#জলছবি
#পার্ট_২৫
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
হাতের রিপোর্ট গুলো নিয়ে ইশান হতবিহ্বল চোখে এদিক সেদিক তাকালো।
সকাল থেকে আদ্র ভীষণ রকম অসুস্থ হয়ে পড়েছে। না, সকাল থেকে বললে ভুল বলা হবে। মাঝরাত থেকেই বলা চলে। ইশান তখনও ঘুমায়নি। আগের দিনের করা ফটোগ্রাফি গুলোই দেখছিলো। এডিটিং করছিলো। রাত তখন দুটো কি তিনটে বাজে।
আদ্র উঠে বসলো। হাটুর উপর দু’হাতের ভরে মাথা রেখে বলল,
“দোস্ত জেগে আছিস?”
ইশান ভাবলো মজা করে প্রশ্নটা করেছে। কারণ তখনও রুমের লাইট অন করা। ইশান নিজের খাটে বসেই ছিলো। এপাশ থেকে ওপাশ স্পষ্টই সব কিছু দেখা যায়। তারপরও এই প্রশ্ন রসিকতার মতোই লাগে। ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে বলে,
“না, জেগে জেগে ঘুমাচ্ছি। হা হা হা!”
আদ্র ইশানের এই রসিকতার বিপরীতে বলল,
“দোস্ত? মাথাটা কেটে ফেলে দেই? কি হবে, কেটে ফেলে দিলে?”
মাঝরাতে আদ্রর বলা সেই অদ্ভুত কথাটা ইশান মোটেও মজা হিসেবে নিলো না। কারন ভয়ানক মাইগ্রেশনের ব্যাথা উঠলেই আদ্র এমন উদ্ভট কথা বলে।
ইশান কিছু প্রতিত্তুর করার আগের হরবর করে বমি করে দিল। মাঝরাতে হসপিটাল না নিয়ে সেবাযত্ন করে ঘন্টাখানিক এর জন্য ঘুম পারালেও সকাল হতে না হতেই সেই যন্ত্রনা!
পরপর দুবার বমি করল। ইশান সামনে থাকার পরও বলছিলো, সে ইশানকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। মাইগ্রেনের ব্যাথা হচ্ছে। সাথে চোখ ব্যাথা। চোখ লাল হয়ে যাচ্ছিলো।
ইশানের চিন্তা লাগে। আদ্রকে নিয়ে হসপিটাল আসে দ্রুত। যদিও আদ্র আসতে চায়নি প্রথমে। বারবার বলছি ও জানে, ওর কি সমস্যা হয়েছে। ডক্টর-ফক্টর দেখিয়ে লাভ নেই।
কিন্তু ইশান এক প্রকার জোর করেই নিয়ে এসেছে। ছেলেটা হঠাৎ এমন অসুস্থতার রেশ এতক্ষণ কেবল চিন্তা হিসেবে থাকলেও এবার সেই চিন্তাটাই বাস্তবে রূপ নিলো।
আদ্রকে কেবিনে রেখে ইশান-ই ডক্টরের সঙ্গে কথা বলেছে। ডক্টর যখন বলেছিলো, ‘এতো সেন্সেটিভ একটা বিষয় এতদিন হেলাখেলা করাটা মোটেও ঠিক হয়নি। এত ইর-রেসপন্সিবল আর কেয়ারলেস হলে রোগ তো চেপে বসবেই! এখন তেমন কিছুই করার নেই। যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে।’
তখন ইশানের নিজেকে সবচাইতে অপদার্থ বন্ধু মনে হচ্ছিলো। আদ্র তো কখনো নিজের প্রতি যত্নাশীল ছিল না। কিন্তু সে নিজে কি করে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের প্রতি এতোটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারলো?
এই অনুতাপ বোধ মস্তিষ্কে পিড়া তৈরি করে বসলো।
আদ্র’র কাছে যাওয়ার পর আদ্র বলল,
“দেখি রিপোর্টগুলো?”
ইশান দিলো। কিন্তু আদ্র খুব চেষ্টা করেও কিছুই পড়তে পারলো না। ইশান এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কেবল। এই কষ্ট, এই অপারগতা আদ্রকে যতটা না কষ্ট দিলো তার থেকে বেশি দিলো ইশানকে।
এক টানে আদ্রর থেকে রিপোর্ট গুলো ছিনিয়ে নিয়ে বলল,
“তোর পড়তে হবে না, দে।”
আদ্র হেসে উঠলো। কি অদ্ভুত সেই হাসি! চোখের চশমাটা খুলে চোখ দুটো দু আঙুলে পরিষ্কার করে বলে,
“চোখ আর মাথা দুটোই বোধহয় বরবাত হতে চলল। চলল বলছি কেন? হয়ে গিয়েছে অলরেডি, হা হা হা! ভালোই হয়েছে, বল?”
হাসি লেগে থাকে আদ্রর ঠোঁটে, গালে, চোখে। ইশান আর সইতে পারে না। এক পলক আদ্রর হাসি লেগে থাকা চোখে তাকায় তারপর বেরিয়ে আসে কেবিন থেকে।
হসপিটাল ভর্তি মানুষ, তবুও তার মনে হচ্ছে সে নির্জন কোনো মরুভূমিতে চলে এসেছে। গলা শুকিয়ে আসছে। পাশের বেঞ্চটাতে বসে হাত দিয়ে গলা মোছে, কপাল মোছে। পরপর দুবার কল করে নোলককে। ফোন বন্ধ। শেষে ফোন করে নবনীকে। নবনী ফোন ধরতেই বলে,
“ভাবী নোলক আছে? ওকে…ওকে একটু দেয়া যাবে? একটু দরকার ছিলো প্লিজ।”
ওপাশ থেকে ভেসে আসে,
“নোলক তো নেই। ও তো ভার্সিটিতে।”
ইশানের খুব অসহায় লাগে। অসহায় কন্ঠেই বলে,
“ও! রাখি তবে।”
বলে ফোন রেখে দেয়। কি করবে? কাকে বলবে? অমন করেই বসে থাকে অনির্দিষ্ট সময় অব্দি।
.
নোলক যখন বাসায় ফিরলো তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলে নামছে। বিধ্বস্ত ভগ্ন মন নিয়ে বাসায় প্রবেশ করতেই নবনী বলল হন্তদন্ত হয়ে কাছে এসে বলল,
“নোলক? তোর ফোন অফ কেন? সেই কখন থেকে কল দিচ্ছি।”
নোলক নবনীকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকতে বলল,
“চুরি হয়ে গিয়েছে। আপু একটু পানি দাও।”
নবনী প্রথমে পানি আনলো তারপর পানির গ্লাস নোলকের হাতে দিয়ে বলল,
“চুরি হয়ে গিয়েছে মানে? কিভাবে চুরি হলো?”
পরে বুঝলো নবনীর প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। নিজের ভুল শুধরে নিয়ে বোনকে শান্তনা দেয়ার মতো করে বলল,
“আচ্ছা, কোনো ব্যাপার না। এই তো দুদিন পর বেতন পাবো। তখন নাহয় নতুন একটা কিনে নিবো। ওকে? মন খারাপ করিস না।”
নোলক কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। নবনী বলে,
“বাদ দে তো। শোন? ইশান কল করেছিল আমায়। তোকেও কল করেছিল বোধহয়। পায়নি দেখে আমায় করলো। কথা বলবি? আমার ফোন দিব?”
“না। আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি এখন ঘুমাবো।”
বলেই নিজের রুমে আসে। আসলেই তার ঘুম পাচ্ছে। অতি মন খারাপ তার রাগে পরিনত হয়েছে। ভয়ানক রাগ জন্মালো ইশানের প্রতি, আরশির প্রতি এবং সব শেষে আদ্রর প্রতি।
বারবার মনে হতে লাগলো, তার আত্মসম্মানেও আঘাত করা হয়েছে। ছিনতাই হওয়ার কারনে এতক্ষণ মন খারাপ থাকলেও এই পর্যায়ে এসে মনে হলো, খুব ভালো হয়েছে সব হারিয়ে গিয়েছে! কাউকে লাগবে না, কিছু লাগবে না।
এটা রাগ নাকি, অভিমান? ভালোবাসার অভিমান?
.
নোলককে ওর বাসায় দিয়ে এসেই নিজের বাসায় ফিরে ফয়সাল। জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরা, ঝলসে যাওয়া রংহীন দুই রুমের বাড়িটাতেই মা-ছেলের বসবাস। বাপের রেখে যাওয়া ওই আধ ফাটল বাড়ি আর এই একটুখানি জমিতেই কাটিয়ে দিলেন এক মহীয়সী নারীর সংসার জীবন, আর এক প্রখর আত্মসম্মান সম্পূর্ণ ছেলের বেশ অনেক খানি জীবন।
ফয়সাল বাড়ির সামনের কল থেকে মুখ ধুতে ধুতেই হাঁক ছাড়ে,
“আম্মা? ও আম্মা? খাইতে দাও। ক্ষুধা লাগছে।”
ভেতর থেকে আওয়াজ আসে,
“বাপ আইছিস? আজ এত দেরি করলি যে?”
বলতে বলতেই সে ঘড়ে দরজায় এসে দাঁড়ায়। ফয়সাল তার অর্ধেক গোটানো হাতাটায় মুখ মুছতে মুছতে বলে,
“একটু ঝামেলা হইছিলো আম্মা। তুমি খাইছো?”
কোহিনূর বেগম পৃথীবির অন্যতম সুন্দর হাসিটা হেসে বলেন,
“তোরে রাইখা আমি খাইছি কোনোদিন?”
ফয়সাল কাছে এগিয়ে আসে। মাকে কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“ফালতু অভ্যাস! খুব রাগ লাগে আম্মা! কোনো একদিন যদি না ফিরি? খাইবা না তুমি? না খাইয়া থাকবা? এইসব কেমন অভ্যাস আম্মা? চারটা বাজে এখনও খাও নাই!”
তিনি অপরাধী ভঙ্গিতে হেসে বলেন,
“সে আমার অভ্যাস আছে। একলা একলা গলা দিয়া খাওন নামে না বাপ। রাগ করিস কেন?”
ফয়সাল তখনও মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
“এটাই শেষবার আম্মা। আর কখনো এমন করবা না। আমার কত কাম থাকতে পারে না? দেরি হইতে পারে না? তাছাড়া আমি তো ক্যাম্পাসে খাই। পেট ভরাই থাকে। আমার চিন্তা করো ক্যা? বয়স হইতাছে না তোমার? অনিয়ম করলে চলবো আম্মা? আল্লাহ বেরাজ হয়, রুহুরে কষ্ট দিলে। সাথে আমিও হই। বুঝ না ক্যান?”
বলেই জড়িয়ে ধরে। কপালে চুমু দিয়ে বলে,
“তোমারে আমি কত ভালোবাসি তুমি জানো না? তুমি আমার কলিজা আম্মা, আমার জান, আমার অন্তর, আমার পরান। এমন কইরো না তো। দুঃখ লাগে। দেখ তো, মুখটা কেমন শুকাইয়া ফেলছো?”
বলেই আরেকটা চুমু দিল।
কোহিনূর বেগমের চোখ ভিজে যায়। ছেলে তারে সত্যি ভীষণ ভালোবাসে সে কথা সে অস্বীকার করতে পারবে না। ছেলে ছাড়া তাঁর, সে ছাড়া ছেলের যে কেউ নেই!
দুজন ঘরে ঢুকবে তখনই ফয়সালের ফোন বেজে উঠে। ওপাশ থেকে কে কি বলে, স্পষ্ট বুঝা যায় না। ফয়সাল একটা গালি দিয়ে বলে,
“তুই ওইখানেই থাক। আমি আইতাছি। এত বড় সাহস ওর। দুই মিনিটে আসতেছি, থাক তুই। আজ ওর একদিন কি আমার একদিন। জাস্ট গাইরা ফালামু। তুই বাইক নিয়া মোরে থাক আমি এক মিনিটে আসতেছি।”
বলেই হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে আসতে লাগলে কোহিনূর বেগম বিচলিত হয়ে বলে,
“কি হইছে বাপ? কই যাস? আবার কোন গ্যাঞ্জামে জড়াতে চাইছিস? দেখ, কোনো গ্যাঞ্জামে জড়াবি না কইলাম। শোন আমার কথা…!”
ফয়সাল ততক্ষণে কিছুদূর এগিয়ে আসে। না দাঁড়িয়েই বলে,
“চিন্তা করো না আম্মা। গ্যাঞ্জামের দফারফা করতেই যাইতেছি। তুমি খাইয়া নেও, আমি আসতেছি। আইসা যদি শুনি এখনও খাও নাই, তবে তোমার সাথে আমি আর কথা বলবো না আম্মা। তুমি আমার একটা কথাও শোনো না।”
“তুই শুনিস?”
কোহিনূর বেগমের কথা শুনতে পেলো কি পেলনা কে জানে? অনেকদূর এগিয়ে যায় সে। কোহিনূর বেগম আতংকিত হয়ে আকাশের দিকে তাকায়। জড়ানো কন্ঠে বলে,
“আবার কোন ঝামেলা করতে চাইতাছে পোলাডা! আল্লাহ তুমি রক্ষা করো। বাপের মতো এই উগ্র মেজাজটাই না আবার ওর কাল হয়ে দাঁড়ায়! এত চিন্তা আমার আর ভাল্লাগে না। পোলাডা ক্যান ওর বাপের মতো হইলো?”
সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে নবনী এসে নোলককে ব্যস্তগতিতে জাগিয়ে বলে,
“এই? এই নোলক? ফয়সাল…ফয়সাল হসপিটালে। এই উঠ!”
নোলকের ঘুম হালকা হয়ে আসার ফলে সে প্রথমবারেই শুনতে পায়। হুড়মুড় করে উঠে বসে বলে,
“কি? মা…নে? ফাইজলামি করছিস আপু? ফাইজলামি একদমই ভালো লাগছে না এখন। যা তো।”
নবনী হাতের ফোনের দিকে নির্দেশ করে বলে,
“নিষাদ…নিষাদ ফোন করলো। বোন? ও কি প্রাঙ্ক করছে কিনা জিজ্ঞেস করে শিওর হয়ে নে তো!”
এতটুকু বলে নবনী নোলকের দিকে ভীত চোখে চায়। নোলক ধরেই নিয়েছে প্রাঙ্ক। বিকেলে দিয়ে গেলো ওকে আর সন্ধ্যায় হসপিটাল মানে?
নোলক নবনীর থেকে ফোন নিয়ে নিষাদকে ফোন লাগায়। নিষাদ ফোন তুলতে কান্নার কন্ঠ শোনা যায়। নোলক কিছু বলার সুযোগই পায় না। নিষাদ বলে,
“নোলক…. নোলক! আমাদের ফয়সাল….!”
(চলবে)