জীবনের গল্প পর্ব-৩

0
2005

# জীবনের গল্প
# পর্ব-৩

বাবার পছন্দ করা ছেলেটাকে যখন ফোন দিলাম তখন সে ফোনটা রিসিভ করলো না,কেটে দিলো। ভাবলাম হয়তো ব্যস্ত আছে তাই আর বিরক্ত করলাম না। কিন্তু তার দুইমিনিট পরেই ওই নাম্বার থেকে কল আসলো। বুঝলাম কলব্যাক করার জন্যই আমার ফোনটা কেটে দিয়েছিলো। এমন ব্যবহার দেখে কিছুটা হলেও আচ করতে পারলাম মানুষটা ভদ্রলোক।

ফোনটা ধরতে সংকোচ বোধ হচ্ছিলো। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। তবুও ফোনটা হাতে তুলে নিলাম। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অনেক দিনের পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো। মনে হলো এই মানুষটার গলার স্বর আমার বহুদিনের পরিচিত। চাঁদিনী রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে বলতে কতো রাত পাড় করেছি এই কণ্ঠটা শুনে সেটা শুধু আমিই জানি। সাদাফের কণ্ঠ। আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে এটা সাদাফ। কিন্তু না এসব আমার কল্পনা। আমি সাদাফকে এখনো ভুলতে পারিনি। তাই এমন মনে হচ্ছে আমার।

যখন ওপাশ থেকে কেউ একজন অনেক মায়াভরা কণ্ঠে বলে উঠলো,
“আমি অয়ন,আপনি নিশ্চয় সাদিয়া?”

তখন আমার আর কোনো দ্বিধা থাকলো না যে এটা সাদাফ না। আমার সাদাফকে ভুলে যেতে হবে। আমি কোনো বিশ্বাসঘাতক কাপুরুষকে মনে রাখতে চাই না। মনে রাখতে চাই না আমি একজন ঠক,প্রতারক কে ভালোবেসেছিলাম। যে আমাকে ভরা সমুদ্রের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে নৌকা নিয়ে কিনারায় এসে পাড়ি জমিয়েছিল। একটিবারের জন্যও চিন্তা করেনি আমি অতল সমুদ্রে ডুবে মরে যেতে পারি। এই লোকটার সাথেই আমাকে কথা বলতে হবে,একাকিত্ব দূর করতে হবে। সাদাফকে ভুলে যাওয়ার জন্য এর থেকে ভালো সুযোগ আর আমি পাবো না।

“আমি তাঁর কথার প্রতি উত্তরে শুধু বললাম, হ্যাঁ আমি সাদিয়া। কেমন আছেন আপনি?”
– ভালো,আপনি কেমন আছেন?
– ভালো আছি।
– আমি আসলে কখনো মেয়ের সাথে কথা বলিনি। উল্টোপাল্টা কিছু বলে ফেললে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। দুইদিন আগে আমি আপনাকে দেখেছি। মা আপনাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলেছেন। আমিও চোখ সরাতে পারিনি। আপনাদের বাসায় গিয়েছিলাম হয়তো আপনি খেয়াল করেন নি।
– আমার অতীত সম্পর্কে হয়তো বাবা আপনাদের কিছু বলেনি।
– না,আপনার বাবা অনেক ভালো মানুষ। তিনি চাইলেই আমাদের কাছে সবকিছু লুকাতে পারতেন। কিন্তু সেটা তিনি করেন নি। তিনি সব বলেছেন। এটা কোনো সমস্যা না। মানুষের জীবনে ভুল হতেই পারে। এখানে আমি আপনার কোনো দোষ দেখছি না। আপনি একজন মানুষকে বিশ্বাস করেছিলেন। সে আপনার সাথে প্রতারণা করেছে। দোষটা তো ওই লোকটার যে আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেনি। আপনি চাইলে দেখা করতে পারেন আমার সাথে। মাও চাচ্ছে আপনার সাথে একদিন দেখা করি আমি।
– কবে দেখা করতে চাচ্ছেন?
– যেদিন আপনি চাইবেন?
– আমি চাইলেই হবে? আপনার অফিস আছে তো।
– অফিস থেকে ছুটি নিতে পারবো সমস্যা নেই।
– আচ্ছা আমি আপনাকে জানাবো।
– ধন্যবাদ।
– কেনো?
– এই যে দেখা করছেন আমার সাথে।
– ঠিক আছে ভালো থাকবেন।
– আপনিও ভালো থাকবেন।

লোকটাকে আমি দুইমিনিট আগেও চিনতাম না। অথচ তাঁর সাথে যখন কথা বললাম তখন আমার মনে হলো আমি আমার অতীতটা কিছু সময়ের জন্য হলেও ভুলে ছিলাম। কি বোকাসোকা মানুষ। কতো সুন্দর করে কথা বলে। সাদাফও তো অনেক সুন্দর করে কথা বলতো। কিন্তু কি হলো?

প্রথমে সবাই খুব সুন্দর করে নিজেকে সবার সামনে উপস্থাপন করতে চায়। কিন্তু পরে ঠিকই তাঁর খারাপ রুপটা সবাইকে দেখিয়ে দেয়। অয়নও হয়তো এমন। এখন খুব সহজ সরল ভাবে কথা বলছে। পরে হয়তো নিজের হিংস্র চেহারাটা প্রকাশ পেয়ে যাবে।

বাবাকে যখন বললাম তোমার পছন্দ করা ছেলেটা আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি তাকে হ্যাঁ বলেছি,সময়ও জানিয়ে দিয়েছি তোমাকে না বলেই।

তখন বাবার চোখে মুখে অনেক হাসি দেখতে পেয়েছিলাম আমি। মাও অনেক খুশি হয়েছিল।

বিকেল তিনটার সময় দেখা করার কথা ছিলো। আমি দশ মিনিট আগে গেলেও অয়ন দশ মিনিট পরে আসলো।

সরি, একটু দেরি হয়ে গেলো
– ইটস ওকে।

মানুষটা আসলেই বোকা। সে আর সবার মতো গোলাপের তোড়া বা রজনীগন্ধা কিংবা একগুচ্ছ কদম হাতে আমার সাথে দেখা করতে আসেনি। খালি হাতেই এসেছে। আমি ভেবেছিলাম এসব কিছু নিয়ে আসবে। কিন্তু না,সে শুধু একটা চকলেট নিয়ে এসেছে আমার জন্য।

আমি যখন তাকে বললাম আমি কি এখনো ছোট? আমাকে কি আপনার বাচ্চা মনে হয়?
যে চকলেট নিয়ে এসেছেন আমার জন্য।
তখন লোকটা মাথাটা নিচে নামিয়ে ফেলল। হয়তো অনেক লজ্জা পেয়েছে।

সেদিন আমাদের খুব বেশি কথা হয়নি। তবে অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটেছিলাম আমরা। লোকটার মধ্যে বিশেষ কিছু আছে। আমি যখন তাঁর সাথে থাকি তখন আমার কেনো জানি অনেক ভালো লাগা কাজ করে,আমি আমার অতীতটা ভুলে যাই তখন।

বাসায় এসে যখন বললাম, বাবা বিয়েটা আমি করবো। তবে খুব তাড়াতাড়ি। তখন বাবা খুশিতে মরে যাওয়ার মতো অবস্থা। এতো খুশি আমি বাবাকে কোনোদিন দেখিনি। বাবার সুখের জন্য হলেও বিয়েটা আমাকে করতে হবে।

“আমি নিজে কখনো কারো জন্য কোনো কিছু কিনি নি। কিন্তু যখন শুনলাম বিয়েতে আপনি রাজী হয়েছেন তখন এতো খুশি হয়েছিলাম যে বলে বোঝাতে পারবো না। আমার পঁচিশ বছরের জীবনে এই প্রথম কারো জন্য কিছু নিজে পছন্দ করে কিনেছি। আপনার জন্য একটা শাড়ী কিনেছি। শাড়ীটা আমার পছন্দের রং। আজ পর্যন্ত কেউ জানে না আমার পছন্দের রং কি। কাউকে কখনো বলা হয়নি। আপনি যদি শাড়ীটা নেন তাহলে আমার ভালো লাগবে।”

শাড়ী হাতে দাঁড়িয়ে যখন লোকটা কথাগুলো বলল,তখন আমি তাঁর চোখে অনেক মায়া,মমতা,ভালোবাসা দেখেছিলাম আমার জন্য। যে ভালোবাসাটা সে সারাজীবন নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রাখতে চায়। আমাকে কখনো জানতে দিবে না আমার জন্য তাঁর বুকের ভেতরে এক অসহ্য ব্যাথা অনুভূত হয়। আমি বুঝতে পেরেছিলাম তাঁর ভালোবাসায় কোনো ফাকি ছিলো না।

“আমি তাঁর হাত থেকে শাড়ীটা নিয়ে শুধু বললাম। আপনার পছন্দ অনেক সুন্দর।”

ওইদিন আমাদের আর কথা হলো না।

এর কিছুদিন পরেই আমার বিয়ে হয়ে যায় বাবার পছন্দ করা সেই বোকা ছেলেটার সাথে। বিয়ের দিন বাড়ির সবাই অনেক বেশি খুশি ছিলো। কারণ সবাই ভেবেছিল আমি আমার অতীতকে হয়তো কখনো ভুলতে পারবো না। কিন্তু আমি সব ভুলে আজ খুশি মনেই বিয়ের পিরিতে বসেছি। এর পেছনে আমার স্বামীর অনেক অবদান আছে। বিয়ের আগে সে আমাকে অনেক মূল্যবান সময় উপহার দিয়েছে। আমার খারাপ সময়ে আমার পাশে ছিলো। আমার যখন ভালো লাগতো না তখনই আমি তাকে ফোন দিতাম,দেখা করতে চাইতাম। সে তখন অফিস বাদ দিয়ে ছুটে আসতো আমার সাথে দেখা করার জন্য। আমি তাঁর সাথে অনেক সুন্দর সুন্দর সময় কাটিয়েছি যার কারণেই আমি আমার বিশ্রী অতীতটাকে ভুলতে পেরেছি।

যাকে ভালোবেসেছিলাম,যাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন বুনেছিলাম তাঁর সাথে কিছুই হলো না। ঘর বাঁধলাম অন্য কারো সাথে। তবুও আমি অনেক সুখী,সত্যি বলছি তবুও অামি অনেক সুখী। কারণ আমি এমন একজন মানুষকে স্বামী হিসেবে পেয়েছি যে আমাকে একা রেখে কখনো যাবে না এটা হলফ করে বলতে পারি।

মানুষটা সময় পেলেই আমাকে নিয়ে ঘুরতে যায়,সিনেমা দেখতে যায়। বিয়ের আগে পরে আমার কোনো আবদার সে অপূর্ণ রাখেনি। আমি যেটাই বলেছি সেটাই সে করেছে। অন্যায় আবদার করলেও কখনো সে না করেনি। ভেবেছিলাম সাদাফের মতো আমাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না। কিন্তু অয়ন সেটা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে। একটা মেয়ের আর কি চাই?

ভালোই যাচ্ছিলো আমাদের সময়। বিয়ের দুইমাস পরের কথা।

হঠাৎ করেই দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ শুনতে পেয়ে দরজা খুলি। দরজা খুলতেই জাহানারাকে দেখতে পাই। আমার বিয়ের দিন এসেছিল। তারপর আজ দেখা হলো তাঁর সাথে। তবে বুঝলাম না সে আমার বাড়ির ঠিকানা কিভাবে পেলো। আমি কিছু বলার আগেই সে আমার হাতে একটা ডায়রি ধরিয়ে দিলো।

“তোমার বাবা কাছ থেকে তোমার ঠিকানাটা নিয়েছিলাম।
সাদাফ মারা গিয়েছে। মারা যাওয়ার আগে এই ডায়রিটা আমাকে দিয়ে গিয়েছে, আমি যেনো তোমার কাছে পৌছে দেই। এই ডায়রিটা পড়লে তুমি অনেক কিছুই জানতে পারবে। আমি তোমাকে কোনো সাহায্য করিনি এটাও জানতে পারবে ডায়রিটা পড়লে।
তুমি সেদিন বলেছিলে তোমার ভালোবাসা মিথ্যে,সাদাফ তোমাকে ভালোবাসে না।
তোমার ভালোবাসা মিথ্যে ছিলো না। সাদাফের মতো তোমাকে আর কেউ ভালোবাসতে পারবে না।”

কথাগুলো বলে জাহানারা চলে গেলো। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

চলবে….

লেখাঃ আমিনুর রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে