ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭

0
1613

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩৫

রাদিদের মনে হলো মেয়েটা তার সাথে উদ্ধত আচরণ করছে। তারপরেও সে নম্রভাবে বলল, ‘আমি রাদিদ। আপনার দাদুর সাথে দেখা করতে এসেছি।’

মেয়েটা রাদিদের সামনে এসে দাঁড়াল। তাকে ভালো করে খেয়াল করে মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘রাদিদ! মানে তুমি কি আমাদের প্লে বয় রাদিদ?’

রাদিদের মনে হলো সে আকাশ থেকে পড়ল। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে সামনের মেয়েটার এমন সম্বোধনে। এইভাবে তাকে অপমান না করলেও পারতো! এই মেয়েটাকে চেনার ব্যাপারটা এতক্ষণ পর্যন্ত তার ভাবনাতে না থাকলেও এখন একে চেনাটা খুব জরুরি মনে হলো।

রাদিদ বিস্ময়াভূত হয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা যে কে তা সে বুঝতে পারছে না। প্রিয় রাদিদের দ্বিধান্বিত অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, ‘আরে দোস্ত আমি প্রিয়। চিনতে পারছিস না?’

‘কী!’ রাদিদ ভীষণ অবাক হলো। বলল, ‘তোকে তো একদম চেনা যাচ্ছে না। চুল বড়ো করেছিস। আগের চাইতে স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। আগে ছিলি পাটকাঠি। এখন তো দেখে মনে হচ্ছে কোনো মডেল।’

‘হয়েছে। হয়েছে। আর কোনো প্রশংসা করার দরকার নেই।’ পরক্ষণেই মন খারাপ করে আফসোসের সুরে বলল, ‘আমার জন্য সবকিছু নষ্ট গেল রে।’

‘আচ্ছা, চল আমার রুমে আয়। আর কারো সাথে তো কথা বলার সাহস হয় না আমার। তোর সাথে কথা বলে মনটা হালকা করতে চাই।’

রাদিদ একা থাকতে থাকতে নিজের মধ্যে একটা সঙ্কোচ নামক পাহাড় তৈরী করে ফেলেছে। সেই বিশাল পাহাড় ভেঙ্গে ফেলা তার পক্ষে কঠিন বৈ সহজ কিছু নয়। তাই সে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গির কারণে প্রিয়র সাথে আড্ডা দিতে চাইছিল না বলে প্রসঙ্গ এড়াতে বলল,
‘তোর সাথে দেখা হয়ে ভালোই হলো। কিন্তু আমার যে এখন তাড়া আছে। আমি না হয় পরে আসব। আজকে যাই। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দেখছিসই তো।’

‘আমি তোর কোনো কথাই শুনব না। আজকে তোকে আমার সব কথা শুনতে হবে। আর আমার হাতের তৈরী কফিও খেয়ে যাবি।’ প্রিয় জোর গলায় বলতে বলতে রাদিদের হাত ধরে টানতে থাকল।

রাদিদ নিতান্ত বাধ্য হয়ে প্রিয়র হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তার পিছুপিছু তার রুমে গেল। রাদিদকে বসতে বলে প্রিয় কিচেন থেকে দুজনের জন্য দু’কাপ কফি আর পপকর্ন নিয়ে রুমে গেল। সেন্টার টেবিলে কফি আর পপকর্ন রেখে রাদিদকে খেতে বলল।

রাদিদ খেয়াল করল এত বছর ধরে বন্ধুদের সাথে দূরত্ব থাকায় তার মধ্যে জড়তা কাজ করছে অথচ প্রিয় কেমন সহজভাবে তার সাথে মিশে গেল। কথা শুনেও বোঝার উপায় নেই যে দশটা বছর পরে তার সাথে কথা হচ্ছে! রাদিদ আলতোভাবে কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল, ‘কেমন আছিস?’

‘এই তো ভালো আছি। তবে তোদের কথা মনে পড়লেই আমার ভালো থাকা হয়ে উঠে না। আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়।’

‘কী হয়েছে? কেন নিজেকে অপরাধী মনে হয় তোর?’

ঠিক তখনই মেইন ডোরের বেলটা বেজে উঠল। রাদিদ বলল, ‘কেউ এসেছে মনে হয়।’

‘ওসব বাদ দে। এখন তুই শুধু আমার কথাই শুনবি।’

প্রিয় রাদিদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হতে চাইল। কিন্তু আবারও বেলটা বেজে উঠল। প্রিয় এবার খুব বিরক্ত হলো। তিরিক্ষি মেজাজে বলল, ‘এই ঘরে কি কেউ নাই না-কি? দরজাটা কেউ এখনও খুলছে না কেন?’

সাথে সাথেই দারোয়ান ইন্টারকমে কল করল। প্রিয় রিসিভ করতেই দারোয়ান বলল, ‘প্রিয় আপা। আপনের লগে দেখা করবার লাইগা আপনের বন্ধু আইছে।’

প্রিয় ভাবল তার সাথে দেখা করার জন্য আবার কে আসল। দারোয়ানকে বলল, ‘আচ্ছা, আমি আসছি ।’

প্রিয় রাদিদকে বলল, ‘তুই কফি খা। আমি দেখে আসছি কে আসলো।’

ড্রয়িং রুমে এসে মোহনা আর ফাহমিকে দেখে প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেল প্রিয়। বিদেশে পড়াশুনা করলেও মোহনা তার সাথে যোগাযোগ রেখেছিল। প্রিয় অবাক হয়ে বলল, ‘আমি যে বাংলাদেশে এসেছি জানলি কি করে?’

মোহনা প্রিয়র দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘আমার কাছ থেকে লুকানো এত সহজ কিছু কি?’

‘কেন এসেছিস? আবারও কথা শোনাতে এসেছিস?’ ব্যথাতুর কণ্ঠে প্রিয় বলল, ‘ঠিক আছে বল। কোনো সমস্যা নেই।’

‘কে বলেছে আমি তোকে কথা শোনাতে এসেছি? কে বলেছে?’ মোহনা বলল, অনুযোগের সুরে।

‘বলতে হবে কেন?’ প্রিয় ছলছল চোখে বলল, ‘আমি জানি। ছোটোবেলায় করা ভুলের শাস্তি আমি এখনও পাচ্ছি। তোরা কেউ আমাকে ক্ষমা করিসনি। অবশ্য সবচাইতে বেশি যাদের ক্ষতি করেছি তাদের কাছে আমি এখনও ক্ষমা চাইতে পারিনি।’ একটু থেমে প্রিয় আবারও বলল, ‘অবশ্য আমিই কখনও সাহস করে তাদের সামনে দাঁড়াইনি।’

প্রিয়র দেরি দেখে রাদিদ নিচে নেমে এলো। প্রিয় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অপরিচিত মেয়ে ও ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ। অবশেষে চিনতে পারল। চিনতে পারার পরে তার ভেতরের একটা সত্তা আনন্দিত হলো কিন্তু একইসাথে অপর একটা সত্তা আহত হলো। সে চায় না আবার বন্ধুত্বের বেড়াজালে আটকাতে। তার পক্ষে তা আর কখনোই সম্ভব নয়। তার আর তার বন্ধুদের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। যা কখনোই ঘুচবার নয়।

তবে রাদিদের জন্য সবচাইতে বেশি শকিং ছিল প্রিয়র কথা। প্রিয়র বলা কথার কোনো মানেই সে বুঝতে পারছে না। তাই সে বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘কার ক্ষতি করেছিস তুই?’

ভরাট স্বরের কৌতূল মিশ্রিত কণ্ঠের করা প্রশ্নের মানুষটির প্রতি চোখ গেল প্রিয়, মোহনা আর ফাহমির। মোহনা আর ফাহমি স্তম্ভিত হয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ সময়। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে চেনার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে তাদের উভয়ের মস্তিষ্ক। মোহনার খুব বেশি সময় লাগল না রাদিদকে চিনতে। তার ঠোঁটের মধ্যে দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো, ‘রাদিদ!’

আর সাথে সাথেই আনন্দ উল্লাসে নৃত্যে মশগুল হয়ে মাদল বেজে উঠার মতো শব্দ করে উঠল। মোহনার মনে উদয় হলো একটি সহজ অথচ সময়ের তরে সবচাইতে কঠিন প্রশ্নটা;
বন্ধুরা কি সবাই আবার এক হতে চলেছে! ফাহমিও এবার চিনতে পারল। উভয়ে সমস্বরে বলে উঠল, ‘রাদিদ! তুই এখানে?’

‘হুম।’ ছোট্ট করে জবাব দিল রাদিদ।

ফাহমি গিয়ে শক্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিল রাদিদকে। রাদিদের মধ্যে স্পষ্ট সঙ্কোচ। ফাহমি অভিযোগের সুরে বলল, ‘তুই খুব নিষ্ঠুর! আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখিসনি!’

মোহনা গাল ফুলিয়ে বলল, ‘একদিন তোর গার্লফ্রেন্ডদের একটু বকেছিলাম । আর তাই তুই এতো বড়ো শাস্তি দিলি?’ মোহনার চোখে স্পষ্ট জলের উপস্থিতি।

রাদিদ এবার নিজে খুব অসহায়বোধ করছে। প্রসঙ্গ এড়াতে সে প্রিয়র পুরো বিষয়টা জানার জন্য ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘আমি না তোদের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে একটু খুলে বল তো।’

মোহনা তাকে সংক্ষেপে পুরোটা বলল। সবটা শোনার পর সে থম ধরে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তার বন্ধুদের মধ্যে এত কিছু হয়ে গেল অথচ সে এসবের কিছুই জানে না! তার নিজস্ব কিছু কারণ অবশ্য ছিল। তবুও সে বন্ধুদের একটাবার খোঁজ নেয়নি। এই বিষয়টা তাকে আজ বড্ড কষ্ট দিচ্ছে।

‘রাদিদ! তুইও এখন আমাকে ক্ষমা করবি না। তাই না?’ প্রিয় কান্না করতে করতে বলল, ‘আমি জানি তোরা সবাই আমাকে পর করে দিবি। তাইতো আমি দেশে আসতে চাই না। আমার দাদু সুস্থ হলে আমি আবার ফিরে যাব। তোদের সকলের ঘৃণা ভরা চোখের দিকে আমি তাকাতে পারব না। আমার ভীষণ কষ্ট হয়। ভীষণ কষ্ট।’

মোহনা প্রিয়র কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘শুধু তুই একা কষ্ট পাচ্ছিস কে বলেছে? তুই জানিস তোর ওই কান্ডের জন্য আমাদের বন্ধুত্ব তো নষ্ট হলোই। আরও কত ক্ষতি হয়েছে তা তুই ধারণাও করতে পারবি না। সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের অতল।’

প্রিয় আর রাদিদ মোহনার দিকে তাকিয়ে প্রায় সমস্বরে প্রশ্ন করল, ‘কী বলছিস?’

‘হুম। একদম ঠিক বলছি।’ মোহনা ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলতে শুরু করল, ‘অতলের ফ্যামিলিতে কী হয় তা তো আমাদের অজানা নয়। ছেলেটা বাসায় কারো কাছ থেকে ভালোবাসা পেত না। যতটুকু ভালোবাসা পেত তা শুধু তার মায়ের কাছ থেকে। এর বাইরে শিহরণ আর তার বোন ছিল ওর দুনিয়া। শিহরণকে সে তার ভাই ভাবতো। আর বহ্নির সাথে সে তার সমস্ত কিছুই শেয়ার করতো। সবকিছু। বলতে গেলে অতল শিহরণের থেকেও বেশি কাছে ছিল বহ্নির। অথচ তোর করা একটা ভুলের কারণে ওর দুনিয়াটাই মিথ্যে হয়ে গেল। শান্ত অতল আজ কতটা বেপরোয়া হয়ে গেছে তা তুই ধারণাও করতে পারবি না।’

‘তুই এসব কী করে জানলি? অতলের সাথে তো তোর কোনো যোগাযোগ ছিল না।’

‘এসবকিছু জেনেছি বহ্নির কাছ থেকে।’

‘বহ্নি কী করে জানলো?’ প্রিয়র পাল্টা প্রশ্ন।

‘বহ্নি সবসময় তার ভাইয়ের বন্ধুদের একসাথে দেখতে চেয়েছে। সেই প্রয়াস মেয়েটা আজও করছে। সেই চেষ্টার বদৌলতে সবার বিষয়ে খোঁজ রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। আর অতলকে বহ্নি কতটা পছন্দ করে তা নিশ্চয়ই তোর অজানা নয়? অতলের সমস্ত খবর
জেনেছে অতলের বন্ধু আয়মানের কাছ থেকে।’

প্রিয়র চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। বিবেকের দংশনে পুড়ছে সে। প্রিয় আজ অনুতপ্ত।

রাদিদের চোখে জমেছে অনাকাঙ্ক্ষিত অশ্রুবিন্দু। মনে মনে সে ভীষণ অবাক হচ্ছে বহ্নির কথাটা ভেবে। এতটা করেছে সে! তার বুকের ভেতরে কষ্টগুলো মোচড় দিয়ে উঠতে চাইছে। কেন যেন মনটা অবাধ্য হয় বারেবারে। যা কখনোই পাবার নয় তা কেন পেতে চায় অবাধ্য মন বারেবারে! বহ্নি তার কৈশোরের তাড়নায় মনের গহীনে পোষণ করা এক অনভিপ্রেত অভিলাস ব্যতীত আর কিছুই নয়। যেই অভিলাষ থেকে তাকে মুক্তি পেতেই হবে।

ফাহমি এবার মুখ খুলল। বলল, ‘এবার সব দোষ স্বীকার করে নে অন্ততপক্ষে। অতল তো ভুল বুঝে আছে শিহরণকে। শিহরণের ভুলটাও পুরোপুরি ভাঙ্গেনি।’

মোহনা প্রিয়র দু’হাত ধরে অনুনয় করে বলল, ‘চল না আমরা সব বন্ধুরা আবার এক হয়ে যাই। মনের মধ্যে এত রেষারেষি পোষণ করে আমরা কি খুব সুখে ছিলাম? তুই সত্যি করে বল তো তুই কি খুব আনন্দ পেয়েছিস তোর করা ভুলের জন্য? আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হবার কারণে তোর কি কখনো অনুতাপ হয়নি? কখনও কি মনে হয়নি যে তুই ভুল করেছিস?’

‘বারবার মনে হয়েছে। বারবার। কিন্তু আমি কখনও সাহস যুগিয়ে উঠতে পারিনি। নিজের ভুলটা মনে মনে স্বীকার করলেও ক্ষমা চাওয়ার সাহসটা কেন যুগাতে পারিনি।’ প্রিয় কান্না ভেজা কণ্ঠে চেঁচিয়ে বলল।

রাদিদের সবকিছু বিষাক্ত মনে হচ্ছে। এমনিতেই তার জীবনে এত যন্ত্রণা। তার উপর এখন এসব শোনার পর তার নিজেকে দিশেহারা লাগছে।
সে তিক্ত গলায় বলল, ‘তোরা থাক। আমি যাচ্ছি।’

ফাহমি তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বাহ্! তুই দেখছি দিব্যি ভুলে গেছিস আমাদেরকে। একবার জানতেও চাইলি না কেমন আছি!’

এটুকু বলেই ফাহমি রাদিদকে আবারও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘তোকে ভীষণ মিস করেছি দোস্ত।’ পরক্ষণেই কৌতুকমিশ্রিত কণ্ঠে বলল,’বিশেষ করে কোন ব্যাপারটার জন্য জানিস?’ ফাহমি রাদিদকে প্রশ্ন করলেও তার উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই বলতে শুরু করল, ‘যখনই কোনো সুন্দর মেয়ে দেখতাম তখনই মনে হতো; ইশ! এখন যদি রাদিদ থাকত তাহলে এখনই মেয়েটাকে পটিয়ে চুটিয়ে প্রেম করত।’

রাদিদ হাসল। প্রাণখোলা হাসি। তার মনে হলো অনেকদিন পরে সে হেসেছে। স্মিত হেসে বলল, ‘রাদিদ এখন নাইভ হয়ে গেছে। প্রে বয় ট্যাগ কেড়ে নিয়েছে সময়।’

মোহনা বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল, ‘সে কী রে! তোর ট্যাগ কেড়ে নেওয়া হয়েছে আমাদের একবার জানালি না পর্যন্ত। আচ্ছা আমরা নিজেরাই না হয় তোকে আবার সেই ট্যাগ দিব। চলবে তো?’

রাদিদ সহাস্যে বলল, ‘উঁহু! সময় কেড়ে নিয়েছে। আর আমি ইচ্ছকৃতভাবে বর্জন করেছি সেই ট্যাগ। তাই বর্জনকৃত ট্যাগ আমার আর চাই না।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। তোকে এই ফালতু ট্যাগ আর দিব না। এখনকার রাদিদকেই আমাদের ভীষণ ভালো লাগছে।’ প্রিয় বলল, মৃদু হেসে।

‘এখন আমাদের প্রধান কাজ হলো সব বন্ধুরা একসাথে হওয়া। আর যত প্রকার ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে তার অবসান করা। এই কাজে কোনো প্রকার ইগো যেন কেউ না দেখায়। এটা আমার অনুরোধ।’ মোহনা প্রিয়র দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল, ‘এই অনুরোধটা স্পেশালি তোর কাছে করছি। প্লিজ একটু কো-অপারেট কর আমাদের সাথে। ঠিক আছে?’

প্রিয় মাথা নিচু রেখেই বলল, ‘আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আমার কারণে যেসব ক্ষতি হয়েছে তা হয়তো কখনোই ঠিক হবে না। তবে ভুল বোঝাবুঝির অবসানের জন্য আমার যতটুকু করা লাগে তা আমি অবশ্যই করব। কথা দিলাম।’

প্রিয়র কথা শুনে মোহনা প্রিয়কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুই আমাকে অনেকটা রিলিফ দিয়েছিস। অনেক ধন্যবাদ তোকে।’

রাদিদকে উদ্দেশ্য করে ফাহমি ফিসফিস করে বলল, ‘দেখছিস, বান্ধবীকে কেমন করে জড়িয়ে ধরেছে। অথচ আমার ফাটা কপাল আমার বউ হয়েও তার হাতে পায়ে ধরতে হয় শুধু একবার জড়িয়ে ধরার জন্য।’

রাদিদের এবার আরেক দফা অবাক হবার পালা। সে সবিস্ময়ে ফাহমির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘তোরা বিয়ে করেছিস?’

‘শুধু কি বিয়ে করেছি? বিয়ের আগে চুটিয়ে প্রেম করেছি দুজনে মিলে।’

‘কীভাবে হলো?’ রাদিদ এখন চূড়ান্ত অবাক।

রাদিদের বিস্ময়াভূত চেহারা দেখে ফাহমি যেন ভীষণ মজা পেল। বলল, ‘প্রেম কী শুধু তুই করতে পারিস? আমিও করে দেখালাম।’ ফাহমি তার শার্টের কলার উঁচু করে গর্ব করার ভঙ্গিতে বলল, ‘শুধু কি প্রেম করে দেখালাম? বিয়েটাও সবার আগেই করে দেখিয়েছি। এখন শুধু আমার বাবুর অপেক্ষায় দিন কাটে আমার!’

‘তোর বাবুটা আবার কে?’

‘দূর! তুই দেখি কিচ্ছু বুঝিস না। প্রেম করা ছেড়ে দেবার পরে তুই নিভৃতবাসী হয়ে গেছিস না-কি?’

ফাহমির বলা কথার মানে বুঝতে পেরে রাদিদের নিজেকে মহাবেকুব মনে হতে লাগল। সে
বুঝল তার মাথা আজ একদিনেই এত লোড নিতে পারছে না। তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকাটাই শ্রেয় মনে করল সে। আজকে আর কোনো প্রশ্ন করবে না বলে মনে মনে পণ করল। মুখে কুলুপ এঁটে দাঁড়িয়ে থাকল বন্ধুদের পাশে।

____________________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩৬

অন্ধকার জেঁকে বসেছে পুরো ছাদ জুড়ে। গিটার হাতে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে শিহরণ। অনেকদিন পরে গিটার হাতে নিল সে। তবে আজ শত চেষ্টাতেও গিটারে কোনো সুর তুলতে পারল না। কণ্ঠ দিয়েও কোনো গান বের হতে চাইছে না। অগত্যা বিশাল অন্তরীক্ষে দৃষ্টি নিবন্ধ করে চেয়ে রইল নিবিষ্টচিত্তে। মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্নের ছুটোছুটি, জমানো আবেগগুলো শব্দবন্দী হবার অপেক্ষায়…! অথচ আজ তার নিজেকে শব্দহীন কোনো এক আগন্তুকের মতো মনে হচ্ছে। হঠাৎই বহ্নি আর তার মধ্যের সেদিনের কথাগুলো রোমন্থন করতে লাগল।

‘তুই আমাকে না বলে ওর সাথে কেন দেখা করেছিস? কেন?’ ক্রোধান্বিত হয়ে প্রশ্ন করেছিল, শিহরণ।

আচমকা শিহরণের এভাবে রেগে যাওয়ায় বহ্নি থতমত খেয়ে গেল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল। হিমশীতল গলায় প্রতিবাদের সুরে বলল,
‘ভাইয়া! তুমি আমার কথা তো শুনো। আমি কি বলতে চাই তা তো একবার শুনবে না-কি?’

‘আমি এটা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছি না তুই আমাকে না জানিয়ে অতলের সাথে দেখা করেছিস। আর আমাকে জানাচ্ছিস এত দিন পরে। তুই আমাকে হতাশ করেছিস। আমি তোর কাছ থেকে এটা আশা করিনি।’ শিহরণ আশাহত হয়ে বলল।

বহ্নি হাল ছাড়ল না। সে আগের মতো কণ্ঠের তেজ বহাল রেখে বলল, ‘ভাইয়া! তুমি মাঝেমধ্যে এত শর্ট টেম্পার্ড কেন হয়ে যাও বলো তো? আমি কী বলতে চাই একটা বার শুনো!’

শিহরণ বহ্নির কথা শুনে কিছুটা শান্ত হলো। অস্থির পায়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করল। তারপর বলল, ‘বল কি বলতে চাস?’

‘অতল ভাইয়া যেমন তোমাকে ভুল বুঝেছে তেমনি তুমিও অতল ভাইয়াকে ভুল বুঝেছ। অতল ভাইয়াকে তুমি যতটা খারাপ ভাবছ সে তেমন খারাপ মোটেও নয়। অতল ভাইয়ার জায়গায় যদি আমি হতাম বা তুমি হতে তবে বোধহয় আমরা আরও বেশি খারাপ হয়ে যেতাম। নিজেদের কষ্ট কমাতে হয়তো অন্যের ক্ষতি করে বসতাম। অতল ভাইয়া তেমন বড়ো ধরনের কোনোকিছুই করেনি। আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট লেগেছে কারণ তুমি অতল ভাইয়াকে বুঝলে না।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে বহ্নি হাঁপিয়ে উঠল। তার চোখে পানি। সে আবারও বলতে শুরু করল, ‘জানো ভাইয়া! অতল ভাইয়া কী পরিমাণ মানসিক কষ্ট ভোগ করেছে তুমি তার ধারণাও করতে পারবে না। তার ভাই, বাবা প্রতিনিয়ত তাকে মানসিক কষ্ট দিয়েছে। এতকিছু সহ্য করে সে যে এখনও স্বাভাবিক আছে সেটাই তো অনেক। আমি হলে এটা কখনোই পারতাম না,ভাইয়া। আমরা সবকিছু পেয়ে ভালো আছি। অতল ভাইয়া কিছু না পেয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত ভালো থাকার অভিনয় করে বেড়াচ্ছে।’

বহ্নির কথা শুনে শিহরণের অনুভূতি সম্পর্কে বোঝা গেল না। তবে সে মরিয়া হয়ে জানতে চাইল, ‘তুই এত কিছু কীভাবে জানলি? অতল বলেছে?’

‘না।’ দৃঢ়তার সাথে বলল, বহ্নি, ‘তোমার কী মনে হয় সে এই ব্যাপারে কিছু বলবে আমাকে?’

‘তাহলে তুই এইসব কীভাবে জেনেছিস?’ শিহরণের পাল্টা প্রশ্ন, অধৈর্য গলায়।

‘সে অনেক কাহিনি ভাইয়া। তবে আমার ভাগ্য ভালো ছিল বিধায় তা জানতে পেরেছি। কারণ সায়মার কাজিন আয়মান হচ্ছে অতল ভাইয়ার বন্ধু। আমি এই সবকিছু তার কাছ থেকেই জেনেছি।’

বহ্নি শিহরণের দিকে চাইল আরেকবার। তার অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করছে সে। তবে এই মুহূর্তে শিহরণের অনুভূতি সম্পর্কে ধারণা করা যাচ্ছে না।

শিহরণকে চুপ থাকতে দেখে বহ্নি আবারও বলতে শুরু করল, ‘ভাইয়া! অতল ভাইয়ার সাথে কথা বলার সুযোগ এবার পেতে চলেছ। আমি জানি অনেক দেরি হয়েছে। কিন্তু সব বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত থাকার চাইতে সবকিছু ঠিক করে নেওয়াটাই উত্তম নয় কি?’

বহ্নির বলা শেষ কথাটাই শিহরণের কানে বেজে চলেছে ক্রমাগত। হুম, সবকিছু ঠিক করে নেওয়াই উত্তম । সে তো এতোদিন তাই চেয়েছে। তবে আজ আবারও কেন কোনো এক অব্যক্ত দ্বিধা তাকে গ্রাস করে ফেলল! বহ্নি নিজে অতলের সাথে দেখা করেছে; এটাই কি এই দ্বিধার কারণ? না-কি ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া সেই দুঃস্বপ্ন, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা তার মনে এখনও তার বিষাক্ত প্রভাব রেখে দিয়েছে? শিহরণ আপনমনেই নিজেকে বারংবার প্রশ্ন করে চলেছে। দমবন্ধ অনুভূতি হতে লাগল তার।

এমন সময় তার একজনের কথা ভীষণ মনে পড়ল। গিটারটা এক পাশে রেখে মোবাইলটা হাতে নিল। ফোনের গ্যালারি থেকে সেদিনকার ছবিটা বের করল সে। পিয়াসী মনের চোখের তৃষ্ণা মেটাতে এই ছবিই এখন উত্তম পন্থা। তবে হৃদয় বাস্তবিক মানুষের সঙ্গ পেতে মরিয়া হয়ে উঠল।

প্রিয়তমা
তোমাতেই আমি মরেছি
তোমাতেই আমি হারিয়েছি
নিজেকে বারংবার!

প্রিয়তমা
শ্রাবণের বারিধারা দেখা হয়নি
কাশফুলের শুভ্রতা ছোঁয়া হয়নি
একসাথে হাতে হাত রেখে
দুজনে মিলে ছুঁয়ে দেব বলে।

প্রিয়তমা
আকাশের নীলে তাকিয়েছি
অগণিতবার, ক্ষণে ক্ষণে
দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছি
একসাথে হারাব বলে।

প্রিয়তমা
তোমাতে মোহাবিষ্ট হয়েছি বলেই
আমি মুগ্ধ হয়নি কোনোকিছুতেই
সৌন্দর্যে ভরা কোনো পুষ্প দেখেও
মৌতাত হয়ে ডুবতে যাইনি
তোমাতে মৌতাত হয়ে ডুব দেব বলে।

‘প্রিয়তা! আজ যে তোমার সঙ্গ পেতে অবাধ্য মন মরিয়া হয়ে উঠছে বারেবারে!’ শিহরণ যেন স্বগতোক্তি করল।

বহ্নি সারা ঘরে শিহরণকে খুঁজতে লাগল। শিহরণের রুমে গিয়ে তাকে খুঁজেও পেল না। ওয়াশরুম, ব্যালকনি সবখানে দেখেও তাকে না পেয়ে শেষমেশ ছাদে আসল। ছাদে এসেই অন্ধকারে বসে থাকতে দেখে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল বহ্নি। শিহরণ তার ভাবনাতে এতটাই মশগুল ছিল যে বহ্নির আসাটা অনুভব করতে পারল না।

বহ্নি শিহরণের পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘ভাইয়া! কী ভাবছ?’

শিহরণ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। বহ্নিকে তার পাশে দেখে স্মিত হেসে বলল, ‘কই কিছু না।’

‘সত্যি বলছ?’

শিহরণ নিরুত্তর। বহ্নি অবিচলিত কণ্ঠে বলল, ‘ভাইয়া!
তুমি ছোঁয়া আপুকে তোমার মনের কথা জানিয়ে দাও।’

শিহরণ সবিস্ময়ে তাকাল বহ্নির দিকে। বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘তুই কি মন পড়তে পারিস?’

বহ্নি হেসে বলল, ‘উঁহু! তবে আমার ভাইয়ের মনে কী চলতে পারে তা কিছুটা আন্দাজ করতে পারি।’

শিহরণ হাসল। দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘এখন বলাটা কি ঠিক হবে?’

‘তাহলে কখন বলবে?’ জিজ্ঞাসু চাউনিতে তাকাল বহ্নি। পরক্ষণেই শীতল গলায় বলল, ‘এমনিতেই অনেক দেরি করে ফেলেছ। আর দেরি করার কোনো মানে আমি দেখছি না।’

শিহরণ সাত পাঁচ না ভেবে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। শিহরণকে এভাবে আচমকা উঠে দাঁড়াতে দেখে
বহ্নি বলল, ‘কী হয়েছে? কোথায় যাচ্ছ?’

শিহরণ প্রশস্ত হেসে বহ্নিকে বলল, ‘বার্বি ডল! আমি এখনই যাচ্ছি আমার প্রিয়তার কাছে।’

কথাটা বলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না শিহরণ।
গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ছোঁয়াদের বাসার সামনে এসে গাড়ি থামাল। তারপর ছোঁয়ার রুমের ব্যালকনির দিকে চাতক পাখির ন্যায় তাকাল। রুমের আলো নিভানো। শিহরণ হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকল।

বিড়বিড় করে হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছ কেন, প্রিয়তা?’ মুখে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘তোমাকে আজ ঘুমোতে দিলে তো।’

শিহরণ মোবাইলটা বের করে ছোঁয়াকে কল দিল। প্রথম তিনবারই কল রিসিভ হলো না। পরের বার কল রিসিভ করতেই ছোঁয়া ঘুম জড়ানো গলায় বলল, ‘হ্যালো!’

কল রিসিভ করাতে শিহরণ বেশ খুশি হলো। খুশিতে গদগদ হয়ে সে ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল, ‘একবার ব্যালকনিতে আসবে? তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।’

ওপাশ থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে শিহরণ কলটা কেটে দিয়ে পুনরায় কল করল।

এবারও ছোঁয়া ঘুমো ঘুমো চোখে কলটা রিসিভ করল।
শিহরণ বলল, ‘একবার ব্যালকনিতে আসবে? তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।’

এবার শিহরণের কণ্ঠ শুনে ছোঁয়া লাফিয়ে উঠে বসল। কিছুক্ষণ থম ধরে বসে রইল। চোখ পিটপিট করে মোবাইলের স্ক্রিনে থাকা নাম্বারটা বারবার চেক করছে। ঘটনা সত্যি কি মিথ্যা তা বোঝার প্রাণপণ প্রচেষ্টা করছে। অবশেষে নিজের হাতে নিজেই চিমটি কাটল। মনে মনে বলল, ‘শিরহণ সত্যি এসেছে?’
দ্রুত বিছানা থেকে উঠে ঘরের লাইটটা জ্বালাল।

শিহরণ অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। ব্যালকনির দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে ছোঁয়ার নাম্বারে আবারও কল করল। রুমের আলো জ্বালাতে দেখে শিহরণের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল।

ঠিক তখন ছোঁয়াকে ব্যালকনি খুলে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতে দেখল। শিহরণ হাত নাড়ল। ছোঁয়া হাতের ইশারায় জানতে চাইল, ‘এত রাতে এখানে কী?’

শিহরণ হাতের ইশারায় বলল, ‘কলটা রিসিভ করো।’

ছোঁয়া কল রিসিভ করতেই শিহরণ বলল, ‘একবার নিচে আসবে?’

‘কী আশ্চর্য! তুমি এত রাতে এখানে কী করছ?’

‘বললাম না একটু আগে। তোমাকে দেখতে মন চাইছিল। ছবি দেখেও মন ভরছিল না তাই চলে এলাম আমার প্রিয়তাকে দেখতে।’

‘ওয়েট! ছবি মানে? কার ছবি দেখছিলে?’

‘তোমার ছবি। আর কার ছবি আমি দেখতে পারি?’

‘আমার ছবি তোমার কাছে কীভাবে?’

‘উফফো! এত প্রশ্ন করছ কেন? তুমি কি নিচে আসবে না-কি আমি দেয়াল টপকে আসব?’

‘এত রাতে তুমি এসব কী শুরু করেছ? কাল তো এমনিতেই দেখা হতো।’

‘তুমি আসবে কি না বলো?’

‘আচ্ছা, আসছি।’

ছোঁয়া গেটের কাছাকাছি এসে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কী বলতে এসেছ বলো।’

শিহরণ তেজী গলায় বলল, ‘গেট খুলে দাও। আমি ভেতরে আসব।’

‘ভেতরে আসা লাগবে কেন? যেখানে আছ সেখান থেকেই বলো।’

‘তুমি গেট না খুললে কি আমি ভেতরে আসতে পারব না ভেবেছ?’ শিহরণ ভ্রু কুঁচকে বলল।

ছোঁয়া এবার তিরিক্ষি মেজাজে বলল, ‘কেন এসেছ বলে বিদেয় হও না। এত রাতে আমাকে কেন শুধু শুধু জ্বালাচ্ছ?’

‘গেট খুলো। তারপর কারণ বলব।’ শিহরণ বিরক্ত গলায় বলল।

ছোঁয়া বাধ্য হয়ে রাগে গজগজ করতে করতে গেট খুলল। শিহরণ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,’ তুমি তোমার রুমে যাও। আমি তোমার ব্যালকনিতে আসছি। আর হ্যাঁ নুডলস আর কফি নিয়ে আসবে। আমার খুব খিদে পেয়েছে।’

ছোঁয়া এবার চূড়ান্ত অবাক। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলল, ‘কী বলবে বলে বিদেয় হও তো। আমি এত রাতে কিছুই করতে পারব না।’

‘পারব না বললে তো হবে না। ড্রাইভ করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। এবার আমার কিছু খাওয়া দরকার।’ শিহরণ বাঁকা হেসে বলল।

‘তোমাকে কি আমি ড্রাইভ করে এখানে আসতে বলেছি?’ ছোঁয়া শিহরণের সামনে এসে এক হাত কোমরে রেখে অপর হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে প্রতিবাদের সুরে প্রশ্ন করল।

‘আমাকে বলতে হবে কেন? তুমি মনে মনে এটাই চাইছিলে তাই কষ্ট করে চলে এলাম।’ শিহরণ পূর্বের হাসি ঠোঁটে রেখে বলল।

‘এই আমি চাইছিলাম কে বলেছে?’

‘কাউকে বলতে হবে কেন? তোমার আর আমার মধ্যের ট্যালিপ্যাথির মাধ্যমে জেনেছি।’

‘কী জ্বালা! আমি কিন্তু মাকে ডেকে তুলব।’

শিহরণ প্রশস্ত হাসল। বলল, ‘এই কাজটা তুমি করবে না। আমার জায়গায় তোমার পাণিপ্রার্থী পিচ্চি আরাভ হলেও তোমার এই বাচ্চামো মার্কা কথাটা বিশ্বাস করতো না।’ ঠোঁট টিপে হেসে শিহরণ বলল, ‘তাড়াতাড়ি যাও।’

ছোঁয়া চলে যেতেই শিহরণ বাগান থেকে বেশ কয়েকটা গোলাপ ফুল ছিঁড়ে নিল। ছেঁড়ার সময় বিষাদমাখা কণ্ঠে বলল, ‘স্যরি! এই রাতে তোমাদের বিরক্ত করছি। আমি আপারগ, ক্ষমা করো।’

তারপর ফুলগুলো পেছনে রেখে পাইপ বেয়ে ছোঁয়ার ব্যালকনিতে পৌঁছাল। পৌঁছেই আরাম করে আধশোয়া হয়ে বসে রইল বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারে। বিড়বিড় করে বলল, ‘আর পারছি না নিজের মধ্যের জমানো আবেগ জমা রাখতে । তাই আজ আমার মনের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে জমিয়ে রাখা আবেগগুলো শব্দবন্দী করে তোমায় জানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।’

ছোঁয়া কিচেনে গিয়ে চোরের মতো করে ধীর পদক্ষেপে কোনো প্রকার শব্দ যাতে না হয় তাই যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করে নুডলস তৈরী করল। তারপর এক কাপ কফি বানিয়ে নিল। মনে মনে শিহরণকে আচ্ছামতো বকা দিল এই রাতে তাকে বিরক্ত করার জন্য। তার ঘুমটাও নষ্ট করে দিল।

ব্যালকনিতে আসতেই শিহরণ ছোঁ মেরে ছোঁয়ার হাত থেকে নুডলসের বাটি নিয়ে বলল, ‘থ্যাঙ্কস, প্রিয়তা।’

ছোঁয়া কফির কাপটা নিজের হাতে ধরে রাখল। শিহরণ গপাগপ খেতে খেতে বলল, ‘বাহ্! তুমি তো খুব ভালো রাঁধতে পারো। না-কি আমার জন্য স্পেশাল করে রেঁধেছ বলে আমার ভালো লাগছে? কিছু মিশিয়েছ?’

‘হুম, মিশিয়েছি তো। আমাদের বাসায় এখন ইঁদুরের উৎপাত বেড়েছে। তাই মাঝেমধ্যে অনাকঙ্ক্ষিত কেউ এলে তাদের খাবারের সাথে ইঁদুর ফ্রাই মিশিয়ে দিই।’

‘ইয়াক! এত জেলাস কেন তুমি?’

‘এখন আবার জেলাসির কী করলাম?’

‘ভেবেছিলে আমি একা খাব। তাই না? ধরো এবার তুমি খাও। ইঁদুর ফ্রাই আমি একা খাব কেন? তোমাকেও খেতে হবে।’ শিহরণ ছোঁয়ার হাত ধরে তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, আমি নিজেই খাইয়ে দিচ্ছি।’

‘কেন এসেছ?’

‘বললাম তো একবার।’

‘আমি আবার প্রশ্ন করেছি। এবার ঠিকঠাক উত্তর দাও।’

‘তোমাকে দেখতে।’

‘আমাকে কেন দেখতে হচ্ছে তোমার?’

‘কারণটা বুঝতে পারছ না?’

‘আমি বুঝতে চাই না। জানতে চাই।’

‘জানাতেই তো এলাম।’

আকাশে আজ তারার মেলা। পূর্ণ চাঁদটা যেন তার রুপালি আলো ছড়িয়ে আকাশের মাঝে থাকা সমস্ত তারাদের প্রতিনিধিত্ব করছে। শিহরণ অনেকটা জোর করেই খাইয়ে দিল ছোঁয়াকে। তারপর আয়েশ করে কফি খেল। এদিকে ছোঁয়া প্রচণ্ড রাগে মনে মনে ইচ্ছেমতো বকছে তাকে ।

কফি শেষে শিহরণ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বকা দেওয়া শেষ? না-কি আরও কিছু বাকি আছে?’

ছোঁয়া চমকে উঠে দাঁড়াল। শিহরণ তার সাথে করে আনা ফুলগুলো ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এগুলো তোমার জন্য। আমার মনের ভিতরের জমানো আবেগ শব্দবন্দি করে তোমাকে জানাতে এলাম ভালোবাসার প্রতীকের মাধ্যমে।’

ছোঁয়া হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল সহসা। বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম আওয়াজ হচ্ছে ক্রমাগত। মস্তিষ্কে ছুটোছুটি করছে অসংখ্য প্রশ্নের ঝাঁক। এতদিনের চাওয়া কি তবে পূর্ণতা পেতে চলেছে? তার মাথা ধরে এলো মুহূর্তেই। নিজেকে ধাতস্থ করতে কিছুটা সময় লাগল তার। পরক্ষণেই নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে প্রশ্ন করল, ‘কী বলতে চাইছ তুমি?’

_____________________

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩৭

শিহরণ ছোঁয়ার দু’হাত আলতো করে ধরে বলল, ‘ভালোবাসি।’

শিহরণের মুখে ভালোবাসি শব্দটা শুনে ছোঁয়ার চোখ ভিজে এলো। এত দীর্ঘ অপেক্ষার পরে এই শব্দটা শিহরণের মুখ থেকে শুনতে পেয়ে সে দিশেহারা হয়ে পড়ল। আচমকাই কাঁদতে শুরু করল সে। শিহরণ প্রশ্ন করল, ‘কাঁদছ কেন?’

শিহরণের প্রশ্ন শুনে ছোঁয়ার কান্নার দমক যেন বেড়ে গেল। তাতে শিহরণ কিছুটা ভড়কে গেল। তার মনে বেশ কিছু অযাচিত প্রশ্নের উদয় হলো। প্রথমেই উদয় হলো, ‘তবে কি তার এত দিনের ধারণা ভুল ছিল? তবে কি ছোঁয়া অতলকে ভালোবাসে?’

মস্তিষ্কে এইসব অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের উদয়ে শিহরণ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ল মুহূর্তেই। সন্দিগ্ধ গলায় বলল, ‘তুমি কাঁদছ কেন?’ পরক্ষণেই নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল, ‘তুমি কি অন্য কাউকে পছন্দ করো?’

ছোঁয়ার কান্নার বেগ আরও একধাপ বেড়ে গেল। শিহরণের ইচ্ছে করছে নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে। তিরিক্ষি মেজাজে নিয়ে অধৈর্য গলায় সে বলল, ‘কী হলো! তোমাকে তো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করা মেয়েদের মতো মনে হয়নি কখনও। কাঁদছ কেন সেটা তো বলো।’

ছোঁয়া নিরুত্তর। শিহরণ এবার নিজের চোয়াল শক্ত করে আড়ষ্ট গলায় প্রশ্ন করল, ‘তুমি কি অতলকে ভালোবাসো?’

ছোঁয়া ক্ষুব্ধ চোখে শিহরণের দিকে চাইল। তারপর আচমকাই শিহরণের বুকের উপর কয়েক দফা কিল ঘুসি বসিয়ে দিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি কাকে ভালোবাসি জানো না তুমি?’

শিহরণের মনে হলো তার বুকের উপর থেকে বিশাল এক পাথর সরে গেল। তার মনটা আনন্দে নেচে উঠল মুহূর্তেই। হৃদয়ের গহীনে লুকানো সমস্ত বিষাদ আনন্দে পরিণত হয়ে গেল। মেঘবতী আকাশের জমানো মেঘ যেন বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল আর তার হৃদয় এক অব্যক্ত ও দুর্জ্ঞেয় প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল হাসির রেখা। নিজের ভালোলাগার সমস্ত অনুভূতি লুকিয়ে কৌতুক মিশ্রিত কণ্ঠে সে বলল,
‘আরে বাবা! না বললে জানবো কী করে?’

‘ডায়েরিটা পেয়েছ না? ডায়েরি পড়েও জানতে পারোনি?’ অভিযোগের সুরে বলল, ছোঁয়া।

‘আমি আবার কবে তোমার ডায়েরি পেলাম?’ শিহরণ লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল।

‘মিথ্যুক কোথাকার। সবসময় মিথ্যা কথা বলো। আমি তো জানি আমার দিকে চুপিচুপি নজর রাখা মানুষটা তুমি ছিলে।’

শিহরণ চরম বিস্ময়াভূত হলো। বলল, ‘কে বলেছে এসব?’

‘তুমি নিজেকে কি ভাবো? আমি কিছুই বুঝতে পারি না, কিছুই জানতে পারব না ভেবেছ।’

শিহরণ মনে মনে মায়াকে এক প্রস্থ বকা ঝকা করল। বিড়বিড় করে বলল, ‘এটা নিশ্চয়ই মায়ার কাজ হবে।’
তারপর ধৈর্যচ্যুত হয়ে বলল, ‘আমার উত্তর পেলাম না তো।’

ছোঁয়া শিহরণকে ছেড়ে দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, ‘আমি তো তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই। আবার বলো তারপর ভেবে দেখব।’

শিহরণ আবারও গোলাপফুলগুলো ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভালোবাসি প্রিয়তা। অনেক বেশি ভালোবাসি।’

ছোঁয়া এবার ফুলগুলো হাতে নিয়ে আবারও শিহরণকে জড়িয়ে ধরল। ইচ্ছেমতো কাঁদতে শুরু করল। শিহরণ বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে তার বাহুবন্ধনে অবদ্ধ করল ছোঁয়াকে। ছোঁয়ার চোখের জলে এদিকে শিহরণের শার্টের উপরের অংশ খানিকটা ভিজে গেছে। তা অনুভব করতে পেরে শিহরণ দুষ্টুমির স্বরে বলল, ‘তোমার চোখের জল দিয়েই কি আমাকে গোসল করিয়ে দিবে?’

ছোঁয়া শিহরণের কথার উত্তর না দিয়ে বলল, ‘আমি তোমার উপর খুব রাগ করেছি।’

‘কেন?’

‘এতদিন দূরে ছিলে কেন?’

‘এতদিন ভালোবাসতাম না তো।’

ছোঁয়া মুখ তুলে চাইল শিহরণের দিকে। আবছা আলোতে তার অভিব্যক্তি বোঝা যাচ্ছে না। ছোঁয়া আবারও কয়েকটা কিল ঘুসি বসিয়ে দিল শিহরণের বুকে। শিহরণ তার হাত দুটো নিজের হাতে ধরে বলল, ‘আমি কি এখানে তোমার মাইর খেতে আসছি? সেই কখন থেকে মেরেই চলেছ। আমি ব্যথা পাই না বুঝি?’

ছোঁয়া কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, ‘মিথ্যুক। মিথ্যা কথা বলার উপর পি.এইচ.ডি করেছ। তাই না? তোমাকে আরও বেশি করে মারা উচিত। এত অল্পতে তোমার কিছুই হবে না।’

‘আমি কোথায় মিথ্যা বললাম?’

‘একদম চুপ থাকবে তুমি। আর কোনো কথা বলতে হবে না।’

‘যথাআজ্ঞা, প্রিয়তা।’

‘যথাআজ্ঞা না ছাই!’ রাগান্বিত কণ্ঠে বলল ছোঁয়া, ‘ আমার কথা একটা বারও ভাবলে না!’

‘কে বলল ভাবিনি?’

‘এই ভাবার কোনো দাম আছে?’ জিজ্ঞাসু চাউনিতে তাকাল ছোঁয়া শিহরণের দিকে। বলল, ‘ সবসময় ফিলোসফি মার্কা কথাবার্তা। আজকে দয়া করে নিজের কাছেই রাখো তোমার ফিলোসফি। এই ধরনের ফিলোসফি কার থেকে শিখেছ?’

‘ফিলোসফি আসলো কোথা থেকে?’ শিরহণ না বুঝার ভান করল।

‘এতদিন তুমি অনেক ফিলোসফি ঝেড়েছ। আসলে তুমি একটা স্টুপিড। অন্য সবার কাছে তোমার এইসব বক্তব্য ফিলোসফি হতে পারে আমার কাছে এই সবকিছু হলো তোমার স্টুপিডিটি।’

শিহরণ ছোঁয়ার কথায় আহত হবার ভান করে মুখটা অসহায়ের মতো করে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। মুখে রাজ্যের অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলে বলল,
‘আর কতো অপেক্ষা করতে হবে আমায়? এবার তো বলো, ভালোবাসো কি না?’

‘তুমি মোটেই অপেক্ষা করোনি। অপেক্ষা করেছি আমি। এবার তোমার অপেক্ষার পালা।’

‘তার মানে তুমি বলবে না?’

‘একদম না।’ ছোঁয়ার একগুঁয়ে উত্তর।

‘ঠিক আছে। তাহলে আমিও আজকে তোমার বাসা থেকে যাচ্ছি না। এখানেই থাকব আজকে।’ শিহরণও নাছোড়বান্দার মতো করে বলল।

‘ঠিক আছে থাকো। আমার কোনো অসুবিধা নাই। এতক্ষণ নুডলস খেয়েছ। এখন বারান্দায় বসে বসে মশার কামড় খাবে।’ এটুকু বলে ছোঁয়া রুমে ঢুকে পড়ল।

‘উত্তর না শুনে আমি আজ কোথাও যাব না। বলে দিলাম কিন্তু।’ জেদী গলায় বলল, শিহরণ।

‘আমিও উত্তর দেব না। অপেক্ষা করাব তোমায়। এতদিন আমাকে অপেক্ষা করিয়েছ এবার তোমার পালা।’ মৃদু চেঁচিয়ে বলল, ছোঁয়া।

‘একটা নিষ্ঠুর মেয়েকে আমি ভালোবেসেছি।’ ব্যথিত কণ্ঠে বলল, শিহরণ।

ছোঁয়া এবার ব্যালকনির দরজা বন্ধ করে দিল। শিহরণ কিছুক্ষণ দরজা ধাক্কাল। ছোঁয়া এবারও চেঁচিয়ে বলল, ‘কোনো লাভ নেই। অপেক্ষা তোমায় করতেই হবে।’

‘তুমি যে এত নিষ্ঠুর, হৃদয়হীনা তা তো জানা ছিল না।’ আহত কণ্ঠে বলল, শিহরণ।

‘আজ তো জানলে। তাই না? আমার চাইতে তুমি অনেক বেশি নিষ্ঠুর, নির্দয়, হঠকারী, একটা স্টুপিড।’

‘আর কিছু বাকি থাকলে সেগুলোও বলে ফেল। সবটা একবারে শুনেই যাই।’

‘আজকে আর বলতে ইচ্ছে করছে না। ঘুম পাচ্ছে আমার। একে তো আমার সুন্দর ঘুমটা নষ্ট করছ তার উপর আবার নিজের স্টুপিড মার্কা ফিলোসফি ঝাড়তে আসছে। হুহ্! এসবে আমি গলে যাব না। বলে দিলাম।’

শিহরণ বেশ কিছুক্ষণ বসে রইল বারান্দায়। বিড়বিড় করে নিজের ভাগ্যকে গালি দিল। মায়াকেও বকল কিছুক্ষণ। তারপর চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে রইল বেশকিছুক্ষণ। হঠাৎ পরপর কয়েক দফা মশার কামড়ে লাফিয়ে উঠল। বিড়বিড় করে বলল, ‘ব্যাটা, মশা! তোরাও দেখছি খুব নিষ্ঠুর। অসহায় কাউকে দেখতেই ঝাপিয়ে পড়লি!’

মশার জ্বালায় বসে থাকতে না পেরে উঠে পায়চারি শুরু করল। তারপর ছোঁয়ার দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু যাইনি।’

ছোঁয়া নিরুত্তর। শিহরণ আবার বসে পড়ল। দু’হাতে নিজের চুল টেনে ধরল। তারপর আবার উঠে দাঁড়াল। মনে মনে ভাবল, ‘আজ বরফ গলবে না মনে হচ্ছে।’ রেলিং বেয়ে নামার চেষ্টা করার সময় তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সাথে সাথেই তা বাস্তবায়িত করার কাজে লেগে পড়ল।

রেলিংয়ের বাইরে এসে এক পা নিচে রেখে ব্যথা পাবার ভান করে আহ্ শব্দে চিৎকার করে উঠল। আর্তনাদ করে বলল, ‘আহ্! আমার পা-টা আজ গেল রে! নির্দয়, নিষ্ঠুর প্রাণীর কারণে আজ আমার পা-টা আহত হলো!’

শিহরণের আর্তনাদ শুনতে পেয়ে ছোঁয়া সাথে সাথে দরজা খুলে বলল, ‘কী হয়েছে? কোথায় ব্যথা পেয়েছ?’

শিহরণ মুখে হাসি ঝুলিয়ে তাকিয়ে থাকল ছোঁয়ার দিকে। মনে মনে ভাবল, ‘বাহ্! এই নিঞ্জা টেকনিক তো বেশ কাজে আসল।’

‘এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে কি দেখছ?’

‘আমার উত্তর?’ তারপর ডান পা-টা উঠানোর সময় আহ্ শব্দ করে পুনরায় আর্তনাদ করে উঠল।

ছোঁয়া বলল, ‘সাবধানে করো না। এতটা কেয়ারলেস কেন তুমি?’

‘এবার তো বলো।’

‘এই উত্তর কি দিতেই হবে? তুমি বুঝতে পারো না?’

‘তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।’

‘আগে এখান থেকে নামো। চেয়ারে বসে কোথায় ব্যথা পেয়েছ আমাকে দেখাও।’

‘আগে উত্তর শুনতে চাই প্রিয়তা।’

‘ভালোবাসি তো। এবার হয়েছে?’

‘মনে হলো আমি তোমার মাথায় গান পয়েন্ট রেখে ভালোবাসি কথাটা বলালাম।’ মুখ বাঁকিয়ে কথা বলেই শিহরণ মুখটা ঘুরিয়ে নিল।

‘ভালোবাসতাম, ভালোবাসি এবং ভবিষ্যতেও তোমাকেই ভালোবাসব।’

শিহরণ প্রশস্ত হাসল। বলল, ‘তাহলে আমাকে বকতে কেন? ডায়েরিতে আমার কত শত বিচ্ছিরি ছবি এঁকেছ। তোমার আঁকার হাত জঘন্য, প্রিয়তা। আমার সুন্দর মুখটাকে কি এক বিচ্ছিরি কার্টুন হিসেবে এঁকেছ।’

‘তুমি আমার ডায়েরি নিয়েছ?’

‘একদম না। আমি কেন ডায়েরি নিতে যাব?’ হঠাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,’ ওয়েট, তারমানে সত্যিই তুমি আমার ছবি একেছ?

‘ওসব তো রাগের মাথায় আঁকা।’ ছোঁয়া বলেই জিহ্বায় কামড় দিল।

‘হুম, চুরি ধরা পড়েছে। আর লুকিয়ে লাভ নেই। এই না-কি ভালোবাসা! ভালোবাসায় মানুষ প্রিয়জনের সুন্দর ছবি আঁকে আর তুমি আমার সুকুমার মুখশ্রীকে কী যে বানিয়েছ আল্লাহ মালুম!

‘অতটাও তো খারাপ হয়নি।’

শিহরণ মনে মনে বলল,’উঁহু! তোমাকে পুরস্কৃত করার মতো আর্ট হয়েছে।’

___________________________________

মোহনা, ফাহমি, আর রাদিদ চলে যাবার পরে প্রিয় নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে বসে থাকল অনেকক্ষণ। তার মাথায় আসছে না সে কীভাবে সবকিছু কনফেস করবে। শিহরণ আর অতল ওকে ক্ষমা করবে কি না সেই বিষয়েও সে যথেষ্ট সন্দিহান হয়ে পড়েছে।

এমন দ্বিধান্বিত অবস্থায় তার বন্ধু জিহানের কথা মনে পড়ল। সে ঝটপট জিহানকে ভিডিয়ো কল করল।

‘হেই! হোয়াটস আপ?’

‘আমি কী করব বুঝতে পারছি না, জিহান!’

‘হেই! হোয়াট হ্যাপেন্ড? টেল মি।’

‘জিহান, তুমি তো সবকিছুই জানো। আমি হঠকারিতা করে আমার বন্ধুদের জীবন বিশৃঙ্খল করে ফেলেছিলাম। এখন আমি সবকিছু কীভাবে ঠিক করব? প্লিজ হেল্প মি।’

‘ইয়াহ্! বিপদে পড়ে জিহানকে কল করা হয়েছে? এর আগে আমার কল কিন্তু রিসিভ করা হয়নি।’

‘জিহান, আমি সিরিয়াস। আমার সত্যিই তোমার সাহায্য লাগবে।’

‘তুমি ওদের সাথে দেখা করে সব কথা এক নিঃশ্বাসে বলে ফেল। তোমাদের বন্ধুদের সম্পর্কে তুমি আমাকে যা বলেছিলে তাতে আমার মনে হয় তারা তোমাকে মাফ করে দেবার সম্ভাবনাই বেশি।’

‘আমি ওদের সামনে কী করে দাঁড়াব? আমার খুব ভয় হচ্ছে জিহান।’

‘উগ্র আচরণ আর হঠকারিতা করার সময় মনে থাকে না?’

‘ঠিক আছে। তুমিও আমাকে সাহায্য করবে না। বুঝতে পেরেছি।’

‘হেই! আই ওয়াজ জাস্ট কিডিং।’

‘বাট ইট ওয়াজ ট্রু।’

‘লেট মি থিংক, ডিয়ার।’

‘মেক ইট ফাস্ট।’

‘এক কাজ করো। তুমি চিঠি লিখেও জানিয়ে দাও।’

‘সিমস্ বেটার।’

‘কার বুদ্ধি দেখতে হবে না?’

‘জিহান, আই মিসড ইউ আ লট।’

‘মি টু, প্রিয়।’

‘জিহান, তুমি কি আসবে?’

‘নো, আ’ম বিজি উয়িথ মাই বিজনেস ইস্যুস। ইউ নো রাইট?’

‘ইয়াহ্! থ্যাঙ্কস আ লট।’

প্রিয় জিহানের সাথে কথা শেষ করে চিঠি লিখতে বসে গেল। শিহরণ আর অতল দুজনের জন্যই দুটো চিঠি লিখল সে। চিঠি লিখা শেষে আবারও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ল সে। তার ভাবনাতে বারবার আসছে অতল আর শিহরণ কি তাকে ক্ষমা করবে?
___________________________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে