জানালার ওপারে পর্ব-১০+১১

0
883

#জানালার_ওপারে
||১০ম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
“কী হলো আসো মেয়ে!” ধমক দিয়ে উঠলেন তিনি।

কেঁপে উঠলাম আমি। এগিয়ে গেলাম তাঁর টেবিলের দিকে। তবে এই বেশভূষায় আমাকে চেনার কথা নয়। কেউই চিনতে পারেনি।

আমি স্থির হয়ে দাঁড়াতেই তিনি এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন। আমার গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি এতো অবুঝ কেন মেয়ে? একটা বার বললে কী গায়ে ফোস্কা পড়ে যেতো? আর তোমার সাহস কীভাবে হয় এ অসুস্থতা নিয়ে বাসা থেকে পালানোর! You deserve a real big punishment Mayabalika! Do you know?”

আমি চোখ-মুখ খিঁচে ফেললাম ভয়ে এই পরিস্থিতিতে পড়ে। ভয়টা আবেগ ভাইয়ের শাস্তি বা তিনি জড়িত নয়, যে আমার নয় তাঁর প্রতি বিন্দুমাত্রও অনুভূতি আমার কাজ করছে না, করে না। ভয় তো নয়ই। তবে বাবা-মা যদি জানতে পেরে আমাকে নিয়ে যেতে জোর করে এই ভয় কাজ করছে।

“আবেগ তোকে রশিদ স্যার ডাকছেন, ইমারজেন্সি। তাড়াতাড়ি যা।” একজন সিনিয়র এসে ডাক দেন তাঁকে।

“Stand right here. Don’t you dare to move.”

তিনি চলে গেলেন। আমি স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। কফি সমেত ওয়ান টাইম কফির কাপটা হাতে নিয়ে বড় বড় পা ফেলে বের হয়ে গেলাম ক্যান্টিন থেকে।

রাসেল সাহেবও ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন ক্যান্টিনের সামনে। রাহা আপুর কড়া আদেশ কোনো ক্রমেই আমাকে একা ছাড়া যাবে না। তাই তাঁর আমাকে পিক করার কথা ছিল ক্যান্টিনের সামনে থেকে।

“সামু চলো।”

আমি সায় জানালাম। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কী মনে করে যেন পিছনে ঘুরি। আবেগ ভাই ভবনের দ্বিতীয় তলা হতে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আরও দ্রুত পা চালাই এ দৃশ্য দেখে।


রাস্তা আজ বেশ ফাঁকাই ছিল, আধা ঘণ্টাতেই বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। রাহা আপু এখন হাসপাতালে। আসতে আসতে তাঁর রাত হবে আজ। আমি চুলায় ভাত বসিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এসে দেখি এখনও ভাত হয়নি। তবে কয়েক মিনিটের হয়ে যাবে। চাল হয়তো ভালো পড়েনি, কারণ নাজিরশাইল চাল সিদ্ধ হতে এতো সময় লাগার কথা নয়।

ভাবতে ভাবতেই কলিংবেল বেজে উঠে। দ্রুতো দরজা খুলে কে আসছে না দেখেই ছুটে আসি রান্নাঘরে। কারণ চুলোয় ভাতের মাড় পড়লে, তা মুছা বেশ কষ্টকর। আর আজ রাহা আপু বা কাজের লোকও নেই। তাড়াতাড়ি পাতিল নামিয়ে ভাতের মাড় ঝরাতে বসাই।

“সামু ডিয়ার, কে এসেছে?” রাসেল সাহেব প্রশ্ন করতে করতে নিজের রুম থেকে বের হন।

আমিও রান্নাঘর থেকে বের হয়ে বসার ঘরে যাই। সর্বপ্রথম যাকে চোখে পড়ে তিনি হলেন হাসিব ভাইয়া এবং নিশা। আর আমার পাশের সোফায় কপালে হাত দিয়ে শক্ত মুখে বসে আছেন আবেগ ভাই।

চমকে যাই। এতোটাই যে কয়েক মুহূর্ত থমকে যাই আমি। নিশার জড়িয়ে ধরায় ধ্যান ভাঙে আমার।

“কেমন আছিস রে সামু? আমাকে তো ভুলেই গিয়েছিস।”

আমি জোরপূর্বক হাসলাম। রাসেল সাহেবও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে বেমানান ভাবে কাশি শুরু হয় আমার। গতরাতে এক বসায় ৫০০ ml আইসক্রিম শেষ করার ফলাফল হয়তো।

আবেগ ভাই অবিলম্বে উঠে দাঁড়ান পানি আনতে। কিন্তু তাঁর আগেই রাসেল সাহেব এক গ্লাস পানি এনে দেন। এতে অন্যরকম এক আক্রোশ দেখা দিল যেন এই অসভ্য লোকটার চোখে-মুখে। কিন্তু তাঁর কী?

তিনি এসে আমার হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরেন।
“অনেক দেখেছি তোমার কাহিনী মেয়ে। এখনই বাসায় চলো আমার সাথে।”

রাগের সাথে সাথে বিরক্তিও মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। ঝাড়া দিয়ে হাত ফেলে দেই। রাসেল সাহেব প্রথম বারের মতো মুখ খুলেন সবার সামনে।

“আসলে ও যখন যেতে চাচ্ছে না। জোর করছেন ক্যানো? ঠাণ্ডা মাথায় বসে কথা হলে ভালো হয়।”

“দেখুন, মিস্টার। আমি আমার ওয়াইফের সাথে কথা বলছি। দয়া করে আপনি এতে ইন্টারফেয়ার করবেন না।”

আমার বিস্ময়ে চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে। আমি কি হ্যালুসিনেশন করছি বা ভুল শুনছি? কী বললেন তিনি?

“ওয়েট এ মিনিট, আপনার বিয়ে তো সামুর ছোটো বোনের সাথে… সামু আপনার ওয়াইফ মানে?”

“Who the hell are you? আপনাকে কেন এক্সপ্লেইনেশন দিব আমি? কী হন আপনি আমার বা মায়াবালিকার? আর মেয়ে তুমি কি যাবা আমার সাথে না কি যাবা না? সোজাসুজি বলো।”

কিছুটা ধমকের ছাপ। আমি চোখ অন্যদিকে রেখে মাথা নাড়াই, যার অর্থ না।

“এখানে কি মধু পেয়েছো যে নিজের বাসায় ফিরবা না? ফিরো না আমার সাথে। সবাই তো আমাকে পেয়েছো পাগল বানাতে। একজন আমার ভালো করতে যেয়ে দশ হাত পানির নিচে ঢুকায় দেয়, আরেকজন অনর্থক শাস্তি দেয়। রাখো বানিয়ে পাগল। আমার তো কাজ নেই, সারা দিন তোমার পিছনে টুকটুক করে ঘুরবো।”

একঝাঁক অভিযোগ, তাড়না ও অভিমান প্রকাশ পেল তাঁর কথায়৷ যা বোধ করতে পারলেও প্রতিক্রিয়া দেখানোতে নিষেধ।

পরিস্থিতি বিপরীতে যেতে দেখে নিশা শুধায়,
“ভাইয়া, আপনি একটু সামনের লেক থেকে ঘুরে মাথা ঠাণ্ডা করে আসেন। হাসিব আপনিও যান ভাইয়ার সাথে। অনেকদিন পর দুই বান্ধবীর দেখা হয়েছে, আমরা কথা বলি।”

আবেগ ভাই হনহন করে বের হয়ে গেলেন। পিছন পিছন হাসিব ভাইয়াও চলে গেলেন। আমিও আমার জন্য নির্ধারিত ঘরের এসে পড়লাম। নিশা কাঁধে হাত রাখতেই তাকে জড়িয়ে ধরি শক্ত করে নিজেকে সামলাতে। তবুও এক ফোঁটা জল বেরিয়েই আসে বাধ ভেঙে।

নিশা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে প্রথম যে কথাটা উচ্চারণ করে, তা হলো –
“সামু, আবেগ ভাইয়ের কোনো দোষ নেই। তিনি তো জানতোও ন…”
|
চলবে…

#জানালার_ওপারে
||১১তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
“সামু, আবেগ ভাইয়ের কোনো দোষ নেই। তিনি তো জানতেনও না তোর সাথে না, হাফসার সাথে বিয়ে। ইভেন শুধু তিনি কেন, আমরা, আমাদের ভার্সিটির বন্ধুমহল, সিনিয়র্স সবাই জানে তোর আর আবেগ ভাইয়ের বিয়ে। তুই যদি সোশিয়াল মিডিয়া আনইন্সটল না করে কারো সাথে একটু কথা বলতি বা ভার্সিটিতে যেতি তাহলেই জল এতোদূর গড়াতো না।”

প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয় আমার। এমন হাস্যকর কথার কোনো অর্থ হয় না কি? যার বিয়ে তিনি জানেন না কনে আমি না, হাফসা, এও সম্ভব? হাতের ইশারায় থামিয়ে দেই নিশাকে।

উঠে খাতা কলম এনে লিখি,
“একদম আজগুবি, হাস্যকর কথা বললি না নিশু! কারো বিয়ে আর তাঁর কাছে সঠিক ইনফরমেশন নাই কার সাথে তাঁর বিয়ে! আচ্ছা, একবারের জন্য মানলাম তিনি জানতেন না। কিন্তু বিয়ের দিন অবধি কারো মুখেও শুনেননি তাঁর বউ কে! এও মানতে বলছিস আমায়?

তোর স্বামীর প্রিয় বন্ধু মানে তোর ভাসুর বলেই কি সাপোর্ট করছিস? আমি তোর স্কুলের বান্ধুবী, কিছু না এখন…? আর সাপোর্ট করলেও সরাসরি বল, এসব আজগুবি কাহিনী বানাইস না প্লিজ। আরও একটা সম্পর্ক থেকে বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।”

শক্ত মুখে খাতাটা নিশার দিকে এগিয়ে দিলাম। সে দেখে দীর্ঘ এক শ্বাস ফেললো।

“তোকে এভাবে বোঝানো সম্ভব নয়। তুই বাড়ি চল, ঠাণ্ডা মাথায় সব শুনে তুই নিজেই সিদ্ধান্ত নিস।”

“আমি কোনোক্রমেই বাসায় যাবো না। আর তাছাড়া রাহা আপুও বাসায় নেই, তাঁর সাথে দেখা না করেও কোথায় যাবো না। না আমি তাঁর সাফাইজবাব তোর মুখে শুনতে রাজি।”

পুনরায় খাতা কলম নিয়ে লিখি। আমার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে সে পার্স থেকে নিজের ফোন বের করে।

কিছুক্ষণ টিপাটিপি করে একটি ভিডিও চালু করে আমার সামনে ধরে। ভিডিওটির টাইটেল ও কন্টেন্ট দেখে আমি থমকে যাই।

একটি সংবাদ চ্যানেল কর্তৃক তৈরিকৃত সংবাদ। টাইটেল হলো ‘কিশোরীকে ধর্ষণ থেকে বাঁচানোর ফলে বিত্তবান ব্যবসায়ীর আক্রোশের শিকার সাহসী তরুণী”। ভিডিওটিতে মতি ব্যাপারীর আদালত থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়ে বের হওয়ার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। পরের দৃশ্যে আমার দুই বছর আগের গাউন-হিজাব পরা একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখানো হচ্ছে স্ক্রিনে।

সুদর্শন একজন রিপোর্টার রিপোর্টিং করছেন। বলছেন,
“গল্পটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীর। চেহারার মতোই হাসিখুশি, স্নিগ্ধ, শান্তশিষ্ট, পরোপকারী, প্রতিবাদী। আর দশটা মেয়ের মতোই সুন্দর একটা জীবন ছিল তার। কিন্তু তার পরোপকার করার গুণটিই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো।

দিনটি আজ থেকে মাস খাণেক আগের পনেরো তারিখ, বুধবার দুপুরের। অন্যান্য দিনগুলোর মতোই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরছিল মেয়েটি। মেইন রোডে ট্রাফিক জ্যাম থাকায় পিছনের একটি জনমানবশূন্য গলি দিয়ে বাসার জন্য রওনা হয়। যাত্রাপথেই দেখতে পায় এক গায়ে কাটা দেওয়া দৃশ্য।

বিত্তশালী ব্যবসায়ী মতি মিয়া তার দুজন সহায়ক রনি ও মনির সাথে মিলে একটি বারো বছরের কিশোরী মেয়েকে আটকে রেখে অপকর্ম করার চেষ্টা করছে।” স্ক্রিনে আমার ধারণ করা ঐদিনের ভিডিও ফুটেজটি দেখানো হয়।

❝মেয়েটিও পারতো অন্যান্যদের মতো ভয় পেয়ে চলে যেতে বা এড়িয়ে যেতে। সে ভয় পায়নি এমন নয়, কিন্তু সে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ হতে দেয়নি। বরং, তখনই কল করে ১০৯ এ ও নিজের হবু স্বামীকে। বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সে নিজের ফোনের ক্যামেরায় ধারণ করে তাদের অপকর্মের দৃশ্য। অদম্য সাহসিকতার সাথে প্রতিবাদ করে হায়নাদের বিরুদ্ধে।

পুলিশ কর্মীরা সঠিক সময়ে পৌঁছিয়ে মতি মিয়াকে গ্রেফতার করে। এতেই যেন মতি নামক পশুর আক্রোশের শিকার হয় সে। অর্থের জোরে বেইলে ছাড়া পেতেই হত্যার চেষ্টা করেন এই সাক্ষাৎ ফেরেশতার ন্যায় মেয়েটিকে। সফলও হন অনেকটা। তবে কথায় আছে না, রাখে আল্লাহ, মারে কে? সৃষ্টিকর্তার রহমতে মেয়েটি বেঁচে যায়। তবে হারায় তার বাকশক্তি। এর পর থেকেই তার স্বামীর যুদ্ধ ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য।

অবশেষে আজ সফল হলেন তিনি প্রিয় স্ত্রীকে ন্যায়বিচার দিতে। প্রেয়সীর জন্য তো তাজমহল অনেকেই তৈরি করতে পারেন, তবে ভালোবাসার এ উৎকর্ষ উদাহরণ কত জন হতে পারেন? যারা দুঃসময়েও হাত আগলে রাখতে জানে। আজকের দিনটি এমন অসাধারণ সব ভালোবাসার নামে। বলা বাহুল্য, ভিক্টিমের ও তার পরিবারের অনুরোধে কিশোরী মেয়েটির চেহারা ব্লার রাখা হয়েছে।”

ভিডিও স্টপ করে তাতে করা মানুষের মন্তব্যগুলো একে একে দেখায় আমায় নিশা। যেই আমি কাল পর্যন্ত মানুষের তিরস্কারের শিকার হচ্ছিলাম, সেই-ই আজ এতো ভালোবাসা ও সমর্থনের অধিকারী। চোখে জল চলে আসে আমার। কিন্তু এতো সব কখন বা কীভাবে হলো? আনন্দকে ছাপিয়ে গেল বিস্ময় ও জিজ্ঞেসা। আমি কি সত্যিই ভুল বুঝছি আবেগকে?

প্রিয় বান্ধুবীর হাত ধরে জিজ্ঞেসু চাহনি নিক্ষেপ করতেই সে ম্লান হাসে।

“দেখ, আবেগ ভাইয়ের চেয়ে তুই আমার হাজার গুণ বেশি আপন। কিন্তু তাই বলে তো আমি সত্যকে মিথ্যে মেনে বিচার করতে পারি না। এই যা দেখলি, সবকিছুর পিছনে আবেগ ভাইয়ের হাত। তাঁর একাধিক নির্ঘুম রাত্রি, অক্লান্ত দৌড়াদৌড়ি, পরিশ্রম, এমন কী তাঁর ছাত্রজীবনের সঞ্চিত সকল অর্থের বিপরীতে আজ তোর জন্য ন্যায় এনেছেন। আমি তোকে আজকে ফিরার জন্য বা আমার সাফাই শুনার জন্য জোর করবো না৷ বরং, তুই শান্তিতে ভাব, একটু ভাব। আমি কাল আবার আসবো৷ তুই যদি আমার কথা, তাঁর জবাব শুনতে চাস, তবে আমার সাথে বাড়িতে চলিস। কোনো জোরাজুরি নেই, তোর জীবন, তোর ইচ্ছে।”

আমাকে আরও একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিল সে। আমি চুপ করে বসে থাকলাম। প্রকৃতপক্ষেই আমার সময় চাই, নিজের মতো কিছুটা সময়। এতোটা কনফিউজ, দ্বিধান্বিত জীবনের কোনো পর্যায়ে আমি হইনি।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে