#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪৭
‘আমি কি পুরো ঘটনাটা জানতে পারি, মিসেজ শিহরণ?’ পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে প্রশ্ন করল ইন্সপেক্টর ফায়াজ রহমান।
ফায়াজের প্রশ্ন শুনে ছোঁয়া, শিহরণ আর প্রিয় চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল তার দিকে। ফায়াজ কিছুই হয়নি এমন ভান করে পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘এভাবে তাকাচ্ছেন কেন আমার দিকে? আমি কি ভুল কোনো প্রশ্ন করেছি? কেইসটা সলভ করার জন্য পুরো বিষয়টা আমাকে জানতে হবে। তাই নয় কি?’
‘মিসেজ শিহরণ? কিসব বলছ ভাইয়া? তোমার মাথা ঠিক আছে তো?’ প্রিয় বিস্মাভূত মুখ করে বলল।
‘আমি কি ভুল কিছু বলে ফেলেছি?’ বিভ্রান্ত দেখাল ফায়াজকে। নিজেকে শোধরানোর ভঙ্গি করে পরক্ষণেই বলল, ‘ওদের বিয়ে হয়নি এখনও?’
প্রিয় বলল, ‘না, ভাইয়া। তুমিও না!’
ফায়াজ দু’হাত উপরে তুলে বলল, ‘স্যরি, ইট ওয়াজ মাই মিস্টেক।’
ছোঁয়াকে পুরোপুরি বিরক্ত দেখাল। শিহরণ খুব মনোযোগ দিয়ে কী যেন ভাবছে! তার চেহারা দেখে তার মনোভাব বোঝা যাচ্ছে না।
ফায়াজ মুখে গাম্ভীর্য এনে বলল, ‘আমি কিন্তু মোটেই মজা করিনি। সত্যি ঘটনাটা জানতে চেয়েছি কেবল।’
ছোঁয়া গম্ভীর মুখ করে বলল, ‘আমার সত্যিই খুব খারাপ লাগছে এই বিষয়টা বলতে কিন্তু এই বিষয়টা জানাতেই হচ্ছে পরিস্থিতির চাপে পড়ে। যদি এমন পরিস্থিতি না হতো তবে আমি কখনোই বলতাম না।’ কথাগুলো বলার সময় ছোঁয়াকে খুবই বিমর্ষ দেখাল।
ফায়াজ সিগারেটের একটা শেষ টান দিয়ে ছোঁয়াকে তাড়া দিয়ে বলল, ‘এখন আবেগী হবার সময় নয়, মিস ছোঁয়া। আপনি পুরো ঘটনাটা আমাকে বলুন, তাহলে আমার পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে সুবিধা হবে।’
প্রিয়’র মামাতো ভাই ফায়াজ পুলিশে আছে। শিহরণের কাছে ছোঁয়ার বিপদের কথা শুনেই সে ফায়াজের কথা বলে। এই কথা বলেও আশ্বস্ত করে যে ফায়াজকে বিশ্বাস করা যায়। সে এরকম বহু কেইস নিজে হ্যান্ডল করেছে।
ছোঁয়ার তার জীবনের তিক্ত সত্যগুলো কাউকে বলতে ইচ্ছে করে না। তবুও আজ তাকে বলতে হচ্ছে। তাছাড়া সে কোনোভাবেই ফাহমিদা বেগমকে কারো কাছে ছোটো করতে চায় না। তাই এই সব ঘটনা তেমন কেউ জানেও না। ছোঁয়াকে দ্বিধান্বিত দেখে শিহরণ তার পাশে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করল। ছোঁয়া উদাস চোখে তাকাল শিহরণের দিকে। যেই চোখ জোড়াতে সে ভরসা, বিশ্বাস আর নির্ভরতা খুঁজে পেল। ছোঁয়া একটা প্রলম্বিত শ্বাস নিল। তারপর বলতে শুরু করল, ‘বাবা মারা যাবার পর থেকে মা বিভিন্ন মানুষের সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। নানান ধরনের মানুষের সাথে তার উঠাবসা ছিল। সম্পর্কের গভীরতাটা আমি তখনও ঠিক বুঝতাম না। ছোটো ছিলাম, তাই হয়তো এইসব জটিলতা বুঝতে পারতাম না। একটা সময় পরে তানভীর নামে ছেলেটার সাথে মা গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। বাসায় আসা যাওয়া চলতে থাকল এই লোকটার।।একসময় হিয়ার প্রতি তার নজর পড়ে। হিয়া, প্রথম দেখাতেই ভালো লাগার মতো মেয়ে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই লোকটা কথাচ্ছলে হিয়ার গায়ে হাত দিত। এক পর্যায়ে এই লোকের আমাদের বাসায় আনাগোনা বেড়ে যায়। মা, হয়তো ধীরে ধীরে এই লোকের হিয়ার প্রতি নোংরা দৃষ্টি বুঝতে পেরে তানভীরের সাথে সম্পর্ক শেষ করতে চায়। কিন্তু এই নোংরা, কুৎসিত লোকটা না মায়ের সাথে সম্পর্ক শেষ করতে চাইছিল, না হিয়ার প্রতি নোংরা দৃষ্টি দেওয়া বন্ধ করতে চাইছিল। তাই সে মাকে ব্ল্যকমেল করা শুরু করে, তাদের সম্পর্কের ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দিতে থাকে। একটা সময় মা খুব বেশি ভেঙে পড়েন। দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। সেই সময়টাতে আমি মায়ের সেবা-যত্ন করার সময় কিছু কিছু বিষয় আন্দাজ করতে পারতাম।’
ছোঁয়া থামল। সবার দৃষ্টি ছোঁয়ার দিকে। শিহরণ টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাসটা ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে দিল। ছোঁয়া এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের সবটুকু পানি শেষ করে ফেলল।
ফায়াজ হিমশীতল গলায় বলল, ‘কথা শেষ করুন, মিস ছোঁয়া।’
ছোঁয়া ফায়াজের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াল। পুনরায় বলতে শুরু করল সে, ‘তারপর আসে সেই সেই ভয়ংকর রাত। যেদিন ঘরে শুধুমাত্র হিয়া ছিল, অহনা আর মা কোনো একটা ইনভাইটেশন এটেন্ড করতে গিয়েছিল। আমার পরীক্ষার ডেট হয়ে যাওয়াতে আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ নোটসের এর জন্য মায়ার বাসায় গিয়েছিলাম। তবে সেদিন মায়া তার বাসায় না থাকাতেই আমি আবার ফিরে এলাম। ফিরে আসতেই গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেলাম। প্রথমে আমি ভড়কে গেলাম এইরকম আওয়াজ শুনতে পেয়ে। পরে একে একে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙার শব্দ শুনতে পাই। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই হিয়ার চিৎকার শুনতে পেলাম। ভেবেছিলাম চোর এসেছে হয়তো। তাই আমি রান্নাঘরে রাখা লাঠি নিয়ে হিয়ার রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। রুমের দরজাটা লক ছিল না। কারণ পুরো ঘর খালি ছিল। এই বিষয়টা নিশ্চয়ই তানভীর নামে লোকটা জানতো। তাই সে দরজা লক করেনি। এটাতে আমার বরং সুবিধাই হলো। আমি ভিতরে ঢুকতেই লোকটাকে হিয়ার সাথে…! তখন আমি হতভম্ব হয়ে চেয়েছিলাম কয়েক সেকেন্ড। কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সম্বিৎ ফিরে পেতেই আমি একবার লাঠির দিকে তাকায় একবার লোকটার দিকে। আমি বুঝে গেলাম এই লাঠি দিয়ে কিছুই করা সম্ভব নয়। তখনই হিয়ার দরজার পাশে রাখা ভারী ফুলদানিটা নজরে পড়ল। আমি কোনোকিছু না ভেবেই সেই ফুলদানিটা হাতে নিয়ে তানভীরের মাথায় জোরে আঘাত করে বসলাম। সেই এক আগাতেই লোকটা হুঁশ হারাল। তারপর হিয়ার মোবাইল থেকে আমি মাকে কল করে সবটা জানাই। মা এসে পুলিশকে ইনফর্ম করে। এর পর থেকে হিয়া সিরিয়াস ডিপ্রেশনে চলে যায়। অনেক চিকিৎসা করানোর পরে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। মাও তার অতীত জীবনটাকে ভুলে গিয়ে একটা সুন্দর জীবন শুরু করে। কিন্তু এখন আবার লোকটা এসে হানা দিয়েছে আমাদের বর্তমানে। তাও আবার লুকিয়ে হিয়ার ছবি তুলেছে। এবার আর কোনো ধাক্কা সামলাতে পারবে না আমার বোনটা।’
ফায়াজ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘এবার তাহলে আমি উঠি।’
ছোঁয়া তাড়া দিয়ে বলল, ‘আমার কথা শেষ হয়নি এখনও।’
ফায়াজ ছোঁয়ার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘আর কী বলার আছে?’
‘আমি চাই লোকটাকে প্রথমে আমরা শাস্তি দিব। তারপর আইনের আওতায় এনে তার স্বাভাবিক শাস্তি যা হবার তা হবে।’
‘আপনারা কী ধরনের শাস্তি দিতে চাইছেন?’
‘আপনার তো জানার কথা এই লোকটা আরও অনেক মেয়ের সাথেই সম্পর্ক করে, গোপন ভিডিও করে, পরে সেগুলো ভাইরাল করার হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করাসহ নানা ধরনের অবৈধ কাজ করায় তাদের মাধ্যমে। তাছাড়া ড্রাগও নেওয়া ও তা পাচারের কাজে সিদ্ধহস্ত এই লোকটা।’
‘আমাদের জানা আছে, মিস ছোঁয়া। কিন্তু এই লোকের রাজনৈতিক ক্ষমতাও আছে। যার কারণে কিছু দিন পর পরই ছাড়া পেয়ে যায়। মেয়েরা এত বোকা কেন বুঝি না। গুড লুকিং হলেই প্রেমে পড়ে যায়। এটা কেমন পছন্দ, অদ্ভুত!’ শেষ বাক্যটা বলার সময় ফায়াজের কণ্ঠে ছিল তাচ্ছিল্য।
ছোঁয়া বিরক্ত হয়ে বলল, ‘হিয়া ওই লোকের প্রেমে পড়েনি, মিস্টার ফায়াজ।’
‘আপনার মা তো পড়েছিল, তাই না?’ ফায়াজ বাঁকা হেসে প্রশ্ন করল।
শিহরণ ফায়াজকে সংশোধন করতে গিয়ে বলল, ‘উনি ছোঁয়ার সৎ মা হোন, আপন মা না।’
ফায়াজ শিহরণের দিকে তাকাল রহস্যময় দৃষ্টিতে। তারপর গটগট করে বেরিয়ে গেল।
প্রিয় চেঁচিয়ে বলল, ‘ফায়াজ ভাইয়া, ওকে ধরে এনে আমার হাতে দিও। একদম চাটনি বানিয়ে তারপর ছাড়ব। এরপর মেয়েদের ব্ল্যাকমেল করা তো দূরের কথা মেয়েদের দিকে তাকাতেও পারবে না।’
সবটা শোনার পরে মোহনা কথা বলে উঠল, ‘আরে থাম। তুই তো এমনিতেও দুই তিন কদম আগায় থাকিস।’
শিহরণ প্রিয়র দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘তোমার ভাই কি পারবে এই কাজ?’
প্রিয় হেসে বলল, ‘ওকে দেখে সন্দেহ হচ্ছে না-কি? ও দেখতে তোমার মতো চকলেট বয় হলে কি হবে, কাজের মধ্যে ওর মতো ভয়ংকর আর কেউ হয় না। সেবার একটা কেসের সময় হয়েছিল কি জানো…?’
মোহনা প্রিয়কে বাধা দিয়ে বলল, ‘আমাদের জানার দরকার নাই। এই কাজটা ভালোই ভালোই মিটে গেলেই হলো। তোর ভাই তো তোর মুখ থেকে এমনিতেই প্রশংসার ঝাঁপি ঝরে পড়বে তাতে আমাদের অবশ্য কারো সন্দেহ ছিল না।’
প্রিয় রেগে গিয়ে বলল, ‘মোহন! বেশি বাড়াবাড়ি করছিস কিন্তু।’
‘মোহন না কিউটি আমি মোহনা।’ মোহনা প্রিয়র চুল টেনে দিয়ে বলল।
প্রিয় তাতে ক্ষেপে গেল। মোহনা সেখানে আর দাঁড়াল না। দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। প্রিয়ও তার পেছন পেছন ছুট লাগাল।
ছোঁয়ার চোখ অশ্রুতে টলমল করছে। শিহরণ তার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। তবুও তার কাছে অজানা নয় তার প্রিয়তার মনটা একটা বিষণ্ন। ধূসর মেঘে ঢেকে গেছে তার মনের আকাশটা। শিহরণ ছোঁয়ার কাঁধে হাত রেখে তার দিকে ঘুরাল। ছোঁয়া চকিতে মুখটা নিচু করি ফেলল। চিবুকটা যেন বুকের সাথে লাগিয়ে ফেলবে এমন অবস্থা! শিহরণ তা দেখে স্মিত হাসল। শিহরণ ডান হাত দিয়ে মুখটা তুলে আলতো স্পর্শে চোখের পানিটুকু মুছে দিয়ে বলল, ‘মন খারাপ করো না, প্রিয়তা। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তো তোমার পাশে।’
ছোঁয়া চোখ তুলে তাকাল শিহরণের দিকে। তারপর তার দু’হাত শক্ত করে ধরে বলল, ‘তুমি পাশে আছ বলেই তো আমি সাহস পাই। তুমি না থাকলে আমার কি হবে তা আমি ভাবতেই পারি না..!’
শিহরণ মুচকি হেসে বলল, ‘আমি না থাকলে কি হবে তা নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করো না, প্রিয়তা। আমি আছি, থাকব। এখন তোমাকে হিয়ার পাশে থাকতে হবে। মেয়েটা খুব ভেঙে পড়েছে। তুমি তো দেখেছই। এখন তুমিও যদি ভেঙে পড়ো তাহলে তোমার মা আর বোনকে কে সামলাবে বলো তো।’
ছোঁয়া শিহরণের কথায় সম্মতি জানিয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ।’ চোখের জল মুছে ফেলে বলল, ‘আমি আর ভেঙে পড়ব না।’
‘কথা দিচ্ছ তো?’ ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল শিহরণ।
‘হুম।’ হেসে জবাব দিল ছোঁয়া।
______________________
#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪৮
আমিরাহ তার উচ্চবিত্ত ক্লাস মেইনটেইন করতেই ব্যস্ত। সারাক্ষণ এই পার্টি, সেই পার্টি করেই তার দিন কাটে। স্বামী বা সন্তানকে দেবার মতো সময় তার কাছে নেই। আশফাক তাকে অনেকবার বুঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনোভাবেই বুঝাতে সক্ষম হয়নি। তার মতো একগুঁয়ে আর উড়নচণ্ডী মেয়ে খুব কমই দেখেছে সে। মাঝেমধ্যে সে ভাবে, আমিরাহকে বিয়ে করে সে বড়ো ভুল করেছে। পরক্ষণেই আবার ভাবে তার কি-ই-বা করার ছিল! সে তো ছিল বন্দী আপনজনের ইচ্ছের কাছে! সময়ের হাতে অর্থের জন্য, একজন ভীষণ প্রিয় মানুষের জীবনের জন্য। ড্রাইভিং সিটে বসে স্টিয়ারিং এর চাকা ঘুরাতে ঘুরাতে এমনই আকাশ পাতাল ভাবনাতে মশগুল ছিল আশফাক। বাসা থেকে বের হবার আগেও তার আর আমিরাহের মধ্যে এক চোট ঝগড়া লেগে গিয়েছিল। বিষয়টা এখন এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যে, তারা দু’জন যখনই একসাথে হয় তখনই ঝগড়া লেগে যায়। শুধুমাত্র এই একটি কারণে আশফাক যেকোনো জনসমাগম এড়িয়ে চলে। এমনকি ফ্যামিলি মিটিংস বা গেট টুগেদারে পর্যন্ত যায় না। এই তো কিছুদিন আগে এতো বড়ো অনুষ্ঠান হলো, শিহরণ কতো করে বলেছে তবুও সে যায়নি। কারণ সে ভয় পায়। কোথাও সিন ক্রিয়েট হোক তা সে চায় না। এতে করে সে আর তার মেয়েই শুধু তামাশার পাত্র হবে। আমিরাহর কোনো হেলদোল কখনোই ছিল না। ভবিষ্যতে কোনো এক সময় হবে, সেই আশাও আশফাক করে না। টিয়ার বয়স মাত্র চার বছর। এই চার বছরে আমিরাহ ওকে খুব একটা সময় দেয়নি। মাকে কাছে পাবার জন্য মেয়েটা মরিয়া হয়ে ওঠে বারবার। কিন্তু তার মা তার চাইতেও বেশি নিজেকে ভালোবাসে। এই সত্যটা এখন স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে তার কাছে।
টিয়া তার পাশে বসে নানান কথা বলেই চলেছে, আশফাক শুধু হু, হ্যাঁ করে যাচ্ছে আর মাঝেমধ্যে হাসছে। তার বাচ্চা মেয়েটাও তার মতো ভীষণ একা। এই কথাটা ভাবতেই তার বুক চিরে একটা প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তার নিজের জীবনটা এমন হতো না, যদি তার ভালোবাসার মানুষকে সে পাশে পেত। কিন্তু তাকে পেয়েও হারিয়ে ফেলল আশফাক। এই দুঃখ, যন্ত্রণা কখনোই ভুলবার নয়। অর্থের কাছে তার ভালোবাসাকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। অথচ আজ এত অর্থ থাকা সত্ত্বেও তার জীবনে কোনো সুখ নেই। মানুষ ভুল বলে, সত্যি বলতে, অর্থ দিয়ে সবকিছু কেনা যায় না। সুখ নামক আপেক্ষিক জিনিসটা পৃথিবীর সবচাইতে দামী জিনিস। যা শত টাকা থাকা সত্ত্বেও কেনা যায় না, আবার মাঝেমধ্যে টাকা না থাকলেও এই সুখ ধর্না দিয়ে যায় জীবনের আঙিনায়।
আশফাক টিয়াকে নিয়ে একটা পেস্ট্রি শপে ঢুকল। টিয়া পেস্ট্রি শপে ঢুকতেই খুশিতে গদগদ হয়ে একটা প্রেস্ট্রি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘আব্বু, আমি এই পেস্ট্রিটা খাব।’
আশফাক টিয়ার মাথাতে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই তো মামুণি, আমি অর্ডার করেছি। আঙ্কেল প্যাক করে দিলেই হবে।’
টিয়া আবারও বলল, ‘বাবা, মা কখন আসবে?’
আশফাক অসহায় চোখে তাকাল তার ছোট্ট মেয়েটার দিকে। মেয়েটার চোখে-মুখে মায়ের ভালোবাসা পাবার এক তীব্র আকুলতা। আশফাকের নিজেকে অপরাধী মনে হলো। ক্লান্ত গলায় সে বলল, ‘আসবে, মা। তুমি একদম চিন্তা করো না। বাবার কম্পানি ভালো লাগছে না, আমার মামুণিটার?’
টিয়া মিষ্টি হেসে বলল, ‘ভালো লাগছে তো, আব্বু।’
আশফাকও মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসল। টিয়ার একটা হাত খুব যত্ন করে নিজের হাতের মুঠোয় ধরে রাখল।
___________________________
রাদিদ টিকেট কেনার জন্য বেরিয়েছিল সেই সকাল বেলায়। নিজের কিছু কাজ সেরে তার অতি পরিচিত কাজ করতে হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। তারপর টিকেট কেটে কাউন্টার থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হবার সময় চোখে পড়ল তার এত বছরের আকাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে। মানুষটাকে দেখা মাত্রই তার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। নিজের ক্রোধ সংবরণ করার প্রাণপণ প্রচেষ্টাতে লিপ্ত সে। আজ এই মানুষটার মুখোমুখি তাকে হতেই হবে। তার নিজের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আজ এই মানুষটাকে দিতেই হবে। কোনোভাবেই ছাড়বে না এই ঠগবাজ, প্রতারক লোকটাকে।
লোকটা একটা দোকান থেকে বের হচ্ছে। রাদিদ বার্ডস আই ভিউতেই সবকিছু ধারণা করে ফেলল। শপের পাশে রাখা গাড়িটা নিশ্চয়ই তার। তার মানে শপ থেকে বেরিয়ে গেলেই তার হাত ফসকে যাবে এই মানুষটা। সে দ্রুত রাস্তা পার হতে যেতেই একটা বিশাল ট্রাক ধেয়ে আসতে লাগল। একটুর জন্য অঘটন ঘটতে ঘটতে বেঁচে গেল সে। কিন্তু তার সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটা ততক্ষণে হাওয়া। কোথায় গেল তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই রাদিদের। সমস্ত আশা ছেড়ে দিয়েই তো সে এই শহর ছেড়ে আবার নিজের চিরচেনা গ্রামে ফিরে যেতে উদ্যত হয়েছিল। অথচ এই লোকটাকে দেখে তার চলে যাওয়াটা আটকে গেল। এই লোকটিকে তার খুঁজে পেতেই হবে।
এতদিন পরে লোকটিকে দেখে তার যেমন ভালো লাগছে তেমনি বিষণ্ণতাও তাকে ঘিরে ধরেছে । রাদিদ হুট করেই নীলাকে ফোন দিয়ে বসল। নীলা আমুদে গলায় বলল, ‘কী রে ভাই, এত দিন পরে মনে পড়ল আপার কথা?’
রাদিদ নীলার কণ্ঠস্বর শুনে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘আপা, আমি খুঁজে পেয়েছি…!”
রাদিদ কথাটা শেষ করতে পারল না। তার আগেই নীলা প্রশ্ন করে উঠল, ‘কী খুঁজে পেয়েছিস, ভাই?’
নীলার প্রশ্ন শুনেই যেন রাদিদ সম্বিত ফিরে পেল। দ্রুত চিন্তা করতে লাগল সে। লোকটাকে সে দেখেছে তবে এখনও তার সম্পর্কে কিছুই জানে না সে। তাই আপাতত নীলাকে কিছু না জানানোই শ্রেয় মনে করল। রাদিদ জানে, আশা ভেঙ্গে গেলে ভীষণ কষ্ট হয়। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘পিউর পছন্দের খেলনা খুঁজে পেয়েছি আপা।’
নীলা অবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘তুই কি কিছু লুকাচ্ছিস, রাদিদ?’
রাদিদ মলিন হাসল। সে হাসি নীলা দেখল না। রাদিদ ক্লান্ত গলায় বলল, ‘কেন মনে হলো তোর?’
নীলা কপট রাগান্বিত স্বরে বলল, ‘তোর কণ্ঠস্বর খুব সিরিয়াস ছিল। অথচ এখন মনে হচ্ছে আমার সাথে ফাইজলামি করতেছিস।’
‘আপা, পিউ কিন্তু খেলনাটা দেখলে দারুণ খুশি হবে। ওকে বলিস তো ওর জন্য দারুণ একটা খেলনা কিনে আনব। খুশিতে বাকবাকুম হয়ে দৌড়াবে পুরো ঘরে। আম্মাকে বলিস, আমার আসতে আরও দেরি হবে।’
কথা শেষ করেই রাদিদ হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করল।
‘এত কিসের কাজ বল তো? এত দিন তো তোর থাকার কথা না। ফুফুকেই ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করব আমি।’ অবিশ্বাসের সুরে বলল নীলা।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। কেউ যদি আমাকে বিশ্বাস করতে না চায় তাহলে আমি তাকে কখনোই জোর করি না আমার কথা বিশ্বাস করার জন্য। তোর যা মন চায় তাই কর। আমার কোনো অসুবিধা নাই।’ রাদিদ বলল কপট রাগ দেখিয়ে। বলেই কলটা কেটে দিল। নিজের মনকে প্রবোধ দিল এই ভেবে যে, লোকটাকে যেদিন সামনাসামনি দেখবে সেদিনই এই লোকটাকে উপযুক্ত শাস্তি দিবে সে। তার মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এই লোকটাকে দিতেই হবে।
রাদিদ ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চলেছে। হাঁপিয়ে উঠেছে সে। সে জানে এবং বিশ্বাস করে, জীবন মানে যুদ্ধ। তার মানে কি সর্বক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে? একটু সময় কি নিজের জন্য সে পাবে না? একটু নিজের মতো বাঁচতে খুব ইচ্ছে করে তার। কিন্তু সে বাঁচাটা বোধহয় তার ভাগ্যে নেই।
মোবাইলটা তারস্বরে বেজে চলেছে। রাদিদ জানে এই মুহূর্তে তাকে কে কল করতে পারে। তবে সে এই মুহূর্তে কারও সাথেই কথা বলতে চায় না। কিছু সময় একাকী থাকাটাই উত্তম। নয়তো আপনজনদের আঘাত করার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। রাদিদ চায় না, আপন কাউকে আঘাও করতে। তাই সে হেঁটে চলেছে উদ্দেশ্যহীন কোনো এক গন্তব্যের পানে।
_____________________
নীলাভ্র ঘামছে। আফরিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘নীলাভ্র, তুমি এতোটা কাপুরুষ জানলে আমি তোমাকে কখনোই ভালোবাসতাম না।’
নীলাভ্র মাথা নিচু করে বসে আছে। আফরিন ক্ষেপে গিয়ে বলল, ‘তুমি আসলে এরকম মাথা নিচু করেই থাকবে আজীবন। আমাদের ভালোবাসার কথাটা তুমি বাসায় জানাতে পারছ না! এটা ভাবতেই আমার নিজের উপর রাগ হচ্ছে। কোন কুক্ষণে যে আমি তোমাকে ভালোবাসতে গেলাম!’
নীলাভ্র মিনমিনে কণ্ঠে বলল, ‘আব্বু, মানবে না এই সম্পর্ক! আব্বুকে আমি ভীষণ ভয় পাই।’
আগুনে ঘি ঢালার মতো করে দপ করে আফরিনের রাগ আরও বেশি বেড়ে গেল। সে তেতে গিয়ে বলল,
‘এই কথাটা তোর আমার সাথে সম্পর্ক করার আগে মনে ছিল না?’
নীলাভ্র এবারও নিশ্চুপ। তা দেখে আফরিন এবার মারাত্মক খ্যাপানো গলায় বলল, ‘তুই কি করবি আমি জানি না। আমি কোনোভাবেই তোকে অন্য কাউকে বিয়ে করতে দিব না। এখন তুই কি করবি তুই জানিস।’
নীলাভ্র ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘আব্বুকে আমাদের সম্পর্কের কথা বললে আমাকে মেরেই ফেলবে।’
‘আর তুই যদি না বলিস তো আমি কি তোকে ছেড়ে দেব ভেবেছিস? আমিও তোকে মেরেই ফেলব। আমাকে কষ্ট দিয়ে তুই ড্যাডিস গুড বয় হয় ঘুরে বেড়াবি আর আমি তা চেয়ে চেয়ে দেখব। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই, নীলাভ্র!’ নীলাভ্রকে ধমকে উঠে আফরিন আবারও বলল, ‘আরও একটা কথা শুনে রাখো, তোকে শেষ করার পরে আমি নিজেকেও শেষ করে দিব। এখন তুই বল তোর কোন প্রস্তাবটা বেশি ভালো লাগছে?’
‘আমি কী করব আফরিন?’ নীলাভ্র তার দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে বলল, ‘না আমি তোমাকে ছাড়তে পারব না বাবাকে!’ নীলাভ্র আফরিনের হাত ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু আফরিন এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিল। নীলাভ্র ব্যথাতুর গলায় বলল, ‘আমি কি করব তুমিই বলো? আমি সত্যিই তোমাকে খুব ভালোবাসি।’
আফরিন রেগে বলল, ‘ভালোবাসো না ছাই! তুমি আমাকে ভালোবাসলে তোমার নাম যে আতিক তা কেন বলোনি? সেদিন তোমার ভাই এসে যদি সামনাসামনি সবকিছু না বলতো তাহলে তো আমি জানতেই পারতাম না। তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসি বলেই তোমার সমস্ত দোষ আমি দেখেও দেখি না। কিন্তু সবসময় যে দেখব না তা ভাবার কোনো কারণ নেই। এতোদিন তোমাকে আমি এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করিনি। আজ আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর চাই।’
‘আফরিন শান্ত হও।’ নীলাভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘প্রথমত আমি তোমাকে কোনো প্রকার মিথ্যে কথা বলিনি। তোমাকে ভালোবাসি। মন প্রাণ দিয়েই ভালোবাসি। তাই আজ তোমাকে সবটাই বলছি, আমার পুরো নাম নীলাভ্র হোসেন আতিক। আর তুমি যার কথা ধরে আমাকে সন্দেহ করছ সে আমার ভাই ন। বুঝেছ?’
‘তোমার ভাই না মানে?’ সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জানতে চাইল আফরিন।
‘এখানে না বোঝার কিছু নেই, আফরিন।’ চোখ-মুখ শক্ত করে বলল নীলাভ্র।
‘তুমি আমাকে সবকিছু বলো, নীল।’ শান্ত স্বরে বলল, আফরিন।
‘আমি এই বিষয়ে আর কিছুই বলতে পারব না, আফরু। অতলকে আমি ভাই ভলে কখনোই ভাবিনি। না মন থেকে ওকে ভাই হিসেবে কখনও মেনে নিয়েছি। আর ওর সম্পর্কে কথ বলতে আমি কখনোই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। তাই ওর ব্যাপারে আমাকে আর কখনোই কোনো প্রশ্ন করবে না প্লিজ। এটা আমার অনুরোধ।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে শেষ করল নীলাভ্র।
‘ঠিক আছে। ওই বিষয়ে আমি কোনো প্রশ্ন করব না। এখন তুমি আমাকে কবে বিয়ে করবে সেটা বলো?’
নীলাভ্র শুকনো ঢোক গিলল আফরিনের প্রশ্ন শুনে। আফরিন তা দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ‘সমস্ত সাহস শেষ হয়ে গেছে তাই না?’ পরক্ষণেই নীলাভ্রের একটা হাত চেপে ধরে বলল, ‘তোমাকে আমি এক সপ্তাহ সময় দিলাম। দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা ভাবো। এর মধ্যে যদি আমাকে বিয়ে না করো তো আমি সুইসাইড করব। এটাকে ফাঁকা থ্রেট মনে করবে না আশা করি। তুমি ভালো করেই জানো, আমি কি কি করতে পারি। আর যা বলি তা অবশ্যই করি, এটা তোমার থেকে ভালো কেউ অবশ্য জানে না।’
কথাগুলো বলেই আফরিন হাঁটা শুরু করল। পেছন ফিরে একবারও তাকাল না। যদি তাকাতো তবে দেখতে পেত দুশ্চিন্তায় মাখা নীলাভ্রর মুখটা। হয়তো আফরিন তা দেখতে চায় না। হয়তো তাই সে পেছন ফিরে একটাবারও তাকায়নি। অপরদিকে নীলাভ্রর নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগতে শুরু করল। কী করবে সে কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না! তার মাথাটা ফাঁকা লাগছে।
_______________________
#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪৯
পুরো রুম জুড়ে আলো-আঁধারের খেলা চলছে। থেকে থেকে মৃদু গোঙানির আওয়াজ বেরুচ্ছে।
একটা চেয়ারের সাথে হাত-পা-মুখ বেঁধে রাখা হয়েছে তানভীরকে।
ফায়াজ তানভীরের চুল শক্ত করে মুঠো করে ধরে তার মাথাটা পেছনে নিয়ে বলল, ‘আর কোনো মেয়েকে ব্ল্যাকমেল করবি কি না বল?’
তানভীরের মুখ বাঁধা থাকার কারণে সে আওয়াজ করলেও অদ্ভুত সব শব্দ বেরুচ্ছে তার মুখ দিয়ে। ফায়াজ যেন ভুলেই গিয়েছে যে তানভীরের মুখটা বাঁধা। তাই সে চাইলেও কথা বলতে পারবে না।
তানভীরের কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে ফায়াজ প্রচণ্ড ক্রোধে তানভীরের টুটি চেপে ধরল। ফলে তানভীরের মুখ থেকে বের হওয়া শব্দগুলো কু কু হয়ে বেরিয়ে আসছে। ঠিক তখনই ছোঁয়া হিয়াকে নিয়ে রুমে ঢুকল। তানভীরকে দেখে প্রথমেই হিয়া ভয়ে ছোঁয়ার পিছনে লুকাল। ছোঁয়া তাকে আশ্বস্ত করল। ছোঁয়া ক্রোধান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘হিট হিম। জাস্ট হিট হিম।’
প্রিয় মারমুখো হয়েই বসে দেখছিল তানভীরকে। হিয়াকে ভয় পেতে দেখে সে হিসহিসিয়ে বলল, ‘তুমি মারতে না পারলে আমাকে বলো আমিই মারছি এই শয়তানটাকে। মেয়েদেরকে কি এরা ফেলনা ভেবেছে। নিজের হাতের পুতুল ভেবেছে! তোর সব ধরনের খায়েশ মিটিয়ে দিব আজ শু*** বাচ্চা।’
প্রিয়র গালি শুনে শিহরণ বলে উঠল, ‘কীসব ভাষা বলছিস, প্রিয়!’
প্রিয় তানভীরের নাক বরারবর একটা ঘুসি দিয়ে বলল, ‘ঠিকই বলতেছি। এই ধরনের বিকৃত মানসিকতার লোককে এর থেকেও খারাপ সব গালি দেওয়া উচিত। আমি তো তারে তেমন খারাপ গালি দিই নাই।’
প্রিয়র মারে ব্যথায় ককিয়ে উঠল তানভীর। সে নিস্তেজ হওয়া সত্ত্বেও অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল প্রিয়র দিকে। তা দেখে প্রিয় বলল, ‘দেখ, কু*** বাচ্চার কত্তো বড়ো সাহস। সে আমার দিকে এমন চোখ রাঙিয়ে তাকাচ্ছে।’ তারপর তানভীরের দিকে তেড়ে গিয়ে বলল, ‘তুই চিনিস আমাকে? হিয়ার জায়গায় আমি হলে তুই সারাজীবন আফসোস করতি, আমার সাথে পাঙ্গা নেওয়ার কারণে।’
অহনা এসে দাঁড়াল হিয়ার পাশে। হিয়া তাকে দেখে চমকে গেল। অহনা হিয়াকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘আজি সবটা জেনে গেছি হিয়া। তুই এখন একা না। আমিও আছি তোদের সাথে।’
অহনা তানভীরের দিকে তেড়ে এসে তার গাল বরাবর একটা ঘুসি বসিয়ে দিল। তাই দেখেই বোধহয় হিয়া কিছুটা সাহস পেল। সে ধীর পায়ে তানভীরের দিকে এগিয়ে গিয়ে মিডল পয়েন্ট বরারব একটা লাথি দিল। এবার প্রচণ্ড ব্যথায় ককিয়ে উঠল তানভীর।
অহনা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘কেমন লাগছে কু*** বাচ্চা? মেয়েদের ব্ল্যাকমেল করে মজা পাস না? লুকিয়ে ছবি তুলছিস আমার বোনের। এখন তোর ছবি তুলে আমি ভাইরাল করব। তোর মজা বাইর করতেছি।’ কথা শেষ করেই সেও একটা লাথি বসিয়ে দিল একই জায়গায়। তানভীর এবারও ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল। হাত ছাড়ানোর প্রবল চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু পারছে না। হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে গিয়ে সে চেয়ার সমেত কাত হয়ে পড়ে গেল।
শিহরণ চেয়ার সমেত তানভীরকে আবারও সোজা করে বসাল। তারপর হিসহিসিয়ে বলে উঠল, ‘এবার বোঝ, মেয়েদেরকে হেনস্থা করার মজা।’ বলেই সেও একটা ঘুসি বসিয়ে দিল তার নাক বরাবর।
তানভীরের ঠোঁট ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে, নাকটাও বোধহয় ফেটে গেছে। মুখ বাঁধা থাকার কারণে তার গলা থেকে অদ্ভুত সব আওয়াজ বের হচ্ছে।
মোহনা আর মায়া এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। তানভীরের নির্জীবতা দেখেও যেন তারা শান্তি পাচ্ছিল না। মোহনা বলে উঠল, ‘তোরা সবাই মারলি আমরা কেন বাদ থাকব। আমাদেরও এই শয়তানকে পুরস্কার দেওয়া উচিত। কি বলো মায়া?’
মায়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। তারপর তারা দুজন ও ইচ্ছেমতো থাপ্পড় লাগাল ওর মুখে। প্রিয় যেন কোনোভাবেই শান্তি পাচ্ছিল না। সে রেগে বলল, ‘কি মাইর দিতেছিস ওরে। লাগতেছে জামাই আদর করতেছিস। ওরে ক্যামনে মারা লাগবে আমি দেখাইতেছি।’ প্রিয় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তানভীরকে ইচ্ছেমতো লাথি মারল।
শিহরণ বলল, ‘তুই কি লাত্থি মারার ট্রেনিং নিছস না-কি?’
‘পুলিশের বোন আমি, হুহ্। এসব বিকৃত ছেলেদের ঠিক করা আমার জন্য চাট্টিখানি ব্যাপার। আমার তো রাগ লাগতেছে এইটা ভেবে যে, এই কু*** বাচ্চা এতোদিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াইছে তাই।’ প্রিয় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। ফায়াজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে তাদের সবাইকে দেখছে। প্রিয়কে সে বরাবরই উদ্ধত ভেবেছে। ছোটো থেকেই সে যেটা ভালো মনে করে সেটাই করেছে। অন্যদের মতামতের পরোয়া সে কখনোই করেনি। একগুঁয়ে আর জেদী স্বভাবের হওয়ায় ফায়াজ প্রিয়কে খুব একটা পছন্দ করতো না। তবে আজকের এই প্রিয়কে তার ভীষণ ভালো লাগছে। বন্ধুদের সাথে তার সম্পর্ক দেখেও ফায়াজের বেশ ভালো লাগল।
এবার তানভীরের মুখের কাপড়টা খুলে দিল ফায়াজ। অদ্ভুত সব আওয়াজ বের হচ্ছে ওর মুখ থেকে। বেশ কিছুক্ষণ পরে ওরা সবাই বুঝতে পারল যে তানভীর তাদের কাছে ক্ষমা চাইছে। তানভীর ভাঙা গলায় আওড়াতে লাগল, ‘আমাকে মাফ করে দাও, প্লিজ। আমি আর কোনো মেয়েকে ব্ল্যাকমেল করব না। লুকিয়ে ছবিও তুলব না।’
শিহরণ বলল, ‘এবার ওকে পুলিশের হাতে ছেড়ে দেওয়া হোক।’
ছোঁয়া বলল, ‘একটা কাজ এখনও বাকি আছে।’
সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। সে বলল, ‘লাভার বয়ের ভীষণ প্রিয় চুলগুলোর একটা দফারফা করা উচিত বলে মনে হচ্ছে না তোমাদের?’
অহনা আর প্রিয় হেসে বলল, ‘আহা! একদম মনের কথাগুলোই বলেছ তুমি।’
ছোঁয়া হিয়াকে বলল, ‘এই কাজটা বরং তুই নিজের হাতেই কর। তাহলেই তুই শান্তি পাবি।’
হিয়া ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে প্রিয় বলল, ‘এই মেয়ে তুমি কেন ভয় পাচ্ছ? অপরাধ এই নোংরা লোক করেছে। তুমি করোনি। এইসব বিকৃত মানসিকতার মানুষকে তোমাদের মতো মেয়েরা ভয় পায় বলেই এরা এইসব নোংরামি চালিয়ে যাবার সাহস পায়। রুখে না দাঁড়ালে, প্রতিবাদ না করলে, পাল্টা জবাব না দিলে সবাই তোমাকেই শোষণ করতে চাইবে।’
ছোঁয়া, মায়া, মোহনা আর অহনাও প্রিয়র সাথে সম্মতি জানাল। হিয়া যেন সবাইকে পাশে পেয়ে দ্বিগুণ সাহস পেল। সে তানভীরের মাথার বিভিন্ন অংশের চুল ব্লেড চালিয়ে চুলের দফারফা করে ছাড়ল। হিয়ার সমস্ত ক্রোধ যেন তানভীরের মাথার উপর গিয়ে পড়ল। তার মাথার বিভিন্ন জায়গার চুল তো উঠেছেই, পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় কেটে গিয়ে রক্তারক্তি অবস্থা।
তানভীর বারংবার আর্তনাদ করে উঠছে। কিন্তু তাতেও যেন মন গলছে না কারো। গলবেই বা কেন? যখন দিনের পর দিন এই ধরনের মানুষরূপী পশুগুলো মেয়েদের হেনস্থা করে, গোপন ভিডিয়ো ধারণ করে ভাইরাল করে দেবার ভয় দেখিয়ে নিজেদের অবৈধ ও বিকৃত লালসা মেটায় তখন তো এরাও বিন্দুমাত্র মায়া দেখায় না মেয়েদের প্রতি।
চুল না থাকায় তানভীরকে খুবই বিদখুটে দেখাচ্ছে। এরপর মোহনা বলল, ‘আরো একটা কাজ বাকি আছে। লাভার বয়কে তার নতুন রূপের সাথে একটু সাক্ষাত করানো বাকি আছে।’
সে ঝটপট তার ব্যাগ থেকে একটা আয়না বের করে তানভীরের সামনে ধরল। তানভীর সেদিকে তাকাতেই চাইছে না। তারপর সবাই ধরে জোর করেই তাকে আয়না দেখতে বাধ্য করল। আয়নাতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে এক ভয়ার্ত চিৎকার দিলো তানভীর। সেই চিৎকার শুনেই যেন সব মেয়েরা শান্তি পেল।
ফায়াজ বলল, ‘হয়েছে আপনাদের? এবার আমাকে আমার কাজ করতে দিন। এবার দীর্ঘ সময়ের জন্যই শ্বশুরবাড়িতে পাঠাব এই লোককে। দেখব ওর কতো ক্ষমতা আছে।’
ছোঁয়া আবারও বলে উঠল, ‘এবার এই সুন্দর চাঁদ মুখখানার কয়েকটা ছবি তুলে ফেলা যাক। তারপর এইগুলো ভাইরাল করতে হবে। এতদিন তো অন্য মেয়েদের ছবি ভাইরাল করে মজা নিছে। এখন ওর নিজের ছবি ভাইরাল হলে কেমন লাগে তাও একটু বুঝুক।’
ছোঁয়ার কথা বলতে দেরি নেই। প্রিয় ঝটপট বেশ কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল। তারপর তার দিকে তেড়ে গিয়ে বলল, ‘এখন তোর উপর করা টর্চারের ভিডিয়ো প্লাস এই চাঁদ মুখের ছবি ভাইরাল করব।’ মাথায় আঙ্গুল দিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে প্রিয় আবারও বলল, ‘না এখন ভাইরাল করব না। যদি কখনও হিয়া বা তার মায়ের আশেপাশে তোকে দেখা যায় তো আমি ভিডিয়ো আর সমস্ত ভিডিয়ো ভাইরাল করে দেব। কথাগুলো মনে রাখিস।’
তানভীরকে ফায়াজ সাথে করে নিয়ে গেল। হিয়া ছোঁয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ছোঁয়া তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘আরে পাগলি আমি কিছুই করিনি। সব তো শিহরণ আর তার বন্ধুরা করেছে।’
প্রিয়র দিকে এগিয়ে এসে ছোঁয়া বলল, ‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ প্রিয়। অনেক বড়ো উপকার করলে তুমি।’
প্রিয় হেসে বলল, ‘আমি কিছুই করিনি। সব তো ভাইয়া করেছে।’
অহনা ছোঁয়ার সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। দ্বিধান্বিত দেখাচ্ছে তাকে। ছোঁয়া বলল, ‘কিছু বলবে, অহনা?’
অহনা যেন প্রসঙ্গ ফিরে পেল। কিন্তু সে অদ্ভুতভাবে খেয়াল করল, সে কিছুই বলতে পারছে না। গলার কাছটাতে কান্নার দলা আটকে তাকে ভীষণ অসহায় করে ফেলছে। আচমকা সে ছোঁয়াকে জড়িয়ে ধরল। কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করে দিও, ছোঁয়া আপু।’
এই প্রথমবারের মতো অহনার মুখে আপু ডাক শুনে ছোঁয়ার ভীষণ ভালো লাগল। মনে হলো, সে যেন সবকিছু পেয়ে গেছে। তার মতো সুখী যেন আর কেউ নেই। সে বলল, ‘আমি তো তোমার উপর কখনোই রাগ করিনি, অহনা। তোমাকে সবসময় বোনের মতো দেখেছি।’
‘তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ তো, আপু?’ ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান দৃষ্টিতে ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল অহনা।
‘হুম, করেছি। বোনের উপর কি রাগ করে থাকা যায়? পাগলি বোন আমার।’ ছোঁয়া মাথা উপর নিচে দুলিয়ে বলল।
ছোঁয়া, হিয়া আর অহনা যেন এক নতুন বন্ধনে আবদ্ধ হলো। যেই বন্ধনে নেই কোনো হিংসা, নেই কোনো ঈর্ষা। তিন বোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে যেন এতো দিনের মানসিক দূরত্ব ঘুচাতে চাইছে। যেন আজ বহু বছর পরে তিন বোনের মিলন মেলা চলছে।
‘আজ কি তবে মিলন মেলা চলছে?’ শিহরণ হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল মায়াকে।
মায়া ভাবুক গলায় বলল, ‘সব ঠিক হয়ে গেছে ভাবতেই আমার ভীষণ ভালো লাগছে, শিহরণ। এবার তুমি এই মেয়েটাকে তোমার করে নাও একেবারের জন্য।’
শিহরণ বলল, ‘হুম, এবার তো করতেই হবে।’
প্রিয় ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ফিসফিস করে কি বলাবলি করছ তোমরা? আমাকে কি বলা যায়?’
শিহরণ মুচকি হেসে প্রিয়র দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোদের ভাবিকে ঘরে তোলার প্ল্যান করছি।’
‘ওহ্ হো! দারুণ তো। এবার তাহলে একটার পর একটা বিয়ে খেতেই খেতেই দিন কাটবে। প্রথমে মায়া তারপরেই দ্যা মোস্ট ওয়ান্টেড লাভ বার্ডস ছোঁয়া এন্ড শিহরণ।’ প্রিয় খুশিতে বাকবাকুম হয়ে বলল।
মোহনা প্রিয়র পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই তোরা কি নিয়ে হাসাহাসি করছিস?’
প্রিয় দুঃখী গলায় বলল, ‘আরে দোস্ত, আমরা হাসতেছি না, আমরা তো কাঁদতেছিলাম।’
‘মজা নেও?’ মোহনা হাতের কনুই দিয়ে প্রিয়কে গুতা দিয়ে বলল।
‘একদম না। তোর লগে কি আর মজা নেওন যায়? তুই তোর বিয়েতে আমাদের দাওয়াত দিস নাই সেই দুঃখেই আমরা কাঁদতেছি।’ প্রিয়র অসহায় মুখ করে বলার ভঙ্গি দেখে সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
_______________________