ছোঁয়া শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৭০ এবং শেষ পর্ব

1
2357

#ছোঁয়া_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
শেষ পর্ব (১ম অংশ)

অতলের সাথে দেখা করতে রাদিদের তেমন কষ্ট হলো না। অতল নিজেই ওকে ফোন করে দেখা করতে চাইল। অতলের অবস্থা দেখে রাদিদ একটা ধাক্কা খেল। এতোটা পরিবর্তন! চোখের নিচে কালি, উস্কখুস্ক চুল, বিধ্বস্ত চেহারা। এমন অবস্থায় সে বলার জন্য কোনো কথাই খুঁজে পেল না।

অনেকক্ষণ পর জানতে চাইল, ‘এ কেমন অবস্থা করেছিস নিজের?’

অতল হেসে বলল, ‘আমি তো এটারই যোগ্য তাই না? আমার তো এরকম অবস্থা হবারই ছিল।’

রাদিদ তখন অনুনয়ের স্বরে বলল, ‘প্লিজ অতল, ভাই আমার। তুই নিজেকে কষ্ট দিস না আর বহ্নিকে একা ছেড়ে দিস না। ও তোকে অনেক ভালোবাসে।’

অতল অদ্ভুত হাসল। হাসতে হাসতে বলল, ‘ভালো তো ওকে তুই নিজেও বাসিস। তাই না?’

রাদিদ চোখ নিচু করে ফেলল সাথে সাথেই। তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘কে বলেছে আমি ওকে ভালোবাসি?’

‘তোর দৃষ্টি।’

রাদিদ অতলকে অনেকভাবে বুঝাতে চাইল কিন্তু অতল রাদিদের কোনো কথাই শুনতে চাইল না। সে তার সিদ্ধান্তে অনড়। রাদিদ যাই বলছে অতল তার বিপরীতে উল্টো যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে।

রাদিদ রেগে গিয়ে বলল,
‘এসব আবোল-তাবোল কথা বাদ দে তো। আমি তোকে যা বলছি তা শোন একবার।’

‘তুই আমার কথা শোন। বহ্নিকে কখনও কষ্ট দিস না। আমি জানি ও তোর কাছে ভালো থাকবে।’ কথাটা বলেই অতল চলে গেল। এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। অতলের দু’চোখ ভরা বিষাদ রাদিদের চোখে এড়ার না।

_______________________

অতলের সাথে বহ্নির মানসিক দূরত্ব বাড়তেই থাকল, সাথে বাড়তে থাকল বহ্নির জেদ আর অতলের পাগলামো। একদিকে ভাঙছে, অপরদিকে অভিমানের পাহাড় গড়ছে। যে বহ্নি এতোদিন অতলকে বিয়ে করবে বলে অনড় ছিল। সেই এবার বিয়ে কোনোভাবেই ভাঙবে না বলে অনড় অবস্থান করল, তবে বর হিসেবে এবার থাকবে অন্যকেউ। নির্ধারিত দিনেই সে বিয়ে করবে। মূলত অতলের সাথে তৃণা নামের মেয়েটাকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখার পর থেকেই বহ্নির মাথায় আগুন ধরে গেল। ঠিক তখনই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে রাদিদকেই বিয়ে করবে। সবাই ওকে বুঝাল কিন্তু ও কারো কথাই শুনল না। শিহরণ আর ছোঁয়া অনেক বোঝাল, তাতেও কাজ হলো না। সে তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকল। নিজের ভেতরে থাকা একগুঁয়ে সত্তাটা বেরিয়ে এসেছে, যাকে দমন করা তার নিজের পক্ষেও সম্ভব নয়।

অতল নিজের ব্যর্থতা দেখতে দেখতে ক্লান্ত। সে আর পারছে না। নিজের উপরে থাকা অবশিষ্ট বিশ্বাসটুকু হতাশায় পরিণত হলো। অবশেষে সে হার মানল, নিজের ব্যর্থ ভাগ্যের কাছে।

বিয়ের দিন অতলকে কল করল বহ্নি। অতল কল রিসিভ করল না। অবশেষে বহ্নি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। সাথে করে নিয়ে গেল অতলের দেওয়া নীল শাড়ি আর নীল চুড়ি। বহ্নি জানে অতল কোথায় থাকতে পারে। গাড়ি থেকে নেমে নদীর কাছাকাছি এসেই অতলকে বেঞ্চে বসে থাকতে দেখল। অতলকে দেখে বহ্নি ভীষণ চমকে গেল। বিধ্বস্ত অতল, বিধ্বস্ত তার বাহ্যিক অবয়ব।

অতলের সামনে দাঁড়িয়ে বহ্নি শেষবারের মতো একবার বলল, ‘এখনও সময় আছে। যদি আমাকে বলার মতো কিছু থেকে থাকে তবে জানাও।’

‘আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছি।’

‘ঠিক আছে, আমিও আমার সিদ্ধান্ত জানাতেই এলাম।’

‘কীসের সিদ্ধান্ত?’

‘আমি রাদিদ ভাইয়াকে বিয়ে করছি।’

অতলের মনে হলো তার বুকের ভেতর হৃৎপিন্ডটা কেউ ছুরি দিয়ে কেটে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। তবুও বহ্নির ভালোর জন্য সে এই কষ্টটা মেনে নিল।

‘রাদিদ, ইজ অ্যা বেটার অপশন।’ অতল ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলল।

বহ্নি অতলের দেওয়া সবস্ত উপহার তাকে ফিরিয়ে দিয়ে চলে গেল। একটা বারও পেছন ফিরে তাকাল না। রাস্তার সকলেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বহ্নির দিকে। এরকম বিয়ের সাজে একটা মেয়ে রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছে দেখে সকলের মনেই কৌতূহল।

অতল নীল শাড়িটা বুকের সাথে চেপে ধরল। শাড়ি আর চুড়িগুলো নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। এসেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। সে জানে আজ থেকে বহ্নি রাদিদের হয়ে যাবে। শাড়িটা বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। বিয়ের সাজে বহ্নিকে সত্যিকারের পরীর মতো দেখাচ্ছে। পরীদের কষ্টে থাকতে নেই, তারা কষ্ট সহ্যও করতে পারে না, অতলের সাথে থাকা মানেই কষ্টকে জেনেশুনে আলিঙ্গন করা, বহ্নি তা চাইলেও অতল তা হতে দিতে পারে না।

এটাই বহ্নির জন্য বেস্ট। একজন ব্যর্থ মানুষের সাথে থেকে নিজের জীবন ধ্বংস করে ফেলুক তা অতল চায় না। তাই মুক্তি দিল বহ্নিকে, তার ব্যর্থ ভালোবাসা থেকে, তার ব্যর্থ জীবন থেকে!

_______________________

অবশেষে অনাড়ম্বরভাবে রাদিদ আর বহ্নির বিয়েটা হয়ে গেল। এই বিয়েতে কেউ রাজী ছিল না। কিন্তু বহ্নির জেদের কাছে সবাইকে হার মানতে হলো। কবুল বলার সময় বহ্নির চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

শিহরণ জানতে চাইলেও বহ্নি বলল না তার অতলকে ছেড়ে রাদিদকে বিয়ে করার কারণ। সে চায় না তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হউক। তাই সবকিছুই শিহরণের কাছ থেকে চেপে গেল। বহ্নি আর রাদিদ যখন গাড়িতে করে কুমিল্লা রওনা দিল তখন ভূতগ্রস্তের মতো রাস্তার এক কোণে ল্যাম্পপোস্টের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে অতল তাকিয়ে থাকল। অন্ধকারের অতলে ডুবে যাচ্ছে সে। কারো নজর তার উপরে পড়ল না। কেউ দেখল না, উস্কখুস্ক চুল, কুঁচকে যাওয়া কাপড় পরে অতল তার প্রিয়তমার শেষ বিদায়ের বেলা তাকে অগোচরে বিদায় জানাতে এলো। কোনো কারণ ছাড়াই বহ্নি একবার গাড়ির কাচের বাইরে মাথাটা বের করে এদিক সেদিক তাকাল। অতল শেষবারের মতো তার পরীর মুখটা দেখল, কী ভয়ংকর সুন্দর লাগছে তাকে! আর সে ভয়ংকরভাবে ভেঙে পড়ছে।

পৃথিবী নামক গ্রহে বোধহীন মানুষের সবচাইতে বড়ো শত্রু তার শঙ্কা, অবিশ্বাস আর ভয়। অতল সেই ভয়, শঙ্কা আর অবিশ্বাসের কারণেই সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেল। ডুবে গেল অন্ধকারের অতলে নিঃশব্দে, কেউ জানতেই পারল না তার বুকের গহীনের কষ্টের গভীরতা কতটুকু! তবুও ভালোবাসার ভালো থাকাকে বেছে নিল অবলীলায়, নিজ ক্ষতের পরোয়া না করেই। পৃথিবীতে এই শ্রেণীর মানুষ বিরল, যে কজন আছে তারা কেবল দুঃখ বয়ে বেড়ায়। তাদের দুঃখের ফেরিওয়ালা বলা যায় নির্দ্বিধায়!
___________________

অতল কারো সাথেই কোনো যোগাযোগ রাখল না। একা ঘরে নিজেকে বন্ধী করে রেখেছে। তার মানসিক অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকেই যাচ্ছে। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে সে আরও অনেক বেশি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। নিজের উপর যেটুকু বিশ্বাস, ভরসা বাকি ছিল তার সবটুকু শেষ হয়ে গেছে। এখন তার পুরোটা জুড়ে কেবল হতাশা। খাওয়া-দাওয়ার চরম অনিয়ম করা শুরু করেছে। এর মধ্যে সে তিনবার সুইসাইড এটেম্পটও করে ফেলেছে। একবার অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেছে, একবার বিষ খেয়ে ফেলেছিল। মেহেরুন নাহার যখন কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘এমন কেন করছিস তুই? আমরা কি তোর কেউ না? আমাদের জন্য কি তুই নিজেকে একটু ভালো রাখতে পারিস না?’

অতল তখন অপ্রকৃতিস্থের ন্যায় বলেছিল, ‘আমি ঘুমাতেই চাই মা, আমার না ঘুম আসে না। সারা রাত শুধু মাকে মনে পড়ে। মনে হয় আমিও আমার বাবার মতো হয়ে যাব না তো?’ তারপর পরই কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, ‘দেখো না, আমিও বাবার মতো হয়ে যেতে পারি বলে আমি আমার এঞ্জেলকে হারিয়ে ফেললাম। তার বাবা-মা আমাকে ভরসা করতে পারেনি। আমি নিজেও ভরসা করতে পারছি না নিজেকে। যদি আমি আমার এঞ্জেলকে কষ্ট দিয়ে ফেলি। যদি ও আমার মায়ের মতো হয়ে যায়। এতো বড়ো ঝুঁকি নিতে পারিনি আমি মা। তার চাইতে বরং ও ভালো থাকুক। আমি জানি রাদিদ ওকে ভালো রাখবে। ভালোবাসলে পেতেই হবে এমন কোনো নিয়ম পৃথিবীতে এখনও সৃষ্টি হয়নি, আমি না হয় দূর থেকেই ভালোবেসে যাব আমার এঞ্জেলকে। আমি জানি আমার ভাগ্য এতোটাও সুপ্রসন্ন নয় যে, আমার ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে।’

অতলের কথা শুনে মেহেরুন নাহার আঁচলে মুখ চেপে কাঁদতে থাকলেন। তানিয়া কান্না ভেজা কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘তবে কেন যেতে দিলে বহ্নি আপুকে?’

‘আমার নিজের উপরে ভরসা নেই। ভালোবাসার মানুষের ভালো থাকাটাই তো মুখ্য তাকে পাওয়া তো নয়।’

‘তাহলে এখন এরকম মরে যেতে চাইছ কেন?’

‘আমার নিজেকে নিঃস্ব লাগে। মার কথা, বহ্নির কথা এতো বেশি মনে পড়ে যে আমার নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে। আমার নিজের উপরে তখন আমার কোনত নিয়ন্ত্রণ থাকে না।’

শেষ বার সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অতল ভয়ংকর কাজ করে ফেলেছিল। সে ধারালো ব্লেড দিয়ে নিজের হাতের রগ কেটে ফেলেছিল। তানিয়া অতলের খাবার দিতে এসে ডাকতে ডাকতে যখন তার কোনো সাড়া পেল না তখন এলাকার কয়েকজন বড়ো ভাইয়ের সহায়তায় দরজা ভেঙে ফেলে। দরজা ভাঙার পরে দেখে রুমের অবস্থা ভয়াবহ। পুরো ফ্লোর জুড়ে রক্তের স্রোত। সবাই মিলে ওকে ধরে বের করে হাসপাতালে এডমিট করে। অনেক ব্লাড দিতে হয়েছিল।

তানিয়া তখন কী মনে করে বহ্নির সাথে যোগাযোগ করল। বহ্নির মনে তখনও অতলের জন্য এক আকাশ অভিমান জমেছিল। কিন্তু তানিয়ার কাছ থেকে অতলের ব্যাপারে সবটা শুনে সে আর না এসে থাকতে পারল না। রাদিদও তার সাথে এলো।

বহ্নি আসার পরে তানিয়া তাকে সবকিছু জানিয়ে দিল। তৃণাকে দিয়ে অভিনয়, তার মায়ের অতলের কাছে করা অনুরোধ, জব না হওয়া, একদম সবকিছু বলে ফেলল। বহ্নির তখন নিজের উপরে রাগ হচ্ছিল। কেন সে রাগ করল, রাগের বশে সে নিজেই সবটা শেষ করে দিয়েছে। একটু অপেক্ষা করলে কি এমন ক্ষতি হতো!

অতলের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে বহ্নির বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছিল। এতোটা করুণ অবস্থা হয়েছে! এভাবে কষ্ট পাচ্ছে। তিন বার সুইসাইড এটেম্পট! অতলের এমন অবস্থার জন্য সে নিজেও কী দায়ী নয়?

বহ্নি একটা চিরকুট লিখল অতলের জন্য।

প্রিয় তুমি,

সব ভালোবাসা কি পূর্ণতা পায়?
তোমার আমার ভালোবাসাও হয়তো পূর্ণতা পাবে না। তবুও তোমায় ভালোবেসেই যাব। তোমার স্থানটুকু তোমার জন্যই বরাদ্দ থাকবে।

একটা কথা বলবে?
আমার উপর এতটুকুও কি বিশ্বাস জন্মায়নি তোমার? আমাকে একবারও জানাতে ইচ্ছে হয়নি তোমার? সারাজীবন সব সম্পর্ক থেকে তুমি পালিয়ে এসেছ। আমার কাছ থেকেও পালিয়ে বেঁচে গেছ। এখন নিজের জীবন থেকেও পালাতে চাইছ? বাহ! অতল, বাহ্! একটাবারও সেই মায়ের কথা ভাবলে না, যেই মা তোমার জন্য অনেক অত্যাচার সহ্য করেছে, বোনের কথা মনে হলো না, যে তোমার জন্য নিজের ভাইয়ের সাথেও যুদ্ধ করতে চায়!

কারা পালাতে চায় জানো তো? কাপুরুষরা? তুমি কি কাপুরুষ?

অপরাজিতা না-কি তোমার প্রিয় ফুল? অথচ সম্পর্কের কাছে তুমি বারবার পরাজিত। এ তোমার কেমন পছন্দ? বলবে আমায়?

একটা অদ্ভুত বিষয় দেখেছ, জীবনের পথচলায় তুমি আমাকে একা ছেড়ে দিলে, আমার উপর একটুও বিশ্বাস রাখোনি। তুমি ভাবছ-তোমাকে ছাড়াই আমার ভালো হবে! কে ভাবতে বলেছে আমার ভালো? আমার ভালোটা আমাকেই বুঝতে দিতে।

যদি আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা সত্যিই হয়ে থাকে তবে তুমি অপরাজিত হও ঠিক তোমার জন্য রেখে যাওয়া আমার শেষ স্মৃতির মতো। তোমার জন্য নিজ হাতে এই অপরাজিতা ফুলগুলো তুলেছি। যত্ন করে রেখো। নিজের খেয়াল রেখো।

কিছু মানুষকে ভোলার চেষ্টা করতে নেই, তুমি তাদের মধ্যে একজন। কিন্তু যখনই তোমার কথা আমার মনে পড়বে তখন যেন আমার এটা মনে না হয় যে আমি একজন ভীরুকে ভালোবেসেছিলাম। যে ছিল পলাতক। আমি এই ভাবনাতে ভীষণ কষ্ট পাব। আমি ভাবতে চাই, আমার ভালোবাসার অতল নীল অপরাজিতার মতোই অপরাজিত, তাকে রুদ্ধ করার সাহস কারো নেই ,নেই কোনো ক্ষমতা।

পৃথিবীতে কেউ পারফেক্ট হয় না, অপূর্ণতাটুকু পুর্ণ করে নিতে হয়। তবুও মানুষ বেঁচে থাকে, স্বপ্ন দেখে। পৃথিবীতে কেউ পরিপূর্ণ হয় না। আমি চাই তুমি তোমার সমস্ত অপূর্ণতার মাঝে থেকে পরিপূর্ণ হও।

ইতি
তোমার কেউ না।

অতলের জ্ঞান ফেরার পূর্বেই বহ্নি চলে গেল। রাদিদ বুকে পাথর রেখে বহ্নিকে বলল, ‘তুমি চাইলে ওর কাছে ফিরে যেতে পারো।’

জবাবে বহ্নি মৃদু হাসল। তারপর রাদিদের একটা হাত শক্ত করে ধরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল। তানিয়া নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকল তাদের গমনপথে।

অতলের জ্ঞান ফেরার পর সে বহ্নির রেখে যাওয়া চিঠি আর অপরাজিতা ফুলগুলো পেল। চিঠিটা বার বার পড়ল। মনে হলো সেই চিঠিতে বহ্নির স্পর্শ লেগে আছে, বহ্নির ভালোবাসার শেষ চিহ্নটুকু সে যত্ন করে রেখে দিল নিজের কাছে। সেদিন সারা রাত সে ঘুমাতে পারেনি। সারা রাত শুধু বহ্নির চিঠিটা বারবার পড়েছে আর অপরাজিতা ফুলগুলো বুকের সাথে চেপে ধরেছিল।
___________________

প্রকৃতিতে ফাগুনের হাওয়া লেগেছে। গাছে গাছে সবুজ পাতা গজেছে। চারদিক থেকে ফুলের ঘ্রাণ বাতাসের ভেলায় ভর করে ভেসে আসছে। ছোঁয়া হুইল চেয়ারে বসে আছে। শিহরণ তার থেকে দুই তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাকুল হয়ে বলছে, ‘ইউ ক্যান ডু ইট, ছোঁয়া। ডু বিলিভ অন ইউ। ডোন্ট লুজ ইওর পেশেন্স।’

ছোঁয়া কম্পিত বুক নিয়ে কম্পমান হাতে হুইলচেয়ারের হাতল ধরে রেখেছে শক্ত করে। তার পায়ের পাতা মাটিতে রাখল, বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে। একটু একটু করে ওঠার চেষ্টা করছে সে। শিহরণ দূরে দাঁড়িয়ে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। মনের মধ্যে শত ডানার প্রজাপতিরা উড়ছে, এই বুঝি ছোঁয়া হাঁটতে শুরু করবে। এই প্রত্যাশা আর ইচ্ছে নিয়ে দীর্ঘ ছ’মাস চেষ্টা করছে শিহরণ। ফিজিওথেরাপিস্টের ট্রিটমেন্টের পাশাপাশি সে নিজেও ছোঁয়ার হাঁটার চেষ্টায় সফলতার স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছে, চেষ্টা করে গেছে মুহুর্মুহু। সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে ছোঁয়া হাঁটতে পারবে। পৃথিবীতে যেকোনো ধরনের সফলতার পূর্বশর্ত বিশ্বাস। বিশ্বাসহীন চাওয়া ঠুনকো বৈ আর কিছুই নয়। ছোঁয়া দাঁড়িয়েছে, এটা ছ’মাসের অক্লান্ত চেষ্টার ফল। শিহরণ চেঁচিয়ে বলল, ‘কাম অন ছোঁয়া, ইউ ক্যান ডু ইট। ট্রাস্ট মি ইউ উইল বি সাকসিডেড।’

শিহরণের কথায় ছোঁয়া যেন জোর পেল। সে দুরু দুরু বুক নিয়ে কম্পমান পা ফেলছে।পড়ে যেতে চাইছে, কিন্তু পরক্ষণেই আবার নিজেকে সামলে নিচ্ছে। ঠিক যেমন করে নতুন শিশু প্রথম হাঁটতে শেখে।

ছোঁয়া যখন হাঁটতে হাঁটতে শিহরণকে ধরে ফেলল তখন সে এক ঝটকায় ছোঁয়াকে কোলে তুলে নিল। তারপর আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঘুরতে লাগল। ছোঁয়া বলল, ‘আরে করছটা কী? সবাই দেখছে তো?’

‘দেখলে দেখুক। আমি নিজের বিয়ে করা বউকে কোলে তুলেছি, অন্য কাউকে তো নয়।’

বেশ কিছুক্ষণ পরে তাদের চারপাশে একটা জটলা মতন পেকে গেছে। সবার মধ্যে কৌতূহল কাজ করছে। হলোটা কী? সকলের উৎসুক চোখ ব্যাকুল হয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছে। একটা সময় পরে শিহরণ ছোঁয়াকে কোল থেকে নামাল।

ছোঁয়াকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেখে ফাহমিদা বেগম খুশিতে কেঁদে ফেললেন। অহনা আর হিয়াও অনেক খুশি হলো। ফাহমিদা বেগম শিহরণের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তোমার অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণেই আজকে আমার মেয়েটা হাঁটতে পারছে। অনেক ভালো থাকো বাবা।’

হিয়া হেসে বলল,’জিজু, এই খুশিতে আমাদের কিন্তু ট্রিট দিতে হবে। কি দেবে না?’

শিহরণ মৃদু হেসে বলল,’কেন দেব না? এবার বিশাল পার্টি হবে। কী বলো প্রিয়তা?’

ছোঁয়া মিষ্টি হেসে বলল,’তোমাকে নিষেধ করলেও কি তুমি তা শুনবে? তোমার যা ইচ্ছে হবে তা-ই তো করবে। তাহলে আমাকে শুধুশুধু প্রশ্ন করছ কেন?’

‘এরকম অপবাদ সহ্য করার মতো নয়।’ শিহরণ কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’আমি তো তোমার কথা সবসময় শুনি। তবুও এই অপবাদ!’

ছোঁয়া বলল, ‘যথেষ্ট হয়েছে। এখন আর নাটক না করলেও চলবে। বাসায় চলো। অফিসে যেতে হবে না?’

‘আজকে নো অফিস। আজকে আমরা সবাই মিলে সেলিব্রেট করব। ঠিক আছে না অহনা, হিয়া?’

অহনা আর হিয়া সম্মতি জানিয়ে বলল,’হুম, একদম ঠিক।’

ছোঁয়া বিরক্ত হয়ে বলল,’অফিসে না হয় যাবে না। এবার অন্তত বাসায় তো চলো।’

আকাশে তারাদের মেলা বসেছে। রাত বাড়ছে। এতোদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে আজ। পুরো রুমটা নানা রকমের ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। বধুবেশে ছোঁয়াকে মোহনীয় লাগছে। শিহরণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মুগ্ধতার রেশ না কাটতেই তার মনে পড়ল ছোঁয়াকে সারপ্রাইজ দেবার কথাটা।

ছোঁয়াকে সারপ্রাইজ দেবার জন্য শিহরণ যেন এক যুগ অপেক্ষা করেছে। আজ তার অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চলেছে। ছোঁয়াকে চোখ বন্ধ রাখতে বলে শিহরণ ড্রয়ার থেকে একটা লাল রঙের ছোট বক্স আর একটা ডায়েরি বের করল।

লাল রঙা বক্স থেকে একটা লকেট বের করে সেটা ছোঁয়ার গলায় পরিয়ে দিল। তারপর বলল,’এবার চোখ খুলতে পারো, প্রিয়তা।’

ছোঁয়া দেখল তার গলায় খুব চমৎকার একটা লকেট। সে খুশি হওয়ার পাশাপাশি অনেক বেশিই অবাক হলো কারণ সে লকেটটা তার মায়ের। সে ছলছল চোখে তাকাল শিহরণের দিকে। শিহরণ চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে ডায়েরিটা তার দিকে এগিয়ে দিল। ছোঁয়া ডায়েরি দেখে আরও বেশি চমকে গেল। বলল,’এটা তোমার কাছে কী করে?’

‘তুমি ভুল করে স্কুলে ফেলে গিয়েছিলে। আমার নজর পরার পরে আমি ওটা সাথে করে নিয়ে আসি। তোমাকে ফিরিয়ে দেবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ডায়েরির প্রতিটা পাতা আমি না চাইতেও আত্মস্থ করে ফেলেছিলাম। তাই আর দিতে পারিনি। যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম আজকের এই দিনে তোমাকে উপহার দেব বলে।’

ছোঁয়া ডায়েরির পাতা উল্টাতে লাগল। কৈশোরের সমস্ত পাগলামো ভরা আবেগে ভরপুর এই ডায়েরি। সবকিছু এখনও জীবন্ত, যেন হাত বাড়ালেই সবকিছু ধরা যাবে, অনুভব করা যাবে। মনের মধ্যে একটা চাওয়া মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে, সেই দিনগুলি ফিরে পাওয়ার জন্য।

‘আমার জিনিস আমাকেই উপহার দিচ্ছ। একটু অদ্ভুত হয়ে গেল না?’

‘আমি তো এমন সব অদ্ভুত কাজ করতেই ভালোবাসি। এতোদিন ধরে এগুলো নিজের কাছে আমানত হিসেবে রেখেছি। কই খুশি হয়ে আমাকে পুরস্কার দেবে তা না করে…!’

ছোঁয়া তৎক্ষণাৎ শিহরণকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলল,’অনেক ভালোবাসি।’

শিহরণ কিছু বলল না। সব কথা বলতে হয় না। রাত গভীর হচ্ছে পাশাপাশি দুটো হৃদয়ে জমিয়ে থাকা একে অপরের প্রতি ভালোবাসাও একীভূত হচ্ছে। নিশাচর পাখিরা ডাকছে তারস্বরে। ঝিঁঝিঁপোকারা দল বেঁধে ডেকে চলেছে এমনতরভাবে যেন তারা আজ কোনো উৎসবে আমন্ত্রিত অতিথি!
__________________

আমিরাহকে ডিভোর্স দেবার পরে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে আশফাক নীলাকে তার বাড়িতে তুলল। আশফাকের বাবা আর মা কোনোভাবেই রাজী হলেন না। অবশেষে আশফাক আলাদা থাকার কথা বলার পরে তারা বাধ্য হন নীলাকে মেনে নেওয়ার জন্য। টিয়া এখন আর মুখ গোমড়া করে থাকে না। নীলাকে সে মা বলে ডাকে। পিউ ছোট বোন পেয়ে দারুণ খুশি। পিউ তো টিয়ার জন্য পাগলপ্রায়, টিয়াও পিউ বলতে অজ্ঞান।

দুই মেয়েকে নিয়ে আশফাক আর নীলার সংসার বেশ ভালোই যাচ্ছে। আশফাকের বাবা-মা নীলাকে পছন্দ না করলেও সামনাসামনি কিছু বলতে পারেন না।

________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
শেষ পর্ব (২য় অংশ)

পাঁচ বছর পর…

বছরের সেরা ঔপন্যাসিকের অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছে রাদিদ ইবনে ইফতেখার। এই সংবাদটা শোনার পর থেকে রাদিদের মধ্যে উত্তেজনা কাজ করছে। সে কোথাও এক দন্ড বসছে না। কেবল অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। তার একান্ত গোপন মনের কথাগুলো আজ হাজার হাজার পাঠক হৃদয়ে ঠাই পেয়েছে! অপ্রত্যাশিত যেকোনো কিছুই অতুলনীয় আনন্দ দেয়। তাই রাদিদ আজ ভীষণ খুশি।

রাদিদের এখনও মনে হয় এই তো সেদিনকার কথা। হঠাৎ করেই একজন প্রকাশক তাকে ফোন করে তার লেখা প্রকাশ করতে চাইল। রাদিদ কোনোভাবেই বুঝতে পারল না, তার লেখালেখির কথা প্রকাশকের কানে গেল কীভাবে! এই কথা খুব কম লোকই জানে!

অবাক করার বিষয় ছিল রাদিদ তার উপন্যাসের খাতাটা যেখানে রেখেছিল সেখানে পায়নি। পরে পুরো ঘর সে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। অবশেষে খাতাটা পেল তাদের গোয়াল ঘরের ছাদে। কিন্তু খাতাটা কীভাবে যে সেখানে পৌঁছাল তা সে এখনও অবধি জানে না!

আর এখন আশ্চর্যজনকভাবে সে সেরা ঔপন্যাসিক হয়ে গেল। এটা কি চাট্টিখানি কথা!

বহ্নি কিচেনে রান্না করছিল। রাদিদ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে খবরটা দিল। বহ্নি প্রশস্ত হেসে বলল, ‘এ আর নতুন কী! আমি তো আগে থেকেই জানতাম। এটা তোমারই প্রাপ্য ছিল।’

রংধনু দৌড়ে এসে বলল, ‘পাপা, আমাকেও মামুণির মতো করে আদর করে দাও।’

রাদিদ তাড়াতাড়ি বহ্নিকে ছেড়ে দিল। রংধনুকে যেই কোলে নিতে গেল ও পুরো ঘরময় দৌড়াতে শুরু করল। শেষ পর্যন্ত রংধনুকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে রাদিদ বহ্নিকে বলল, ‘আমাকে ঘোড় দৌড় দৌড়িয়ে ছাড়ল তোমার মেয়ে।’

বহ্নি হেসে বলল, ‘হুম, তা ও কি শুধু আমার মেয়ে না-কি তোমারও মেয়ে?’

‘কিন্তু ও তো একদম আমার মতো হয়নি। হয়েছে তোমার মতো দুরন্তপনা।’

রংধনু বলে উঠল, ‘পাপা, আবার।’

রাদিদ বলল, ‘পাপা আজকে ক্লান্ত হয়ে গেছে। আবার কালকে, ঠিক আছে?’

রংধনু খুশি হয়ে বলল, ‘ওকে পাপা। মাই বেস্ট পাপা।’ মায়ের কোলে গিয়ে চুমু দিয়ে বলল, ‘মাই বেস্ট মাম্মা।’

ফাইজা বেগম ফোড়ন কেটে বললেন, ‘ও বড়ো খোকা, তুই কি নিজের ছোটোবেলার কথা একদম ভুলতে বসেছিস? তোর মেয়ে একদম তোর মতোই দুরন্তপনা হয়েছে। কী যে দুষ্ট ছিলি তা আর বলতে!’

শাশুড়ির কথা শুনে বহ্নি ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল। রাদিদ মনে মনে আফসোস করে বলল, ‘কেন যে এমন সময় তার মা তোর পোলটা খুলতে গেল!’

ফাইজা বেগমকে এখন আর কোনো কাজই করতে হয় না। বহ্নি নিজেই সব কাজ সেরে ফেলে। পাশাপাশি একটা কলেজের প্রভাষক সে। রাদিদের জীবনে এভাবে সুখপাখিরা হানা দেবে তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। তবে শয়নে-স্বপনে কিংবা জাগরণে সৃষ্টিকর্তার কাছে কেবল প্রার্থনা করে গেছেন যেন সমস্ত সুখ থেকে বঞ্চিত তার ছেলেটার জীবন যাতে একদিন সুখে-শান্তিতে ভরে যায়। আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করেছেন। রাদিদের জীবনে বহ্নি আসার পর থেকেই সবকিছু ম্যাজিকের মতো করে পরিবর্তন হয়ে গেল। বহ্নিকে তিনি নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন। আবির আর সাবরিনা এখন রাদিদকে ভাই বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায় না বরং তারা তাদের বন্ধুদের কাছে ঔপন্যাসিক রাদিদের ভাই-বোন হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এতেই তিনি শান্তি পান। নীলার বলা কথাগুলো সত্যি প্রমাণ হলো।

ফাইজা বেগমকে দেখে রংধনু খুশিতে লাফ দিয়ে উঠতে চাইল। রাদিদ দ্রুত ধরে ফেলল ওকে। এমন দুরন্ত মেয়েটা! রংধনু বলে উঠল, ‘দাদুর কাছে যাব।’

রাদিদ রংধনুকে ফাইজা বেগমের কাছে দিল। কিন্তু সে আবারও দৌড়াতে শুরু করল, এভাবেই প্রতিটা দিন সে পুরো ঘর মাথায় তুলে ফেলে। খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলতে থাকল,’দাদু, দেখি আমাকে ধরতে পারো কি না?’

রাদিদ হাসে মেয়ের চালাকি দেখে। বহ্নি মুচকি হেসে তার কাজে মনোযোগ দিল। রাদিদ বলল, ‘আজকে কি স্পেশাল কোনো আয়োজন করা হচ্ছে?’

‘জি, জনাব। আপনি অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছেন তাই ভালোমন্দ কিছু খাওয়ানোর জন্যই আমার পক্ষ থেকে এই ছোট্ট আয়োজন।’

‘এই অ্যাওয়ার্ডটা আসলে কার পাওয়া উচিত জানো?’

‘কার?’

রাদিদ জবাব দিল না। বহ্নি পুনরায় প্রশ্ন করল,’উত্তর দিলে না যে?’

রাদিদ বহ্নির কপালে চুমো দিয়ে তার দু’হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,’দেব। সময় আসুক।’ একটু থেমে রাদিদ আবারও বলল, ‘এসব অ্যাওয়ার্ড আমার জন্য খুব একটা মাইনে রাখে না, বহ্নি। আমার জীবনের সবচাইতে বড়ো পুরস্কার তুমি। তুমি না থাকলে এসব আনন্দ আমার কাছে আনন্দ বলেই মনে হতো না। আমি বেঁচে থাকতাম, হয়তো তোমার জায়গায় অন্য কেউ আমার পাশে দাঁড়াত। তবে এটা সারাজীবন চিরসত্যের ন্যায় অম্লান হয়ে থাকত আমার সাহিত্য রচনার একমাত্র অনুপ্রেরণা তুমি, কেবলই তুমি। পাঠকরা ভালোবেসে আমাকে গ্রহণ করেছে। কিন্তু তারা গ্রহণ না করলেও আমার কাছে এইসব সৃষ্টি অমূল্য থাকত।’

বহ্নি জবাবে হাসল। হাসছে রাদিদের চোখ জোড়াও। তার মন কৃতজ্ঞ সেই মানুষটার প্রতি যে অগোচরে থেকে তার এতো বড়ো উপকার করেছে।
_____________________

বিকেলের দিকে পশ্চিমাকাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছিল শিহরণ। একটু আগেই বৃষ্টি থেমেছে। রংধনু উঠেছে আকাশের বুকে। শিহরণ সেদিকেই তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধ সতেজ বাতাস শরীরে আঁচড় কাটছে। সেই সমীরণের ছোঁয়ায় বারান্দায় লাগানো ফুলের গাছগুলোতে ফুটন্ত ফুলগুলো দোল খাচ্ছে।
ছোঁয়া এসে তার কাঁধে হাত রাখল । শিহরণ সেই হাতে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘ছোঁয়া, দেখ না আকাশটা কেমন মনমরা হয়ে আছে? আর রংধনুটা দেখেছ? বিবর্ণ লাগছে না তোমার কাছে? অতল আর আমার বোনটার সাথে এমন কেন হলো? মা কেন অতলকে একটা দ্বিতীয় সুযোগ দিল না!’

ছোঁয়া গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আকাশের মন খারাপ নয়, শিহরণ। আর রংধনুটা মোটেই বিবর্ণ নয়। রংধনুটা তার গায়ে সাতটা রঙই ধারণ করে রেখেছে। বহ্নি, অতলকে হারিয়েছে কিন্তু রাদিদকে তো পেয়েছে। তাই না? মানুষ হিসেবে দু’জন-ই মূল্যবান। আর দুজনেই বহ্নিকে পাগলের মতো ভালোবাসে, সেই ছোটোবেলা থেকে। কেন ভাবছ শিহরণ, কেন নিজেকে এতো কষ্ট দিচ্ছ? বহ্নি ভালো আছে তো। আর অতল সে তো রূপকথার রাজকুমারের থেকে কম কিছু নয়! ও তো হেরে গিয়েও জিতে গেল! কজন পারে এমন জেতা জিততে?’

শিহরণ অশ্রুসিক্ত চোখে ছোঁয়ার দিকে একটু আশ্বাসের আশায় তাকিয়ে বলল, ‘ঠিক বলেছ তুমি। অতল সত্যিই ম্যাজিশিয়ান। সে হেরে গিয়েও জিতে গেল।’

‘শুধু কি তাই। ও একা জেতেনি। ও জিতিয়েছে আরও হাজারও মানুষকে। তোমার তো গর্ব হওয়া উচিত এমন একজন মানুষ তোমার বন্ধু বলে।’

‘ঠিক, আমার সত্যিই গর্ব হয় অতলের জন্য।’

‘বাবা, মা, বাবা মা, তোমরা কোথায়?’ হাতের মুঠোয় একগাদা চকলেট নিয়ে বর্ণ দৌড়ে আসল ছোঁয়া আর শিহরণের কাছে।

‘কী হয়েছে আমার বাবাটার?’ ছোঁয়া বলল আদুরে গলায়।

বর্ণ অধৈর্য হয়ে বলল, ‘পাপা, আমাকে কোলে নাও। আমি রংধনু দেখব। দাদু বলেছে আকাশে এখন রংধনু উঠেছে।’

শিহরণ বর্ণকে কোলে তুলে নিয়ে আকাশের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখাল। বর্ণ অবাক গলায় বলল, ‘পাপা, এটা তো খুব সুন্দর।’ তারপর ছোঁয়ার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘মাম্মা, এই চক্কেতগুলো একটু রাখো তো।’

ছোঁয়া চকলেটগুলো হাতে নিতেই বর্ণ দু’হাত দিয়ে তালি দিতে শুরু করল। তারপর টুক করে চুমো খেল শিহরণের গালে। ছোঁয়া তখন গাল ফুলিয়ে বলল, ‘মাম্মাকে দেবে না?’

‘দেব তো মাম্মা, এক এক জন করে দেব। আমার একটা বোন চাই, মামনি। আমাকে একটা বোন এনে দাও না। আমি খেলব ওর সাথে।’

ছোঁয়া প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,’আজকে তো তোমার বোন আসবে। রংধনু আসবে, সাথে আর কে কে আসবে বলো তো?’

‘ফুফু আর ফুফা আসবে। ইয়ে…কী মজা, রংধনু আসবে আকাশ থেকে!’ বর্ণ শিহরণের কোল থেকে নেমে দিল ভোঁ দৌড়।

বর্ণের কথা শুনে ছোঁয়া আর শিহরণ দুজনেই হেসে ফেলল। শিহরণ বলল,’কোথায় যাচ্ছ, বাবা?’

বর্ণ চিৎকার করে বলল,’আমি দাদুর কাছে যাচ্ছি পাপা।’

ছোঁয়া সতর্ক গলায় বলল,’আস্তে যাও বাবা, পড়ে যাবে তো।’

ছোঁয়া আর শিহরণ দুজনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাতে হাত রেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আকাশের দিকে।

________________

সাব্বির আহমেদ এখন নাতিকে নিয়ে অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দেন। শিহরণকেই অফিসের সমস্ত কাজ একা সামলাতে হয়।

বর্ণ এসে দাদুর কোলে বসে বলল,’দাদু, জানো আজ রংধনু আসবে।’

‘জানি তো দাদুভাই।’

সাবিহা সাবরিন অবাক হয়ে বললেন, ‘বহ্নি আসবে অথচ আমাকে কেউ একটু জানাল না পর্যন্ত।’

সাবিহা সাবরিনের কথার উত্তর দিলেন না সাব্বির আহমেদ। বহ্নি মায়ের সাথে এখনও ঠিক করে কথা বলে না। তাদের সম্পর্কে একটা অদৃশ্য দেওয়াল উঠে গেছে। যেটা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। হয়তো কোনো একদিন সেটার অস্তিত্ব থাকবে না। এই আশাতেই দিন পার করছেন সাবিহা সাবরিন। শিহরণও খুব বেশি কথা বলে না। বাসার সবাই যেন তার সাথে ফর্মালিটি মেইনটেইন করে। তবুও তিনি মানিয়ে নেন এই বিরূপ অবস্থার সাথে। এইটা ভেবে স্বস্তি পান যে তার মেয়ে ভালো আছে।

বহ্নি, রাদিদ আর রংধনু আসার খবর শুনেই তিনি কিচেনে চলে গেলেন মেয়ের প্রিয় খাবার বানানোর জন্য।
_____________________

কলিং বেলের শব্দ শুনে তানিয়া দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল। আশরাফ হোসেন পত্রিকা হাতে নিয়ে বসেছিলেন। তানিয়া দরজা খুলে অতলের নামে আসা চিঠি নিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ‘ম্যাজিশিয়ান ভাইয়া’ বলে ডাকতে শুরু করল।

তানিয়ার ডাকে অতল নিজের রুম থেকে বেরিয়ে
ড্রয়িং রুমে এসে সোফায় বসে একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করল। তানিয়া আহ্লাদিত কণ্ঠে বলল,’ভাইয়া, আজকে তো পাঁচটা চিঠি এসেছে রে।’

অতল মাথা নাড়ল। মেহেরুন নাহার রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। তানিয়ার ডাক শুনে নাস্তার ট্রে হাতে দ্রুত ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে তানিয়াকে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি পড়ে শোনা তো।’

তানিয়া অতলের দিকে তাকিয়ে অনুমতি নেবার ভঙ্গিতে বলল,’ভাইয়া, পড়ব?’

তবে সে প্রশ্ন করলেও অতলের জবাবের অপেক্ষা না করে পাঁচটা চিঠির মধ্যে একটা চিঠি খাম খুলে পড়তে শুরু করল।

দ্য গ্রেট ম্যাজিশিয়ান,

এই সম্বোধনটাই যথার্থ বলে মনে হয়েছে আমার। আমি তাসনিম। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে আমার। মেয়ে বলে হয়তো দ্রুত বোঝাটা ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন আমার বাবা-মা আর ভাইয়েরা।
বিয়ের পরে নতুন সংসারে এসেই আমি প্রতিটি পদে পদে বুঝতে পারলাম মেয়েদের জীবন কতোটা কঠিন! বিয়েতে যৌতুক দিতে গিয়েই বাবার আবস্থা নাজেহাল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এতেও ক্ষুধা মেটেনি আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের। এই সত্যটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম বিয়ের তিন মাসের মধ্যেই। শাশুড়ির অকারণ অত্যাচারের কারণ প্রথমদিকে বুঝতেই পারতাম না। স্বামীর অন্যায়ভাবে গায়ে হাত তোলার অর্থ হিসেবে নিজের ত্রুটি খুঁজে ফিরতাম। তাদের প্রচ্ছন্নভাবে পুনরায় অর্থের দাবীর ব্যাপারটা আমি ধরতেই পারলাম না। কী বোকাটাই না ছিলাম আমি! এত অত্যাচার স্বত্ত্বেও যখন আমি মুখ বুজে পড়ে রইলাম তখন তাদের চাওয়া আর প্রচ্ছন্ন থাকল না। প্রকাশিত হয়ে গেল আরও জঘন্যতমভাবে। বাবা-মা আর ভাইদেরকে জানালেও তাদের কিছুই করার ছিল না, তাদের অবস্থাও নুন আনতে পানতা ফুরায় মতন। একটা সময় শ্বশুড়বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে চাইলাম নিজের বাবার বাড়ি। তখন জানতে পারলাম বিয়ের দিন ফেলে আসা বাড়িটা আর আমার নেই। সেখানে আমার আর জায়গা হবে না। এদিকে শ্বশুরবাড়িতে আমার উপর করা শারীরিক আর মানসিক অত্যাচার বাড়তেই থাকল। এতোটাই বাড়ল যে আমি নিজেকে শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। বারবার মরার চেয়ে একবার মরাটাই আমার কাছে শ্রেয় মনে হলো!
ঠিক তখনই আপনার একটা স্পিচ শুনলাম। কী অদ্ভুত সম্মোহন করলেন আপনি! আমি মৃত্যুর পথ বেছে নেবার কথা ভুলে গেলাম। যদিও
আমি খুব করে চাইছিলাম আপনার কথাগুলোকে গুরুত্ব না দিতে তবুও মাথা থেকে সরাতে পারছিলাম না। আপনার বলা প্রতিটা কথা আমাকে ভাবতে বাধ্য করল। আমি উপলব্ধি করতে সক্ষম হলাম
আপনার প্রতিটা কথাই সত্য। যে কষ্টের হাত থেকে বাঁচতে আমি মৃত্যুর পথ বেছে নিচ্ছি সেই কষ্ট থেকে তো পিছু ছাড়বে না। অবশেষে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসলাম। আপনি যো সবসময় বলেন, বি ইউ, বি বোল্ড। এই কথাটা খুব কাজে দিয়েছে। আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছি। আপনার কারণেই আমি বুঝতে পেরেছি আমার নিজের ভরণপোষণের জন্য আমার না স্বামীর উপর নির্ভর করতে হবে, না আমার বাবা কিংবা ভাইয়ের উপর। ঠিক তখনই জীবনে প্রথমবারের মতো আমি স্বনির্ভর হবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলাম। হ্যান্ডিক্রাফটসের কাজ খুব ভালো পারতাম, অনেকটা খেলার ছলেই শিখেছিলাম। তাই সেটাকেই বেছে নিলাম নিজেকে স্বনির্ভর করার সম্বল হিসেবে। এখন আমি কারও উপর বোঝা নই।

জানেন, একটা অদ্ভুত বিষয় ঘটে গেছে, এই তো কদিন আগে। আমার স্বামী আবার আমার কাছে ফিরে আসতে চায়। সে না-কি তার ভুল বুঝতে পেরেছে! আমি আজ স্বনির্ভর হবার কারণে হয়তো সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে! যদিও আমি জানি আপনার উত্তর কি হবে তবুও প্রশ্ন করছি, আমি কি তাকে দ্বিতীয় একটা সুযোগ দিব?

ইতি
তাসনিম

চিঠি পড়া শেষে তানিয়া রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ‘এই জানোয়ারকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। কি বলো ভাইয়া?’

অতল জবাবে কিছুই বলল না। মেহেরুন নাহার বললেন, ‘একটা সুযোগ দেওয়া উচিত তাকে।’

আশরাফ হোসেন এতক্ষণে নীরবতা ভেঙে বললেন, ‘ওকে আর একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। কী বলিস বাবা?’

অতল স্মিত হাসল। ওর সবাই বুঝেছে ওর উত্তর কী হতে পারে। তবুও এ নিয়ে বেশ অনেকক্ষণ আলোচনা চলবে। এ নিত্যদিনের নিয়ম। অতল হাসে ওদের কাণ্ড দেখে। অতল উঠে যাচ্ছিল তখন তানিয়া আবারও ডেকে বলল, ‘ভাইয়া আরও চারটা চিঠি আছে তো। শুনবে না?’

ব্যস্ত ভঙ্গিতে অতল বলল,’না, এখন সময় নেই। আমার রুমে রেখে দিস। রাতে পড়ব।’

তৃতীয়বার সুইসাইড এটেম্পট করার পরেই অতলের জীবনের সবচাইতে বড়ো টার্নিং পয়েন্ট আসে। নিজের জীবন শেষ করার সেটাই ছিল সর্বশেষ প্রয়াস। তারপর থেকে অতল কেবল জিতেছে, হারেনি। অতল এখন ভাবে, ভাগ্যিস বিধাতা তাকে সুযোগ দিয়েছিলেন তিন তিন বার! যেখানে মানুষ তাকে একটা দ্বিতীয় সুযোগ দেয়নি, সেখানে বিধাতা তাকে তিনবার পৃথিবীর বুকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ দিয়েছেন। সত্যিই তিনি মহান, মহামহিম, অন্তর্যামী। আর শেষবার তার জন্য আলোকবর্তিকা হাতে দাঁড়িয়েছিল তারই এঞ্জেল, বহ্নি। বহ্নির লেখা চিঠি অতলের ভাবনাকে অন্য স্রোতে ভাসিয়েছিল। তার রেখে যাওয়া অপরাজিতাগুলো থেকে সে শক্তি সঞ্চয় করেছিল।

অফিসে বসে অতল তার জীবনের অতীত অধ্যায়ের পাতাগুলোতে উঁকি দিল। হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ পাবার পরে অতল যখন বহ্নির রেখে যাওয়া শেষ স্মৃতিটুকু আঁকড়ে ধরল তখনই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে ঘুরে দাঁড়াবে।

‘আমার কিছুই নেই, আমি নিঃস্ব, আমাকে কেউ ভালোবাসে না।’ এমন আস্ফালন কেবল দুর্বল, মেরুদণ্ডহীন মানুষেরাই করে থাকে। অতল মেরুদণ্ডহীন নয়।

সে প্রথমেই একজন সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হয়। দীর্ঘ নয় মাস ধরে কাউন্সেলিং করে। অবশেষে তার মানসিক অবস্থা উন্নত হয়। আগে যেসব চিন্তা তাকে অন্ধকারের অতলে ডুবিয়ে রাখত, কাউন্সেলিং শেষে সেসব চিন্তার কারণে সে শক্তি পেত। তিনবছর পড়াশুনা ছাড়া অন্য কোনোদিকেই মনোযোগ দেয়নি। কারণ সে বুঝেগিয়েছিল ফেইস ভ্যালু কী জিনিস!

মানুষের কর্ম মূল্যায়নের পূর্বে তার ফেইস ভ্যালু মূল্যায়ন করা হয়। এটাই বাস্তবতা। তাই সে নিজের পরিচয় তৈরী করার পেছনে নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়েছে। যেদিন গেজেট হবে বলে সম্ভাব্য ডেট দিলো সেদিন সে তার পুরনো মোবাইল নাম্বারটা সচল করে রেখেছিল। কারণ সে জানত-সে জিতবেই। হলোও তাই। সেদিন পরিচিত-অর্ধপরিচিত-অপরিচিত সকলের কাছ থেকে ফোন পেয়েছিল অতল।

প্রশাসন ক্যাডারে প্রথম হয়ে রেকর্ড করেছে সে। ব্যর্থতার ট্যাগ পাওয়া ছেলেটা ফার্স্ট হয়ে গেল! সেদিন থেকে শুরু হলো তার অন্য অন্যজীবন। জয়েন করার পূর্বে সে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের নিয়ে কাজ করা শুরু করল, বিশেষ করে সমাজে পাগল উপাধিখ্যাত মানুষদের জন্য সে কাজ করা শুরু করেছে। যখনই কোনো পাগল মহিলাকে দেখে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। ভাবে, এই বুঝি তার মা। শত চেষ্টাতেও সে তার চোখকে সিক্ত হওয়া থেকে এড়াতে পারে না। এ এক ভীষণরকমের জ্বালা । এটা থেকে বাঁচার জন্য সাথে একটা কালো গ্লাস রাখে সে। সে জানে, সবার কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতেই নেই।

আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ পথটা মানুষ কেন বেছে নেয় অতলের কাছে তা আর অজানা নয়। তাই সে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গিয়ে আত্মহত্যা বিষয়ক স্পিচ দিয়েছিল। যাতে কেউ কখনও সেই পথে পা না বাড়ায়। তার স্পিচটা এতোটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে শেষপর্যন্ত মোটিভেশনাল স্পিকারের খাতায় তার নাম উঠে গেল। অতল সবচাইতে বেশি শান্তি পায় তখন–যখন কেউ তার স্পিচ শুনে আত্মহত্যা থেকে ফিরে এসেছে জানিয়ে তাকে চিঠি লিখে। অনেকে তাদের সমস্যার কথা জানিয়েও অতলকে চিঠি লিখে। অতল সেসব সমস্যার সমাধান করে দেয়।

রাত যখন গভীর হয় তখন অতল সবার চিঠিগুলো পড়ে। প্রতিটা চিঠি পড়ার পরে একটা মিশ্র অনুভূতিতে তার মন ভরে যায়। যখন মানুষের সমস্যাগুলো পড়ে তখন নিজের অতীতে ফিরে যায় সে। সর্বোচ্চটুকু দিয়ে তাদের সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করে সে।

এতো ব্যস্ততা শেষেও একসময় একাকীত্ব ভর করে তার উপরে। আর তখনই তার অবাধ্য মন তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় তার জীবনে দেখা নীল পরীর কথা। তবে মনটা প্রশান্তিতেছেয়ে যায় যখন দেখে একটা যোগ্য হাতেই সে তার এঞ্জেলকে সমর্পণ করেছে! এর থেকে বেশি কিছুই চাওয়ার নেই, পাওয়ারও নেই।
__________________________

নওশীন হক ভীষণ খুশি হয়েছেন রাদিদের জন্য। নীরা শুধু রাদিদ আর অতলের গল্প বলে বেড়ায় সবার কাছে। আফরিনের স্বভাবে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। সে এখন নীলাভ্রকে চাপ দেয় শ্বশুরবাড়িতে ফিরে আসার জন্য। কিন্তু নীলাভ্র সেসব কথা পাত্তা দেয় না। যেই অতলের পিছনে লেগেছিল সে সারাজীবন আজ তার আকাশচুম্বী সফলতা। এসব দেখে তার অস্বস্তি হয়, ঈর্ষা হয়। তার বাবাও নিজের ভুল স্বীকার করেছেন। এতে তার আরও বেশি রাগ হয়। যাকে সে হারাতে চেয়েছিল। সে হেরে গিয়েও জিতে গেল । এটা তার সহ্য হয় না।

______________

চারিদিকে আলোকিত হয়ে আছে। চারপাশে কত শত মানুষ। বহ্নি আর রাদিদ যখন গেইট দিয়ে ঢুকছিল তখন অনেকেই অটোগ্রাফের জন্য ভিড় জমাল। ভেতরে ঢুকেই আশফাক, নীলা, পিউ আর টিয়াকে দেখতে পেল তারা। তাদের পাশের দুটো সিটে পাশাপাশি বসল রাদিদ আর বহ্নি। পিউ তার বড়ো মামাকে দেখে বাবার পাশ থেকে উঠে গিয়ে মামার পাশে বসল। নীলা হেসে বলে উঠল, ‘এমন মামা পাগল মেয়েটা।’

পিউকে দেখে টিয়াও উঠে গিয়ে রাদিদের পাশে বসল। আশফাক তখন হাসতে হাসতে বলল, ‘আর টিয়া হলো বোন পাগল।’

নীলা রংধনুকে কোলে নিয়ে আদর করল। একটু পরেই বাবার কোলে আসার পাঁয়তারা শুরু করল মেয়েটা।

রংধনু বাবার কোলে বসে ইচ্ছেমতো প্রশ্ন করেই চলেছে। বহ্নি অবাক হয়ে রাদিদের ধৈর্য দেখছে। মেয়েটা এত বেশি প্রশ্ন করে যে অন্য যে কেউ হলে বিরক্ত হয়ে যেত। অথচ রাদিদ মেয়ের সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।

শিহরণ বহ্নিকে বলল, ‘কেমন আছে আমার বার্বি ডলটা?’

বহ্নি হেসে বলল, ‘ভালো আছি, ভাইয়া। বর্ণ কোথায়?’

বর্ণ লাফিয়ে উঠে বলল, ‘এই তো আমি আগুন ফুপ্পি!’

বর্ণের কথা শুনে সবাই হেসে ফেলল। শিহরণ ছোঁয়া, বহ্নি আর রাদিদকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমি জানতাম, এই অ্যাওয়ার্ডটা রাদিদই পাবে।’

শিহরণের কথায় ওরা মাথা নাড়ল। বহ্নি রংধনুকে নিয়ে উঠে তার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে চলে গেল।

ছোঁয়ার চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে অন্য এক অসাধারণ মানুষকে। বর্ণ মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘মা, তুমি কাকে খুঁজছ?’

শিহরণ হেসে বলল, ‘তোমার ম্যাজিশিয়ান চাচ্চুকে খুঁজছে।’

বেশ কিছুক্ষণ পর অতলকে আসতে দেখা গেল। তার সাথে আয়মানকেও দেখা গেল। অতল এসে শিহরণের পাশে বসল। সহাস্যে বলল, ‘হেই ব্রো! হোয়াটস্ আপ?’

শিহরণ অতলকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ আ’ম নট দ্যাট গুড লাইক অ্যা ম্যাজিশিয়ান।’

অতল হেসে ফেলল। বলল, ‘তোর ওই এক কথা। আমাকে আর কত শুনতে হবে কে জানে!’

বর্ণ আদুরে গলায় বলল, ‘চাচ্চু, তুমি এখন বাসায় আসো না কেন?’

অতল বর্ণকে কোলে নিয়ে আদর করে বলল, ‘এখন থেকে আসব চাচ্চু।’

অ্যাওয়ার্ড রিসিভ করার জন্য রাদিদের নাম অ্যানাউন্স করা হলে সে মঞ্চে গিয়ে অ্যাওয়ার্ডটা রিসিভ করে বলল,’আই ওয়ান্ট টু ডেডিকেট দিস অ্যাওয়ার্ড টু মাই বেটার হাফ, রিতিকা আহমেদ বহ্নি। এই মানুষটিকে স্মরণ করেই আমি আমার সমস্ত লেখা লিখেছি, তাই এই মানুষটিই আমার অণুপ্রেরণা ছিল, এখনও এই অসাধারণ মানুষটিই আমার সমস্ত লেখার পেছনের অনুপ্রেরণা। আ’ম গ্রেটফুল টু হার, আ’ম গ্রেটফুল টু মাই ফ্যানস ফর দ্যা লাভ দে হ্যাভ গিভেন মি। থ্যাংক্স আ লট ট ইউ অল।’

বহ্নি রংধনুকে এক হাতে ধরে স্টেজে গেল। রাদিদ অ্যাওয়ার্ডটা বহ্নির হাতে তুলে দিল। রংধনু তালি দিচ্ছিল। বর্ণও ছোঁয়ার কোল থেকে নেমে গিয়ে দৌড়ে স্টেজে উঠে পড়ল। বহ্নির দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। সাথে সাথেই অশ্রুসিক্ত হলো শিহরণ, ছোঁয়াসহ আরও অনেকের চোখ। অতল তখন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিল। তার চোখ থেকে কালো গ্লাসটা খুলে সকলের অগোচরে একটা টিস্যু পেপার দিয়ে চোখ মুছে নিল।

অনুষ্ঠানে প্রায় শেষের দিকে অনেকেই যখন চলে যাচ্ছিল ঠিক তখন অতলের দিকে নজর পড়ল বহ্নির। অতলকে দেখে বহ্নির এক অদ্ভুত অবর্ণনীয় অনুভূতি হলো। সে চট করে একটা কাগজে কিছু একটা লিখে আয়মান ডেকে চিরকুটটা অতলকে দিতে বলল।

ছোঁয়া, শিহরণ, মায়া আর ফায়াজ এক কোণে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। অতল সেখানে যোগ দিয়ে
কৌতুকের স্বরে বলল, ‘আমার দোয়া তাহলে কাজে লেগেই গেল। কী বলো?’

মায়া বুঝতে পারল না অতল কী বলতে চাইছে। সে বলল, ‘মানে?’

‘ছোটোবেলায় একবার দোয়া করেছিলাম।তুমি যেন খুব ভালো বর পাও। আমার দোয়া তো ফলে গেল।’ কথাটা শেষ করেই অতল হাসতে লাগল। ছোঁয়া আর শিহরণও ওর হাসির সাথে যোগ দিল।

ফায়াজ তখন মজা করে বলল, ‘ভাগ্যিস দোয়া করেছিলে ভাই। তাই তো এমন রত্ন খুঁজে পেলাম অবশেষে।’

প্রিয় যেন আকাশ ফুঁড়ে এসে পড়ল। বলল, ‘এই তুই মনে হয় আমাকে বদদোয়া দিছস!’ সাইফের দিকে ইশারা করে বলল, ‘নাহলে এমন হাবাগোবা কেউ আমার কপালে আসলো ক্যামন করে।’

প্রিয়র কথা শুনে ছোঁয়া, শিহরণ, অতলসহ বাকি সবাই আবারও হাসতে থাকল। মোহনা আর ফাহমি বিদেশে থাকায় তারা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারল না। শিহরণ তবুও ফোন করে বলেছিল চেষ্টা করে দেখার জন্য। কিন্তু দুজনের আসা একসাথে ম্যানেজ করা হয়ে উঠেনি। সবাই যখন গল্পে মশগুল এমন সময় আয়মান এসে অতলকে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল। চিরকুটটা হাতে নিয়ে অতল বন্ধুদের থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে চিরকুটটা পড়তে শুরু করল।

‘এখনও কি গোধূলী দেখো তুমি? শেষ বিকেলের রংধনুতে এখন ঠিক কয়টা রং দেখতে পাও?
তোমার দেখা রংধনু কি এখনও রঙিন না-কি বিবর্ণ?’

বি.দ্র. এঞ্জেল এমনি এমনিই বলতে, মন থেকে কখনও বিশ্বাস করোনি। না হলে এঞ্জেলকে এতোটা দুর্বল ভাবতে না। জানো না, এঞ্জেলরা সবকিছু জাদু দিয়ে ঠিক করে ফেলতে পারে। তোমার এঞ্জেল এখন সবসময় হাসতে শিখে গেছে, সমস্ত কষ্ট বুকে চেপে রেখেও সে হাসে। এবার বিয়েটা করেই ফেলো।

চিরকুটটা পড়া শেষ করে এক কোণায় গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকল অতল। তারপর পকেট থেকে একটা প্যাড বের করে লিখতে শুরু করল। ঠিক সে সময় রংধনু এসে ওর সামনে মাথা ঝুঁকে দাঁড়াল। অতল চিরকুটটা লেখা শেষ করে রংধনুকে আদর করে বলল, ‘কিছু বলবে মামুণি?’

রংধনু হাসল শুধু। অতল ওকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করল। সে জানে বাচ্চা মেয়েটা রাদিদ আর বহ্নির অংশ। কেমন মায়াভরা চাহনি মেয়েটার। ঠিক যেন বহ্নির স্মল ভার্সন! অতল পকেট থেকে একটা ক্যাডবেরি চকলেট বের করে রংধনুকে দিল।

তারপর তার লেখা চিরকুটটা আয়মানকে দিয়ে পাঠিয়ে দিল বহ্নির কাছে। বহ্নি এক মুহূর্তও দেরি না করে পড়তে শুরু করল।

‘আমার এঞ্জেলকে ছাড়া কি গোধূলীকে ভালো লাগতে পারে? জানিস, আমার আকাশে এখন আর রংধনু উঠে না। মাঝে মধ্যে একটা দুইটা রংধনু উঠলেও তা হয় বিবর্ণ। বিবর্ণ রংধনু দেখতে কার ভালো লাগে বল তো?’

বি.দ্র. আমার জীবন্ত নীল পরীটাকে এখনও ভীষণ ভালোবাসি। হারিয়ে ফেলেছি তাকে। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা কখনোই ভাবিনি, ভাবতেও পারি না। বুকের বাঁ পাশটাতে চিন চিন করে ব্যথা করে। আমি আবার সাধারণ কোনো মানুষকে বিয়ে করতে পারব না। আমার এঞ্জেলই চাই। এঞ্জেল পেলে ঠিক বিয়ে করে নেব, দেখে নিস।

অতলের লেখা চিরকুটটা পড়া শেষ হতেই বহ্নি দেখতে পেল অতল চলে যাচ্ছে। তার পাশেই আয়মান। সবাই অতলকে ছেড়ে চলে গেলেও আয়মান ছেড়ে যায়নি। সবসময় তার পাশে থেকেছে। অতল ড্রাইভারকে গাড়ি ছাড়তে বলল। গাড়ি চলেছে অজানা কোনো গন্তব্যে।
হঠাৎ করেই অতল গাড়ি থামাতে বলল। গাড়ি থেকে নেমেই অতল দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে থাকে আকাশের বুকে ওঠা রংধনুটা। আয়মান তার পাশে দাঁড়াতেই সে প্রশ্ন করল, ‘আয়মান, দেখতো রংধনুটাতে আজকে কয়টা রঙ আছে? আমার কাছে বিবর্ণ লাগছে কেন? আমি কি কালার ব্লাইন্ড হয়ে যাচ্ছি?’

__________________________

ছোঁয়া, শিহরণ, রাদিদ, বহ্নি, আশফাক, নীলা সাব্বির আহমেদ আর সাবিহা সাবরিন সবাই ড্রয়িং রুমে বসে টিভিতে একটা প্রশাসনিক কাজের অনুষ্ঠান দেখছে।
অনুষ্ঠানে এক অসাধারণ বক্তৃতা দিয়েছে অতল।
সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সেটা দেখে সাবিহা সাবরিন হিসাব মেলাতে পারেন না। পিউ তার মোবাইলে ভিডিয়ো দেখছে। টিয়া রংধনু আর বর্ণ মিলে ওকে ডিস্টার্ব করতে লাগল। তাদের আবদার হলো তাকে তাদের সাথে খেলতে হবে। কিন্তু পিউ কোনোমতেই খেলবে না। সে এখন স্পিচের ভিডিয়ো দেখবে। ওদের বিরক্তিতে থাকতে না পেরে সে সাবিহা সাবরিনের পাশে এসে বসল।
পিউ অতলের একটা স্পিচের ভিডিয়ো দেখছিল। সাবিহা সাবরিন আনমনেই পিউর মোবাইলটা নিজের হাতে নিয়ে ভিডিয়োটা দেখতে লাগলেন।

মঞ্চে দাঁড়িয়ে অতল বলে চলেছে,

‘জীবনে একবার ব্যর্থ হওয়া মানেই বারবার ব্যর্থ হওয়া নয়। বারবার ব্যর্থ হওয়া মানে কখনোই জিতবেই না এমনও নয়। ব্যর্থতা সবসময় আমাদেরকে দুর্বল করতে আসে না, মাঝেমধ্যে ব্যর্থতা আমাদেরকে শক্ত, মজবুত করতেও আসে। এক একটা ব্যর্থতা এক একটা অভিজ্ঞতা।’

কথাগুলো বলার পরপরই চারিদিকে হাততালি পড়তে শুরু করল। অতল বলতে শুরু করল,

‘এই কথাগুলো আমি আমার জীবন দিয়ে শিখেছি। উত্তরাধিকার সূত্র সবসময় বর্তায় না। মাঝেমধ্যে পূর্বপুরুষ ভালো হওয়া সত্ত্বেও উত্তরসূরি অধঃপতনে যায়। আমাকে বিচার করার ক্ষেত্রে আমাকেই বিচার করতে হবে।’

‘Everyone deserves a second chance. No matter who is he or what is he! Get them prove at least. Don’t cumber your thoughts upon them. It destroys their’s potentiality. So keep you and your thoughts safely , so that it can’t harm anyone.’

সাবিহা সাবরিনের মনে হলো অতল শেষ কথাগুলো তাকে উদ্দেশ্য করেই বলেছে। তিনি চোখ তুলে তাকাতে পারছেন না এই ছেলেটার দিকে। এত আত্মবিশ্বাস, এত আভিজাত্য, এতোটা সাফল্য অর্জন করাটা কীভাবে সম্ভব হলো এই ছেলেটার পক্ষে! এটা তার জন্য বিস্ময়! হতাশা, হীনমন্যতা, নিজের বাবা-মায়ের কালো অতীত কীভাবে ভুলতে পারল ছেলেটা! কীভাবে সমস্ত বাধা পেরিয়ে এতোটা জনপ্রিয় হলো সে। এই ছেলেটাকে দেখে কে বলবে-একটা সময় সে বারংবার সুইসাইড করতে চেয়েছে!

অতলের এতোটা পরিবর্তন দেখে আজ সাবিহা সাবরিন অনুতপ্ত। তিনি এইটাও জানেন রাদিদের লেখা উপন্যাস প্রকাশিত হবার পেছনেও এই ছেলেটার হাত আছে। একা হাতে সবকিছু সামলানোর এক অসাধারণ ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে এই ছেলেটা। যে ছেলেটা একসময় হতাশায় ডুবে মরেছে সেই আজ হতাশাগ্রস্ত মানুষকে আলোর পথে আহ্বান করছে! অথচ কী অদ্ভুত, মানুষ তার আহ্বানে সাড়াও দিচ্ছে! এতোসব উপাধি, এতোসব অর্জন!

অতলের বলা শেষ কথাটা সাবিহা সাবরিনের কানে বেজে চলেছে, ‘Everyone deserves a second chance. No matter who is he or what is he.’

সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না, পূর্ণতাহীনতা ভালোবাসার গভীরতা বা সৌন্দর্য কমাতে পারে না, পারে না বিশুদ্ধ ভালোবাসাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে কিংবা মিথ্যে প্রমাণ করতে। কিছু কিছু ভালোবাসা অপূর্ণ হয়েও পূর্ণতার সাক্ষর রেখে যায়। অতলের দেখা বিবর্ণ রংধনুর রঙ হয়তো রঙিন হবে কোনো এক সময়।

সমাপ্ত

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে