ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৫৩+৫৪+৫৫

0
1591

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫৩

ছোঁয়ার মুখে সবটা শুনে শিহরণ বেশ কিছুক্ষণ থম ধরে বসে রইল। তার খুব খারাপ লাগছে মায়ার জন্য। ছোঁয়া শিহরণের হাতের উপর নিজের হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘এটাই ভালো হয়েছে, শিহরণ। এই বিয়েটা ভেঙ্গে যাওয়তে ওর লাভই হয়েছে। সাময়িকভাবে একটু খারাপ লাগলেও এটা ভালোর জন্যই হয়েছে। এবার ওর পরিবার ওর উপর রাখা নিষেধাজ্ঞা তো তুলে নিয়েছে। ওকে জব করার অনুমতি দিয়েছে। এবার দেখো ও নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে।’

শিহরণ মাথা তুলে তাকাল ছোঁয়ার দিকে। স্মিত হেসে বলল, ‘তুমি ঠিক বলছ। তাও ভালো যে ওর বাবা ওকে জব করার অনুমতি দিয়েছে। এর আগেরবার তো জব পেয়েও করতে পারেনি সে।’

‘আসলে ওদের পরিবার মেয়েদের জব করা এলাউ করে না। বিয়েটা ভেঙে যাওয়াতে আঙ্কেল একটু নরম হয়েছেন। তাছাড়া মায়ার যুক্তির কাছে তাকে হার মানতেই হলো।’

সাইফ আর মায়াকে আসতে দেখে ছোঁয়া কিছু বলতে চেয়েও আর বলল না। মায়া হেসে বলল, ‘লাভ বার্ডসদের ডিস্টার্ব করে ফেললাম মনে হচ্ছে!’

সাইফও মায়ার কথার সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘আমারও তাই মনে হচ্ছে রে। কাবাবে হাড্ডি হতে চলে এলাম দুজনেই।’

শিহরণ খুব আক্ষেপের সুরে বলল, ‘কাবাবে হাড্ডি হও আর যাই হও না কেন ডিস্টার্ব তো করেই ফেলেছ। কী আর করা? একটু যে লুকোচুরি প্রেম করব তারও সুযোগ পাই না।’

‘আহা রে!’ মায়া কৌতুক মেশানো গলায় বলল, ‘আমাদের প্রেমিক পুরুষের প্রেম করতে কতো অসুবিধা। কতো কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে বেচারাকে।

সাইফের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সাইফ চল তো আমরা অন্য কোনো রেস্টুরেন্টে চলে যাই। লাভ বার্ডসদেরকে একটু লাভ করার সুযোগ দিয়েই দিই। আমি আবার এতোটাও নির্দয় নই।’

শিহরণ বেশ ভাব নিয়ে বলল, ‘এসেই যখন পড়েছ তখন থেকেই যাও। প্রেম করার মুড তো নষ্ট হয়েই গেল।’

ছোঁয়া দুম করে শিহরণের হাতে একটা থাপ্পড় দিয়ে বসল। লজ্জাবনত কণ্ঠে বলল, ‘কী শুরু করেছ, শিহরণ?’

মায়া ব্যঙ্গ করে বলল, ‘ইশ, প্রেম করার মুডও লাগে তোমার।’

শিহরণ চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে আগের চাইতেও বেশি ভাব নিয়ে বলল, ‘তা তো লাগবেই। তোমার বান্ধবী কেমন কাঠখোট্টা তা তো জানোই। সেই তো আমার ভালো ভালো মুডের বারোটা বাজিয়ে দেয়।’

শিহরণের কথা শুনে ছোঁয়া তেতে গিয়ে বলল, ‘কী, আমি কাঠখোট্টা?’

‘নয়তো কী?’ শিহরণ বেশ দুঃখের সাথে বলল, ‘একটা চুমুও খেতে দাওনি আজ পর্যন্ত।’

‘ঠিক আছে। যে চুমু খেতে দেবে তার সাথে গিয়ে প্রেম করো।’ ছোঁয়া হুমকি দেবার ভঙ্গিতে বলল, ‘আমার সাথে তোমার আর কোনো সম্পর্ক নাই। এই বলে দিলাম। আমাকে আর কখনও কোনো প্রকার যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।’

শিহরণ আর ছোঁয়ার কাণ্ড দেখে মায়া হাসতে শুরু করল। শিহরণ এক ফাঁকে ওয়েটারকে ডেকে চার জনের জন্য চারটা কফি অর্ডার করার পরে ছোঁয়াকে বলল, ‘তো এখন কি আমাকে রেখে আরাভের কথা ভাবছ না-কি?’

‘আরাভ কে?’

‘তোমার পিচ্চি লাভার বয়।’

‘উফ্! তুমি যে কী শুরু করেছ দিন দিন! ওই বাচ্চা ছেলেটার কথা নিয়ে এখনও খোঁচা দিতে ভুলো না।অদ্ভুত সব কথাবার্তা।’

‘বাচ্চা হলে কী হবে? সে খুবই সিরিয়াস তোমার ব্যাপারে।’

মায়া সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘আমি ভাবছি স্কুলের জবটাতে একবার খোঁজ নিয়ে দেখব। তোমরা কী বলো?’

মায়ার সাথে তিন জনই সম্মতি জানাল। সাইফ বলল, ‘তুই জবটাতে জয়েন করতে চাইলে আমি খোঁজ নিতে পারি। আমার পরিচিত এক আঙ্কেল আছেন। তাকে একটা ফোন করলেই হবে।’

মায়া সাইফের কথায় সম্মতি জানাল। ওয়েটার কফি দিয়ে যেতেই সাইফ আর মায়া কফি খেতে খেতে কোনো একটা বিষয় নিয়ে আলোচনায় মগ্ন হয়ে গেল। মায়াকে দেখতে এখন খুবই প্রাণবন্ত লাগছে। শিহরণ ইশারায় ওদের দুজনকে দেখাল ছোঁয়াকে। তারপর ছোঁয়ার কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বলল, ‘মায়ার মুড একটু হালকা করার জন্য মজা করে বললেও কথাগুলো কিন্তু সত্য।’

ছোঁয়া ঠিক তখনই শিহরণের হাতে চিমটি কাটল। শিহরণ বলল, ‘এর শোধ কিন্তু সময়মতো নেওয়া হবে, প্রিয়তা।’

‘আমিও কি তোমায় ছেড়ে দেব ভেবেছ?’ পাল্টা হুমকি দিল ছোঁয়া।

‘নট ব্যাড, প্রিয়তা। আই লাভ টু এক্সেপ্ট চ্যালেঞ্জেস।’

_______________________

পিউ কাঁদতে কাঁদতে বাসায় আসলো। তার চুল এলোমেলো। স্কুলের পোশাক মাটিতে মাখামাখি হয়ে নোংরা হয়ে আছে। নীলা মেয়েকে দেখে আঁতকে উঠল। মেয়ের হাত ধরে তাকে কাছে টেনে বলল, ‘কী হয়েছে, মামুণি? তোমার এই অবস্থা কী করে হয়েছে?’

পিউ মাকে কাছে পেয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। নীলা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘কাঁদে না মামুণি, কাঁদে না। কী হয়েছে মাকে বলো?’

ফাইজা বেগম পিউর কান্না শুনে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। পিউর এমন অবস্থা দেখে তিনি আঁচ করতে পারলেন কিছু একটা হয়েছে। তিনি নীলাকে বললেন, ‘নীলা পিউকে গোসল করিয়ে খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দে।’

নীলা উৎকণ্ঠা মিশ্রিত গলায় বলল, ‘কিন্তু মা দেখো না ওর কী অবস্থা হয়েছে! মেয়েটা কিছু বলছেই না। আসার পর থেকেই কেঁদে চলেছে। আবিরকে পাঠিয়েছিলাম ওকে আনতে। কিন্তু আবিরকে তো দেখতেই পেলাম না।’

ফাইজা বেগম আদেশের সুরে বললেন, ‘যেটা বলেছি সেটা কর।’

নীলা পিউকে গোসল করানোর পরে খাবার খাইয়ে দেবার সময় পিউ বলল, ‘মা, বাবা কোথায়? বাবা কি আমাদের ফেলে চলে গেছে? বলো না, মা। বাবা কেন আমাদের সাথে থাকে না? আমি বাবার ছবির সাথেই কথা বলি। অথচ আমার বন্ধুরা প্রতিদিন বাবার সাথে খেলে, গল্প করে, ঘুরতে যায়, ওদের বাবারা ওদেরকে অন্নেক আদর করে।’

নীলা উৎকণ্ঠা বলল, ‘স্কুলের কেউ বাবাকে নিয়ে কিছু বলেছে?’

নীলার প্রশ্ন শুনে পিউ মুখটা গোমড়া করে মাথা নিচু করে ফেলল। নীলা মেয়েকে কোলে বসিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে, পিউ? মাকে বলো। ভালো বাচ্চারা
মাকে সবকিছু বলে দেয়।’

পিউ স্কুলের সব ঘটনা বলল। পিউর মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে নীলা ভয়ে আঁতকে উঠল। এত ছোটো ছোটো বাচ্চাদের মাথায় কী করে এই ধরনের কথাবার্তা আসতে পারে তা নীলা ভেবে পেল না! তার ছোট্ট মেয়েটা আজকে বাবা না থাকার কারণে স্কুলের অন্যান্য বাচ্চাদের হাতে মার খেয়েছে এই কথাটা তার ভাবতেই ভয় করছে। বাবা-মায়েরা এখন নিজেদের গসিপে এতোটাই নিমগ্ন যে তারা এইটুকুও খেয়াল করে না যে, তাদের কথাবার্তার প্রভাব তাদের সন্তানের মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে তাদের মানবিকতা, মনুষ্যত্ববোধকে বিনষ্ট করে ফেলছে। এতে বাচ্চারা হয়ে উঠছে বেপরোয়া, ক্ষেত্রবিশেষে নিষ্ঠুর ও অমানবিকও হয়ে উঠছে। যার ফলে কিছু কিছু বাচ্চারা তাদের তুলনায় দুর্বল কাউকে দেখলেই তার প্রতি অন্যায় আচরণ করে এক ধরনের নিষ্ঠুর আনন্দ লাভে মরিয়া হয়ে উঠে।

নীলা পিউকে বলল, ‘পিউ মামণি, তোমার বাবা একদিন ঠিক আসবে। তখন তুমিও তোমার বাবার সাথে খেলতে পারবে, ঘুরতে পারবে।’

‘আমাকে অনেক আদর করবে?’ পিউ মুখটা মায়ের দিকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল।

নীলা বিষণ্ন চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, অনেক আদর করবে আমার মামুণিকে।’

‘মা, বাবা কবে আসবে?’ আহ্লাদী গলায় পিউ প্রশ্ন করল।

পিউর চোখের কোণে অশ্রু জমলো, বেদনাসিক্ত হয়ে উঠল মুহূর্তেই। নীলা পিউকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘আসবে, খুব তাড়াতাড়ি।’

পিউকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নীলা চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকল, ‘আসলেই কি আশফাক আসবে তার কাছে, তার মেয়ের কাছে।’

বন্ধ চোখের পাতায় আশফাকের সাথে তার ভালোবাসা, বিয়ে, একসাথে কাটানো সমস্ত সুন্দর মুহূর্তগুলো জীবন্ত চিত্রের ন্যায় এখনও জ্বলজ্বল করছে। এতোটা কালের বিচ্ছেদও তার বুকের মধ্যে এই মানুষটার উপর তার কখনও রাগ হয়নি। মনের মধ্যে যতটুকু আছে সবটাই অভিমান। নীলা ভাবে, যেদিন তার সাথে দেখা হবে, সেদিন খুব করে বকে দেবে সে, এই ভাবনা তার কতদিনের! সে ভেবে রেখেছে দীর্ঘ একমাস যাবৎ মৌনব্রত পালন করবে সে। আশফাকের সাথে কথাই বলবে না। এটাই তার শাস্তি।

সমস্ত ভাবনার বেড়াজালের মধ্যে ও নীলার দু’চোখের পাতায় ঘুম নেমে এলো। ঘুমের মধ্যে সে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। আশফাকের পাশে একটা সুন্দরী মহিলা আর একটা পরীর মতো বাচ্চা তাদের চারপাশে দৌড়াচ্ছে। নীলা খুব খেয়াল করে দেখল বাচ্চাটা পিউ নয়। নীলার চোখ পিউকে খুঁজছে। অবশেষে বাগানের একটা কোণে মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে থাকা পিউকে দেখতে পেল নীলা। পিউ গোমড়ামুখো হয়ে দাঁড়িয়ে আশফাক আর বাচ্চাটার দিকেই তাকিয়ে আছে। কিছু সময় পরে আশফাক বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করল। তারপর অন্য এক হাতে সুন্দরী মহিলাটির হাত আঁকড়ে ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। পিউ কাঁদছে হাউ মাউ করে। নীলা তার মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দিলেও তার কান্না থামছে না। পিউ হঠাৎ করে ডেকে উঠল, ‘বাবা, আমাদের ছেড়ে যেও না। বাবা, আমাকেও ওর মতো আদর করো। বাবা, আমাকেও ওর মতো কোলে তুলে নাও।’

পিউর শত ডাকেও আশফাক ফিরেও তাকাল না। হয়তো পিউর ডাক আশফাকের কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌঁছায়নি। কিন্তু পিউ হঠাৎ করেই মায়ের হাত ছেড়ে দিয়ে তার বাবার পিছু ছুটতে লাগল।

নীলার ঘুম ভেঙ্গে গেল। পিউ ঘুমাচ্ছে। নিষ্পাপ দেখাচ্ছে তাকে। নীলা পিউর মাথায় হাত বুলিয়ে তার কপালে চুমু খেলো। এমন অদ্ভুত স্বপ্ন সে কেন দেখল তা সে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ-ই নীলার মনে হলো, তার মানে কি আশফাকের জীবনে অন্য কেউ আছে?

___________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫৪

পড়ন্ত বিকেল, সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। ছায়াঘেরা শীতল পরিবেশ। স্নিগ্ধ বাতাসে শিহরিত হচ্ছে শরীর ও মন একই সাথে। অতল বসে আছে একটা লেকের পাশে। চারিদিকে সবুজ গাছগাছালির সমাবেশ। খানিক বাদে বাদেই নাম না জানা কতক পাখি ডেকে উঠছে তারস্বরে। অতলের দৃষ্টি লেকের নীল রঙা পানির উপর নিবদ্ধ। আকাশের নীল রঙ নদীর জলকে নীল রঙে রাঙিয়ে দিয়িছে। কী ভীষণ সুন্দর লাগছে! অতল মোহাবিষ্টের মতো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেদিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে। যেন নীল রঙ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিচ্ছে।

বহ্নির জন্য অপেক্ষা করছে সে। বহ্নির আসার কথা আরও আধ ঘন্টা আগে। কিন্তু এখনও তার দেখা নাই। অতলের রাগ হচ্ছে না। বরঞ্চ লেকের পানির দিকে তাকিয়ে পাখির কলতান শুনতে তার বেশ ভালো লাগছে। অনেকদিন এভাবে প্রকৃতির কাছাকাছি আসা হয়নি তার। অনেকদিন এভাবে ছায়াঘেরা বিকেলে নিজেকে খোঁজা হয়নি। আজ কেবল বহ্নির জন্যই এই সুযোগটা পেয়েছে সে। বাবার বারংবার করা তিরস্কার তার মন ও মস্তিষ্কে এমন এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলেছে। যার কারণে সে তার মধ্যে থাকা সম্ভাবনাগুলো সম্পর্কে জানতে পারেনি, বুঝতেও পারেনি, এমনকি এখনও তা কাজে লাগাতে পারেনি। বাবার ভালোবাসা পেতে মরিয়া অতল, একসময় বাবার ভালোবাসা পাবার আশা ছেড়েই দিয়েছিল। তারপরেও সে খুব করে চাইত বাবা যেন তার সাথে একটু ভালো করে কথা বলে। এতে আর কিছু হোক বা না হোক, বাসায় শান্তি বজায় থাকবে, সেও মন দিয়ে তার কাজ করতে পারবে। অথচ নিয়তির পরিহাস না-কি অতলের চিরায়ত দুর্ভাগ্য কে জানে, অতলের চাওয়া কখনোই পূরণ হয়নি।

অতল অনেকবার ভেবেছে বাবার ভালোবাসা পায়নি তাতে কী হয়েছে, মায়ের ভালোবাসা তো পেয়েছে। কিন্তু অবাধ্য মন বারংবার যেটা পাবার নয় সেটার পানেই ছুটেছে। আর প্রতিবারই সে আঘাত পেয়েছে হৃদয়ের ঠিক কোমল জায়গায়, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়েছে তার হৃদয় প্রান্তর, তবুও ভালোবাসার বৃষ্টি সেই ধু ধু প্রান্তরে বর্ষিত হয়ে তৃষিত হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দেয়নি।

এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যা পায় না তার পেছনেই সবসময় ছুটতে থাকে, আর না পাওয়ার বেদনায় বেদনাসিক্ত হতে থাকে। এই চিরায়ত নিয়মটির ব্যত্যয় কদাচিৎ-ই দেখা যায়। কারণ মানুষ যা খুব সহজেই পেয়ে যায় তাকে মূল্যহীন ভাবে আর যা পায় না তা যতই মূল্যহীন হোক না কেন সেই অলভ্য জিনিসটাকে ভাবে মহামূল্যবান। এতে করে আমরা অহর্নিশ ভুলে যাই, যে জিনিসটা আমাদের কাছে আছে তার গুরুত্ব মূল্যায়ন করতে।

এতো না পাওয়ার মধ্যেও মরুভূমির ধু ধু প্রান্তরে এক পশলা বৃষ্টির মতো বহ্নি তার জীবনে এলো। তার মনের উপর বিশাল রাজত্ব শুরু করে দিয়েছে পিচ্চিটা। এই ভাবনাটা মনের মধ্যে উঁকি দিতেই অতল হাসল। সেই হাসি তার ঠোঁটের কোণে লেগে রইল অনেকক্ষণ। কী বোকাই না সে, তার জীবনের সবচাইতে বেশি পরম নির্ভরতার মানুষটাকে চিনতে পারেনি সে। এতোটা বছর পরে, তাও তো পেল, এই ঢের। হঠাৎ মনে পড়ে গেল কিছুদিন আগের দুর্ঘটনার কথা। বিয়ের কনে বিয়েতে নিষেধ না করলে তাকে ওই মেয়েটাকেই বিয়ে করতে হতো। বাবার উপর প্রচণ্ড রাগ, ক্ষোভ, অভিমানে সেই মেয়েটাকে একটা বারও দেখার চেষ্টা করেনি, জানারও চেষ্টা করেনি।
বুকের মধ্যে এক তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করল সে। এই চিন্তাটা তার মাথা ভারী করে দিলো মুহূর্তেই। বুকের মধ্যে ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করল।

হঠাৎ শেষ বিকেলের এক চিলতে রোদের ঝলক এসে পড়েছে অতলের চোখ বরাবর। চকিতে সে ঘুরে তাকাল। তার ভালোবাসার মানুষটা ধীর পায়ে এক পা দু পা করে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। বাতাসে তার নীল শাড়ির আঁচলটা অবাধ্য হয়ে উড়ছে। বহ্নি সামলানোর চেষ্টায় মশগুল। এই চেষ্টা করতে গিয়ে তার হাতের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ কানে এসে বাজছে অমর্ত্যলোকের সুর ও ছন্দের ন্যায়। অতল মোহাবিষ্টের ন্যায় তাকিয়ে আছে তার দিকে।

‘স্যরি, শাড়ি পরতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল।’ অতলের কাছে এসে বহ্নি বলল, অপরাধীর সুরে।

অতল মুচকি হাসল। বহ্নি তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘হাসছ কেন?’

‘তোকে দেখে?’

‘আমাকে কি সার্কাস দেখানো জোকারের মতো লাগছে?’

অতল এবার হো হো করে হেসে ফেলল। বহ্নি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘এভাবে পাগলের মতো করে হাসছ কেন?’

‘ভালো লাগছে।’

‘কী ভালো লাগছে?’

‘তোকে।’

‘আমাকে?’

‘তো, আর কাকে ভালো লাগতে পারে আমার?’

‘ভালো লাগলে কেউ হাসে?’

‘বেশি ভালো লাগলে হাসে তো। অবশ্য ওটাও আপেক্ষিক।

‘আপেক্ষিক কীভাবে?’

‘ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হয়।’

দু’টো মানুষ পাশাপাশি বসে রইল অনেকক্ষণ, চুপচাপ। কিছুক্ষণ পরে অতল বহ্নির একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখল। তবে কিছু বলল না। দু’জন দু’জনার এতো কাছাকাছি থেকে যেন নিজেদের নিঃশ্বাসের শব্দ অনুভব করছে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে অতল মুখ খুলল। বলল, ‘আমার কল্পনা ভুল ছিল না। এই শাড়িটা শুধুই তোর জন্য। আমার নীল পরীর জন্য।’

বহ্নি মৃদু হাসল। বলল, ‘আমিও তোমার জন্য কিছু এনেছি।’

অতল উৎসাহী গলায় বলল, ‘কই, কি এনেছিস দেখি?’

‘এত অধৈর্য হচ্ছ কেন?’ বহ্নি অতলকে চোখ রাঙিয়ে
শাসিয়ে তার ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করে দিল।

অতল বলল, ‘এতে কী আছে?’

বহ্নি রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি নিজেই খুলে দেখো না।’

অতল র্য্যাপিং পেপার খুলে দেখল বক্সটার ভেতরে একটা সুন্দর ঘড়ি। অতল অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘আমার জন্য ঘড়ি কেন? ঘড়ি তো তোর দরকার।’

বহ্নি মুখ গোমড়া করে বলল, ‘ঠিক আছে। তোমাকে পরতে হবে না। তোমার পছন্দ হয়নি বললেই তো হয়। এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলছ কেন?’

অতল বহ্নির রাগ ভাঙাতে নরম সুরে বলল, ‘আরে বাবা, একটু মজা করেছিলাম। আমি কি একটা বারও বলেছি, এই ঘড়িটা আমার পছন্দ হয়নি? তোর পছন্দ সব সময় বেস্ট। এবার বল তো আমাকে ঘড়ি দেবার উদ্দেশ্য কি?’

‘তোমার সবসময়ের সঙ্গী হিসেবে এই ঘড়িটা সবসময় হাতে পরবে। যখনই সময় দেখবে তখনই তোমার মনে হবে এই ঘড়িটার মতো আমিও তোমার সঙ্গে আছি।’

‘জানিস, এটা আমার পাওয়া বেস্ট উপহার। এইটা কখনওই আমার হাত ছাড়া হবে না। আমার নীল পরীর দেওয়া প্রথম উপহার আজীবন আমার সাথেই থাকবে।’

আচমকা আকাশের রঙ পরিবর্তন হতে শুরু করল। ‘মেঘ না চাইতে বৃষ্টি’ কথাটির সত্যতার প্রমাণ দিতে আচমকা বৃষ্টি এসে হাজির হয়ে গেল। অতল বহ্নিকে নিয়ে দ্রুত একটা গাছের নিচে জায়গা নিল। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থেমে গেলে তারা দুজন আবারও আগের জায়গায় এসে বসল। ঠিক তখন পশ্চিমাকাশে রংধনুর প্রত্যাবর্তন হলো। অতল মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকল। বহ্নি অতলের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল অতল রংধনুতে মগ্ন হয়ে আছে। বহ্নি প্রশ্ন করল, ‘রংধনু ভালোবাসো?”

‘হুম, খুব। দেখতে ভালোবাসি। সাতটা রঙে রাঙানো এই রংধনু দেখলে আমারও ইচ্ছে হয় রংধনুর রঙে জীবনকে রাঙাতে।’

বহ্নি মনে মনে বলল, ‘তবে আজ থেকে এই রংধনু দেখা আর তার সাত রঙে রঙিন হবার স্বপ্ন আমারও।’

রংধনু যখন বিলীন হয়ে গেল তখন অতল বলল, ‘এঞ্জেল, এবার কিন্তু তোর যাওয়া উচিত।’

বহ্নি দেরি করল না। ঝট করে উঠে দাঁড়াল। অতলকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি যাবে না?’

অতল বলল, ‘আমি আর একটু পরে যাব। তুই বাসায় পৌঁছেই আমাকে কল করে জানাবি।’

বহ্নি হেঁটে বেশ কিছুদূর পথ হেঁটে চলে গেছে। অতল সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। তার মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা কথার উদয় হতেই আচমকা অতল দৌড়ে এসে বহ্নিকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কতক্ষণ কে জানে! বহ্নি স্মিত হেসে বলল, ‘একটু আস্তে, জনাব।’

অতল আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বহ্নি এবার বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। অতলের কি কিছু হয়েছে? সে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে তোমার? আমাকে বলো।’

অতল বলল, ‘কিছু হয়নি।’ পরক্ষণেই মাথা নিচু করে ফেলে বলল, ‘স্যরি, পারমিশন নেওয়া হয়নি।’

এরপর বেশ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ, নিস্তরঙ্গ। বহ্নি চুপ করেই দাঁড়িয়ে আছে। সে চায় অতল নিজ থেকেই বলুক। অতল বহ্নির হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘তোকে হারিয়ে ফেলার কথা ভাবতেই বুকের বাঁ পাশটাতে এক তীব্র ব্যথা অনুভব হয়।’

বহ্নি অতলের কথা শুনে আঁতকে উঠে বলল, ‘আমাকে হারিয়ে ফেলবে কেন? আমি কি তোমাকে ছেড়ে কোথাও চলে যাচ্ছি না-কি? সবকিছু ছাড়লেও তোমাকে ছাড়ব না, মনে রেখ?’

অতল বলল, ‘একটা কথা বলব?’

‘বলো।’

‘তোকে আজ ভয়ংকর সুন্দর লাগছে। জীবন্ত নীল পরীর মতো।’ তারপর মৃদু হেসে বলল, ‘যদিও আমি কখনোই পরী দেখিনি।’

অতলের কথা শুনে বহ্নি লজ্জা পেল। তারপরে আবার নিস্তব্ধতা। অতল আবার বলল, ‘এই মুহূর্তে ভয়ংকর একটা কিছু করতে ইচ্ছে করছে।’

বহ্নি অতলের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘ইচ্ছে করলেই হবে না। ভয়ংকর কিছু বিয়ের আগে করার কথা ভাবলে তোমাকেও ভয়ংকর শাস্তি পেতে হবে।’

অতল এবারও হো হো করে হেসে উঠল। বলল, ‘তোর দেয়া শাস্তি পেতেও আমি মরিয়া হয়ে আছি। তবে আজকের দিনের আমার ভয়ংকর ইচ্ছেটাকেই বুকের মধ্যে দাফন করে ফেললাম। তোর দেওয়া শাস্তির ভয়ে দাফন করেছি ভাবার কোনো কারণ নেই কিন্তু।’

______________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫৫

মাহফুজ হক স্ত্রীকে দেওয়া কথা রাখতে নীলাভ্র আর আফরিন দুজনকেই বাসায় নিয়ে আসলেন। আফরিনকে দেখে নওশীন হক শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কাঁদলেন ইচ্ছেমতো। মায়ের কান্না দেখে আফরিনের মনও বোধহয় কিছুটা নরম হলো। সে অনুনয়ের স্বরে বলল, ‘এখন আর কেঁদো না, আম্মু। আমাকে মাফ করে দাও, প্লিজ আম্মু।’

নওশীন হক প্রত্যুত্তরে কিছুই বললেন না। আফরিনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলেন। এক সপ্তাহ মেয়েকে না দেখে তিনি হয়তো সন্তানকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে কাবু হয়ে গিয়েছেন। এই মুহূর্তে নীরার মায়ের উপরেও কিছুটা অভিমান হচ্ছে। আফরিন অন্যায় করেছে তবুও তাকে কোনো প্রকার শাস্তি তো দূরের কথা নূন্যতম বকাঝকাও করা হলো না, এটা ভাবতেই তার খারাপ লাগছে। পরক্ষণেই আবার ভাবতে থাকলো, মায়ের মন হচ্ছে পৃথিবীর সবচাইতে কোমল জিনিস, যেটা শুধুমাত্র সন্তানের মঙ্গলের কথা ভেবেই বিগলিত হয়ে যায়, সমস্ত অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত জিনিসও মেনে নেয়, আবার সন্তানের বড়ো ধরনের ভুল ক্ষমাও করে দেয় নিমিষেই। তবে আফরিনের উপর থেকে তার রাগ গেল না। পাশাপাশি তার দুলাভাই নামক লোকটাকেও তার একদম অসহ্য লাগছে। তার ইচ্ছে করছে এই লোকটাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিতে। কিন্তু সব ইচ্ছে পূর্ণ হয় না। তাই সে ইচ্ছেটাকে মাটিচাপা দিয়ে সবকিছুই মুখ বুজে সহ্য করছে।

মা-মেয়ের কান্নাকাটির ঠেলায় নীলাভ্রকে যেন ভুলেই গেল সবাই। এই ঘরে পা রাখার পর থেকেই সে দাঁড়িয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে, পা দুটো খসে পড়ে যাবে। কেউ তাকে একটু বসতেও বলছে না। খুবই বিরক্ত লাগছে তার কাছে। এদিকে শ্বশুরবাড়িতে বউ নিয়ে উঠে আসায় তার একটু-আধটু লজ্জা হচ্ছে বৈ কী! তাই মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। আফরিনের উপরেও রাগ হচ্ছে, এই মেয়েটার জন্য সে নিজের বাবার কাছে কালার হয়ে গেল। অথচ সে যে এই বাড়িতে প্রবেশ করার পর থেকেই দাঁড়িয়ে আছে সেইদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই আফরিনের।

নীরা শেষমেশ সকলের জন্য নাস্তা তৈরী করতে কিচেনে চলে গেল। রাদিদ নীলাভ্রকে বলল, ‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন। আপনি চাইলে বিশ্রামও নিতে পারেন।’

নীলাভ্রের মনে হলো এই একটা মানুষ তার কষ্টটা বুঝতে পারল। রাদিদের প্রতি তার মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল। তার আসলেই বিশ্রাম দরকার। রাদিদ তাকে আফরিনের রুমে নিয়ে গেল। রাদিদ বলল, ‘আপনি ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিন, নাস্তা রেডি হলেই খেতে ডাকা হবে।’

রাদিদ নীরাকে সাহায্য করতে কিচেনে গেল। নীরা নাস্তা তৈরী করতে করতে রাগে গজগজ করছিল। রাদিদ বলল, ‘কী হয়েছে তোর? বাচালদের মতো এরকম নিজে নিজেই বকবক করছিস কেন?’

‘জানো না তুমি?’ নীরা রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে প্রচণ্ড পরিমাণে তেতে উঠল, ‘আম্মু কী সুন্দর করে আপুকে গলায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে বসে গেছে। আপুর এতো বড়ো অপরাধ ভুলে গেছে। বাবাও ভুলে গেছে, মাও ভুলে গেছে। তোমাকেও দেখে মনে হচ্ছে তুমিও ভুলে গেছ। খালি আমিই ভুলতে পারছি না।’

‘এখন এইসব বলে কী লাভ? তাড়াতাড়ি নাস্তা রেডি কর। সবাই ক্ষুধার্ত।’ আদেশের সুরে বলল রাদিদ।

‘আমাকেই সবাই অর্ডার করতে পারে। আর কেউ তো নেই খায়েশ মঞ্জুর করার জন্য।’ নীরার কণ্ঠে রাগ উপচে পড়ছে।

‘ওরে বাপ্রে! তুই দেখি রাগও করতে পারিস।’ খানিকটা কৌতুকের স্বরে বলল, রাদিদ।

‘রাদিদ ভাইয়া, তুমি কিন্তু আমাকে খুব জ্বালাচ্ছ?’ নীরা চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘বহ্নি আপুকে বিচার দিব কিন্তু…!’

বহ্নির কথা উঠতেই রাদিদের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তার এতক্ষণের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা মলিন হয়ে গেল। নীরা তার কথাটা অসম্পূর্ণই রেখে দিল। অপরাধীর সুরে বলল, ‘স্যরি, রাদিদ ভাইয়া।’

রাদিদ কিছু বলল না। নীরবে কিচেন থেকে প্রস্থান করল। নীরার মনটাও খারাপ হয়ে গেল। একটু পরেই রাদিদ ফিরে এসে স্মিত হেসে বলল, ‘দূর পাগলি, আমি তোর উপর রাগ করিনি। তবে বহ্নির প্রসঙ্গ না আনলেই ভালো। সে আমার কেউ না। আমিও তার কেউ না। এই কথাটা মাথায় ভালো করেই ঢুকিয়ে নে।’

নীরা মলিন স্বরে বলল, ‘বহ্নির কথা ইচ্ছে করে বলিনি, ভাইয়া। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। আমি সত্যিই দুঃখিত।’

রাদিদ হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, ‘বহ্নির নামটা শুনলেই কোথাও যেন আগুন জ্বলে। আমি সহ্য করতে পারি না সেই উত্তপ্ত আগুনের দহন। সবসময় ভুলে থাকার চেষ্টা করি। আর তো কিছু করার নেই আমার, তাই না?’

নীরা একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল,
‘ভুলতেও পারলে কোথায়? সে তো তোমার শয়নে- স্বপনে দিব্যি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তোমার রচিত শত শত কবিতা আর উপন্যাসের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে, তোমারই অগোচরে, নীরবে, খুব গোপনে।’

_______________

শিহরণের মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল যখন শুনল তার মা মান্নাতের সাথেই তার বিয়ের কথা পাকাপাকি করে ফেলেছে। খবরটা শোনার পর থেকেই সে অস্থির পায়ে পায়চারি করছে। তার বাবার সাথে কথা বলার জন্যই অপেক্ষা করছিল সে। বাবার সাথে সে অনেকটাই ফ্রি। তাই বিষয়টি বলা অতটা কঠিন হবে না। কিন্তু হুট করেই জানতে পারল তার বাবা বিজনেস ট্যুরে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে। এই খবরটা শোনার পর থেকেই তার মনটা ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। তার ধারণা এর মধ্যে সে বাবার সাথে কোনোমতেই কথা বলতে পারবে না। এই কথাটা ভাবতেই বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইছে। ছোঁয়ার সাথে বিচ্ছেদের কথা সে ভাবতেই পারে না। তার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে আসতে চায়। কী অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কেটে গেল তার পুরো বিকেলটা! অপরদিকে তার মা মান্নাতের পরিবারের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। সে এইসব কিছু সহ্য করতে না পেরে বিশ্রামের কথা বলে নিজের রুমে চলে এসেছে।

‘কী হয়েছে? তুমি এভাবে উঠে আসলে কেন?’ তীক্ষ্ম কণ্ঠে করা প্রশ্নে শিহরণ চমকে তাকাল তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মান্নাতের দিকে।

শিহরণ চোখ বন্ধ করে গম্ভীর শ্বাস ফেলে কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে সোজাসাপ্টা উত্তরে বলল, ‘আমি এই বিয়েটা করতে পারব না, মান্নাত।’

মান্নাতের চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বিস্ফোরিত নেত্রে শিহরণের দিকে তাকিয়ে মান্নাত প্রশ্ন করল, ‘বিয়ে করতে পারবে না মানে? সব ঠিক হয়ে গেছে, শিহরণ। এসব তুমি কী বলছ?’

শিহরণের চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে দাঁতে দাঁত চেপে টেনে টেনে বলল, ‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। না মানে না। এটা কখনোই হ্যাঁ হবে না। গট ইট?’

‘না, আমি বুঝিনি। বললেই হলো বিয়ে করতে পারবে না, তোমার আমাকেই বিয়ে করতে হবে।’ উত্তেজিত কণ্ঠে কথাগুলো বলে শিহরণের কাছে ঘেঁষে মান্নাত বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি শিহরণ। তুমি এভাবে না করো না।’

শিহরণের মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে। মান্নাত এবার শিহরণকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভাবতেই পারি না শিহরণ। প্লিজ, তুমি এই বিয়েতে রাজী হয়ে যাও। আমি তোমাকে অনেক সুখে রাখব, কথা দিচ্ছি।’

শিহরণ এক ঝটকায় মান্নাতকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিল। উত্তেজিত গলায় বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি না। বুঝতে পেরেছ?’

মান্নাত বেজায় বিরক্ত। সে আবারও শিহরণের কাছে এসে তাঁকে বাহুডোরে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ করে বলল, ‘আমি জানি তুমি আমাকে মিথ্যে বলছ। আমি জানি তুমি আমাকেই পছন্দ করো, আমাকেই ভালোবাসো।’

‘সিরিয়াসলি?’ শিহরণ ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, ‘আমার কোন আচরণটা দেখে আমি তোমাকে ভালোবাসি বলে মনে হয়েছে তোমার? আমি কি কখনও তোমাকে ভালোবাসি কথাটা বলেছি? কোনো ইঙ্গিত দিয়েছি? কিছু একটা তো বলো।’

মান্নাত কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি এই একটা কারণই যথেষ্ট আমার জন্য।’

‘কিন্তু আমার জন্য যথেষ্ট নয়।’ তেজী গলায় বলল শিহরণ ।

‘কিন্তু কেন?’

‘কারণ আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।’

মান্নাত কথাটা শুনে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর চাবি দেওয়া পুতুলের মতো করে বলল, ‘তাহলে তুমি ভুলে যাও যে আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে কখনও ভালোবেসেছিলে।’

শিহরণ হো হো করে হেসে উঠল মান্নাতের কথা শুনে। দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘এই দেহে প্রাণ থাকতে তা সম্ভব নয় মান্নাত।’

‘যদি যাকে ভালোবাসো সেই না থাকে তো?’ গমগমে গলায় প্রশ্ন করল মান্নাত।

_____________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে