ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৩৮+৩৯+৪০

0
1606

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩৮

বহ্নি, তূর্ণ, সায়মা আর রিয়া আশ্রমের গেটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কোনো একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিল। আলোচনা শেষে বহ্নি তার বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এই তোরা কি ভেতরে যাবি না-কি বাইরেই থাকবি?’

তূর্ণ, সায়মা আর রিয়া বাইরেই থাকবে বলার কারণে বহ্নি আশ্রমের ভেতরের দিকে পা বাড়ায়। বহ্নি যখন একা একা ভেতরে ঢুকছিল। ঠিক তখন আরাভ গেটের ভেতর ঢুকলো। বহ্নিকে দেখেই ‘পুতুল’ বলে চিৎকার করতে করতে দিল ভোঁ দৌড়। বহ্নির কাছাকাছি এসে দু’হাঁটুর উপরে দুহাত রেখে দম নিল। তারপর বলল, ‘পুতুল! আমি যে তোমাকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছ না?’

বহ্নি আরাভের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল। অপরাধীর সুরে বলল, ‘বিগ ব্রো! স্যরি। একদম শুনতে পাইনি। শুনলে কি আর আমার বিগ ব্রোকে অবহেলা করতে পারতাম?’

‘ঠিক আছে। এবারের মতো মাফ করলাম।’ আরাভ
মাফ করার ভঙ্গিতে ডান হাতটা উপরে তুলে বলল, ‘পুতুল! তোমার সাথে আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।’

‘বাব্বাহ! খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা! বহ্নি অবাক হবার ভান করে বলল, ‘তাহলে ভেতরে বসে কথা বলি?’

‘না। ভেতরে বলা যাবে না। ওখানে আমার প্রতিপক্ষ আছে।’ ভীষণ জরুরী গলায় বলল, আরাভ।

‘তোমার আবার প্রতিপক্ষও আছে না-কি?’ বহ্নি চূড়ান্ত অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।

‘প্রতিপক্ষ কে সেটা জানতে পারলে আরও বেশি অবাক হবে।’ আরাভ দুঃখী গলায় টেনে টেনে বলল।

‘তাই না-কি?’ বহ্নি ভীষণ অবাক হবার ভান করে বলল, ‘কী সাংঘাতিক ব্যাপার! তা কে সে?’

‘কে আবার?’ রাজ্যের অনীহা কণ্ঠে ঢেলে বলল আরাভ, ‘শিহরণ ভাইয়া। ভাইয়াকে সাবধান করে দিও। আমি কিন্তু ভাইয়া কী করছে না করছে সব জানি।’

বহ্নি বিস্ময়াভূত হয়ে বলল, ‘শিহরণ ভাইয়া তোমার প্রতিপক্ষ!’ বহ্নি হাঁটা থামিয়ে আরাভের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘তো কী করেছে শিহরণ ভাইয়া?’

‘পুতুল! আই থিংক তুমিও জানো। তাও বলছি। শিহরণ ভাইয়া ইদানিং আমার রোজের পেছনে ঘুরঘুর করছে। যেটা আমি কোনোভাবেই মানতে পারছি না।’
মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, আরাভ।

‘ওকে, বিগ ব্রো। আমি মনে হয় ব্যাপারটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি। আচ্ছা তোমার রোজ কি ছোঁয়া আপু?’

আরাভ মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ল। তারপর বলল, ‘ইয়েস, শী ইজ মাই লাভলি রোজ।’

বহ্নি অবিচলিত কণ্ঠে বলল, ‘এবার বুঝতে পারলাম। কিন্তু তুমিই তো তাকে সাবধান করে দিতে পারো। আমার প্রয়োজন কেন হচ্ছে?’

‘সাবধান তো করেছি।’ আরাভ তার চেহারায় দুঃখী ভাব এনে ভীষণ হতাশ গলায় বলল, ‘কিন্তু আমার কথা শুনলে তো।’

‘আচ্ছা, আমি আল্টিমেটাম দিয়ে দিব।’

‘কড়াভাবে দিবে কিন্তু।’

বহ্নি আরাভের হাত ধরে বলল, ‘এবার ভেতরে চলো। আন্টি বকবে না একা একা চলে এসেছ যে?’

‘বলে এসেছি তো।’

‘তোমার তো বিকেলে আসার কথা। সকালে আসলে কেন?’

‘আমার রোজকে দেখতে।’

‘বাব্বাহ! এতটাই দেখতে মন চাইছিল তোমার?’

‘হুম। দেখতে তো সবসময় ইচ্ছে করে। আমার রোজ কী যে কিউট! তুমি তো দেখোনি। তোমারও খুব পছন্দ হবে। আমি নিশ্চিত।’

‘কে বলেছে আমি দেখিনি। আমি দেখেছি তো। আমার ভাবিকে আমি দেখব না তো কে দেখবে?’

‘ভাবি মানে?’ আরাভ কোমরে দু’হাত রেখে বহ্নির দিকে চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘তার মানে তুমি কি কোনোভাবে শিহরণ ভাইয়ের পক্ষ নিচ্ছ?’

‘আরে না। আমি তো সব সময় তোমার পক্ষে।’

‘তাহলে ভাবি বলছ কেন?’

‘তুমি আমার বিগ ব্রো। তুমিই তো বলেছিলে তোমার রোজকে বিয়ে করবে। তাহলে আমার ভাবি হলো না?’

‘আচ্ছা, এবার বুঝেছি।’ আরাভ মিষ্টি হাসল।

ছোঁয়া বাচ্চাদের কস্টিউম রেডি করে দিচ্ছিল। আরাভ আর বহ্নি তার পাশে এসে বসল। আরাভকে দেখে ছোঁয়া বলল, ‘কেমন আছ বাবু?’

আরাভ মুখ গোমড়া করে বলল, ‘আমি কোনো বাবু নই। প্লিজ ডোন্ট কল মি দ্যাট।’

বহ্নি কৌতুক মেশানো গলায় বলল, ‘ছোঁয়া আপু! নিজের হবু বরকে কেউ বাবু ডাকে?’

‘ওকে, স্যরি আরাভ।’ ছোঁয়া মুখটা কাঁচুমাচু করে অপরাধীর গলায় বলল।

‘নেক্সট টাইম যেন এমন না হয়।’ আরাভ সতর্ক গলায় বলল।

ছোঁয়া আর বহ্নি দুজন মিলে আশ্রমের বাচ্চাদের কস্টিউম ঠিক করে দিল। আশ্রমের বাচ্চারা মিলে একটা নাটক মঞ্চায়ন করবে বলে সকলের মধ্যে চাপা আনন্দ বিরাজ করছে।

ছোঁয়াকে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে দেখে বহ্নি মৃদু হাসল। তার ভাইয়ের পছন্দ নিয়ে তার কখনোই কোনো সন্দেহ ছিল না। ছোঁয়াকে দেখে এই বিষয়ে সে আরও বেশি নিশ্চিত হলো। ছোঁয়া বহ্নিকে মুচকি হাসতে দেখে বলল, ‘বহ্নি! তোমার হাসি খুব মিষ্টি ।’

ছোঁয়ার কথা শুনে বহ্নি প্রশস্ত হাসল। বলল, ‘হুম, তবে তোমার হাসির চাইতে কম মিষ্টি। কী ঠিক বললাম তো, বিগ ব্রো?’

আরাভ বহ্নির সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘আ’ম এগ্রি উয়িথ ইউ।’ তারপর বহ্নির কানে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘অ্যান্ড শী ইজ মাইন। আই উইল ম্যারি হার ওয়ান ডে।’

বহ্নি আরাভের কথা শুনে নিজের হাসি আটকাতে পারল না। আরাভ চোখ রাঙিয়ে তাকাল বহ্নির দিকে। বহ্নি হাসি আটকালো বহু কষ্টে। বলল, ‘স্যরি, ব্রো।’ এবার বহ্নিও আরাভের কানে নিজের মুখটা এনে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কিন্তু বিগ ব্রো! আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার রোজকে তুমি বিয়ে করার আগেই অন্য কেউ উঠিয়ে নিয়ে যাবে।’

আরাভ এবার গাল ফুলিয়ে বলল, ‘ইউ আর নট আ গুড ফ্রেন্ড এট অল।’

‘ওকে, স্যরি।’ বহ্নি আবারও বলল, ‘কিন্তু তুমি তো ছোঁয়া আপুর চাইতে অনেক ছোটো। তুমি বড়ো হতে হতে তার তো বিয়ে হয়ে যাবে।’

‘আমি একদমই ছোটো নয়।’ চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি এনে আরাভ বলল, ‘শুধু আম্মুই আমাকে বাবু বাবু বলে ডাকে।’ আরাভ এবার কোমরে হাতে রেখে বলল, ‘আচ্ছা, পুতুল! তুমি বলো তো আমি কি বাবু? আমি তো বড়ো হয়েছি। তাই না?’

বহ্নি ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বলল, ‘একদম। তুমি তো বড়ো বাবু।’

‘তুমিও আমাকে বাবু বলছ?’ চোখ বড়ো বড়ো করে ভ্রু উঁচিয়ে সাবধানী গলায় বলল, ‘আর একবার বাবু বলে ডাকলে তোমার সাথে আমার বন্ধুত্ব কিন্তু শেষ হয়ে যাবে!’

‘ওকে, স্যরি ব্রো।’ বহ্নি নিজের কান ধরে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি করে বলল।

ছোঁয়া ওদের মধ্যেকার ফিসফিসানি শুনে বলল, ‘এত গোপন কথা কিসের? আমাকেও বলো। আমিও শুনি এত কীসের গোপন কথা চলছে তোমাদের মধ্যে।’

বহ্নি হেসে বলল, ‘আমার বিগ ব্রো বলছে যে তোমাকে আজ প্রিন্সেসের মতো লাগছে।’

‘তাই?’ ছোঁয়া আরাভের দিকে জিজ্ঞাসু চাউনিতে জানতে চাইল, ‘তোমার ফ্রেন্ড সত্যি বলছে?’

শিহরণ আচমকা এসে বলল, ‘একদম না। আজ তোমাকে রানীর মতো লাগছে। কার রানী সেটা নিশ্চয়ই বলার প্রয়োজন নেই?’

আরাভ উঠে শিহরণের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কার আবার? আমার।’

‘উঁহু! একদম না।’ শিহরণ আরাভের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল, ‘এখানে রাজা এক জনই আছে। আর রানী কেবল রাজাদেরই থাকে। আর বাবুদের তো খেলতে খেলতেই দিন কাটে।’

আরাভ গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে ছোঁয়া বলল, ‘আমি কিন্ত জানি আমার রাজা কেবল এবং কেবল কেবলই আরাভ।’

ছোঁয়ার কথাতে আরাভের মুখে হাসি ফুটল। সাথে সাথে সবাই সমস্বরে হেসে উঠল।
___________________________________

চারিদিক চাকচিক্যময়। আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে পুরো প্রাঙ্গণ। স্টেজে আশ্রমের কয়েকজন বাচ্চা মিলে কোরাস গাইছে। শিহরণ, মোহনা আর ফাহমির সাথে কথা বলছে আশ্রমের পেছনে দাঁড়িয়ে। প্রিয় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কথাই বলছে না। শিহরণ ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলল, ‘এখন নিশ্চয়ই খুব ভালো আছিস?’

প্রিয় আচমকা মুখ তুলে তাকাল শিহরণের দিকে। পরক্ষণেই চোখ নিচে নামিয়ে ফেলল। তার চোখ ভিজে এলো হুট করেই। ফাহমি শিহরণের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আজকের জন্য বাদ দে না ওসব।’

প্রিয় কী বলবে বুঝতে পারছে না! তার নিজেকে অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত মনে হচ্ছে এই অনুষ্ঠানে। তার পার্সে রাখা চিঠি কীভাবে শিহরণকে দিবে তা সে কোনোভাবেই বুঝতে পারছে না। কোনোরকমে বলল, ‘আ’ম রিয়েলি স্যরি, দোস্ত।’

শিহরণ হেসে উড়িয়ে দিল। বিদ্রূপাত্মক হেসে বলল, ‘তোর এই স্যরি বলাতে কী সব ঠিক হয়ে যাবে?’

প্রিয় কোনোকিছু না ভেবেই শিহরণের জন্য লেখা চিঠিটা তার হাতে ধরিয়ে দিল। বলল, ‘প্লিজ, এই চিঠিটা পড়। তারপর যা খুশি তাই বলিস আমাকে। যা খুশি তাই শাস্তি দিস।’

শিহরণ চিঠিটা না পড়েই ছিঁড়ে ফেলতে গেলে মোহনা বাধা দিল। বলল, ‘পড়ার পরে ছিঁড়ে ফেলিস কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এখন এটা তোকে আজ পড়তেই হবে।’

একান্ত বাধ্য হয়ে শিহরণ চিঠিটা পড়ল। চিঠিটা পড়া শেষ হতেই শিহরণ যে গাছের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল আচমকা নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে গাছটাতে ঘুসি বসিয়ে ক্রোধান্বিত হয়ে বলল, ‘তোর আজকের এই সত্য স্বীকারোক্তি কি আমাদের কৈশোরের সেই বিষাদময় দিনগুলি পরিবর্তন করতে পারবে? অতল আর আমার মধ্যের সম্পর্ক কী ঠিক হয়ে যাবে?’

শিহরণের এমন মারমুখো আচরণে ভয়ে গুটিয়ে গেল প্রিয়। থুতনিটা একদম বুকের কাছে লাগিয়ে ফেলল। মোহনা বলল, ‘মাফ করে দে না দোস্ত। সব ভুলে আমরা আবার এক হয়ে যাই।’

বহ্নি বলল, ‘মোহনা আপু ঠিক বলছে ভাইয়া। ভুলে যাও সব। আবার নতুন করে শুরু করো সবকিছু।’

হঠাৎ তার সেলফোনটা বেজে উঠল। মোবাইলের স্ক্রিনে থাকা নামটা দেখে সে বলল, ‘আমি আসছি। তোমরা এখানে অপেক্ষা করো।’

বহ্নিকে এগিয়ে আসতে দেখে অতল মুচকি হাসল। কাছে আসতেই বহ্নি অতলকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তুমি আসাতে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। আজকে তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।’

অতল ডান হাতের তর্জনী দিয়ে চশমাটা ঠিক করে বলল, ‘কী সারপ্রাইজ?’

বহ্নি হেসে বলল, ‘এখন বলে দিলে কি আর সেটা সারপ্রাইজ থাকবে?’

অতল খেয়াল করল ছোট্ট বহ্নি আজ অনেক বড়ো হয়ে গেছে। এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো তাকে শাড়ি পরা দেখল সে। হাত ভর্তি নীল রঙের কাচের চুড়ি আর নীল রঙা শাড়িতে তাকে নীল পরীর মতো লাগছে। অতল বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল বহ্নির দিকে। তারপর আচমকা বলেই ফেলল, ‘আগুনমণি! এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো তোকে শাড়ি পরা দেখছি।’

অতলের মুখে হঠাৎ সেই ছোট্টবেলার ডাকটা শুনে বহ্নি স্তব্ধ হয়ে গেল। চশমার আড়ালে থাকা ওই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল নির্বিকার ও অনুভূতি শুন্য হয়ে ।

‘খুব সুন্দর লাগছে তোকে।’ অতলের চেহারা ভাবলেশহীন কিন্তু কণ্ঠে মুগ্ধতা।

অতলের মুখ থেকে নিজের প্রশংসা শুনে বহ্নি কিছুটা লজ্জা পেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ।’

আয়মান দাঁড়িয়ে থেকে দুজনকে পর্যবেক্ষণ করছে। সে মনে মনে একটা কিছু আশঙ্কা করছে। তবে সেটা কতটুকু ঠিক তা জানার জন্য তাকে কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে তা সে বেশ বুঝতে পারছে।

নিস্তব্ধতা কাটিয়ে বহ্নি বলল, ‘আমার সাথে আসো।’

অতলকে দেখে বহ্নি মনে মনে অনেক বেশি খুশি হয়েছে। তার কথা রেখেছে ভাবতেই তার মনের মধ্যে একরাশ সুখানুভূতি হলো। বহ্নির সাথে অতলকে দেখতেই অন্য বন্ধুরা স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকল।

শিহরণের দিকে চোখ পড়তেই অতল থমকে দাঁড়াল। আয়মান তার হাত ধরে টেনে বলল, ‘কী রে! থেমে গেলি কেন? চল।’

অতল নড়ছে না। স্তম্ভিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে ঝাঁকড়া চুল আর সবুজাভ চোখের অধিকারী ছেলেটার দিকে। শিহরণও নিষ্পলক তাকিয়ে আছে চশমা পরা ছেলেটার দিকে। তার ভাবনায় এলো বহ্নির বলা কথাগুলো। আর একটু আগে প্রিয়র দেওয়া চিঠি পড়ে তার যেইটুকু অভিযোগ ছিল সেটুকুও নেই। কিন্তু অতল! অতল কি তাকে মাফ করবে?

শিহরণ বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে গেল অতলের দিকে। অতলের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘চশমা পরা শুরু করেছিস কবে থেকে?’

অতল নির্বিকার। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো শিহরণের দিক থেকে। শিহরণ ওর কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘ওইদিকে কি দেখছিস? আমার দিকে তাকা।’

অতল সরে যেতে চাইলে শিহরণ ওকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘ভাই বলেছিলি কিন্তু মন থেকে মানিসনি। এই জন্যেই তো পর করে দিয়েছিস। তাই না?’

মোহনা, ফাহমি, প্রিয়, বহ্নি, আয়মান চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে দুই বন্ধুর মান অভিমানের দৃশ্য। সকলেই মনে মনে প্রার্থনা করছে এবার যেন এতদিন ধরে জমিয়ে রাখা অভিমানের বরফটা গলে যায়।

অতলকে কিছু বলতে না দেখে শিহরণ পুনরায় বলল, ‘
এতদিন পরেও রাগ ভাঙেনি? এত্ত অভিমান তো আগে ছিল না তোর? সামান্য কারণেই আমাদের সবার কাছ থেকে দূরে সরে গেলি?’

অতল এবার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল শিহরণকে। উল্টো ঘুরে দ্রুত পায়ে হাঁটা দিল। পেছন থেকে বহ্নি ডাকলেও সেই ডাকে সে সাড়া দিল না।

অতল এভাবে চলে যাওয়ায় শিহরণ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। দু’হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে বিড়বিড় করে ব্যথাতুর কণ্ঠে আওড়াতে লাগল, ‘ও আমাকে আজও ক্ষমা করেনি। ওর অভিমান হয়তো কখনোই ভাঙবে না!’

মোহনা আর ফাহমি এসে তাকে সান্ত্বনা দিতে থাকল। প্রিয় ভয়ে গুটিশুটি মেরে এক পাশে দাঁড়িয়ে রইল। আয়মান ছুটল অতলের পেছনে। বহ্নিও পেছন পেছন গেল।
__________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩৯

রদিদ দুপুরে ঘুমিয়েছিল। নীরা বেশ কয়েকবার এসে দেখে গেল রাদিদ ঘুম থেকে উঠেছে কি না। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসতেই নীরার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। সে রাদিদের কাছে গিয়ে তার কানের কাছে এসে বিকট একটা চিৎকার দিল। রাদিদ ধরফড়িয়ে উঠল। বেশ কিছুক্ষণ কী হলো তা বুঝতেই পারেনি! হতভম্ব হয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে বারবার। কিছুটা ধাতস্থ হতেই নীরাকে দেখতে পেল। নীরা তখন রাদিদের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে রাজ্যের বিরক্তি মুখের উপর এনে তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল।

রাদিদকে এদিক সেদিক তাকাতে দেখে নীরা বলল, ‘তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ো। তোমাকে তো আমার সাথে একটা জায়গায় যেতে বলছিলাম। অথচ তুমি কুম্ভকর্ণের ঘুম দিচ্ছ। এবার এক লাফ দিয়ে উঠো আর ঝটপট রেডি হও।’

হুট করেই রাদিদ ইয়া বড়ো বড়ো চোখ করে নীরার দিকে তাকাল। যেন চোখ দিয়েই নীরাকে শেষ করে ফেলবে! নীরার এই কাণ্ডে রাদিদের মাথাটা প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেল। প্রচণ্ড চিৎকার দিয়ে নীরার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘বান্দর মেয়ে! এভাবে কী কেউ কাউকে ঘুম থেকে তুলে?’

তার পর মুহূর্তেই রাদিদ ধরমড় করে বিছানা থেকে নেমে পড়ল মারমুখো হয়ে। নীরা বুঝতে পেরে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না; দিল ছুট। রাদিদও পেছন পেছন ছুটতে লাগল। নীরা পুরো ঘরময় দৌড়াতে থাকল; আর রাদিদ তার পিছু পিছু। একটা সময় নীরা
নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। রাদিদ
ধরাম ধরাম শব্দ করে দরজা ধাক্কাল। তারপর প্রচণ্ড রাগে নিজেকে সামলাতে না পেরে নওশীন হকের কাছে গিয়ে বলল, ‘ফুফু, আমি আর এখানে আসব না। নীরা বান্দর আজকে আমার কানের পর্দা ফাটিয়ে ফেলেছে।’ মুখে রাজ্যের অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘আমি আর কানে শুনতে পাব কি না জানি না।’

নওশীন হক উদ্বেগ নিয়ে বললেন, ‘সে কী! কানে শুনতে পাবি না কেন? কী হয়েছে? নীরা কী করেছে?’

রাদিদ জবাব দিল না। প্রচণ্ড ক্ষিপ্ততা তার চোখে-মুখে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। অবশেষে নিজের রাগকে বহুকষ্টে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের রুমে চলে এলো। নওশীন হক বুঝতে পারলেন রাদিদের রাগ করার কারণটা। তাই তাকে আর ঘাটালেন না।

রাদিদের রাগ কমে আসতেই নীরা তার মাকে ম্যানেজ করে ফেলল। অবশ্য কিছুটা বকা শুনতে হয়েছে বৈ কি। কিন্তু তাতে কী! তার তো অভ্যাস হয়ে গেছে।

নীরা আর রাদিদের এমন কাণ্ড দেখে আফরিন মহাবিরক্ত। নিজের ভেতরে এক চাপা কষ্টের উপস্থিতি টের পেল সে যা তার ভেতরে থেকে প্রচণ্ড এক চিৎকার দিয়ে ক্রমশ অগ্নিফুলকি স্বরূপ বেরিয়ে আসতে চাইছিল। তার পর মুহূর্তেই প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত গলায় সে বলল, ‘এত্ত নাটক এই ঘরে চলতে পারে। অথচ আমি কিছু করলেই সবার সমস্যা হয়ে যায়।’

নওশীন হক আফরিনকে ধমকে বললেন, ‘তুই চুপ থাক। ওরা কি প্রতিদিন তোর মতো কাণ্ড বাঁধায় না-কি? আর বাঁধালেও তোর মতো অবাধ্য না ওরা।’

আফরিন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ‘মা, তোমার জন্য তো আমিই সবসময় বেশি। আমি যাই করি না কেন সবকিছুতেই তোমার সমস্যা।’

এটুকু বলেই সে নিজের রুমে চলে গেল। নওশীন হক সোফায় বসে পড়লেন। তার মাথা ঘুরাচ্ছে। আফরিন কেন যে অল্পতেই এত গণ্ডগোল বাঁধায় তা তিনি বুঝতেই পারেন না। নিজেকে এই মুহূর্তে ভীষণ অসহায় লাগছে তার।
_______________________

নীরা আর রাদিদ যখন গেটের কাছাকাছি পৌঁছাল ঠিক তখন বহ্নির সাথে দেখা হয়ে গেল। বহ্নি আর অতলের পিছু পিছু যেতে পারল না। নীরা আর রাদিদকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল।

কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া অবাঞ্ছিত ঘটনার কথা ভুলে যাওয়াটা সহজ কিছু নয় তার জন্য। তারপরেও নিজেকে সহজ স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল, ‘রাদিদ ভাইয়া, তুমি আসাতে আমি খুব খুশি হয়েছি।’

রাদিদ তখন মোহগ্রস্ত। সামনে দন্ডায়মান তরুণীর দু’চোখে তার অবাধ্য চোখ জোড়া হারিয়ে গেল তার শত সহস্র নিষেধ অমান্য করেই। বহ্নির কথাতেই হুঁশ ফিরে আসতেই তার সেই মুগ্ধতার রেশ কেটে গেল। বাস্তবতার বেড়াজাল তাকে ঘিরে ধরল। আর ঠিক তখনই আজকের দিনে দ্বিতীয়বারের মতো করে নীরার উপর তার প্রচণ্ড রাগ হলো।

রাদিদকে চুপ থাকতে দেখে বহ্নি স্মিত হেসে প্রশ্ন করল, ‘কী ব্যাপার, রাদিদ ভাইয়া? তুমি কি এখন খুব কম কথা বলো?’ রাদিদের উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই বহ্নি আবারও বলল, ‘আমার একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিচ্ছ না। তোমার কি কোনো কারণে মন খারাপ?’

নীরা একগাল হেসে বলল, ‘আরে আপু ও কিছু না। রাদিদ ভাইয়া আমাকে মারতে না পেরে গাল ফুলিয়েছে।’ ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ‘ভাইয়াকে বলো গাল ফুলালে তাকে দেখতে একদম ভালো লাগে না। একদম পেঁচার মতো দেখায়।’

বহ্নি হেসে ফেলল নীরার কথায়। রাদিদ ত্যাড়ছা চোখে নীরার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এবার কিন্তু তুই খুব বাড়াবাড়ি করছিস নীরা। এর পর থেকে তোর সাথে আমি আর কোথাও যাব না।’

‘হুহ্! বললেই হলো না-কি? তুমি না তোমার ঘাড়সুদ্ধ যাবে।’ নীরা এটা বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসল।

বহ্নি বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার আসো আমার সাথে।’

হাঁটতে হাঁটতে বহ্নি রাদিদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাইয়ার সাথে তো এর আগে দেখা করোনি। আজকে তো দেখা করতেই হবে। শুধু ভাইয়া কেন আজ সবার সাথেই দেখা করবে। সবাইকে একসাথে দেখে তুমি আজ নিশ্চিত সারপ্রাইজড হবে।’

রাদিদ মনে মনে ভীষণ অশান্ত হয়ে গেল বহ্নির কথা শুনে। এতদিন পরে সবার সাথে দেখা হবে; বন্ধুরা একে অপরের মুখোমুখি হবে ভাবতেই বুকের ভেতর কেমন যেন একটা তোলপাড় শুরু হয়ে গেল।

রাদিদকে দেখেই শিহরণ জড়িয়ে ধরল দৃঢ় বন্ধনে কিন্তু রাদিদ ধরল না। সে প্রথমদিকে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেও পরমুহূর্তেই একদম স্বাভাবিক হয়ে গেল। রাদিদ অদ্ভুতভাবে আবিষ্কার করল তার মধ্যের জড়তা কেটে গেছে। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করল সে। সাথে সাথেই সে নিজেও শিহরণকে জড়িয়ে ধরল। দুই বন্ধুর চোখেই জলের আনাগোনা এলো একই সাথে; একই সময়ে।

শিহরণ বলল, ‘এবার দূরে সরে যাবার চিন্তা করলেই তোর নামে কেইস ফাইল করব।’

শিহরণের কথা শুনে রাদিদ হেসে ফেলল। সাথে হাসল তার চোখ দুটোও। শিহরণ তা দেখে বলল, ‘নাউ, ইটস লুকস লাইক মাই ব্রাদার রাদিদ।’

‘একদম ঠিক।’ মোহনা অভিযোগের সুরে বলল, ‘জানিস তো শিহরণ, এই রাদু কিন্তু পালাতে চাইছিল আমাকে আর ফাহমিকে দেখে। আমার ধারণা সে আমাদের সবার কাছ থেকেই পালিয়ে পালিয়ে থাকতে চেয়েছিল।’

ফাহমি মোহনার সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘কিন্তু প্লে বয় রাদিদ সেটা আর পারল না।’

রাদিদ মাথা নিচু করে ফেলল। কিছুটা লজ্জিত স্বরে বলল, ‘আমাকে আর না ঘাটালে কি হয় না?’ পর মুহূর্তেই নিজের দু’হাত উপরে তুলে আত্মসমর্পণ করার ভঙ্গিতে বলল, ‘আর পালাব না। এবার তো আমাকে পচানো বন্ধ করে দে।’

শিহরণ কৌতুক মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ‘ফাহমি একটা কথা কিন্তু তুই ভুল বলেছিস।’

ফাহমিসহ সবাই অত্যন্ত আগ্রহের সাথে তাকাল শিহরণের দিকে। সকলেই সমবেত অতি উৎসাহিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘কোন কথাটা?’

রাদিদের কাঁধে নিজের হাতটা রেখে শিহরণ বলল, ‘রাদিদ ইজ নট আ প্লে বয়। রাইট?’

সবাই উচ্চস্বরে বলে উঠল, ‘ইয়াহ্! হি ইজ সো নাইভ।’

রাদিদ এবার মিনমিনে কণ্ঠস্বরে বলল, ‘এরকম করলে কিন্তু আমি গেলাম।’ সাথে সাথেই পেছন ফিরে চলে যাবার উদ্দেশ্যে পা বাড়াল।

শিহরণ পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলল, ‘যেতে চাইলেই কি যেতে দেব আমরা? এই তোরা কি বলিস?’

‘না।’ সকলে পুনরায় সমস্বরে বলল, ‘উই ওয়ান্ট ব্যাক দ্যা চার্মিং রাদিদ।’

_______________________

অতল হাঁটুর উপর দু’হাত রেখে দু’হাতের তালু দিয়ে মুখটা ঢেকে রেখেছে। আয়মান তার পাশে বসে কাঁধে হাত রাখল। বলল, ‘ওভাবে চলে এলি কেন?’

অতল যেভাবে বসে ছিল সেভাবেই বসে রইল। একটুও নড়ল না। আয়মানও আর প্রশ্ন করল না। এভাবে কাটল অনেকটা ক্ষণ; নীরবে। দূরে কোথাও ঝিঁ ঝিঁ পোকার দল ডাকছে ব্যাকুল হয়ে; সেই সুর যেন ব্যথার বাহক।

আয়মান এবার প্রিয়র দেয়া চিঠিটা অতলের হাতের মুঠোয় পুরে দিল। বলল, ‘চিঠিটা পড়। তাহলেই তোর অভিমানের পাহাড়টা হয়তো এবার ভেঙে পড়বে।’

অতল মুখ তুলে চাইল। চিঠির ভাঁজ খুলে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলল। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে ঝরতে কবে যে গালটাই ভিজে গেল তা অতল টেরই পেল না।
চিঠি পড়া শেষে চিঠিটা দুমড়ে মুচড়ে মুষ্টিবদ্ধ করে হাতের মুঠোয় রেখে দিল অনেকক্ষণ। তারপর বসা থেকে উঠে পড়ল। আয়মান অতলকে দেখে কিছুটা ভয় পেল। অতলকে দেখতে উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে। যেন সবকিছু নিমিষেই ধ্বংস করে ফেলবে। চোখ দুটোও কেমন যেন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। খানিক বাদে ভূতগ্রস্তের মতো এদিক সেদিক পায়চারি করতে লাগল।

আয়মান উঠে দাঁড়াল। অতলের দু’বাহু শক্ত করে ধরে বলল, ‘এরকম করছিস কেন? তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? নিজেকে নিয়ন্ত্রণ কর। এরকম পাগলামো করিস না।’

অতল নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি নিয়ে এক ঝটকায় আয়মানের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে বলল, ‘প্রিয় এটা কেন করল? কেন?’

চিৎকার করেই মাটিতে বসে পড়ল। আবারও কণ্ঠের সেই আগের ক্রোধ বজায় রেখে বলল, ‘আমি প্রিয়কে কখনোই ক্ষমা করব না। কখনোই না।’

আয়মান অতলের পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরল। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। ক্ষমা করতে হবে না তোর। আগে নিজেকে ঠিক কর। তারপর অন্যকিছু ভাবা যাবে।’

অতল ব্যথাতুর কণ্ঠে পুনরায় আওড়াল, ‘কেন করেছে বল তো? প্রিয় এটা কেন করেছে?’

আয়মান অসহায় ভঙ্গিতে বসে রইল। তার কাছে কোনো শব্দ অবশিষ্ট নেই সান্ত্বনা দেবার, নেই কোনো আশ্বাসবাণী। অতল কতটা সেনসিটিভ তা সে জানে। আর সে কারণেই তার ভীষণ ভয় হয় অতলের জন্য।

আয়মান মনে মনে ভাবল, ‘পৃথিবীতে কিছু মানুষ অকারণে কষ্ট পায়। কিছু মানুষের মন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায় কোনো প্রকার অপরাধ না করেই। অতল তাদের মধ্যে একজন।’
_________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৪০

সবাই যখন রাদিদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল ঠিক তখন বহ্নি চুপিচুপি সেখান থেকে সরে পড়ল। অতলের সাথে কথা বলা খুব জরুরী তার জন্য। কী না করছে সেই চিন্তাতেই বহ্নির ভীষণ অস্থির লাগছে। আয়মান যদিও আছে, তবুও তার ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে অতলের জন্য।

শাড়ি পরাতে দ্রুত হাঁটতে পারছে না সে। এদিক সেদিক সবদিকে খুঁজেও অতলকে কোথাও দেখতে পেল না সে। পেছন ঘুরে চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই একটা চাপা আর্তনাদ কানে এলো। তখনই কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল অতলকে। আয়মানও পাশেই বসা ছিল। বহ্নি যেতেই আয়মান উঠে দাঁড়াল। বহ্নি অতলের পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘অতল ভাইয়া! এমন করে কাঁদছ কেন?’

অতল মুখ তুলে তাকাল। তার অশ্রুসিক্ত চোখ, কান্নাভেজা গাল আর এলোমেলো চুল বহ্নিকে মুহূর্তেই ভীষণ রকমের এলোমেলো করে দিল। অতলের জন্য তার ভীষণ খারাপ লাগতে শুরু করল। সান্ত্বনা দেবার ভাষাটুকুও সে হারিয়ে ফেলল। তার চোখদুটোও অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল। সে বলল, ‘এভাবে ভেঙে পড়ার মতো তো কিচ্ছু হয়নি।’

অতল নিরুত্তর। বহ্নি বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘এমন কিছু তো হয়নি যে তুমি বেঁচে থাকাটাই ভুলে যাবে। তুমি তো এমন ছিলে না! আমি আগের তোমাকে ফিরে পেতে চাই। যেই তুমি তোমার মনের সমস্ত কথা অনায়াসেই আমাকে বলে ফেলতে পারতে।’

অতল তার কাঁধে রাখা বহ্নির হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আমার সাথেই কেন সবসময় এমন হয় বলতে পারিস? সবাই আমাকেই কেন দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়? কেন?’

অতল করুণ চোখে তাকিয়ে রইল বহ্নির দিকে। দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা, মনের মধ্যে হাজারও প্রশ্নের দাপাদাপি। বহ্নি অসহায় বোধ করল। অতলের কোনো প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই।

নিজেকে সামলে নিয়ে অবিচলিত কণ্ঠে বহ্নি বলল, ‘সব ভুলে যাও। আজকে তোমার সব বন্ধুরা আছে ওদের সাথে কথা বলো দেখবে তোমার মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা সমস্ত অভিমান আজকের এই আনন্দের জোয়ারে হারিয়ে যাবে।’

‘আমি খুব খারাপ। খুব খারাপ। এজন্যই আমার সাথে এরকম হয়। তাই না?’ অতল পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল বহ্নির দিকে, স্থির অথচ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

বহ্নি ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। সামনে বসে থাকা চশমা পরা ছেলেটার প্রতি তার মন ও মস্তিষ্ক উভয়েই প্রচণ্ড রকমের দুর্বল। সে মুহূর্তেই চোখ বন্ধ করে অতলকে জড়িয়ে ধরল। ম্লান কণ্ঠে বলল, ‘তুমি মোটেই খারাপ নও। আমার দেখা সবচাইতে ভালো মানুষ তুমি।’

অতল ধরা গলায় বলল, ‘মিথ্যা বলছিস কেন? আমি আসলেই খুব খারাপ। তাই কেউ আমাকে ভালোবাসে না। কেউ না। যাদের ভালোবাসা পেয়েছিলাম তাদের ভালোবাসাও কেড়ে নিল আমার দুর্ভাগ্য।’ অতল চাপা আর্তনাদ করে বলল, ‘এরকম দুর্ভাগা কি কেউ হয়, আগুনমণি? হয় না। কেউ হয় না।’

অতল উঠে দাঁড়াল। চোখের পানি মুছে চশমাটা ঠিক করে পরে নিল। বহ্নির ভীষণ কষ্ট হতে লাগল। সেও বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। অতলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, ‘তুমি মোটেও দুর্ভাগা নও। যারা তোমাকে বুঝতে পারে না তারাই দুর্ভাগা। যারা তোমাকে ভালোবাসতে পারে না তারাই দুর্ভাগা।’

অতল এবার তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ‘আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিস? এটা করিস না প্লিজ।’ ডান হাতের তর্জনী দিয়ে বুকের বাম দিকটাতে দেখিয়ে বলল, ‘ঠিক এই খানটাতে লাগে। খুব কষ্ট হয় তখন।’

বহ্নি এবার অতলের দু’হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে তেজী গলায় বলল, ‘তোমার অনুভূতি শক্তি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেছে। এই জন্য তুমি শুধু কষ্ট অনুভব করছ। সত্যি বলতে তুমি বোধহয় কষ্টের প্রেমে পড়ে গেছ তাই কষ্টরা তোমার সমস্ত সত্তা জুড়ে ছড়িয়ে গেছে। এখানে তোমার দোষও আছে। তুমি নিজের মনের কথা কাউকে বলো না। সত্যি বলতে কী জানো, তুমি নিজেই কাউকে আপন ভাবো না! আর তাই তোমার মন আর মস্তিষ্ক সবসময় নেতিবাচক দিকটাই গ্রহণ করে। যা আমার মোটেই পছন্দ না। এখন থেকে আমি…!’ শেষের কথাটা সম্পূর্ণ শেষ না করেই বহ্নি থামল।

অতল ভ্রু কুঁচকে বহ্নির দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘এখন থেকে তুই কি?’

‘কিছু না।’ বলেই মুখ ঘুরাল বহ্নি ।

‘কথা শেষ কর।’ অতল নাছোড়বান্দার মতো করে বলল ।

‘কিছু না বললাম তো।’ দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলল, বহ্নি ।

‘কথা পুরোটা শেষ করতে বলেছি তো।’ চেঁচিয়ে বলল, অতল।

‘বলতে পারি একটা শর্তে। রাজী?’

‘কী শর্ত?’

‘এখন থেকে আমি যা বলব তাই তোমাকে শুনতে হবে।’

‘এটা কেমন শর্ত?’

‘কেমন জানি না। ব্যস এটাই শর্ত। মানা না মানা তোমার ব্যাপার। কিন্তু শর্ত এটাই।’ বহ্নি হাসল। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর সেই হাসি। ঠোঁটের কোণে সেই হাসির রেখা ধরে রেখেই বলল, ‘আর এত ভয় পাচ্ছ কেন? আমি কি তোমাকে আগুনে ঝাপ দিতে বলেছি না-কি তোমার কিডনি চেয়েছি?’

‘আমার কিডনি দিয়ে তুই কি করবি?’ অতল দ্বিধান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল।

অতলকে বিভ্রান্তিতে রেখে বহ্নি হাঁটা শুরু করল। অতল বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকল ভ্রমপূর্ণ দৃষ্টিতে । পরক্ষণেই লম্বা পদক্ষেপে বহ্নির সামনে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞাসু চাউনিতে তাকিয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার?’

বহ্নি কিছুই হয়নি এমন ভাব ধরে বলল, ‘কোথায় কী ব্যাপার?’

অতল প্রলম্বিত শ্বাস ছাড়ল। বলল, ‘এসব কী শুরু করেছিস?’

‘কী শুরু করেছি?’ বহ্নি পাল্টা প্রশ্ন করল।

অতল হাল ছেড়ে দিল এবার। তাই দেখে বহ্নি ঠোঁট টিপে হাসল। যা অতলের চোখ এড়াল না। রাগান্বিত হয়ে সে বলল, ‘আমাকে কি তোর জোকার মনে হচ্ছে?’

‘একটু তো বটেই।’ বহ্নি প্রশস্ত হাসল। বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি রেগে যাও কেন? মজা করছিলাম। এখন চলো।’

দুজন একসাথে পাশাপাশি হাঁটতে থাকল। বহ্নি আবারও বলল, ‘আমার সব কথা শুনবে বলে কথা দিয়েছ। মনে থাকে যেন।’

‘আমি কোনো কথা দিইনি। আর তোর কথা কেন শুনব? আমি পিচ্চিদের কথা শুনি না।’ বহ্নির দিকে ত্যাড়ছাভাবে তাকিয়ে বলল, অতল।

অতলের মুখ থেকে আবারও পিচ্চি শব্দটা শুনে বহ্নির মুখের হাসি উবে গেল। ক্রোধিত কণ্ঠে অতলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোমরে দু’হাত রেখে বলল, ‘আমি মোটেই পিচ্চি না।’

‘আমার কাছে তো তুই এখনও সেই পিচ্চিই আছিস।’
অতল বলল দৃঢ়তার সাথে।

‘আমি পিচ্চি হলে তুমি তার থেকেও বড়ো পিচ্চি। সেজন্য যার যা খুশি তাই তোমাকে বুঝিয়ে চম্পট দিতে পারে।’ তেজস্বী কণ্ঠে বলল, বহ্নি ।

অতল চুপ হয়ে গেল। বহ্নি বলল, ‘স্যরি।’

অতল মলিন হাসল। বলল, ‘স্যরি কেন বলছিস? কথাটা মোটেই ভুল বলিসনি।’

দুজন আবারও পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল। অতলের মনে হলো এই মুহূর্তে তার ভীষণ ভালো লাগতে শুরু করেছে। মনে হলো তার বুকের উপর থেকে এক বিশাল বোঝা সরে গেল। নিজেকে হালকা অনুভব করছে সে। সে মনে মনে ভাবতে লাগল তার আগুনমণির মধ্যে কী এমন আছে যা তার সমস্ত কষ্ট ফিকে করে দিল মুহূর্তেই। কেন সে এতটা নির্ভরশীল এই পিচ্চিটার উপর। কেন?
কিছু কিছু প্রশ্ন যেমন জটিল হয়ে থাকে ঠিক তেমনি সেই জটিল প্রশ্নের উত্তর আরও বেশি জটিল হয়ে থাকে। অতলের মনের প্রশ্নগুলো সেই জটিলতায় মোড়ানো কিছু প্রশ্ন। যার উত্তর তার জানা নেই। শুধু অনুভূতি শক্তির মাধ্যমে সে অনুভব করতে পারছে তার আগুনমণির বলা প্রতিটা কথা সত্য।
___________________

শিহরণ তখনও গাছটার পাশেই বসে ছিল নিচের দিকে তাকিয়ে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে। অতল তার পাশে গিয়ে বসল। ইতস্তত কণ্ঠে বলল, ‘স্যরি, শিহরণ।’

শিহরণ সাথে সাথেই মুখ তুলে তাকাল। অতলের দিকে তাকিয়েই সে বুঝতে পারল অতল তার উপর রেগে নেই। সাথে সাথেই শিহরণ অতলকে জড়িয়ে ধরল। আবেগে আপ্লুত কণ্ঠে বলল, ‘থ্যাঙ্কস, অতল। তোকে আমি বুঝাতে পারব না আজ আমি কতটা খুশি।’

অতল স্মিত হেসে বলল, ‘বিশ্বজয় করার মতো খুশি হয়েছিস। তাই না?’

‘একদম। তোকে পেয়ে আমার সত্যিই মনে হচ্ছে আমি বিশ্ব জয় করেছি।’

‘আমারও তাই মনে হচ্ছে।’ প্রশস্ত হেসে বলল, অতল।

ফাহমি ব্যঙ্গ করে বলল, ‘বাব্বাহ! শিহরণ-ই তোর জন্য সব। তাই না অতল? ভাই আমাদেরকেও একটু জড়িয়ে-টড়িয়ে ধর।’

অতল ফাহমিকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘জড়িয়ে তো আমি ধরেছি। এবার টড়িয়ে কীভাবে ধরতে হয় আমাকে শিখিয়ে দে।’

অতলের কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে ফেলল। রাদিদকে দেখে অতল ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘রাদিদ। রাইট?’

রাদিদ জবাবে হাসল। অতল রাদিদকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সামথিং ইজ মিসিং। কী মিসিং বল তো?’

মোহনা আর ফাহমি সমস্বরে চেঁচিয়ে বলল, ‘ইটস্ প্লে বয় ট্যাগ।’

‘হোয়াট?’ অতল বিস্ময়াভূত হয়ে বলল, ‘কীভাবে হলো এসব?’

রাদিদ মাথা নিচু করে লজ্জাবনত কণ্ঠে বলল, ‘ইটস্ দ্যা ম্যাজিক অফ টাইম অর সিচুয়েশন।’

অতল সম্মতি জানাল। বলল, ‘দারুণ বলেছিস। সিরিয়াসলি টাইম ইজ দ্যা রিয়েল ম্যাজিশিয়ান।’

সব বন্ধুদের মান অভিমানের পালা শেষ হওয়াতে সব বন্ধুরা আজকে দারুণ খুশি। এ যেন এক মহোৎসবের মেলা বসেছে। সাইফ ছোঁয়াকে বলল, ‘সত্যি বন্ধুদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হলে জীবন দুর্বিসহ মনে হয়।’

মায়া সাইফের কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল, ‘একদম ঠিক বলেছিস।’

প্রিয় তখনও গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল এক কোণায় । ছোঁয়া ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে অপর বন্ধুদের পাশে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘এবার প্রিয়কেও মাফ করে দেওয়া হোক। ছোটোবেলায় করা ভুলের শাস্তি আজীবন দেওয়া হলে সেটা ঘোর অন্যায় হয়ে যাবে।’

প্রিয় মুখ তুলে তাকাল ছোঁয়ার দিকে। তার চোখে স্পষ্ট কৃতজ্ঞতা। অতল আর শিহরণ প্রিয়র দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। ছোঁয়া শিহরণকে বলল, ‘কী আশ্চর্য! এভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছ কেন?’

একটু দম নিয়ে ছোঁয়া পুনরায় বলল, ‘তুমিও তো ছোটোখাটো কতো ভুল করেছ। তার শাস্তি যদি তোমাকে আজীবন দেওয়া হয় তোমার কেমন লাগবে?’

শিহরণ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল প্রিয়র দিকে। তারপর ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে একগুঁয়ে স্বরে বলল, ‘ও যা করেছে তা কোনো ছোটোখাটো ভুল ছিল না।’

অতল শিহরণের কথার সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘আমিও শিহরণের সাথে একমত।’

প্রিয় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘আমি জানতাম ওরা দুজন আমাকে মাফ করবে না। তাই আমি এখানে আসতে চাইনি।’

রাদিদ, শিহরণ আর অতলকে উদ্দেশ্য করে প্রিয়র স্বপক্ষে বলল, ‘আমরা কি সবকিছু ভুলে যেতে পারি না। আমিও তো কতো অন্যায় করেছিলাম। আমাকে তো তোরা মাফ করে দিয়েছিস।’

শিহরণ তেজী গলায় বলল, ‘তুই কোনো অপরাধ করিসনি। মিথ্যা বলছিস কেন?’

রাদিদ অদ্ভুত হাসল। হেসে বলল, ‘আমার ক্ষেত্রে ম্যাজিকের মতো একটা ব্যাপার ঘটেছিল বলে আজকের এই আমি। নয়তো আমি হয়তো আজও প্লে বয় ট্যাগ নিয়ে ঘুরতাম। মানুষকে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে মূল্যায়ন না করে তার সামাজিক স্ট্যাটাস দিয়ে মূল্যায়ন করতাম। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি কারণ বাবার অসুস্থতা ছাড়াও বেশ কিছু ঘটনা আমার চিন্তা জগতে বেশ ভালো রকমের প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাই আজকের এই আমি। আজ আমি যদি প্লে বয় হয়েই থাকতাম তবুও কি তোরা আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারতি? আমাকে পর করে দিতে পারতি?’

মোহনা আর ফাহমি বলল, ‘রাদিদ একদম ঠিক বলছে। আসলেই আমরা আমাদের বন্ধুকে পর করে দিতে পারতাম না।’

অতল আর শিহরণ যেন নাছোড়বান্দা হয়ে গেল। প্রিয়র প্রতি তাদের রাগ যেন কোনোভাবেই কমছে না।
রাদিদ আবারও বলতে শুরু করল, ‘এখন যখন সব ঠিক হয়ে গেছে তখন আমাদের এক বন্ধুকে পর করে দেওয়াটা বোকামি হবে বলেই আমার ধারণা। তাছাড়া প্রিয় তার কাজের জন্য অনুতপ্ত। এটাই তো তার সবচাইতে বড়ো শাস্তি।’

বহ্নি এবার মুখ খুলল। শিহরণকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘কী রে ভাইয়া? জেদ বেড়েছে না তোমার? সবাই এত করে বলছে তাও তুমি প্রিয় আপুকে মাফ করে দিচ্ছ না। এখন এসব একগুঁয়েমি ছেড়ে দাও।’ একটু থেমে
ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলল, ‘আসলে তোমাদের দুজনের এত ঢং না করলে চলছে না। এটাই হলো আসল কথা।’

মোহনা আর ফাহমি বহ্নির সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘একদম। দুই জিগরি দোস্ত এক হইছে তো এখন আরও কতো ঢং যে দেখা লাগবে সেটাই ভাবতেছি।’

বহ্নি অতলের পাশে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘শর্তের কথা এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে তা তো ভাবিনি।’

অতল পরাস্ত হয়ে শিহরণকে বলল, ‘আমার মনে হয় প্রিয়কে মাফ করে দেওয়াটাই ভালো হবে।’

‘বলছিস?’ শিহরণ জিজ্ঞাসু চাউনিতে তাকাল অতলের দিকে।

অতল চোখের ইশারায় সম্মতি জানাল। প্রিয় তখন খুশিতে বাকবাকুম হয়ে গেছে। দৌড়ে এসে দুই বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘থ্যাংক ইউ দোস্ত। আর কখনও এরকম ভুল হবে না। আমার এখন খুব ভালো লাগছে। তোরা আমার উপর অনেক দয়া করেছিস। আমি এ ঋণের কথা কখনোই ভুলব না।’

অনুষ্ঠানের আনন্দ ছাপিয়ে বন্ধুদের মিলনমেলার এক অনন্য উৎসবমুখর আনন্দে চারিদিক মুখরিত হয়ে গেল। বাচ্চাদের সমস্বরে গাওয়া কোরাসের স্বর ভেসে আসছে বাতাসের ভেলায় চড়ে।

দু’জোড়া চোখ মিলিত হচ্ছে বারেবারে, কারণে-অকারণে, কৃতজ্ঞতায়। কারণ অজানা একজনের কাছে তো অন্যজনের কাছে তা স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার। এই দুই জোড়া চোখের দৃষ্টির মিলন ছোঁয়ার চোখ এড়াল না। পুরো বিষয়টা তার কাছে এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে। মনে মনে সে ভীষণ খুশি হলো।
___________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে