?হাত ছাড়ুন।ব্যথা পাচ্ছি।’
__’চাপ,স্পর্শ, যন্ত্রণা প্রভৃতি স্থূল অনুভূতির কেন্দ্র থ্যালামাস।এখানে আমার কোনো দোষ নেই।’
__’খবরদার আমার কথা আমাকে ফেরত দিবেন না।’
নির্ঝর মুচকি হেসে হাত ছেড়ে দিল।ফাইনালি,খেয়ার কান্না থেমেছে।সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
২.
নির্ঝরের বাসার সামনে গাড়ি থামতেই খেয়া চমকে উঠল।নির্ঝর তাকে তার বাসায় কেন এনেছে?সে তো ভেবেছিল কোনো ফিমেল হোস্টেল বা মেস ঠিক করে তাকে রাখবে।সরাসরি তার বাসায় কেন এনেছে?
খেয়ার ভীত,সন্ত্রস্থ দৃষ্টি নির্ঝরের চোখ এড়াল না।সে গাড়ি থেকে নেমে জোর করেই খেয়াকে ভেতরে নিয়ে গেল।
যদিও এই বাসা খেয়া আগে থেকে চিনে তবে এই প্রথম ভেতরে পা রাখা।সে আড়ষ্ট হয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসলো।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চার-পাঁচ বছরের একটা মেয়ে এসে নির্ঝরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
__’বাবাই,তুমি এসেছো?তোমার সাথে কে?’
নির্ঝর তাকে চুমু খেয়ে কোলে তুলে নিলো।খেয়া হা করে তাকিয়ে সব দেখছে।কিছুই তার মস্তিষ্কে ঢুকছে না।নির্ঝরের এতবড় মেয়ে আছে? তার মানে নির্ঝর যখন তাকে বিয়ের অফার দিয়েছিল তখন সে ম্যারিড?
কিছু বুঝে উঠার আগেই খেয়া অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়লো।
(চলবে)