ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৪১+৪২+৪৩

0
1644

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪১

অতল নিজ থেকেই একের পর এক করে জড়িয়ে ধরল ছোটোবেলার সেই প্রাণপ্রিয় বন্ধুদেরকে। সকলের মাঝের এতদিনের দূরত্ব ঘুচে গেল অবশেষে। সবচাইতে অবাক করার বিষয়টা হলো ছোঁয়া আর শিহরণের এক হওয়ার বিষয়টাতে অতল দারুণ খুশি হয়েছে। সকলের পরিবর্তনে সে ভীষণ অবাক হয়েছে। সবচাইতে বেশি অবাক হয়েছে রাদিদ আর ছোঁয়ার পরিবর্তন দেখে। ছোঁয়াকে এখন আর সেই অসহায় মেয়েটার মতো মনে হয় না বরং এক আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়চেতা, সাবলম্বী নারী মনে হলো তার। আর এই বিষয়টিতেই অতল দারুণ আনন্দ পেয়েছে। এক সময় যে মেয়েটাকে সবাই অবহেলা করত; তাকে এখন আর কেউ অবহেলা করার কোনো সুযোগ তো পাবেই না বরং তার সান্নিধ্য লাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। অতল খুব করে খেয়াল করল ছোঁয়াকে দেখে তার কোনো অদ্ভুত বা বিশেষ কোনো ধরনের অনুভূতিই হলো না। যতটুকু অনুভূতি হলো তা শুধু ভালোলাগা, যা এই মুহূর্তে সকলের জন্যই কাজ করছে।

তবে রাদিদের পরিবর্তনে সে আকাশচুম্বি আশ্চর্যান্বিত হলো। রাদিদের ব্যাপারে মোটামুটি যে ধারণা পেল তাতে সে এতটুকু নিশ্চিত যে সে খুব ভালো একজন মানুষ যে মানুষটা নিজের কথা ভাবার আগে নিজের পরিবারের কথা ভাবে। রাদিদের এমন বিশাল পরিবর্তনে অতল বেশ মজাও পেল। ভাবল এই ব্যাপারে তার সাথে একটু মজা করা যাক।

যেই ভাবনা সেই কাজ। অতল রাদিদের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘দোস্ত, তুই তোর চিরায়ত অভ্যাস ভুলে সাধু পুরুষ হলি তাতে আমার কোনো অভিযোগ নাই। আমার অভিযোগ শুধু এক জায়গায় তুই তোর প্লে বয় তকমাটা আমার মধ্যে ট্রান্সমিট করলি ক্যামনে?’

রাদিদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বলল, ‘আমি আবার কখন ট্রান্সমিট করলাম?’

অতল হেসে বলল, ‘বাদ দে, ওসব তুই আর বুঝবি না।’

রাদিদ হতবিহ্বল হয়ে অতলের দিকে তাকিয়ে থাকল। অতল তাতে বেশ মজা পাচ্ছে। গম্ভীর গলায় আবারও বলল, ‘জানিস, আমি না একজনকে খুব মিস করছি?’

‘কাকে?’ রাদিদ কৌতূহল সহকারে জনতে চাইল।

‘ইটস্ অবভিয়াসলি আওয়ার প্লে বয় রাদিদ।’ অতল হাসতে হাসতে ফাহমির গায়ের উপর গড়িয়ে পড়ল।

রাদিদ জবাবে হাসল। অতলকে হাসতে দেখে তার ভীষণ ভালো লাগল। এই বন্ধুটিকে সে খুব কমই হাসতে দেখেছে। জীবনকে উপভোগ করতে দেখেনি। সেই ছোট্টবেলা থেকেই সে দেখেছে এই বন্ধুটির চিন্তা জগতের মধ্যে তীব্র জীবনবোধের প্রবেশ। তাই আজ তার নিজের সেই ছোট্ট বেলার পাগলামির জন্য জীবনে প্রথম একটুও আফসোস হচ্ছে না বরং মনে হচ্ছে ভালোই তো ছিল সেসব। পরক্ষণেই তার খুব করে বলতে মন চাইল তার সকল বন্ধুদেরকে, ‘আজ কেন যেন আমার রাগ হচ্ছে না আমার চরিত্রের পুরনো বৈশিষ্ট্য মনে করিয়ে দেওয়াতে। আমার সেই বৈশিষ্ট্য যদি কারো মুখে হাসির উদ্রেক করতে পারে তবে তাই হোক। এই যে এই চশমা পরা ছেলেটা হাসছে সেটা তো আমার ছোটোবেলার প্লে বয় স্বভাবের জন্যই।’

কিন্তু মুখে খুব ভাব নিয়ে বলল, ‘অবশ্য তুই চাইলে আমি আবার সেই রূপে ফিরে যেতে পারি। তখন আবার আমার তকমাটা আমাকেই ফিরিয়ে দিতে হবে।’

শিহরণ এবার মুখ খুলল। সে রাদিদের ঘাড়ে হাত রেখে বলল, ‘ওটা তুই আর পারবি না দোস্ত। ভুলে যা। এখন যেমন আছিস তেমনই থাকিস আজীবন। এই রাদিদকে আমরা বন্ধুরা বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি।’

মোহনা, ফাহমি আর প্রিয় সমস্বরে বলল, ‘শিহরণ একদম ঠিক বলেছে।’ প্লিয় রাদিদের একটা হাত ধরে বলল, ‘থ্যাঙ্কস দোস্ত।’

‘থ্যাঙ্কস কেন?’ রাদিদ দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জানতে চাইল।

‘ফর এভরিথিং।’ প্রিয় হাসিমুখে বলল।
__________________

রাফি সকাল থেকেই সুযোগ খুঁজছিল বহ্নির সাথে আলাদা একটু সময় কাটানোর জন্য। কিন্তু কোনোভাবেই সুযোগ করতে পারছিল না। অবশেষে বহ্নিকে একা দেখে তার পিছু নিয়েছিল। কিন্তু যা দেখল তাতে সে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে গেল বহ্নির উপর। আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও তাকে সে পাত্তা দেয় না অথচ চশমা পরা চারচোখা ছেলেটার দিকে হা করে তাকিয়ে ছিল। তার গা ঘেঁষে বসে ছিল। এমনকি তাকে জড়িয়ে ধরতেও দ্বিধাবোধ করেনি। আর সে শুধুমাত্র হাত ধরতে চাইতেও অগ্নিমূর্তির ন্যায় ভষ্ম করে দিতে চায়। এইসব কিছুর কারণেই রাফি বহ্নির উপর প্রচণ্ড রেগে আছে।

বহ্নি আর অতল যখন ফিরল তখন অতল নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। একে একে শিহরণসহ তার সকল বন্ধুদের জড়িয়ে ধরেছিল। এইসব দেখেই রাফি বুঝে নিয়েছে যে ছেলেটার সাথে তাদের পুরনো পরিচয় সূত্র আছে।

রাফি বহ্নিকে একা পেয়ে সুযোগ বুঝে ওকে হাত ধরে টানতে টানতে আশ্রমের পেছনে নিয়ে গেল। ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলল, ‘বেশ ভালোই তো প্রেম করছ?’

রাফির এমন আচরণে বহ্নির মেজাজ পুরোটাই খারাপ হয়ে গেল। সে চেঁচিয়ে বলল, ‘তোমাকে কতোবার বলেছি আমার সাথে এই ধরনের বাজে আচরণ করবে না? নেক্সট আমার সাথে অসভ্যতা করার আগে একশবার ভেবে নিবে। নয়তো আমার বাবা আর ভাইয়া তোমার কী অবস্থা করবে তা তুমিও ভাবতেও পারবে না!’

রাফি হো হো করে বিদ্রুপাত্মক হেসে উঠল। অনুযোগের সুরে বলল, ‘সামান্য একটা মেয়ে হয়ে এত দেমাগ তোমার? আজ যদি আমি তোমার সাথে কিছু করে বসি তাহলে? কী করবে তোমার ভাই ? কী করতে পারবে তোমার বাবা?’ রাফি দম নিয়ে আবারও বলতে শুরু করল, ‘যাই করুক না কেন তোমার উপর যেই কলঙ্ক লাগবে সেটা মুছতে পারবে?’ রাফি আবারও হাসতে লাগল। বলল, ‘পারবে না। শেষমেশ বাধ্য হয়ে তোমাকে আমার গলাতেই ঝুলিয়ে দেবে। আমার আসলে এই কাজটা অনেক আগেই করা উচিত ছিল।’ শেষ কথাটা বলেই রাফি বহ্নির দিকে এগিয়ে এসে ওর দু’বাহু চেপে ধরল।

বহ্নি নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে রাফিকে দূরে ঠেলে বলল, ‘অসভ্যতা করছ কেন? আর এসব অসভ্য ছেলের মতো আচরণ করছ কেন? তোমার মন-মানসিকতা এতটা নোংরা! ছিঃ। আমার ভাবতেও লজ্জা লাগছে তুমি আমার আব্বুর ভাইয়ের ছেলে।’

‘আমি অসভ্য?’ রাফি আবারও তেড়ে এলো বহ্নির দিকে। চেঁচিয়ে বলল, ‘আজকে না হয় সত্যিই কিছুটা অসভ্যতা করেই ফেলি! আর ওই চারচোখার সাথে যখন ছিলে তখন লজ্জা লাগেনি তোমার? সমস্ত লজ্জা শুধু আমার সাথে?’

রাফি বহ্নির দিকে আবারও এগিয়ে আসতে থাকল। যখনই বহ্নির গায়ে হাত দিবে ঠিক তখন অতল পেছন থেকে ওর শার্টের কলার ধরে তার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে জোরে সোরে এক ঘা বসিয়ে দিল রাফির নাক বরাবর । ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল রাফি। প্রচণ্ড বিরক্তির সুরে বলল, ‘হু দ্যা ফাক ইউ আর?’

রাফি ডান হাত দিয়ে নাক ঘষতে ঘষতে যেই না
অতলের দিকে তাকাল তার পর পরই অতল আরও একটা ঘুসি বসিয়ে দিল তার ডান গাল বরারবর। এরপরেই এলোপাথাড়ি কয়েকটা লাথি মারল। মুখ বরাবর ক্রমাগত ঘুসি মারার কারণে রাফির ঠোঁট কেঁটে গিয়ে সেখান থেকে রক্ত বের হতে থাকল।

শেষবারের মতো শাসানোর জন্য অতল রাফির ডান হাতটা বাঁকিয়ে ধরে বলল, ‘আর কখনও যেন আমার আগুণমনিকে বিরক্ত করতে না দেখি তোকে। দেখলে কিন্তু তোর ডান হাতটা আর থাকবে না। ভেঙ্গে তোর বাম হাতে ধরিয়ে দেব। মনে থাকে যেন।’

বহ্নি রাফির এমন উগ্র আচরণে কিছুটা মিইয়ে গেল। কাঁপতে শুরু করেছে সে। অতল ওর কাছে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি আছি তো, আগুনমণি। তুই ভয় পাচ্ছিস কেন?’

বহ্নি সহসা অতলকে জড়িয়ে ধরল। মৃদু শব্দে কাঁদতে লাগল। অতল তাকে ধরল না। কেমন যেন সংকোচ লাগছে তার। এদিকে বহ্নির কান্না বেড়েই চলেছে। কান্না ভেজা কণ্ঠে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে আর কখনও যাবে না তো?’

অতল কোনোকিছু না ভেবেই বলল, ‘কক্ষণো যাব না।’

‘প্রমিস করো।’ কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, বহ্নি ।

অতল বহ্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘বাচ্চাদের মতো জেদ করছিস কেন?’

‘তুমি প্রমিস করবে না?’ বহ্নি অসহায় কণ্ঠে বলল।

‘আচ্ছা, প্রমিস।’ অতল পরাস্ত হয়ে বলল।

‘এই প্রমিসের কথা কখনও ভুলে যেও না। তাহলে কিন্তু…!’ বহ্নি আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল অতলকে।

‘তাহলে কিন্তু কি?’ অতল পাল্টা প্রশ্ন করল। বহ্নি নিরুত্তর। অবশেষে সমস্ত সংকোচ ফেলে অতল বহ্নিকে জড়িয়ে ধরল।

ছোঁয়া দূর থেকেই পুরো ঘটনাটা দেখল। তার এতদিনের সন্দেহ সত্যি হয়ে গেছে। এখন শুধু আর একটা স্টেপ বাকি এই সন্দেহ পুরোপুরি সত্যি কি না তা বোঝার জন্য।
___________________

ছোঁয়া আর শিহরণ ওয়েটিং রুমে বসেছিল। শিহরণ তার পাশে বসে বিড়বিড় করে বলছে, ‘তোমার হঠাৎ সাইকিয়াট্রিস্ট এর প্রয়োজন পড়ল কেন?’

‘আমার মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তাই না এসে উপায় ছিল না।’ ছোঁয়া দুষ্টুমির স্বরে বলল।

শিহরণ নড়ে চড়ে বসল। ছোঁয়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল, ‘ছোঁয়া, তুমি এসব কী বলছ? তোমার কী হয়েছে আমাকে বলো? আমার কিন্তু খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে।’

‘আমি ঠিক জানি না আমার কী হয়েছে? কিন্তু কিছু একটা তো অবশ্যই হয়েছে।’

শিহরণ উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল, ‘এক্ষুণি ভেতরে চলো। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। তোমার কী হয়েছে আমার এক্ষুণি জানতে হবে।’

‘একদম চুপচাপ বসে থাকো। আমার কিচ্ছু হয়নি। আমি একটা কাজে এসেছি। তোমার আসাটাও জরুরী ছিল তাই তোমাকেও সাথে আনলাম।’

ছোঁয়ার কথা শুনে শিহরণ আর কথা বাড়াল না। কিছুক্ষণ পরে ছোঁয়ার ডাক পড়তেই সে শিহরণকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল।

ছোঁয়া আর শিহরণকে দেখে প্রশস্ত হেসে ডাক্তার ইলিয়ানা বলল, ‘কেমন আছ তোমরা?’

‘পাগলকে নিয়ে আর কতটুকুই বা ভালো থাকা যায়?’ ছোঁয়ার ত্যাড়ছা উত্তর।

শিহরণ ভ্রু কুঁচকে তাকাল ছোঁয়ার দিকে। দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘কে পাগল?’

‘কে আবার?’ পাল্টা প্লশ্ন ছোঁয়ার।

‘আমি মোটেই পাগল না। পাগলামি তুমি করছ আজ এক সপ্তাহ যাবৎ। তোমার পাগলামির কারণে আমার ঠিকমতো ঘুম হয় না। সারারাত তোমাকে নিয়ে চিন্তায় থাকি।’ শিহরণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল।

‘তুমি আমার চিন্তায় ঘুমাতে পারছ না?’ ছোঁয়া বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘প্রতিদিন তাহলে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হয় কেন যদি তুমি জেগেই থাকো?’

‘ভোরের দিকে দু’চোখের পাতা একটু এক হয় ওটাই আরকি।’ শিহরণ নিজের সাফাই গাইতে যেন বদ্ধপরিকর।

ছোঁয়া আর শিহরণের এমন বাচ্চামো দেখে ইলিয়ানা পেপার ওয়েটটা টেবিলের উপরে সজোরে বাড়ি দিয়ে দু’জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘কাম টু দ্যা পয়েন্ট। ঝগড়া বাসায় গিয়ে করিও। এখন আমার কথা শুনো।’

ছোঁয়া আর শিহরণ দু’জনেই ভীষণ লজ্জা পেল। একদম মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় ইলিয়ানার দিকে তাকিয়ে দুজনেই সমস্বরে বলল, ‘শুনছি, আমরা।’

ইলিয়ানা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ছোঁয়া তোমার সন্দেহ ঠিক ছিল। আমি তোমার দেওয়া সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে এটাই বুঝেছি যে অতল মানসিকভাবে বিধ্বস্ত থাকার কারণেই সে তার নিজের অনুভূতি ধরতে পারেনি। আর তোমার প্রতি থাকা সিমপ্যাথিকে বা সমবেদনাকে সে ভালোবাসা বলে ভুল করেছিল।’

শিহরণ অবাক হয়ে বলল, ‘ছোঁয়া, তুমি অতলের ব্যাপারে জানতে এখানে এসেছ?’

ছোঁয়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। বলল, ‘তোমার বারবার গিল্টি ফিলিংস দেখতে আমার ভালো লাগছিল না। এই ব্যাপারে আমি আগে থেকেই নিশ্চিত ছিলাম তবুও ইলির কাছে আসার কারণ হলো ইলির কথা তুমি বিশ্বাস করতে বাধ্য কারণ সে এই শহরের একজন বেস্ট সাইকিয়াট্রিস্ট যে কি না পেশেন্টের সাথে কথা না বলেও শুধুমাত্র তথ্যের উপর নির্ভর করেই একজন মানুষের মানসিক দিকের সম্পূর্ণ ব্যখ্যা করতে পারে।’

ছোঁয়া থামল। শিহরণের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে সে। শিহরণ নিরুত্তর । চুপচাপ মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ছোঁয়া পুনরায় বলতে শুরু করল,
‘তোমার বন্ধু রেহানকেও তো ইলিই ঠিক করেছে। এটা কি ভুলে গেছ শিহরণ?’

শিহরণ এবারও কিছু বলল না। সে যেন অনুভূতিশূন্য হয়ে গেছে। তাই ছোঁয়া পুনরায় বলল, ‘শিহরণ, তোমার কি মনে নেই রেহান কী পরিমাণ বদ্ধ উন্মাদ ছিল? এই ইলিই কিন্তু ওকে বাগে এনেছে। আজ ওকে দেখ কেমন শান্ত হয়ে গেছে। ইলিকে কতোটা ভালোবাসে।’

রেহানকে বদ্ধ উন্মাদ বলাতে ইলির যেন গায়ে লাগল। সে বলল, ‘ছোঁয়া, রেহান উন্মাদ নয়। তার একটু ভালোবাসার দরকার ছিল শুধু।’

ছোঁয়া স্মিত হেসে বলল, ‘এখনও সে উন্মাদ।’

‘ছোঁয়া!’ ইলিয়ানা খানিকটা রেগে উঠল।

‘রেগে যাচ্ছ কেন? আগে তো উন্মাদ ছিলই এখন তোমার ভালোবাসার জন্য উন্মাদ হয়ে গেছে।’ ছোঁয়া ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল।

ছোঁয়ার কথায় হাসল ইলিয়ানা। শিহরণ ও এবার স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল। ইলিয়ানা যখন ছোঁয়া আর শিহরণের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত ঠিক তখনই কোনো প্রকার নক না করেই রেহান ঢুকে পড়ল। তেজী গলায় বলল, ‘তুমি আমার ফোন ধরছ না কেন, ইলি? আমার তোমাকে নিয়ে কতোটা দুশ্চিন্তা হয় জানো না তুমি?’

ইলিয়ানা লজ্জা পেল রেহানের এমন কাণ্ডে। রেহানকে দেখে শিহরণ উঠে দাঁড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল।।বলল, ‘সিমস্ ইউ আর ম্যাডলি ইন লাভ উইথ ইলি।’

‘ইউ সিমস্ টু। তারপর ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে রেহান প্রশ্ন করল,’রাইট ছোঁয়া?’

ছোঁয়া হাসল। রেহান আর একটুও দেরি করল না। ইলিয়ানার পাশের চেয়ারটাতে বসেই তাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘আর কখনও আমাকে এভাবে অপেক্ষা করাবে না। নয়তো এর জন্য শাস্তি পেতে হবে তোমাকে।’ এটুকু বলেই সে টুক করে চুমু খেল ইলিয়ানার অধর যুগলে।

ছোঁয়া আর শিহরণ তৎক্ষণাৎ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। ইলিয়ানা লজ্জায় ছোঁয়া আর শিহরণের দিকে তাকাতেই পারছে না। তাই দেখে রেহান বলল, ‘দে আর লাভ বার্ডস টু, ইলি। তুমি এতো লজ্জা পাচ্ছ কেন?’

ছোঁয়া কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। রেহান যে ইলিয়ানাকে নিয়ে মারাত্মক রকমের পজেসিভ তা তাদের অজানা নয়। তবুও সবার সামনে কিস করার ব্যাপারটা সত্যিই কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকে তার কাছে। শিহরণ ছোঁয়ার কোল থেকে তার হাতটা নিয়ে নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে বলল, ‘আমি ভাবছি আমি রেহানের কাছ থেকে ট্রেনিং নিব।’

ছোঁয়া চকিতে তাকাল শিহরণের দিকে। বলল, ‘কিসের ট্রেনিং?’

শিহরণ ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলল, ‘হাউ টু কিস পাবলিকলি।’

রেহান বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এটা মোটেই কোনো পাবলিক প্লেস নয়। আর আমার ওয়াইফকে আমি যেখানে খুশি সেখানেই কিস করতে পারি। তাই নয় কি?’

শিহরণ রেহানের সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘অফ কোর্স ব্রো। আই ডোন্ট হ্যাভ এনি অবজেকশন এট অল।’ কিন্তু পরক্ষণেই বিড়বিড় করে বলল, ‘কিন্তু এই কাজটা আমি করলে ছোঁয়া আমার সাথে মৌনব্রত পালন তো করবেই পাশাপাশি আমার আস্ত রাখবে না।’

ছোঁয়া সন্দিগ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘আমাকে কিছু বললে?’

শিহরণ ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে কাতর কণ্ঠে বলল, ‘বললেই কি তুমি শুনবে না-কি?’ ছোঁয়ার চোখ রাঙানো দেখে শিহরণ বলল, ‘না মানে তেমন কিছু না। আসলে রেহানের কথা বলছিলাম। দেখছ না কেমন ভদ্র হয়ে গেছে। আর ইলিয়ানা তো রেহানের সব কথা শুনে। রেহান সত্যিই খুব লাকি।’

‘হুম।’ ছোট্ট করে জবাব দিল ছোঁয়া ।

রেহান চকিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাড়া দিয়ে বলল, ‘ওকে ইউ টু ক্যান গো নাউ। আই ওয়ান্ট ইলি টু গো উইথ মি, রাইট নাও।’

___________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪২

কফিশপে বসে অতলের জন্য অপেক্ষা করছে ছোঁয়া। ছেলেটাকে বলেছে ঠিক বিকাল চারটায় আসার জন্য। ছোঁয়া কফি শপে অপেক্ষা করছে প্রায় বিশ মিনিট হতে চলল কিন্তু অতলের দেখা এখনও মেলেনি। অতলের দেরি দেখে ছোঁয়া ওয়েটারকে ডেকে এক কাপ কফি অর্ডার করেছিল। সেই কফিটাও শেষ হয়ে গেছে। তবুও অতলের দেখা মিলছে না। ছোঁয়া অতলের নাম্বারে কল করার জন্য নিজের মোবাইলটা বের করল। নাম্বার ডায়াল করতে যাবে ঠিক তখনই ছোঁয়া শুনতে পেল অপরাধীর সুরে বলা একটা কণ্ঠস্বর, ‘স্যরি, জ্যামের কারণে দেরি হয়ে গেল।আমাকেই কল করছ তাই না?’

ছোঁয়া মোবাইল থেকে মুখ তুলে তাকাল। অতলকে দেখে প্রশস্ত হেসে বলল, ‘ফাইনালি তোমার দেখা মিলল তাহলে। আমি তো ভেবেছিলাম আজ দেখা না করেই আমাকে চলে যেতে হবে। এর পর আবার এপয়েন্টমেন্ট নিতে হতো। হাজার হোক ব্যস্ত মানুষ বলে কথা।’

ছোঁয়ার খোঁচাটা ধরতে পেরে অতল বলল, ‘বাহ্! এই গুণটা কবে অর্জন করলে?’

ছোঁয়া বিরক্ত হয়ে বলল, ‘একদম বেপরোয়া হয়ে গেছ।’ অতলকে পাল্টা আক্রমণ করে বলল, ‘এত্ত পরিবর্তন আর দারুণ সব গুণ তুমি যেভাবে অর্জন করলে?’

‘আই স্যারেন্ডার।’ অতল দু’হাত উপরে তুলে আত্ম সমর্পণ করার ভঙ্গিতে বলল, ‘আমার পরিবর্তনের চাইতেও তোমার পরিবর্তন বেশি স্ট্রং।’ কথাটা বলেই অতল মাথা ঝাঁকাল। ডান হাতের তর্জনী দিয়ে চশমাটা ঠিক করে আবারও বলল, ‘কী যেন বলবে বলেছিলে?’

‘কথা তো বলবই। আগে বলো কেমন ছিলে?’

‘আমি কখনোই খারাপ থাকি না। তুমি?’

‘আমি সবসময় ভালো থাকাদের দলে।’

‘হুম।’ অতল খাবার অর্ডার দেবার জন্য ওয়েটারকে ডেকে ছোঁয়ার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘তা তো তোমাকে দেখেই বেশ বুঝতে পারছি। যাইহোক, কী খাবে বলো?’

‘আমার কিছু লাগবে না। আমি তো মাত্র কফি শেষ করলাম । তোমার জন্য অর্ডার করো।’

‘খাবে না বললেই কি হবে? কিছু তো খেতেই হবে।’ অতল স্যুপ আর কফি অর্ডার দিয়ে ছোঁয়ার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিল।

‘এবার বলো কী বলতে তলব পাঠিয়েছ?’ স্মিতহাস্যে প্রশ্ন করল, অতল।

ছোঁয়া অতলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘চশমাতে কিন্তু তোমাকে বেশ মানিয়েছে।’

অতল মৃদু হাসল। বলল, ‘হুম, সবাই বলে।’

কণ্ঠে গাম্ভীর্য এনে ছোঁয়া বলতে শুরু করল, আমি এখন তোমাকে যা বলতে যাচ্ছি তা তোমার কাছে উদ্ভট মনে হতে পারে। কিংবা অন্যকিছুও তুমি মনে করতে পারো। তবে তোমার কাছে একটাই অনুরোধ আমার সম্পূর্ণ কথা শুনবে তুমি।’

অতল এক মুহূর্তের জন্য কপালে আঙ্গুল ঠেকিয়ে কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’

ছোঁয়া ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি কি একবার চোখ বন্ধ করবে?’

অতল ভ্রু কুঁচকাল। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘চোখ বন্ধ করব কেন?’

ছোঁয়া বিরক্ত গলায় বলল, ‘আরে বাবা করোই না একবার।’

অতল দ্বিধান্বিত হয়ে চোখ বন্ধ করল। ধৈর্যহীন হয়ে প্রশ্ন করল, ‘হয়েছে?’ সাথে সাথেই আবার চোখ খুলে ফেলল।

ছোঁয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘এত অধৈর্য কেন তুমি? চোখ বন্ধ করতে বলেছি যখন করো।’ অতলকে সতর্ক করে বলল, ‘আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবে না।’

উপায়ান্তর খুঁজে না পেয়ে অতলকে আবারও চোখ বন্ধ করতে হলো। ছোঁয়া বলল, ‘কাকে দেখছ?’

‘চোখ বন্ধ করলে কি কেউ দেখতে পায়?’

‘উফফো! তুমি তো দেখছি মারাত্মক ঘাড়ত্যাড়া হয়ে গেছ। তুমি একটু স্থির হয়ে বসে বন্ধ চোখের পাতায় প্রথমেই কার ছবি ভেসে আসছে তা দেখ।’ এক নাগাড়ে কথাটা বলে থামল ছোঁয়া।

অতল বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল। ছোঁয়া ঠিক কী করতে চাইছে তা সে একটুও বুঝতে পারছে না।

নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থেকে উদাস গলায় বলল, ‘আমি কাউকে দেখছি না, ছোঁয়া।’

ছোঁয়া দ্বিগুণ জোর কণ্ঠে ঢেলে বলল, ‘তুমি অবশ্যই দেখবে।’ পরক্ষণেই অনুনয় করার ভঙ্গিতে বলল, ‘ প্লিজ একবার ট্রাই করো।’

‘ওকে।’ অতল মনোযোগ দিল। সাথে সাথেই তার চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো সোনালি পাড়ের সাদা শাড়ি পরিহিত এক তরুণী। যে ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। তরুণীর চেহারা ধীরে ধীরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। চেহারা স্পষ্ট হতেই অতল ঝট করে চোখ খুলে ফেলল। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল । বিড়বিড় করে বলতে থাকল, ‘এটা কী করে হলো? আমি তো কোনোভাবেই বুঝতে পারছি না। এটা সম্ভব নয়। কোনোভাবেই নয়।’

ছোঁয়া এবার মুচকি হাসল। ভ্রু উঁচিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে অতলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কার চেহারা দেখলে?’

অতল জবাবে তৎক্ষণাৎ বলল, ‘কারো না। আমি কাউকে দেখিনি।’

ছোঁয়া যেন নাছোড়বান্দা হবার পণ করেই এসেছে। সে দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘আমি জানি তুমি কাকে দেখেছ। বিশ্বাস করো অতল, এই মুহূর্তে তুমি যাকে দেখেছ, সেই মানুষটাকেই তুমি ভালোবাসতে, ভালোবাসো আর আজীবন ভালোবাসবে।’

ছোঁয়ার কথা শুনে অতলকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। এমন একটা ব্যাপার কী করে হতে পারে সে কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না।

ছোঁয়া একটু দম নিল। তারপর বলল, ‘আমার প্রতি তোমার যে ফিলিংসটা ছিল সেটা কখনোই ভালোবাসা ছিল না। সেটা ছিল সিমপ্যাথি। অর্থাৎ সমবেদনা। এর পেছনেও অবশ্যই যুক্তি আছে।’

কফির মগে চুমুক দিতে দিতে ছোঁয়া পুনরায় বলতে শুরু করল, ‘ছোটোবেলায় তোমার আর আমার অবস্থা প্রায় একই রকম ছিল। আমরা দুজনেই ছিলাম ভালোবাসার কাঙ্গাল। নিজেদের পরিবারের দিক থেকে আমরা দুজনেই ছিলাম দুঃখী। অবশ্য তোমার চেয়ে আমি একটু বেশি দুঃখী ছিলাম। কারণ আমার তো আপন বলতে কেউ ছিল না। সেদিক থেকে তোমার মা আর ছোটোবোন তোমাকে ভীষণ ভালোবাসতো। অথচ সেই ভালোবাসার চাইতে দ্বিগুণ কষ্ট তুমি তোমার বাবা আর ভাইয়ের কাছ থেকে পেতে। তাই তুমি যেই ভালোবাসা পেতে তা হয়ে যেত ম্লান। যে কারণে তুমি নিজেকে দুঃখী ভাবতে সবসময়।
আর আমাদের স্কুলে সব থেকে অসহায় ছিলাম আমি। দু-একজন ছাড়া সবাই আমাকে নিয়ে উপহাস করতো। এতে তুমি ব্যথিত হতে। নিজের কষ্টের কারণে তুমি আমার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারতে। যেটাকে তুমি ভালোবাসা ভেবে ভুল করেছিলে। কিন্তু তোমার ভালোবাসা ছিল অন্য কেউ; যার উপর তুমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে, ছোটো বড়ো বিপদে অথবা কারণে-অকারণে ছুটে যেতে তার কাছে। আমি জানি এখন তুমি তার মুখটাই দেখেছ।’ অবশেষে ছোঁয়া অতলের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘কী! আমি ঠিক বললাম তো?’

অতলের চোখের দৃষ্টিতে বিভ্রম। ভেতরটাতে এক অন্যরকম তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। নিজের রাগটাকে সে বহুকষ্টে দমিয়ে রেখেছে। দমফাটা চিৎকার দিয়ে তার বলতে ইচ্ছে করছে ছোঁয়ার সব কথা ভুল। সব ধারণা ভুল। এভাবেই ছোঁয়া হুট করে এসে তার সমস্ত কিছু ভুল প্রমাণ করে দিতে পারে না। কিন্তু আশ্চর্যরকমভাবে অতল খেয়াল করল সে ছোঁয়াকে কিছুই বলতে পারছে না।

নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে অতল একগুঁয়ে উত্তর দিয়ে বলল, ‘আমি তোমার বলা একটা কথাও বিশ্বাস করি না। এই সবকিছু বানোয়াট। মিথ্যা বলছ তুমি।’

প্রত্যুত্তরে ছোঁয়া হাসল। তা দেখে অতলের রাগ চূড়ান্ত রূপ ধারণ করল। সে চেঁচিয়ে বলল, ‘এভাবে হাসছ কেন?’

অতলের চেঁচানোর কারণে রেস্টুরেন্টে থাকা মানুষগুলো তাদের দিকে তাকাচ্ছে বারংবার। তা দেখে অতলের মেজাজটা আরও বেশি বিগড়ে গেল।

ছোঁয়া শীতল গলায় বলল, ‘এতটা বেপরোয়া হয়ো না অতল। তুমি এমন ছিলে না। এটা তুমি নও। আর কতো মুখোশ পরে থাকবে বলো?’

‘আমাকে যেতে হবে। তোমার কথাগুলো মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ এটুকু বলেই অতল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

ছোঁয়া হিম শীতল গলায় বলল, ‘আমার কথা শেষ হয়নি এখনও, অতল। আমাকে একটা চিঠি দিয়েছিলে সেটার কথা তোমার মনে আছে?’

অতল পুনরায় চেয়ারে বসল। বলল, ‘হুম।’

‘ওই চিঠিটা তুমি নিজে লেখোনি। লিখার চেষ্টা করেছিলে কিন্তু পারোনি। ব্যর্থ হয়েছিলে। অথচ সেই কথাগুলো অনায়াসেই অন্য একজনকে বলেছিলে। ঠিক বললাম তো?’

অতল ভাবার চেষ্টা করল। মনে পড়ে গেল তার সেদিনের পুরো ঘটনা। এই মুহূর্তে অতল অনুধাবন করতে পারছে যেই কথাগুলো অনায়াসেই সে বহ্নিকে বলতে পেরেছিল সেই একই কথা সে ছোঁয়াকে শত চেষ্টা করেও পারেনি। দমবন্ধ অনুভূতি হচ্ছে তার। এটা কী করে হতে পারে! এই কথাটাই তার মাথায় আসছে না।

অতল আচমকা এলোমেলোভাবে বলল, ‘না, এটা কখনোই হতেই পারে না।’

‘এটাই হয়েছে।’ প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, ছোঁয়া।

‘কখনোই না।’ অতল ছোঁয়ার দিকে আঙ্গুল তুলে তাকে অভিযোগ করার ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি নিজেকে সেইভ করার জন্য আমাকে আকাশ-পাতাল বুজাচ্ছ! তাই না?’ ছোঁয়ার উত্তরের অপেক্ষা না করেই অতল তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে পুনরায় বলল, ‘ভয় পেও না। আমি তোমাদের মধ্যে আসব না।’

ছোঁয়া এবার প্রশস্ত হাসল। প্রাণখোলা সেই হাসি। সেই হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে রেখেই বলল, ‘আমাদের মধ্যে তো কখনোই কেউ ছিল না, অতল।’

‘তাহলে আমাকে এসব বলার মানে কি?’ দ্বিধান্বিত দেখাল অতলকে।

‘সেদিন রাফি যখন বহ্নিকে স্পর্শ করেছিল তখন তোমাকে দেখতে অমন লাগছিল কেন? আর যখন সে তার সাথে অসভ্যতা করেছিল তখন তাকে ওভাবে মেরেছিলে কেন?’

‘কী!’ অতল ভীষণ অবাক হয়ে বলল, ‘ওই বেয়াদপ আমার আগুনমণির সাথে অসভ্যতা করবে আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখব। এটাই বলতে চাইছ তুমি?’

‘একদম না।’ ছোঁয়ার হাসি আরও প্রশস্ত হলো। বলল, ‘তোমার আগুনমাণির ক্ষতি তুমি থাকতে কখনোই হবে না এটা আমাকে নতুন করে বোঝানোর কিছু নেই।’

‘তুমি কি বলতে চাইছ?’ অতল ক্রোধান্বিত হয়ে বলল, ‘
বিনা অনুমতিতে ওকে স্পর্শ করবে কেন? আর ওর দৃষ্টিটা ছিল নোংরা। তাই আমি ওদের পিছু নিয়েছিলাম। শেষমেশ আমার আশঙ্কাই তো ঠিক হয়েছিল। ওর সাথে অসভ্যতা করছে আর তাই ওকে মেরেছি। ওর জায়গায় তুমি হলেও আমি এমনটাই করতাম। ইনফ্যাক্ট অন্য কোনো মেয়ে হলেও এমনটাই করতাম।’

‘ওকে ফাইন।’ ছোঁয়া পুনরায় বলতে শুরু করল, ‘অনুষ্ঠানে তূর্ণ যখন ওর হাত ধরল তখন কেন তুমি তোমার হাত মুষ্টিবদ্ধ করলে?’

অতল চোখ বন্ধ করে বলল, ‘কীসব আবোল তাবোল বলছ?’

ছোঁয়া শান্ত কণ্ঠে অনুনয় করে বলল, ‘এডমিট ইট অতল। তুমি জানো আমি কী বলছি।’

‘না, আমি জানি না তুমি কী বলতে চাইছ।’

ছোঁয়া এবার বলেই ফেলল, ‘তুমি কেবল এবং কেবলই বহ্নিকে ভালোবাসো।’

অতল চিৎকার করে বলল, ‘না।’

‘হ্যাঁ।’ ছোঁয়া অতলকে আশ্বস্ত করল।

‘অবশ্যই না। তুমি আসলে ভয় পাচ্ছ। আমি যদি তোমার আর শিহরণের মাঝে এসে আবার কোনো ঝামেলা করে বসি সেই জন্য।’

‘মোটেই না।’ ছোঁয়া আবারও প্রশস্ত হাসল। বলল, ‘তুমি যদি আমাকে সত্যিই ভালোবাসতে তবে তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে। কিন্তু তুমি তার কোনোটাই করোনি। ঢাকায় আসার পরেও তোমার কখনও মনে হয়নি আমার সাথে একবারের জন্যও দেখা করার কথা। অথচ আমরা কত কাছাকাছি ছিলাম। তুমি চাইলেই দেখা হয়ে যেত। সবচাইতে মজার ব্যাপার কি জানো? তুমি আমাকে বিগত দশ বছরে কখনও মনেও করোনি। অথচ শিহরণ আর বহ্নিকে তুমি ভুলতে পারোনি একটা মুহূর্তের জন্যেও।’

‘আমার কখনও দেখা করার ইচ্ছে হয়নি। তাই দেখা করিনি।’ অতল ভেবে দেখল, ছোঁয়ার বলা কথাগুলো আসলেই ঠিক কি না। অতীতের পাতা উল্টিয়ে সে ছোঁয়ার বলা কথাগুলোর সত্যতা ছাড়া আর কিছুই পেল না।

অতলকে নিশ্চুপ দেখে ছোঁয়া বলল, ‘আচ্ছা, একটা কথা সত্যি করে বলবে?’

অতল মাথা ঝাঁকাল। ছোঁয়া বলল, ‘বিগত দশ বছরে কার কথা তোমার সবচাইতে বেশি মনে পড়েছে?’

ছোঁয়ার প্রশ্নে স্তব্ধ হয়ে গেল অতল। এই প্রশ্নটার উত্তর তার জানা থাকলেও ছোঁয়ার ইঙ্গিত সে কোনোভাবেই মানতে পারছে না। এটা কীভাবে হতে পারে তা সে কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না!

ছোঁয়ার প্রশ্ন এড়াতে অতল বলল, ‘আমাকে যেতে হবে এখন।’

ছোঁয়া ঠান্ডা গলায় বলল, ‘এখনও বুঝতে পারলে না! শীঘ্রই তুমি বুঝতে পারবে। যখনই বুঝতে পারো, এটাকে এডমিট করবে। মেয়েটাকে আর কষ্ট দিও না। শী লাভস ইউ মোর দ্যান এনিথিং।’

অতল আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। দ্রুত পদক্ষেপ ফেলে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল।

_________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪৩

দরজা বন্ধ করে নিজের রুমে বসে আছে অতল। পুরোপুরি অন্ধকার রুমটা। তানিয়া বার কয়েক ডাকলেও অতল সাড়া দেয়নি। তারপর অনেকক্ষণ যাবৎ দরজা ধাক্কাল তাতেও কোনো সুবিধা হলো না। আতল কোনো সাড়া শব্দ করেনি। শেষমেশ মেহেরুন নাহার এসে ডাকলে সে ঘুমিয়ে থাকার বাহানায় রুম থেকে বের হয়নি। তবে মাথার মধ্যে এখনও ছোঁয়ার বলা প্রতিটা কথা ঘুর্ণিপাকের মতো করে ঘুরপাক খাচ্ছে। কানের মধ্যে বেজে চলেছে কথাগুলো, ‘
তোমার ভালোবাসা ছিল অন্য কেউ; যার উপর তুমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে, ছোটো বড়ো বিপদে অথবা কারণে-অকারণে ছুটে যেতে তার কাছে। আমি জানি এখন তুমি তার মুখটাই দেখেছ।’

ছোঁয়ার কথা মনে পড়তেই অতল সাথে সাথে চোখ বন্ধ করল। গাঢ় কালো অন্ধকার। সেই অন্ধকার ভেদ করে পূর্বের সেই চেহারা ক্রমশই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। সেই মুখাবয়বের দর্শনমাত্র অতল ঝট করে চোখ খুলে ফেলল। তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে। হৃদপিন্ড যেন অস্বাভাবিক গতিতে দৌড়াচ্ছে। সাথে মস্তিষ্কের নিউরনগুলোও ভাবনাতে মশগুল হলো নিবিষ্ট চিত্তে।

বারবার; অনেকবার ভেবেও অতল কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না এটা কীভাবে সম্ভব! অতল আবারও চোখ বন্ধ করল। বন্ধ চোখের পাতায় এবারও প্রথমেই ভেসে উঠল তার চিরচেনা সেই মুখটা। এক এক করে অতলের মনে পড়ছে বিগত দশ বছরে অতল একটিবারের জন্যেও বহ্নির কথা ভুলেনি। প্রতিদিন তার কথা মনে পড়েছে। যখনই কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে তার জীবনে তখনই মনে হয়েছিল বহ্নির সাথে বিষয়টা শেয়ার করতে পারলে তার কষ্টটা কমে যেত। কিন্তু শিহরণের প্রতি জমানো অভিমানের কারণে তা কখনোই হয়ে উঠেনি। এখন তার কাছে স্পষ্ট বহ্নি তার ভরসার স্থল, নির্ভরতার এক অনন্য উৎস। কিন্তু ভালোবাসা কী করে সম্ভব! সে বহ্নিকে কী করে ভালোবাসতে পারে। কিন্তু এটা হয়ে গেছে। এবার কী করবে সে? সামান্য ভুল বোঝাবুঝির কারণেই তো শিহরণ আর তার বন্ধুত্ব ভেঙ্গে গিয়েছিল। এখন আবার যদি এমন হয় তাহলে সে তো আবারও সম্পূর্ণ একা হয়ে যাবে।

অতলের হাঁসফাঁস লাগছে। ভালো যখন বাসলোই তার অবাধ্য বেয়াড়া মনটা তা ভালোবাসার জন্য আর কাউকে পেল না। বন্ধুর বোনের প্রেমেই পড়তে হলো। এটা ভাবতেই নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিচ্ছে।

এবার তার ছোঁয়ার বলা শেষ কথাটা মনে পড়ল, ‘শী লাভস্ ইউ মোর দ্যান এনিথিং।’

তার মানে বহ্নিও তাকে! উফ্! অতল আর ভাবতেই পারছে না। সম্পর্কগুলো এত জটিল কেন? কেন এত অসহ্য লাগছে তার সবকিছু। অতলের এবার এক এক করে সবকিছু মনে হতে থাকল। আয়মানও এই কথাটা ওকে বলেছে। কিন্তু সে বিশ্বাস করেনি। এবার সম্পূর্ণ বিষয়টা অতলের কাছে পরিস্কার। কিন্তু শিহরণ কি এই বিষয়টা মেনে নিবে? অতল ভাবল অনেকক্ষণ। সমস্ত ভাবনা চিন্তার পরে সে ভাবল সে এবার কোনোভাবেই তার ভালোবাসাকে হারিয়ে যেতে দেবে না। কোনোভাবেই না। এই বিষয়টা একজনকে জানানো খুব জরুরি বলে মনে করল সে। সাথে সাথে তার নাম্বারটা ডায়াল করল। ওপাশের মানুষটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অতল বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছিলে।’

সাথে সাথেই কলটা কেটে দিল সে। এবার তার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করা দরকার। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল অতল। বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। তারপর বেরিয়ে পড়ল। মেহেরুন নাহার পেছন থেকে ডাকলেও সে জরুরি কাজের কথা বলে বেরিয়ে গেল।

চারিদিকে স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। অতল উদাস চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। পাশে বসে আছে বহ্নি। তার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। আধাঘন্টা যাবৎ নদীর কোল ঘেসে এ ছায়াশীতল জায়গাটাতে বসে আছে তারা। এই আধাঘন্টার মধ্যে অতল একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। বহ্নি কয়েকবার প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পায়নি। তাই শেষমেশ সে নিজেও হাল ছেড়ে দিয়ে অতলের পাশে বসে ছিল। বারকয়েক চোরা চোখে তাকাল অতলের দিকে। অতল এখনও নির্বিকার। কী ভাবছে তা বোঝার উপায় নেই। অবশেষে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল বহ্নির। হঠাৎ অতলের চোখে চোখ পড়তে তার মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল। অতলের চোখ দুটো কেমন যেন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। বহ্নির ভয় হতে লাগল। সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত গলায় প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে তোমার?’

অতল এবার সরাসরি চোখ তুলে চাইল বহ্নির দিকে। এই দৃষ্টি বহ্নির অচেনা। তার কেমন যেন অদ্ভুত লাগল । সে ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বলল, ‘এমনভাবে কী দেখছ?’

‘তোকে।’ অতলের অকপট স্বীকারোক্তি।

অতলের এমন কথায় বহ্নি হেসে ফেলল। খানিকটা কৌতুক মেশানো গলায় প্রশ্ন করল, ‘আমাকে কি আজ প্রথম দেখছ?’

‘আচ্ছা, তোর কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে?’

‘বয়ফ্রেন্ড?’ বহ্নি চমকে উঠল, ‘হঠাৎ বয়ফ্রেন্ডের কথা কেন আসছে?’

‘রাফিকে বলতে শুনলাম সে নাকি তোকেই বিয়ে করবে। তাই জানতে চাইছি।’ অতল দিকভ্রান্ত হয়ে এলোমেলো প্রশ্ন করতে শুরু করল।

বহ্নির চোখ জ্বলে উঠল। বসা থেকে দুম করে উঠে পড়ে বলল, ‘ওই বেয়াদপ ছেলেটার নাম না নিলেই কি হতো না।’

‘তাহলে তুই কি তূর্ণকে ভালোবাসিস?’ এবারও অতল অপ্রাসঙ্গিক কথায় মত্ত হলো।

‘তূর্ণ?’ বহ্নি চিৎকার করে বলে উঠল, ‘ও শুধুই আমার বন্ধু। এর বেশি কিছু না।’

‘তাহলে তুই কি আমাকে ভালোবাসিস?’

‘হ্যাঁ!’ বহ্নি ভীষণভাবে চমকে তাকাল অতলের দিকে। তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘না, মানে কী বলছ এসব?’

‘হ্যাঁ না-কি না?’ অতল ভ্রু কুঁচকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল বহ্নির দিকে। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘সত্যিটা বলবি।’

বহ্নি সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেলল। তার ঠোঁট কাঁপছে। বুকের মধ্যে অদ্ভুত শিহরণ জেগে উঠল মুহূর্তেই। অতল বহ্নির হাত ধরে তাকে তার পাশে বসাল। একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে তাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘প্লিজ, আগুনমণি। আমি না খুব হাঁপিয়ে উঠেছি। আর পারছি না। সত্যিটা জানা আমার জন্য খুব দরকার।’

বহ্নি উপর নিচে মাথা দুলাল। বলল, ‘এটা তুমি কেন বুঝতে পারোনি?’

‘ভালোবাসা হচ্ছে পৃথিবীর সবচাইতে জটিল বিষয় এই বিষয়টা বুঝে নেবার আগে জেনে নেওয়াটা অধিক জরুরি।’ বিজ্ঞের মতো করে বলল, অতল।

‘তাহলে বলো তুমি কাকে ভালোবাস?’

ঠিক তখনই অতলের মোবাইলটা বেজে উঠল। মোবাইল হাতে নিতেই তৃণার নাম্বারটা দেখতে পেল অতল। অতল কলটা কেটে দিল। পরক্ষণেই আবার কল আসলো। এবার অতল মোবাইলটাই সুইচড অফ করে দিল। বহ্নি প্রশ্ন করল, ‘কে কল করেছে?’

‘বাদ দে ওসব। জরুরী কল না।’

‘তোমার গার্লফ্রেন্ড নয় তো?’

অতল বলল, ‘আজ থেকে আমার এক জনই গার্লফ্রেন্ড আর সে আমার সামনে বসে আছে। তাকে ছাড়া আর কারো অস্তিত্ব নেই এখন থেকে আমার জীবনে।’

‘কথাগুলো মনে না রাখলে কিন্তু তোমার খবর আছে।’ গম্ভীর গলায় সতর্ক করতে চাইল বহ্নি।

‘মারবি না-কি?’ খানিকটা কৌতুকের ছলে বলল অতল।

‘প্রয়োজন হলে তাই করব।’ স্মিত হাসল বহ্নি।

‘বাব্বাহ! তাহলে তো বোধহয় আমি ভুল করলাম।’

‘ভুল যখন করেছ তখন ভুলের মাশুল তো দিতেই হবে।’

পরক্ষণেই অতল খুব সিরিয়াস হয়ে বহ্নির দিকে ঘুরে বসে তাকে প্রশ্ন করল, ‘শিহরণ কীভাবে নিবে ব্যাপারটা?’

‘ওসব নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। আমি সব সামলে নিব।’ বহ্নি অতলকে আশ্বাস দিল।

‘সামলে তো নিতেই হবে। আমি কিন্তু কখনোই তোর পিছু ছাড়ব না। মরে গেলেও ছাড়ব না। কথাটা যেন মনে থাকে।’

বহ্নি অতলের কথা শুনে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘মরার কথা আর একবার বলেছ তো তোমার সাথে আমি আর কখনও কথাই বলব না।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আর কখনও বলব না। কিন্তু যদি কখনও আমি না থাকি তবে কি তুই আমাকে ভুলে যাবি?’ কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইল অতল।

‘ভুলে যাবার জন্য দশটা বছর কি পর্যাপ্ত ছিল না?’

অতল বলল, ‘তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। ভুলে যাসনি। তুই ভুলবিও না। আচ্ছা, যদি আমি তোকে ভুলে যাই তো?’

বহ্নি জহুরি চোখে তাকাল অতলের দিকে। যেন দৃষ্টি দিয়ে অতলের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছে। পরক্ষণেই সহাস্যে বলল, ‘তোমাকে আমি ভুলতে দিলে তো ভুলবে।’

বিকেলের আলোটা মরে এসেছে। সন্ধ্যা নেমে আসছে ধরণীর বুকে। পশ্চিম দিগন্তে লাল রক্তিম আলোর ছটা একসময় আকাশের বুকে মিলিয়ে গিয়ে ঝুপ করেই নেমে পড়বে রাতের অন্ধকার। পাখির ঝাঁক একসাথে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে নীড়ে ফেরার তাড়া করছে। বহ্নি আর অতল দুজনেই হাতে হাত রেখে সেই পার্থিব মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের মাঝে নিজেদের হারাল। এক অপার্থিব আনন্দে ভরে গেছে বহ্নির মন।
____________________

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে রাদিদ। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। মনের মধ্যে এক সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করছে। কিছুটা আফসোসও হচ্ছে বৈ কি! কেন যে সে নিজের শহর ছেড়ে এই শহরে এলো সেই চিন্তাটাই মনের মধ্যে বারবার ঝড় তুলছে। বহ্নি অতলকে ভালোবাসে এই কথাটা তার অজানা ছিল না। কিন্তু তারপরেও মেয়েটাকে দেখলে তার মনে জমিয়ে রাখা ভালোবাসার অনুভূতিগুলো আবারও দুর্বার গতিতে জেগে উঠে, পূর্ণতা পাবার আকাঙ্ক্ষায়। সবচাইতে কষ্টের ছিল দশ বছর পরে আবারও অতলের সাথে বহ্নিকে আলিঙ্গনরত অবস্থায় দেখাটা। কী ভীষণ কষ্ট হয়েছিল রাদিদের তা কেবল সেই জানে!

‘আমি হেরে গেলাম বাজিতে। তোমার কথাই ঠিক হলো শেষমেশ।’

নীরার বিষণ্ণ কণ্ঠ শুনে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল রাদিদের। ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে নীরা। অপরাধবোধ তার চোখে স্পষ্ট দৃশ্যমান।

রাদিদ হাসল। নিষ্প্রাণ সেই হাসি। শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘এখানে হেরে যাবার মতো কিছু হয়নি। সত্যটা কেবল দেখেছিস।’ রাদিদ প্রাণবন্ত হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, ‘এখন তো আর আমাকে এই বিষয়টা নিয়ে খোঁচাতে পারবি না। এটাই ঢের বেশি।’

‘তোমার কষ্ট হচ্ছে না?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল নীরা।

‘কষ্ট হবে কেন পাগলি বোন আমার?’ রাদিদের পাল্টা প্রশ্ন ।

‘আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল বলল, নীরা।

‘তুই ভুল জানিস। ভালোবাসলেই পূর্ণতা পেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমি চাই বহ্নি ভালো থাকুক সেটা যেকোনো মূল্যেই হোক না কেন। আমার বিশ্বাস অতল ওকে ভালো রাখবে।’ হিমশীতল গলায় বলল, রাদিদ।

‘আর তোমার ভালো থাকার কি হবে?’

‘আমি তো কখনোই খারাপ ছিলাম না।’

‘মিথ্যা বলছ কেন?’

‘সত্যি বলছি।’

রাদিদ আবারও অন্তরীক্ষে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। মেঘলা আকাশ। ঘন কালো মেঘের ভেলা উড়ে যাচ্ছে আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। সেই ঘন কালো মেঘ মন খারাপের চাদরে বারবার আলোকিত পূর্ণ চাঁদটাকে ঢেকে ফেলছে। কিন্তু পরক্ষণেই চাঁদটা আবারও মেঘের চাদর ভেদ করে উঁকি দিয়ে তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।

ঘন কালো মেঘগুলোর ছুটোছুটি দেখে রাদিদের মনে হলো আজ তার মনের মতো আকাশেরও ভীষণ মন খারাপ। মনে হচ্ছে এখনি কেঁদে ফেলবে আর সেই কষ্টগুলো টুপটুপ করে বৃষ্টির ফোঁটার আকারে ঝরে পড়বে আকাশের বুক থেকে। শীতল বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে রাদিদের শরীরটা। কিন্তু মনটা ভীষণ আনচান করছে; ভীষণ যত্নে মনের মধ্যে পুষে রাখা ভালোবাসা না পাবার কারণে। অথচ সেই ভালোবাসা পাবার আশা সে কখনোই করেনি। তবুও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কেন হচ্ছে এমন? রাদিদের জানা নেই।

নীরা চুপচাপ বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল রাদিদের পাশে। তার ইচ্ছে ছিল অনেককিছু বলার। কিন্তু কিছুই বলতে পারল না। তার কি-ই-বা বলার আছে। তাই নিশ্চুপ প্রস্থান করাটাই ভালো মনে করল।

মোবাইল বেজে উঠাতে রাদিদের ধ্যান ভাঙল। কল রিসিভ করতেই মায়ের উদ্বিগ্নতা আর ভালোবাসায় ভরা কণ্ঠে রাদিদের বিষণ্ন মনটা কিছুটা শান্ত হলো। মায়ের সাথে কথা বলার পরে রাদিদের মনের সমস্ত বিক্ষিপ্ত অনুভূতি কোনো এক অদৃশ্য কেন্দ্রবিন্দুতে মিলিত হলো। তার কষ্টগুলো যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মা হয়তো এমনই প্রশান্তি প্রদানকারী এক শক্তির নাম। আর পরিবার হলো প্রতিটা মানুষের জন্য এক অন্যতম শক্তিশালী রক্ষাকবচ তুল্য এক অনন্য বন্ধনের নাম।

_________________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে