#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩২
ভীষণ ক্লান্ত থাকায় সকালে ঘুম থেকে উঠতে কিছুটা দেরি হয়ে গেল রাদিদের। আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠল অনিচ্ছাসত্ত্বেও। ফাইজা বেগম নিজের রুমে আধশোয়া হয়ে বসেছিলেন। সকালের নামাজ শেষে মর্নিং ওয়াক করে এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। তার শরীরটা এই ভালো তো এই খারাপ। তবে ইদানিং মর্নিং ওয়াকটা বেশ কাজে দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে তার। এছাড়া বিশ্রামই এখন তার নিত্যসঙ্গী। বিশ্রাম না নিলে তার বড়ো খোকা ভীষণ কষ্ট পায় তিনি তা বুঝতে পারেন। সেই কারণেই শুয়ে বসে কাটান তিনি। কিন্তু কাজ ছাড়া তার ভালো লাগে না। তাও ছেলে যাতে খুশি থাকে সেই প্রচেষ্টায় ছেলের সামনে কাজ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। ঘুমো ঘুমো চোখে হাঁটতে হাঁটতে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে রাদিদকে ব্রাশ করতে দেখে ফাইজা বেগম শোয়া থেকে উঠে ড্রয়িং রুমে এলেন। তারপর একটা চেয়ার টেনে বসে শান্ত স্বরে বললেন, ‘বড়ো খোকা! আজ না হয় দোকানে যাস না। আরেকটু ঘুমিয়ে নে। আজকে আবির দোকান সামলাবে।’
আবির টেবিলে বসে নাস্তা করছিল। মায়ের মুখে এমন কথা শুনে তার সকালের আমুদে মনটা মুহূর্তেই বিষণ্ন হয়ে গেল। মায়ের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘আমার কলেজ আছে, আম্মু। আমি দোকান সামলাতে পারব না।’
রাদিদ ব্রাশ করা শেষে নিজের রুমে চলে গেল। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। তাই দ্রুত একটা শার্ট গায়ে চাপিয়ে দোকানের জন্য ছুটতে হবে।
পিউ একটা পাউরুটির টুকরোতে কামড় দিয়ে প্রতিবাদের সুরে বলল, ‘কেন পারবে না? বড়ো মামা তো সবসময় একা হাতে সবকিছু সামলায়। তুমি না হয় একদিন করলে। তাতে এমন কী ক্ষতি হবে তোমার?’ আবির ওর দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। পিউ সেই দৃষ্টির তোয়াক্কা না করে হাত নেড়ে নেড়ে বিজ্ঞের মতো করে বলল, ‘একদিন কলেজে না গেলে তেমন ক্ষতি হয় না। দেখো না যখন আমার জ্বর হয় তখন আমিও একদিন দুইদিন স্কুলে যাই না।’
সাবরিনা আর আবির পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। পিউকে চোখ রাঙিয়ে আবির বলল, ‘এই তুই বাচ্চা মেয়ে এতো পাকনা পাকনা কথা বলিস কেন? তোকে এখানে কথা বলতে কে বলছে?’
পিউ বলল, ‘আমি তো খারাপ কথা বলিনি।’ ফাইজা বেগমের হাত ধরে নাড়া দিয়ে বলল, ‘ও নানু! নানু, আমি কি ভুল কিছু বলেছি?’
সাবরিনা পিউর পাশেই বসেছিল। নীলা রান্নাঘরে চুলায় চা চড়িয়েছে। সাবরিনা নীলাকে উদ্দেশ্য করে
মৃদু চেঁচিয়ে বলল, ‘মেয়েকে এগুলো শেখাচ্ছ? মেয়েটাকে আমাদের দু’জনের বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছ। আমরা কি কিছু বুঝতে পারি না? সবকিছুই দেখছি আর বুঝতেও পারছি।’
নীলা চায়ের ট্রে হাতে আসতে আসতে পিউর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পিউ! তোমাকে না বলেছি বড়োদের মাঝে কথা বলবে না?’
মায়ের কথা যেন পিউর কানেই ঢুকল না। সে অনুযোগের সুরে সাবরিনাকে বলল, ‘খালামণি! তুমিও ছোট মামার মতো খুব পচা। বাসার সব কাজ মা করে । তুমি একটা কাজও করো না। মাকে একটু সাহায্যও করো না।’
সাবরিনা ক্রোধান্বিত হয়ে পিউর পিঠে একটা কিল দিল। পিউ তারস্বরে কেঁদে উঠল । তার কান্নার স্বরে শুনে রাদিদ নিজের রুম থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। পিউ কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেল রাদিদের রুমের দিকে। পিউ দরজার কাছাকাছি যেতেই রাদিদ পিউকে কোলে তুলে নিল। পিউকে শান্ত করার জন্য বলল, ‘কী হয়েছে, পিউ? আমার চ্যাম্প কাঁদছে কেন? কে মেরেছে? কেউ কি বকেছে?’
নীলা প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল, ‘কিচ্ছু হয়নি ভাই। আমি একটু ধমকে বলেছি তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করতে তাই কাঁদছে।’
রাদিদ পিউর মুখটা তুলে প্রশ্ন করল, ‘পিউ! মা কি সত্যি বলছে?’
পিউ এপাশ ওপাশ মাথা দুলাল। পিউর কান্নার দমক এবার আরও বেড়ে গেল। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘খালামণি মেরেছে।’ এটুকু বলেই পিউ আবারও কাঁদতে শুরু করল।
রাদিদ চোখ রাঙিয়ে তাকাল আবির আর সাবরিনার দিকে। তারা মাথা নিচু করে আছে। রাদিদ পুরো ঘটনা আন্দাজ করে ফেলল। বলল,’তোরা কী আমাকে গাধা ভাবিস?’
আবির আর সাবরিনা থতমত খেয়ে গেল। মাথা উঁচু করে একবার চাইল রাদিদের দিকে। পরে আবার মাথা নিচু করে ফেলল। রাদিদ আবারও বলল, ‘যদি আমাকে গাধা ভেবে থাকিস তাহলে ভুল ভাবছিস। তোদের সবকিছুই আমি জানি। আমি জানি তোরা দু’জন বাসায় কেমন আচরণ করিস। আমি জানি তোরা দুজন আপাকে তাচ্ছিল্য করে কথা বলিস। আমি এটাও জানি তোরা আপাকে বারবার খোঁটা দিস। এটাও আমার কাছে অজানা নয় যে যে মাকে তোরা ভালোবাসিস না।’
‘এসব কী বলছিস ভাইয়া?’ বিস্ময়াভূত হয়ে সমস্বরে প্রশ্ন করল আবির ও সাবরিনা।
‘আমি ঠিকই বলছি। আজকে তোরা সমস্ত সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিস। একটা বাচ্চাকে কীভাবে তোরা ধমকাতে পারিস? কীভাবে ওকে মারতে পারলি? একটুও মায়া হলো না ওর প্রতি? আমি সত্যিই ভেবে পাই না। আর আপা কি শুধু আমার আপা? মা কি শুধু আমার মা? মা আর আপা কি তোদের কেউ না? নিজেকে ভালোবাসাটাই কি জীবন? একবার আশেপাশের মানুষগুলোকে ভালোবেসে দেখ তোদের এই সব তুচ্ছ ও অকারণে করা অভিযোগ আর থাকবে না। ভালোবাসতে না পারিস চেষ্টা তো করে দেখতে পারিস। একবার চেষ্টা করেই দেখ না।’ একসাথে এত কথা বলাতে রাদিদ যেন হাঁপিয়ে উঠল। তাকে বড়ো বেশি বিপন্ন দেখাল।
ফাইজা বেগম নীরবে চোখের জল ফেলছেন। শাড়ির আঁচলে মুছেই চলেছেন অবাধ্য অশ্রু ধারা। নীলার চোখেও অনভিপ্রেত অশ্রু। আবির আর সাবরিনা আগের মতোই মাথা নিচু করেই আছে।
রাদিদ আবারও বলতে শুরু করল, ‘আপাকে যেই বিষয়টা বলে বারবার হেয় করিস। সেটা যদি কখনও তোদের সাথে হয় তখন কী করবি? একজন বিপন্ন, অসহায়, কষ্টে জর্জরিত মানুষকে বিচার করার আগে সেই মানুষটার জায়গায় নিজেকে রেখে বিচার করবি। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে। আমি তো একসময় তোদের মতোই ছিলাম। তাই না? আমি বদলে যেতে পারলে তোরা কেন পারবি না? আব্বা আর আম্মার শিক্ষাটাকে মিথ্যা করে দিস না। এটা তোদের দুজনের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ।’
পিউ এতক্ষণ রাদিদের মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ রাদিদ তার গালে পিউর ছোট্ট হাতের স্পর্শ পেল। সে বুঝতে পারল নিজের অজান্তেই চোখের আয়না মনের আয়নাকে প্রদর্শন করে ফেলেছে।হৃদয়ের রক্তক্ষরণের রক্তিম লাল বর্ণ, বর্ণহীন জলের ন্যায় গড়িয়ে পড়ার চেষ্টায় তৎপর হয়ে আছে।
পিউর দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে রাদিদ বলল, ‘চ্যাম্প!
দেখ বকে দিয়েছি। এবার একটু ম্যাজিক দেখা তো।’
পিউ মিষ্টি হাসল। রাদিদের মনে হলো পিউর ওই হাসিটা পৃথিবীর সবচাইতে দামী উপহার তার জন্য। ওই হাসির জন্য ও সব করতে পারে। সব! ওই হাসিটা চিরদিন অম্লান রাখার জন্য তাকে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। এই হাসিটাই তার জন্য ম্যাজিক স্বরূপ।
_______________
সকাল থেকেই ব্যস্ত সাব্বির আহমেদ। অফিসের কাজে বাইরে যেতে হয়েছিল বলে সব দায়িত্ব শিহরণকে দিয়েছিলেন। শিহরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন কতটুকু করেছে তা দেখতেই সকাল সকাল আশ্রমের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। আসার পরে তিনি বিস্ময়াভূত হয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। শিহরণ তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। বাবাকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে একটু বিব্রত হয়ে পড়ল। জানতে চাইল, ‘কোনো সমস্যা হয়েছে আব্বু?’
সাব্বির আহমেদ জবাব দিলেন না। নিশ্চুপ থেকে সমস্ত আয়োজন নিজে পর্যবেক্ষণ করলেন। অবশেষে এখানের সমস্ত আয়োজন এত নিখুঁত ও পরিপাটি দেখে তিনি তার নিজের পুত্রের উপর গর্ববোধ করে সহাস্যে বললেন, ‘আ’ম রিয়েলি প্রাউড অফ ইউ মাই সান।’
শিহরণের চোখ আর মুখের অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছিল বাবার সন্তুষ্টিতে সে দারুণ খুশি হয়েছে। স্মিত হেসে বলল, ‘আব্বু! এটা আমরা সবাই মিলে করেছি। তাই এই প্রশংসার যোগ্য শুধু আমি না বরং আমরা সবাই। এমনকি তুমিও।’
সাব্বির আহমেদ গলা খাঁকারি দিয়ে জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা, সব না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমি কীভাবে এই প্রশংসার যোগ্য তা তো বুঝলাম না!’
শিহরণ বাবার পাশে বসে বলল, ‘আব্বু! কোনো একটি কাজে সফলতা পাবার প্রধান শর্ত আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস না থাকলে একজন যোগ্য ব্যক্তিও হেরে যেতে পারে। আত্মবিশ্বাস থাকলে জীবনে জেতার জন্য অন্যসব গুণ অর্জন করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমার আত্মবিশ্বাস সৃষ্টিকারী তুমি আব্বু। আমার আত্মবিশ্বাস তৈরীতে তোমার ভূমিকা অন্যতম এবং অনন্য। আমার প্রতি তোমার আস্থার কারণে আমি সবসময় ভালো কিছু করার চেষ্টায় থাকি। আর তোমার দেওয়া অনুপ্রেরণা ও সেই অনুপ্রেরণার বদৌলতে আমার মধ্যে জাগ্রত করা আত্মবিশ্বাসের দরুণ আমি কাজে সফলতা লাভ করতে পারি।’
শিহরণ একটু থেমে বাবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। তারপর আবার বলা শুরু করল, ‘আব্বু! তোমার মনে আছে সপ্তম শ্রেণীতে থাকাকালীন তুমি আমাকে একটা কথা বলেছিলে?’
‘কোন কথাটার কথা বলছ আব্বু?’ সাব্বির আহমেদ মনে করতে না পেরে জানতে চাইলেন।
‘আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়তাম তখনকার কথা। সেবার ম্যাথ পরীক্ষাটা খুব খারাপ হয়েছিল। আমি বাসায় আসার পরে খুব মন খারাপ করে ছিলাম। সারাদিন কিচ্ছু খাইনি। এমনকি রাতের খাবারও না খেয়ে নিজের রুমে বসেছিলাম। সেদিন তুমি আমাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলে আমি পাশ করব। অথচ আমি সেই পরীক্ষাতে মাত্র চল্লিশ মার্ক উত্তর করতে পেরেছিলাম। কী দারুণ সব যুক্তি দিয়েছিলে তুমি আমাকে আশ্বস্ত করতে। তোমার সেই আশ্বাস আমার মনের মধ্যে বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল। এর পর থেকেই আমি সবকিছুকে ইতিবাচকভাবে দেখতে শুরু করেছিলাম। ব্যস! সবকিছু সহজ হয়ে গেল আমার জন্য।’
‘হুম। এবার মনে পড়েছে।’ সাব্বির আহমেদ প্রদীপ্ত কণ্ঠে বললেন।
শিহরণ মুচকি হাসল। সাব্বির আহমেদ বেশ কিছুক্ষণ চেয়ারে ঝিম মেরে বসে থাকলেন। তারপর চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আচমকা শিহরণকে বুকে টেনে নিলেন । পিঠে আলতোভাব হাত চাপড়ে বললেন, ‘আমার ছেলেটা যে এত বড়ো হয়ে গেছে তা তো খেয়ালই করলাম না।’
_________________________
#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩৩
মেহেরুন নাহার নিজের রুমে শুয়ে ছিলেন। অতল মায়ের রুমে ঢুকে মাকে বিশ্রাম নিতে দেখেই আবার বের হবার জন্য উদ্যত হতে গেলেই মেহেরুন নাহার ডেকে বললেন, ‘আম্মুর সাথে দেখা না করেই চলে যাচ্ছিস?’
অতল মায়ের কথা শুনে ঘুরে দাঁড়াল। মেহেরুন নাহার উঠে বসেছেন। অতল বাচ্চাদের মতো সোজা গিয়ে মায়ের কোলে মাথা রাখল। বিষণ্ন কণ্ঠে বলল, ‘আম্মু! আমাকে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে? আমার না এখন ঘুম আসে না, আম্মু। প্রায় রাতে দেরি করে ঘুমাতে হয়। একটু ঘুম আসলেও আবার ঘুমটা ভেঙে যায়। এমন কেন হচ্ছে আমার সাথে আম্মু? আমি কার কী ক্ষতি করেছি?’
মেহেরুন নাহার অতলের কথা শুনেই বুঝতে পারলেন সবকিছু। তার ছেলেটার সবকিছু থেকেও নেই। বড্ড একা ছেলেটা। আর এই একাকীত্ব আর কষ্ট চেপে রাখার স্বভাবের কারণে ছেলেটা ডিপ্রেশনে ভুগছে তা তার কাছে স্বচ্ছ জলের ন্যায় স্পষ্ট।
তিনি ছেলেকে আশ্বস্ত করতে বললেন, ‘আমি এখন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। দেখবি ঠিক ঘুম চলে আসবে।’
‘আব্বু চলে আসলে তো তোমাকে আর আমাকে দু’জনকেই বকা দিবে!’ এটুকু বলেই অতল মায়ের কোল থেকে নিজের মাথাটা তুলে মায়ের হাত ধরে টেনে তুলতে চেয়ে বলল, ‘আমার রুমে চলো। তুমি আমার মাথাতে হাত বুলিয়ে দেবে আর আমি ঘুমাব।’
‘তোর আব্বু আজকে বাসায় আসবে না। তার বন্ধুর বাসায় গিয়েছেন কোনো একটা কাজের জন্য। আজকে সম্ভবত সেখানেই থাকবেন। আর আসলেও সমস্যা নাই। তুই ঘুমিয়ে পড়। আমি তোকে ডেকে তুলব।’
অতল পুনরায় মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। ব্যথাতুর গলায় প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, আম্মু! আব্বু আমাকে ভালোবাসে না কেন?’
অতলের প্রশ্ন শুনে মেহেরুন নাহারের বুকটা ধ্বক করে উঠল। তিনি ছেলেকে সান্ত্বনা দিতে বললেন, ‘কে বলেছে ভালোবাসে না? অবশ্যই ভালোবাসে। তোর আব্বু উপর থেকে শক্ত হলেও ভেতর থেকে খুব নরম। তুই তো জানিস । তাই না?’
‘না, আম্মু! আব্বু সত্যিই আমাকে ভালোবাসে না। তিনি আমাকে অপছন্দ করেন।’ অতল নিজেকে সংশোধন করে বলল, ‘ঠিক অপছন্দ নয় আম্মু আসলে আব্বু আমাকে ঘৃণা করেন। মনে হয় আমি তার উপর একটা বোঝা ছাড়া আর কিছু না।’
মেহেরুন নাহার অতলকে ধমক দেবার সুরে বললেন,
‘এসব অবান্তর চিন্তা কেন করছিস? এজন্যই তোর ঘুম আসে না। উল্টাপাল্টা চিন্তার কারণে তোর ঘুম কম হচ্ছে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিস।’
‘আচ্ছা, আম্মু! আমি কি সত্যিই খুব খারাপ?’
‘আমার আব্বুর চাইতে ভালো কোনো ছেলে আর নেই। তুই পৃথিবীর সবচাইতে বেশি ভালো সন্তান।’
‘আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছ আম্মু?’ অতল মায়ের দিকে চাইল। মলিন কণ্ঠে বলল, ‘আমার না সান্ত্বনা লাগবে না আম্মু। আমি সত্যিটা জানতে চাই। তোমরা সবাই মিলে আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছ। আমার তা জানতে হবে। জানতেই হবে।’
এটুকু বলে অতল মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তার এখন একা থাকতে হবে। সে কারও সামনে নিজের দুর্বলতা দেখাতে চায় না। কারও সামনেই নয়।
মেহেরুন নাহার চেঁচিয়ে বললেন, ‘অতল! আমার কথা তো শুনে যা।’
অতল শুনল না। একবার ফিরেও তাকাল না। পৃথিবীর সবকিছুই তার কাছে বিষাক্ত লাগছে।
_______________________
নওশীন হক ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে মাথায় আইসপ্যাক দিচ্ছেন। তিনি তার বড়ো মেয়েটাকে
আর সামলাতে পারছেন না । মেয়েটাকে শাসন করতে করতে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছেন। গতকাল সারাদিন আফরিন ঘরের বাইরে ছিল। এমনকি বাসায় এসেছে রাত দশটায়। সারাদিন কল করেও কোনো খোঁজ পেলেন না। প্রথমে কল কেটে দিয়েছে পরে মোবাইলটাই অফ করে রেখেছে। তার স্বামীকে এই বিষয়ে জানালেও তার কোনো হেলদোল ছিল না। অথচ মেয়ের কিছু হলেই তার স্বামী তাকেই দোষারোপ করবেন। এই বিষয়টাতে তিনি শতভাগ নিশ্চিত।
কী এক অসহ্য যন্ত্রণাতে তিনি দিন পার করছেন তা বলার বাইরে! আজকেও তিনি রান্নাঘরে থাকাকালীন আফরিন চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। মাথাটা ঠিক তখনই খারাপ হয়ে গেল। এখন মাথা ঠান্ডা করতেই আইসপ্যাকের শরণাপন্ন হলেন। নীরা মায়ের অবস্থা দেখে কলেজে যায়নি। মায়ের পাশে বসে নীরা বলল, ‘আম্মু! আপুর সাথে তুমি মাথা ঠান্ডা করে কথা বলো।’
‘তোর বোন কি আমার কথা শুনে? তোরা কেউ আমার কথা শুনিস না। আমি সারা জীবন কামলা খাটলাম। আর কিছু না। তোদের বাবাই যখন নিশ্চিতে আছে তখন আমি আর কিচ্ছু বলব না। সব চিন্তা কি আমার একার?’ ব্যথাতুর কণ্ঠে চেঁচিয়ে বললেন, নওশীন হক।
নীরা বলল, ‘আম্মু! এসব কেন বলছ শুধু শুধু?’
নীরার কথা শুনে নওশীন হক আরও বেশি তেতে উঠে বললেন, ‘এই তুই চুপ কর। আমার মাথা আর গরম করিস না। আমাকে এবার একটু শান্তিতে থাকতে দে।’
নীরা অসহায় বোধ করল। নীরবে প্রস্থান করল মায়ের সামনে থেকে। রুমে ঢুকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বাবাকে কল করল। মাহফুজ হক তখন মিটিং এ ব্যস্ত থাকায় কল রিসিভ করলেন না। নীরা কী করবে বুঝতে না পেরে শেষমেশ রাদিদকে কল করল। রাদিদও বারবার কল কেটে দিচ্ছে। নীরাও কম যায় না। রাদিদ যতবার কল কেটে দিচ্ছে সে ততবারই
জেদ করে কল করছে। অবশেষে রাদিদ কলটা রিসিভ করেই ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘তোর কি জীবনেও বুদ্ধিসুদ্ধি হবে না? আমি এতবার কল কেটে দিচ্ছি তারপরেও বারবার কল দিয়েই যাচ্ছিস। আমি রাখছি। এখন দোকানে আছি। পরে সময় পেলে কল করব।’
‘আরেহ্! আমার কথাটা তো একবার শুনবে না-কি?’
রাদিদ বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে? তাড়াতাড়ি বল। আমার সময় নাই।’
‘আম্মু কেমন যেন করছে রাদিদ ভাইয়া। আমি আম্মুকে সামলাতে পারছি না। প্লিজ তুমি একবার আসো। আপু খুব বিরক্ত করছে আম্মুকে। আম্মুর কথা একদম শুনে না।’ নীরা এক নিঃশ্বাসে সবটা বলে ফেলল।
‘ফুফা কোথায়?’
‘আব্বু তো অফিসে। আব্বুকে বলেও কোনো লাভ হয় না। তারপরেও কল করেছি। মনে হয় মিটিং এ আছে এখন। তাছাড়া আব্বুর তো আদরের মেয়ে আফরিন আপু। আমি খুব ভালো করেই জানি আব্বু আপুকে কিছুই বলবে না।’
‘সমস্যাটা কী?’ রাদিদ বলল, ব্যস্ত গলায়।
‘আম্মু বলেছে আপুর বিয়ে দিবে। সমস্যা তখন থেকেই শুরু। আপু কোনোভাবেই আম্মুর পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করবে না। এখন প্রচণ্ড উচ্ছৃঙ্খল আচরণ শুরু করেছে আপু। আমিও কথা বলতে পারছি না। আম্মুও কোনো কথাই বলতে পারছে না। কিছু বলতে গেলেই জিনিসপত্র ভাঙচুর করছে।’
‘আফরিন নিশ্চয়ই কোনো ছেলেকে পছন্দ করে। যাকে পছন্দ করে তার সাথে বিয়ে দিতে বল। তাহলেই তো ঝামেলা শেষ।’
‘ঝামেলা শেষ না ভাইয়া। আপু তো কিছু বলছেই না। খুব সমস্যা করছে বাসায়।’ এটুকু বলে থামল নীরা। তারপর অনুনয়ের স্বরে বলল, ‘ভাইয়া, প্লিজ তুমি একবার আসো। আম্মু যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন আমি কী করব?’
রাদিদ কিছুক্ষণ নীরব থেকে ভাবল। তারপর বলল, ‘আমাকে একটু সময় দে। একটু ভাবতে হবে আমার।’
‘এখন ভাবাভাবির সময় নাই ভাইয়া। তুমি প্লিজ আসো।’
‘আচ্ছা, তুই শান্ত হ। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসার চেষ্টা করব।’
নীরা খুশিতে আটখানা হয়ে বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। দেখো তোমার উপকারের কথা আমি কখনোই ভুলব না।’
রাদিদ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমি আসলেই তো আর ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে না। এখানে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কিছুই হয়নি। আমি ফুফুর জন্য আসছি।’
নীরা মৃদু স্বরে বলল, ‘আমি জানি তুমি কার জন্য আসছ।’
ফোনে কথা শেষ করে কিচেনে গেল নীরা। কফি মেকারে কফি বানাতে বানাতে বিড়বিড় করে বলল, ‘রাদিদ ভাইয়া, তুমি জানো তুমি আম্মুর জন্য আসছ। কিন্তু আমি তোমাকে এখানে আসতে বলার পেছনে আম্মুই একমাত্র কারণ নয়। আরও কারণ আছে। আশা করছি সেই কারণটা তোমার খুব পছন্দ হবে।’
__________________________
‘তোর শাড়ি পরা হয়েছে?’ ফাহমি প্রশ্ন করল, দরজায় হেলান দিয়ে।
মোহনা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গলার হারটা পরার চেষ্টা করছিল। আয়নাতে ফাহমির প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে সে মিষ্টি হাসল। বলল, ‘শাড়ি তো পরা হয়েছে। কিন্তু গয়নার হুকটা লাগাতে পারছি না।’
ফাহমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল মোহনার কাছে। প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, ‘ওটা তো তুই পারবি না। এই কাজটা শুধুই আমার।’
মোহনা বলল, ‘এত কথা বলছেন কেন? গয়নাটা পরতে সাহায্য করুন।’
ফাহমি গয়নাটা পরিয়ে দিয়েই মোহনাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধের উপর মুখ রেখে বলল, ‘তোর মুখ থেকে আপনি সম্বোধনটা শুনলে আমার কেন যেন নিজেকে পর পর মনে হয়। মনে হয় তোর আর আমার অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছে তাই তুই আমাকে সম্মান দিয়ে কথা বলছিস! তবে এই আপনি সম্বোধনটা শুনতে আমার বেশ লাগে যদিও কদাচিৎই তা আমার ভাগ্যে জুটে। সারাক্ষণ তো তুই তুকারি করেই বলিস।’
মোহনা ফাহমির কথা শুনে প্রশস্ত হাসল। ফাহমির চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল, ‘বিয়ে যখন হয়েছে তখন একটু আধটু সম্মান না দিলে কি চলে?’
‘এটা কি করলি? আমার চুল এলোমেলো করলি ক্যান? এখন কিন্তু আমি আবার চুল আঁচড়াতে পারব না। এই এলোমেলো চুল নিয়েই বেরোব।’
‘আমি যখন এলোমেলো করেছি তখন আমিই ঠিক করে দিব।’
‘কেমন অনুভূতি হচ্ছে?’ ফাহমি প্রশ্ন করল।
‘কোন বিষয়ে?’
‘এটাও আমাকে বলে দিতে হবে?’
‘দুর্জ্ঞেয়। আমি জাস্ট তোকে বলে বুঝাতে পারব না। আমার সত্যিই অনেক বেশি ভালো লাগছে। তুই যদি আম্মু আর আব্বুকে রাজী না করাতি তো আমাদের দেশে আসা সম্ভব হতো না।’
‘আমাকে তো এমনিতেই আসতে হতো। তো তোকে না নিয়ে চলে আসব সেটা ভাবলি কি করে?’
‘তোর এখানে আসার জন্য বিজনেস ইস্যু ছিল কিন্তু আমার তো ছিল না। তাই একটু টেনশনে ছিলাম আরকি। তবে তুই যে আমার চাওয়াকে প্রাধান্য দিবি
তা আমি জানতাম।’
‘মিথ্যে কথা এখন আর না বললেও হবে। আমার উপরে বিশ্বাস থাকলে মুখটাকে ওরকম শত বছরের দুঃখী মানুষের মতো বানাই রাখছিলি ক্যান?’
‘ওই আরকি একটু আধটু কষ্ট হচ্ছিল। তোরা সবাই আমাকে রেখে মজা করবি ভাবতেই আমার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছিল।’
ফাহমি ব্যঙ্গ করে বলল, ‘এই তোর বিশ্বাস? হুহ্!’
মোহনা ফাহমির একটা হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আরে ওটা বাদ দে তো। অনেকদিন পরে সবার সাথে দেখা হবে ভাবতেই মনে প্রাণে এক ধরনের শিহরণ ছড়িয়ে পড়ছে। ‘
‘শিহরণ! ওহ্, শিহরণের কারণেই তো আমাদের বাংলাদেশে আসা হলো। কত রিকুয়েস্ট করল সে। তারপর বাবা-মাকে রাজী করাল। পারেও বটেও সে। কনভিন্সিং পাওয়ার দারুণ! মাঝেমধ্যে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই ওর মানুষকে কনভিন্স করার ক্ষমতা দেখে।’ ফাহমি বলল, বিস্ময়ের সুরে।
‘দেখতে হবে না কার বন্ধু!’ মোহনা বলল, গর্ব করার ভঙ্গিতে।
‘উঁহু! একদম ঠিক বলিসনি। দেখতে হবে না কাদের বন্ধু! এরকম বলা উচিত ছিল।’ ফাহমি মোহনাকে সংশোধন করে দিল।
‘আচ্ছা, তোর কেমন লাগছে?’ মোহনা জানতে চাইল, ফাহমির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
‘আমার এখনও তেমন কিছু অনুভব হচ্ছে না। সবার সাথে দেখা করার পরে যদি কিছু ফিল হয় তবে তোকে জানাব। আর জানাতে হবেই বা কেন? তুই বুঝে নিতে পারবি না?’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। বুঝে নিব। এখন চল বের হই।’
মোহনা বের হতে নিলেই ফাহমি তার হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কাছাকাছি এনে বলল, ‘একটা জিনিস কম আছে।’
‘কী?’
‘তোর না টিপ খুব পছন্দ? আজকে পরিসনি কেন?’
মোহনা চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘ইয়ার্কি করছিস আমার সাথে? তুই জানিস না আমি এখন আর টিপ পরি না?’
‘ওপস্! ভুলে গেছিলাম।’
মোহনা আবারও বের হতে নিলে ফাহমি আবারও তার পথ আটকে দাঁড়ায়। মোহনা ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল, ‘আবার কী হলো?’
‘সকাল থেকেই আমি কিছু একটা মিস করছি। তুই মিস করছিস না?’
‘না তো। সব তো ঠিকই আছে।’
‘কিচ্ছু ঠিক নেই।’
‘কী ঠিক নেই?’
‘জানিস না তুই?’
‘জানি না বলেই তো জানতে চাইছি।’
‘আমার মর্নিং কিসেস পাইনি আজকে!’ ফাহমি অভিযোগের সুরে বলল।
মোহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘রাখ তোর মর্নিং কিস। এখন আর মর্নিং নাই। ভুলে যা।’
‘ভারি অন্যায় হচ্ছে এই অধমের প্রতি!’
‘মাঝেমধ্যে একটু অন্যায় না করলে তো তুই আমাদের স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক ছাড়াও যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে সেটা ভুলতে বসবি।’
‘আহা! কেন যে বন্ধুর প্রেমে পড়লাম!’ ফাহমি আক্ষেপ করে বলল, ‘আজ এরেঞ্জ ম্যারেজ করলে আমার বউ আমাকে আপনি আপনি করে করে দিন-রাত শুধু আমার ফারমায়েশ খাটতো।’
‘ঠিক আছে। তোর যখন এতই ইচ্ছে আরেকটা বিয়ে করে নিলেই পারিস।’
‘তোর কী হবে তখন?’
‘তুই আরেকটা বিয়ে করলে আমিও না-হয় তোর বিয়ে দেখে খুশি হয়ে আরেকটা বিয়ে করব।’
‘কী!’ ফাহমি বিস্মায়াভূত হয়ে বলল, ‘আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?’
‘বাহ্ রে! তুই আমাকে ছেড়ে যেতে পারবি আর আমি পারব না?’
ফাহমি মোহনার একটা হাত ধরে নিজের কাছে এনে সাবধানী গলায় বলল, ‘আর কক্ষণো আমাকে ছেড়ে যাবার কথা মুখে আনবি না। তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।’
মোহনা হাসল। ফাহমির দিকে বেশ কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। মোহনা লজ্জা পেয়ে ফাহমির বুকে মুখ লুকাল।
মোহনাকে লজ্জা পেতে দেখে ফাহমি বলল, ‘আরে আমার লজ্জাবতী বউ রে! তুই এত লজ্জা পাস জানতাম না তো।’
মোহনা ফাহমির আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলে ফাহমি আরও দৃঢ়ভাবে তাকে আবদ্ধ করে ফেলল তার বাহুবন্ধনে। মোহনা হাল ছেড়ে দিয়ে বাধ্য বউ হয়েছে মনে করে ফাহমি তার বাহুবন্ধন একটু হালকা করতেই মোহনা সুযোগ পেয়ে ইচ্ছেমতো কিল ঘুসি বসিয়ে দিল তার বুকের উপর।
ফাহমি তখন দুষ্টুমির স্বরে বলল, ‘ভালোবাসার অত্যাচার! খারাপ না।’
__________________________
#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩৪
পরদিনই রাদিদ ফুফুর বাসায় এসে পৌঁছাল। নওশীন হক তার এই দুঃসময়ে রাদিদকে কাছে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, ‘তুই এসেছিস? খুব ভালো করেছিস।’
রাদিদ ফুফুর কাছে বসল। নওশীন হক অভিযোগের সুরে বললেন, ‘এই পরিবারে কেউই আমার কথা শুনে না। আমি এখন কী করব বল তো?’
‘কী হয়েছে ফুফু? তুমি আমাকে পুরো ব্যাপারটা একটু বলো তো।’
‘কী আর হবে তোর বোন যা ইচ্ছে তাই করছে। আর তোর ফুফা আছে বিজনেস নিয়ে। সারা জীবন শুধু টাকা কামানোর ধান্দায় পরে থাকল। এদিকে বড়ো মেয়েটা যে উচ্ছন্নে যাচ্ছে তার কোনো খবর নাই।’
‘ফুফু, ফুফা তো সবকিছু তোমাদের জন্যই করছেন। এত রাগারাগি করো না। হালকা বিষয়টাকে গম্ভীরভাবে নিচ্ছ বলেই এতো ঝামেলা হচ্ছে।’
‘এই বিষয়টা তোর হালকা মনে হচ্ছে?’ চরম বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন নওশীন হক ।
‘অবশ্যই হালকা।’ রাদিদ জোর দিয়ে বলল।
‘কোন দিক থেকে তোর হালকা মনে হচ্ছে? আফরিনকে তুই চিনিস না। কার না কার পাল্লায় পড়ছে আল্লাহ জানে। কেমন পরিবারের ছেলের পাল্লায় পড়েছে সেটাও জানি না।’
‘এক্সেক্টলি! জানো না। জানো না তাই জানতে হবে। আফরিনের সাথে কথা বলতে হবে মাথা ঠান্ডা রেখে । যেরকম ছেলেই হবে হোক না কেন আগে তো জানতে হবে ছেলেটার সম্পর্কে। তারপর খোঁজখবর নিয়ে বিয়ে দিয়ে দাও। ব্যস! ঝামেলা শেষ।’
‘চিনি না জানি না এমন একটা ছেলের সাথে ধুম করে বিয়ে দিয়ে দিতে বলছিস?’
‘ফুফু! তুমিও না মাঝেমধ্যে একদম অবুঝের মতো আচরণ করো। চিনো না বলেই তো খোঁজ নিতে বলছি।’
‘মেয়েটা আমাকে কিছু জানালে তো!’
‘একটু মাথা ঠান্ডা করে কথা বলো। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি মাথা ঠান্ডা রেখেই কথা বলব। তুই গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি খাবার দিচ্ছি। দুপুরের খাবারের টাইম তো প্রায় শেষ হতে চলল।’
ফুফুর বাসায় প্রায় সময় যাতায়াত করার সুবাদে রাদিদের জন্য একটা রুম বরাদ্দ আছে। রাদিদ তার রুমে গিয়ে ওয়্যারড্রব থেকে জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে গেল শাওয়ার নিতে।
বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোলে নীরা মুখ ঝামটা মেরে বলল, ‘এই নীরাকে তুমি পাত্তা দিচ্ছ না তো । একদিন আমার কাছেই সবচাইতে বেশি কৃতজ্ঞ থাকবে। দেখে নিও।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। থাকব। কৃতজ্ঞ থাকা ভালো মানুষের লক্ষণ। আমি ভালো মানুষ হবার চেষ্টা করছি। সেটা সফল হলে তো আমিই বেশি খুশি হব।’ হাসতে হাসতে বলল, রাদিদ।
‘আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে তোমায়। রেডি থেকো। কোনো প্রকার বাহানা চলবে না।’ রাদিদকে আদেশ দেবার ভঙ্গিতে বলল, নীরা।
‘আরে আমার কাজ আছে তো। আমি কি এখানে এমনি এমনি এসেছি? হাতে আনেক কাজ নিয়ে এসেছি।’ রাদিদ মাথার চুল মুছতে মুছতে বলল।
‘আমি জানি তুমি একগাদা কাজ নিয়ে আসো সাথে করে। মানুষ এক ঢিলে বড়ো জোর দুই পাখি মারতে চায় আর তুমি এক ঢিলেই বহুপাখি মারতে চাও। কোনো বাহানাতেই কাজ হবে না। যেতেই হবে।’ নীরা হনহন করে বেরিয়ে গেল রাদিদের রুম থেকে।
‘আরে পাগলী আমার কথাটা তো শুনে যা।’ রাদিদ পেছন থেকে চিৎকার করে ডাকলেও সে শুনল না।
কিছুক্ষণ পর নীরা আবার আসল রাদিদের রুমে। বলল, ‘আজকে জার্নি করে এসেছ। খাও, দাও, আরাম করো। আজকেই তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। আমি জাস্ট তোমাকে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলেছি।’
নীরা রুম থেকে চলে যাবার পর রাদিদ রুমে বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করল। সে প্রতিবারই ঢাকায় আসে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। এবারও ভিন্ন নয়। হঠাৎ করেই তার নজরে পড়ল এর আগেরবার বৃদ্ধ দাদুটার কাছ থেকে নেওয়া ছাতাটা। কাজ ব্যস্ত থাকার দরুণ এই ছাতাটা আর দেওয়া হয়নি। রাদিদ ভাবল আজকেই ছাতাটা দেবার জন্য দাদুটার বাসায় যাবে।
_______________________________
প্রিয় বাংলাদেশে এসেছে বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে। পড়াশোনা করার জন্য দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছিল। পোস্ট গ্রাজুয়েট শেষে তার ভার্সিটিতে শিক্ষকতা করার সুযোগ পেলেও শেষ পর্যন্ত তা করা হয়নি। ছোটোবেলা থেকেই তার ফ্যাশন ডিজাইনিং এর উপর ভীষণ দুর্বলতা থাকায় পড়ালেখা শেষ করে ফ্যাশন ডিজাইনিংকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে।দেশে আসবার কারণ তার দাদু। দাদুর না-কি তাকে দেখতে খুব মন চাইছিল। দাদুর অসুস্থতার কারণে বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেছে সে। অবশ্য নিজ ইচ্ছায় পা রেখেছে বলার উপায় নেই। নিতান্ত বাধ্য হয়েই এসেছে। সবার কথা অগ্রাহ্য করতে পারলেও দাদুর প্রসঙ্গে প্রিয় খুবই দুর্বল। দাদুর অসুস্থতার কথা শুনে দেশের বাইরে থাকা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই শেষমেশ সাহস যুগিয়েছে দেশের মাটিতে পা রাখার।
প্রিয়র দাদু করিমুল ইসলাম বিছানায় শুয়ে আছেন। তার ছেলে ওয়াহিদুল ইসলাম তার পাশেই বসে আছেন। প্রিয় দাদুর রুমে প্রবেশ করতেই করিমুল ইসলাম ভাঙা গলায় ডাকলেন প্রিয়কে, ‘আমার কাছে আসো দাদু ভাই।’
দাদুকে এরকম অসুস্থ দেখে প্রিয়র খুব খারাপ লাগছে সে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে দাদুর পাশে বসল। বলল, ‘হ্যাঁ, দাদু বলো।’
‘কেমন আছ, দাদু ভাই?’
‘আমি ভালো আছি। কিন্তু আমি তার সাথে খুব রাগ করেছি।’
‘সে কী! কেন দাদু ভাই?’
‘তুমি হাসপাতালে যেতে চাইছ না তাই।’
‘হাসপাতালে যেতে হবে না। তুমি এসেছ এখন দেখবে আমি একদম সুস্থ হয়ে যাব।’
‘দাদু! আমি কি ওষুধ যে আমি আসার কারণে তুমি ভালো হয়ি যাবে?’
‘হ্যাঁ, তোমাকে না দেখতে পেয়েই তো আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি।’
‘বলি কি দাদু ভাই এবার আর বাইরে যাবার দরকার নেই। এখন থেকে তুমি দেশেই থাকো। কি দাদুর কথা রাখবে না?’
‘দাদু! জেদ করো না। তুমি তো জানো আমি দেশের বাইরে সবকিছু সামলে নিয়েছি। এখন আর এখানে থাকা সম্ভব নয়। আমার এদেশে ভালো লাগে না।’
‘দাদু ভাই! তুমি চলে গেলে দাদু কিন্তু খুব কষ্ট পাব। যে কয়টা দিন বেঁচে আছি আমি চাই তুমি আমার কাছেই থাকো।’
‘দাদু! এরকম কথা আর কক্ষণো বলবে না। আমি কিন্তু খুব রাগ করব এরকম কথা যদি আর শুনি।’
জাহেদা খানম এসে বললেন, ‘এবার আর কোথাও যেতে দিচ্ছি না। এত বছর পড়ালেখার অযুহাতে থেকেছ বলে মেনে নিয়েছি। কিন্তু এখন আর কোনো অবস্থাতেই দেশের বাইরে যেতে দিচ্ছি না।’
প্রিয় বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ঠিক এই কারণে আমি দেশে আসতে চাই না। তোমরা সবাই মিলে আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করবে বলে।’ প্রিয় মাথা নিচু করে থম ধরে বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর হুট করে মাথা উঁচু করে ছলছল চোখে বলল, ‘মা! তুমি জানো আমি কেন দেশে থাকতে চাই না। আমার সবকিছু মনে পড়ে যায়। আমার ভীষণ কষ্ট হয় মা। ভীষণ কষ্ট!’
‘কী হয়েছে দাদু ভাই? আমাকে বলো।’
‘কিছু হয়নি দাদু। এসব মা আর আমার কথা। তুমি এসব নিয়ে ভেবো না।’ একথা বলেই প্রিয় তার দাদুর রুম থেকে চলে গেল।
_____________________________
রাদিদ বিকেলের দিকে ছাতা হাতে বৃদ্ধ দাদুর বাসায় পৌঁছাল। বাসার দারোয়ান নানা প্রশ্নবাণে তাকে জর্জরিত করল। অবশেষে মাহফুজ হকের ভাগ্নে পরিচয় দেবার পরে ভেতরে ঢুকতে দিল। ভেতরে প্রবেশ করার পর বাড়ির কাজের মেয়ে তাকে একটা সোফায় বসতে দিয়ে জাহেদা খানমকে ডাকতে গেল।
রাদিদ অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে শেষমেশ ছাতাটা রেখেই চলে আসতে চাইল। কিন্তু পেছন থেকে একজন ভদ্রমহিলার আওয়াজে থমকে দাঁড়াল।
‘তুমি কি নওশীন ভাবির ভাগ্নে?’
রাদিদ ঘুরে দাঁড়াল। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলাকে সে চিনে না। সে বলল, ‘জি, আন্টি। আসলে আমি দাদুকে ছাতা দিতে এসেছি।’
‘আরে বসো। দাঁড়িয়ে আছ কেন? আব্বার সাথে তোমার দেখা হলো কখন?’
‘সে অনেক আগের কথা। আমি আসলে আমার বাড়িতে চলে যাবার কারণে ছাতাটা ফেরত দেবার কথা ভুলে গিয়েছিলাম।’
‘আচ্ছা। মনে পড়েছে। বাবা তোমার খুব প্রশংসা করেছিলেন।’ জাহেদা খানম রাদিদের দিকে তীক্ষ্ম চোখ তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার নামটা তো জানা হলো না।’
‘আমি রাদিদ।’
‘আচ্ছা, রাদিদ। তুমি একটু বসো।’
‘আসলে আন্টি আমার তাড়া আছে। দাদু কোথায়? আমি কি উনার সাথে একবার দেখা করতে পারি?’
‘বাবা তো অসুস্থ।’ এটা বলেই কী যেন ভাবলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘দেখা করতে পারবে না কেন? আসো আমার সাথে।’
‘কবে থেকে অসুস্থ?’
‘এই তো সপ্তাহখানেক হবে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে। তবে এখন দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবে। বাবার ভালোহবার ওষুধ হচ্ছে তার নাতনী। নাতনীকে কাছে পেয়েছে তো এখন আর কোনো অসুখই বাবাকে বশ করতে পারবে না।’ জাহেদা খানম সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে উঠতে বলতে থাকলেন। রাদিদ তার পিছু পিছু হেঁটে চলেছে।
রাদিদকে দেখে প্রিয়র দাদু করিমুল ইসলাম বেশ খুশি হলেন। রাদিদ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘কেমন আছ, দাদু?’
‘আমি এখন খুব ভালো আছি। আমার দাদু ভাই চলে এসেছে। এখন কী আর খারাপ থাকতে পারি?’
করিমুল ইসলাম বলতে বলতে উঠে বসার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না।
রাদিদ তাকে উঠতে নিষেধ করল। বলল, ‘দাদু! তোমাকে উঠতে হবে না। শুয়ে থাকো। তোমার বিশ্রাম দরকার।’
রাদিদকে করিমুল ইসলামের রুমে বসিয়ে দিয়ে জাহেদা খানম বেরিয়ে গেলেন। যাবার সময় বললেন, ‘তোমার জন্য নাস্তা পাঠাচ্ছি। না খেয়ে যাবে না কিন্তু।’
রাদিদ যখন রুম থেকে বেরিয়ে এসে নিচে নেমে এলো। ঠিক তখনই তার সামনে পড়ল ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরা একটা মেয়ে। রাদিদ তাকে ক্রস করে মেইন দরজার কাছে চলে এলো। মেয়েটা চিৎকার করে বলল, ‘এক মিনিট। একটু দাঁড়ান।’
রাদিদ থমকে দাঁড়াল। পেছন থেকে ঘুরে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে ভালো করে দেখল। চেনা চেনা লাগলেও কিন্তু চিনতে পারছে না। ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরা মেয়েটাকে সে জীবনে প্রথম দেখছে মনে হলো। তবে মনে মনে একটা ধারণা করেছে তবে তার ধারণা কতটুকু ঠিক সে বিষয়ে সে যথেষ্ট সন্দিহান। নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে থতমত খাওয়ার মতো করে সে বলল, ‘জি, আমাকে বলছেন?’
‘হুম, কে আপনি? এখানে কার কাছে এসেছেন?’
________________________