জানালার ওপারে পর্ব-৬+৭

0
1022

#জানালার_ওপারে
||৬ষ্ঠ পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
🌺🥀পৃষ্ঠা- ৭
চোখ দু’টো অশ্রুতে টলমল করছে। আবেগ ভাই কী করে করে করতে পারলেন এমনটা আমার সাথে? চোখ মুছতে মুছতে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আসি।

ইদানীং বড্ড আবেগ পাগল হয়েছি আমি। অপ্রয়োজনেও ভার্সিটিতে যাই তাঁর দর্শন পেতে। বিনা কারণেই ঐ অসভ্য দলের আড্ডাখানা তথা বটতলার আশেপাশে ঘুরঘুর করি, সালামও দেই যেয়ে। এই বাহানায় যদি ব্যক্তিটি কথা জুড়ে দেয়। হোক না সেই কথায় একটু ঝাঁঝ, একটু নোকঝোক, কটাক্ষ; তবুও কথাটা হোক। কিন্তু অসভ্য যে লোকটি আগে খোঁচা দিতে মুখিয়ে থাকতেন, এখন ঠিকভাবে দেখেনও না হয়তো আমায়।

আজও এই ভাবনা মনে নিয়েই বটতলার সামনে গিয়েছিলাম। হাতে জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন বইটি। ভাব খানা এমন যেন গভীর ভাবে ডুবে আছি আমি বনলতা সেনের মায়ায়। অথচ, আবেগ ভাইয়ের ফন্দীবাজ মায়াবালিকার মনে অন্যই চিন্তা।

“পিপীলিকা, পিপীলিকা
দলবল ছাড়ি একা
কোথা যাও, যাও ভাই বলি।”
আমাকে দেখে আজকেও হাসিব ভাই কটাক্ষ করতে ভুল করেন না।

দলবল বলতে যে নিশাকে বুঝিয়েছে তা বোধ করতে দেরী লাগেনি। কারণ সাধারণত বেচারি নিশাকেও জোর করে নিয়ে আসি আমি, কিন্তু আজ আমি একাই। এই মানুষটার অদ্ভুৎ সব নাম ডাকাতে বিরক্ত আমি। আর আমিই নয় শুধু, সব জুনিয়াররাই। কাউকে কাঠবিড়ালি তো কাউকে মৌমাছি। বেচারি নিশাকে তো মশা ডাকতে ডাকতে কাঁদিয়ে ফেলেন।

তবুও প্রিয় মানু্ষের প্রিয় বন্ধু। তাই জোরপূর্বক কিঞ্চিৎ হেসে উত্তর দিলাম, “ঘাস কাটতে তো আর যাই না ভাইয়া। হাঁটছি এমনি।”

হাসিব ভাইয়া আরও হাজারটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। অথচ, যার জন্য আসলাম, তিনি আমাকে না চেনার মতোন নির্বিকার ভাবে মোবাইলে ডুবে। ধুপধাপ পা ফেলে চলে আসলাম সেখান থেকে। কল লাগালাম মাকে।

বললাম,
“আম্মু, তুমি পাশের বাড়ির ভাইয়া না কি আমায় পড়াবে। সপ্তাহ শেষ হয়ে গেল একদিনও আসলো না, পরে তো ঠিকই টাকা নিবে।”

আমার কথা বলার ধরনটা বেশ ভালোই কাজে লাগলো বোধহয়। মায়ের মেজাজ ভালোই চটেছে। নিশ্চয়ই এখনই কল দিবে আবেগ ভাইকে। ক্লাস নেই আজ, তাই খুশি মনে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াই যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

পাশে চোখ যেতেই মাথায় হাত। ক্যান্টিনের চাচার বারো বছর বয়সী মেয়ে দুলি বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে। দুলির সাথে আবেগ ভাইয়ের গলায় গলায় খাতির, যদি বলে দেয়… প্রেম-টেম সব বাদ, জীবন নিয়ে টানাটানি হয়ে যাবে।

আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম। অতিরিক্ত মধুমাখা কণ্ঠে কিছু বলার আগেই সে কড়া মেজাজে বলে,
“আপনি আবেগ ভাইয়ের নামে এসব কী কইলেন? আমি এহনই যায়া বলতাসি ভাইয়ের কাছে।”

সে যেতে অগ্রসর হয়। আমি দ্রুতো তার হাত আঁকড়ে ধরি। “কাউকে বলিস না প্লিজ। বিনিময়ে তোর চকলেট লাগবে না কি আইসক্রিম না খেলনা? যা চাবি দিব।”

মেয়েটা চুপ থেকে খাণিক ক্ষণ ভাবলো। আমার হৃদয় দুরুদুরু কাঁপছে।

“ঠিক আছে, কিন্তু পাঁচটা কিটক্যাট কিনে দিতে হইবে।”

স্বস্তির শ্বাস ফেললাম, সেই সাথে আফসোসও হলো বড্ড। কারণ আজ রিকশা স্বপ্নীয় বিলাসিতা, বাস দিয়েই বাড়ি যেতে হবে। অতঃপর তার বাবার দোকান থেকেই তাকে চকোলেট কিনে দেই। বালিকা বুদ্ধিমান আছে, বাবার বিক্রিও বাড়ালো, আবার উপহারও পেল।

ঐ অসভ্যটার উপর রাগ লাগছে, তিনি আমার সাথে একটু কথা বললেই আমার টাকাটা বেঁচে যেত।ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার পথে যে দৃশ্য দেখি তাতেই কান্না চলে আসে। আবেগ ভাই একজন মেয়ের সাথে গল্পে মেতে আছেন। হাসির ছলে বারবার মেয়েটা তাঁর গায়ে হাত দিচ্ছে। তবে কি মিথ্যে ছিল সব স্বপ্ন, এতো জল্পনা-কল্পনা?

ভার্সিটির বাহিরে যেয়ে কিছু দূর এগিয়ে গেলে আমাকে কেউ ব্যস্ত রাস্তা থেকে ডাক দেয়। তাকিয়ে দেখি রিকশায় বসে থাকা আমার কাজিন আবির ডাক দিচ্ছে। নিঃশব্দে রিকশায় চড়ে বসি। কেন যেন মনে হলো কেউ আমায় ডাকলো, ঐ পরিচিত বজ্রকন্ঠ। পিছনে তাকাতে গিয়েও তাকালাম না। ভাবলাম মনেরই ভুল হবে, ঐ অসভ্য যুবকের সময় কোথায় আমার জন্য?

বাসায় যেয়ে ‘ঘুমাবো’ বলে বেডরুমের দরজা আটকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। আসরের নামাজ শেষ হলে দ্বারে নক করে আবির ভাইয়া।

“কী রে! আর কতো ঘুমাবি!”

আমি তাড়াতাড়ি চোখে-মুখে পানি দিয়ে আসি। আবির ভাইয়ের পছন্দ, চিন্তাধারার সাথে আমার পছন্দ, চিন্তাধারার এক অসম্ভব মিলবন্ধন আছে। তার সাথে গল্পে মজে দুঃখগুলো কয়েক মুহূর্তের জন্য ভুলেই গেলাম। অথচ, এক মুহূর্তের জন্যও বোধ করিনি কেউ একজন অগ্নিদৃষ্টিতে দেখছে আমাদের। মাগরিবের আজান অবধি কথোপকথন চলে আমাদের

“আবেগ এসেছে। ড্রইংরুমে চলে যা।”
প্রথমে বিস্মিত হলেও পরে বড্ড কান্না পেল নামাজ শেষে এ কথা শুনে। ক্যানো এসেছেন তিনি? কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে? অভিমানে ঠোঁট, গাল সবই ফুলালাম। তবে অভিমানটা দেখার মানুষটি কি আদৌ দেখবেন?

মাথায় কাপড় দিয়ে গুটি গুটি পায়ে বই নিয়ে বসার ঘরে যেয়ে বসলাম। অশ্রুর পতন আটকানোর বহু প্রচেষ্টা আমার। আম্মু চা-নাস্তা দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। বাসায় এ মুহূর্ত তেমন কেউ নেই, সবাই কোনো না কোনো কাজে বাহিরে।

ভুলক্রমেও আবেগ ভাইয়ের দিকে চোখ তুলে তাকালাম না। তিনি বই নিয়ে একটা পেজ বের করে আমাকে তা দেখিয়ে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
“টানা আসর থেকে মাগরিব অবধি বলা এতো কথা পেটের কোন কোণে থাকে মায়াবালিকা? কই আমার সামনে তো কখনও বের হয় না!”

আমি হা হয়ে গেলাম। তীব্র বিস্ময় নিয়ে তাকালাম তাঁর দিকে। এই পুরুষটি জ্বিন না কি গুপ্তচর ? কী করে জানলেন এ বিষয়ে?

আমার দৃষ্টিতে তাঁর চোখজোড়া আরও সংকুচিত হলো। ধমক দিয়ে উঠলেন হুট করে,
“বইয়ের দিকে তাকাও ইডিয়ট। তোমার মা এদিকে সিসিটিভি ক্যামেরার মতো তাকিয়ে আছে। যত্তসব ঝামেলা কোথাকার!”

আড়চোখে রান্নাঘরে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই বলছেন তিনি।
“কেন বলবো? আর আপনার সামনে কীভাবে বের হবে? আপনার কি আমার কথার জন্য সময় আছে? আপনার তো বান্ধবের অভাব নেই, যারা কাঁধে, পিঠে কথায় হাত রেখে আনন্দে মাতিয়ে রাখে। আবির ভাইয়ার আমার জন্য সময় আছে, আপনার মতোন না আমার ভাই।” তীব্র কঠোরতা মিশে আছে আমার বচনভঙ্গিতে।

তাঁর মেঘের আড়ালে ঢাকা চেহারায় সূর্যের মতোন মৃদু হাসি উঁকি দেয়। পরক্ষণেই মুখ খানা গম্ভীর বানিয়ে ফেলেন।

“আমার বড়ো মামাতো বোন ছিলেন, ব্রিটেনে বড়ো হয়েছেন তা-ই একটু বেশিই ফ্রী। তবে সামনে আর হবেন না। আর হ্যাঁ, এসব কাজিন-ফাজিনকে ভাই-টাই আমি মানি না বুঝলে মায়াবালিকা? So stay away girl. Otherwise you would not like the consequences. আর আন্টিকে কী সব উল্টাপাল্টা কথা বলো আমার নামে। কান ধরে ক্যাম্পাস চক্কর দেওয়াবো বলে দিলাম।” গাম্ভীর্যপূর্ণ তাঁর কণ্ঠ।

উঠে দাঁড়ালেন তিনি। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। কী বললেন এসব? একই সাথে কেউ এমন দুই ধরনের ভাবাবেগপূর্ণ কথা বলতে পারে! এই লোকটা আমাকে বিস্মিত করার কোনো সুযোগ ছাড়েন না। আর এই দুলিটাও না! বলেই দিয়েছে সব তাঁকে! তবে সব বাদ দিয়ে অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করছে।

আপন মনেই বিড়বিড় করলাম, “আমার অন্তর খানা যে কাঁপিয়ে দিয়ে গিয়েছেন সামান্য কথার দ্বারা, তা কি জানেন আবেগ ভাই?”

হৃদয়ের মধ্যখানে শত প্রজাপতির আলোড়ন হচ্ছে। অন্যরকম ভালো লাগা, প্রাপ্তির সুখ। আমার কাঙ্ক্ষিত পুরুষটির মনেও আমায় নিয়ে অনুভূতি আছে, নাহলে আমাকে কেন ব্যাখ্যা করতে গেলেন এতো কিছু? এতোটা চিন্তা, ঈর্ষা কেন আমায় নিয়ে? সারাটা রাত্রি ঘুম হলো না। তাঁর ভাবনায় বিভোর হয়ে রাত কাটালাম, নব নব স্বপ্ন বুনলাম।

এখন কোনো বিষয় না বুঝলে আবেগ ভাই বাসায় আসেন। তিনি তো পড়া বুঝান, আমি শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকি। বিনা কারণেই তাঁর অসভ্য দলের সামনে দিয়ে যাই। তিনি তাঁর তীক্ষ্ম, গভীর দৃষ্টি ফেললে, আমি লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলি। বড্ড প্রেমময় যাচ্ছে আমার দিনগুলো।

___

এতোটুকু লিখেই কলম থামালাম। সুদীর্ঘ এক শ্বাস ফেললাম। কী সুন্দর ছিল দিনগুলো! কিন্তু এর পরের একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা সব ধ্বংস করে দিল! সব! নোনা জল গড়িয়ে পড়লো। লিখতে বসলাম সেই বিষাক্ত দিনটির কথা।

চলবে…

#জানালার_ওপারে
||৭ম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
“আমি কথা বলতে পারি না বলেই কি আমাকে ভালোবাসেন না আবেগ ভাই? না কি আপনিও আমাকে অপয়া, অপবিত্র মনে করেন?” কথাটা বলতে চেয়েও পারলাম না। ‘আ’ জাতীয় অস্পষ্ট শব্দ বের হলো শুধু।

সপ্তম পৃষ্ঠা অবধি লিখার পর আর লিখতে পারিনি। মা ঠেলে-ঠুলে হাফসার সাথে পাঠিয়েছে তার বিয়ের, বৌভাতের শপিংয়ে সাহায্য করার জন্য।

গাউসিয়া মার্কেটের সামনে এসে রিকশা থামে। নামতে নামতেই আবেগ ভাই এগিয়ে আসেন। আজ আমার কাতর দৃষ্টি তাকে ছুঁতে পারে না, এক পলক দেখেই চোখ সরিয়ে নেন।

হাসি মুখে হাফসাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করেন,
“কেমন আছো হাফসা? আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো।”

আহত হই, চোখের কোণে অশ্রু জমে। প্রকাশ করি হৃদয়ের আর্তনাদ। কিন্তু ঐ যে পালনকর্তা বড্ড বেশিই অসহায় বানিয়েছেন আমায়৷ তাই কোনো কথাই হয় না প্রকাশিত।

“আপু আসো”
বলতে বলতে হাফসা আবেগ ভাইয়ের সাথে গল্প করতে করতে এগিয়ে যাই। আমি একাকী তাদের পিছন পিছন চলি। একটি বিলাসবহুল দোকানে প্রবেশ করি আমরা।

দোকানে আবেগের মা, বড়ো বোন, মামী আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন। আমি তাদের দেখে ইশারায় সালাম জানাই। হাফসা ও আবেগ ভাই তাদের সাথে পোশাক চয়ন করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকি।

শত জামা-কাপড়ের ভীড়ে আমার চোখ আটকে যায় সাদা রঙের মাঝে সোনালি জরি কাজের বেনারসি কাতান শাড়ির দিকে, পাড়টা রয়েল ব্লু রঙের। শাড়িটা হাতে নিতেই চোখ পুনরায় নোনাজলে সিক্ত হলো। একদা এমন শাড়ি পরেই আবেগ ভাইয়ের বউ সাজার স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি, অথচ আজ সবকিছুই মরীচিকা।

হুহু করে উঠে বুকটা, বউ না হতে পারলাম তাঁর, শাড়িটাই নাহয় হোক তাঁর স্মৃতিগন্ধা। হাফসা হাতে তুলে নেয় শাড়িটি।

“এই শাড়িটা পছন্দ করেছো? তোমার চয়েস আসলেই অস্থির। এটাই নিচ্ছি বিয়ের জন্য।”

আমি আলতো হাসলাম। আমার পছন্দ প্রকৃতপক্ষেই বেশ ভালো, তোর পছন্দনীয়। তাই তো আমার প্রিয় পুরুষটিকেও তোর পছন্দ হলো, তাঁকে নিয়ে নিলি। তা যখন বিনা শর্তে দিতে পেরেছি, এ আর এমন কী?

শাড়িটা নিয়ে সে চলে গেলে আমি পুনরায় কোণঠাসা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম মোবাইল নিয়ে। হুট করে শুনতে পেলাম এক পুরুষালি কণ্ঠ,

“এক্সকিউজ মি? আপনি কি…? হ্যাঁ, সামুই তো তুমি। কেমন আছো?”

রেজাউল সাহেবকে দেখে খাণিক চমকে উঠলাম। আমি যে হাসপাতালে ছিলাম, তিনি সেখানে ইন্টার্নি করছেন। প্রায়শয়ই মূল ডাক্তারের পরিবর্তে তিনি উপস্থিত হতেন।

আমি ইশারায় বললাম বোনের বিয়ের শপিং করতে। তিনি মৃদু হেসে আবেদন করলেন,

“ভালোই হয়েছে তোমাকে পেয়ে। তোমার আমার একটা সাহায্য করতেই হবে। আমার বড়ো বোনের জন্মদিন উপলক্ষে তার জন্য শাড়ি নিতে এসেছি কিন্তু পছন্দ করতেই পারছি না। একটু চ্যুজ করে দাও না প্লিজ। না করবে না, প্লিজ। আমি কিন্তু তোমায় সেবা দান করেছি, না করলে পাপ হবে।”

ফিঁক করে হেসে ফেললাম আমি। মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে শাড়ি দেখতে লাগলাম। অবশেষে প্যাস্টেল গ্রিন কালারের একটা হালকা কাজের সিল্ক জামদানি পছন্দ করে দিলাম। কারণ এ রঙটা গাড় রঙ পছন্দ করা মানুষেরও ভালো লাগবে, আর হালকা রঙ পছন্দ করা মানুষেরও।

তিনি বিল দিয়ে চলে যাওয়ার আগে আমার হাতেও একটি ব্যাগ ধরিয়ে দিলেন, সাথে নিজের কার্ডও। আমি অবাক হয়ে প্রশ্নসূচক চাহনি নিক্ষেপ করি।

“দেখো কন্যা লাবণ্যময়ী, এটা উপহার তোমার জন্য। আমাকে সাহায্য করার জন্য, ঐ হাস্যোজ্জ্বল চাহনিতে আমার দিন সুন্দর করার জন্য, আমাকে নিজের চিকিৎসা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য।”

কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই কাচের দরজার বাহিরে চলে গেলেন। অনেকদিন পর পজেটিভ বাক্য শুনে আমার মুখেও কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে উঠে। পিছনে ঘুরতেই কারো দেহের সাথে মাথার সংঘর্ষ।

মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চোখ তুলতেই মুখশ্রী ম্লান হয়ে যায়। আবেগ ভাই তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখছেন আমায়। হুট করে আমার হাতের ব্যাগ খানা হাতে নিয়ে নেন। কার্ড বের করে টুকরো টুকরো করে, টুকরোগুলো ব্যাগে ভরে ছুঁড়ে ফেলেন মেঝেতে।

“ব্লাডি বাস্টার্ড একটা! আর তোমাকেও বলি, একটা না একটা ছেলের সঙ্গ লাগবেই তোমার মেয়ে? বলেছিলাম না দূরে থাকতে সবার থেকে!” গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠ তাঁর।

“আপনার কী? আমি যার সাথে ইচ্ছে কথা বলবো? আপনি আপনার বউকে দেখে রাখেন, আমাকে দেখা লাগবে না।” অন্তরের প্রতিবাদ অন্তরেই থেকে গেল। মুখ বলার ক্ষমতা তো নেই।

তিনি ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলেন। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেও গাউসিয়া থেকে বের হয়ে রিকশায় চড়লাম, হাফসাকেও একটা ম্যাসেজ দিলাম চলে যাচ্ছি জানিয়ে।

বাসায় আসতেই মা সহ সবার জেরার মুখোমুখি। উত্তর দিতে না পারায় যা নয় তা শুনলাম। অথচ, উপস্থিত প্রতিটি সদস্য জানতো আমি কথা বলতে অক্ষম। আচ্ছা, আমার দোষটা আমার অক্ষমতা না আমার সাথে ঘটা পূর্বঘটনাটা?

ফ্রেশ হয়ে আবার ডায়ারি কলম নিয়ে বসলাম।

🥀🌺পৃষ্ঠা – ৮

সকাল সকাল টিএসসিতে বসে চা আর বাদাম খাচ্ছি আপনমনে। নিশাটা ক্লাসে। মেয়েটাও এতো পড়া পাগল না! একটা ক্লাসও তার মিস দেওয়া চলবে না।

“কী অবস্থা ভেঁপু?”

আমার শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটিয়ে উপস্থিত হন হাসিব ভাইয়া। তাঁকে দেখেই বিরক্তিতে আমার মুখ দিয়ে ‘চ’ বোধক শব্দ বের হয়। তবুও বিরক্তি পাশে রেখে উত্তর দেই,

“অবস্থা তো এ পর্যন্ত ভালোই ছিল ভাইয়া। এখন ভালো থাকবে কি না সন্দেহ।”

তিনি মৃদু কণ্ঠে বিড়বিড়ালেন,
“এই মেয়েটাও না একদম ত্যাড়া, ঠিক আবেইগ্যার মতোন। একটা কথাও মাটিত পড়তে দেয় না।”

আমি শুনতে পেরেও না শোনার ভান করলাম।

“দেখো মেয়ে, আমি তোমার সিনিয়র। জুনিয়ার হিসেবে তোমার উচিত আমার সব কাজকে সাপোর্ট করা, কোওপারেট করা, সাহায্য করা। আমি মশা আই মিন নিশাকে আজ প্রপোজ করব, তুমি ওকে ঠিক সাড়ে এগারোটায় বটতলায় নিয়ে আসবে। নাহলে সব সিনিয়রদের এসাইনমেন্ট তোমাকে দিয়ে করাব। মনে থাকে যেন। ঠিক সাড়ে এগারোটা।”

তিনি আমাকে জরুরি কোনো ভাষণদানের মতোন গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলে হনহন করে চলে গেলেন। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এদের গোটা ফ্রেন্ড সার্কেলই কি এমন অদ্ভুৎ না কি! কথাটা তো ভালোভাবে বা অনুরোধ করেও বলা যেতো। কিন্তু না, ভাষণের বেশে হুমকি দিয়ে গেলেন। অসভ্যর দল!

তবুও প্রিয় পুরুষের বন্ধু তা-ই সাহায্য তো করতেই হয়। তাছাড়া বান্ধুবী নিশাও তাঁর উপর ক্রাশ খেয়ে বসে আছে বহু আগে থেকেই।

কথা মোতাবেক জোরজবরদস্তি করে নিশাকে বটতলায় নিয়ে আসলাম। যেয়ে তো আমার চক্ষু ছানাবড়া। হাসিব ভাই নতুন বরের মতোন নীল রঙের শেরওয়ানি আর ধুতি পরে, কড়া আতর দিয়ে সেজে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে বেলি ফুলের মালা। তাঁর বন্ধুরাও আছে।

“এই মেয়েরা, এদিকে আসো।”

তাঁদের দেখে নিশা উলটোপথ ধরতে নেয়, আমি হাত ধরে ফেলি। কাঁপা কাঁপা গলায় সালাম দেয় সে।

“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়ারা।”

সালামের জবাব পাওয়া গেল না। বরং, আকস্মাৎ করে ফুল হাতে মাটিতে বসে পড়লেন হাসিব ভাইয়া। করলেন এক অদ্ভুৎ ভঙ্গিমায় প্রপোজ।

আজকেও ছড়া কাটলেন,
“তুমি মশা আমি মাছি,
আমি তোমায় ভালোবাসি।”

আমি চোখ কবে যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসে এই অসভ্যদের জন্য। এভাবেও কেউ প্রপোজ করে! আমি হাসি আটকাতে পারি না, শব্দ করে হেসে দেই। মিটমিট করে হাসা তাঁর বন্ধুগুলোও হা হা করে হাসে। হাসিব ভাইকে তাতে একটুও লজ্জা পেতে দেখা যাচ্ছে না। বরং, নিশার লজ্জায় মরি মরি দশা।

হাসিব ভাই ধমকিয়ে উঠলেন,
“এই মেয়ে আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবো আমি? তাড়াতাড়ি ফুল হাতে নাও, নাহলে পুরো ক্যাম্পাস কানে ধরিয়ে ঘুরাবো।”

বেচারি নিশা ভয় পেয়ে চটজলদি মালাটা হাতে নেয়।। হাসিব ভাই হাসি মুখে উঠে দাঁড়ান। নিশা আমার হাত আঁকড়ে ধরে চলে যেতে নিলে তিনি গম্ভীর গলায় শুধান,

“আমার সাথে বাসায় যাচ্ছো তুমি আজ, অন্য কারো সাথে না। আর হ্যাঁ, বাসার এড্রেস দিয়ে যাবা। আমার চাকরি হয়ে গেছে। আজকে বিকালেই আম্মু-আব্বু যাবে। চুপচাপ রাজি হয়ে যাবা, ওকে?”

শেষের কথাটা একটু জোরেশোরেই উচ্চারণ করেন। নিশা ভয় পেয়ে দ্রুতো মাথা নাড়ায়। হাসিব নিজের হাত এগিয়ে দেন, নিশাও তা আঁকড়ে ধরে। নিশার মুখে আলতো হাসি, এক তৃপ্তি। ইশ! কী ভালোবাসাময় এক দৃশ্য! অন্যের ভালোবাসা দেখাতেও এক তৃপ্তি আছে। আমার চোখ যায় আবেগ ভাইয়ের দিকে, তাঁর দৃষ্টিও আমাতেই স্থির। কামনা করি, এ দিন আমার জীবনেও আসুক।।

অতঃপর আমি রওনা হই বাসার জন্য। রাস্তায় জ্যাম থাকায় অর্ধেক রাস্তাতেই নেমে যাই। শূন্য পথ ধরে হাঁটতে শুরু করি। কারণ প্রচুর মেইন রোডে ট্রাফিক জ্যাম ও মানুষের ভীড়।

মাঝ দুপুরে ফাঁকা রাস্তায় কিশোরী মেয়েটির হাত চেপে ধরে মতি ব্যাপারী। ভীত মেয়েটি হাত ছাড়াতে জোরাজুরি, চেঁচামেচি করে। ফলাফল শূন্য। নোংরা স্পর্শ লেপ্টে যাচ্ছে তার অসহায় শরীরে। অথচ, কিছু করার নেই আমার। কিছু করার নেই।

চলবে…।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে