ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৫৬+৫৭+৫৮

0
1568

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫৬

মান্নাতের কথা শুনে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলো শিহরণ। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘সে থাকবে না মানে? কী বলতে চাইছ তুমি?’

‘তোমার আমাকেই বিয়ে করতে হবে। আই মিন ইট, শিহরণ।’ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, মান্নাত।

‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছ, মান্নাত?’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, শিহরণ।

‘হুম, আমি পাগল হয়ে গেছি, তোমার ভালোবাসার জন্য পাগল হয়েছি।’ অপ্রকৃতিস্থের ন্যায় বলল, মান্নাত।

শিহরণ মেজাজ ক্রমেই পারদস্তম্ভের ন্যায় উর্ধ্বগতিতে আরোহণ হচ্ছিল। সে নিজেকে শান্ত করার প্রাণপ্রণ চেষ্টা করছে। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি না। অযথা এমন জেদের বশে আমাদের মধ্যের বন্ধুত্বটা অন্তত নষ্ট করো না।’

‘বন্ধু? তুমি কি আমাকে কখনও বন্ধু ভেবেছ?’ মান্নাতের কন্ঠ যেন রুদ্ধ হয়ে আসতে চাইছে।

শিহরণ ভেবে দেখল সে কখনোই মান্নাতকে বন্ধু ভাবেনি, ভাবতে পারেনি। তার সঙ্গ সে কখনওই পছন্দ করত না, এখনও করে না। পারিবারিক সম্পর্ক রক্ষার খাতিরে দু’চারটে কথা বলা পর্যন্তই সীমিত ছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল, ‘তুমি আমার কাজিন তো হও। সেই সম্পর্কটা অন্তত নষ্ট করো না। তোমার প্রতি আমার অনুরোধ এটা।’

মান্নাত শিহরণের দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘মেয়েটা কি আমার চাইতেও সুন্দরী?’

‘কী!’ আচমকা অন্য প্রসঙ্গ আসাতে শিহরণ বুঝতে না পেরে তেতে উঠে বলল, ‘কীসব বলছ তুমি?’

‘তুমি যাকে ভালোবাসো সে কি আমার চাইতেও সুন্দরী।’

এমন একটা প্রশ্ন শিহরণ আশা করেনি। সে আচমকা হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল, ‘এই অদ্ভুত প্রশ্ন কেন করছ, মান্নাত?’

শিহরণকে হাসতে দেখে মান্নাতের খুব রাগ উঠে গেল। তারপরেও সে নিজেকে সংযত করে বলল, ‘প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে চাইছ কেন?’

‘এমন অদ্ভুত আর অবান্তর প্রশ্নের উত্তর দেবার কোনো প্রয়োজন বোধ করছি না।’ শিহরণ একটু থেমে আবারও বলল,’বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রসঙ্গে আমি কিছুই বলব না, তবে অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যে সে অতুলনীয়।’

মান্নাত শিহরণের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর ভূতগ্রস্তের মতো তার কাছে ঘেঁষে আবারও বলল, ‘তুমি শুধুই আমার। আর কাউকে তোমার হতে দেব না। তুমি চাইলেও না।’

শিহরণকে হালকা থ্রেট দিলেও শিহরণ সেটা গায়ে মাখল না। মান্নাতের দেওয়া থ্রেটকে সে হাওয়ায় উড়িয়ে দিল। তাতেই মান্নাত তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। সে মনে মনে বেশ কয়েকটা ছক কষে ফেলল। শিহরণের বাসা থেকে বেরিয়েই সে রাফিকে কল করল। রাফি কাল বিলম্ব না করেই মান্নাতের কল রিসিভ করল। মান্নাত বলল, ‘আমার সাথে এখনি দেখা করো।’

রাফি নিজের হাতের ঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘আমি আধ ঘন্টার মধ্যেই আসছি।’

রাফি আসার পরে মান্নাত পুরো ঘটনা খুলে বলল রাফিকে। রাফি দ্রুত ভাবছে। মান্নাতের মনের মধ্যে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডকে বাড়িয়ে দেবার এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করার মতো বোকা সে নয়। তাই সে দ্রুত তার মোবাইলটা বের করে ছোঁয়ার ছবিটা দেখাল।
মান্নাত যখন ছোঁয়ার ছবিটা দেখল তখন তার একে একে সমস্ত ঘটনা মনে পড়ে গেল। শিহরণ এই মেয়েটার উপরেই সবসময় নজর রাখত। অথচ সে কখনোই এই মেয়েটাকে পাত্তা দেয়নি। শিহরণ এমন একটা মিডল ক্লাস মেয়েকে পছন্দ করতে পারে সেই ভাবনা তার মাথাতেই আসেনি। ভুল করেছে সে, মস্ত বড়ো ভুল। কিন্তু এবার সে আর কোনো ভুল করবে না বলেই মনে মনে পণ করল।

মান্নাত রাফিকে বলল, ‘এই মেয়েটার সমস্ত ডিটেইল আমার চাই। ও কখন কোথায় যায়, কী করে সবকিছু। একটা ছোট্ট বিষয়ও যেন বাদ না যায়।’

রাফি দ্রুত মাথা নেড়ে সায় দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। মান্নাত ওয়েটারকে ডেকে একটা কোল্ড কফি অর্ডার দিল। এই মুহূর্তে তার মাথাটা ঠান্ডা রাখা খুব জরুরী। তাকে যে শান্ত থাকতেই হবে।

____________________

‘আমার চালচলনে তোমার এতোই সমস্যা থাকলে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। গট ইট?’ নির্বিকার ভঙ্গিতে কথাটা বলেই আমিরাহ নিজেকে শেষবারের মতো আয়নায় দেখে নিল আরও একবার।

আশফাক বিব্রত হয়ে গেল আমিরাহর কথায়। টিয়ার জন্য সে চেয়েছিল তার আর আমিরাহের সম্পর্ককে শেষবারের মতো একটা সুযোগ দিতে। কিন্তু আমরাহ এখনও সেই টিনেজদের মতোই জীবনকে উপভোগ করতে চায়। তার জীবনযাপন পদ্ধতির কোনো পরিবর্তন হয়নি, বিয়ের এত বছর পরেও।

সে পরাস্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘একবার আমাদের মেয়ের কথাটা তো ভাবো, আমিরাহ।’

আমিরাহ ভাবলেশহীন হয়ে বলল, ‘টিয়ার কথা কী ভাবব আমি? ও তো ভালোই আছে। যখন যা চাইছে সব তো পাচ্ছে। তাহলে আর কি লাগবে ওর?’

‘আমার মেয়েটা তার মাকে পাচ্ছে না। বুঝতে পারছ তুমি, টিয়া তার মাকে কাছে চায়, মায়ের সঙ্গ পেতে চায়, অন্য দশটা বাচ্চার মতো। তুমি কি তাকে সেই সময়টা দিচ্ছ, সেই ভালোবাসা দিচ্ছ?’

আমিরাহ রেগে গেল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সে বলল, ‘টিয়া এখন আর এতোটাও ছোটো না যে তাকে কোলে নিয়ে আমাকে ঘুরতে হবে। এমনিতেই তোমাকে বিয়ে করে আমি আমার জীবনের সবচাইতে বড়ো ভুল করেছি। এখন তোমার কথা শুনে দ্বিতীয় কোনো ভুল আমি করতে চাই না।’

আশফাক নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে বলল, ‘তোমার পাগলামির কারণে আমার জীবনটাই তো শেষ হয়ে গেছে। তোমার ভুলের কারণে শাস্তি তো আমি পেয়েছি। এখন আমার মেয়েও সেই শাস্তি ভোগ করছে।’

‘তুমি শাস্তি পাচ্ছ?’ আমিরাহ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘তুমি আমার একটা ভুল আশফাক। কম বয়সে করা সবচাইতে বড়ো একটা ভুল। তোমার মতো সেকেলে একটা মানুষকে আমি কী করে ভালোবেসেছি আমি সেটা ভাবতেই পারছি না। কী বোকাটাই না ছিলাম আমি!’

আশফাক ঠিক কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। যেই মেয়ের পাগলামোর কারণে তাকে যার ভালোবাসাকে হারাতে হয়েছে, সেই মেয়েটাই এখন তাকে সহ্য করতে পারছে না, তার নিজের করা ভুলের সমস্ত দায় তার উপরে অর্পণ করছে। তার মনে হলো, এই ঘটনাটা অদৃশ্যের পরিহাস নয়তো আর কী!

আশফাককে কথাগুলো বলেই আমিরাহ গটগট করে হেঁটে পার্টির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। আমিরাহ চলে যেতেই টিয়া এসে আশফাককে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বাবা, মা খুব খারাপ। তোমার সাথে ঝগড়া করে সবসময়।’

আশফাকের চোখের কোণা বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ডান হাতের আঙ্গুলি দ্বারা সেই অশ্রুবিন্দু অতি সন্তর্পণে মুছে নিল আশফাক। মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, ‘মায়ের সম্পর্কে এরকম বলতে নেই, মামুণি।’

টিয়া বলল, ‘মা আমাকে ভালোবাসে না কেন, বাবা?’

কিছু প্রশ্নের উত্তর হয় না। কারও কাছেই সেই সব প্রশ্ন উত্তর থাকে না। তাই সেই প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যেতে হয়। আশফাকও তার ব্যতিক্রম করল না। সে মুখে কৃত্রিম হাসির রেখা টেনে বলল, ‘চলো মামুণি, আমরা এখন খেলতে যাব। বাবার সাথে খেলবে তো?’

টিয়ার মুখে তৎক্ষণাৎ হাসি ফুটল। মাথা উপর নিচ করে সে সম্মতি জানাল।

__________

ছোঁয়াকে কাছে আসতেই জড়িয়ে ধরল শিহরণ। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার। ছোঁয়ার একটু খটকা লাগল। সে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, ‘কী হয়েছে, শিহরণ? তুমি ঠিক আছ?’

শিহরণ ছোঁয়াকে ছাড়ল না। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। ছোঁয়া বলল, ‘সবাই দেখছে তো, জনাব শিহরণ।’

শিহরণ জবাব দিল, ‘দেখুক। দেখলে কী হয়েছে?’

‘আরে বাবা তোমার কী হয়েছে বলবে তো না-কি?’ অধৈর্য গলায় বলল, ছোঁয়া।

শিহরণ এবার ছোঁয়াকে ছেড়ে দিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল ছোঁয়ার দিকে, মায়া ভরা সেই দৃষ্টি। তা দেখে ছোঁয়ার বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠল। সে বুঝতে পারছে, শিহরণ ঠিক নেই। নিজেকে সামলে নিয়ে সে শান্ত কণ্ঠে শিহরণের গালে হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কী হয়েছে বলবে আমাকে?’

‘তেমন কিছু না।’ শিহরণ পুরো বিষয়টা লুকাল ছোঁয়ার কাছ থেকে। সে ভালো করেই জানে ছোঁয়া দুশ্চিন্তা করবে। তাই সে তার বিয়ের কথাটা না বলাটাই ঠিক মনে করল। ছোঁয়ার নজর এড়িয়ে উদাস গলায় বলল, ‘ভয় হয় আমার। মাঝেমধ্যে খুব বেশি ভয় হয়।’

‘কেন?’ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল, ছোঁয়া।

‘হারিয়ে ফেলার ভয়।’

‘মানে?’

‘আশফাক ভাইয়ার কথা মনে আছে তোমার?’

ছোঁয়া ভাবল খানিক। পরে বলল, ‘মনে পড়ছে না তো।’

‘রাফির আপন ভাই উনি। সেবার ভাইয়াকে বারবার আমাদের আশ্রমের অনুষ্ঠানে আসতে বলার পরেও আসলো না তার কথা বলছি।’

‘ও আচ্ছা। কী হয়েছে উনার?’

‘জানো, ভাইয়া একজনকে ভীষণ ভালোবাসতো। কিন্তু শেষমেশ তাকে হারিয়ে ফেলে এমন একজনের সাথে আছে যাকে সে ভালোবাসে না, যার প্রতি তার কোনো অনুভূতি নেই। ভাইয়াকে দেখলেই আমার কষ্ট হয়। কী ভয়ানক কষ্ট বুকের মধ্যে চেপে রেখে তিনি ভালো থাকার অভিনয় করে যাচ্ছে।’

‘কেন এমন হলো উনার সাথে?’

‘সব হয়েছে উনার মা আর বাবার কারণে। আমি এই দুজন মানুষকে একদম পছন্দ করি না। ভাবির টাকার কাছে ওরা সন্তানের ভালোবাসা আর ভালো থাকাকে বিসর্জন দিয়েছে।’

‘আফশফাক ভাই প্রতিবাদ করলেন না কেন?’

‘সবসময় প্রতিবাদ করা হয়ে উঠে না, ছোঁয়া। যখন তোমার অনিষ্টকারী তোমার আপন মানুষগুলো হবে তখন তোমার হার আবশ্যক। সব দিকে থেকেই তোমার হারই হবে। কারণ প্রতিটা মানুষই তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের প্রত্যেকের ভালো থাকা নিয়েই তোমার ভালো থাকা।’ ব্যথাতুর গলায় বলল শিহরণ ।

ছোঁয়া বলল, ‘এখন কী অবস্থা উনার? যাকে ভালোবাসতো সেই বা কোথায়?’

‘জানি না। আমি আর কিছুই জানি না।’ শিহরণকে হতবিহ্বল দেখাল।

ছোঁয়া তাকে আশ্বস্ত করার জন্য বলল, ‘আমরা কি ভাইয়ার জন্য কিছু করতে পারি?’

_______________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫৭

মধ্যরাত! চারিদিকে শুনসান নীরবতা। এই নিস্তব্ধ নীরব রাত্রিতে রাদিদের চোখে ঘুম নেই। টেবিল ল্যাম্পের মৃদু আলোতে লিখে যাচ্ছে সে। রাতের সেই ভয়ংকর নিস্তব্ধতা ভেদ করে কেবলই
খস খস আওয়াজ হচ্ছে শুধু। রাদিদ লিখছে মনের সমস্ত আব্যক্ত উপাখ্যান নিজের অজান্তেই। তার মনের ক্যানভাসে প্রথম দর্শনের সেই সুদর্শনা কন্যার এক মূর্তিমান ছবি, বারংবার এসে দোলা দিয়ে যাচ্ছে মনের গহীনে। রাদিদ বিমোহিত, বিমুগ্ধ হয়ে সেই প্রতিচ্ছবির উপরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে। কেমন যেন মাতাল করা এক অনুভূতিতে ছেয়ে গেছে তার হৃদয় প্রান্তর।

প্রিয়তমা, তুমি পাশে নেই বলে
আজ মরচে মরা পেরেকের মতন জং-ধরা এই আমি।
মনোহারিনী, তুমি স্নিগ্ধ স্বরে ডাকোনি বলে,
মৃত্যুঞ্জয়ের শেষ বিদায়ের মতন শীর্ণ হয়েছে দেহখানি।
উন্মাদিনী, আমায় তোমার প্রেমের মায়ায় জড়াওনি বলে,
বিবর্ণ আমার এই চিরচেনা সবুজ পৃথিবী।
নিশীথিনী, তোমার ছায়া নামক মরীচিকার পানে ছুটেছি বলেই,
আজ আমার আকাশে ওঠা রংধনুটাও বিবর্ণ।
গোধূলীর লালিমাও যেন ম্লান হয়ে গেছে।
প্রিয়া, তুমি আমার পাশে নেই বলে আজ
শতবর্ষব্যাপী নিস্তেজ, নিষ্প্রাণ, নিথর দেহে
চিরনিন্দ্রায় শয্যাশায়ী হয়ে ঘুমিয়ে আছে মুকুটহীন প্রেমকুমার।
চিরজাগরূক, তুমি নেই তো পাশে, জানি,
তবুও কেন বুুক চিরে বেরোয় দীর্ঘশ্বাস?
তবুও কেন বারংবার খুঁজে ফিরি তোমাকেই?
মনের আঙিনায়, তোমার শহরের অলিগলি কিংবা খোলা প্রান্তরে।
তবুও তোমার পদচিহ্ন পড়েনি তো আমার আঙিনায়
কী পাষণ্ড আমার প্রিয়া, ভাবি, আর কেঁদে মরি!
তাই অসমাপ্ত রয়ে গেছে বহুবছর আগে শুরু করা
আমার প্রিয়ার তরে রচিত আমার প্রেমের এই অব্যক্ত উপাখ্যান।

হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতায় নেমে এলো এক অবর্ণনীয় হৃদয় ভারাক্রান্ত করা বিষাদ। রাদিদ টের পেল তার রচিত কবিতাখানা অন্যায়, নিতান্ত পারিহাস্য, তবুও সে তার ডায়েরির সেই পাতাটি ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েও ছিঁড়ল না। মনে মনে ভাবল, পৃথিবীর শত অন্যায়, অনিয়মের তরে থাকুক না তার এই অন্যায় আবদার মাখা, অন্যায্য দোষারোপে ভরা কবিতাখানা, থাকুক না তার প্রেমের অসমাপ্ত উপাখ্যান হয়ে তার সেই অসমাপ্ত উপন্যাসটির মতন।

কুকুরের করুণ স্বরের আর্তনাদ ভেসে আসছে। গভীর রাতের জানান দিচ্ছে কী? না-কি রাদিদের বুকের মধ্যে ছাইচাপা দেওয়া আগুনটা দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে দেবার তরে এমন করুণ স্বরে তাকে ভর্ৎসনা করার জন্য উপহাসে মশগুল হলো প্রভুভক্ত খ্যাত এই প্রাণীটি?

রাদিদ তা ভেবে পায় না। অবান্তর, অযৌক্তিক চিন্তারা আজ তার মনন ও মস্তিষ্ককে ভারাক্রান্ত করে তুলছে কেবল এই একটা কথাই তার মনে আসছে। কুকুরটা কেঁদেই চলেছে। রাদিদ জানালা খুলে পর্দা সরিয়ে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু দেখতে পেল না, সেই কুকুরের অবয়ব। বহুবার এই প্রাণীটিকে খোঁজার চেষ্টা করে অবশেষে পরাস্ত হয়ে সে জানালা বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পড়ল। হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তন হয়ে গেল। একই সাথে ঝড়, বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আচমকা এই পরিবর্তনে রাদিদের ভয় হলো, অহেতুক ভয় না-কি এই ভয়ের পেছনে কোনো কারণ আছে তা রাদিদ জানে না। রাদিদ শুধু জানে, এই মুহূর্তে একজন মনোহারিনীর মুখচ্ছবি দেখতে মরিয়া সে, একদম পাগলপ্রায়। সে জানে এই ইচ্ছে পূরণ হবার নয়, তবুও অবাধ্য মন এহেন অলভ্য নানান বাসনায় সিক্ত করে তোলে মনের অলিগলি। রাদিদের মুখ ফুটে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো, ‘আমার নিষ্ঠুর প্রিয়ার তরেই না হয় আজীবন লিখে যাব আমার প্রেমের অব্যক্ত উপাখ্যান, যতদিন এই দেহে প্রাণ থাকে ঠিক তত দিন।’

_____________________

বহ্নির এক্সাম, অতলের ভাইভার প্রিপারেশন এসবের মধ্যেই কেটে যাচ্ছে সময়। ওদের মধ্যে যোগাযোগ কমে গেছে অনেকটাই। দুজনেই ইচ্ছাকৃতভাবে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছে, পড়ালেখার খাতিরে। এতে অবশ্য বহ্নির ভূমিকাই অগ্রগণ্য ছিল। অতল তো বহ্নি বলতেই চোখে হারায়। কিন্তু বহ্নি অতলকে বেশ কয়েকটা শর্ত জুড়ে দিল। অতল ভাবে, বহ্নিকে সে কী করে বুঝাবে, তাকে ছাড়া তার কাছে সবকিছুই বেরঙের লাগে, সবকিছুই পানসে ঠেকে। সবসময় বহ্নির সান্নিধ্য পেতে মরিয়া অতল সুযোগ পেলেই বহ্নিকে কাছে পেতে চায়। অপরদিকে বহ্নি শক্ত অবস্থানে অনড় থাকে। অতল তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যথিত কণ্ঠে বলে, ‘তুই খুব নিষ্ঠুর, আগুনমণি। আমি তোর কথা ভেবে ভেবেই দিন রাত পার করি। আর তুই আমি একটু কথা বলতে চাইলেও শর্ত, শর্ত আর শর্ত। আমার মনে হচ্ছে, শর্তের বেড়াজালে বন্ধী হয়ে গেছে আমার ভালোবাসা।’

বহ্নি হেসে খানিকটা কৌতুক মেশানো কণ্ঠে বলে, ‘তোমাকে এখন থেকেই লাগাম দিচ্ছি বুচ্ছ? চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত এই লাগাম ছাড়ব না।’

অতল অহসহায় গলায় বলে, ‘কেন এই নিষ্ঠুর আচরণ আমার তরে?’

বহ্নি তখন বেশ ভাব নিয়ে বলে, ‘তোমায় ভালোবাসি বলেই নিষ্ঠুর হয়েছি নিজের তরেও।’

অতল তখন হুমকি দেবার ভঙ্গিতে বলে, ‘এই নিষ্ঠুরতার শোধ সুদে-আসলে তোলা হবে, বলে দিলাম।’

‘ভালোবাসার সেই শাস্তি না হয় আমি মাথা পেতেই নেব।’

অতল কোনোভাবেই বহ্নিকে টলাতে পারে না। অদ্রির ন্যায় সে অটল থাকে নিজের ভাবনাতে, নিজ অবস্থানে। প্রেমে মরিয়া অতল পড়তে বসে ভাবতে থাকে বহ্নির কথা, তার কথা ভাবতে ভাবতেই দিন রাত হয়, রাত হয় ভোর। তবুও যেন প্রেমের এই নেশা ছুটে না। অতল যেন আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল তার হৃদয় সিংহাসনের রাজত্ব করা এই শর্তকন্যার উপর।
__________________________

মান্নাত কোনো প্রকার ভণিতা না করেই সোজাসাপ্টাভাবে ছোঁয়াকে বলল, ‘শিহরণের সাথে কোনোপ্রকার যোগাযোগ রাখবে না। রাখলে তা ভালো হবে না তোমার জন্য।’

মান্নাতকে চিনতে কোনো অসুবিধা হয়নি ছোঁয়ার। এই মেয়েটাকে সে প্রথম থেকেই সহ্য করতে পারত না। সবকিছুতেই তার মেকি ভাব তার কাছে রীতিমতো বিরক্ত লাগত। আর আজকে এই মেয়ে সোজাসুজি তার কাছে এসে থ্রেট দিচ্ছে ভাবতেই যার ভীষণ অবাক লাগছে।

মান্নাতের এইসব আবোল-তাবোল কথা শুনে
ছোঁয়া বেজায় বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এই কথাগুলো তুমি শিহরণকে বলতে পারতে। আমাকে এইসব কথা বলার কোনো কারণ দেখছি না।’

মান্নাত ক্ষেপে গিয়ে বলল, ‘আমি কাকে বলব সেটা একান্তই আমার ব্যাপার। তোমাকে সাবধান করতে ইচ্ছে হলো তাই করলাম। আমার কথা হালকাভাবে নেওয়ার ভুল করো না।’

মান্নাতের এহেন পাগলামি দেখে ছোঁয়া হেসে ফেলল। ঠোঁটের কোণে হাসি ধরে রেখেই বলল, ‘ঠিক আছে, আমি না হয় শিহরণের সাথে যোগাযোগ করলাম না। কিন্তু শিহরণকে কী করে আটকাবে আমার সাথে দেখা করা থেকে?’

‘ভ্রান্ত ধারণা হয়েছে তোমার। শিহরণ তোমাকে মোটেই ভালোবাসে না। সে আমাকে ভালোবাসে। ওর সাথে পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে অনেক আগে থেকেই। এমনকি বিয়ের ডেটও ফাইনাল হয়ে গেছে। শিহরণ তোমার সাথে কেবলই টাইম পাস করেছে।’

মান্নাতের কথা ছোঁয়া পাত্তাই দিল না। সে হেসে বলল, ‘এই কথাটা শিহরণ নিজের মুখে বললেও হয়তো আমি বিশ্বাস করব না, মান্নাত।’

মান্নাত ক্ষুব্ধ হল। ক্রোধ উপচে পড়ছে তার চোখ-মুখ থেকে। রাগান্বিত কণ্ঠে সে বলল, ‘আমার সাথেই শিহরণের বিয়ে হবে, এই কথাটা তো আর মিথ্যে করে দিতে পারবে না। তুমি চাইলে শিহরণকেই জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, আমার সাথে তার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়েছে কি না।’

কথাটা বলেই মান্নাত বেরিয়ে গেল। ছোঁয়া হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। শিহরণের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, এই কথাটা তার বুকের মধ্যে শেলের মতো বিঁধল। সে তৎক্ষণাৎ শিহরণের নাম্বার ডায়াল করল। শিহরণ কল রিসিভ করল না। শিহরণ মিটিং এ ব্যস্ত থাকায় কল কেটে দিল। কিন্তু ছোঁয়া নাছোড়বান্দার মতন বারংবার তার নাম্বারে কল দিতেই থাকল। অবশেষে ছোঁয়ার কল রিসিভ করে শিহরণ শান্ত স্বরে বলল, ‘আমি এখন ব্যস্ত আছি। ফ্রি হয়ে কল দিচ্ছি।’

শিহরণের ব্যস্ততার কোনো প্রকার তোয়াক্কা না করেই ছোঁয়া ঝাঁঝালো গলায় প্রশ্ন করল, ‘মান্নাতের সাথে কি তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?’

শিহরণ চমকে গেল। এই খবরটা ছোঁয়ার কানে কে দিল তা সে ভাবতে থাকল। পরক্ষণেই ছোঁয়া বাঁজখাই গলায় পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘কী হলো? উত্তর দাও।’

‘ছোঁয়া, আমি এখন মিটিংয়ে আছি। ফ্রি হয়ে তোমাকে কল ব্যাক করছি।’ ব্যস্ত গলায় বলল, শিহরণ।

ছোঁয়া জেদী গলায় প্রশ্ন করল, ‘হ্যাঁ না-কি না?’

শিহরণ বলল, ‘তুমি আমার কথাটা তো শোনো আগে। এই বিষয়টা আমি তোমাকে পরে ব্যাখ্যা করব।’

ছোঁয়া একগুঁয়ের মতন পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘এক কথায় উত্তর দাও, হ্যাঁ না-কি না?’

শিহরণ পরাস্ত ভঙ্গিতে অতি সংক্ষেপে বলল, ‘হ্যাঁ।’
__________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫৮

এক ধরনের চাপের মধ্যে থেকেই শিহরণ তার কাজ শেষ করল। ছোঁয়াকে খবরটা কে দিয়েছে তা আর অজানা থাকল না। মান্নাতের উপর তার ক্রোধ উপচে পড়ছে। প্রচণ্ড ক্রোধে তার মাথার শিরা-উপশিরাগুলো দপদপ করছে। মিটিং শেষে ছোঁয়াকে বেশ কয়েকবার কল করল অথচ সে কল রিসিভ করছে না। ছোঁয়ার এহেন আচরণে শিহরণের রাগ আরও কয়েক ধাপ বেড়ে গেল। তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল মান্নাতের উপর। সে অফিস শেষে সোজা মান্নাতের বাসায় চলে গেল। শিহরণকে নিজের বাসায় দেখে মান্নাতের খুশি ধরে না। সে আহ্লাদে আটখানা হয়ে শিহরণকে বলল, ‘আমি জানতাম তুমি আমার কাছে ফিরে আসবেই।’

মান্নাতের হাসি দেখে শিহরণের রাগ আরও বেড়ে গেল। সে রাগের মাথায় বলল, ‘এতোদিন শুধু তোমাকে বলেছিলাম যে আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। এখন এই বিষয়টা খালামণিকে আমি নিজেই বলব।’

শিহরণের কথা শুনে মান্নাতের সমস্ত খুশি উবে গেল। মান্নাতের একটু আগের হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় শ্রাবণের মেঘ স্থান করে নিল। শিহরণ ততক্ষণে মান্নাতের মায়ের সাথে কথা বলার জন্য তার রুমের দিকে এগিয়ে গেল। মান্নাত শিহরণকে আটকানোর চেষ্টা করেও পারল না। মান্নাতের মা ফোনে কথা বলছিলেন। শিহরণকে নিজের রুমে দেখে তিনি ফোন রেখে বললেন, ‘কী হয়েছে, শিহরণ? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’

‘খালামণি, তোমার সাথে আমার কথা আছে।’

‘কী কথা বল?’

মান্নাত মাঝখানে ফোড়ন কেটে বলল, ‘মা, ও তেমন কিছু না। আসলে বিয়ের শপিং নিয়ে ওর সাথে আমার একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে। তাই সে রেগে একদম ফুলে গেছে।’

মান্নাতের মা হাসতে হাসতে শিহরণেকে বললেন, ‘তোমরা এখনও সেই বাচ্চাই রয়ে গেছ। এই সামান্য বিষয়েও সেই পিচ্চিকালের মতন ঝগড়া করছ?’

শিহরণ কোনো প্রকার সঙ্কোচ ব্যতিরেকে বলল, ‘খালামণি, মান্নাত যা বলছে তা নয়। আসলে আমি তোমাকে অন্যকিছু বলতে চাইছি।’

‘কী বলতে এসেছ বল। আমার আবার একটু বেরোতে হবে।’

মান্নাত তার মাকে তাড়া দিয়ে বলল, ‘মা, ও তেমন কিছু না। তোমার না মামার বাসায় যাওয়ার কথা ছিল। তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে তো, মামুণি। তুমি তোমার কাজে যাও। আমি শিহরণের সাথে কথা বলছি। তুমি টেনশন করো না।’

মান্নাতের হেঁয়ালিপনা দেখে শিহরণ এবার রাগের চোটে বলেই ফেলল,’আমি মান্নাতকে বিয়ে করতে পারব না। আমি ওকে কখনোই ওই নজরে দেখিনি, খারামণি।’

মান্নাতের মা থমকে দাঁড়াল। স্তম্ভিত কণ্ঠে বললেন,’তোমরা কী ঝগড়া করেছ? বিয়ের মতো একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে এইরকম ঠাট্টা করা একদম উচিত নয়। এটা তোমাদের সারাজীবনের প্রশ্ন।’

‘না, খালামণি। আমি কোনো দুষ্টামি বা ঠাট্টা করছি না। আমি সিরিয়াস। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। যাকে পছন্দ করি তাকেই বিয়ে করব।’

‘এই কথা কি তোমার আম্মু জানে?’

‘না, আম্মুকে বলিনি। তোমাকেই প্রথমে জানানো উচিত বলে মনে হয়েছে। কারণ মান্নাত এই বিষয়টা জেনেও আমাকে বিয়ে করতে চাইছে।’

শিহরণ বাসায় আসার পরে সাবিহা সাবরিন বললেন, ‘এসব কী শুনছি, শিহরণ?’

মায়ের প্রশ্ন করার ধরন দেখেই সে বুঝতে পারল খারামণি মাকে ফোন করে সব কিছু বলে দিয়েছেন। শিহরণ দ্বিধাহীন চিত্তে বলল, ‘যা শুনেছ ঠিক শুনেছ, আম্মু।’

‘তোমার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, শিহরণ।’

‘এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আম্মু। আমি মান্নাতকে বিষয়টা জানিয়েছিলাম কিন্তু সে শুনেনি আমার কথা। তাই বাধ্য হয়েই খারামণিকে জানাতে হলো। আম্মু তুমি মান্নাতকে খুব পছন্দ করো কিন্তু আমি ওকে একদম পছন্দ করি না। যেই মানুষটাকে আমি দু’মিনিটের জন্য সহ্য করতে পারি না সেই মানুষটার সাথে আমি সারাটা জীবন কাটাব কী করে আম্মু?’

সাবিহা সাবরিন শিহরণের এমন ঔদ্ধত্য দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন, এই ঔদ্ধত্যের কারণ নিশ্চিতভাবেই ওই মিডল ক্লাস মেয়েটা। এই ভাবনার বশবর্তী হয়েই তিনি বলে ফেললেন,’তোমার বিয়ে মান্নাতের সাথেই হবে। এটাই আমার শেষ কথা।’

মায়ের এমন অনড় অবস্থানে শিহরণ খুব আহত হলো। তার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, মা এরকমভাবে কোনোকিছু তার উপর চাপিয়ে দিতে পারে। সে অসহায় গলায় বলল, ‘আম্মু, তুমি এভাবে ওকে আমার উপর চাপিয়ে দিতে পারো না।’

সাবিহা সাবরিন তেজী গলায় বললেন, ‘ছেলেরা ভুল পথে গেলে তাদের সেই পথ থেকে ফেরানো বাবা-মায়ের কর্তব্য।’

‘বিশ্বাস করো মা, আমি যাকে পছন্দ করি, সে চমৎকার একজন মানুষ। তুমি নিশ্চয়ই তাকে পছন্দ করবে।’ মাথা নিচু করে ব্যথাতুর গলায় বলল, শিহরণ।

সাবিহা সাবরিন বললেন, ‘সেই মেয়েটা কতোটা চমৎকার তা বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তোমার অধঃপতন দেখেই আমি তা বেশ বুঝতে পারছি।’

শিহরণ অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল, ‘আম্মু তুমি একবার তার সাথে দেখা তো করো। তারপর না হয় তার সম্পর্কে তোমার মতামত জানিও।’

সাবিহা সাবরিন নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে বললেন, ‘আমি আমার সিদ্ধান্ত তোমাকে জানিয়েছি। এবার তুমি কী করবে ভেবে দেখো।’

_______________________

‘রাফি, যেটা করব না ভেবেছিলাম সেটা করতেই হচ্ছে। তারপর দেখি সে কী করে আমাকে বাদ দিয়ে ওই মিডল ক্লাস মেয়েটাকে বিয়ে করে।’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, মান্নাত।

রাফি দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে এই বিষয়টা আর একবার ভেবে দেখা উচিত তোমার।’

‘এই বিষয়ে ভাবার কিছু নেই। ওই মেয়ের কারণে আজ মায়ের কাছ থেকে আমাকে তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছে। এটা কোনোভাবেই মানতে পারছি না আমি। শিহরণের এই কাজের শাস্তি ছোঁয়াকেই পেতে হবে।’ ঠোঁটের কোণে পৈশাচিক হাসি ফুটিয়ে বলল, মান্নাত।

‘ঠিক আছে। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কিন্তু আমার লাভটা কী?’ সুযোগ মতো নিজেরটাও আদায় করার প্রস্তাব দিল রাফি।

‘ওহ, কাম অন, রাফি। তোমার লাভ কোথায় তা তুমি যেমন জানো। আমিও জানি। ইটস্ ইওর লাভ অর সো কলড অ্যাট্রাকশন ফর বহ্নি। এম আই রাইট?’

রাফি হাসল। বিদ্রুপ সেই হাসি। বিদ্রুপাত্মক হাসি হাসতে হাসতেই সে বলল, ‘লাভ, মাই ফুট।’ খানিক থেমে সে আবারও বলল, ‘বাট আই ওয়ান্ট হার এট এনি কস্ট।’

মান্নাত রাফিকে সাবধান করে দিয়ে সতর্ক গলায় বলল, ‘বিষয়টা যেন পিওর এক্সিডেন্ট দেখায়। পুলিশের যাতে কোনোপ্রকার সন্দেহ না হয়। আনকোরা লোক দ্বারা কাজ করাবে না। যত টাকা লাগে দাও বাট কাজটা প্রফেশনাল কাউকে দ্বারা করাবে।’

_____________________

শিহরণ পড়েছে এক মহাবিপদে, একদিকে তার মা অন্যদিকে তার পছন্দের মানুষ, যাকে ছাড়া তার দম বন্ধ হয়ে আসে। দুজনেই তাকে ভুল বুঝে বসে আছে। কেউ তার দিকটা ভাবছে না। তাকে বোঝার দায় যেন কারও নেই। সবার মান-অভিমান ভাঙ্গানোর দায় যেন শুধুই তার। একদিকে মা তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়ছে, অপরদিকে ছোঁয়াও তার কল রিসিভ করছে না। ছোঁয়ার অভিমানের কারণটা সে বুঝে, তবুও তার সাথে এভাবে কথা না বলাটা মেনে নিতে পারছে না শিহরণ।

সকালে নাস্তা না করেই অফিসের জন্য বেরিয়ে গেল সে। অফিসের ব্যস্ততা থাকায় সে ছোঁয়ার সাথে দেখা করতে পারছে না। ছোঁয়াও অফিসে আসছে না, ছুটি নিয়েছে হুট করেই। তার কারণটা অবশ্য বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না তার। ছোঁয়াকে আশেপাশে দেখতে অভ্যস্ত শিহরণ, তাকে এক ঝলক দেখার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছে। অথচ ছোঁয়া পাষণ্ডের ন্যায় আচরণ করছে। তার দিকটা ব্যখ্যা করার সুযোগটাও দিল না।

বিকেলের দিকে শিহরণের অস্থিরতা আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল। ছোঁয়ার সাথে সারাটা দিনে একবারের জন্যও কথা না হওয়ায় খুব অস্থির লাগছে তার। এমনটা আগে কখনও হয়নি। যখন দূরে ছিল তখনের ব্যাপারটা আলাদা ছিল, কিন্তু এখনের ব্যাপরটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। গত এক ঘন্টা যাবৎ সে ছোঁয়ার নাম্বারে কল করে যাচ্ছে অথচ যতবারই সে কল করছে ততবারই একজন মহিলা যান্ত্রিক কণ্ঠে আওড়াচ্ছে, ‘দ্যা নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড ইজ নাউ সুইচড অফ। প্রিজ ট্রাই এগেইন লেটার।’

শিহরণের মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে ততবার ঠিক যতবার এই যান্ত্রিক কণ্ঠের আওয়াজটি সে শুনছে। এভাবেই অস্থির হয়েই সময় কাটছিল তার। একসময় মায়া, সাইফ দুজনকেই কল করে ছোঁয়ার খবর নিল সে। এমনকি ছোঁয়ার বাসায় পর্যন্ত কল করেছে।
অথচ কারো কাছেই ছোঁয়ার কোনও খবর পেল না। উপরন্তু ছানতে পেরেছে ছোঁয়া বাসায় নেই, সে কাজ বেরিয়েছে। তাই সে আরও বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ল।

একসময় অফিসে বসে থাকতে না পেরে গাড়ি নিয়ে নিজেই বেরিয়ে পড়ল। যেখানে ছোঁয়া যেতে সারে সবখানেই খবর নেওয়া হয়ে গেছে। তবুও কোনও প্রকার খোঁজ না পেয়ে শিহরণ হতাশ হয়ে পড়ল। তার মনে হচ্ছে তার বুক ফেঁটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। এরকম অস্থির সে কখনওই হয়নি। এমনকি ছোটোবেলায় যখন সে ছোঁয়াকে ছেড়ে তার ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সদর্পে সেই সময়টাতেও না। পেছন থেকে ছোঁয়ার করুণ কণ্ঠে বলা সেই কথাগুলোও তাকে এতোটা অস্থির করতে পারেনি।

সন্ধ্যা রানীর আগমনে হঠাৎ দিনের আলো ম্লান হতে শুরু করেছে। শিহরণ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সময় ছোঁয়ার নাম্বার থেকে কল আসায় হুট করেই রিসিভ করে ফেলল শিহরণ। ওপাশ থেকে একটা পুরুষালী কণ্ঠের কেউ বলে উঠল, ‘হ্যালো, আপনি কি শিহরণ বলছেন?’

পুরুষালী কণ্ঠের কারও কথা শুনে বিচলিত কণ্ঠে শিহরণ প্রশ্ন করল, ‘জি, আপনি কে বলছেন? ছোঁয়া কোথায়?’

ওপাশের পুরুষটি ইতস্তত করতে করতে বলল, ‘এই ফোনের মালিকের একটা মারাত্মক এক্সিডেন্ট হয়েছে।’

শিহরণের হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেল। তার দু’চোখ মুহূর্তেই বিস্ফোরিত হয়ে গেল। এমন ভয়ংকর একটা কথা শোনার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। তার হৃদস্পন্দন দ্রুতগতিতে চলতে শুরু করল। হতবিহ্বল হয়ে শিহরণ ফোন তুলে নিয়ে পুনরায় ছোঁয়ার নাম্বারে কল করল। উত্তেজিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘ছোঁয়া এখন কোথায়?’

লোকটির কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েই সে আর একটা মুহূর্তও দেরি করল না, বেরিয়ে গেল প্রচণ্ড বেগে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা কোনো এক উল্কার ন্যায়। আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে ছোঁয়াকে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।

ফাহমিদা বেগম কান্নাকাটি করছেন। হিয়া ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। অহনা চোখজোড়াও অশ্রুসিক্ত। মায়া মহিলাদের জন্য নির্ধারিত নামাজ কক্ষে প্রার্থনা করছে।

শিহরণ উদভ্রান্তের ন্যায় অপারেশন থিয়েটারর সামনের খোলা জায়গায় অস্থির পায়ে পায়চারি করছে। মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে।

ছোঁয়ার এক্সিডেন্টের খবর শোনার পর অতল আর রাদিদও প্রায় ছুটে আসল। আসার সময় অন্য বন্ধুদেরও খবরটা জানিয়ে দিল।

অতল আর রাদিদ তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে চুপটি মেরে বসে আছে। তাদের সকলের চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা।

ওটি থেকে বেরিয়ে ডাক্তার মলিন কণ্ঠে বললেন, ‘প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে পেশেন্টের। রক্ত দেওয়া হয়েছে। তবে সেন্স না আসা পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না। অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাছাড়া দুই পায়ে ফ্রাকচার হয়েছে মারাত্মকভাবে। হাঁটতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। পা কেটেও ফেলতে হতে পারে।’

ডাক্তারের বলা এই একটা কথাই যথেষ্ট ছিল শিহরণেকে ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ করার জন্য। সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। ভয়ংকর কোনো ঝড় আসার আগৈর নিস্তব্ধতা ওকে ঘিরে ধরেছে। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে। অতল আর রাদিদ ছুটে এসে ওকে ধরল। এই খবরটা শোনার পরে সবার অবস্থা ভয়ংকর রকমের খারাপ হয়ে গেছে। কারও মুখে কোনো শব্দ নেই। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাটাও যেন হারিয়ে ফেলেছে সবাই।

________________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে