#জলছবি
#৭ম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
ব্যস্তগতিতে একটু সামনে আগাতেই কারো সঙ্গে ধাক্কা লাগতে লাগে। নোলক নিজেকে সামলে নেয়, অন্য মানুষটাও সামলে নেয় নিজেকে। যার ফলে ধাক্কাটা আর লাগেনি। ইশান নিজের আঁকাবাঁকা দাঁতের সুন্দর হাসিটা দিয়ে বলে,
“হেই, অগ্নিশর্মা! এমন ব্যস্ত গতিতে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”
ইশানের কথায় মন নেই নোলকের। হাত নেড়ে বলে,
“আপনার সঙ্গে পড়ে কথা বলবো।”
বলেই ইশানকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ইশান মুখে হাসি রেখেই ঠোঁট উল্টে বলে,
“বাব্বাহ! কত কাজ তার!”
.
বাড়ির পেছন দিকে ভীষণ নিরিবিলি একটা বৈঠকখানা আছে। সম্ভবত এই জায়গাটা গল্পগুজবের জন্যই বানানো হয়েছে। সকালে কিংবা বিকেলে যে কেউ এখানে আসলে মন ভালো হয়ে যাবে এক নিমিষে। এই রাতেও কিন্তু খারাপ লাগছে না। বরং খুবই সতেজ একটা পরিবেশ। গোল আকৃতির উঁচু ফ্লোরটায় উঠতে চার-পাঁচটা সিড়ি বাইতে হয়। চারপাশ নকশা করা গোল করে স্টিলের রেলিং দেয়া। বিয়ে উপলক্ষে এই জায়গাটাও অসম্ভব সুন্দর করে সাজিয়েছে। তবে মানুষজন কেউ নেই এখন এখানে। অনেকটা বিষন্ন পরিবেশ। লুবনার বিষন্ন মনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্যই যেন পরিবেশটার এই নিরবতা!
অযথাই চোখ ভেসে আসছে মেয়েটা। অতি আবেগী মেয়েটার অল্পতেই চোখে ভিজে টইটুম্বুর হয়ে উঠে। এক হাতে রেলিং ধরে রেখে অন্যহাতের তিন আঙুলে অশ্রুকণা দূর করার বৃথা চেষ্ঠা। মন জুড়ে ঠিকরে পড়া অভিমান।
“খুব বেশি কি রেগে আছিস আমার উপর?”
আহ্লাদমাখা প্রশ্নটা করতে করতেই লুবনার ঠিক পাশে এসে দাঁড়ায় ফয়সাল। লুবনা চমকে উঠে। দু’হাতে চটপট দু’চোখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার মেকি ভান করে। তবে এটা সত্যি যে, বন্ধুমহলের সবচাইতে প্রাণবন্ত বন্ধুটার কাছ থেকে এমন কিছু মোটেও আশা করেনি সে। ফয়সালের আহ্লাদী প্রশ্নটার জবাব দেয় না। বরং অন্যদিকে ফিরে তাকায়। ‘এই ছেলের সাথে আর কোনো কথাই বলবে না’ বলে পণ করেছে।
ফয়সাল রেলিং এর উপর থাকা লুবনার চুড়ি পড়া হাতটার উপর হাত রাখে।
এই একটুখানি ছোঁয়াতেও কেমন যেন অসস্তিতে ঝাপটে ধরে শরীর, মন! অথচ এর আগে কতবার হাত ধরেছে। এমন তো লাগেনি কখনো! ফয়সালের কন্ঠে অনুতাপ। সেই অনুতাপের সুরেই বলে,
“এই মেয়ে? কথা বলবি না আমার সাথে?”
লুবনা তবুও তাকায় না। সে যে পণ করেছে! ফয়সাল নত শিকার করার মতো করে বলে,
“বিশ্বাস কর, বাজে কোনো ট্যান্ডেন্সি থেকে অমন করিনি। আসলে অমন কেন করেছিলাম তাও বুঝতে পারছি না। বাট ভুল করেছি। প্লিজ, মাফ করে দে। এই দেখ, কানে ধরেছি। অমন আর জিন্দেগিতেও করতাম না। দেখ, দেখ!”
প্রাণপণ চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হলো না। এই পর্যায়ে এসে না তাকিয়ে থাকতে পারলো না। লুবনা। সে ফিরলো। অনুতাপময় ফয়সালকে দেখে অভিমানের কৌটো অর্ধেক ফাঁকা হয়ে গেলো। কি আশ্চর্য! কৃষ্ণ বর্ণের ছেলেটার আগাগোড়া পাগলামোতে ভরপুর। ফয়সাল খানিকটা নিচু স্বরে বললো,
“আর কতক্ষণ কানে ধরে দাঁড়ায় থাকমু। কিছু তো বল? কেউ যদি দেখে ফেলে এই দামড়া বয়সে এসে এমন কানে ধরে দাঁড়ায় আছি, মান-ইজ্জত কই গিয়ে দাঁড়াবে ভাবতে পারছিস? প্লিজ জানেমন, নিস্তার দে।”
প্রচন্ড মন খারাপের মাঝেও ফয়সালের এমন কথায় না হেসে পারলো না লুবনা। মুচকি হেসে অন্যদিকে মুখ ঘুরায়। আর তা দেখে ফয়সালও খুশিতে গদগদ। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে অস্ফুট স্বরে বলে,”ই-য়েস, ইয়েস!”
লুবনার কাছে অনুমতি চাওয়ার মতো করে বলে,
“ক্যান আই হাগ ইউ, দোস্ত?”
লুবনা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ফয়সাল থতমত খাওয়ার মতো করে বলে,
“এজ অ্যা ফ্রেন্ড!”
লুবনা মৃদু হাসতেই আলতো হাতে জড়িয়ে নেয় ফয়সাল। কৃতজ্ঞ হওয়ার মতো করে বলে,
“থ্যাংক ইউ দোস্ত। লাভ ইউ!”
নিজের বাহুডোর থেকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
“আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম, ইমোশনের ডিব্বাটা এইটুকুর জন্য আবার সুইসাইড-টুইসাইড না করে বসে!”
বলেই ‘হা হা হা’ করে হেসে উঠে। লুবনার রাগ-অভিমান কই যে পালিয়ে যায়! ফয়সালের বাহুতে বেশ জোরেই একটা থাপ্পড় মেরে বলে,
“যাহ, অসভ্য! মোটেও আমি অমন কিছু করতাম না।”
ফয়সাল হাসে, হাসে লুবনাও। ফয়সাল স্বস্তির নিশ্বাঃস ছেড়ে বলে,
“তো ম্যাডাম? ভেতরে চলুন। আপনাকে খুঁজে খুঁজে সবাই পাগল হয়ে যাচ্ছে।”
কথা শেষেই ফয়সাল হাঁটা আরম্ভ করলে, লুবনাও পা মিলায়। হাঁটার আড়ালেই প্রথমবারের মতো এই কৃষ্ণ-মানবটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। এর আগে কাউকে নিয়ে এমন অনুভূতি জন্মায়নি তো! এমন করে কাউওকে দেখতেও ইচ্ছে হয়নি। আজ কেন হলো?
.
রাত একটা পেরিয়ে গিয়েছে। তবুও কারো ঘুমের কোনো নাম নেই। বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পরও বর-কনেরও নিস্তার মেলেনি। চঞ্চল প্রাণগুলো ওদের নিয়ে আসর বসিয়েছে। শ্রীতমা একবার ফিসফিয়ে তার প্রণয় পুরুষকে বলে,”আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”
শায়ন শ্রীতমার কাছে ঝুকে শ্রীতমার মতোই ফিসফিয়ে বলে,
“কিন্তু আমার খুব……”
কথা শেষ না করাতে শ্রীতমা জিজ্ঞেস করে,
“কী? পুরোটা বললেন না যে?”
শায়ন মুচকি হেসে বলে,
“বলতাম, যদি তুমি করে বলতা।”
শ্রীতমা সবার আড়ালেই মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“থাক, বলা লাগবে না। তুমি-টুমি বলতে পারবো না। ওসব আমার দ্বারা হবে না।”
শায়ন রহস্যের সহিত বলে,
“না পারলে আর কি করার? তবে খুবই ইন্টারেস্টিং কথা কিন্তু।”
শ্রীতমার আগ্রহ বেড়ে যার তরতর করে। অনুরোধ করার মতো করে বলে,
“বলেন না প্লিজ?”
সদ্য শেইভ করা ফর্সা গালে হাত বুলাতে বুলাতে শায়ন বলে,
“না থাক। পরে দেখা যাবে লজ্জায় বউ আমার, লাল টুকটুকে বউ হয়ে গিয়েছে! তারপর দেখা যাবে চ্যাংড়া ছেলেপুলে এমন মিষ্টি মুখ দেখে ক্রাশ ট্রাশ খেয়ে কাইত হয়ে পরে আছে। আমি আবার সচেতন জামাই, এমন ভুল করা যাবে না।”
বলেই এক গাল হাসে। হাসি মুখেই সোজা হয়ে বসে। শ্রীতমাও হাসে, কি যে সুন্দর সেই হাসি।
একটু দূর থেকে নিষাদ বলে,
“ওখানে কিসের ফুসুরফাসুর চলছে?”
শ্রীতমা ধরা পড়ে যাওয়ার মতো করে বলে,
“কই, কিছু না তো!”
সবাই হেসে উঠে। সৃজন বলে,
“বুঝি মামা, বুঝি। যতই ফুসুরফাসুর করো, কোনো লাভ নাই।”
শায়ন করুন মুখ করে বলে,
“অসুবিধে নাই। প্রকৃতি প্রতিশোধ নিবে একদিন। কঠিন বরদোয়া দিলাম!”
ইশান সম্মতি জানানোর মতো করে বলে,
“কারেক্ট ব্রো। আই এগ্রি উইথ ইউ। প্রকৃতি প্রতিশোধ নিবে।”
তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“এই বাচ্চারা? এবার ওদের ছেড়ে দাও। বর-কনের বরদোয়া কিন্তু কঠিন বরদোয়া!”
ফয়সাল অসন্তুষ্টি হওয়ার মতো করে বলে,
“ভাই? সময় বুঝে এমনে পল্টি নিলেন? আপনি তো মিয়া সুবিধার মানুষ না।”
বাই রুম কাঁপিয়ে সমস্বরে হেসে উঠে। হাসে ইশানও। এই সাঙ্গপাঙ্গ অস্থির ছেলেপুলেদের সঙ্গ তার ভালো লাগছে।
সবার মাঝ থেকে নোলক উঠে আসে।
হঠাৎ-ই তার ভীষণ খারাপ লাগতে আরম্ভ করে। শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। গা গরম লাগছে। মনে হচ্ছে জ্বর আসছে। ভীরভাট্টা কিছুই ভালো লাগছে না তার। হট্টগোল থেকে বেড়িয়ে এলো। গলা শুকিয়ে আসায় দুই গ্লাস পানি খেলো। মনে হলো খোলা আকাশের নিচে কিছুক্ষণ থাকতে পারলে বোধহয় ভালো লাগতো। অন্তত্য প্রাণ খুলে সতেজ নিশ্বাঃস তো নিতে পারবে। যা মনে আসে তাই করে মেয়েটা। শরীর খারাপের চাপায় পড়ে ভুতে ভয় উবে গেলো কিংবা ভুলে গেলো। এক পা দু’পা করে সিড়ি ভেঙে এগিয়ে গেলো ছাদের দিকে। ছাদের দরজার সামনে আসতেই ভেসে এলো স্নিগ্ধ এক কন্ঠস্বর। ওই জ্বর শরীরেই দাঁড়িয়ে থেকে ভাসা ভাসা শুনলো,
“আমায় নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না। আমি খুব ভালোই থাকি সবসময়। আগে যখন ভাবেন নি। দয়া করে এখনও ভাববেন না আমায় নিয়ে! বয়স হচ্ছে, নিজের শরীর নিয়ে ভাবুন, প্লিজ। লুকিয়ে চুরিয়ে আমার খোঁজ নিতে হবে না।”
পেছন দিক দেখেও একটুও কষ্ট হয়নি আদ্রকে চিনতে নোলকের। আদ্র ফোন কেটে দিতেই ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ঠিক আদ্রর পাশেই দাঁড়ায় নোলক।
অতি অল্পেই চমকে যাওয়া কিংবা বিচলিত হওয়া আদ্র’র ধাতে নেই। শান্ত স্বভাবের বুদ্ধিমান ভাবুক ছেলে হওয়ার সুবাদেই হয়তো এই অসামান্য গুনটা খুব নিপুণভাবে আছে ওর মাঝে। চশমা ঠিক করতে করতে তাকায় নোলকের দিকে। আড়ষ্ট হয়ে থাকা শান্ত নোলককে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে কিছু বলার আগেই পুনরায় ফোন বেজে উঠে। একবার কাটে, সঙ্গে সঙ্গে আবার বেজে উঠে। আদ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চায় হাতের ফোনটার দিকে। অনিচ্ছায় কিংবা ইচ্ছায় চোখ চলে যায় নোলকেরও। ছোট্ট একটা শব্দ ভেসে উঠে স্ক্রিনে। “মা”! খারাপ শরীরটা আরো খানিক খারাপ লেগে উঠে নোলকের। ফাঁকা ফাঁকা লাগে মন।
ফোন কেটে দেয় আদ্র। তার মন জুড়ে প্রগাঢ় বিতৃষ্ণা। রাগ, অভিমান, কষ্ট সম্মিলিত অদ্ভুত এক অনুভূতি। আচ্ছা? এই অনুভূতির কি নাম দেয়া যায়?
নোলকের জড়ানো কন্ঠ। থেমে থেমে বলে,
“মায়েরা বুঝি এমনই হয়, তাই না? একটু দূরে কোথাও গেলে অস্থির হয়ে উঠে। শুনেছি আমার মা-ও এমন ছিলেন!”
আদ্র’র কপাল কুঁচকে আসে। মেয়েটার কথাবার্তা, আচরণ কেমন যেন একটা ঠেকে তার কাছে। মাথায় ঘুরপাক খায় ‘ছিলেন’! প্রশ্নটা জিজ্ঞেস ‘করবে-কি-করবে না’ দ্বিধা-দন্দে ভোগে। এই ভাবনা চিন্তার মাঝেই নোলকের তুমুল আগ্রহী প্রশ্ন ভেসে আসে,
“মা-বাবাদের আদর অনেক মিষ্টি হয়, তাই না?”
আদ্র লক্ষ্য করে নোলকের নরম চাহনি হঠাৎ-ই বিরক্ততে রূপ নেয়। মৃদু বাতাসে উড়ে আসা চুলগুলো কুঁচকানো ভ্রু ছুঁয়ে যায়। কিন্তু চুল সরানো নিয়ে নেই কোনো পায়তারা মেয়েটার। অসন্তুষ্টির দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলে,
“আপনি তো খুব খারাপ মানুষ। একটু খারাপ না, অনেক বেশি খারাপ। তা নয়তো মায়েদের ফোন কেউ কেটে দেয়?”
মেয়েটার এই এলোমেলো চাহনি, অগোছালো কথাগুলো কোথায় গিয়ে যেন স্পর্শ করে আদ্র’র। নোলকের ঠিক চোখের দিকে দৃষ্টি ফেলে বলে,
“এটা যদি খুব খারাপ কিছু হয়ে থাকে এতে আমার কিছুই করার নেই। যদি বলি, কিছু কিছু সময় আরো বেশি খারাপ মানুষ হতে ইচ্ছে করে? কিন্তু জানেন? ইচ্ছে থাকা সত্বেও এই ফোন কেটে দেয়ার চাইতে আর বেশি কিছু করতে পারি না। কিসের যেন পিছুটান।”
নোলক বাকা হাসে। তার মনে আদ্র’র জন্য একরাশ তাচ্ছিল্যের হাসি জমা হলো। হয়তো ছেলেটার এই কথাগুলো সঠিক কারন জানা নেই বলেই! নোলকে কি ভিষন কষ্ট লেগে উঠে! গলা ধরে আসে। সেই ভেঙে আসা কন্ঠেই বলে,
“আমার মতো মা-বাবাহীন এতিম তো আপনি নন, তাই এমন বলতে পারেন। কারন মা-বাবা না থাকার কষ্টটা আপনার জানা নেই। যদি জানতেন, তবে কখনোই এমন বলতে পারতেন না।”
আদ্র আকস্মিক ধাক্কার মতো খেলো। এমন চাঞ্চলতার পেছনেও কারো মনে যে এমন চাপা কষ্ট থাকতে পারে, তা যেন ধারনাতেই ছিলো না তার। নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে তখনই নোলক বাঁধা দিয়ে বলল,
“কিছু বলবেন না প্লিজ। আমি জানি, আপনি কি বলবেন। ‘মা-বাবা নেই’ শোনার পর মানুষের করুনা ভরা কথাগুলো ঠিক হজম করতে পারি না। মনেহয়, মনেহয় কেউ যেন গলা টিপে ধরেছে! করুণা করবেন না।”……..(চলবে)