ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৫০+৫১+৫২

0
1565

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫০

সকালে নাস্তা করতে বসেও কেমন যেন নিশ্চুপ, শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছিল পুরো ঘর জুড়ে। তানিয়ার মতো চঞ্চল মেয়েটাও নীরব ছিল। ইদানিং সেও তার বাবাকে কিছুটা ভয় পেতে শুরু করেছে, হয়তো কিছুটা ঘৃণাও তার মনে স্থান পেয়েছে। বিশেষ করে সেদিনের পর থেকে। অতল যখন আতিকের বিষয়টা খুব সাহস করে জানাল তার বাবাকে, তখন তিনি নিজের মধ্যে চেপে রাখা সমস্ত রাগ, ক্ষোভ বজ্রপাতের মতো করেই যেন অতলের উপর বর্ষিত করেছিল। অতলের বলা কথাগুলো তিনি বিশ্বাস তো করলেনই না বরং তার গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছিলেন। উপরন্তু তাকে কুলাঙ্গার উপাধি দেওয়া হলো। অতল পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে সবকিছু হজম করেছিল। সে বুঝে গিয়েছিল তার বাবার কাছে তার বলা কোনো কথারই মূল্য নেই। আতিক অতলের বলা সমস্ত কথা অস্বীকার করেছিল। তখন আশরাফ হোসেন আতিকের উপর বেশ গর্ব করে বলেছিলেন, ‘এমন ছেলে থাকলে বাবা-মায়ের আর কিছু লাগে না। তোর মতো কুলাঙ্গার সন্তান যেন আর কারও ঘরে না হয়। ঘরের শত্রু বিভীষণ বলে একটা কথা আছে না। তুই হলি ঘরের শত্রু। তোর মতো শত্রু আর কুলাঙ্গার সন্তান থাকতে আর নতুন কোনো শত্রুর কী দরকার?’

অতল পাথরের তৈরী জীবন্ত মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়েছিল। তার চোখের কার্নিশ বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু অতি সন্তর্পণে গড়িয়ে পড়েছিল। অতলের কাছে আতিকের বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমাণ ছিল। কিন্তু সে আর সেসব প্রমাণ দেখানোর প্রয়োজন বোধ করল না। আতিকের ব্যাপারটা অতল তার বাবাকে না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু যখন শুনেছে আতিক বিয়েতে রাজী, তখন সে আতিকের রিলেশনের বিষয়টা বাবাকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেবল বাবার মান-সম্মানের কথা ভেবে। কিন্তু তার বাবা তার কথা বিশ্বাস করল না। মেহেরুন নাহার শেষ পর্যন্ত অতলকে টানতে টানতে তার রুমে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়েছিলেন। অতল এর পর থেকে একটা কথাও বলেনি, রাতে ভাতও খায়নি। মেহেরুন নাহার আর তানিয়াও অভুক্ত থেকেছিল। কিন্তু পরদিন সকালে অতল খুব স্বাভাবিক ছিল, যেন কিছুই হয়নি। ছেলের এমন রূপ দেখে মেহেরুন নাহার ভয় পেতে শুরু করেছিলেন। তিনি অতলকে নিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকেন। ছেলেটার মানসিক অবস্থা খুবই সেনসিটিভ, কী করতে গিয়ে কী করে ফেলবে সেটা নিয়ে তিনি সবসময় উদ্বিগ্ন থাকেন।

নাস্তার টেবিলে বসে দ্রুত খাবার শেষ করে অতল কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই
আশরাফ হোসেন বাঁজখাই গলায় অতলকে বললেন, ‘আজকে কোথাও যেতে হবে না তোমার। তোমার আম্মুর সাথে শপিং এ যাবে।’

অতল দাঁড়িয়ে পড়ল। বাবার দিকে তাকালও না, আবার কোনো উত্তরও দিল না। মেহেরুন নাহার শুধু বললেন, ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমি রেডি হয়ে আসছি বাবা।’

অতল নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘তাড়াহুড়ো করো না মা। ধীরে সুস্থে রেডি হও। আমি অপেক্ষা করছি।’

তানিয়াকে উদ্দেশ্য করে আশরাফ হোসেন বললেন, ‘আমার মামুণিটার কোনো শপিং করতে হবে না? তুমিও যাও মামুণি তোমার আম্মুর সাথে।’

তানিয়া উদাস চোখে তাকাল বাবার দিকে। তারপর একই দৃষ্টিতে তাকাল অতলের দিকে। আতলের দিকে তাকাতেই তার মনটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সে মনে মনে বলল, ‘আমার প্রতি যেই ভালোবাসাটা তুমি দেখাও বাবা, তার এক কোটি ভাগের এক ভাগও যদি আমার এই হতভাগ্য ভাইটার প্রতি দেখাতে তবে এই ভাইটাই তোমার নাম উজ্জ্বল করে দিত। তুমি সারাজীবন উলুবনে মুক্তো ছড়িয়ে এসেছ। একদিন তোমার এই ভুলটা নিশ্চয়ই ভেঙবে। হয়তো তুমি স্বীকার করবে না, তবে বিবেকের দংশনে ঠিক দংশিত হবে। বিবেক কাউকে ছেড়ে দেয় না।’

তানিয়াকে ভাবুক দেখে আশরাফ হোসেন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, ‘আমার ছোট্ট মামুণিটা এত কী ভাবছে?’

বাবার কথায় তানিয়া সংবিৎ ফিরে পেল। বলল, ‘যাব, বাবা। আমার ভাই যাচ্ছে শুধু তাই যাব।’

মেয়ের কথা শুনে আশরাফ হোসেন আর কিছু বললেন না। তিনি খুব ভালো করেই জানেন তার মেয়েটা অতলকে ভীষণ ভালোবাসে।

শপিং যখন শেষের দিকে ঠিক তখনই একটা শাড়ির দিকে অতলের চোখ আটকে গেল। নীল রঙের শাড়িটা দেখেই তার বহ্নির কথা মনে পড়ে গেল। মনে হলো এই নীল রঙা শাড়িটাতে বহ্নিকে নীল পরীর মতো দেখাবে, যদিও সে পরী দেখেনি। তবুও তার জীবনে তিনজন জীবন্ত পরী আছে, যাদেরকে দেখে তার মনে হয়েছে, পরীরা ঠিক এরকমই হয়।

মা আর বোনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে শাড়িটা কিনে ফেলল। তার সাথে ম্যাচিং করা কানের দুল আর এক ডজন চুড়িও কিনল। তারপর এক ফাঁকে বহ্নির জন্য কেনা উপহারের প্যাকেটটা অতি সন্তর্পণে তার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল।

বাসায় আসার পরে তানিয়া তার রুমে এসে বলল, ‘শাড়িটা কার জন্য নিয়েছ, ভাইয়া?’

অতল ভীষণভাবে চমকে গেল। অতলকে চমকাতে দেখে তানিয়া বেশ মজা পেল। অতল যখন শাড়ি চুপিচুপি শাড়ি কিনছিল তখন সে সব দেখেও চুপ ছিল। অতল তানিয়ার মাথায় চাটি মেরে বলল, ‘কীসের শাড়ি? তুই ইদানিং বেশি পটর পটর করছিস, টমেটো সস।’

‘আমি কিন্তু সব দেখেছিলাম, ভাইয়া। তুমি শাড়ি কিনেছ, আবার সেই শাড়ির সাথে ম্যাচ করে কানের দুল আর চুড়িও কিনেছ।’

‘তোর না চোখে সমস্যা হইছে। আজ বিকেলেই তোকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাব।’

‘তুমি প্যাকেটটা কোথায় রেখেছ সেটা বললে তবেই কি বিশ্বাস করবে?’

অতল এবার অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। দুম করে তানিয়ার হাত ধরে আহ্লাদী গলায় বলল, ‘আমার মজার টমেটো সস, তুই এই কথা আর কাউকে বলিস না প্লিজ। এই তোর হাতে ধরলাম।’

‘উফ্, ভাইয়া। টমেটো সস বললে কিন্তু মাকে বলে দিব।’

‘তাহলে কি সয়া সস বলব না-কি চিলি সস বলব? কোনটা শুনতে চাস তুই? যেটা বলবি সেটা বলেই ডাকব তোকে।’

‘এসব কী শুরু করেছ, ভাইয়া। একদম বিরক্ত লাগে। খালি সস সস করো।’

‘আচ্ছা, যা এখন থেকে আর কোনো সস-ই বলব না। তোকে এখন থেকে তানু বলে ডাকব। ঠিক আছে এবার?’

‘একদম ঠিক আছে।’ তানিয়া হাসল।

অতল এক হাতে তানিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমার এই বোনটা হচ্ছে পৃথিবীর বেস্ট বোন।’

‘আর তুমি হচ্ছো আমার বেস্ট ভাইয়া।’

মেহেরুন নাহার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে ভাই-বোনের সব কথাই শুনেছেন। তিনি জানেন তার ছেলেটা খুব বেশিই ইন্ট্রোভার্ট। তানিয়ার উপর তার খুব গর্ব হচ্ছে। মেয়েটা খুব চেষ্টা করে অতলের মন ভালো করার জন্য। তার ছেলেটার জীবনে সত্যিই কেউ এসেছে? এই একটা বিষয় নিয়ে তিনি এখনও শঙ্কিত। প্রশ্ন করলেও কোনো উত্তর তিনি পাবেন না, এই এক জ্বালা উনার। ছেলেটা যে তাকে কিছুই বলতে চায় না।

__________________

বহ্নি অতলের দেওয়া উপহারের প্যাকেটটা খুলল। শাড়িটা দেখেই তার ভীষণ পছন্দ হলো। শাড়িটার উপরে একটা চিঠি। বহ্নি চিঠির ভাঁজ খুলে পড়তে শুরু করল।

প্রিয় আগুনমণি,

এঞ্জেল, তোকে তুমি করে বলতে পারি না কী করি বল তো? তুই তো সেই ছোট্টবেলা থেকেই আমার তুই হয়ে আছিস। এই শাড়িটাতে তোকে একদম পরীর মতো লাগবে, নীল পরী। আমার নীল পরী। ভীষণ ভালোবাসি, আমার নীল পরীটাকে।

তুই কিন্তু আমার জীবনের একমাত্র পরী না। আমার জীবনে তিনজন জীবন্ত পরী আছে। একজন আমার মা। মা হচ্ছে সাদা পরী। যখন মা আমার সামনে আসে তখন আমার মনে হয় চারিদিক আলোকিত হয়ে যাচ্ছে শুভ্র আলোকচ্ছটায়।

দ্বিতীয় জন আমার বোন তানিয়া। তানিয়া হচ্ছে লাল পরী। সে যখন আমার সামনে আসে তখন মনে হয় গোধূলি লগ্নের আকাশের লালিমার মতো চারিদিক রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ছে। আমার ভীষণ ভালো লাগে। তাই ওকে আমি টমেটো সস বলে ডাকি। ও কিন্তু এই ডাক শুনে ভীষণ ক্ষেপে যায়। ওকে খ্যাপাতে কিন্তু আমার ভীষণ ভালো লাগে।

আর তৃতীয় জন কে হতে পারে, একটু ধারণা কর তো। হুম, ঠিক ধরেছিস। তোর কথাই তো বলছি। তুই হচ্ছিস আমার নীল পরী। নীল পরীটাকে আমি অনেক অনেক সাধনা করে পেয়েছি, যদিও আমার চাইতে আমার পরীর সাধনা অনেক বেশি। তবুও বলছি, ভীষণ ভালোবাসি আমার এঞ্জেলকে, আমার নীল পরীকে।

ওহ, তোকে কী কখনও বলেছি, গোধূলী দেখতে আমি ভীষণ ভালোবাসি? জেনে রাখ, শেষ বিকেলের রংধনু আমার তার চাইতেও বেশি প্রিয়। মাঝেমধ্যে ভাবি, রংধনুর সাতটি রঙে যদি আমার জীবনটাও রঙিন হতো। তুই কি আমার সেই শেষ বিকেলের রংধনু হবি?

বি.দ্র. এই শাড়িটা দেখার পর মনে হয়েছে এটা কেবল এবং কেবলই আমার নীল পরীটার জন্য। এটা পরে আমার সাথে দেখা করতে আসবি।

ইতি
তোর অনেক সাধনার পরে অর্জিত ভালোবাসা

চিঠিটা পড়ে বহ্নির মনটা এক অবর্ণনীয় ভালোলাগায় ছেয়ে গেল। সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে আজ পূর্ণ চাঁদ। পূর্ণ চাঁদটা যেন পুরো আকাশে তার আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। চাঁদের সেই রুপোলি আলো গায়ে মাখছে গাছের সবুজ পাতা।

বহ্নি তার মোবাইলটা বের করে কল করল অতলকে। অতল যেন ওঁত পেতে বসেছিল কল রিসিভ করার জন্য। রিং পড়ার সাথে সাথেই কল রিসিভ করল অতল। বহ্নি বলল, ‘বাইরে আসবে?’

‘বাইরে কোথায়, আগুনমণি?’

‘আরে বাবা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াও। চাঁদটা দেখো। কেমন করে আলো ছড়াচ্ছে।’

অতল আর দেরি করল না। ব্যালকনিতে আসতে আসতে বলল, ‘শাড়ি পছন্দ হয়েছে, নীল পরী?’

‘ভয়ংকর রকমের পছন্দ হয়েছে।’ বহ্নি হেসে বলল।

‘ভয়ংকর রকমের পছন্দ? সেটা আবার কী রকম?’

অতলের প্রশ্ন করার ধরন শুনে বহ্নি হাসল প্রাণখুলে। তারপর বিজ্ঞের মতো করে বলল, ‘যখন কোনো পছন্দ একজন মানুষের পছন্দের সর্বোচ্চ মাত্রা অতিক্রম করে ফেলে তখন সেটাকে ভয়ংকর রকমের পছন্দ বলে।’ পরক্ষণেই বহ্নি কোনো প্রকার দ্বিধা, সঙ্কোচ ব্যতিরেকে বলল, ‘যেমন তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা। ভয়ংকর রকমের ভালোবাসি তোমায়।’

‘এতো ভালোবাসিস কেন আমায়? আমার মতো অধমকে এতোটা ভালোবাসা কি ঠিক হচ্ছে তোর?’ অতলের কন্ঠস্বর দ্বিধান্বিত শোনাল যেন।

‘ঠিক ভুল কিছু বুঝি না আমি। আমি শুধু জানি ভালোবাসি, ভীষণভাবে ভালোবাসি, ভয়ংকর রকমের ভালোবাসি তোমায়।’

বহ্নির ভালোবাসি কথাটা বলার ধরনে অতল হো হো করে হেসে উঠল। মোবাইলটা অপর হাতে কানে চেপে ধরে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রসিকতা করে বলল, ‘আচ্ছা আগুনমণি, আমি যদি কখনও তোর কাছ থেকে হারিয়ে যাই তখন তুই কি করবি? না, মানে ভয়ংকর রকমের ভালোবাসিস বললি তাই জানতে চাইলাম আরকি।’

বহ্নি গম্ভীর কণ্ঠে দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘আমি তোমাকে কখনোই হারাতে দিব না,

অতল হাসল। বহ্নি বলল, ‘হাসছ কেন?

‘সেকী! তুই কি আমাকে দেখতে পাচ্ছিস?’

‘আবার তুই?’

‘ওহ্, স্যরি। আসলে এত বছরের অভ্যাস কি আর কয়েকদিনে পরিবর্তন হবে?’

‘আচ্ছা, বল তো তুই কি আমাকে দেখতে পাচ্ছিস? মানে আশেপাশে কোথাও চলে আসিসনি তো আবার? তুই যে রকম পাগলি, তোর তো কোনো বিশ্বাস নেই।’

‘হুম, পারছি তো। মনের চোখ দিয়ে দেখছি। আর অনুভব করতে পারছি।’

হঠাৎ অতল প্রশ্ন করে বসল, ‘আমাকে জানাসনি কেন?’

‘কী?’ অতলের করা প্রশ্ন বুঝতে না পেরে পাল্টা প্রশ্ন করল, বহ্নি।

‘ভালোবাসিস সেটা।’

বুঝতে পেরে বহ্নি লজ্জা পেল। লজ্জাবনত কণ্ঠে বলল, ‘তুমি তো অন্য একজনের মধ্যে ডুবে ছিলে। আমার সাহস হয়নি।’

‘ভুল করেছিলি।’ অতল গম্ভীরভাবে ঘন গন বার কয়েক শ্বাস ফেলে বলল, ‘তুই কনফেস করলে আমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারতাম।’

‘তখন বললে তুমি বুঝতে পারতে না।’ বহ্নি বলল, দৃঢ়তার সাথে।

‘এতটা নিশ্চিত হচ্ছিস কীভাবে?’

‘তোমাকে আমি তোমার থেকেও বেশি চিনি।’

‘আচ্ছা, তুই আমাকে কোনো প্রকার সম্বোধন ছাড়াই কথা বলছিস কেন?’

‘কী বলে ডাকব তোমায় বলো?’

‘কেন? অতল বলবি।’

‘হুম, আসলে আমারও একটু সমস্যা হচ্ছে কিন্তু। অতল ভাইয়া বলেই তো অভ্যস্ত।’

‘তাহলে অতল ভাইয়া বলেই ডাকতে পারিস। আমার অবশ্য কোনো অসুবিধা নেই।’ কথাটা বলেই অতল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।

‘না, অতল ভাইয়া বলে ডাকব না। অতল ডাকব। শুধু অতল।’

‘নো সমস্যা। আমাকে জানু, জান্টুস, মনপাখি যা খুশি তাই ডাকতে পারিস। আমার এত ডাকাডাকি নিয়ে সমস্যা হয় না।’ অতল কৌতুক মিশ্রিত কণ্ঠে বলল।

‘এহ্, এত বিচ্ছিরি টাইপ ডাক তোমাকে আমি কখনোই ডাকব না।’ বহ্নি বলল, চোখ মুখ কুঁচকে।

‘জানু বিচ্ছিরি?’ অতল জানতে চাইল অবাক হয়ে।

‘জানু খুব কমন, বাকিগুলো খুবই বিচ্ছিরি।’

‘এই রে, একটা তারা খসে পড়েছে তুমি দেখেছ?’

‘হুম, কিন্তু দেখলেই বা কি?’

‘উইশ করবে না?’

‘এঞ্জেল, আমি এসব একদম বিশ্বাস করি না।’

‘তাতে কি হয়েছে? আমিও করি না তো।’

‘তুই উইশ করেছিস?’

‘না, আমিও বিশ্বাস করি না।’ বহ্নি হাসল।

‘তবে জানতে চাইলি যে?’

‘তুমি বিশ্বাস করো কি না তা জানার জন্য।’

অতল এবার হেসে ফেলল। বারান্দায় একটা অপরাজিতা গাছ লাগিয়েছিল সে। সেই গাছটাতে বেশ অনেকগুলো অপরাজিতা ফুল ফুটেছে। একটা ফুল আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দিয়ে অতল বহ্নিকে প্রশ্ন করল, ‘অপরাজিতা ভালোবাসিস?’

‘হুম, খুব।’

‘অপরাজিতার নীল রঙটা কষ্টের প্রতীক জানিস তো?’

‘জানি, তবুও এই নীল আমার ভীষণ প্রিয় । কারণ নীল তোমার পছন্দ। তোমার পছন্দ আমার পছন্দ।’

অতল এবার নিশ্চুপ। মেয়েটা কেন যে তাকে এতো বেশি ভালোবাসে তা অতল জানে না। এখন অবশ্য তা জানতেও চায় না। এখন সে শুধু জানে, এই মেয়েটাকে তার খুব করে চায়, একদম আপন করে নিতে চায় সে তাকে। সে অনুভব করে এই পিচ্চিটার পাগলের মতো ভালোবাসা, বিনিময়ে সেও তাকে পাগলের মতো করে ভালোবাসতে চায়, পাগলিটার চাইতেও বেশি করে। অতল ভাবে তাকে এভাবে পাগলের মতো করে ভালোবাসার মতো কী আছে তার মধ্যে? সত্যিই কি কিছু আছে? না-কি কিছুই নেই, না-কি সে বরাবরের মতোই নিঃস্ব, রিক্ত, নির্জীব এক মানব?

____________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫১

মায়ার বিয়ে উপলক্ষে খুব ছোটোখাটো আয়োজন করা হয়েছে। ছোঁয়া, হিয়া, অহনা আর সাইফ অনেকটা জোর করেই মায়াকে পার্লার থেকে সাজিয়ে নিয়ে এসেছে। মায়া অনেক নিষেধ করা সত্ত্বেও তার কথা কেউ শুনল না। ছোঁয়া তো বলেই বসল, ‘আরে দোস্ত, বিয়ে তো একবারই করবি, সেই একবারও যদি একটু সাজগোজ না করিস তাহলে কেমনে হবে?’

হিয়া মজা করে বলল, ‘তেমন কিছুই হবে না, ছোঁয়াপু। দুলাইভাই শুধু একটু আফসোস করে বলবে, আজকের দিনে একটু সাজলেও পারতেন।’

হিয়ার কথা শুনে সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ল।
সাইফ মায়াকে বলল, ‘এই তুই এদের কথায় একদম কান দিস না। তুই এমনিতেই অনেক সুন্দর।’

মায়ার বন্ধুদের এমন স্বতঃস্ফূর্ত কাজ দেখে মায়ার মা আর বাবা বেশ নিশ্চিন্ত হলেন।
______________

নীলাভ্র শেষ পর্যন্ত বরের পোশাক পরে নিজের রুমে বসে ছিল। আফরিন ভিডিয়ো কল করছে বার বার। নীলাভ্র কল রিসিভ করতেই দেখতে পেল আফরিন একটা ব্লেড নিজের হাতের উপর ধরে বলল, ‘এখন বিশ্বাস হচ্ছে তো, নীল?’

নীলাভ্র আঁতকে উঠল। আতঙ্কিত গলায় বলল,
‘আফরিন এটা করো না, প্লিজ।’

আফরিন অপ্রকৃতিস্থের মতো করে হেসে বলল, ‘কেন? ভয় হচ্ছে নীল?’

‘আফরিন, প্লিজ তুমি এটা করো না, প্লিজ আফরিন, প্লিজ।’ অনুনয় ভরা কণ্ঠে বলল নীলাভ্র, ‘নিজের ক্ষতি করো না আফরিন, প্লিজ।’

‘কেন, নীল? কেন? তুমি তো বিয়েটা করবেই, তাই না? তাহলে আমি বেঁচে থেকে কী করব বলো?’ কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল আফরিন।

নীলাভ্র অসহায় গলায় বলল, ‘আফরিন, আমি অপারগ।’

আফরিন ব্লেড হাতে বসিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। সেও গমগমে গলায় বলল, ‘আমিও অপারগ নীল। তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তুমি আমাকে ভালোই বাসোনি কখনও ।’

নীলাভ্র আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল, ‘আফরিন, তুমি নিজের ক্ষতি করো না, প্লিজ। আমি এই বিয়েটা করব না। আমি তোমার কাছে আসছি।’

আফরিন ব্লেড ছুড়ে ফেলে দিল। মরিয়া হয়ে সে বলল, ‘আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব, নীল। আজকেই আমরা বিয়ে করব।’
________________

বিয়ে বাড়িতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। বরের পরিবার চলে এলেও এখনও বরের দেখা নেই। বরের গাড়িতে ছিল অতল, তানিয়া আর আয়মান। গাড়ি যখন কনের বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছিল ঠিক তখনই আতিক গাড়ি থেকে নেমে পড়ে, তার অফিসের খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা বলে। অতল অনেক জোর করলেও তার কথা না শুনেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ে সে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন আতিক এলো না তখন অতল যখন আতিককে ফোন করল তখন আতিক বারবার তার কল কেটে দিচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত তার ফোনটাই বন্ধ করে রাখল। অতল ঠিক এই ভয়টাই পেয়েছিল, অথচ তার বাবা তার কথা শুনল না। এর পরের অবস্থা কী হবে সেটা নিয়েই সে বেশ উদ্বিগ্ন।

গাড়ি থেকে নেমে সোজা মায়ের কাছে ব্যাপারটা খুলে বললেন। আশরাফ হোসেন বিষয়টা জানতে পেরে থম ধরে বসে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। একটা সময় পরে সবাই জেনে গেল যে, বর আসেনি। তখন মায়ার বাবা শফিক সাহেব আশরাফ হোসেনকে উদ্দেশ্য করে কঠিন গলায় বললেন, ‘এসব কী হচ্ছে, আশরাফ সাহেব? বিয়েতে কি আপনার ছেলের মত ছিল না? আপনি কি জোর করে বিয়ে দিচ্ছিলেন? এভাবে আমাদের অপমান করার কী দরকার ছিল বলেন?’

আশরাফ হোসেন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি নতমস্তকে হাত জোর করে ক্ষমা চাইলেন তার এক সময়কার কলিগ শফিক সাহেবের কাছে। শফিক সাহেব কঠিন কিছু কথা শোনালেন তাকে। অবশেষে আশরাফ হোসেন শফিক সাহেবকে বললেন, ‘আপনার আপত্তি না থাকলে আমার আরেক ছেলের সাথে আপনার মেয়েকে বিয়ে দিতে পারেন।’

শফিক সাহেব যেন অকূল পাথারে ঠাই খুঁজে পেলেন। তিনি সাথে সাথে রাজী হয়ে গেলেন। তারপরও বলে গেলেন যে, ‘আপনার এই ছেলে রাজী হবে তো?’

আশরাফ হোসেন বললেন, ‘ও রাজী হবে। আপনাকে ভাবতে হবে না। ছেলে তো বিয়েতে এসেছে। আমি এখনি তার সাথে কথা বলব।’

শফিক সাহেব বললেন, ‘একটু তাড়াতাড়ি করুন, প্লিজ। কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানোর জন্য অনেক্ষা করছেন। আমাদের আত্মীয় স্বজনরাও অপেক্ষা করছেন। আজকে বিয়েটা না হলে আমাদের অনেক অপমানিত হতে হবে।’

বর না আসার বিষয়টা ততক্ষণে মায়া জেনে গেছে। মায়া সেই খবরটা শুনে পাথরের মতো জমে গেল। কারো সাথে কোনো কথা বলল না সে। ছোঁয়া আর সাইফ দুজনেই তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল।

আশরাফ হোসেন অতলকে ডেকে বললেন, ‘বিয়েটা তোমাকেই করতে হবে। বাবার মান-সম্মান বাঁচাতে এই বিয়েটা করতে নিশ্চয়ই তোমার কোনো আপত্তি নেই?’

অতলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এভাবে হুট করে কীভাবে বিয়ে করতে বলছে তার বাবা তা সে কোনোভাবেই বুঝতে পারল না। সে ইতস্তত করে বলল, ‘বাবা, আমি কি করে বিয়ে করব? কাকে বিয়ে করব? যার সাথে বিয়ে হচ্ছে তাকে তো আমি দেখলামও না। তাছাড়া আমি এখন বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত নই।’

আশরাফ হোসেন অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন মেহেরুন নাহারের দিকে। গমগমে কণ্ঠে বললেন, ‘দেখলে তো, খুব তো গর্ব করো এই ছেলেটাকে নিয়ে। আমার নাম ছড়াবে এই ছেলে একদিন। দেখলে তো, এই ছেলে আজ আমাকে এই অপমানের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সামান্য বিয়ে করতে পারছে না। এরকম বেকার ছেলেকে কে মেয়ে বিয়ে দেবে বলো তো? শফিক সাহেব শুধু আমার দিকে তাকিয়েই বিয়েটা দিচ্ছেন। এইটাতে শুকরিয়া না করে সে বলছে তার মানসিক প্রস্তুতি নেই।’

অতলের ইচ্ছে হলো একবার বলেই ফেলুক, ‘তাহলে বিয়েটা তুমিই করে নাও বাবা। আমাকে কেন এতো প্রেশার দিচ্ছ?’

কিন্তু সে মুখে বলল, ‘এরকম কিছু হতে পারে মনে করেই তো আমি সেদিন আতিক ভাইয়ের রিলেশনের বিষয়টা জানিয়েছিলাম। তখন তো আমার বিশ্বাস করোনি। বিশ্বাস করলে এরকম তো হতো না, তাই না?’

আশরাফ হোসেন কড়া গলায় বললেন, ‘আমি এতো কিছু শুনতে চাই না। বিয়েটা তোমাকেই করতে হবে। ব্যস, আমার কথা এখানেই শেষ।’

মেহেরুন নাহার বুঝতে পারছেন না তিনি কী করবেন! অতলকে কাছে ডেকে তিনি বললেন, ‘বাবা, বিয়েটা করে নে। তোর ভাই তো আমাদের সবাইকে এই বিপদে ফেলে চলে গেছে। এবার তুই-ই শুধু আমাদের এত্ত বড়ো অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে পারিস। এতে করে হয়তো তোর প্রতি তোর বাবার দৃষ্টিভঙ্গিটা পরিবর্তন হবে। তিনি হয়তো বুঝতে পারবেন, যেই ছেলেটাকে দূর দূর করে বারবার অবহেলা করে এসেছেন, সেই ছেলেটাই তার দুঃসময়ের তার পাশে এসে দাঁড়াল। হয়তো তখনই তোর বাবা তোর গুরুত্বটা বুঝতে পারবে।’

অতল নির্বিকারভাবে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। মেহেরুন নাহার আবারও বললেন, ‘বাবা, মেয়েটা খুব ভালো। আমি চিনি মেয়েটাকে। খুব লক্ষ্ণী একটা মেয়ে। ওকে বিয়ে করলে তুই কখনও আক্ষেপ করবি না, শুধু এটুকু বলছি।’

কথা শেষ করেই মেহেরুন নাহার চলে গেলেন। অতল সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল, নির্বিকার ভঙ্গিতে, অনুভূতি শুন্য হয়ে। তবে তার চোখের দৃশ্যপটে কেবলই বহ্নির ছবি দেখছে সে। সে যদি অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করে তাহলে বহ্নির কী হবে? সে কি তবে তার ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলবে? কেন, তার ভাগ্যটা এতো খারাপ? হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল। অতল মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল বহ্নি কল করছে। অতল অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে।

অতলকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে তানিয়া শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘ভাইয়া, তোর মনের কথা শুনবি শুধু। বাবা-মা তোকে বলেছে বলেই কিন্তু তোকে বিয়েটা করতে হবে না। বাবা-মায়ের কথা ভেবে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিস না, যার জন্য সারাজীবন আক্ষেপ করতে হয়।’

বাবা আর মায়ের চাপে পড়ে অতল বিয়েতে শেষমেশ রাজী হয়ে গেল।

_________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৫২

নীলাভ্র আর আফরিন রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করে ফেলল। বিয়ে করার পরেই যেন আসল ভয় পেয়ে বসেছে নীলাভ্রকে। আফরিন অনেকটা জোর করেই নীলাভ্রকে নিয়ে তার বাড়িতে চলে এলো। নীলাভ্রকে দেখে আশরাফ হোসেন বাঁজখাই গলায় বললেন, ‘কুলাঙ্গার কোথাকার। বাপের মান ইজ্জত খেয়ে এখন এখানে কেন এসেছিস তুই? তুই এই বিয়ে করতে পারবি না তো আমাকে বলতে পারতি। এভাবে আমার মান সম্মান কেন ধুলোয় মেশালি?’

আশরাফ হোসেনের বজ্রের ন্যায় কণ্ঠস্বরে যেন নীলাভ্রের কান ঝলসে গেল। সে মাথা নিচু করেই রইল। আফরিন তেজী গলায় বলল, ‘আপনি সবাইকে ধমকের উপর রাখেন বলেই তো সবাই আপনাকে এরকম ভয় পায়। এরকম অকারণ জেদ থাকা ভালো না। এতো বড়ো ছেলেকে বিয়ে দিচ্ছেন অথচ তার কোনো পছন্দ আছে কি না তা একবার জানতে চাইলেন না। কেন বলুন তো? বিয়ে করার পরে সংসার তো আপনার ছেলেকেই করতে হবে। তাই না?’

আশরাফ হোসেনের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। এভাবে কেউ কোনোদিন তার সাথে কথা বলেনি। হাঁটুর সমান বয়সী মেয়ে তার সাথে মুখে মুখে তর্ক করছে। তিনি তা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারলেন না। প্রচণ্ড ক্রোধান্বিত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘তোমাদের জায়গা এই বাড়িতে হবে না। বেয়াদব একটা মেয়েকে বিয়ে করার জন্যই তুই আমার মান সম্মানের জলাঞ্জলি দিয়েছিস। তাই না? ঠিক আছে। যার যেমন খুশি তেমন করো। এই বাড়ির দরজা তোর জন্য সারা জীবনের জন্য বন্ধ। ‘

কথাগুলো বলেই আশরাফ হোসেন আফরিন আর নীলাভ্রর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন । নীলাভ্র আর আফরিন দুজনেই দুজনের মুখের দিকে একবার দেখল। উপায়ান্তর না পেয়ে তারা অজানার পথে পা বাড়াল।

নীরব রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নীলাভ্র তার বন্ধুদেরকে কল দিয়ে একটা থাকার জায়গা ব্যবস্থা করে দিতে বলল। কিন্তু কেউই করল না। শেষমেশ ওরা একটা হোটেলে গিয়ে উঠল।

_______________

নওশীন হক মাথায় আইসপ্যাক দিচ্ছেন। বিকাল থেকেই তার মাথাটায় তীব্র যন্ত্রণা করছে। এই যন্ত্রণাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তার মেয়ে আফরিন। মেয়েটা সেই সকাল বেলা বেরিয়েছে। তারপর সন্ধ্যা অবধি তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। মাহফুজ হকেরও যেন এবার টনক নড়েছে। বিজনেস ইস্যু নিয়ে তিনি এতোটাই ব্যস্ত থাকেন যে পরিবারের দিকে নজর দিতে পারেন না। আবার তিনি তার স্ত্রীর কথাকেও খুব একটা গুরুত্ব দেননি। তাই তার খুব আফসোস হচ্ছে। মেয়েটার জন্যেও দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আফরিনের বন্ধু-বান্ধব যারা আছে তাদের সবাইকেই কল করেছে নীরা। কিন্তু তাদের কারো কাছেই যায়নি আফরিন। শেষমেশ নওশীন হক কান্নাকাটি শুরু করলেন মেয়ের জন্য। অবশেষে মাহফুজ হক পুলিশে খবর দিতে যেই পুলিশের নাম্বার ডায়াল করবে অমনি একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসলো তার মোবাইলে। মাহফুজ হক কলটা রিসিভ করতেই আফরিন গমগমে গলায় বলে উঠল, ‘আব্বু, আম্মুকে দাও। আম্মুর সাথে কথা আছে আমার।’

নওশীন হক কান্না ভেজা গলায় বললেন, ‘আফরিন মা আমার, তুই কোথায়? এভাবে না বলে কয়ে কেউ কি বাসা থেকে বের হয়ে যায়?’

‘মা, আমি বিয়ে করে ফেলেছি।’ অনুভূতিশূন্য কণ্ঠে বলল আফরিন।

নওশীন হক যেন খবরটা ঠিক ঠাউর করতে পারলেন না। তিনি দ্বিধান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘কী করে ফেলেছিস?’

‘বিয়ে! বিয়ে করে ফেলেছি আমি। তোমার কাছে আর কখনোই ফিরব না, মা। তোমার জন্য তো নীরাই ভালো। নীরাই তোমার সব। তুমি এখন নীরাকে নিয়েই থাকো। আমি তোমার কাছ থেকে দূরে সরে গেলাম।’ কঠিন গলায় জবাব দিলো আফরিন।

‘কী!’ নওশীন হক একটা বিকট চিৎকার দিয়ে উঠলেন। তার শরীর কাঁপছে। হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেছে। নীরা দৌড়ে এসে তার মাকে ধরে সোফায় বসাল।

মাহফুজ হক চিন্তিত সুরে বললেন, ‘নওশীন, কী হয়েছে তোমার? আফরিন কী বলেছে? ও কোথায়?’

‘আফরিন বিয়ে…!’ কথা শেষ করার আগেই সেন্স হারালেন নওশীন হক।

নীরা মায়ের পাশে বসে মায়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘আব্বু, ডাক্তারকে কল করো এখনি। মা কেমন যেন করছে। প্লিজ আব্বু তাড়াতাড়ি করো। মায়ের কিছু হলে আমি আপুকে কোনোদিনও ক্ষমা করব না। তুমি আপুকে আস্কারা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছ। আমি তোমাকেও ক্ষমা করব না।’

মাহফুজ হকের নিজেকে অসহায় লাগতে শুরু করল। তিনি তার স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসেন। তার স্ত্রীর কিছু হয়ে গেলে তিনি নিজেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন না। তিনি দ্রুত তার ফ্যামিলি ডাক্তারকে কল করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার চলে এলো। ডাক্তার জানালেন, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সেন্স ফিরে আসবে। অতিরিক্ত দুর্বলতা আর টেনশনের কারণে তার বিপি হাই হয়ে গেছে।’

নওশীন হকের জ্ঞান ফিরতেই তিনি আবারও আফরিন বলে চিৎকার শুরু করলেন। মাহফুজ হক স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। নওশীন হক ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। তিনি কান্না ভেজা গলায় বললেন, ‘আমার মেয়েকে এনে দাও। আমি জানি না ও কাকে বিয়ে করেছে। ওকে বলো, যাকেই বিয়ে করুক আমি মেনে নেব। আমার মেয়েকে শুধু এনে দাও আমার কাছে।’

মাহফুজ হক স্ত্রীর কাপলে চুমো দিয়ে বললেন, ‘আমি এনে দেব তোমার মেয়েকে। তুমি একদম চিন্তা করো না। আমি সব ঠিক করে দিব এবার।’

মাহফুজ হক আফরিনের নাম্বারে অনেক বার কল করেছেন। কিন্তু মেয়েটা মোবাইল সুইচড অফ করে রেখেছে। নীরা বাবার কাছে এসে মাথা নিচু করে লজ্জাবনত কণ্ঠে বলল, ‘আব্বু, আমাকে ক্ষমা করে দাও, প্লিজ। তখন আম্মুকে ওভাবে দেখে আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’

মাহফুজ হক মেয়ের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন। এই মুহূর্তে তার কাছে কোনো শব্দ নেই। তিনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমি তোমার কথায় কিছু মনে করিনি আম্মু। তবে তুমি যা বলেছ সব ঠিকই বলেছ। টাকা পয়সা উপার্জন করলেই হয় না। পরিবারকেও সময় দিতে হয়। বিশাল বিত্ত-বৈভব থাকলেই সুখের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়, এটা আমার ভুল ধারণা ছিল। তোমার কারণে আজ সেই ভুলটা ভেঙ্গে গেছে।’

এক সপ্তাহ হয়ে গেছে এখনও আফরিন কোনো যোগাযোগ করেনি। এদিকে নওশীন হকের অবস্থা খুবই করুণ। ফুফুকে এমন অসহায় অবস্থায় দেখে রাদিদ নিজ উদ্যোগে আফরিনকে খুঁজতে বেরিয়ে গেল।

_______________________

বর না আসার সংবাদ শুনে কিছুটা ভেঙ্গে পড়লেও শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নেয় মায়া। কিন্তু যখন শুনেছে তার বাবা বরের পরিবর্তে বরের ভাইয়ের সাথে তার বিয়ে দিতে চাইছেন, তখন সে খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে গেল। বাবার সাথে তার এক চোট লেগে গেল। কোনোদিন বাবা-মায়ের সাথে উচ্চস্বরে কথা না বলা মায়াও বলে বসল, ‘বাবা, আমি কি তোমাদের কাছে একজন মানুষ না-কি কোরবানের গরু যে এক জন ক্রেতা কিনেনি বলে অন্য একজনকে গছিয়ে দিতে চাইছ?’

শফিক সাহেব মেয়ের কাছে শত অনুনয় বিনয় করা সত্ত্বেও মায়া রাজী হলো না। হিম শীতল গলায় বাবাকে বলেছিল, ‘বাবা, তুমি কি চাও তোমার মেয়ে কোনো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে চলে যাক? বিয়েটাই কি জীবনের সবকিছু? এই একদিনেই আমি কি তোমার কাছে বোঝা হয়ে গেছি যে একটা বিয়ে ভেঙ্গে গেছে বলে আমার আর কখনও বিয়েই হবে না বলে ভাবছ?’

শফিক সাহেব তখন অসহায় গলায় বললেন, ‘মা রে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা যে তোরই বদনাম করবে? বলবে মেয়েটারই কোনো দোষ আছে। বাবা হয়ে মেয়ের অপমান কি করে সহ্য করব?’

‘তুমি যাদের কথা বলছ, তারা যদি আমাদের খারাপ সময়ে আমাদের পাশে বন্ধু বেশে না থেকে শত্রু বেশে থাকতে চায় তাহলে তাদের পরোয়া করে জীবনকে একটা অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দেওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে বাবা? আর এমন হঠকারিতা দেখানোর জন্যই কি তোমরা মিলে আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছ?’ মায়ার প্রশ্নের যৌক্তিকতায় শফিক সাহেব বাকরুদ্ধ। তিনি কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না!

ছোঁয়া বলল, ‘আঙ্কেল, মায়া একদম ঠিক বলছে। ও শিক্ষিত মেয়ে। আপনি চাকরি করতে নিষেধ করেছেন বলেই সে ভালো জব পেয়েও করেনি। এতোদিন সে আপনার কথা শুনে এসেছে। আপনার উপর ভরসা করেছে। এই একটা বার নাহয় আপনি ওর উপর ভরসা করে দেখুন।’

সাইফও একই কথা বলল। বন্ধুদের সাথে পেয়ে মায়ার মনের জোর কয়েকগুণ বেড়ে গেল। সে বাবার হাত ধরে আকুতির স্বরে তার বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবা, এই একটা বার আমার উপর বিশ্বাস করেই দেখো না। তোমাদের কথামতো এরেঞ্জ ম্যারেজ করতে রাজী হয়ে গিয়েছি। একটা বারও নিজের পছন্দ-অপছন্দ ও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের কারণে তোমাদের সিদ্ধান্তের অমর্যাদা করিনি। আমি তো সবকিছুই তোমাদের কথামতো করে এসেছি। এই একটা বার কি তোমরা আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতে পারবে না?’

মায়ার কথায় প্রভাবিত হতেই হলো তার বাবা-মাকে। শেষ পর্যন্ত বিয়েটা আটকাতে সক্ষম হলো সে। ছোঁয়া চলে আসার সময় মায়াকে দীপ্ত কণ্ঠে বলেছিল, ‘এটাই তোর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট মায়া। মনে রাখিস, এই বিয়েটা না হওয়ায় তুই বেঁচে গিয়েছিস। এবার নতুনভাবে জীবন শুরু কর, এবার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সময় এসেছে, আর নিজেকে তোর চিরায়ত খোলসের মধ্যে বন্দী করে রাখিস না। এটা তোর কাছে আমার অনুরোধ।’

মায়া মুচকি হেসে সম্মতি জানিয়েছিল। ছোঁয়া শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল তাকে। মায়ার শক্ত অবস্থানে সে সত্যিই মুগ্ধ হলো আজ।

বিয়ের পোশাক ছেড়ে শাওয়ার নিল মায়া। ভেজা চুলগুলো তোয়ালেতে পেঁচিয়ে জানালার কার্নিশে দাঁড়িয়ে আকাশপানে তাকিয়ে দেখল আকাশে থাকা ঘন কালো মেঘগুলো কাটতে শুরু করেছে। ওই তো চাঁদটা উঁকি দিচ্ছে, বারেবারে। ঘন কালো মেঘ শত চেষ্টাতেও রাতের আঁধারে পথ প্রদর্শনকারী চাঁদকে তার জ্যোতি ছড়াতে বিরত রাখতে পারছে না। স্নিগ্ধ হাওয়া এসে তার গায়ে আঁচড় কাটছে। একটু শীত লাগতে শুরু করল তার। গায়ের সাথে জড়ানো সাদা ওড়নাটা আরও একটু ভালোমতো পেঁচিয়ে নিল সে।

বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হবার পরে তার নিজেকে একদম নির্ভার লাগতে শুরু করল। একটা সময় পরে তার সত্যি সত্যিই মনে হতে লাগল, ‘খারাপ সময় সবসময় সবকিছু ধ্বংস করতে আসে না বরং মাঝেমধ্যে আমাদেরকে আরও শক্ত মজবুত করার জন্যও আসে।’

_____________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে