# জীবনের গল্প
# পর্ব-৪ (শেষ পর্ব)
জাহানারা অনেক আগেই চলে গিয়েছে। তবে আমি এখনো আগের মতোই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ডায়রিটা খোলার সাহস হচ্ছে না,ভয় হচ্ছে,অনেক বেশি ভয় হচ্ছে। তবুও যখন ডায়রিটা ওপেন করলাম তখন তার ভিতরে সাদা কাগজে মোড়ানো একটি চিঠি পেলাম। চিঠির ভাজটা খুলতেই বুকের ভিতর ধুকধুক শুরু হলো।
প্রিয় সাদিয়া,
তুমি যখন এটা পাবে তখন আমি তোমার থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছি। যতোটা দূরে গেলে আর কখনো ফেরা যায় না ঠিক ততোটাই দূরে। জীবনে সবকিছু আমাদের নিজের হাতে থাকে না। বিধিতার হাতেও অনেক কিছু থাকে। তোমার সাথে পালিয়ে যাওয়ার সাতদিন আগে আমার বাবা মারা যান। তাদের কোনো অসুখ ছিলো না। তবুও হঠাৎ করেই তারা আমাকে ছেড়ে চলে যান। আমি অনেক ভেঙে পড়েছিলাম। আমি তো বেশি কিছু চাইনি। বিলাসিতা চাইনি,স্বাচ্ছন্দ্য চাইনি,শুধু আপনজনকে নিয়ে একটু শান্তিতে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম,দুবেলা দুমুঠো খাবার হলেই চলে যেতো আমাদের। তবুও বিধিতা আমাকে একা রেখে তাদের নিয়ে গেলেন। তবুও আমি বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম। তোমার জন্য শুধু তোমার জন্য আমি বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম। আমি খুব করে বিশ্বাস করতাম তুমি আমাকে এতো ভালোবাসা দিবে যেটা আমার বাবা মাকে ভুলতে যতেষ্ট হবে।
তাই তো তোমার সাথে পাড়ি জমিয়েছিলাম এক অনিশ্চিত জীবনে। জানো? যেদিন আমার চাকরি হলো সেদিন আমি কি খুশিই না হয়েছিলাম। আমাদের একটা ছোট্ট সংসার হবে। তোমার কোল জুড়ে ফুটফুটে একটা বাচ্চা আসবে। কিন্তু যখন হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়লাম,মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলাম রাস্তায়। তখন একজন ভালো মানুষ আমাকে হাসপাতালে পৌছে দেয়। সেদিন আমি জানতে পারলাম এই মায়াময় পৃথিবী থেকে আমাকে বিদায় নিতে হবে। এই পৃথিবীতে আর বেশিদিন থাকতে পারবো না আমি। আমার বেঁচে থাকার মেয়াদ ক্রমে ক্রমেই ফুরিয়ে এসেছে যেটা আমি বুঝতে পারিনি। আমার ব্রেইন টিউমার। মাঝে মাঝে মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা হতো তখন ভাবতাম হয়তো চিন্তা করি তাই এমন হয়। কিন্তু এখন সব স্পষ্ট আমার কাছে।
আমাদের বাড়িওয়ালার মেয়েটা বড় ভালো। প্রথমে না করলেও পরে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সে তোমাকে অনেক সাহায্য করেছে। আমি চেয়েছি তুমি আমাকে ঘৃণা করো,আমাকে ভুলে অন্য কাউকে নিয়ে ভালো থাকো। যেমনটা এখন আছো। একসময় বুঝতে পারলাম এখানে থেকে তুমি আমাকে ভুলতে পারবে না। তাই জাহানারাকে বলে তোমার বাবার সাথে কথা বলতে বলেছিলাম। তোমাকে রেখে স্বার্থপরের মতো যেদিন পালিয়ে গিয়েছিলাম সেদিন থেকে আমি তোমাকে কখনো একা ছাড়িনি,সবসময় তোমার সাথে ছায়ার মতো থেকেছি। তুমি যখন টিউশনি করতে যেতে তখন আমি তোমার আশেপাশেই থাকতাম। যে আমার হৃদয়ের রাণী,যে মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি তাঁর কোনো বিপদ আসতে পারবে না অন্তত আমি বেঁচে থাকতে। লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে যখন দেখতাম তখন আমার অনেক বাঁচতে ইচ্ছে হতো। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার প্রাণ ভিক্ষা চাইতাম আমি। কিন্তু আমার আর বেঁচে থাকা হয়নি।
যেদিন তুমি তোমার হবু স্বামীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে সেদিন তোমাকে কি সুন্দরই না লাগছিলো। আমার খুব হিংসে হচ্ছিলো লোকটাকে যে আমার ভালোবাসার মানুষটাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো এই পৃথিবীতে আমার পরে যদি কেউ তোমাকে ভালোবাসতে পারে,সুখে রাখতে পারে তাহলে এই বোকাসোকা মানুষটাই পারবে। তাই সেদিন খুশি মনেই মেনে নিয়েছিলাম। তারপরে যেদিন তুমি লোকটার কাছ থেকে শাড়ী উপহার নিলে সেদিন আমার অনেক খারাপ লেগেছিল।
এসব তো আমার করার কথা ছিলো। বিয়ের আগে আমি তোমাকে আমার পছন্দের শাড়ী দিতাম যেটা তুমি পড়ে আমার বউ হয়ে আমার জন্য বাসর ঘরে বসে থাকবে। কিন্তু হলো বিপরীত। তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করবে,তাঁর পছন্দ করা শাড়ী পড়ে বউ সেজে তাঁর জন্য বসে থাকবে । সেদিন আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আকাশের মালিককে একটা প্রশ্ন করেছিলাম।
আমার কি অপরাধ ছিলো? এতো ভালোবাসার পরেও আমি তাকে পেলাম না। যদি আমার মনে কারো জন্য এতো ভালোবাসা দিয়েছো তবে কেনো আমার জীবনের মেয়াদ এতো কম করলে?
আমি উত্তর পাইনি।
যেদিন বিয়ে হয়ে গেলো সেদিন আমি অনেক কেঁদেছিলাম। খুব ইচ্ছে ছিলো তোমাকে বিয়ের সাজে দেখবো কিন্তু পারিনি। তুমি অন্য কারো বউ হবে এটা আমি সহ্য করতে পারিনি। বুকের ভিতর এক প্রকাণ্ড জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছিলো। যেটা প্রতিনিয়ত বের হয়ে আসতে চাইতো। আমি চলে গিয়েছিলাম। বধু সাজে অনুভব করেছিলাম তোমাকে। আমি সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম।
বিয়ের পর যখন তুমি তোমার স্বামীর সাথে রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়াতে তখন আমার মনে হতো তুমি এভাবে আমার সাথেও ঘুরতে পারতে। যখন তুমি তোমার স্বামীর হাতে হাত রেখে হাঁটতে তখন মনে হতো ওই হাতটা তো আমারও হতে পারতো। কিন্তু হয়নি। আমার ভাগ্য এতো ভালো না। তাই হয়তো তোমাকে পাইনি। তবে পরের জনমে যদি কখনো পৃথিবীতে আসি তবে তোমাকে পাওয়ার প্রতিশ্রূতি নিয়েই আসবো।
মাথার মধ্যে যখন খুব ব্যাথা হতো তখন মনে হতো কেউ একজন যদি পরম মমতায় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তাহলে আমার এই অসহ্যনীয় ব্যাথাটা হয়তো সেড়ে যাবে। কিন্তু এমনটা কেউ করেনি। যখন মাথায় পেইন হতো তখন তোমাকে নিয়ে কল্পনা করতাম, তোমার আমার সোনালী দিনগুলোর কথা ভাবতাম। তখন কিছুটা হলেও ব্যাথাটা ভুলে থাকতাম।
আজ আমার শেষ দিন। শেষ দিন বলছি এজন্য যে আজ আমার অপারেশন। ডাক্তার ধরেই নিয়েছে আমাকে বাঁচাতে পারবে না। আমার বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র পাঁচ পারসেন্ট। আমি জানি আমি বাঁচবো না। তবুও আমার বন্ধুটা বৃথা চেষ্টা করছে। ও তোমাকে সব বলতে চেয়েছিল কিন্তু বলতে দেইনি। বাবা মা মারা যাওয়ার পর বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছিলাম। টাকাটা হাতে পেয়েছিলাম না তাই সেদিন আমি খালি হাতে বের হয়েছিলাম। তবে ভেবেছিলাম বাড়িটা বিক্রি করে যে টাকা পাবো সেটা দিয়ে তোমাকে নিয়ে অনেক সুখে থাকতে পারবো। কিন্তু বিধিতা হয়তো এমনটা চায়নি।
যে টাকাগুলো পেয়েছিলাম সেটা দিয়েই চিকিৎসা করছি। আর বাকি টাকাগুলো আমার বন্ধুর কাছেই রয়েছে। যদি পারো টাকাগুলো অনাথআলয়ে দিয়ে দিও। ওর ঠিকানাটাও ডায়রিতে লেখা আছে।
এই তো আর কিছু সময় পর আমাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবে। আমি জানি আমি আর জাগা পাবো না। চিরতরে ঘুমিয়ে যাবো।
তবে জানো,আমার কি মনে হয়?
তুমি যদি ভালোবেসে পরম আদরে জড়িয়ে ধরে একটাবার বলতে তুমি ফিরে আসবে, আমার জন্য হলেও তুমি ফিরে আসবে। তাহলে হয়তো আমি ফিরে আসতাম তোমার কাছে।
পরের জনমে যদি রজনীগন্ধা হয়ে তোমার কাছে ফিরে আসি তাহলে আমাকে ফেলে দিও না। তোমার খোপায় খুঁজে দিও।
আমি কখনো চাইনি তুমি আমাকে ঘৃণা করে বেঁচে থাকো। তাই আমার লেখা ডায়রিটা তোমাকে দিতে বলেছি। জানি না তুমি এটা পাবে কি না। তবে যদি পাও আমার জন্য দুঃখ করো না। মনে রেখো তুমি ভালো থাকলেই কেবল আমি ভালো থাকবো।
ইতি
তোমার সাদাফ।
চিঠিটা যখন পড়লাম তখন নিজের অজান্তেই দুচোখ বেয়ে বিন্দু বিন্দু জল নিচে গড়িয়ে পড়ল।
সাদাফ চেয়েছিল আমি যেনো সুখী হই। সে সফল হয়েছে। আজ আমি অনেক সুখী।
হঠাৎ করেই অয়ন চলে এসেছে আমি খেয়াল করিনি।
আমাকে এমন অবস্থায় দেখে ও সব বুঝতে পারলো। আমিও কিছু লুকালাম না। সব বললাম তাকে। অয়ন আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বুকে টেনে নিলো।
আমি আর অয়ন সাদাফের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। আমি কাঁদছি, অনবরত কেঁদেই চলেছি। তখন পাশ থেকে অয়ন বলল,
“তুমি কাঁদলে সাদাফও কাঁদবে। সাদাফ চেয়েছিল তুমি সুখী হও। তুমি যদি চোখের পানি ফেলো সাদাফ কি ভালো থাকতে পারবে?”
আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না।
মনে মনে শুধু বললাম,পরের জনমে আমি তোমারই হবো।
সমাপ্ত ।
লেখাঃ আমিনুর রহমান