# জীবনের গল্প
# পর্ব-২
যখন মানুষের খারাপ সময় আসে তখন তাঁর ভালোবাসার মানুষটা তাকে সাহস দেয়,অনুরপ্রেরণা দেয়। তাকে কখনো এভাবে একা রেখে চলে যায় না। যেমনটা সাদাফ আমাকে রেখে চলে গিয়েছে। এই সময়টাতে তাকে আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো অথচ সে কাপুরুষের মতো আমাকে বিপদের মুখে ফেলে পালিয়ে গিয়েছে। সাদাফ কি জানতো না?
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি দিনের পর দিন রাতের পর রাত না খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারতাম। ও কি জানতো না? ওর ভালোবাসার টানে ফুটফাতে ওর বুকে মাথা রেখে প্রতিটা রাত কাটিয়ে দিতে পারতাম আমি।
ও কি জানতো না? ও আমাকে যেখানে যেভাবে রাখতো আমি খুশি মনেই সেখানে থাকতাম। তাহলে কেনো এমন করলো আমার সাথে?
আমার কি কোনো অপরাধ ছিল? আমি কি কোনো ভুল করেছিলাম?
যদি ভুল করি ও তো আমাকে বলতে পারতো। এভাবে চলে গেলো কেনো? এসব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে অজানা। তবুও খুব জানতে ইচ্ছে করছে। আমার ভালোবাসায় কিসের কমতি ছিলো যে ও আমার সাথে এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা করলো? আমার ভালোবাসাটাকে অপমান করলো।
আজ একদিন হলো সাদাফ আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। এই একটা দিন আমার জীবনে সবচেয়ে কষ্টের দিন ছিলো। এই একটা দিন আমার কাছে একটা বছর মনে হয়েছে। আমি কোনো কিছু মুখে দেয় নি,এক ফোটা পানিও না। সাদাফের চিঠিটার দিকে তাকিয়ে শুধু অদ্ভূত সব চিন্তা করেছি।
জাহানারা এসে যখন আমাকে এই অবস্থায় দেখলো তখন সেও তাঁর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। সে আমাদের ভালোবাসার কথা জানে,আমি তাকে সব বলেছি। বলেছি সাদাফ আমাকে কতোটা ভালোবাসে। হয়তো পৃথিবীতে এতো ভালো কেউ কাউকে বাসতে পারে না। সাদাফ আমাকে ততোটাই ভালোবাসে যার বেশি আর ভালোবাসা যায় না। আজ জাহানারার কাছে আমার ভালোবাসাটা মিথ্যে হয়ে গেলো।
জাহানারা সেদিন আমার অনেক যত্ন করেছিলো। হয়তো ও না থাকলে আমি মেঝেতে মরার মতো পড়ে থাকতাম। আমার যখন দুচোখ বেয়ে অঝরে জল পড়তো,কাঁদতে না চাইলেও চোখ দিয়ে বৃষ্টি ঝড়তো। তখন জাহানারা আমার চোখের পানি মুছে দিতো। আমাকে সাহস দিতো। বেঁচে থাকার হাজারটা কারণ দেখাতো। ওর কথা শুনে আমার বাঁচতে ইচ্ছে হতো। আবার যখন সাদাফের কথা মনে হতো তখন মরে যেতে ইচ্ছে করতো।
আমি যখন জাহানারাকে সব খুলে বললাম। আমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নেই। এই শহরে একজন মানুষ ছিলো আমার যাকে ভালোবেসে নিজের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে চলে এসেছিলাম কিন্তু সে আমাকে ধোঁকা দিয়ে চলে গেছে। তুমি ছাড়া পরিচিত বলতে আর কেউ নেই। তুমিই বলো কি করবো আমি?
তখন জাহানারা আমার হাতে হাত রেখে বলেছিল। যার কেউ নেই তাঁর আল্লাহ আছে। মানুষ তো মানুষের জন্যই। এতো বড় বাড়ি আমাদের তোমাকে থাকার মতো জায়গা দিতে পারবো না? এতোটা খারাপ মানুষ নই আমরা। আজ থেকে তুমি আমার সাথে আমার রুমে থাকবে। যতোদিন ইচ্ছে থাকবে। কেউ কিছু বলবে না তোমাকে। আর আমার থাকার রুম আমার পরিবার থেকে একটু দূরেই। সো তোমার অস্বস্তি হবে না।
সাদাফ আর আমি যে ফ্লাটে থাকতাম সেটা ছেড়ে জাহানারার সাথে থাকা শুরু করলাম। জাহানারার ভয় ছিলো আমি একা থাকলে হয়তো কোনো কিছু করে ফেলতে পারি তাই আমাকে তাঁর ঘরে নিয়ে গিয়েছে। আর তাছাড়া আমার একার জন্য ফ্ল্যাট ছেড়ে দিবে না কেউ। আমি চলে আসার দুদিন পরেই নতুন ভাড়াটিয়া শিফট হয় সেখানে।
আমি অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়তাম। ভেবেছিলাম সাদাফ কিছু একটা করলে আবার নতুন করে অনার্সে ভর্তি হবো কিন্তু সেটা হয় নি। তবে জাহানারা আমার অনার্সে ভর্তি হওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। আমার জন্য কয়েকটা টিউশনি জোগাড় করে দিয়েছিলো। আর কিছু টাকাও দিয়েছিলো। যেটা দিয়ে আমি অনার্সে ভর্তি হই। একসময় খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমার জীবনের সংগ্রাম শুরু হলো। একটা মেয়ে হয়েও দিনে তিনটা টিউশনি করাতাম। ভার্সিটিতে নিয়মিত ক্লাস করতাম। তবে এতো কিছুর মাঝেও আমি সাদাফকে ভুলতে পারছিলাম না।
সাদাফ চলে যাওয়ার প্রায় একমাস পাড় হয়ে গেছে। এই একমাসে অনেক কিছুই হয়েছে। আমি নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি,জানি না কতোটুকু পেরেছি। অতীত ভুলে বর্তমান নিয়ে ভালো থাকার বৃথা চেষ্টা করেছি। বাসায় অনেক বার ফোন দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু সাহস হয়নি। কোন মুখ নিয়ে ফোন দিবো বাসায়?
কি বলবো আমি?
একটা ছেলের সাথে পালিয়ে এসেছিলাম। তাঁর সাথে এক ফ্ল্যাটে প্রায় দুই মাস থেকেছি। এসব শুনলে হয়তো বাবা সহ্য করতে পারবেন না। মা হয়তো বাজে মেয়ে ভেবে ভুলে যাবে। তাই অনেক বার নাম্বার বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেছি,ডায়াল করতে গিয়েও করিনি।
আজ আকাশে মেঘ জমেছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। ঝুম বৃষ্টি। এই বৃষ্টির কথা মনে হলে সাদাফের কথা খুব মনে পড়ে। কতো শত বার আমি আর সাদাফ বৃষ্টিতে ভিজেছি। গ্রামের সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে সাদাফের হাত ধরে বৃষ্টির মধ্যে হেটেছি। সাদাফ জানতো বৃষ্টিতে ভিজলে তাঁর জ্বর আসবে, সর্দি লাগবে। তবুও সে আমার খুশির জন্য আমার সাথে ভিজতো। কখনো না করতো না। কারণ ও জানতো বৃষ্টি আমার কতোটা ভালো লাগে।
কারণ এই বৃষ্টির মধ্যেই যে সাদাফ আমাকে ভালোবাসার কথা বলেছিলো।
সেদিন প্রায় বিকেল। আমি আপন মনে এক আকাশ মুগ্ধতা নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছিলাম আর ছুয়ে দিচ্ছিলাম। ঠিক সেই সময় একটা ছেলে একগুচ্ছ কদম হাতে আমাকে বলেছিলো, সে নাকি আমাকে ভালোবেসে। সেদিন আমি লজ্জায়, রাগে সেখান থেকে দৌড়ে বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস কিছুদিন পর ওই ছেলেটার সাথেই আমি আমার জীবনটা জড়িয়ে ফেলি। ওই ছেলেটাই ছিলো সাদাফ। কিন্তু এসব এখন অতীত। বর্তমানে এর কোনো অস্তিত্ব নেই।
হঠাৎ করেই জাহানারা আমার পাশে এসে বসেছে আমি খেয়াল করিনি।
এভাবে আর কতোদিন নিজেকে কষ্ট দিবে?
-জানি না।
-তুমি তোমার বাসায় একটা বার কথা বলো। হয়তো সব ভুলে তোমাকে আবার কাছে টেনে নিবে। হাজার হলেও বাবা মা। তারা কখনো সন্তানকে ফেলে দিতে পারে না। সন্তান হাজারটা ভুল করলেও তারা ক্ষমা করে।
-সেই সাহস টা নেই।
– কথা বলে দেখো তো। হয়তো তোমার অপেক্ষাতে এখনো দিন গুনছে তারা। কবে তাদের মেয়ে তাদের কাছে ফিরে আসবে সেই পথ চেয়ে বসে আছে তারা।
সব ভুলে যখন আমি ফোন দিলাম। তখন মা ফোন ধরেই কাঁদতে শুরু করলো।
আমাদের সাথে কথা না বলে এতোদিন কি করে থাকলি? একবারোও আমাদের কথা মনে পড়লো না? তুই চলে যাওয়ার পর তোর বাবা স্ট্রোক করেছিলো। আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম। তোকে অনেক ফোন দিয়েছি তোর ফোন ব্যস্ত দেখায় না হয় বন্ধ। তুই চলে আয় মা। তোর বাবা সব ভুলে গিয়েছে।
– মা আমাকে মাফ করে দাও। আমি অনেক বড় ভুল করেছি।
মাকে যখন সবকিছু বললাম তখন মা শুধু বলল তুই চিন্তা করিস না। তোর বাবা মা এখনো বেঁচে আছে।
পরের দিন বাবা নিজে এসে আমাকে নিয়ে গেলেন। সেদিন আমি দৌড়ে গিয়ে বাবার পায়ে পড়েছিলাম। কিন্তু বাবা পায়ে পড়তে দেয়নি,বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলো।
আসলে আমরা যতো যাই বলি বাবা মায়ের মতো কেউ হয় না। ছেলে মেয়ে যতো খারাপই হোক না কেনো বাবা মায়ের কাছে তারা নিষ্পাপ।
রুমে বসে বসে জানালা দিয়ে নিজের গ্রামের বিচিত্র পরিবেশটা দেখছিলাম। কতো সুন্দর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! এমন সময় বাবা রুমে এসে আমার পাশে বসলেন।
এখন কেমন লাগছে?
– ভালো। তুমি আজকে অফিসে যাওনি।
– না,আজকে তো অফিস বন্ধ। তোর জন্য তোর মামা একটা বিয়ে এনেছে। ছেলে অনেক ভালো, ছেলের পরিবারও অনেক ভালো। তোকে বলছি না যে বিয়েটা করতেই হবে। এখানে ছেলের ছবি আর ফোন নাম্বার আছে। তোর ইচ্ছে হলো কথা বলিস।
কথাগুলো বলে বাবা চলে গেলো।
ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ছেলেটাকে ফোন দিলাম। কারণ আমি জানি এটা মামার কাজ না। এটা বাবা নিজেই করেছেন আমার জন্য। এতো ভালো একজন বাবার জন্য এতোটুকু তো করতেই পারি।
চলবে…
লেখাঃ আমিনুুর রহমান