জলছবি পর্ব-০৬

0
1275

#জলছবি
#৬ষ্ঠ_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
বিয়ের ঝাকঝমক সাজের জন্য বাড়িটা ঝলমল করছে। লাল-নীল বাতিতে মুখরিত চারপাশ। গান বাজছে জোর আওয়াজে। দূর থেকে কারো কথাই বোঝা যাবে না। সবাই ব্যস্ত তার নিজ নিজ কাজে। কেউ ছুটাছুটি করছে। কেউ বর-কনের ছবি তুলছে। কেউ-বা আবার নিজের সাজগোজ সামলাতেইই হাঁপিয়ে উঠছে। বারবার আয়না দেখছে, সাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না তো?

ইচ্ছের বিরুদ্ধে অনেকটা জোর করেই লুবনাকে ছাদে নিয়ে এলো ফয়সাল। ‘চুড়ি হাতে ব্যথা পাচ্ছে’ বলে আর্তনাদ করলেও হাত ছাড়েনি একবারও। ছাদ ঘরের দেয়ালটার সাথে লুবনাকে ঠেসে ধরে তবেই শান্ত হলো ছেলেটা। বিরক্ত লুবনা জোরে শ্বাস নিয়ে বিরক্তির সহিত বলে,
“পাগল হলি নাকি? এভাবে টেনে নিয়ে এলি ক্যান? উফফ! ব্যথা লাগছে হাতে।”
ছন্নছাড়া ফয়সাল গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল,
“এইটুকু ব্যথায় কিছু হয় না।”
লুবনা নিজের হাত ডলতে ডলতে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“এখানে এনেছিস কী জন্য?”
ফয়সাল লুবনার একটু কাছে ঝুঁকে বলে,
“তোরে কামড় দিবো, তাই!”
বিস্মিত লুবনা ঝুঁকে থাকা ফয়সালের মাথা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে, কপট রাগ নিয়ে বলে,
“অসভ্য, ফালতু! খাচ্চোর কোথাকার জানি। সর এইখান থেকে। যতসব অসভ্যদের মতো কথাবার্তা!”
ফয়সাল হো হো করে হেসে উঠলো। যেন খুব মজার কথা শুনেছে সে। তবে লুবনার থেকে এমন রিয়েকশন আসবে জেনেই সে কথাটা বলেছে। নিজের দু’হাত দিয়ে লুবনার দু’হাত চেপে ধরে রেখে বলে,
“এত সাজছিস ক্যান? পুরা পেত্নীর মতো লাগছে! জানিস? আমাদের বাসার সামনের চাউলতা গাছের মগডালে একটা পেত্নীকে বসে বসে পা দুলাতে দেখেছিলাম। ঠিক অমন লাগছে তোকে। কি বিচ্ছিরি, কি বিচ্ছিরি!”
লুবনার ভয়ানক খারাপ লাগলো। কাউকে অসুন্দর লাগলেই কি এমন করে বলতে হবে? এই ছেলেটা সবসময় ওর সাথে এমন করে। চোখ ফেটে কান্না পায় লুবনার। গলা ধরে আসে। কাজল রাঙা টলমল চোখ নিয়ে তাকায় ফয়সালের দিকে। ঠিক চোখের দিকে। লুবনা ছলছল চোখের দিকে চেয়ে ফয়সালও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ওই মায়ামায়া মুখখানায় আটকে যায়। বিষয়টা যে লুবনা এত সিরিয়াসলি নিয়ে নিবে তা বুঝতে পারেনি। লুবনা মাথা নিচু করে ফেলে। কপালের টিকলিটা চকচক করে উঠে। গোলগাল মুখটায় অভিমানে যেন ভরে উঠলো। গাল দুটো লাল আভা ছরালো। মানুষ লজ্জা পেলে গাল লাল হয় আর এই মেয়ে কান্না করলে গাল লাল হয়। কি আশ্চর্য! সারাক্ষণ পিছে লেগে থাকা মেয়েটার প্রতি অদ্ভুত অনুভূতি হয় ছেলেটার। অতি আদরে মেয়েটার নরম গালটাতে একটা হাত রেখে বলে,
“সব কিছু এতো সিরিয়াসলি নিস ক্যান গাধী? অল্পতেই বাচ্চা মেয়েদের মতো কেঁদেকেটে পৃথীবি ভাসিয়ে ফেলে। পাগলী একটা!”
বলেই কপালের টিকলিটা সরিয়ে সেখানে ঠোঁট ছোঁয়ায়। একটু থেমে বলে,
“এমন পরীর মতো সেজেগুজে আমার সামনে ঘুরে বেড়াবি না, খবরদার। অস্বস্তি লাগে আমার।”
বলেই মূহুর্তের মাঝেই উধাও হয়ে যায়। হতভম্ব লুবনা কিছু বুঝে উঠার আগেই যেন সবটা ঘটে গেলো। বুক ধুকপুক করছে। কপালে হাত রেখে কিছু ভাবার আগেই ডাক পড়লো,
“এই লুবু? তুই এখানে কি করিস?”
শ্রেয়ার কন্ঠ। লুবনা অস্ফুট স্বরে কেবল বলে,
“হু?”
শ্রেয়া লুবনার বাহুতে হাত রেখে বলে,
“কী হু? একা একা কী করছিস এখানে?”
লুবনার মোহ কাটলো না পুরোপুরি তবুও বলল,
“কিছু না। চ..চল নিচে।”
লুবনার একবার মনে হলো সে বোধহয় স্বপ্ন দেখেছে। নয়তো আকস্মিক এমন কান্ড ক্যান করবে ছেলেটা? ও তো এমন নয়!
.
নূপুরটা সম্ভবত রুপার। সুন্দর নকশা করা নূপুরটার শেষপ্রান্তে তিনটে ঝুমকো। আদ্র নিজের চোখের সামনে ধরে রেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে নূপুরটা। মৃদু নাড়তেই ঝুনঝুন করে উঠলো। তার অনুমান যদি ঠিক হয়ে থাকে তবে নূপুরটা নোলকের। যেভাবে সে ছোটাছুটি করছে এতে করে এই নূপুর পায়ে আটকে থাকা দুষ্কর!
আদ্র হাতের মুঠোয় বন্ধি করে নেয় নূপুরটা। অন্য হাতে চোখের চশমাটা ঠিক করে নিয়ে নোলকের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। বাড়ির এ-মাথা থেকে ও-মাথা একাই দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে মেয়েটা। কারো কিছু লাগবে কিনা সেদিকেও তদারকি করছে। যেন বাড়িটাই তার!
আদ্র ভাবনার মাঝেই ব্যস্ত গতিতে ছুটে এলো ইশান। ক্যামেরাটা আদ্র’র হাতে দিয়ে বলল,
“দোস্ত, একটু ধরতো।”
আদ্র বিনাবাক্যে বন্ধু অনুরোধ মেনে নেয়। আদ্র’র হাতে ক্যামেরাটা দিয়েই সে যেন কোথায় উধাও হয়ে যায়। আদ্র পাল্টে পাল্টে ইশানের তোলা ছবিগুলো দেখে। বেশিরভাগ ছবিতেই নোলকের মুখ জ্বলজ্বল করছে। তার হাসি, তার রাগ, তার বিরক্তির প্রতিচ্ছবিই! মেয়েটা অনেকটা মুক্ত পাখির মতো। শাসন-বারন মানে না। ছবিগুলো দেখতে দেখতেই একটা ছবিতে চোখ আটকে গেলো আদ্র’র। কোনো এক চঞ্চলাবতীর নিচ-অর্ধেক অংশ। ভারী লেহেঙ্গার শেষে উন্মুক্ত দু’খানা পা। আদ্র’র কপাল কুঁচকে আসে। এক পায়ে নূপুর অন্য পা খালি। নিজের মুঠোয় আবদ্ধ হয়ে থাকা নূপুরটার সাথে ক্যামেরা বন্দি নূপুরটা মিলায়।
এরই মাঝে ইশান ফিরে আসে। আদ্র হাত বন্ধ করে ফেলে। ইশানকে ছবিটা দেখিয়ে বলে,
“এটা কে?”
ইশান মুগ্ধ হাসে। দূরের নোলকের দিকে তাকিয়ে বলে,
“মিস.অগ্নিশর্মার।”
আদ্র ছোট্ট করে বলে,
“ও!”
ইশান আনমনা হয়ে বলে,
“মেয়েটার দূরন্তপনার মায়ায় পড়ে যাচ্ছি দোস্ত!”
“আর আমি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি।”
কথাটা বলতে গিয়ে কোথায় যেন বাধা অনুভব করে আদ্র! কিসের বাধা তা জানা নেই। কপাল কুঞ্চিত হয়ে আসে। মুঠোয় রাখা নূপুর সহিত হাতখানা পকেটে ঢুকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অহেতুক এই দীর্ঘশ্বাসের অর্থদ্বার করতে গিয়েও কোনো কারন খুঁজে পেলো না। কি যন্ত্রনা!
.
প্রথমে এই বাড়িটাকেই ভুতের বাড়ি মনে হলেও এখন তা একদমই মনে হচ্ছে না নোলকের। বরং রাজপ্রাসাদ রাজপ্রাসাদ লাগছে।
সবচাইতে বেশি ইন্টারেস্টিং লাগছে বিয়েটা। এর আগে সে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়ে দেখেনি। দেখেনি এই শুভদৃষ্টি, সাতপাকে বাঁধা, মালাবদল, কন্যাদান, সিঁদুর দান! ফাঁকা সিঁথি টকটকে লাল সিঁদুরে ভর্তি হয়ে গেলো মূহুর্তের মাঝেই। নোলক বিস্ময় নিয়ে তাকায় শ্রীতমার দিকে।
মেয়েটা গোলগাল মুখখানা পুতুলের মতো লাগছে।
নোলক চুপিচুপি শ্রীতমার পাশে গিয়ে বসে। ফিসফিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“দোস্ত? তোর কি আসলেই বিয়ে হয়ে গিয়েছে?”
শ্রীতমা সুন্দর করে হাসে। হালকা মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়।
নোলকের মুখ ঝলমল করে উঠে। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বলে,
“দোস্ত তোকে মিষ্টি বউ লাগছে।”
শ্রীতমা লাজুক হেসে মাথা নিচু করে ফেলে। নোলক এবার বরের কাছে গিয়ে বলে,
“জিজু? দেখেছেন, কত সুন্দর মিষ্টি পুতুল বউ পেয়েছেন?”

ছেলেটাও প্রতিত্তুরে হাসি ফিরিয়ে দেয়। নোলকের মতোই ফিসফিয়ে বলে,
“জিতছি, তাই না?”
“হ্যাঁ, একদম!”
কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ায়। শ্রীতমার বরটাকে ওর ভালো লেগেছে। নাম শায়ন। ছেলে যে মারাত্মক বউ পাগল হবে সেটা বিয়ের আগ থেকে অনুধাবন করতে পারছে নোলক। যেহেতু দুইমাস আগেই আশির্বাদ হয়ে ছিলো, সেহেতু এই দুইমাসে যথেষ্ট টান যে তৈরি হয়ে গিয়েছে তা-ও চোখ এড়ায়নি নোলকে। শ্রীতমা তো প্রেমেই পড়ে গিয়েছে এই দুই মাসেই। দিন রাত সে তার প্রণয়কাব্য জপে গিয়েছে অনবরত। মাঝে মধ্যেই অদ্ভুত এক প্রশ্ন করতো,’দোস্ত? তার নামও ‘শ’ দিয়ে আমার নামও ‘শ’ দিয়ে, ব্যাপারটা জোশ না?’
এর মাঝে জোশ কিছু খুঁজে না পেলেও নোলক মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতো।
যদিও যেকোনো কিছুর শুরুতে মানুষের তুখোড় আগ্রহ থাকে। সময়ের ব্যবধানে সেই আগ্রহে ভাটা পড়ে যায়! তবুও নোলক মনেপ্রাণে চায়, সুন্দর সম্পর্কগুলোতে কখনো ভাটা না পড়ুক। সম্পর্ক সজীব, সতেজ ও প্রাণবন্ত থাকুক শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।

ভাবনার বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে নোলক দেখলো, বন্ধুরা সব একসঙ্গে ছবি তুলছে। নোলক এক ছুটে সেখানে উপস্থিত হলো। রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বলে,
“আজব তো? তোরা আমায় রেখে ছবি তুলছিস কেন?”
বলেই সে সবার মাঝে ঢুকলো। তারপর একটা হাসি দিয়ে বলল,
“নে এবার তোল।”
নোলকের এই চঞ্চলতার কারনেই সে তার বন্ধুমহলের মধ্যমণি। তাকে ছাড়া কেউ কিছু করতেও পারে না। আর করলেও শান্তি পায় না।
দুই তিনটা ছবি তোলার পর লক্ষ্য করলো, ফয়সাল আর লুবনা নাই। ঠোঁট উল্টে প্রশ্ন করলো,
“ফয়সাল আর লুবু কই?”
শ্রেয়া বলে,
“লুবনা তো এখানেই ছিলো। কই গেল আবার!”
নিষাদ বলল,
“আসলেই তো? মালটু দুইটা কই?”
“দাঁড়া, আমি দেখে আসি ওরা কই।”
বলেই স্থান ত্যাগ করলো নোলক।
নোলক চলে যাওয়ার পর শ্রেয়া উল্টো প্রশ্ন করলো,
“ব্রো? মালটু আবার কী-রে?”
নিষাদ হাই তুলতে তুলতে বলল,
“তোর জামাইর মাথা।”
“দেখ জামাই তুলে কথা বলবি না।”
কপাল কুঁচকে ঠোঁট উল্টে বলল শ্রেয়া।
সৃজন অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
“আরে সর্বনাশ! মাইয়ার জামাইর লাইগা কি টান দেখছিস?”
বলেই নিষাদের সঙ্গে হাত মিলায়। তারপর আকাশে পাতাল কাঁপিয়ে হেসে উঠে।
শ্রেয়া মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
.
পুরো বাড়ি খুঁজেও ফয়সাল আর লুবনাকে না পেয়ে উদগ্রীব হয়ে উঠলো নোলক। ভাবতে ভাবতেই বাড়ির দক্ষিণ দিকে যায়। দুই’পা বাড়াতেই দেখতে পায় ফয়সালকে। নোলক যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি চেয়ে থেকে বলে, “লুবু কই?”
ফয়সাল ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বিস্ময় নিয়ে বলে,
“লুবু কই মানে? তোদের সাথে নেই?”
“না। পুরো বাড়ি খুঁজলাম। কোথাও তো দেখলাম না! ভাবলাম তোর সাথে।”
ফয়সালের মনে ভয়। তখন আকস্মিক অমন করা উচিত হয়নি বুঝতে পেরে চিন্তিত অনুভব করে। জিহ্বা দিয়ে শুঁকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে বার’কয়েক শ্বাস নেয়। নোলকের নজর এড়ায়নি এটা। ফয়সালের বাহুতে হাত রেখে বলে,
“দোস্ত? ঠিক আছিস তুই?”
ফয়সাল হাত দিয়ে কপাল মুছে উত্তেজিত কন্ঠে বলে,
“একটা ভুল করে ফেলেছি দোস্ত। ত..তুই একটু এদিকটায় দেখ, আমি ওদিকটায় দেখছি।”
বলেই ছুট লাগায়।
নোলক যেন দ্বিধাদন্দে পড়ে যায়। কি ভুল করেছে ছেলেটা? ভাবতে ভাবতেই উল্টো দিকে যায়!…..(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে