#জানালার_ওপারে
||৮ম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
🌺🥀পৃষ্ঠা- ৯
মাথার উপর সূর্য, খাই খাই রোদ। জীবনে প্রথম এমন পরিস্থিতিতে এসে মাথা ঘুরাচ্ছে আমার। আমি কীভাবে আটকাবো? পারবো এই লোকটার সাথে?
ফাঁকা পথ দিয়ে বাসায় যাচ্ছিলাম আমি। দেখতে পাই এক অচেনা মেয়ের হাত ধরে, তাকে বাজে ভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে মধ্যবয়স্ক মতি ব্যাপারী। একটু দূরে তার দোকানের দুটো ছেলেও দাঁড়িয়ে বিশ্রীভাবে হাসছে। দিকভ্রান্ত হয়ে টেক্সট করলাম আবেগ ভাইয়ের নাম্বারে। ১০৯ এও কল করে কোনোরকম তাদের আসতে বললাম।
নিজেকে শান্ত রেখে ক্যামেরা অন করে ভিডিও করতে করতে এগিয়ে গেলাম।
“হাত ছাড় মেয়েটার! তাড়াতাড়ি হাত ছাড় কু*র বাচ্চা।”
মতি ব্যাপারী প্রথমে আমাকে দেখে চমকে গেলেন। যদিও চিনতে পারলেন কি না জানি না। কিন্তু পরক্ষণেই মেয়েটার হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরে ব্যঙ্গার্থে হাসলেন।
“আমি হাত ছাড়মু মাইয়া? এখন তোরেও ধরমু। ভালোই এক মাছ ধরতে বড়শি ফেলসিলাম, আরেকটা নিজেই এসে ধরা দিসে। ঐ রনি, মনি ধর।”
“খবরদার এক পাও আগে বাড়াবি না। অলরেডি পুলিশে কল দিসি, আর এই মোবাইলটাতেও লাইভ তোদের অপকর্ম মানুষ দেখছে। আমার ক্ষতি করবি? আমিও দেখি তোদের এই বাপ কীভাবে বাঁচায়, তোদের বাপেরই তো এখন মরণদশা।”
বিচলিত হলো তিনজনই। ছেলে দুটো কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে উলটোপথ ধরে দৌড় দিল। মতি ব্যাপারী ভয়ে তটস্থ হয়ে মেয়েটার হাত ছেড়ে দেয়। কিশোরী মেয়েটি ছুটে এসে ঝাপটে ধরে আমায়। তার গা অনবরয় কাঁপছে। মেয়েটার বয়স কতোই হবে এগারো-বারো, এই মাঝ বয়সে এটুকু মেয়ের মধ্যেও কীভাবে কামনা খুঁজে পায় এসব পিশাচেরা?
মতি ব্যাপারী ভয়ে ভয়ে চলে যেতে নিবে তার পূর্বেই এসে পড়েন বাইকে চড়ে আবেগ ভাই। তাঁর গা ঘামে ঘামে জবজব করছে। আবেগ ভাই লোকটাকে শক্ত করে ধরে আমার সামনে এসে দাঁড়ান।
আমি মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলি,
“সোনা মেয়ে, কিচ্ছু হয়নি তো। All is well. তুমি তো স্ট্রং গার্ল। ঐ লোকটা তোমাকে কষ্ট দিয়েছে, তার শাস্তি দিবে না ওয়ান্ডার ওমেনের মতোন? মুখ তুলো এখন সোনা মা।”
ছোট্ট মেয়েটা মুখ তুলে অসহায় চোখে তাকায়। আবেগ ভাই বিস্ময় নিয়ে উচ্চারণ করেন,
“আর্শি মামনি, তুমি!”
আমি খাণিকটা বিচলিত হই, তবে কি আবেগ ভাই এই কন্যাকে চেনে? প্রশ্ন করতে তাঁর মুখ পানে তাকিয়ে আঁতকে উঠি। আবেগ ভাইয়ের চোখে, মুখে রাগ তীব্রতর, তাতে যেন অগ্নি জ্বলছে। এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করেন ঐ মানুষ নামক পশুটিকে। তাঁর এমন রুদ্ররূপ দেখে আমিও ভয়ে কুঁকড়ে যাই।
সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি এসে তাদের ছাড়ায়। অনেক কষ্ট থামাই আবেগ ভাইকে। জানতে পারি, আর্শি আবেগ ভাইয়ের বড়ো বোনের একমাত্র মেয়ে। মতি ব্যাপারীর এর মধ্যেই স্থান হয়েছে পুলিশের হেফাজতে। আর্শির হাতে ইচ্ছে মতো চড়-থাপ্পর দেওয়ালাম লোকটাকে।
“আর্শি মামনি, এমন ডিশুম ডিশুম করেই ভিলেইনদের শাস্তি দিতে হবে বুঝলে?” আর্শি হাসলো, তৃপ্তির এক হাসি।
আবেগ ভাই ও পুলিশ অফিসার একটু দূরে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছিলেন। আমি তাদের কাছে যেয়ে দাঁড়াই।
“আবেগ ভাই, এই ব্যাপারটাতে আর্শির নাম যেন ফ্ল্যাশ না হয়। এটা আর্শির জন্য কোনো লজ্জার কিছু না, বরং ভৎসনা এই জানোয়ারটার জন্য। কিন্তু এই সমাজ তো বারবার বাঁকা চোখে তাকাবে তার দিকে, এই ইনসিডেন্ট মনে করিয়ে দিবে, তার মন-মস্তিষ্কে জোর করে ঢুকিয়ে দিবে এই ভীতি। ওর জীবন এখনও শুরুই হয়নি, এখন বড়ো মানসিক যন্ত্রণা, চাপ তার উপর দিলে হীতে বিপরীত হতে পারে। আর এই ঘটনা জানলে আপুও ওকে স্বাভাবিক ভাবে চলতে দিতে ভয় পাবে।”
ইতঃস্তত ভঙ্গিমায় কথাগুলো বলে চোখ তুলি। আবেগ ভাই গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার পানে। দৃষ্টি নত হয়ে যায় সাথে সাথে। তিনি পুলিশ অফিসারকে কিছু একটা কানে কানে বললে তারা সায় জানিয়ে বিদায় হয়। জিপের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাই মতি ব্যাপারীর হিংস্র চাহনি আমার দিকে, ক্যানো যেন গা শিউরে উঠে আমার।
“বাইকে উঠো আর্শিকে নিয়ে।” সরল কণ্ঠ তাঁর।
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বাইকের ভীতি আছে আমার, তাছাড়া অসভ্য লোকটা প্রিয় হলেও তাঁর সাথে বাইকে চড়ার মতো কমফোর্টেবল নই।
“আমি একা একাই যাই। এত্ত ছোটো বাইকে আপনার সাথে… আমি যাই, হ্যাঁ?”
তিনি ভ্রু কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকেন, পরমুহূর্তেই ঠোঁট কামড়ে হেসে দেন। ইশ! কী এমন হাসির কথা বললাম! মুখ বাঁকিয়ে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম আমি। পাশে শূন্য রাস্তায় ধীর গতিতে বাইক চালিয়ে পাহারা দিয়ে যাচ্ছেন আমার বিশেষ পাহারাদার।
রাত বাড়লেই নিশা ফোন করে জানায়, আগামী পরশু তাদের বিয়ে। নিশার বাবা এবং হাসিব ভাইয়ের বাবা দুজন বেশ ধার্মিক মানুষ৷ তাঁরা সাধারণ ভাবেই বিয়েটা করাতে চান, যার খরচ বহন করবেন হাসিব ভাই। বিয়ের পরদিন বিকেলেই ইউএসএ চলে যাবে হাসিব ভাইয়ের সাথে।
দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে এক সপ্তাহ। আমার নিশুপাখিটা আমাকে সঙ্গীহারা করে সংসার করছে। প্রথমদিন ল্যান্ড কল করেছিল, আর কথা হয়নি। হয়তো ভিনদেশে সংসার সাজাতে, সামলাতেই বেগ পেতে হচ্ছে তার। ভার্সিটি থেকে একাই ফিরছি। সামনে একটা অনুষ্ঠান আছে, তাই সব সিনিয়ররা ব্যস্ত। বিশেষ করে আমার অসভ্য জনাবটার দর্শনই আজকাল পাওয়া যায় না।
কথাগুলো মস্তিষ্কে আওড়াতে আওড়াতে শূন্য পথে হাঁটছি তখনই একটি মিনি ট্রাক সর্বোচ্চ গতিতে এসে আঘাত করে আমায়। মুহূর্তেই পিচ ঢালা রাস্তায় লুটিয়ে পড়ি আমি। আধো আধো দৃষ্টিতে দেখতে পাই গাড়ি থেকে নেমে আসছে মতি ব্যাপারী, পশুটার চোখে-মুখে হিংস্র সেই হাসি লেপ্টে আছে।
জ্ঞান ফিরলে নিজেকে খুঁজে পাই শুভ্র এক পরিবেশে, ফিনাইলের তীব্র গন্ধ জুড়ে চারপাশে। আমি হাসপাতালের সাদা বিছানায় ছিলাম, আমার দু’হাতে নাম অজানা সূচ বিঁধে আছে। আমি কাউকে ডাকতে চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না। একটা ধ্বনি নির্গত হতে হতেই শ্বাসকষ্ট বোধ হলো।
নার্স কেবিনে ঢুকে আমাকে খেয়াল করে। একটু পর ডাক্তার সাহেব ও মা প্রবেশ করেন তার সাথে।
“মা রে, ভালো লাগছে তোর এখন?”
উত্তর দিতে পারছিলাম না, তাই আমি ইশারায় হ্যাঁ বললাম। ডাক্তার আমাকে দেখে মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“তিনি এখন সুস্থ আছেন সম্পূর্ণ রূপে। হাতের আর বা’পায়ের ফ্র্যাকচারটা খুব দ্রুতই সেরে যাবে। তবে ভোকাল কর্ডের বেশ ভালোই ক্ষতি হয়েছে। তবুও একদম সুস্থ হওয়ার আশা ছেড়ে দেওয়ার মতো বাজে অবস্থা না। থ্যারাপি নেওয়া উচিত হবে।”
আমার সারা দুনিয়া যেন ওলট-পালট হয়ে গেল। অবিরাম ধারায় অশ্রু ঝরতে শুরু করে। মা আমার হাতটা জড়িয়ে ধরে নিজেও নীরবে কেঁদে দেয়। দুই দিন পর রিলিজ দেওয়া হয় আমায়৷ সেদিনই বাড়িতে পুলিশও আসেন।
সড়ক দুর্ঘটনা হওয়ায় পুলিশ খুব দ্রুতই জড়িয়ে গিয়েছিল আমার বিষয়টার সাথে। বাসায় আসতে না আসতেই তারা আসে। জানান, মতি ব্যাপারীকে ধরেছেন তারা। সে না কি বলেছে, তার মান-সম্মান নষ্ট করার পরিণাম এটা। ঐদিন রাস্তাত ক্ষতি করতে পারেননি তাই আজ করলেন। আমি ভাবছিলাম, জানোয়ারটা ছাড়া পেল কী করে? মনে পড়লো, এ শহরে টাকার বিনিময়ে সম্ভব তো সবই।
ধীরে ধীরে মতি ব্যাপারীর এই বয়ান গোটা এলাকায় আগুনের মতো ছড়িয়ে যেতে লাগলো। মতি ব্যাপারীকে মেয়েজনিত কারণে জেলে পুরা হয়েছে তা সবাই জানতোই। একে দুইয়ে মিলে সবার ধারণা জন্মালো সেদিন আমার সাথে অসভ্যতা করেছিলেন তিনি। আর এক হাতে তালি না বাজার প্রবাদ তো সবার মস্তিষ্কেই সেভ হয়ে থাকে।
মানুষ নানারকম কথা শুনাতো। তাদের কথা শুনে নয়, বরং প্রতিবাদ না করতে পেরে বুক ভার হতে থাকে আমার। আজকাল মা-বাবাও আমায় নিয়ে বড্ড উদাসীন হয়েছে না কি বিরক্ত কে জানে? খোঁজ নিতে মনে থাকে না তাদের আমার। বরং, আমাকে দেখলেও মুখভঙ্গিতে বিরক্তির এক ছাপ।
তবে সবচেয়ে বেশি ভয় লাগে আবেগ ভাইকে নিয়ে। আমার প্রতিবন্ধকতা তার আর আমার ভালোবাসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কি না… কারণ এতো বড়ো একটা এক্সিডেন্ট হলো, কিন্তু একদিনও আবেগ ভাইকে দেখিনি আসতে, না কোনো দিন কল দিয়েছেন। আমিও দেইনি। লজ্জায় না অভিমানে জানা নেই।
লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে ঠিক করলাম কল দিবই। ফোন হাতে নিয়েছি সে মুহূর্তেই মায়ের গলা শুনতে পাই।
“আবেগের মা আবেগের প্রস্তাব এনেছে। আগে থেকে না কি পছন্দ করতো।”
মন আনন্দে নেচে উঠে আমার। বহুদিন পর মরুভূমিতে বৃষ্টি এলে যেমন সতেজ হয়ে পড়ে গোটা প্রকৃতি, তেমনই সতেজ বোধ হচ্ছে।
“হাফসাও জানে। তাঁরা কোনো বাড়াবাড়ি চান না, কয়েকদিনের মধ্যেই বাড়ি তুলতে চান হাফসাকে।”
আমি যেন স্তব্ধ হয়ে পড়ি। ভুল শুনেছি কিছু? এলোমেলো পায়ে বেডরুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়াই। না ভুল কিছু শুনিনি। বাবা, মা, ভাই সবাই খুব স্বাচ্ছন্দ্যে হাফসা ও আবেগ ভাইয়ের বিয়ের আলোচনা মেতে। হাফসাও সলজ্জে হাসছে।
আর নিতে পারলাম না। কী হচ্ছে এসব? বেডরুমে এসে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। হাফসা প্রবেশ করলো সেই ক্ষণে। অশ্রু মুছার সময়টুকুও পেলাম না।
“আপু, তুমি কাঁদছে ক্যানো?”
আমি নিজেকে আটকে রাখতে পারি না। তার মোবাইলে টেক্সট লিখে পাঠাই সবকিছু। হাফসা অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় তাকায়।
“আপু তুমি ভুল বুঝেছো। আবেগ ভাই কখনওই তোমায় ভালোবাসেনি। উনি তো আমার কথায় তোমার সাথে জাস্ট ভালো ব্যবহার করছিল আমার জন্য। যাতে তার একটা ভালো ইমেজ হয় তোমার মাইন্ডে। তুমি কি না এটাকে ভালোবাসা ভেব… আপু মাইন্ড কোরো না। তবে আমার দিকে তাকাও, আর তোমার দিকে তাকাও। না তোমার আছে আমার মতো শুভ্র গায়ের রং, না আছে বড়ো চোখ, তীক্ষ্ম নাক, স্মার্ট ভাবেও চলো না আমার মতো। এমন কী হিজাব অবধিও পড়ো একদম ক্ষ্যাত ভাবে। আর তুমি আশা করেছো আবেগ ভাইয়ের মতোন সুদর্শন, শিক্ষিত, বড়োলোক ছেলে তোমা… তুমি ভাবলেই কীভাবে? যাই হোক। তোমার ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আমাদের জন্য দোয়া কোরো আপু। বিয়েতে কারো মন খারাপ থাকুক আমি চাই না।”
আমি বরফের মূর্তির মতো হয়ে গেলাম যেন, যা কি না কিছুক্ষণ পরই একটু একটু করে মাটিতে মিশে যাবে। অনুভূতিহীন চোখগুলো বেয়ে অঝর ধারায় নোনাজল ঝরছে। আমি নিস্তব্ধ, এ যেন ঝড় আসার পূর্বাভাস। আমার হৃদয়ের জমিনে সত্যিই ঝড় উঠছে, বিশাল ঝড়। যা ধ্বংস করে দিচ্ছে সবকিছু।
সত্যিই কি আমার বোঝায় ভুল ছিল? শুধুমাত্র প্রেমিকার কথায় ভালো ইমেজ সাজাতে মানুষ কি এমন আচারণ করে? তবে সেই ঈর্ষা তাঁর চোখে আমায় নিয়ে? বারবার আগলে রাখাটাও বুঝি নাটকীয়তা ছিল?
আবেগ ভাই, কেন এমন করে ভাঙলেন আমায়? আমার যে বেঁচে থাকার শক্তিটুকু ভেঙে গুড়িয়ে দিলেন। এভাবে বেঁচে থাকা যায় না আবেগ ভাই, মরে যেতে ইচ্ছে করে। বিশ্বাস করেন এ শহর সাপ হয়ে ছোবল মারে আমায়, স্মৃতির বিষ ছড়িয়ে দেয় হৃদয়ে। মনে করিয়ে দেয় এ শহরটা ধোঁকাবাজ, বড্ড বেশি ধোঁকাবাজ। থাকার অযোগ্য। থাকছি না এ শহরে, চলে যাচ্ছি। বহু দূরে চলে যাচ্ছি।
বিদায়ের সওগাত হিসেবে দিয়ে যাচ্ছি, আপনার জানালার ওপারে আমার মনগড়া প্রেমকাব্যটা। একটু খানি সিক্ত যদি হন আমার অনুভূতির পরসে, তবুও সফল আমি হবো আমার মনগড়া কাব্যে আপনার প্রেয়সী হয়ে।
—
সমাপ্ত হলো অবশেষে। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রুজল পড়ে ছাপ ফেলে দিল গল্পের শেষ পাতায়। যত্ন করে জল মুছে নিলাম। ভোর হয়ে গিয়েছে লিখতে লিখতে। আজই আমার প্রিয় মানুষটির বিয়ে আমার ছোটোবোনের সাথে। তা সহন করার ক্ষমতা আমার নেই। এর পূর্বেই বিদায় জানাতে হবে এ শহরকে।
স্নান করে নিলাম। নীল পাড়ের সোনালী কাতান শাড়ি পরলাম, হাইহিল, সোনালী রঙের কাচের চুড়ি। গায়ে মন মাতানো সুগন্ধি মাখলাম। বিদায় যাত্রায় সুন্দর সাজ হওয়া তো অত্যাবশ্যক, তাই না? বড়ো হাত ব্যাগে ও ব্রিফকেসে গুছিয়ে নিলাম যাবতীয় জামা-কাপড়। নিজের একটি অংশ বা স্মৃতিও এ শহরে ফেলে রাখতে চাই না। মা-বাবাও তো পর হয়ে গিয়েছে।
ব্যাগ গোছানোর পর নিশা টেক্সট দিল বহুদিন পর। ভাবলাম শেষবার কথা বলে নিই।
“কী রে আবেগ ভাইয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার সুখে আমার ভুলে গেলি কুত্তি!
” কীসের বিয়ে? বিয়ে তো হাফসার ঠিক হয়েছে আবেগ ভাইয়ের সাথে।”
ওপাশে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হলো জানি না। তবে সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলো,
“কী বলছিস এসব আমাকে তো হাসিব বললেন তোদের বিয়… তুই তো আবেগ ভাইকে ভালোবাসিস।”
“উনি তো ভালোবাসেন না। সবটা বানোয়াট ছিল। উনার থেকেই জেনে নিস।”
ফোনের ডাটা বন্ধ করে আবেগ ভাইয়ের চাচাতো বোন বেলিকে টেক্সট করে বাসার নিচে আসতে অনুরোধ করলাম। তার হাতে সযত্নে ডায়েরি খানা দিয়ে তাকে কাগজে লিখে আবেদন করলাম,
“এটা প্লিজ আবেগ ভাইয়ের হাতেই দিবে। অন্যকারো কাছে যাতে না যায়, সে-ই যেন পায়। আর বলবা আমি দিয়েছি, পড়ে নিয়েই বিয়ের পীড়িতে বসতে।”
বেলিকে ছোটো বেলায় একবার স্কুলে র্যাগিংয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিলাম। সেই থেকে মেয়েটি আমি ভক্ত, তাই বিনা দ্বিধায় মেনে নিল। আমি আলতো হেসে বিদায় জানিয়ে ব্যাগ আর ব্রিফকেস অগ্রসর হলাম আমার যাত্রাপথে।
ফুটপাথ পেরিয়ে পৌঁছালাম ব্যস্ত সড়কটির দিকে। জানা-অজানা অসংখ্য গাড়ি উচ্চ গতিতে ছুটছে নিজ গন্তব্যে। আমারও নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে, এই বিষাক্ত শহর ত্যাগ করে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম।
যেতে যেতে বিড়বিড়ালাম,
“সেদিন তো বাঁচিয়ে ফেলেছিলেন আপনার মায়াবালিকাকে এই ব্যস্ত সড়কের শিকার হওয়া থেকে। আজ তো আপনার মায়াবালিকা নিজেই এসে ধরা দিচ্ছে এই শিকারীর নিকট। বাঁচার কি কোনো উপায় আছে আজ?”
|
চলবে…