#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪৪
সাইফ কুকিজের পার্সেল প্যাক করার সময় ছোঁয়া দোকানে এলো। সূর্য তখন মাথার উপরে। ছড়াচ্ছে উত্তাপ অহর্নিশ। তখনও কর্মজীবী মানুষগুলো ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ছুটছে নিজ নিজ কাজে। সাইফকে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে দেখে তার ফ্রি হবার জন্য বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল ছোঁয়া। তারপর নিজের পেন্ডিং কাজগুলোতে হাত দিল। সাইফ কাজ শেষে ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে এসে কৌতূহলী ভঙ্গিতে বলল, ‘আজ এতো খুশি মনে হচ্ছে কেন? কোনো বিশেষ কিছু ঘটেছে কি?’
ছোঁয়া হিসাবের খাতাটা বন্ধ করে সাইফের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ‘খুশি হবার তো বেশ অনেকগুলো কারণ আছে। কোনটা কোনটা জানতে চাস বল?’
‘আমি তো সবগুলোই জানতে চাই। যদিও আমার কিউরিসিটি বেশি তবুও আমাকে কেউ কিছু জানাতে চায় না। এটা তো আর আমার অজানা নেই।’ সাইফ অভিমানী গলায় বলল।
ছোঁয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘স্যরি দোস্ত। তুই যে কারণে অভিমান করেছিস ওসবের কিছুই ইচ্ছাকৃত ছিল না। তবে মায়া ইচ্ছাকৃতভাবে লুকিয়েছে সবকিছু। এমনকি আমার কাছ থেকেও! ভাবতে পারিস? ঠিক এই কারণটাতে আমার তার উপর খুব রাগ হয়েছিল প্রথমে। আমি এখনও ভাবতেই পারছি না ও আমার কাছ থেকে সবকিছু লুকিয়েছে।’
‘মায়ার উপর রাগ করছিসই বা কীভাবে? তোর রোমিওই তো ওকে নিষেধ করেছে তোকে কিছু না জানানোর জন্য। মায়ার কী-ই-বা করার ছিল? যেহেতু তুই আর তোর রোমিও দুজনেই ওর বন্ধু।’ সাইফ হিমশীতল গলায় বলল।
ছোঁয়া সাইফের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিদ্রুপাত্মক স্বরে বলল, ‘বাহ্! মায়ার পক্ষ নেওয়া হচ্ছে খুব। মায়া অন্যায় করলেও তা মাফ। আর আমার বেলায় খোঁচা মারতে এক মুহূর্তও দেরি হয় না।’ এক মুহূর্ত থেমে ছোঁয়া ঝগড়াটে গলায় বলল, ‘আর রোমিও রোমিও বলে কি শুরু করেছিস?।ওর একটা নাম আছে তো না-কি?’
‘স্প্লেনডিড! রোমিওকে তাহলেও রোমিও বলতে পারব না?’ সাইফ ভীষণ রকমের বিস্ময়াভূত হয়ে বলল, ‘রোমিওর জন্য দেখছি জান-প্রাণ সব একীভূত হয়ে আছে! আর মায়ার ব্যাপারে এমন করে বলছিসই বা কেন? মায়ার কোনো দোষ আমি দেখছি না এখানে। তাই এরকম বলেছি। দোষ করলে তো সেটাও অবশ্যই বলতাম।’
‘হুম।’ ছোঁয়া প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে বলল, ‘যাক। ওসব বাদ দে। মায়ার বিয়েটা শেষমেশ পাকা হয়ে গেছে। তাই আজ আমার বেশ আনন্দ হচ্ছে। মন চাইছে প্রজাপতির মতো ডানা মেলে উড়তে থাকি।’
‘কী!’ সাইফ আঁতকে উঠে বলল, ‘কবে? কখন? মায়া আমাকে জানায়নি কেন?’
‘ওয়েট।’ ছোঁয়া সাইফের সামনে সটান দাঁড়িয়ে বলল, ‘এত হাইপার হচ্ছিস কেন? একটু আগেই আমাকে জানাল। মায়ার বিয়ের খবর শুনে খুশি হোসনি তুই?’
‘খুশি হবো না কেন?’ সাইফ অভিমানের সুরে বলল, ‘রাগ করলেও তোরা তোরা ঠিকই আছিস। আমাকে কল করে জানালো না অথচ তোকে খবরটা ঠিকই দিল।’
‘শুধু আমরা দুজন না বরং আমরা তিনজনই ঠিক আছি। রাগ, অভিমান কোনো কিছুই আমাদের বন্ধুত্বের চাইতে বেশি না। বাচ্চাদের মতো এত অভিমান করিস কেন? এত অভিমান কই থেকে আসে বল তো।’ ছোঁয়া গম্ভীর গলায় বলল।
সাইফ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ছোঁয়ার দিকে ত্যাড়ছাভাবে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আজ কি দেখা হবে মায়ার সাথে?’
‘হুম।’ ছোঁয়া থমথমে গলায় বলল, ‘বিয়ে তো এখনি হয়ে যাচ্ছে না। দেখা নিশ্চয়ই হবে। এত দুশ্চিন্তা করার মতো কিছু নেই।’
‘মায়া চলে যাবে ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে খুব।’ সাঈফ অন্যমনস্ক হয়ে স্বগোতোক্তি করল যেন।
‘তাহলে এক কাজ করলে কেমন হয়?’ হঠাৎ জোর গলায় বলল ছোঁয়া।
‘কী কাজ?’ ভীষণ কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল সাইফ।
‘মায়ার বিয়েটা ভেঙে দিই।’ ছোঁয়া ভ্রু কুঁচকে দ্বিধান্বিত হয়ে তাকাল সাইফের দিকে।
‘এটা কি কোনো কাজ হলো? আমরা ওর বিয়ে ভাঙব-ই-বা কেন? আর বিয়ে তো আজ নয়তো কাল করতেই হবে। তাই না?’ সাইফকে বিভ্রান্ত দেখাল ক্ষণিকের জন্য।
‘এক্সেক্টলি।’ ছোঁয়া জোরালো কণ্ঠে বলল, ‘আমিও ঠিক এই কথাটাই তোকে বোঝাতে চাইছি। আজ নয়তো কাল বিয়ে তো হবেই। তাহলে মন খারাপ করে কী লাভ?’
‘হুম, ঠিক বলেছিস।’ সাইফ বিমর্ষ কণ্ঠে সম্মতি জানাল।
‘তোর কি কোনো কারণে মন খারাপ, সাইফ?’
‘একটু।’ সাইফের দৃষ্টিতে বিভ্রম, ‘তোদের দুজনের বিয়ে হয়ে গেলে আমি খুব একা হয়ে যাব। সেটাই ভাবছি।’
‘এমনভাবে বলছিস যেন তুই জীবনেও বিয়ে করবি না। শুধু আমার আর মায়ার বিয়ে হবে। তুই কি চিরকুমার সভায় নাম লেখানোর ধান্দায় আছিস না-কি?’ ঠাট্টার সুরে বলল, ছোঁয়া।
সাইফ বিস্ফারিত চোখ মেলে ছোঁয়ার দিকে তাকাল। গমগমে গলায় বলল, ‘চিরকুমার সভায় নাম লেখানোর কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তোদের মিস করব খুব।’
‘আরে পাগল আমরা কি দূরে কোথাও চলে যাচ্ছি না-কি? এখানেই থাকব। এই শহর ছেড়ে আমি তো কোথাও যাচ্ছি না। আমি আর মায়া অবশ্য তোর ব্যাপারেও ভাবছি।’
‘কী ভাবছিস?’
‘কিছু একটা তো অবশ্যই ভাবছি দোস্ত।’
‘হুম, কিন্তু কী ভাবছিস?’
‘তোকে দোকা করার কথা ভাবছি।’
‘আমাকে দোকা বানানোর ধান্দায় না পড়ে তোর রোমিওকে কীভাবে সামলাবি সেটাই ভাবতে থাক। তার পেছনে লাগার জন্য তো আর জুলিয়েটের অভাব নেই।’
ছোঁয়া প্রশস্ত হেসে বলল, ‘জুলিয়েট এক জনই । অন্য সবাই জুলিয়েট হতে চাইছে। কিন্তু পারবে না। সো নোউ ওয়ারি!’
‘হোয়াট আ কনফিডেন্ট।’ সাঈফ বলল বিমুগ্ধ হয়ে।
‘ভালোবাসায় এই বিশ্বাসটুকু না থাকলে তা টিকবে কী করে? বন্দীকে পাহাড়া দিতে হয় স্বাধীন সত্তাকে নয়। ভালোবাসার মানুষকে তথাকথিত বন্দিত্ব বরণ করতে বাধ্য না করে তাদের মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় উড়ার স্বাধীনতা দিতে হয়। যদি সে তোর হয়ে থাকে তবে দিনশেষে তোর কাছেই ফিরে আসবে। ঠিক যেমন পাখিরা নীড়ে ফিরে গোধূলিলগ্নে।’ ভালোবাসা বিশারদের ন্যায় ব্যাখ্যা করল, ছোঁয়া।
‘তুই এমন ভালোবাসা বিশারদ হলি কবে থেকে?’ সাইফ ঠাট্টার সুরে বলল।
‘যবে থেকে আমার রোমিওর প্রেমে পড়েছি তবে থেকে।’ ছোঁয়া বিমোহিত কণ্ঠে আওড়াল, ‘সেই স্কুলের দিনগুলি থেকেই আমি তাহাতে মুগ্ধ।’
___________________
বিকেলের দিকে ছোঁয়া বাগানে চলে এলো। কয়েকদিন ধরে নানান ব্যস্ততা থাকায় তার বাগানের অবস্থা বেহাল হয়ে গেছে। বাগানের এমন নির্জীবতা দেখে ছোঁয়া কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে বেশ আফসোসের সুরে স্বগোতোক্তি করে বলল, ‘আমি কয়েকদিন না থাকায় বাগানটার সর্বনাশ হয়ে গেছে। এখন এটাকে ঠিক করতে আমার বেহাল দশা হবে।’
তারপর ওড়নাটা কোমরে গুঁজে সবগুলো গাছে পানি দিল। আগাছাগুলো কেটে পরিষ্কার করল। ততক্ষণে ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে সে। কপাল আর নাকের ডগায় জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘর্মবিন্দু। সেদিকে ছোঁয়ার কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। সে তার কাজে পূর্ণ মনোযোগী। অর্কিডের গাছ গুলো সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছোঁয়ার আফসোস হচ্ছে খুব।
ঠিক সে সময় শিহরণ এসে হাজির হলো। বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ গেটের বিমের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করল তার প্রিয়তাকে। ছোঁয়ার কাজ যখন শেষের দিকে তখন সে উঠে দাঁড়াতেই শিহরণকে দেখল। শিহরণ তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছিল। ছোঁয়া এমন সময়ে শিহরণকে দেখে আঁতকে উঠে বলল, ‘এ কী! তুমি এখানে ! কখন এলে? এখানে এই সময়ে কী করছ?’
শিহরণ মুচকি হাসি ঠোঁটের কোণে বহাল রেখেই বলল, ‘চলে এলাম পিয়াসী মনের পিপাসা মেটাতে।’
স্নিগ্ধ সমীরণের বেগ তখন বেড়েছে খানিকটা। বাতাসের ঝাপটা এসে ছোঁয়ার চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছিল। শিহরণ মুগ্ধ হয়ে দেখছিল তার প্রিয়তাকে। মোহাবিষ্টের ন্যায় দৃষ্টি নিবিষ্ট রেখে শিহরণ বলল, ‘প্রিয়তা আমি বড্ড পিপাসার্ত আজ। আমার পিপাসা কী মিটবে আজ?’
‘উফ্! কী একটা অবস্থা। তুমি পানি খেতে এইখানে চলে এসেছ। তোমার অফিস আর বাসা কোথাও কি পানি ছিল না?’ ছোঁয়া কোনোকিছু না ভেবেই বলল।
শিহরণ এক মুহূর্তের জন্য চোখ দুটো বন্ধ করে হতাশার সুরে বলল, ‘হায়রে কপাল! আমার পানির পিপাসা পায়নি প্রিয়তা। আমার চোখের তৃষ্ণা পেয়েছিল। সেই তৃষ্ণা মেটাতে চলে এলাম।’
শিহরণের কথা শুনে ছোঁয়া বেশ লজ্জা পেল। সাথে সাথেই মুখটা নিচু করে ফেলল। লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ‘কী অশ্লীলটাই না হচ্ছো তুমি দিন দিন!’
শিহরণ ভীষণ অবাক হয়ে বলল, ‘কী, অশ্লীল! এখানে অশ্লীলতার কী দেখলে তুমি?’
ছোঁয়া প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘তৃষ্ণা মিটলে এবার বিদেয় হও। মা যেকোনো সময় বাইরে চলে আসতে পারে। আমি চাই না তোমাকে এখানে দেখুক।’
‘শ্বশুরবাড়িতে এসে শাশুড়ির সাথে দেখা না করেই চলে যাওয়ার মতো বোকা তো আমি নই জানেমান!’ শিহরণ শার্টের কলারটা খানিকটা উঁচিয়ে দম্ভভরে বলল।
‘তুমি কি যাবে?’ ছোঁয়ার একগুঁয়ে প্রশ্ন।
‘উঁহু! যাবার জন্য তো আসিনি।’ শিহরণও নাছোড়বান্দার মতো করে জবাব দিল।
‘একটু আগে না বললে আমাকে দেখতে এলে।’
‘মোটেই না।’
‘তাহলে কেন এসেছ?’
‘তৃষ্ণা মেটাতে এসেছি।’ শিহরণ বেশ ভাব নিয়ে বলল।
‘ওই একই কথাই তো হলো।’ বিরক্তির সুরে বলল, ছোঁয়া ।
‘একদম না।’ জোর গলায় বলেই শিহরণ মাথা ঝাঁকাল।
‘এত প্যাঁচাচ্ছ কেন?’ শিহরণের দিকে তেড়ে এসে বলল, ছোঁয়া।
‘না প্যাঁচালে কি কেউ আমার কথা শোনে?’ আক্ষেপের সুরে বলল, শিহরণ।
‘আচ্ছা এবার কি চাইছ বলো তো?’ মেইন দরজার দিকে চোখ রেখেই বলল, ছোঁয়া।
‘এইবার লাইনে এসেছ।’ কথাটা বলেই শিহরণ এগিয়ে এলো ছোঁয়ার দিকে। ছোঁয়ার সাথে তার দূরত্ব যখন কমে এলো তখন ছোঁয়া বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে মৃদু চেঁচিয়ে বলল, ‘এই তুমি কাছে আসছ কেন? যেখানে আছ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাক।’
শিহরণ থমকে দাঁড়িয়ে পুনরায় ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে এসে তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি কি ভয় পাচ্ছ, প্রিয়তা?’ শিহরণ খুব কাছে দাঁড়িয়ে থাকায় ছোঁয়ার দমবন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছিল। সে সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে ফেলল। ছোঁয়াকে এমন আচমকা চোখ বন্ধ করতে দেখে শিহরণ মুচকি হাসল। প্যান্টের পকেট থেকে টিস্যু বের করে তা দিয়ে ছোঁয়ার কপালের কাছে লেগে থাকা মাটি মুছে দিয়ে বলল, ‘এবার ঠিক আছে। এবার চোখ খুলতে পারো জানেমান। আমাকে রেহান ভাবার কোনো কারণ নেই, জানেমান। আই হ্যাভ মাই পেশেন্স।’
নিজের নির্বুদ্ধিতায় মনে মনে ইচ্ছেমতো বকলো নিজেকে। ছোঁয়া নিজের মাথাটা নিচু করতে করতে চিবুকটা একদম বুকের সাথে লাগিয়ে ফেলল। তাই দেখে শিহরণ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। শিহরণের হাসি দেখে ছোঁয়া প্রচণ্ড রাগান্বিত হয়ে বলল, ‘তুমি একটা অসভ্য!’
‘আমি অসভ্য!’ ভ্রু যুগল কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করল, শিহরণ।
‘শুধু অসভ্য না, মারাত্মক রকমের অসভ্য তুমি।’
ফাহমিদা বেগম বাগানে এসে শিহরণকে দেখে বেশ খুশি হলেন। আনন্দিত গলায় বললেন, ‘কেমন আছ, শিহরণ? সেই যে হাসপাতালে দেখা হলো এর পর তো আর এলে না?’
শিহরণ প্রশস্ত হেসে ফাহমিদা বেগমকে সালাম দিয়ে অভিযোগের সুরে বলল, ‘আসলে আন্টি আমি তো সবসময় আসতে চাই। কিন্তু আপনার মেয়ে আমি আসলেই খালি তাড়িয়ে দেয়। এই যে দেখুন আমি আজকে আপনার সাথে দেখা করতে আসলাম অথচ আপনার এই মেয়েটা আমি আসার পর থেকেই বলছে বিদেয় হও, বিদেয় হও।’
ছোঁয়া তৎক্ষণাৎ চোখ রাঙিয়ে তাকাল শিহরণের দিকে। সেই চোখ রাঙানোতে শিহরণ কোনো ভ্রুক্ষেপই করল না। সে বলতে থাকল, ‘আপনার সাথে দেখা করার জন্য আসতে বললেই আপনার মেয়ে বেঁকে বসে।’
ফাহমিদা বেগম ধমকের সুরে বললেন, ‘ছোঁয়া! এইসব কী শুনছি আমি?’
ছোঁয়া আমতা আমতা করে বলল, ‘না, মানে মা আসলে শিহরণ খুব ব্যস্ত থাকে তাই আসতে নিষেধ করেছিলাম।’
‘একদম মিথ্যে কথা আন্টি।’ শিহরণ বাগড়া দিয়ে বলল।
শিহরণকে ইচ্ছেমতো গালাগাল করলো ছোঁয়া। ফাহমিদা বেগম শিহরণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আচ্ছা, বাবা ভেতরে আসো।’
ছোঁয়া তখনও ভ্যাবলাকান্তের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। শিহরণের এই স্বভাবটা তো তার অজানা নয়। তারপরেও সে হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকল শিহরণের দিকে। ফাহমিদা বেগম তাকে তাড়া দিয়ে বললেন, ‘এই ছোঁয়া, তাড়াতাড়ি আয়। শিহরণকে নাস্তা দিতে হবে তো।’
ছোঁয়া নিজের রুমে গিয়ে ঝটপট রেডি হয়ে কিচেনে গিয়ে কিছু নাস্তা তৈরী করল। তারপর শিহরণের সামনে নাস্তার প্লেট রেখে বলল, ‘খেয়ে উদ্ধার করেন আমাকে। তারপর সোজা বিদেয় হবেন।’
শিহরণ ছোঁয়ার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, ‘আমার শাশুড়ি আম্মাকে ডাকব?’
‘কে তোমার শাশুড়ি, হ্যাঁ? কে? বিয়ে না করেই জামাই আদর পেতে চাইছ? এটা কিন্তু ভীষণ খারাপ অভ্যাস।’
‘তুমি চাইলে এখনই করে ফেলতে পারি। তিনবার কবুল বলব। ব্যস, বিবাহিত জীবনের কাহিনি শুরু হয়ে যাবে। কী বলো?’
‘বিয়ে করার খুব শখ হয়েছে নাকি?’
‘সে তো কবে থেকেই।’
হিয়া আচমকা রুমে প্রবেশ করল। দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেই প্রশ্ন করল, ‘কার বিয়ে করার শখ হয়েছে ছোঁয়া আপু?’
ছোঁয়া তৎক্ষণাৎ বলে বসল, ‘এই যে সামনে বসে যিনি গপাগপ গিলছেন তার।’
শিহরণও কম যায় না। সে বলল, ‘হিয়া, তুমি তো ভালো করেই জানো কার বিয়ের শখ হয়েছে। তাই না?’
হিয়া হতবুদ্ধি হয়ে একবার ছোঁয়ার দিকে তো একবার শিহরণের দিকে তাকাচ্ছে। শিহরণ আবারও বলতে শুরু করল, ‘বুঝলে হিয়া, তোমার বোনের জন্যই আজ অফিসটা করতে পারলাম না। ফোন করে করে আমাকে ত্যাক্ত-বিরক্ত করে ফেলেছে একেবারে। আমাকে না দেখতে পেয়ে না-কি তার অজ্ঞান হবার দশা। এইসব শুনলে কি আর কাজে মন বসে? তুমিই বলো।’
‘এই হিয়া, তুই ওর কথা একদম বিশ্বাস করবি না।’ ছোঁয়া সতর্ক গলায় বলল, ‘সব মিথ্যা কথা বলছে, শিহরণের বাচ্চা। আমি এরকম কিছুই বলিনি। আর আমি তো ফোনও করিনি।’
‘শিহরণের বাচ্চা আবার কোথা থেকে এলো?’ শিহরণ যেন যারপরনাই অবাক।
‘এই তোদের আবার কী হলো?’ ফাহমিদা বেগম ড্রয়িং রুমে আসতে আসতে চেঁচিয়ে বললেন।
ফাহমিদা বেগমকে দেখে ছোঁয়া একদম চুপ হয়ে গেল। হিয়া বলল, ‘ওসব কিছু না, মা। আসলে টম এন্ড জেরির অফস্ক্রিন দৌড়-ঝাপ চলছিল।’
‘তোদের এসব ডিজিটাল কথাবার্তা আমার মাথায় ঢুকবে না। শিহরণকে ভালো-মন্দ কিছু খেতে দে। আমি গেলাম বিশ্রাম নিতে।’ ফাহমিদা বেগম ছোঁয়াকে আদেশ দিয়ে আবারও চলে গেলেন।
শিহরণ এই সুযোগে ছোঁয়াঈএ চোখ মেরে বলল, ‘শাশুড়ি আম্মার আদেশ পালন করো জানেমান।’
হিয়া ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ‘জিজু, তুমি এতো দুষ্ট তা তো জানা ছিল না।’
হিয়ার কথা শুনে শিহরণ হেসে বলল, ‘এবার তো জানলে ।’
‘আমি কিন্তু এখন থেকেই তোমাকে জিজু বলে ডাকব, হু!’
‘আমার তো বেশ ভালো লাগছে তোমার মুখে জিজু ডাক শুনে। কিন্তু কাছাকাছি কেউ হয়তো জ্বলছে। উঁহু, শুধু কী জ্বলছে? জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে একেবারে।’
‘আমিও একটু-আধটু গন্ধ পাচ্ছি বলেই ভনে হচ্ছে।’ শিহরণের সাথে তাল মিলিয়ে বলল, হিয়া।
ছোঁয়ার রাগ তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলেই শিহরণ বলল, ‘আমি আমার প্রিয়তাকে ছাড়া কিচ্ছু মুখি দেব না। কথাটা জানিয়ে রাখলাম। এখন কেউ যদি যেতে চায় তাহলে যেতেই পারে। আমি কিন্তু বাধা দেব না।’
ছোঁয়া থমকে দাঁড়াল। পেছন ঘুরতেই দেখতে পেল এক জোড়া সবুজাভ চোখ তখনও তাতেই নিবিষ্ট। ওই চাহনি পড়তে ছোঁয়ার খুব বেশি কষ্ট হলো না। সে কোনো কিছু না ভেবেই শিহরণের পাশে গিয়ে তার ডান হাতটা শক্ত করে ধরল। তার কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু মোটেই রাগ করিনি জনাব। রাগ করার অভিনয় করছিলাম কেবল।’
জবাবে শিহরণ হাতের বন্ধন আরও বেশি দৃঢ় করে তার ভালোবাসার জানান দিল। হিয়া সহাস্যে প্রশ্ন করল , ‘বাই এনি চান্স আমি কি কাবাব মে হাড্ডি হচ্ছি?’
হিয়ার কথা শুনে ছোঁয়া আর শিহরণ দুজনেই হেসে ফেলল। হিয়াও সাথে যোগ দিল। ড্রয়িং রুম থেকে আওয়াজ আসায় নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে অহনা। ডাইনিং স্পেসে দাঁড়িয়ে থেকে বেশ কিছুক্ষণ চুপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল। শিহরণ আর ছোঁয়াকে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখে অহনার তখন মারাত্মক রকমের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তার উপর হিয়াটাও যে আহ্লাদী কাণ্ড শুরু করেছে তা দেখে তার গা জ্বলে যাচ্ছিল।
_____________________
#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪৫
বহ্নি ভার্সিটির গেটে পা রাখতেই সায়মা তাকে হাত ধরে এক প্রকার টানতে টানতে ক্যান্টিনে নিয়ে গেল। বহ্নি বিরক্তির সুরে বলল, ‘কী হইসে? এভাবে টানতেছিস ক্যান?’
সায়মা বহ্নির হাতের উপর নিজের হাতের বন্ধন আরও জোরালো করে ধরে হিসহিসিয়ে বলল, ‘হারামি! তুই একটা স্বার্থপর। তুই আমাকে কিছুই জানাস নাই। আমাকে সব খবর অন্য কারো কাছ থেকে শুনতে হলো।’
বহ্নি সায়মার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘তুই চুপ করবি? আমার হাতের কি হাল করেছিস দ্যাখ! হাত তো নয় যেন লোহার তৈরী হাতুড়ি!’
তূর্ণ পাশ থেকে ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলে উঠল, ‘আহা, সায়মা একটু হালকা করে ধরতে পারতি তুই। না হয় সে আমাদের নিজের বন্ধু ভাবে না। তাই বলে তো আর আমরা ওর সাথে এমনটা করতে পারি না। তাই না?’
‘তুই এভাবে কথা বলছিস কেন?’ বহ্নি দিয়াশলাইয়ের কাঠির মতো দপ করে জ্বলে উঠল, ‘কী হয়েছে বলবি তো না-কি?’
‘কী আবার হবে?’ সায়মা আক্ষেপ সহকারে বলল, ‘কতো কিছু হয়ে গেছে অথচ আমাদের জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না।’
তূর্ণ অনুযোগের সুরে বলল, ‘বলবে কেন? আমরা তো ওর কেউ না।’
বহ্নি নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত স্বরে বলল, ‘কথা প্যাঁচানো বন্ধ করে কী হয়েছে বল তো আমাকে।’
সায়মা বহ্নির দিকে তেড়ে এসে ঝগড়াটে গলায় বলল, ‘অতল ভাইয়া আর তোর মধ্যে যে সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে তা আমাদের কাউকে জানালি না কেন? তার উপর আবার ন্যাকা সাজছিস!’
‘আরে বাবা, সবকিছু এতো দ্রুত ঘটে গেল যে আমি নিজেই তো বুঝতে পারিনি, তোদের কী করে জানাব বল তো? আমি তো এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, অতল ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে।’ বহ্নি বলল, ভাবুক হয়ে।
‘তা কী করলে বিশ্বাস হবে যে সে তোকে ভালোবাসে?’ তূর্ণ বহ্নির সামনে দাঁড়িয়ে তুড়ি মেরে বলল।
তুড়ি মারার শব্দে বহ্নি ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসলো। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি রেখে বলল,
‘আরও কিছুটা সময় লাগবে। দ্যা গ্রেট অতল ইজ মাইন, ভাবতেই এক অদ্ভুত ভালো লাগছে।’
তূর্ণ বেশ ভাব নিয়ে বলল, ‘যাহ, এবারের মতো মাফ করলাম তোকে। ভালোবাসার ব্যাপার বলে কথা।’ পরক্ষণেই বহ্নিকে সতর্ক করার ভঙ্গিতে বলল, ‘অনেক সাধনার বিনিময়ে অর্জিত ভালোবাসা বলেই মাফ করছি। মনে রাখবি।’
‘আচ্ছা, বাবা মনে রাখব।’ খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, বহ্নি ।
সায়মার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বহ্নি প্রশ্ন করল, ‘আয়মান ভাইয়ার কাছ থেকে জেনেছিস। তাই না?’
‘আমার আপন বলতে তো কেবল সেই আছে।’ ভীষণ হতাশার সুরে বলল, সায়মা।
‘বাব্বাহ, এখন থেকেই দেখছি প্রেমিকের প্রতি দরদ উথলে পড়ছে।’
‘ও শুধু আমার প্রেমিক না আমার কাজিনও। আর ও খুব খুব বেশিই লয়াল। আমার কাছ থেকে একটা কথাও লুকিয়ে রাখে না।’
‘প্রশংসার তীক্ষ্মবাণ ছাড়া আপাতত কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখ তো।’ তূর্ণ রেগে বলল।
‘তোর প্রেমিকা নাই বলে কি আমি আমার প্রেমিকের কথা বলতে পারব না?’ ঝাঁঝালো গলায় বলল, সায়মা।
‘আরে তোরা ঝগড়া থামা তো। বাচ্চাদের মতো এতো ঝগড়া ক্যামনে করিস? এখন পরীক্ষার খবর-টবর কিছু থাকলে বল।’ তূর্ণ আর সায়মার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঝগড়ার মীমাংসা করার চেষ্টায় প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, বহ্নি।
হঠাৎ টেবিলের উপর জোরে একটা চাপড় মেরে সায়মা বলে উঠল, ‘জানিস ফাইনাল এক্সামের রুটিন দিয়েছে। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেছে। এমনিতেই আমার কিছুই পড়া হয়নি।’
‘তোর পড়া জীবনেও হবে না। পরীক্ষার রাতের পড়াই তোর জন্য যথেষ্ট। এর থেকে বেশি পড়া তোর পক্ষে সম্ভব না।’ বহ্নি বলল, বিজ্ঞের মতো করে।
সায়মা মন খারাপ করে বলল, ‘তা যা বলেছিস।’
তূর্ণ ঠাট্টার সুরে বলল, ‘তুই ভালো ছাত্রী বলে কী আমাদের হেয় করলি?’
‘মাইর চিনোস?’ ডান হাতটা তুলে থাপ্পড় দেবার ইশারা করে বলল, বহ্নি।
তুর্ণ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলল, ‘চিনি তো। কিন্তু মারবে কে? তুই? তোর এই হ্যাংলা পাতলা শরীরের চিকনা হাত দিয়ে?’
‘হ্যাংলা বলে আন্ডারস্টিমেট করার ভুল করিস না। মনে নেই সাজ্জাদকে কেমন দিয়েছিলাম পেছন পেছন ঘুরঘুর করছিল বলে।’
‘তা ঠিক আছে। কিন্তু এই তূর্ণকেও আন্ডারস্টিমেট করার ভুল করিস না।’
তূর্ণের দেওয়া সতর্কতা বাণী শুনে বহ্নি আর সায়মা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। সায়মা বলল, ‘এবার অতল ভাইয়াকে লাগিয়ে দেবে। ওর কিছুই করতে হবে না।’
‘ওরে বাবা! ওই কাঠখোট্টার কথা আর বলতে! কথাই বলতে চায় না। কী পাবলিক রে মাইরি। মনে হয় কথা বলতেও তার ট্যাক্স গোনা লাগবে।’
‘তূর্ণ!’ সাবধানী গলায় বলে উঠল বহ্নি, ‘খবরদার, অতল ভাইয়াকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু বলেছিস তো।’
তূর্ণ হাত তুলে স্যারেন্ডার করার ভঙ্গিতে বলল, ‘ওকে, তোর সাধনার ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে ভালো ছাড়া খারাপ বলব না। এবার ঠিক আছে?’
তূর্ণর কথা বলার ভঙ্গি দেখে বহ্নি আর সায়মা উভয়ে ফিক করে হেসে দিল।
________________________
বিকেলের দিকে কিচেনে গিয়ে চা বানাতে গিয়ে হিয়া দেখল চা পাতা শেষ হয়ে গেছে। ফাহমিদা বেগমকে বলতেই তিনি বললেন ছোঁয়াকে ফোন করে জানানোর জন্য। হিয়া নাচতে নাচতে নিজের রুমে এলো। মোবাইলটা খুঁজতেও অনেক কসরত করতে হলো তাকে। শেষ পর্যন্ত বইয়ের ভাঁজের ভেতরে মোবাইলটা খুঁজে পেল।
ছোঁয়াকে কল করার জন্য মোবাইলটা হাতে নিতেই মেসেজের নোটিফিকেশন দেখতে পেল হিয়া। মেসেজবক্সে গিয়ে মেসেজটা পড়তেই হিয়া কাঁপতে লাগল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। এটা কী করে সম্ভব তা কোনোভাবেই তার মাথাতে আসছে না। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে না পেরে আবারও চোখ রাখল মেসেজটাতে।
‘কেমন আছ আমার জান পাখিটা? কী অবাক হচ্ছ? ভেবেছিলে ফিরে আসব না? আমি তো বলেছিলাম ফিরে আসব। ফিরে এসেছি। আহা! এবার জমবে খেলা নতুন করে। ছবিগুলো দেখো তো চিনতে পারো কি না?’
মেসেজের পাশাপাশি এমএমএসটা দেখেই হিয়া চিৎকার করে উঠল। সাথে সাথেই ছুটে গেল মায়ের রুমে। ফাহমিদা বেগম তখন শুয়ে ছিলেন।
হিয়া রুমে ঢুকেই কাঁদতে লাগল। ফাহমিদা বেগম হিয়ার এমন কাণ্ডে ভয় পেয়ে পড়িমরি করে উঠে বসলেন। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছে হিয়া মামণি? এমন করে কাঁদছ কেন?’
‘মা, ওই লোকটা আবার ফিরে এসেছে।’ এটুকু বলেই হিয়া মায়ের কোলে মুখ লুকাল। তার কান্নার বেগ বেড়ে গেছে । ফাহমিদা বেগমের বুকটা অজানা আশঙ্কায় মোচড় দিয়ে উঠেছে। তিনি হিয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে প্রশ্ন করলেন, ‘কে এসেছে?’
হিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘তানভীর নামের লোকটা।’
নামটা শুনেই ফাহমিদা বেগম আঁতকে উঠলেন। বললেন, ‘এটা কী করে সম্ভব? তার তো জেলে থাকার কথা।’
‘বিশ্বাস হচ্ছে না তো? আমার মোবাইলের মেসেজগুলো দেখো। দেখো, বিশ্বাস না হলে।’ ফাহমিদা বেগমের দিকে মোবাইলটা এগিয়ে দিল হিয়া।
তারপর আবার মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল হিয়া। ফাহমিদা বেগম মেসেজ পড়ে আর এমএমএসটা দেখে দরদর করে ঘামতে থাকলেন। তার মানে তানভীর জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। কথাটা ভাবতেই তার কপালে চিন্তার রেখা দেখা দিল। মনের মধ্যে বেশ কিছু সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে।
আচমকা হিয়া ফাহমিদা বেগমকে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে থাকল, ‘সব তোমার জন্য হয়েছে আম্মু। সবকিছুর জন্য তুমিই দায়ী। তুমি যদি তোমার চাইতে কমবয়সী ওই নোংরা লোকের সাথে সম্পর্কে না জড়াতে তাহলে আমার সাথে ওই ঘটনা ঘটতো না। ওই নোংরা লোক আমার দিকে নজর দিতে পারতো না।’
ফাহমিদা বেগম স্তব্ধ হয়ে গেলেন হিয়ার এমন কাণ্ডে। তিনি যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। হিয়ার বলা কথাগুলো সত্য হলেও এই সত্য মেনে নেওয়াটা আজকের দিনে তার জন্য ভীষণ কষ্টের। তিনি কোনোরকমে কম্পিত গলায় বললেন, ‘হিয়া মা, আমি তো ওসবের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলাম।’
‘তোমার ক্ষমা চাওয়াতে কি সব ঠিক হয়ে গেছে মা? কিচ্ছু ঠিক হয়নি। আমি সবকিছু ভুলে গিয়ে যখন নতুনভাবে সব শুরু করেছি ঠিক তখন ওই নোংরা লোকটা আবার আমার পিছু নিয়েছে। আজ থেকে ছয় বছর আগে ওই লোক আমাকে সেক্সুয়ালি অ্যাসাল্ট করেছিল এখন যে তার চাইতে ভয়ংকর কিছু করবে না তার কি নিশ্চিয়তা আছে বলো? তুমি কি এর নিশ্চয়তা দিতে পারবে আমাকে?’
ফাহমিদা বেগম বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হিয়ার কাছে এসে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘তোর কিচ্ছু হবে না মামণি। কিচ্ছু হবে না। আমরা সবাই আছি তো তোর পাশে।’
মায়ের বাহুডোরে হিয়া কিছুটা শান্ত হলো। কিন্তু থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। অতীতটা পুনরায় হানা দিয়েছে বর্তমানে এই চরম সত্যটা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। ফাহমিদা বেগম মনে মনে বললেন, ‘ছোঁয়াকে এই বিষয়ে জানাতে হবে।’
__________________
তানিয়া আমড়ার আচারের বাটি হাতে নিয়ে অতলের রুমে এলো। অতল ল্যাপটপে চোখ রেখেই বলল, ‘কিছু বলবি, টমেটো সস?’
তানিয়া নিরাশ হয়ে বলল, ‘তুমি তো আমাকে দেখোনি, তাহলে বুঝলে কি করে যে আমি এসেছি?’
‘টমেটো সসের আলাদা একটা ঘ্রাণ আছে, বুঝলি? সেটা পেলে বুঝতে কষ্ট হয় না যে আমারে টমেটো সস চলে এসেছে।’
‘আচ্ছা, ভাইয়া একটা কথা বলবে?’
‘কথা বলার আগে তুই কবে থেকে অনুমতি নেওয়া শুরু করেছিস?’
‘সত্যি করে বলবে কি না বলো?’
‘প্রশ্ন পছন্দ হলে অবশ্যই উত্তর দেব।’
‘তোমাকে বেশ কয়েকদিন ধরে একটু অন্যরকম লাগছে। কারণটা আমি যদিও একটু আধটু আঁচ করতে পারছি। তবুও তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।’
‘অন্যরকম বলতে?’
‘এই যে একটু বেশিই হাসি-খুশি, কাজের প্রতি মনোযোগী, অভিযোগহীন।’
‘ওহ্, তার মানে আমাকে হাসি-খুশি দেখে তোর সহ্য হচ্ছে না!’
তানিয়া অভিমান করে বলল, ‘ভাইয়া, এই কথাটা তুমি বললেই বা কী করে? আমি চাই আমার ভাই সবসময় খুশি থাকুক। তোমাকে হাসিখুশি দেখলে আমার চাইতে বেশি কেউ খুশি হবে না। কিন্তু কারণটাও তো জানা দরকার। তাই জানতে চাইছি। তুমি তো আর নিজ থেকে কিছু বলবে না। সবকিছুই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করতে হয়।’
‘আচ্ছা, আতিক ভাইয়ের ব্যাপারটা বল তো। ও কি বিয়েতে রাজী হয়েছে?’
‘প্রসঙ্গ পাল্টালে তো। ঠিক আছে, আমি ঠিক জেনে নেব।’ তারপর নিজের হাতে ধরে রাখা আচারের বাটিটা অতলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমড়ার আচার খাবে? আমি বানিয়েছি।’
‘নাহ্, ওসব আমি খাই না। জানিস না তুই?’
‘অনেক মজা হয়েছে। না খেলে মিস করবে কিন্তু!’
‘জীবনে অনেক কিছুই মিস করেছি। এটা মিস করলে খুব বড়ো কোনো ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না।’
‘ওহ্, হ্যাঁ। আব্বু বলেছে ভাইয়ের বিয়ে আগামী মাসের নয় তারিখ। কথাটা শুনে আতিক ভাইয়া কেমন যেন পাগলের মতো আচরণ করা শুরু করেছে। আমার মনে হয় কি জানো, ভাইয়া বোধহয় বিয়েতে রাজী না।’
অতল কিছুক্ষণ চুপ থাকল। বিড়বিড় করে বলল, ‘এটা তো হবারই ছিল।’
তানিয়া বুঝতে না পরে বলল, ‘কিছু বলেছ?’
‘নাহ্, আম্মু কী করছে?’
‘আম্মু আবার কী করবে? রান্না নিয়ে ব্যস্ত। আরও কতো আয়োজন যে করছে তার হিসেব নেই।’
কথাটা বলেই তানিয়া অতলের রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অতল নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ দরজার দিকে। তারপর আবারও কাজে মনোযোগ দিল।
একটু বাদেই মোবাইলটা বেজে উঠলো হুট করে । অতল তৃণার নাম্বারটা দেখেই কলটা কেটে দিল। মেয়েটা পিছু ছাড়ছেই না। কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। এতটা অস্থির হবার কী আছে সে বুঝতে পারছে না! অতল পরিষ্কারভাবে তাকে জানিয়ে দিয়েছে যে সে তাকে ভালোবাসে না। অথচ মেয়েটা তবুও পিছু ছাড়ছে না। শেষমেশ অন্য কাউকে ভালোবাসার কথা জানিয়েছিল। তবুও কাজ হলো না। মেয়েটা মরিয়া হয়ে উঠেছে। অনবরত কল করতেই আছে।
বারবার কল আসতে থাকায় অতল বাধ্য হয়েই কলটা রিসিভ করে ওপাশের কণ্ঠস্বরের কোনো প্রকার তোয়াক্কা না করেই কঠিন গলায় বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি না। কথাটা কি তোমার মাথার খুলি ভেঙ্গে মগজে ঢুকিয়ে দেবার পরে বুঝবে? যদি এরকমটা হয়ে থাকে তাহলে আমি না হয় তাই করব। তবুও আমি চাই তুমি বুঝো। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি তোমাকে না। আমি জাস্ট টাইমপাস করেছি এতোদিন। দ্যাটস ইট। এই কথাটা রিলেশন করার আগেই ক্লিয়ার করেছিলাম। করিনি?’
তৃণা হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘করেছ কিন্তু আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি, অতল। আমার দিকটা একটু ভাবো। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। প্লিজ, অতল তুমি আমার কাছে ফিরে আসো।’
অতলের মন চাইল নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে। মোবাইলটা কানে ধরে রেখেই সে কতক্ষণ এলোমেলোভাবে পায়চারি করল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘এটা সম্ভব নয় তৃণা। আমি সত্যিই অন্য কাউকে ভালোবাসি। অনেক বেশি ভালোবাসি। আমার জীবনের চাইতেও বেশি। এতোদিন যাবৎ আমি আমার ভালোবাসাকে চিনতে পারিনি বলে ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে দূরে থেকেছিলাম। নিজেকে কষ্ট দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন যখন তাকে আমি নিজের করে পেয়েছি তখন তার কাছ থেকে দূরে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার প্রতিটা হৃদস্পন্দন জুড়ে শুধু তার নাম। আমার প্রতিটা নিঃশ্বাস জুড়ে সে। আমার বিশ্বাস, কষ্ট, সুখ, দুঃখ সবটা জুড়ে কেবল এবং কেবলই সে। সে ছিল, আছে, থাকবে। এর নড়চড় হবে না। কোনোদিন হবে না।’ এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামল অতল।
তৃণা আক্ষেপের সুরে মলিন কণ্ঠে বলল, ‘তাহলে আমার ভালোবাসার কী হবে, অতল?’
অতল অসহায় বোধ করল। তৃণার প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। আচমকা চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল সে। গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ‘তোমার সত্যিকারের ভালোবাসা তুমি নিশ্চয়ই খুঁজে পাবে। যেমনটা আমি খুঁজে পেয়েছি। আমাকে মাফ করি দিও তৃণা। আমার সত্যিই অন্যায় হয়েছে।’
অতলের এমন শান্ত স্বরে বলা প্রতিটি কথার প্রত্যুত্তরে তৃণা হুট করেই কী বলবে ভেবে পেলো না। তবে ভেতরে ভেতরে সে ফুলছে। রাগান্বিত হয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘তুমি কখনোই সুখী হবে না অতল। কখনোই না। আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি যাতে তুমি কখনোই তোমার ভালোবাসাকে না পাও।’
সাথে সাথেই কলটা কেটে দিল তৃণা।
অতল মোবাইলটা বিছানার উপর ছুড়ে মারল। দু’হাত উপরে তুলে মাথাটা চেপে ধরল। তার ভয় হচ্ছে এখন। খুব ভয় হচ্ছে। বহ্নিকে হারিয়ে ফেলার ভয়। সে কোনোকিছুর মূল্যে বহ্নিকে হারাতে চায় না। যেকোনো মূল্যে আগলে রাখতে চায় তার নিজের শক্ত বাহুডোরে আবদ্ধ করে আজীবন। কিন্তু তার ভাগ্যটা বড্ড অপ্রসন্ন। ভালোবাসার মানুষটির উপর অগাধ বিশ্বাস থাকলেও তার নিজের ভাগ্যের উপর ভরসা নেই। ছোটো থেকেই তো সে অবহেলিত, ভালোবাসা পেয়েও পায় না, আবার পেলেও বুঝতে পারে না। তার জীবনটা বড়োই অদ্ভুত। এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতেই অতল বিছায় সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। তার সবকিছু বিতৃষ্ণা লাগছে। চোখ দুটো বন্ধ করে রইল সে। বন্ধ চোখের পাতায় তার মনের রানির অবাধ বিচরণ। দুই চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দু’ফোঁটা অশ্রুবিন্দু। এই অশ্রু বিসর্জন কেন তা জানা নেই অতলের! হয়তো অনেক অনেক সাধনার পরে অর্জিত ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে নিঃস্ব হবার ভয়! এই পৃথিবীর কেউই নিঃস্ব হতে চায় না। সবাই পরিপূর্ণ হতে চায়।
এই পৃথিবীর সবাই ভালোবাসার কাঙাল। আর অতল তো সেই ছোট্ট বেলা থেকেই ভালোবাসা পেতে মরিয়া ছিল। আর এখন যখন পেয়েছে, তখন তা হারিয়ে ফেলার ভয় জেঁকে বসেছে মস্তিষ্ক ও মন জুড়ে। কী নিদারুণ যন্ত্রণা!
_________________________
#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪৬
ফাহমিদা বেগম সর্বস্ব খোয়ানো মানুষের মতো অসহায় মুখ করে বসে আছেন নিজের রুমে। তাকে দেখতে একেবারেই নির্জীব আর নিষ্প্রাণ দেখাচ্ছে। মায়ের মুখটা দেখেই ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল ছোঁয়ার। বাসায় আসার পর পরই হিয়ার মুখে সবটা শুনে ছোঁয়া থ মেরে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তার সবকিছু এলোমেলো লাগছে। তারপরই মায়ের রুমে এসে মায়ের এমন নির্জীব অবস্থা দেখে সে ভেঙে পড়েছে। যে অধ্যায়টা অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল সেটা হঠাৎ করে আবার তাদের সামনে এমন খোলা কোনো পুস্তকের ন্যায় উন্মুক্ত হয়ে দাঁড়াবে তা তাদের কারও কল্পনাতেও ছিল না। মানুষের ভাবনা আর বাস্তবতার বিস্তর ফারাক ঠিক এইখানটাতেই। মায়ের পাশে বসে শুকনো ঢোক গিলে সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে ছোঁয়া বলল, ‘তোমাকে এমন বিষণ্ন দেখাচ্ছে কেন, মা? এত সামান্য একটা বিষয় তোমার ভেতরের সমস্ত সজীবতা কেড়ে নিয়েছে তা ভাবতে আমার ভীষণ অবাক লাগছে।’
ফাহমিদা বেগম অনুভূতিশূন্য চোখে তাকালেন ছোঁয়ার দিকে। মৃত্যু পথযাত্রীদের ন্যায় বহু কষ্টে আতংকগ্রস্ত কণ্ঠে আওড়ালেন, ‘তানভীর খুব ভয়ংকর, ছোঁয়া।’
ছোঁয়া মায়ের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, ‘যতই ভয়ংকর হোক না কেন তার পরাজয় আবশ্যক, মা। এবার তাকে আর এমনি এমনি ছেড়ে দেব না। উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে তারপর ছাড়ব।’ এটুকু বলেই ছোঁয়া নিজেকে সংশোধন করে পুনরায় বলল, ‘ও হ্যাঁ, ছাড়ব না, আবারও হাজতে ঢুকাব। তুমি দেখে নিও, এবার ও পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবে। বাধ্য হবে সে ক্ষমা চাইতে। আগেরবার হালকার উপর ছাড়া পেয়েছে বলে বুঝতে পারেনি পরিবারের উপর আঘাত এলে পরিবারের অন্য সদস্যরা কতটা ভয়ংকর হতে পারে। এতদিন তো সে নিজের ভয়ংকর রূপ মানুষকে দেখিয়েছে এবার সময় এসেছে অন্যদের ভয়ংকর রূপ দেখার।’
কথাগুলো শেষ করেই ছোঁয়া বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আবার পেছন ঘুরে বলল, ‘বিশ্বাস রাখতে পারো আমার উপর।’
ফাহমিদা বেগম উদভ্রান্তের ন্যায় তাকিয়ে থাকলেন ছোঁয়ার গমনপথে। ছোঁয়ার উপর বিশ্বাস থাকলেও তিনি নিজের কৃতকর্মের জন্যই বেশি অনুতপ্ত। নিজের কৃতকর্মের জন্যই তার পাশাপাশি হিয়াকেও এর খেসারত দিতে হচ্ছে। সেদিন এই তানভীরই তাকে আঘাত করেছিল, তিনি এই বিষয়টি কাউকে জানাননি কেবল হিয়ার জন্য। হিয়া এই লোকটার নাম শুনলেই ভয় পাবে বলেই এমন একটা আতংক তিনি মনে মনে রেখেছেন। কারও সাথে শেয়ার করেননি। এমনকি ছোঁয়াকেও বুঝতে দেননি। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হলো না। তানভীর তার মেয়েটার দিকে আবারও হাত বাড়াতে চাইছে। তিনি নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত, লজ্জিত, নিজের বিবেকের দংশনে দংশিত। এই বিষয়টি তিনি কীভাবে বুঝাবেন!
সাইফ, মায়া আর অহনা হিয়াকে শান্ত করতে ব্যস্ত। মেয়েটা কেঁদেই চলেছে। পুরো বিষয়টা সাইফ আর মায়া জানলেও, অহনার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। এমনকি সে কোনো প্রশ্নও করতে পারছে না এই মুহূর্তে। তবে হিয়ার এই রকম অবস্থা দেখে তার নিজেরও ভীষণ খারাপ লাগছে। সন্ধ্যার নাস্তা করা হয়নি কারও। হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সে বলল, ‘হিয়া, তোর জন্য আমি স্যুপ করে আনছি। গরম গরম স্যুপ খেলে তোর খুব ভালো লাগবে।’
হিয়া তখনও কেঁদে চলেছে। কান্নার দমকে খানিক বাদে বাদেই কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীরটা। অহনা হিয়ার উত্তরের অপেক্ষা করল না। বোনের এমন অবস্থা দেখে তার নিজেকে অসহায় লাগছে। উপরন্তু এর কারণটাও তার কাছে অস্পষ্ট। মায়ের অবস্থাও খুব একটা ভালো না তা সে খুব ভালো করেই জানে। ছোঁয়াকে গুরুত্ব দেবার পর থেকে মায়ের সাথে তার দূরত্ব বেড়েছেই কেবল। তবে আজ মায়ের মলিন মুখটা দেখার পর থেকেই তার খারাপ লাগা বেড়েছে। মনে হচ্ছিল দুঃখে কাতর কেউ একজন ক্রমশ নির্জীব হয়ে পড়ছে। নিজের মা আর বোনকে এমন অবস্থায় সে কোনোভাবেই দেখতে চাইনি। দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল অহনা। তারপর কিচেনের উদ্দেশে পা বাড়াল।
ছোঁয়া বেশ অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। হাঁটা থামিয়ে কী যেন ভাবল সে! তারপর আচমকা আবারও হিয়ার মোবাইলটা নিয়ে ছবিগুলো দেখে সে বুঝতে পারল, ছবিগুলো সম্প্রতি তোলা হয়েছে।
সাইফ অস্থির গলায় বলল, ‘কী করবি ভেবেছিস?’
মায়া বলল, ‘পুলিশকে খবর দেওয়া ছাড়া আর কি-ই-বা করতে পারব আমরা!’
ছোঁয়া চোয়াল শক্ত করে কঠিন গলায় বলল, ‘ওকে পুলিশে দেবার আগে একটা শিক্ষা দিতে হবে। যাতে আর কোনো মেয়ের এরকম ছবি তুলতে না পারে। যাতে আর কোনো মেয়েকে ব্ল্যাকমেল করতে না পারে।’
সাইফ মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, ‘একদম ঠিক বলেছিস। এত নোংরা মানসিকতার লোক হয় কি করে! আমার এই বিষয়টাই তো মাথায় আসে না।’
মায়া ক্রোধে ফেটে পড়ে বলল, ‘নিচু মানসিকতার কথা আর কী বলব বল! এই কয়েক মাসের মধ্যে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনাগুলোতেই এইসব নোংরা আর বিকৃত মানসিকতার মানুষগুলোর হীনতা সম্পর্কে বোঝা যায়।’ মায়া থেমে আবারও চোখ মুখ কুঁচকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগল, ‘সিলেটের মেডিকেল কলেজে হওয়া গণধর্ষণ, খাগড়াছড়িতে প্রতিবন্ধী নারীকে ঘরে প্রবেশ করা ধর্ষণ তো সামাজিক অবক্ষয় আর বিকৃত মানসিকতারই ফল। তাই না?’
সাইফ খুব আক্ষেপ নিয়ে বলল, ‘ঠিক বলেছিস। এত এত ধর্ষণের ঘটনা দেখছি যে মনটা বিষিয়ে উঠছে।’
সাইফ আর মায়ার কথোপকথন শুনতে শুনতেই ছোঁয়ার হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে গেল। সে তৎক্ষণাৎ দ্রুত পায়ে ছুটে গেল মায়ের রুমে গেল। ফাহমিদা বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, ‘সেদিন তানভীর লোকটাই তোমাকে মাথায় আঘাত করেছিল, তাই না?’
ফাহমিদা বেগম বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকলেন ছোঁয়ার দিকে। তা দেখে ছোঁয়া বিরক্তির সুরে বলল, ‘মা, এবার কোনো মিথ্যে কথা বলো না। সেদিন তুমি সত্যিটা বলে ফেললে ওই নোংরা লোক এতক্ষণে হাজতে থাকত।’
ফাহমিদা বেগম তোতলাতে তোতলাতে বললেন, ‘কীভাবে বুঝেছিস?’
‘কঠিন ছিল না, মা। ছবিগুলো দেখেই কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছি আর বাকিটা মায়া আর সাইফের আলোচনা থেকেই নিশ্চিত হলাম।’ ছোঁয়া বলল, হতাশার সুরে।
ফাহমিদা বেগম আতংকিত হয়ে বললেন, ‘এখন হিয়ার কী হবে?’
ছোঁয়া মাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘কিছুই হবে না। ওই লোককে এবার উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে। তুমি এরকম মন মরা হয়ে থেকো না। দেখতে ভালো লাগছে না। হিয়ার সাথে থাকো। ওর তোমাকে প্রয়োজন।’
__________________
অফিসের কাজ শেষে মাত্র বাসায় পৌঁছেছে শিহরণ। এসেই সোজা বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার নিল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ছোঁয়ার ফোন পেয়ে শিহরণ নিজেও ব্যাকুল হয়ে পড়ল। সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করল সে। ছোঁয়ার কাছ থেকে যতটুকু শুনেছে তাতেই
তার ব্যাকুলতা, আর অস্থিরতা আন্দাজ করতে খুব একটা কষ্ট হলো না, তাই সে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে বেরিয়ে পড়ল ছোঁয়ার বাসার উদ্দেশ্যে। পেছন থেকে সাবিহা সাবরিন ডাকলেও সে তাতে সায় দিতে পারেনি। শুধু লম্বা পদক্ষেপ ফেলে হেঁটে বেরিয়ে যাবার সময় বলল, ‘মা, আমি খুব জরুরি কাজে যাচ্ছি। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করিও না।’
সাবিহা সাবরিন পেছন থেকে ডেকে বলে উঠলেন, ‘এত রাতে আবার কোথায় যাচ্ছ সেটা তো বল।’
শিহরণ সে কথা শুনতে পেল না। সে ততক্ষণে গাড়ির কাছে চলে এসেছে। ফরিদ নেই, তাই সে নিজেই ড্রাইভ করবে আজ। আর থাকলেও অবশ্য নিয়ে যেত না। কারণ কখন ফিরবে তার কোনো ঠিক নেই।
শিহরণ যখন ছোঁয়াদের বাসায় পৌঁছাল ঠিক তখন ঘড়িতে সময় রাত নয়টা। সে সোজা উপরে চলে আসলো। হিয়া তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। ছোঁয়া পাশে বসে বলছে, ‘তোর কিচ্ছু হবে না বোন, আমরা সবাই আছি তো তোর সাথে।’
ফাহমিদা বেগম সোফায় বসে মাথা নিচু করে আঁচলে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছেন। ঘরের পরিবেশ দেখে শিহরণ স্তব্ধ হয়ে গেল। শিহরণকে দেখে ছোঁয়া হিয়ার পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল। অতি সন্তর্পণে এসে দরজা আটকে দিল। তারপর ছোঁয়ার মোবাইলটা এগিয়ে দিলো শিহরণের দিকে। মেসেজটা পড়ে শিহরণ একটুও ঘাবড়াল না। শিহরণ হিয়ার পাশে এসে বসে মুচকি হেসে বলল, ‘এইটুকুতেই ভয় পেয়ে গেলে তুমি হিয়া? তোমাকে খুব সাহসী ভেবেছিলাম আমি। কিন্তু তুমি দেখছি একটা ভীতুর ডিম।’
হিয়া ছলছল চোখে তাকাল শিহরণের দিকে। তার চোখে-মুখে অসহায়ত্ব, ভয়, শঙ্কা আর নির্ভরতা খুঁজে পাবার এক আকুল আবেদন। শিহরণ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘এই মানসিক রুগীটাকে ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। এর ব্যবস্থা আমি করব। ভাই হিসেবে আমার উপর তো ভরসা করতেই পারো, তাই না?’
হিয়া নির্বাক। তার শব্দ করতেও যেন ভয় হচ্ছে। হিয়া কোনো প্রত্যুত্তর না করাতে শিহরণ হিয়ার দু’বাহু ধরে মৃদু ঝাঁকিয়ে বলল, ‘বোন আমার, ভাইয়ের উপর এইটুকু ভরসা তো করতেই পারো। আমি পুরো বিষয়টা দেখছি। এবার কি আমি আমার বোনের ভরসা অর্জন করতে পেরেছি?’
হিয়া চোখ তুলে তাকাল। শিহরণের দিকে তাকিয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে। হয়তো ভরসা খুঁজে ফিরছে। শিহরণের কুঞ্চিত ভ্রু’যুগল দেখে হিয়া মাথা উপর নিচে ঝাঁকাল। তাই দেখে শিহরণ মৃদু হেসে বলল, ‘তাহলে একটু হাসো তো এখন।’
হিয়া হাসার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করল। সেই হাসিতে মালিনতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ছোঁয়া বলল, ‘এবার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।’
হিয়া ম্লান কণ্ঠে বলল, ‘ঘুম আসছে না।’
‘আচ্ছা, মা তোকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে।’
হিয়া আঁতকে উঠে বলল, ‘না, মাকে চাই না আমার। মাকে চাই না। এই সবকিছু মায়ের জন্য হয়েছে। সব দোষ মায়ের। কিন্তু আমার সাথে কেন এমনটা হলো?’
হিয়ার প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই। সবাই নির্বাক, নিস্তব্ধ। মায়া আর সাইফ হিয়াকে ধরে তার রুমে নিয়ে গেল। ফাহমিদা বেগমও নিজের রুমে চলে গেলেন।
শিহরণ ছোঁয়ার বিছানার উপরে পা তুলে আরাম করে বসে বলল, ‘আন্টির উপর এই লোকটাই এট্যাক করেছিল, তাই না?’
ছোঁয়া মাথা নেড়ে বলল, ‘হুম।’
শিহরণ চিন্তিত সুরে বলল, ‘এই লোকের সাজা তো শেষ হয়নি, ছাড়া পেল কীভাবে?’
ছোঁয়া বলল, ‘যেভাবেই পাক না কেন, ওকে এবার উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।’
‘তা তো অবশ্যই। এখন লোকটার সম্পর্কে আমার কিছু ইনফরমেশন লাগবে। তুমি তার সম্পর্কে যা জানো তার সবটাই আমাকে বলো।’ শিহরণ বলল, গম্ভীর কণ্ঠে।
_______________________