ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৬১+৬২

0
1505

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৬১

ফাহমিদা বেগম মলিন মুখে সঙ্কোচ চিত্তে বসে আছেন। অশ্রুতে টলমল চোখজোড়ায় কৃতজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট দৃশ্যমান। বেশ কিছুক্ষণ দৃষ্টি নত রাখার পরে তিনি সাব্বির আহমেদের দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকালেন।

সাব্বির আহমেদ কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছেন ফাহমিদা বেগমের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা পালন শেষে ফাহমিদা বেগম শাড়ির আঁচলের খুটে চোখের জল মুছে বললেন, ‘ভাই, এটা যে আপনার মহত্ত। তবে এই অবস্থায় বিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে?’

‘এখানে কোনো মহত্ত্ব নেই আপা। মহত্ত্ব তো সেখানে থাকে যেখানে নিজের কোনো স্বার্থ থাকে না আমার তো স্বার্থ আছে। তাই না?’

ফাহমিদা বেগম অবাক হয়ে সন্ধিহান দৃষ্টিতে তাকালেন সাব্বির আহমদ দিকে। এই মুহূর্তে তাকে হতবিহ্বল দেখাচ্ছে। সাব্বির আহমেদ হেসে বললেন, ‘ভয় পাবেন না। স্বার্থ আছে। তবে সব স্বার্থ ভয়ংকর হয় না। কিছু স্বার্থ মধুরও হয়। সেসব স্বার্থ রক্ষা করলে পরিবারের সকলের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। আমার ছেলের খুশিই আমার স্বার্থ।’ সাব্বির আহমেদ থামলেন। ফাহমিদা বেগমের বুক থেকে একটা ভারী পাথর যেন সরে গেল।

ফাহমিদা বেগম বললেন,’ঠিক বলেছেন, ভাই।’

সাব্বির আহমেদ পুনরায় বলতে শুরু করলেন, ‘ছেলে মেয়ে দুটোর পাগলামি সম্পর্কে তো নিশ্চয়ই জানেন। এই পাগল দুটো একসাথে না থাকলেই খারাপ হবে। এরা যত বেশি একসাথে থাকবে, ছোঁয়ার ভাল হবার চান্স তত বেশি বাড়বে।’ একটু থেমে মুচকি হেসে বললেন, ‘এই পাগল দুটো একে অপরের শক্তি স্বরূপ।’

ফাহমিদা বেগম অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন তার সামনে বসা অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষটির দিকে। তিনি মনে মনে ভাবছেন কী অসাধারণ তার বাচন ভঙ্গি, কী অসাধারণ তার চিন্তা-চেতনা! ছেলের অনুভূতিকে কী দারুণভাবেই না বুঝতে পেরেছেন। শিহরণের অনুভূতি কিংবা ছোঁয়ার প্রতি তার ভালোবাসা ফাহমিদা বেগমের চোখ এড়ায়নি। শিহরণ যে মাঝেমধ্যে ছোঁয়ার সাথে দেখা করতে আসতো তা তিনি জানতেন। তবে তাদের বুঝতে দিতেন না। এই ছেলেটার উপর তার কেন যেন কখনও অবিশ্বাস জন্মেনি। ছোটো থেকেই তো দেখেছেন। পার্থক্য শুধু একটাই তখন তার দেখার নজর ভিন্ন ছিল, বিচার করার মানদণ্ড ছিল অতি নিম্নমানের!

সাব্বির আহমেদ বাম হাতে পরে থাকা ঘড়িতে সময় দেখলেন। তারপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আপনার মতামত তো জানা হলো না। আপত্তি থাকলে বলুন। পারস্পরিক সমঝোতায় সমাধানে আসা যাবে।’

‘কীসের আপত্তি ভাই!’ ফাহমিদা বেগম লজ্জাবনত কণ্ঠে বললেন, ‘আপনার ঘরে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিতে পারা তো আমার জন্য ভাগ্যের ব্যাপার।’

‘নিজের মেয়ে’ শব্দটা কানে বাজতে থাকল ফাহমিদা বেগমের কানের কাছে। তিনি পরক্ষণেই ভাবলেন সবকিছু জানানো উচিত। পরে কোনো সমস্যা হোক তা তিনি চান না। অপরাধীর ভঙ্গিতে তিনি বললেন,’ছোঁয়া কিন্তু আমার নিজের মেয়ে নয়।’

সাব্বির আহমেদ স্মিত হেসে বললেন, ‘বিষয়টা খুব গোপনীয় কিছু নয়। এই বিষয়টা আমার কাছে অজানাও নয়। যেহেতু ওর মা বেঁচে নেই তাই এখন আপনিই ওর মা। আর ও আপনার নিজের মেয়ে। এই তথ্য প্রকাশে কোনো প্রকার সঙ্কোচ করবেন না।’

ফাহমিদা বেগম বললেন, ‘আপনার কাছে ঋণী করে গেলেন। আপনার এই ঋণ কখনো ভুলব না।’

‘এইটা কিন্তু বাড়াবাড়ি বেয়ান। আপনাকে একটু আগেই তো বলেছি স্বার্থ আমার আছে। যেখানে স্বার্থ থাকে সেখানে ঋণী হবার সুযোগ নেই।’ স্মিত হাস্যে আবারও বললেন, ‘ভালোবাসাহীন জীবন ধুকে ধুকে মরে যাবার শামিল। আমি চাই না আমাদের সন্তানরা ধুকে ধুকে মরুক।’

_____________

শিহরণ খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘প্রিয়তা, আমরা শীঘ্রই আমাদের কাঙ্ক্ষিত বৈধ সম্পর্কর বাঁধনে আবদ্ধ হতে চলেছি।’

শিহরণের মুখ থেকে খবরটা শুনে ছোঁয়ার চোখ জোড়া ক্ষণিকের জন্য খুশিতে চকচক করে উঠলেও পরক্ষণেই সে বেঁকে বসল। তেজী গলায় বলল, ‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না শিহরণ।’
কথাটা বলেই ছোঁয়া মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

শিহরণ অবাক হল না। এইটা চরম প্রত্যাশিত ছিল। এই কঠিন পরিস্থিতিতেও সুযোগ পেয়ে সেও একটু মজা নিতে ভুল করল না। সে দুঃখী ভাব নিয়ে বলল, ‘বৈধ সম্পর্কে আবদ্ধ করার জন্য তো আমি তোমাকে জোর করতে পারব না। তোমার পরিবর্তে অন্য কাউকেই না হয় নিজের সঙ্গী বানিয়ে নেব। আব্বুর ফাইনাল ডিসিশন বলে কথা। মানতে তো হবেই।’

ছোঁয়া তৎক্ষণাৎ মুখটা শিহরণের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে শিহরণের দিকে তাকাল। শিহরণ ততক্ষণে মুখটা গম্ভীর করে ফেলেছে। ছোঁয়া জহুরি চোখে পরখ করছে তার সামনে বলিষ্ঠভাবে বসে থাকা ছেলেটির সবুজাভ চোখ জোড়া। সেই চোখ জোড়াতে কৌতুকের ছিঁটেফোঁটাও খুঁজে না পেয়ে সে মুখটা আবার ফিরিয়ে নিল। ব্যথাতুর গলায় বলল, ‘তোমাকে কে বেঁধে রেখেছে? যাও যাকে খুশি তাকে বিয়ে করো। আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। ব্যস, আমার কথা শেষ।’

ছোঁয়ার কথা শুনে শিহরণ হাসছে। হাসতে হাসতেই বলল, ‘সকাল থেকে পেটে নিশ্চয়ই কিছু পড়েনি। তাই মেজাজ চড়ে গেছে। তাই না?’

ছোঁয়া উঠে বসার চেষ্টা করল। পারল না। শিহরণ বেড উঁচু করে তার চোখ বরাবর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ‘আমি তোমার ভালোবাসা পেয়েছি, এবার সম্পূর্ণ তোমাকে চাই, তোমার উপর আমার অধিকার চাই।’

ছোঁয়া শিহরণের চোখে চোখ রাখছে না। ও চোখেই তো তার সর্বনাশ হয়েছিল, সেই স্কুল জীবন থেকেই। আবার সেই চোখের দিকে তাকালে সে যে তার এই করুণ পরিস্থিতিতেও নিজেকে আটকে রাখতে পারবে না। শিহরণ ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘আমার চোখের দিকে তাকাও, প্রিয়তা।’

ছোঁয়া মুখটা কোনোভাবেই সোজা করছে না। শিহরণ এবার ব্যাথাতুর গলায় বলল, ‘এখন বুঝি এই চোখের প্রতিও তোমার বিতৃষ্ণা চলে এসেছে? একটা দুর্ঘটনা এক মুহূর্তেই সব পরিবর্তন করে দিয়ে গেল! আমাদের এত বছরের ভালোবাসা কি তবে এতোটাই ঠুনকো ছিল?’

ছোঁয়ার চোখ জোড়া অশ্রুতে টলমল করছে। সে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। বুক চিরে হাহাকার বেরিয়ে এলো। কান্না ভেজা গলায় বলল,’আমি আর হাঁটতে পারব না, শিহরণ। প্লিজ এক্সেপ্ট দ্যা ফ্যাক্ট।’

‘আই ডু, প্রিয়তা।’ শিহরণ চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা ঠুনকো নয় যে তোমার হাঁটতে না পারার করণে তা কর্পূরের মতো উবে যাবে। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার হাঁটার ক্ষমতা দেখে তো তোমাকে ভালোবাসিনি কিংবা তোমার সৌন্দর্যের মোহেও পড়িনি।’

ছোঁয়া নির্বাক তাকিয়ে থাকল শিহরণের দিকে। শিহরণ বলল, ‘একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে?”

ছোঁয়া মাথা নাড়াল। শিহরণ বলল, ‘আজ তোমার জায়গায় যদি আমি থাকতাম। অর্থাৎ আমি যদি হাঁটতে না পারতাম তবে কি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে?’

ছোঁয়া তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল, ‘প্রশ্নই আসে না।’ শিহরণ কে সাবধান করতে আদেশের সুরে বলল, ‘এই ধরনের আজেবাজে কথা আর কখনোই বলবে নি।’

বহ্নি টিফিন বক্স নিয়ে ঢুকল। সাব্বির আহমেদ আর সাবিহা সাবরিনও ঢুকলেন কেবিনে।

শিহরণের হাতে টিফিন বক্সটা দিয়ে বহ্নি বলল, ‘ভাইয়া, ভাবির জন্য আমি নিজের হাতে স্যুপ বানিয়েছি। তুমি খাইয়ে দিও।’

শিহরণকে কথাটা বলেই বহ্নি বেরিয়ে গেল। তার অতলের সাথে দেখা করা দরকার। এই ছেলেটা ভীষণ আবেগী। যত্তসব বায়না সব তার কাছে। কে বলবে এই ছেলেটা যে এখনও বাচ্চাদের মতো অভিমান করে তার সাথে। বহ্নি জানে, ছোটোবেলা থেকে আদর-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছেলে-মেয়েরাই বড়ো হয়ে যখন কারও কাছ থেকে একটু ভালোবাসা পায় তখন তারা আরও একটু ভালোবাসা পাবার জন্য নানান ধরনের বায়না করে থাকে। একদম বাচ্চাদের মতো। কেননা তাদের ছোটোবেলার সেই বাচ্চামো টাইপ আচরণ প্রস্ফুটিত হতে বাঁধা পাওয়ায় তা অসময়ে এসে প্রকাশিত হয়। বহ্নির অতলের করা সমস্ত পাগলামি ভাল লাগে। অতল তার জন্য এক আকাশ ভালোবাসা, এক সমুদ্র নীল জলে। যেখানে সে নিঃশব্দে ডুবে যাচ্ছে। যেখানে ডুবে যেতে তার নেই কোনো আক্ষেপ, নেই কোনো দ্বিধা। সেখানে আছে কেবলই ভালোলাগা আর ভালোবাসার সংমিশ্রণের এক গভীর ভাবাবেগ, এক সুগভীর অনুভূতি। বহ্নি অতলের অতলেই তো থাকতে চায়!

সাব্বির আহমেদ ছোঁয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘এখন কেমন আছ, বউমা?’

ছোঁয়া এই সম্বোধনে লজ্জা পেল। সে লজ্জাবনত কণ্ঠে বলল, ‘ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?’

সাব্বির আহমেদ রসিকতা করে বললেন, ‘তোমাদের বিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত আমার ভাল থাকা হবে না, বউমা।’

সাবিহা সাবরিন খুব ভাল করে জহুরি চোখে পরখ করছেন ছোঁয়াকে। ছোঁয়ার এই অবস্থা দেখে তিনি মনে মনে কষ্ট পেলেন কিন্তু মেয়েটাকে নিজের ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে পারছেন না, হয়তো পারবেনও না। হয়তো তাই তিনি প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে আছেন স্বামীর উপর। এরকম হাঁটতে পারার সম্ভাবনা না থাকা একটা মেয়েকে কোন আক্কেলে যে ছেলের বউ বানাচ্ছে তা তিনি কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারছেন না।

_____________________

সাব্বির আহমেদ ভেবেছিলেন ছোঁয়া পুরোপুরি হাঁটতে পারলে তখনই অনুষ্ঠান করা হবে, আপাতত বিয়েটা হয়ে যাক। এত তাড়াহুড়ো করার পেছনে অবশ্য বিশাল একটা কারণও আছে।

সাবিহা সাবরিন রেগে গিয়ে বললেন, ‘এত তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দেবার দরকার কী?’

তখন তিনি শান্ত কণ্ঠে সাবিহা সাবরিনকে জবাব দিয়ে বললেন, ‘আমি আমার বউমাকে যত দ্রুত সম্ভব ঘরে তুলতে চাই। ছেলেকে এভাবে দেবদাসের মতো ঘুরে বেড়াতে দেখতে কোনো বাবা-মায়ের কি ভালো লাগতে পারে, সাবিহা?’

শিহরণ আর ছোঁয়ার বিয়ের কথা শুনে তাদের বন্ধুরা সবাই দারুণ খুশি হলো। সাব্বির আহমেদ কোনো প্রকার আয়োজন ব্যতিরেকে বিয়ে সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন। তবে শিহরণ আর ছোঁয়ার বন্ধুরা তা মানল না। তারা সবাই মিলে ছোটোখাটো একটা আয়োজনও করে ফেলল তারা নিজ থেকেই। অদ্ভুত একটা বিয়ে হওয়ার কারণেই হয়তো সবার মধ্যেই উৎসাহ অনেক বেশি। হাসপাতালেই বিয়ের আয়োজন করা হলো। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করা কঠিন কিছুই ছিল না সাব্বির আহমেদের জন্য। তবে, ছোঁয়ার বিয়েতে ডাক্তার আর নার্সরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিল। পুরো হাসপাতাল জুড়ে একটা ধুম পড়ে গেল। কৌতূহলী চোখের শেষ ছিল না। তবে কোলাহল এড়িয়ে চলার নির্দেশনা ছিল। ছোঁয়ার কেবিনের মধ্যেই সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়ে গেল। সকলের মধ্যেই দারুণ উচ্ছ্বাস।

সবচাইতে অধিক উৎসাহী মনে হলো অতল আর বহ্নিকে। রাদিদ সবকিছুতে থেকেও যেন নেই। তার কারণ দুটো। এক. তার এতদিনের কাঙ্ক্ষিত মানুষটির দেখা পেয়েও হাত ছাড়া হয়ে যাওয়া। দুই. বহ্নি আর অতলের মাঝের খুনসুটি এখন স্পষ্ট দৃশ্যমান। এই জিনিসটা রাদিদের মনকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে। তবুও সে নিজেকে প্রাণপণে সংযত করার চেষ্টা করছে। এটা তো তাকেই করতেই হতো।

বহ্নি আর অতল হেসে হেসে তার সামনে দাঁড়িয়েই কথা বলছে। অতলকে এভাবে প্রফুল্ল দেখে তার ভীষণ ভাল লাগছে। রাদিদ মনে মনে ভাবল, ‘বহ্নি সত্যিই হয়তো জাদু জানে। বিধ্বস্ত অতলকে অন্ধকারের অতল থেকে ঠিক টেনে তুলল। ভালোবাসার মায়াজালে আটকে তার কষ্ট ভুলিয়ে দিল। তাকে হাসতে শেখাল।’ এক অন্যরকম ভালোলাগায় ছেয়ে গেল রাদিদের মন। পরক্ষণেই সে বিড়বিড় করে বলল, ‘ওহে প্রিয়া, তুই কি তবে জাদুনগরীর রাজকন্যা? একবার সেই জাদুর কাঠি আমায় স্পর্শ করিয়ে দে না, আর ভুলিয়ে দে আমায় আমার হৃদয় মন্দিরের প্রাঙ্গণে তোর লাগি স্তুপাকাকারে জমানো সমস্ত ভালোবাসা।’

বহ্নি হুট করে এসেই বলল, ‘রাদিদ ভাইয়া, কী বিড়বিড় করছ? মন্ত্র পড়ছ না-কি?’

রাদিদ স্তম্ভিত হয়ে গেল। নজর এড়িয়ে কৌতুকচ্ছলে বলল, ‘হুম, মন্ত্র পড়ছি। তোর আর অতলের বিবাহের আয়োজনের জন্য।’

বহ্নি কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেল। অতল এসে তাকে উদ্ধার করল। বলল, ‘ওই তোর মন্ত্র পড়া লাগবে ক্যান? আমার আগুনমণিকে আমি কবুল বলে নিজের করে নেব।’ কথাটা শেষ করেই অতল মুগ্ধ চোখে তাকাল বহ্নির দিকে।

রাদিদ কয়েকবার মুখ খুলল আবার বন্ধ করল। কিন্তু বলার মতো কোনো কথাই সে খুঁজে পেল না। অবশেষে সেখান থেকে সরে দাঁড়াল। ভীষণ অসহায় বোধ করছে সে।

পৃথিবীর সবাই ভালোবাসা পায় না। নশ্বর এই পৃথিবীতে সবার সব চাওয়া পূর্ণতা পায় না। কিছুকিছু মানুষের ভালোবাসা পূর্ণতা না পেয়েও অবিনশ্বর হয়ে থাকে। রাদিদের ভালোবাসা না হয় সেই না পাওয়ার দলেই থাকল। ক্ষতি কী তাতে?
রাদিদ নিজেকে প্রবোধ দিল। অথচ তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটার প্রতি সে দুর্বার আকর্ষণে বারেবারে মোহিত হয়, বারেবারে এই অধরা মানবীর প্রেমে পড়ে!

রাতের দিকেই কাজী ডেকে আনা হলো। কোনোপ্রকার আনুষ্ঠানিকতা ব্যতিরেকেই অনাড়ম্বরভাবে ছোঁয়া আর শিহরণের বিয়েটা হয়ে গেল। তবে ছোঁয়াকে আরও বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকার নির্দেশ দিয়েছে ডাক্তার।

কবুল বলার সময় এক অদ্ভুত ভালোলাগায় ছেয়ে গেছে ছোঁয়ার মন। সে কখনোই ভাবেনি, এভাবে তার বিয়ে হবে। তবুও সে আজ ভীষণ খুশি। সবুজাভ চোখ আর ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটা যাকে সে চোরাচোখে দেখেই মনে মনে চেয়ে এসেছে, যার নামে হৃদয়ের মধ্যেখানে ভালোবাসার প্রাসাদ বানিয়েছে, সেই ছেলেটা এখন তার নিজের একান্ত আপনজন। এই ভাবনা ভাবতেই তার মনের মধ্যে ভালোলাগার প্রজাপতিরা গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করল যেন। কবুল বলার সময় চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল নির্দ্বিধায়, প্রাপ্তির আনন্দে।

শিহরণ সেই যে ছোঁয়ার হাত ধরেছিল, এখনও ছাড়েনি। মনে মনে সে বাবার প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ। আজ সে একটা অধিকার লাভ করেছে, একটা বৈধ অধিকার। এই মুহূর্তে নিজেকে আর ছোঁয়াকে তার আলাদা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে তারা যেন ভিন্ন দুটি দেহের এক ও অভিন্ন সত্তা।

খুব সাদাসিধে সাজে বধূ সাজানো হয়েছে ছোঁয়াকে। লাল বেনারসি, মুখে হালকা ক্রিম, চোখে কাজল আর চুল বাঁধা ছাড়া অতিরিক্ত কোনো প্রসাধন বা জাঁকজমক নেই। তবুও এই সাজেই তাকে দেখতে অপরূপা লাগছে, শিহরণের কাছে। ভালোবাসার সবচাইতে বড়ো সৌন্দর্য হয়তো এটাই যে, ভালোবাসা দৃষ্টির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে দেয়। ভালোবাসার মানুষ যেমন তাকে তেমনিভাবেই গ্রহণ করার সাহস যোগায়। ছোঁয়ার হাত নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে রেখে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে এমনই আকাশ পাতাল ভাবছিল শিহরণ। তার কেন যেন এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, ছোঁয়া এখন তার, শুধুই তার।

মায়া শিহরণের কাণ্ড দেখে হেসে বলল, ‘শিহরণ, ছোঁয়াকে কেউ নিয়ে যাবে না তো। সে তোমারই ছিল, তোমারই আছে, তোমারই থাকবে।’ একটু থেমে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,’ফাইনালি, তোদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেল। আ’ম সো হ্যাপি ফর বোথ অফ ইউ।’

সাইফ কী বলবে ভেবে পেল না। সে মুখ হাসি হাসি করে দাঁড়িয়ে আছে। মোহনা ছোঁয়াকে বলল, ‘ছোঁয়া, ইউ আর ভেরি লাকি টু হ্যাভ সাচ আ লাইফ পার্টনার লাইক শিহরণ।’

ফাহমি মোহনার সাথে সুর মিলিয়ে বলল, ‘আই এগ্রি উয়িথ ইউ।’

প্রিয় ফোড়ন কেটে বলল, ‘বাট আই ডোন্ট।’

সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল প্রিয়র দিকে। প্রিয় বলল,’শিহরণ ইজ ভেরি লাকি টু হ্যাভ সাচ আ লাইফ পার্টনার লাইক ছোঁয়া।’

প্রিয়র কথায় সবাই হেসে ফেলল। বহ্নি কাছে এসে বলল, ‘আমি প্রিয় আপুর সাথে একমত।’

অতল আর রাদিদও প্রিয়র কথায় সম্মতি জানাল। অতল বলল, ‘তাহলে কি এখন থেকেই তোমাকে ভাবি ডাকা শুরু করে দেব আমরা?’

বহ্নি সহাস্যে বলল, ‘আমি তো আরও আগেই শুরু করে দিয়েছি।’ তারপর শিহরণের দিকে তাকিয়ে বলল,’ভাইয়া মনে আছে তোমার? ছোঁয়া আপুকে ভাবি ডাকার কারণে আরাভ আমার সাথে ভীষণ রাগ করেছিল। পরে কোনোমতে বুঝালাম যে, তার বউ হলে সে তো আমার ভাবিই হয়। এটা বলার পরে তার রাগ কমল।’

বহ্নির কথা শুনে সবার মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল। একজন নার্স এসে তাদের নিষেধ করতেই সকলে থেমে গেল। হিয়া ছোঁয়ার পাশে বসে বলল, ‘আ’ম সো হ্যাপি ফর ইউ, ছোঁয়াপু।’

অহনা ছোঁয়ার অপর হাতটা ধরে বলল, ‘আমারও খুব ভাল লাগছে তোমার জন্য আপু।’

হিয়া আর অহনা দুজনেই শিহরণকে বলল,’আমাদের আপুর যাতে কোনো কষ্ট না হয়। চকোলেট বয়, ওকে দেখে রাখার দায়িত্ব এখন থেকে আপনার।’

শিহরণ হেসে ফেলল। বলল, ‘চকোলেট বয় বলে সম্বোধন করলে তো চলবে না, শালিকা মহোদয়ারা। এখন তো সম্বোধন পরিবর্তন করতেই হবে।’

হিয়া আর অহনা দুজনেই হেসে ফেলল শিহরণের কথায়। বলল, ‘তা তো অবশ্যই, জিজু।’

ফাহমিদা বেগম কান্নাভেজা কণ্ঠে বললেন,’এখন থেকে আমার মেয়েটার সমস্ত দায়িত্ব তোমার বাবা। ওকে দেখে রেখো।’

শিহরণ মাথা নেড়ে সায় দিল। রুদ্ধশ্বাসে বলল,’আপনি বিশ্বাস করতে পারেন আমায়। আপনার বিশ্বাসের অমর্যাদা হবে না।’

সাব্বির আহমেদ এসে সবাইকে বেরিয়ে যাবার নির্দেশ দেওয়াতে সকলের উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ল। তিনি ছোঁয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘বউমা, আমার পাগল ছেলেটাকে বলো যে এত চিন্তা করার কিছু নেই। তোমাকে কালকেই ডিসচার্জ করে দিবে। রিস্ক নেই। একেবারে শ্বশুরবাড়িতে থেকেই তোমার ট্রিটমেন্ট নেওয়ার ব্যবস্থা করে এসেছি।’

___________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৬২

হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ পাওয়ার পর ছোঁয়াকে শিহরণের বাসায় নিয়ে আসা হলো। ছোঁয়া কম্পিত বুক নিয়ে প্রথম পদক্ষেপ ফেলল তার সবচাইতে প্রিয় মানুষটির ঘরে। শিহরণের রুমেই তার থাকার ব্যবস্থা করা হলো। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট ঠিক করা হয়েছে তার চিকিৎসার জন্য।

ছোঁয়া আসার পর থেকে সাবিহা সাবরিন তার সাথে একটা কথাও বলেননি। সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে চলেছেন তিনি। এই উপেক্ষা বুঝতে ছোঁয়ার কষ্ট হলো না। তাই বিষণ্ন মুখে ব্যালকনিতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল সে। শিহরণ পাশে এসে বসে বলল, ‘আমি জানি আমার প্রিয়তার মন খারাপের কারণ।’

ছোঁয়া তার দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করল, ‘কী কারণ?’

শিহরণ তার পাশে বসে স্মিত হেসে বলল, ‘ আম্মুকে নিয়ে চিন্তা করো না। আম্মুর অভিমান হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে তোমার ভালোবাসার উষ্ণতা পেলে সেই অভিমানের বরফ ঠিক গলে যাবে।’

ছোঁয়া কৃতজ্ঞচিত্তে তাকাল শিহরণের দিকে। এই অসাধারণ চিন্তার ছেলেটি এখন তার স্বামী, তার একান্ত আপনজন। এই ভাবনা হৃদয়ে প্রশান্তির পরশ দিয়ে যাচ্ছে। শিহরণ হুট করেই ছোঁয়ার কপালে তার ভালোবাসার পরশ ছুঁয়ে দিল। ছোঁয়া চোখ বন্ধ রেখে পরম আবেশে ঠিক সেইখানটাতে চেপে ধরে রাখল বেশ কিছুক্ষণ।

শিহরণ তখন মুচকি হেসে রসিকতা করে বলল, ‘তুমি চাইলে আমি ঠিক ওইখানটাতে আমার অধরদ্বয় চেপে রাখতে পারি। আমার অবশ্য কোনো অসুবিধা হবে না। বরং ভীষণ ভালো লাগবে। তুমি শুধু অনুমতি দিলেই হবে।’

ছোঁয়া লজ্জা পেয়ে হাত নামিয়ে ফেলল। তারপর লজ্জাবনত কণ্ঠে বলল, ‘মুখে কি কিছু আটকায় না তোমার?’

‘আটকাবে কেন?’ শিহরণ ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘আমার বউয়ের কাছে কোনো কিছুই গোপনীয় থাকবে না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গোপনীয়তা শোভনীয় নয় প্রিয়তা।’

শিহরণ তার চেয়ারটা ঘুরিয়ে ছোঁয়ার আরও একটু কাছে টেনে বসল। সে ছোঁয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘যেদিন তুমি পায়ে হাঁটতে পারবে সেদিন আমরা দুজন ছাদে জ্যোৎস্না বিলাস করব এবং সেদিনই হবে আমাদের দুজনের একসাথে চলার প্রথম রজনী। আমার এই সিদ্ধান্তে কি তোমার কোনো আপত্তি আছে?’

ছোঁয়া কী বলবে ভেবে পেল না। শুধু করুণ চোখে তাকিয়েই থাকল শিহরণের সবুজাভ চোখের দিকে।

আকাশে মস্ত চাঁদ উঠেছে। অসংখ্য তারার মেলা বসেছে। চাঁদের রুপালি আলো এসে পড়েছে ছোঁয়ার মুখ বরাবর। শিহরণ মুগ্ধ হয়ে দেখছে তার প্রিয়তাকে। ছোঁয়া নির্বাক, নিরুত্তর।

শিহরণ শান্ত স্বরে দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘আকাশের বুকের এই চাঁদের আলো সাক্ষী সেইদিনটা আমাদের জীবনে আসবে এবং তা খুব শীঘ্রই। তুমি শুধু বিশ্বাস রেখো। মনের জোর রেখো।’

ছোঁয়া শিহরণের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। তার চোখের কোণে দু’ফোঁটা অশ্রু মুক্তোর মতো চিকচিক করছে। শিহরণ তা খুব যত্নের সাথে নির্দ্বিধায় মুছে দিল। ছোঁয়া শিহরণের কাঁধে মাথা রাখল। চাঁদের রুপালি আলো ঠিকরে পড়ছে তাদের অঙ্গে।

অবশেষে এই নিস্তব্ধ রাত্রিতে পূর্ণ চাঁদের রুপালি আলো গায়ে মেখে দুজন কপোত-কপোতী তাদের অনাগত ভবিষ্যতে এক বিশুদ্ধ প্রেমের আখ্যান রচনায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলো।

________________

শিহরণদের পুরো বাড়ি জুড়ে কোলাহলের আমেজ। খুব সাদামাটা বিয়ে হলেও শিহরণের বন্ধুরা সেই সাদামাটা ভাবটা একদম ভ্যানিশ করে দিয়েছে। সাবিহা সাবরিন কোনোভাবেই সহজ হতে পারছেন না ছোঁয়ার সাথে। তিনি ফরমাল কথাবার্তা ছাড়া আর কোনো কথাই বলেননি ছোঁয়াকে। সেটুকুও সাব্বির আহমেদের জোরাজুরিতে করেছেন।

ছোঁয়া সোফায় বসে ছিল, শিহরণ তার পাশেই তার হাত ধরে চুমটি মেরে বসে আছে আর সকলের কাণ্ড দেখে হাসছে। ফাহমি হুট করে এসেই বলল, ‘তুই তো দেখছি বউ পাগলা রে শিহরণ। সেই যে হাত ধরেছিস, ছাড়ার নাম নেই। মনে হচ্ছে হাত ছাড়লেই অন্য কেউ এসে নিয়ে যাবে তোর বউকে।’

শিহরণ ও কম যায় না। সেও বেশ ভাব নিয়ে বলল, ‘হাত তো ছাড়ার জন্য ধরি নাই রে দোস্ত। আর তোদের বিশ্বাস নাই, নিয়ে ও তো যেতে পারিস।’

প্রিয় এই সুযোগটা ছাড়তে চাইল না। সে ফাহমিকে খোঁচা দিয়ে বলল, ‘বাব্বাহ! ভূতের মুখে রাম নাম। তুই নিজেই তো মোহনার সাথে ফেবিকলের মতো চিপকাইয়া থাকিস। আবার আসছিস আমার বন্ধুরে খোঁচা মারতে।’

ফাহমি মারমুখো হয়ে এগিয়ে এসে বলল, ‘এই প্রিয়র বাচ্চা! আমি তোর বন্ধু না? খালি কি শিহরণ তোর বন্ধু? আমার আর শিহরণের মধ্যে তুই ক্যান কথা বলতেছিস? আমার বন্ধুরে আমি যা ইচ্ছা তাই বলব। তোর কোনো সমস্যা?’

‘সত্য কথা বললেই সব দোষ প্রিয়র, হুহ্!’ প্রিয় মুখ ঝামটা মেরে বলল।

মায়া, সাইফ আর মিষ্টি মিলে সবাইকে খাবার সার্ভ করছিল। প্রিয় আর ফাহমি ধুন্ধুমার কাণ্ড শুরু করে দেয়ায় সে এসে তাদের দুজনের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে সহাস্যে বলল, ‘আরে থামো তোমরা। কী শুরু করেছ?’ তারপর কোল্ড ড্রিঙ্কসের দুইটা গ্লাস দু’জনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,’ধরো, ঠান্ডা খেয়ে আগে মাথা ঠান্ডা করো।’

ফায়াজ শিহরণ আর ছোঁয়াকে অভিনন্দন জানানোর পরে সাব্বির আহমেদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল। কথা শেষ করার পর থেকেই সোফায় চুপ করে বসে আছে। মায়ার শান্ত স্বভাব দেখে তার খুব ভালো লাগছে। তাকে সবকিছু খুব সুন্দর করে সামলাতে দেখে সে মুগ্ধ হয়ে গেল। এক পর্যায়ে সে প্রিয়কে ডেকে বলল, ‘প্রিয়, মেয়েটা কে রে?’

প্রিয় চিনতে পেরেও না চেনার ভান করে বলল, ‘কোন মেয়েটা?’

ফায়াজ প্রিয়র ইচ্ছাকৃতভাবে ঘুরানোর ব্যাপরটা বুঝে ফেলল। সে বলল, ‘ওই যে তোকে একটু আগে যে মেয়েটা ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করল সেই মেয়েটার কথা বলছি।’

প্রিয় কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘ওহ্ হো, খুব মনে ধরেছে নিশ্চয়ই?’

ফায়াজ চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘প্রিয়!’

‘ওহ্, স্যরি ব্রো। ও হচ্ছে মায়া। ছোঁয়ার বেস্টি।’

ফায়াজ তখন বিড়বিড় করে বলল, ‘মেয়েটা
দেখতে ভীষণ মিষ্টি।’

‘আরে ভাইয়া মিষ্টি তো শিহরণের বাসায় কাজ করে। শেষমেশ বুঝি তোমার ওকে পছন্দ হলো?’

ফায়াজ এবার রেগে গিয়ে বলল, ‘তুই এখনও সেই বেয়াদপের হদ্দ-ই আছিস তাহলে! একটুও বদলাসনি।’

প্রিয় অনুতপ্ত হবার ভান করে বলল,’অনেক বেশিই বদলে গেছি। তুমি তো আমার ভালো গুণগুলো চোখেই দেখো না। সে যাই হোক, মায়া শুধু দেখতে না সে খেতেও মিষ্টি।’

‘কী!’ ফায়াজ মৃদু চিৎকার করে বলল, ‘কী যা তা বলছিস?’

প্রিয় কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি বলতে চাইছি মায়ার কথাও তার মতো মিষ্টি।’

কথা শেষ করেই সে ফায়াজের পাশে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। ধূমকেতুর মতো হুট করেই গায়েব হয়ে গেল ফায়াজের সামনে থেকে।

ফাহমির সাথে গলায় গলায় ঝগড়া করার সময় প্রিয়কে এক ঝলক দেখছিল সাইফ। মেয়েটাকে এক ঝলক দেখার পর থেকেই তার মনে হলো সে এই মেয়েটাকে আগে কোথাও দেখেছে। বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পরে তার মনে পড়ে গেল। মনে পড়ার পর থেকেই সে তার মধ্যে এক ধরনের উৎসুকতা টের পেল। প্রিয়র সাথে কথা বলার উৎসুক ভাব নিয়ে নিজেকে আটকে রাখা তার জন্য বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে। তাই সে প্রিয়কে চোখে চোখে রাখছে। এই মুহূর্তে প্রিয়কে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে যেতে দেখে সে প্রিয়র পিছু নিল।

হঠাৎ করেই প্রিয় পেছন ফিরতেই সাইফকে দেখে বলল, ‘কী ব্যাপার? পেছন পেছন আসছ কেন? অনেকক্ষণ আগে থেকেই লক্ষ্য করছি তুমি আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছ। ভেবেছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’ পরক্ষণেই কোমরে হাত রেখে ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল,’সমস্যা কী তোমার?’

প্রিয়র কাছে এমন এনকাউন্টার হওয়ায় সাইফ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সে কী বলবে ভেবে পেল না। প্রিয় তাড়া দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে সাইফকে শাসানোর মতো করে বলল, ‘এই যে মিস্টার কিছু বলার থাকলে জলদি বলে ফেলো। আমার হাতে অত সময় নেই। কিছু না বললে এখনই আমার পিছু ছাড়ো। এর পর থেকে পিছু নিলে কিন্তু খবর আছে। মনে রেখো।’

শাসানোর পরেও প্রিয়কে একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাইফ মনে হালকা একটু জোর পেল।
ইতস্তত করতে করতে সাইফ বলল, ‘তুমি সেই মেয়েটা না?’

প্রিয় ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল,’ কোন মেয়েটা?’

‘ওই যে কয়েক মাস আগে আমাকে প্রপোজ করা মেয়েটা!’

প্রিয় চেঁচিয়ে বলল, ‘এই ছেলে, নিজেকে কী মনে করো তুমি? তুমি কি প্রিন্স অব ওয়েলস যে আমি তোমাকে দেখা মাত্র প্রপোজ করতে যাব?’

সাইফ বিভ্রান্ত হয়ে গেল। তার স্পষ্ট মনে হচ্ছে এই সেই মেয়ে। কিন্তু প্রিয়র কথার দৃঢ়তা দেখে সে আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতো করে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকল। ভাবতে থাকল, সত্যিই কি তবে তার দেখার ভুল? কিন্তু তার মন বলছে এই সেই মেয়ে। মেয়েটার গলার স্বর, চোখ, চুল সব তো একই!

_______________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে