#জানালার_ওপারে
||৯ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
“এই মেয়ে মাঝ রাস্তায় কী করছিলে তুমি? পাগল হয়েছো তুমি? আমার কী হতো তোমার কিছু হয়ে গেলে?”
পিটপিট করে চোখ খুলতেই পুরুষালি কণ্ঠ কর্ণগোচর হয়৷ বড্ড অস্থিরতা তার কথায়। মাথাটা ঘুরিয়ে দে পারলাম না, ব্যথায় আর্তনাদ করে চোখ বন্ধ করে ফেলি।
“তুমি ঠিক আছো? বেশি কষ্ট হচ্ছে?”
আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালাম এবার। অবাক আমি। রাসেল সাহেব এখানে কী করছেন? আমিই বা এখানে কেন?
তিনি আমাকে ধরে হেলান দিয়ে বিছানায় বসান৷ এর মধ্যেই রুমে প্রবেশ করে একজন ঊনত্রিশ-ত্রিশ বছর বয়সী নারী। পরনে প্লাজু, লং ঢোলা লেডিস শার্ট, গলায় স্কার্ফ ঝুলানো।
“সামু ডিয়ার, আর ইউ ওকে নাউ? একদম তো ভয় পায়িয়ে দিয়েছিলে আমাদের। আমাদের তো আজ জেলে যেতে হতো তোমার জন্য।”
আমি অদ্ভুত এক গোলকধাঁধায় পড়ি। এখানে কী করছি আমি? এই নারীটাই বা কে? রাসেল সাহেবের স্ত্রী না কি? কিন্তু জিজ্ঞেসও করতে পারছি না। ঐ যে আমার প্রতিবন্ধকতা। সে বরাবরের মতোই আমার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
নারীটি হয়তো বুঝতে পারে আমার মনের অবস্থা। আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“বোনু, আমি হলাম তোমাদের ডক্টর রাসেল সাহেবের বড়ো বোন রাহা। তুমি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমাদের গাড়ির সামনে এসে পড়েছিল। একটুর জন্য কোনো ক্ষতি হয়নি জাস্ট কপালে একটু কেটে গেছে, আর হয়তো অনেক ক্ষণ ধরে অভুক্ত ছিলে তাই সেন্সলেস হয়ে যাও। I don’t know you want to talk about this or not. কিন্তু আমার যতোটুকু মনে হয় তুমি নিজ ইচ্ছেতেই গাড়ির সামনে এসে পড়েছিলে।”
মাথা নত করে ফেললাম আমি। তিনি হয়তো বুঝতে পারলেন তাঁর ভাবনাই সত্য।
“এজন্যই আমি তোমার বাসায় রাসেলকে কিছু জানাতে দেইনি। ব্যাগ প্যাক করা দেখেই বুঝেছি। জানো আমার একটা ছোটো বোনের বড্ড সখ ছিল। এসেও ছিল ছোটো বোন রাইসা, রাসালের এক মিনিটের ছোটো। কিন্তু বোনটা দুই বছর বয়সেই অসুস্থ হয়ে মারা গেল। তোমাকে দেখলেই ওর মাসুম মুখটা ভেসে উঠে চোখে। আমি তোমার বড় আপুই। আপু হিসেবে নয়, আরেকজন মেয়ে ভেবেই নিজের কষ্টগুলো শেয়ার করতে পারো।”
ফোন হাতে গুঁজে দিলেন আপু। ইতঃস্তত বোধ করলাম। তবুও অল্প শব্দে ফোনে টাইপ করে সবকিছু জানালাম আমি। রাহা আপু ফোন হাতে নেওয়ার কিছুক্ষণ পরই জড়িয়ে ধরে আমায়।
ফিসফিসিয়ে শুধায়,
“এই মানুষগুলো এতো বেইমান হয় কেন বলো তো? মিথ্যে প্রেমের মায়ায় ফেলে, আলবাত অন্য একজনকে নিয়ে ঘর করে। ভুলে যায় সব ওয়াদা কতো সহজে। অপরজন শুধু ধুঁকে ধুঁকে মরে। তুমি কোথাও যাবে না। আমার সাথে থাকবে।
ঐ পরিবারেরও তোমার প্রয়োজন নেই যারা তোমার অসহায়ত্বে তোমার সাথে দাঁড়াতে পারে না। আমার সামু ডিয়ার তুমি এখন থেকে বুঝলে? আর হ্যাঁ মেয়ে, এই শহরিটা মোটেই ধোঁকাবাজ নয়, এই শহরের মানুষগুলোই শুধু গিরগিটির মতোন রং বদলায়। শহরটা তো নিজ রঙেই স্থির থাকে।”
রাহা আপু আমাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ললাটে আদর সিক্ত চুমু খেলেন। আমি এখনও বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে আছি। এক দিনের সাক্ষাতে কেউ এতোটা আপন কীভাবে করে নিতে পারে?
“আচ্ছা প্রিয় বালিকা, আমি তোমার জন্য স্যুপ করে আনছি। তা খেয়ে নিবে, ওকে? আর আগামীকাল থেকেই তোমার থ্যারাপি শুরু হবে, বুঝলে? মনে রেখো, তোমায় ঘুরে দাঁড়াতে হবে নিজের জন্য, নিজেকে ভালোবাসবে। অন্যকারো জন্য নয়। জীবনটা এক যুদ্ধ, যে যুদ্ধে যোদ্ধার প্রথম কর্তব্য নিজেকে প্রাধান্য দেওয়া এবং নিজেকে ভালোবাসা ও নিজে নিয়ে ভাবা।”
আমি কৃতজ্ঞ দৃষ্টি তাকিয়ে থাকি। তবে রাসেল সাহেবকে কেমন যেন অন্যরকম দেখা যাচ্ছে। যেন তিনি আশাহত কোনো বিষয় নিয়ে। আমি মাথা ঘামালাম না। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো, তবে সে ইচ্ছে কুরবানি দিলাম। কারণ আমার জন্য কাউকে প্রশ্ন করাও বড্ড ঝামেলার কাজ।
রাহা আপু স্যুপ ও ঔষধ খায়িয়ে দিলে আমি ঘুমিয়ে যাই। রাহা আপুও আমার সাথে শুয়ে পড়েন।
—
কোরআন তিলাওয়াতের মনোমুগ্ধকর আওয়াজে ঘুম ভাঙে আমার। চোখ মেলতেই রাহা আপুর নুরানি চেহারা দেখতে পাই। অনেকটা ভারতীয় নায়িকা নিধি আগারওয়ালের মতোন মিষ্টি চেহারার অধিকারী তিনি।
আমাকে খেয়াল করতেই মিষ্টি একখানা হাসি দিলেন।
“শুভ সকাল সুইটি। ঘুম ভালো হয়েছে?”
আমি মাথা ঝাঁকালাম। মাথাটা বরং ভালোই লাগছে এখন। আপু উঠে একসেট থ্রিপিস হাতে দিলেন।
“যাও সামু, ফ্রেশ হয়ে নেও। আমি বাহিরে আছি দরকার হলে দরজায় নক করবা।”
কথা অনুযায়ী গোসল করে নেই আমি। আপু কফি করছেন। ততক্ষণে আমি ঘুরে ঘুরে ফ্ল্যাটটা দেখছি। ধানমণ্ডির বেশ বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। বিশাল বিশাল দুটো লাগোয়া বাথরুম ও বারান্দা সহ বেডরুম, একটা ছোটোখাটো গেস্ট রুম, লিভিংরুম, ডাইনিং স্পেস, কী নেই? তবে রাহা আপুর মা-বাবকে কোথাও দেখছি না।
“সামু বেবি, যাও তো সোনা। একটু রাসেলকে কফিটা দিয়ে আসো। বা’দিকের ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব’ বোর্ড লাগানো রুমটা ওর।”
আমি কফির কাপ হাতে গেলাম তাঁর রুমে। অগোছালো কামরা, বাথরুম থেকে জলের শব্দ আসছে। বুঝলাম স্নান করছে, কফির কাপটা খাটে রেখে বাথরুমের দরজায় করাঘাত করে বেরিয়ে গেলাম।
পাখির কিচির-মিচির শব্দ শুনতে পেলাম আমি। শব্দ অনুসরণ করে পা বাড়ালেই মিনি ট্যারেসে পৌঁছে যাই৷ বিশাল বড়ো এ্যাকোরিয়াম রাখা দেয়াল ঘেঁষে। তাতে বিভিন্ন জাতে মাছ রাখা। দুটো খাঁচা পাখির, এক জোড়া লাভ বার্ড ও এক জোড়া টিয়া পাখি৷ বাকি ট্যারেস জুড়ে বিভিন্ন ফুলের গাছ। তবে কামিনী ফুল ও বেলি ফুলের ভুবান ভুলানো ঘ্রাণটাই টানছে বেশি।
রাহা আপুও পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এর মধ্যে। মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
“সুন্দর না আমাদের মিনি ছাদ বাগানটা? সবটাই রাসেলের নিজ হাতে গড়া। ছোটো থেকে তার এসবের প্রতি ঝোঁক বেশি। তখন তো নিজেদের বাড়ি ছিল না, এখন সব হয়েছে। আমি ডাক্তার, রাসেল ডাক্তার।
আব্বা-আম্মার আজীবনের সঞ্চয় আর আমাদের পুঞ্জিত টাকায় গড়া এই সুন্দর দুনিয়া। অথচ, বাবা-মা দেখতেই পারলো না কিছু। আমি মেডিকেলে পড়াকালীনই বাবা-মা মারা যান। অনেক যুদ্ধ করে আমরা এইখানে পৌঁছিয়েছি।
জানো সামু, বাবা-মার ছায়া হারানোর পর যখন সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল প্রিয় মানুষের সঙ্গের তখনই সে হাত ছেড়ে দেয়। আমার মতো চালচুলোহীন এতিম মেয়েকে না কি বিয়ে করে যায় না। সেই থেকে আমাদের যুদ্ধ শুরু সফলতার। ধোঁকা আমিও খেয়েছি, কিন্তু মৃত্যু বা হার মানা কখনওই আমার জন্য অপশন ছিল না। আজ ভাবলে মনে হয় সে ছেড়ে না গেলে আজ এই জায়গায় হয়তো থাকতাম না আমি।”
খুব মন দিয়ে শুনলাম রাহা আপুর কথাগুলো। মানুষটি হাসির আড়ালে কি সুন্দর দুঃখগুলো লুকিয়ে রাখে! এজন্যই হয়তো আপু আমাকে এতোটা আপন করে ফেলেছিলেন। কারণ তিনি নিজেও এই যন্ত্রণার ভুক্তভুগী।
“কী রে! তোমরা এখানে কী করো? আপু, তুই কি মেয়েটাকে বকবক করে পাকাচ্ছিস আমাকে যেমন পাকাস?”
মুখ থেকে বের হতে দেখি শেষ বাক্যটি, আপুর রাসেল সাহেবের কান টানতে না। রাসেল সাহেব কাতরে উঠেন ব্যথায়।
“সরি, সরি, আপু। ছাড় আমাকে।”
আমি হেসে দেই তাদের খুনসুটি দেখে। কতো ভালোই না হতো যদি সব ভাই-বোনের সম্পর্ক তাদের মতো হতো।
ব্রেকফাস্ট করার পর আপু আমায় হাসপাতালে নিয়ে যান স্পিচ-ল্যাংগুয়েজ প্যাথলজিস্টের কাছে। আপুই আমার চিকিৎসার ভার উঠিয়েছেন ডাক্তার হিসেবে। আপুর পরিচিত একজনই থ্যারাপি দিচ্ছেন আমায় ব্যক্তিগত ভাবে বিনা অর্থে।
—
দুই সপ্তাহ কেটে গিয়েছে রাহা আপু ও রাসেল সাহেবের সাথে। মিনি ট্যারেসে দাঁড়িয়ে ভাবছি, ঋণের বোঝা দিনে দিনে ভারী হচ্ছে। এতো ঋণ কীভাবে শোধ করবো ভেবে পাচ্ছি না। অর্থের ঋণ না হয় শোধ করা যায়, তাদের ভালোবাসা, যত্ন, সঙ্গ দেওয়ার শোধ কী করে ফিরিয়ে দিব? এতোটা দিন ধরে থাকছি, একদিনও বোধ করিনি আমি এই বাড়ির কেউ নয়।
“এই কন্যা, সকাল সকাল এখানে কী করো? যাও, রেডি হও।”
অবাক হই। কোথাও যাওয়ার কথা তো আজ ছিল না। জিজ্ঞেসু চাহনি আমার।
“আরে বুড়ি, এভাবে ঘরে বসে থেকে পড়া গোল্লায় যেতে দিলে হবে? আজকে ভার্সিটিতে যাবে। ক্লাস করে আসবে বুঝলে। আমি জানি তুমি কী ভাবছো। তবে এসব চিন্তা করে নিজের ক্ষতি করলে হবে না।কারো সাথে দেখা হলে এড়িয়ে যাবা সুন্দর ভাবে, ওকে?”
আমি সায় জানালাম। রাহা আপুর কথা তো আর ফেলা যায় না। কিন্তু সত্যি বলতে আমার মোটেও যেতে ইচ্ছে করছে না, বড়ো বেশি দ্বিধা বোধ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে। যদি কারো সাথে দেখা হয়, যদি কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে…
অনেক ভেবে পাশের ফ্ল্যাটের আন্টির বেশ ঢোলা-ঢালা একটা খিমার পরে বের হলাম রাসেল সাহেবের সাথে। ড্রাইভ করতে করতে তিনি নানা ধরনের গল্প জুড়ে দিলেন একা একাই। আমার তো কথা বলার ক্ষমতা নেই ইচ্ছে থাকলেও। হ্যাঁ-না ইশারা করতে করতেই ভার্সিটিতে এসে পৌঁছালাম।
কোনো দিকে না তাকিয়েই মাথা নত করে ক্লাসে চলে গেলাম। সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। স্যার প্রশ্ন করলেন, “নতুন?”
আমি মাথা ঝাঁকালাম। ক্লাস শেষে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে গেলাম। ক্যান্টিনে বসে আছি তখনই সেই বজ্রকণ্ঠের ডাক,
“এই মেয়ে এদিকে আসো।”
আবেগ ভাই তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দুই টেবিল সামনে বসে আমাকে দেখছেন। তাঁকে কেমন যেন ছন্নছাড়া দেখাচ্ছে। তাঁকে দেখেই ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যায়। তবে কি আজ ধরা পড়েই যাবো?
|
চলবে…