#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-২৯
ছোঁয়া অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবতে ভাবতে নদীর ঘাট থেকে উঠে হাঁটতে লাগল! হঠাৎ কেউ একজন তার সামনে একগুচ্ছ পদ্মফুল ধরল। চোখের সামনে একগুচ্ছ পদ্মফুল দেখে ভীষণ অবাক হলো সে। ফুলের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকাতেই আরেক দফা অবাক হলো সে। শিহরণ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে হাতে একগুচ্ছ পদ্মফুল নিয়ে। এই ভর সন্ধ্যায় পানিতে নেমেছে শিহরণ শুধু তার জন্য; এটা ভাবতেই একটা শীতল স্রোত মেরুদণ্ড দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেল। মনজুড়ে একটা অদ্ভুত ভালো লাগার শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল। শিহরণের কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুল থেকে পানি ঝরে পড়ছে। কিন্তু তার চোখে মুখে এক ধরনের তৃপ্তির রেখা। মিটিমিটি হাসছে সে। উফ! অসহ্য ঠেকছে ছোঁয়ার কাছে। এই হাসিটা কেন যে হাসে ছেলেটা!
‘কী হলো?’ শিহরণ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল, ‘এতক্ষণ তো এদের দিকেই তাকিয়ে আক্ষেপ করছিলে মনে মনে। এখন নিচ্ছ না কেন?’
ফুলগুলো হাতের কাছে পেয়ে ছোঁয়ার খুব ভালো লাগছে এই কথাটা যেমন সত্যি। ঠিক তেমনি সে কষ্টও পেয়েছে। কারণ শিহরণ ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। স্কুলে একসাথে কাটানো সময়গুলোতেই গল্প করার সময় এই বিষয়টা জানতে পেরেছিল সে। তারপর একবার বৃষ্টির দিনে নিজের চোখে দেখেছে শিহরণের বেহাল অবস্থা।
স্কুলে থাকাকালীন ছোঁয়া পরপর কয়েক দিন স্কুলে না যাওয়ায় শিহরণ তাকে দেখতে তার বাসায় পৌঁছে যায়। সেদিন দুপুরে ছোঁয়া ঘুমিয়ে ছিল। বাসায়ও কেউ ছিল না। তাই শিহরণ বেল বাজালেও কেউ দরজা খুলেনি। যার কারণে শিহরণ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুম বৃষ্টি নামল। শিহরণ তবুও দাঁড়িয়েই ছিল বৃষ্টির মধ্যে। সন্ধ্যার দিকে যখন ছোঁয়ার ঘুম ভাঙল তখন সে জানালা দিয়ে তাকাতেই শিহরণকে দেখে ভড়কে গেল। দ্রুত ছাতা মাথায় বেরিয়ে গেল সে।
ছোঁয়া শিহরণকে ধমকে বলল, ‘এই ছেলে! তুমি এই বৃষ্টির মধ্যে আমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কী করছ?’
শিহরণ তখন ঠান্ডায় কাঁপছিল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘সেই দুপুর থেকে এইখানে দাঁড়িয়ে আছি। তোমার বাসার বেল বাজালাম আধাঘন্টা ধরে। তারপর বৃষ্টিতে ভিজেছি আধাঘন্টা যাবৎ। একে তো দরজা খুলোনি। তার উপর আবার আমাকে ধমকাচ্ছ!’
ছোঁয়া ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, ‘তোমাকে আমার বাসার সামনে কে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে? আমি বলেছি?’
‘তুমি বেশ কয়েকদিন স্কুলে যাওনি। তাই আমার খুব টেনশন হচ্ছিল।’ শিহরণ বলল, মৃদু স্বরে ।
‘তো তুমি বৃষ্টিতে ভিজতে গেলে কেন? বাসায় চলে যেতে পারনি?’ ছোঁয়া বলল, শাসন করার ভঙ্গিতে।
‘তোমাকে একবার না দেখে কী করে যেতাম?’ শিহরণ বলল, অদ্ভুত হিম শীতল গলায়।
ছোঁয়ার তখন এক ধরনের মিশ্র অনুভূতি হলো। সে চোখ বুজে একটা গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। এবার তো আমাকে দেখেছ। এখন বাসায় যাও তাড়াতাড়ি।’
‘তুমি ভীষণ কিপ্টে! তুমি কি জান এটা, ছোঁয়া?’ শিহরণ বলল, অভিযোগের সুরে।
‘আমি আবার কিপ্টেমির কী করলাম?’ বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইল ছোঁয়া ।
‘এই যে আমি তোমাকে দেখার জন্য এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর বৃষ্টিতে ভিজলাম। আর তুমি একবারের জন্যও আমাকে তোমার বাসায় যেতে বলছ না। অন্ততপক্ষে এক কাপ কফি বা চা তো অফার করতে পারতে। তাই না?’ শিহরণ হাত নেড়ে নেড়ে বলল, প্রতিবাদের সুরে।
‘বাসায় কেউ নেই এখন। আমি একা। তাই আসতে বলিনি। বুঝতেই পারছ নিশ্চয়ই।’ ছোঁয়া বলল, বিব্রত ভঙ্গিতে।
‘ঠিক আছে। যাচ্ছি। তুমি আসলেই কিপ্টে।’ যেতে যেতে শিহরণ ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলল, ‘বাসায় কেউ নেই। হাহ্! আমি কি তোমাকে খেয়ে ফেলতাম একা ঘরে?’
‘একদম বিড়বিড় করবে না। সোজা বাসায় যাও। নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে।’ ছোঁয়া বলল, আদেশ দেবার ভঙ্গিতে।
তারপরের তিন দিন পর্যন্ত শিহরণ স্কুলে আসেনি। খবর নিয়ে ছোঁয়া জানতে পেরেছে শিহরণের প্রচণ্ড জ্বর। সুস্থ হবার পরে স্কুলে আসলে তখন ছোঁয়া জানতে পারে শিহরণ একদম ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। ঠান্ডা লাগলে তার ভয়াবহ অবস্থা হয়ে যায় ।
তাই এই মুহুর্তে শিহরণের চিন্তা করে তার ভীষণ খারাপ লাগছে। ছোঁয়া উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, ‘শিহরণ! তুমি এগুলো আনতে পানিতে নেমেছ কেন?’
‘পানিতে না নামলে কি এই ফুলগুলো তোমার সামনে এনে দিতে পারতাম?’ শিহরণ বলল, উৎসাহী গলায়।
‘তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে তো।’ ছোঁয়া ভীষণ চিন্তিত হয়ে গেল। ব্যতিব্যস্ত হয়ে সে বলল, ‘দ্রুত চুলগুলো মুছে নাও। কাপড় চেঞ্জ করা লাগবে তোমার। উফ! তুমি যে কীসব করো না মাঝেমধ্যে! আমি তোমাকে একদম বুঝতে পারি না।’
‘আগে ফুলগুলো তো হাতে নাও। নয়তো পানিতে নামার কষ্টটাই মাটি হয়ে যাবে।’ অসহায় মুখ করে বলল, শিহরণ।
শিহরণ কাঁপছে। ছোঁয়ার ভয় লাগতে শুরু করল। সে পুনরায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। কোনোকিছু খুঁজে না পেয়ে সে তার ওড়নার অগ্রভাগ দিয়ে শিহরণের মাথাটা মুছে দিল। এদিক সেদিক তাকিয়ে তার কাপড়ের সন্ধান করতেই দেখল নদীর কাছে ঘাসের উপরে রাখা। ছোঁয়া দ্রুত পায়ে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে তার শার্টটা নিয়ে শিহরণের দিকে এগিয়ে দিল। শিহরণ অধৈর্য গলায় বলল, ‘এবার তো ফুলগুলো হাতে নাও। নয়তো আমি এক হাতে শার্টটা পরব কী করে?’
ছোঁয়া ফুলগুলো নিজের হাতে নিল। তিরিক্ষি মেজাজে বলল, ‘থ্যাংক্স। বাট নো থ্যাংক্স।’
শিহরণ শার্ট পরে নিল। হাসতে হাসতে বলল, ‘আরাভ ঠিক বলছিল। এবার বুঝতে পারলাম।’
‘কী বলছে পিচ্চিটা?’ উৎফুল্ল গলায় জানতে চাইল, ছোঁয়া।
‘সিক্রেট। তোমাকে বলা যাবে না। আর তুমি যাকে পিচ্চি বলছ! সে তো তোমাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখছে। আর তুমিও বোধহয় দেখছ। তার দেয়া গোলাপের মধ্যেই তো ডুবে আছ।’ শিহরণ ব্যথিত কণ্ঠে বলল, ‘এত কষ্ট করে নদীর মাঝখান থেকে আমার আনা ফুলগুলো তো তোমার কোনো এটেনশনই পাচ্ছে না।’
ছোঁয়া বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এখন আর এত কথা বলতে হবে না। তোমাকে দ্রুত এখান থেকে বাসায় পৌঁছাতে হবে। নয়তো তোমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।’
‘তোমাকে বলেছে! আমার অবস্থা খারাপ হবে না। হলে এমন কী-ই-বা হবে বলো তো? তিন চার দিন জ্বর থাকবে এই তো? থাকুক। সমস্যা কী ? আমার কাছে আমার ওষুধ আছে। তোমার আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না।’ ছোঁয়াকে খোঁচা দিতে বলল, ‘তুমি বরং তোমার আরাভকে নিয়ে ভাবতে থাক।’
‘ঠিক আছে ভাবব। আপাতত আমার সব ভাবনা তোমাকে নিয়ে।’ ছোঁয়া বলল, দ্বিধাহীন চিত্তে।
‘আমাকে নিয়ে কবে থেকে ভাবছ আবার?’
‘আমার জন্য পদ্মফুল এনেছ। তাই তোমার সুস্থতা নিয়ে আমাকেই তো ভাবতে হবে। তাই না? আমি চাই না তুমি আমার জন্য অসুস্থ হয়ে পড়ো।’ ছোঁয়া বলল, চিন্তিত সুরে।
‘এবার বুঝেছি।’ মলিন কণ্ঠে বলল শিহরণ, ‘দায় সারতে চাইছ। ওকে, নো প্রবলেম। গেট ইন দ্যা কার।’
‘এত্ত অভিমান কীসের?’
‘আমার তো কোনো অভিমান নেই। অভিমান তো তার থাকে যার অভিমান ভাঙানোর মানুষ থাকে। আমি অভিমান করলে তো আর কারও কোনো কিছু যাই আসে না। তাই না?’
‘এত প্যাঁচাও কেন তুমি? আর এত কথা বাড়াচ্ছ। তোমার শরীরের তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে তো। প্লিজ, শিহরণ তাড়াতাড়ি বাসায় চলো।’
শিহরণের হঠাৎ মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তাই সে আর কোনো কথা বলল না। সোজা ড্রাইভ করে প্রথমে ছোঁয়াকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে নিজের বাসায় চলে গেল। যাবার সময় ছোঁয়া বলল, ‘দ্রুত কাপড় পাল্টে নিবে। আর নিজের খেয়াল রাখবে। আমি কল করব তোমাকে। ঠিক আছ?’
শিহরণ জবাবে কিছু বলেনি। তাই ছোঁয়ার মনটাও খুব খারাপ হয়ে গেল। সে ভাবল, ‘এই ছেলের মুড বুঝা বড়ো দায়। একদম বুঝতে পারি না এই ছেলেটাকে আমি। কখনও মনে হয় ওর মতো আপন আর কেউ নেই আবার কখনও মনে হয় তাকে আমি চিনিই না।’
__________________
ধানমন্ডির একটা রেস্টুরেন্ট বসে আছে বহ্নি । এসেছে প্রায় পঁচিশ মিনিট হয়ে গেল। এরই মধ্যে দু’কাপ কফি শেষ করে ফেলেছে। অথচ অতল এখনও আসছে না । বহ্নি বারবার ঘড়ি দেখছে। আধাঘন্টা অতিক্রম হতেই সে ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ঠিক তখনই রেস্টুরেন্টের কাচের দরজা ঠেলে চশমা পরা ছেলেটাকে ভেতরে ঢুকতে দেখল বহ্নি। ডার্ক ব্লু কালারের টিশার্ট সাথে ব্ল্যাক প্যান্ট পরেছে। চোখ দুটো বিষণ্ণ। সিল্কি চুলগুলোর কিছু কপালের উপর পড়ে আছে অবহেলায়। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দেখে মনে হচ্ছে রাতে ঠিকমতো ঘুমায় না। তবে এসব তার সৌন্দর্য কমাতে সক্ষম হয়নি।
অতলের মনটা এখন প্রায় খারাপ থাকে। সে শুধুমাত্র ভালো থাকার অভিনয় করে বেড়ায়। কোথাও শান্তি পায় না সে। দুদিন ধরে ফোন অফ রেখেছিল। খুলতেই বহ্নির মেসেজ দেখতে পায়। তার সাথে দেখা করতে চেয়েছে। দিশেহারা ভাবটা কাটাতে সে ভাবল–একবার দেখা করেই ফেলবে।
অতল বহ্নির সামনে এসে দাঁড়িয়েই হেসে বলল, ‘চলে যাচ্ছিলি? আমার উপর বিরক্ত হয়েছিস নিশ্চয়ই?’
বহ্নি চশমার আড়ালে থাকা ওই চোখদুটোতে ডুব দিয়েছিল। অতলের প্রশ্নে ফিরে এলো ধরণীতে। মৃদু হেসে বলল, ‘আমি ভেবেছি তুমি আসবে না। তাই চলে যাচ্ছিলাম।’
‘প্রচণ্ড জ্যাম! জ্যামের কারণেই দেরি হয়েছে।’ একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, ‘কিছু অর্ডার করেছিস? ও হ্যাঁ, শুধু কফি। দু’কাপ শেষ করে ফেলেছিস! আচ্ছা, এবার আমি অর্ডার করছি। কি খাবি বল?’
‘আমি কিছু খাব না। তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। তাই দেখা করতে বলেছিলাম।’
বহ্নির কথা শুনে অতল অদ্ভুতভাবে হাসল। বলল, ‘আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল তোর! আচ্ছা আজ তোর সব কথা শুনব। আগে অর্ডার করি কিছু একটা।’
অতল ওয়েটারকে ডেকে চাওমিন, একটা বার্গার আর দুটো কফি অর্ডার করল। বহ্নি বলল, ‘অতল ভাইয়া! এতকিছু কিসের জন্য? আমি অলরেডি দু’কাপ কফি শেষ করেছি। আর এখন খিদে নেই।’
‘কফি তো তুই একা খেয়েছিস। আমার সাথে তো খাসনি। আমার সাথে না খেলে তো হবে না। আর চাওমিন তোর খুব প্রিয় তাই অর্ডার করেছি।’ পরক্ষণেই সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘এখন কি ভালো লাগে না?’
‘তুমি এখনও মনে রেখেছ আমার পছন্দের খাবারের নাম?’ বহ্নি বলল, কণ্ঠে একরাশ বিস্ময় ঢেলে।
‘কিছুই ভুলিনি এখনও। সবকিছু মনে আছে। তাই কষ্টটা খুব বেশি অনুভব করি এখনও।’ বিমর্ষ কণ্ঠে বলল, অতল।
‘এসব মনে কেন রেখেছ এখনও। ছোটোখাটো ভুলের শাস্তি কি সারাটা জীবন ধরে বয়ে বেড়াবে? এটা তো ভারি অন্যায়। সব ভুলে যেতে পারো না তুমি? সবকিছু ভুলে নতুন করে আবারও তোমাদের বন্ধুত্ব শুরু করতে পারো তো। তাই না? এটা করলে তোমার নিজেরই ভালো লাগবে। কষ্ট কমে যাবে।’ বহ্নি বলল, বিজ্ঞের মতো করে।
‘কষ্টটা এমন কারও কাছ থেকে পেয়েছি যা আমি চাইলেও ভুলতে পারি না। চেষ্টা করেও পারিনি। আর হয়তো কখনোই পারব না।’ অতল বলল, বিষণ্ণ কণ্ঠে।
‘আমি যদি বলি, তুমি চেষ্টা করোনি।’ বহ্নি বলল, অভিযোগের সুরে।
অতল প্রশস্ত হাসল। হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে বলল, ‘আমি ভুলে গিয়েছি যে আমি শিহরণের বোনের সাথে কথা বলছি। যার ভাই আমাকে ধোঁকা দিয়েছিল। প্রথমে আমাকে অবিশ্বাস করেছে তারপর আমাকে ধোঁকা দিয়েছিল।’
‘কিরকম ধোঁকার কথা বলছ তুমি? শিহরণ ভাইয়া এরকম কখনোই করতে পারে না। আমি আমার ভাইকে ভালোভাবে চিনি। জানি এবং বিশ্বাস করি সে কখনোই জেনে বুঝে কাউকে কষ্ট দিতে পারে না।’ প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, বহ্নি।
‘ধোঁকার কথা শুনতে চাস তুই? সহ্য করতে পারবে তো?’ অতল বলল, ক্রোধান্বিত হয়ে।
‘তুমি বলেই দেখ না।’
এর মধ্যেই ওয়েটার খাবার দিয়ে গেল। অতল বলল, ‘আগে খাবার শেষ কর। তারপর বলছি।’
বহ্নি বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘বলেছি তো খিদে নেই। খাব না এখন।’
অতল দৃঢ় গলায় বলল, ‘আগে খেতে হবে। নয়তো বলব না।’
বহ্নি পরাস্ত হয়ে বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
অতল বার্গার শেষ করে কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল, ‘তুই যখন এতো করে জানতে চাইছিস তখন আজ তোকে বলেই ফেলি।’ বার কয়েক গভীর নিঃশ্বাস নিল সে। তারপর বলতে শুরু করল, ‘তুই নিশ্চয়ই জানিস আমি ছোঁয়াকে ভালোবাসতাম। এই কথাটা শিহরণও খুব ভালো করে জানত। শুধু শিহরণ কেন স্কুলের সবাই জানত এই কথাটা। তারপরেও শিহরণ আমি যাকে ভালোবাসি তার দিকে হাত বাড়াল। এটা কি সে অন্যায় করেনি? এটা কি বিশ্বাসঘাতকতা নয়? সবকিছু জেনে বুঝেও শিহরণ ছোঁয়ার সাথে গোপনে দেখা করত, কথা বলত। অথচ আমি এর কিছুই জানতাম না। সবকিছু আমার অগোচরে হতে থাকল। আমি বোকার মতো অপেক্ষা করছিলাম, ছোঁয়ার ভালোবাসা পাবার আশায়। অথচ, আমার ভালোবাসা তো আমার বন্ধুই কেড়ে নিল আমার কাছ থেকে। যেই বন্ধুকে আমি নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসতাম তার কাছ থেকে পাওয়া এই আঘাতটা আমি সহ্য করতে পারিনি। ভেতর থেকে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছিলাম।’
অতল টেবিলের উপর রাখা পানির বোতলটা খুলে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিল। তারপর বলল, ‘এবার বল সব দোষ কি আমার?’
বহ্নি স্তব্ধ, হতভম্ব, নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে অতলের দিকে। অতলের চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। বহ্নির দিকে তাকিয়ে অতল বিদ্রুপাত্মক হেসে বলল, ‘কিছু বলার নেই তোর? ভাইয়ের দোষ সম্পর্কে জানতে পেরেই কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল তোর? না-কি এখানেও আমারই দোষ খুঁজে পাচ্ছিস?’
বহ্নি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। সে বলল, ‘এখনও ছোঁয়া আপুকেই ভালোবাস?’
অতল ঝট করে তাকাল বহ্নির দিকে। এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। নিজের মনের মধ্যে এক ধরনের জটিলতা খুঁজে পেল সে। বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে অতলকে। প্রসঙ্গ পাল্টে বহ্নি বলল, ‘শুধু শিহরণ ভাইয়ার দোষ ছিল না। তোমারও দোষ ছিল। ভাইয়া তোমার সাথে কতোবার দেখা করতে গিয়েছে, তার কি কোনো হিসেব আছে? তুমি ভাইয়ার সাথে কথা বলা তো দূরের কথা, দেখা পর্যন্ত করোনি! ভাইয়া এই একটা কারণে কতো কষ্ট পেয়েছে তুমি কি জানো? জানো না। জানতে চাওনি তুমি। তুমি শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলে। মাঝেমধ্যে নিজের কষ্ট ভুলে অন্যের কষ্টের দিকেও তাকাতে হয়। নয়তো কখনোই জানতে পারবে না পৃথিবীতে শুধু তুমিই দুঃখী নও আরও অনেকেই দুঃখী আছে। নিজের কষ্টকে সবসময় বড়ো করে দেখলে তুমি কখনও জীবনে আনন্দের ছোঁয়া পাবে না।’
বহ্নি খানিক থামল। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘ছোঁয়া আপুকে ভাইয়ার ভালোবাসার বিষয়টা ইচ্ছাকৃত ছিল না। এই বিষয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিত। মনের উপর কি কারো হাত থাকে? না-কি কোনো জোর চলে? তারপরেও আমি এই বিষয়টার কোনো ব্যাখ্যা দেব না। আমি চাই এটা তোমরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে মিটমাট করে নাও। কারণ কিছু বিষয় আছে যা শুধু ভাইয়া আর তুমি জানো। ওই বিষয়গুলো নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।’
‘বড়ো হয়ে গিয়েছিস। সত্যিই তো সেই ছোট্ট বহ্নি এখন আর ছোটো নেই।’ অতল যেন স্বগতোক্তি করল।
বহ্নি বলল, ‘আমি কি সারাজীবন ছোটোই থেকে যাব ভেবেছিলে?’
অতল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি জানতাম তুই তোর ভাইয়ের পক্ষেই কথা বলবি। আমি কে যে তুই আমার পক্ষ নিবি? আমি তো কেউ না। আমার কষ্টে কেউ কষ্ট পায় না। আমার কথা কেউ ভাবে না। আমি আসলে বড্ড একা। এখনও অবধি আমি একা।’
বহ্নি অতলের হাতের উপর নিজের হাতটা রাখল। অতল তার হাতের উপর রাখা বহ্নির হাতের দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ তারপর তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। বহ্নির চোখের দেয়ালে জলের উপস্থিতি অতলের চোখ এড়াল না। ছলছল চোখে বহ্নি বলল, ‘মনে রেখো তোমার কষ্টে কেউ একজন গভীরভাবে আঘাত পায়। খুব গভীরভাবে! তুমি হয়তো তার কথা কখনোই জানতে পারবে না। হয়তো তুমি বুঝতে চাও না। তবুও মনে রেখ সে তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে।’
এটুকু বলেই বহ্নি দ্রুত পায়ে হেঁটে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। অতল বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল তার যাওয়ার পানে। বহ্নির বলা কথা সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। কেউ একজন তাকে ভালোবাসে! কে সে! পরক্ষণেই অতল এই চিন্তা মাথা থেকে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলল। চোখের চশমাটা ঠিক করে নিজের মধ্যে জাগ্রত হওয়া সমস্ত আবেগ ঝেড়ে ফেলল সে। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল। তৃণার নাম্বার থেকে অসংখ্য মিসড কল এসেছে। সাথে সাথেই তৃণাকে কল ব্যাক করল। বলল, ‘সুইটহার্ট! আমার সাথে এক্ষুণি দেখা করো।’
__________________________
#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩০
অপেক্ষার প্রহর বড্ড যন্ত্রণার!
জ্বলে পুড়ে ছারখার হয় হৃদয় প্রান্তর।
আর ভগ্ন হৃদয়!
সে তো দহনের পর দহনে ছাই হয়ে যায়।
অস্তিত্বহীনতা গ্রাস করে ফেলে মুহূর্তেই।
অতল অধীর আগ্রহে তৃণার জন্য অপেক্ষা করছিল।
বহ্নি ওভাবে চলে যাবার পর এক নিগূঢ় বিষণ্ণতা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তাকে। তার জীবনের সমস্ত কষ্ট আর অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষাগুলো চাপা আর্তনাদ স্বরূপ হাহাকার হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। বুকের মধ্যে পাহাড় সদৃশ স্তুপাকারে জমান চাপা কষ্টগুলো ফের বেড়ে গিয়ে তার সমস্ত সত্তাকে অস্থির করে দিচ্ছিল। এমন বিবশ অবস্থায় একটা মুখোশের বড্ড প্রয়োজন হলো তার। তাই সে মুহূর্তেই কেয়ারলেস নামক একটা মুখোশের আড়ালে থাকা অতলে রূপান্তরিত হয়ে গেল। এমন নিগূঢ় কষ্টে আচ্ছন্ন থাকার চেয়ে ভালো থাকার অভিনয় করাটা তার কাছে ঢের ভালো মনে হলো। তাই তার গার্লফ্রেন্ড তৃণাকে কল করল সাথে সাথেই। অনেকদিন যাবৎ সে তৃণাকে এভয়েড করছিল। বহ্নির সাথে দেখা হবার পর থেকেই এক ধরনের অদ্ভুত আবেগের বশবর্তী হয়ে পড়েছিল সে। যার দরুণ সে তার তথাকথিত প্রেম চালাতে বারংবার ব্যর্থ হচ্ছিল। এমনটা কেন হলো–জানে না অতল! সে তা জানতে চায়ও না। কিছু প্রশ্ন সারাজীবন প্রশ্নই থেকে যায়।
কিন্তু এখন তার মনে হলো, সে ভুল করেছে। ক্ষণিকের তরে আবেগের স্রোতে গা ভাসিয়ে সে বড্ড বেশি ভুল করে ফেলেছে। এই ফেইক রিলেশনশিপ তাকে তার কষ্ট ভুলে থাকতে একটু হলেও সাহায্য করে। এসব আকাশ পাতাল ভাবনা-চিন্তা আর ভেতর থেকে বের হওয়া অসংখ্য চাপা আর্তনাদ তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। নিজেকে শান্ত করতে বার কয়েক লম্বা শ্বাস নিল সে। তারপর টেবিলের উপর রাখা পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে সবটা পানি খেয়ে নিল। তবুও যেন তৃষ্ণা মিটছে না। অতলের মনে হলো, সে বড়োই তৃষ্ণার্ত। সে তৃষ্ণার্ত; সেই ছোটোবেলা থেকেই। আর সেই তৃষ্ণা হলো ভালোবাসার তৃষ্ণা। মনে মনে সে ভালোবাসার কাঙাল। একটু ভালোবাসা চায় সবার কাছে। অথচ ভালোবাসা অধরাই রয়ে যায়।
মানুষ যা চায় তা পায় না আর যা পায় তা চায় না! চাওয়া ও পাওয়ার এই সমন্বয়হীনতা জীবনের সুখ কিংবা দুঃখের মাত্রা নির্ধারণ করে। এই দুইয়ের ব্যবধান যতই বাড়বে, দুঃখ ততই বাড়বে। আবার ব্যবধান যত কম হবে দুঃখও তত কম হবে।
অতল চোখ দুটো বুজে বিড়বিড় করে বলল, ‘কবে ঘুচবে এই ব্যবধান! কবে ঘুচবে এই যোজন যোজন দূরত্ব? কবে?’
বিকেলের রোদ মরে এসেছ। ধীরে ধীরে সূর্য ডুবতে শুরু করেছে পশ্চিশ দিগন্তে। রেস্টুরেন্টে এখন বেশ কিছু মানুষ প্রবেশ করছে। অতল কোনো কারণ ছাড়াই এদিক সেদিক তাকাল বার কয়েক। অধিকাংশই প্রেমিক যুগল। ভীষণ অবাক লাগতে শুরু করল তার। তার জীবনে সে যাকে চাইল তাকে পেল না। ছোঁয়া! তার জীবনের সবচাইতে অধিক আকাঙ্ক্ষিত! তার সাথে সে আত্মার বাঁধনে বাঁধা পড়তে পারল না। সে তো আত্মার বন্ধনই চেয়েছিল। কিছুই হলো না! ফলস্বরূপ কিছু অপ্রয়োজনীয় সম্পর্ক করে বেড়িয়েছে সে। কিন্তু কারো সাথেই মনের মিল হয়নি। টেবিলের উপর দু’হাতের কনুই রেখে মাথাটা চেপে ধরল সে। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার। সমস্ত চিন্তা ঝেড়ে ফেলে চারদিকে শান্ত দৃষ্টিতে চোখ বুলাল। ঠিক তখনই তার চোখ গেল রেস্টুরেন্টের কোণায় বসে থাকা এক যুগলের দিকে। অতল নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। বাবা তো দিন-রাত এই মানুষটার উদাহরণই দেয়। অতল কোনোকিছু না ভেবেই প্যান্টের পকেট থেকে নিজের মোবাইলটা বের করে ঝটপট একটা নাম্বার ডায়াল করল। পরপর তিনবার কলটা কেটে দেওয়া হলো। অতল আবারও কল দিল।
নীলাভ্র অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে বসে আছে আফরিনের সামনে। আফরিন ঝাঁঝাল গলায় বলল, ‘এখন মাথা নিচু করে আছ কেন?’
নীলাভ্র নিরুত্তর। আফরিন তাতে আরও বেশি তেতে উঠে বলল, ‘কী হচ্ছে? তুমি এরকম মাথা নিচু করে আছ কেন?’
নীলাভ্র মাথাটা তুলল। মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল, ‘জান! প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো। আমার আব্বুটা খুব রাগী! অতিরিক্ত বদমেজাজী যাকে বলে। আমি আসলে আব্বুর সাথে কীভাবে কথা শুরু করব সেটাই বুঝতে পারছি না।’
‘তার মানে তুমি আমাদের ব্যাপারটা তোমার বাসায় জানাবে না?’ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল আফরিন।
নীলাভ্র আফরিনের হাতের উপরে নিজের হাতটা রেখে তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, ‘অবশ্যই বলব। আমাকে আর কিছুটা সময় দাও, প্লিজ।’
আফরিনের মেজাজ বিগড়ে গেল। প্রচণ্ড রাগান্বিত হয়ে সে বলল, ‘তোমার আর কতো সময় লাগবে বলো? আমি বরং আম্মুর পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করে ফেলি। এটাই সমাধান।’
‘না।’ চাপা আর্তনাদ করে উঠল নীলাভ্র। আফরিনের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘প্লিজ, আফরু! এরকম কথা বলো না। আমি তোমাকে ছাড়া একটা মুহূর্তও কল্পনা করতে পারি না। আমি যেভাবেই হোক বাসায় ম্যানেজ করব। কথা দিচ্ছি তোমকে।’
আফরিন নিভল। তবে তার রাগ এখনও পুরোপুরি পড়েনি। সে কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় নিলাভ্রের মোবাইলটা বেজে উঠল। এমন সময়ে কল আসাতে নীলাভ্রের মাথায় যেন আগুন ধরে গেছে। সে কলটা কেটে দিয়ে পুনরায় আফরিনের দিকে মনোযোগ দিল। কিন্তু বারবার কল আসাতে শেষমেশ প্রচণ্ড অনীহা নিয়ে মোবাইলটা রিসিভ করে ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘কল কেটে দিচ্ছি তারপরেও বারবার কল করছিস কেন?’
‘তুমি এখন কোথায় ভাইয়া?’ হিম শীতল গলায় প্রশ্ন করল অতল।
‘আমি যেখানে থাকার কথা সেখানেই আছি।’ দাঁতে দাঁত চেপে নীলাভ্র বলল, ‘তোর সমস্যা কী বল?’
‘আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি শুধু জানতে চাইছি তুমি এখন কোথায়?’ নির্বিকার ভঙ্গিতে পুনরায় প্রশ্ন করল, অতল।
‘আমি যেখানেই থাকি না কেন তোকে জানতে হবে কেন?’ নীলাভ্র তিক্ত গলায় বলল।
‘আসলে একটা রেস্টুরেন্টে ঠিক তোমার মতো এক জনকে দেখছি তো তাই জানতে চাইলাম।’ অতল বলল, অনুযোগের সুরে।
নীলাভ্র এপাশ ওপাশ ঘুরে ঘুরে দেখল প্রথমে। অতল ততক্ষণে সরে গেল তার জায়গা থেকে। রেস্টুরেন্ট কোথাও অতলকে দেখতে না পেয়ে নীলাভ্র একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর ক্রোধিত কণ্ঠে বলল,
‘আমি অফিসে এখন। আর তোর মাথা কি ঠিক আছে?’
‘তুমি ব্যাংক বাদ দিয়ে কবে থেকে রেস্টুরেন্ট কাজ করা শুরু করে দিয়েছ?’ ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে প্রশ্ন করল, অতল।
আফরিন বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এই মোবাইল রাখ তো। কার কাছে এত কৈফিয়ত দিচ্ছ?’
আফরিনের কথা শুনে নীলাভ্র কলটা কেটে দিল। তারপর বলল, ‘একটা বাজে ছেলে কল করেছে। যে আমার বাড়িতে থেকে আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছে।’
‘তাহলে এটাই কি তোমার অফিস? টেবিলের উপর হাত দিয়ে টোকা মেরে বলল, অতল।
নীলাভ্র অতলকে নিজের সামনে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আফরিন অবাক হয়ে দেখল উদভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকা চমশা পরা ছেলেটাকে। কী হচ্ছে তা সে বুঝতে না পেরে বলল, ‘নীলাভ্র! এটা কে?’
আতিক বলল, ‘কেউ না আফরিন! ও আমার কেউ হয় না।’
অতল ভারি অবাক হলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘এই হলে আসল তুমি। নিজে প্রেম করে বেড়াও অথচ আমি করলেই দোষ!’ অতলের কণ্ঠে রাগ উপচে পড়ছে, ‘বাবার সামনে সাধু সেজে আমাকে সবসময় বকা খাওয়াও। আজ বাবাকে আমি এই বিষয়টা জানাবই।’
নীলাভ্র মারমুখো হয়ে বলল, ‘যা খুশি বল গিয়ে। তোর কথা কে বিশ্বাস করে আমি দেখব। যত্তসব আজাইরা কাজকর্ম করে বেড়াস!’ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নীলাভ্র আবারও বলল, ‘এই তুই কি আমার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করছিস? সবসময় আমি কোথায় এটা কেন তোর জানা লাগে?’
অতল আর নীলাভ্রের এমন চিৎকার চেঁচামেচিতে রেস্টুরেন্টের সবাই ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। সবার মধ্যেই এক চাপা কৌতূহল বিরাজ করছে।
‘তুমি তো বাবার সাধু ছেলে।’ অতল ব্যঙ্গ করে চেঁচিয়ে বলল, ‘ওপস্! আদর্শ ছেলে! তাই আদর্শ ছেলেটা যখন
লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করে বেড়ায় অথচ বাসায় মিথ্যে কথা বলে আদর্শ সাজার চেষ্টা করে তখন একটু অবাক তো হতেই হয়। তাই না?’
ততক্ষণে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার এসে তাদের থামতে বলল। অতল আর দাঁড়াল না। হনহন করে হেঁটে বেড়িয়ে গেল।
_________________________________
বাসায় পৌঁছে ছোঁয়া শিহরণের দেওয়া ফুলগুলো বিছানার উপর রাখল। গোলাপটা ফ্লাওয়ার ভাজে রেখে এক ফাঁকে শাওয়ার সেরে নিল। তারপর ভেজা চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে বেঁধে শিহরণের দেওয়া পদ্মফুল হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে রইল সে। যেন ফুলগুলোর সমস্তটা জুড়ে শিহরণের অস্তিত্ব অনুভব করছে সে। ফুলগুলোকে নিজের মুখে স্পর্শ করাল। এক অদ্ভুত অনুভূতিতে তার মন ছেঁয়ে গেল। হিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছোঁয়ার রুমে ঢুকল। ছোঁয়াকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে সে অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘এই ফুলগুলোর মধ্যে এমন কী আছে? এমনভাবে মগ্ন হয়ে কী দেখছ?’
ছোঁয়া তখনও মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে আছে এক নজরে ফুলগুলোর দিকে। হিয়া ওর কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘ফুলগুলো কে দিয়েছে বলো তো?’
ছোঁয়া উঠে দাঁড়াল। আবার বসে পড়ল। আমতা আমতা করে বলল, ‘কেন ? তোর লাগছে কেন?’
‘ফুলগুলো নিশ্চয়ই স্পেশাল কেউ দিয়েছে। নয়তো এতটা মন্ত্রমুগ্ধ তো তুমি হতে না। আমি সেই স্পেশাল মানুষটার নাম জানতে চাই।’ হিয়া ছোঁয়ার পাশে বসে বলল।
ছোঁয়া বিছানা থেকে উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। হিয়াও তার পেছন পেছন গেল। বলল, ‘তুমি বলতে না চাইলেও আমি কিন্তু ধারণা করতে পারছি এই ফুলগুলো কে দিতে পারে।’
‘কে? কে দিয়েছে বল?’ ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল ছোঁয়া।
‘আমি জানি এটা শিহরণ ভাইয়া দিয়েছে। কি ঠিক বললাম তো?’
ছোঁয়া নিরুত্তর। হিয়া ছোঁয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এখন আর লুকিয়ে লাভ নেই। আমি জানি সব।’
‘মানে? কী জানিস?’
‘এই যে তুমি শিহরণ ভাইয়াকে পছন্দ কর।’
‘একদম না। ভুল জানিস। এই ফুলগুলো আমার খুব পছন্দের তাই দেখছি।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। মেনে নিলাম। তবে আমি জানি তুমি বাইরে থেকে যতই অস্বীকার করো না কেন ভেতর থেকে তুমি স্বীকার করো যে, তুমি শিহরণ ভাইয়াকেই উচ্চতর পর্যায়ের পছন্দ করো।’
‘উচ্চতর পছন্দ আবার কি?’
‘ভালোবাসা যাকে বলে।’
‘উঁহু! একদম না।’ ছোঁয়া বলল, বিব্রত ভঙ্গিতে।
‘হু! একদম।’ হিয়া বলল, আমুদে কণ্ঠে।
________________________________
#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি
পর্ব-৩১
ভেবেছিলাম একদিন তুমি আমি মিলে একাকার হব;
দু’টো হৃদয় একসাথে একীভূত হয়ে বাঁধা পড়বে।
ভালোবাসা পুঞ্জীভূত হয়ে এক অন্যরকম অনুভূতির পাহাড় হবে।
সেই পাহাড়েই বানাব ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষিত আলয়।
হৃদয় থেকে হৃদয়ে পৌঁছুবে ভালোবাসার শিহরণ;
হৃদয়ের গহীনে জমান অনুভূতির আবেশ ছড়িয়ে দেব তোমার দেহ মনে।
আমার অনুভূতিকে না বোঝার শাস্তি স্বরূপ-
ভালোবাসা নামক অনলের দহনে পোড়াব তোমায়।
তবুও তোমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখি–তোমায় নিয়েই ভাবি,
কোনো এক পূর্ণিমার রাতে তোমার কাঁধে মাথা রেখে,
রাতের আকাশ দেখব আর গুণব লক্ষ কোটি তারা,
চোরাচোখে দেখব তোমায় পূর্ণিমার চাঁদের রূপালি আলোয়,
আর মাখব গায়ে সেই রুপালি আলোর স্পর্শ।
অবশেষে তোমায় বলব কানে কানে, চুপটি করে,
ভালোবাসি যতখানি-অনুভব করি তার চাইতেও বেশি।
অথচ দেখই না আজ তুমি নির্বিকার, বড্ড অবুঝ।
পরিশেষে আবারও সত্য অনুধাবন করলাম তুমি নও বরং আমিই অবুঝ।
ভেবেছিলাম আমার ভালোবাসা সম্মোহন করবে তোমায়,
হবে তুমি মন্ত্রমুগ্ধ–হবে তুমি কেবল আমাতেই নিঃশেষ।
অবশেষে বুঝলাম আমার ভালোবাসায় নেই কোনো সম্মোহন,
তাইতো মোহাবিষ্ট হওনি তুমি–কেবল আমিই ছিলাম মোহাবিষ্ট তোমার প্রতি।
ভালোবাসা নামক দহনে পুড়ছে হৃদয়–ভাঙছে প্রাচীর;
সেই ধ্বংসাত্মক শব্দ কি তোমার কর্ণকুহরে পৌঁছায়?
‘কী রে! টুন, মুন? আমাকে একদম ভুলে গেছিস?’ বহ্নি চড়ুই পাখি দুটোকে উদ্দেশ্য করে বলল। পাখি দু’টো কী বুঝল কে জানে ডেকে উঠল তারস্বরে। বহ্নি হাসল। নিষ্প্রাণ সেই হাসি! চোখের দেয়াল তখন বর্ষার অথৈ জলে নিমজ্জিত। বহ্নি বাঁধ তৈরী করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। তবুও চোখের কোণে জমেছে অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত দু’ফোঁটা অশ্রুকণা।
বিষণ্ণ কণ্ঠে বহ্নি পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘কবিতাটা ভালো লেগেছে তোদের?’ ঠোঁট উল্টে আদুরে ভঙ্গিতে বলল, ‘একটু বেশি বিষাদময় হয়ে গেছে। তাই না?’
পাখি দুটো আবারও ডেকে উঠল। বহ্নি বলল, ‘কই আজ তো একটা শব্দও করিসনি, আমি কবিতা আবৃত্তি করার সময়।’ এবার পাখি দুটো নীরব। বহ্নি বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘বুঝেছি তোদের ভালো লাগেনি। কষ্ট পেয়েছিস। তাই না?’
এবার পাখি দুটো এদিক সেদিক তাকাল। বহ্নি এবার মলিন হাসল। দরদমাখা কণ্ঠে হঠাৎ সে বলল, ‘কেন হলো আমার সাথে বল তো? কেন?’
অন্ধকার জেঁকে বসেছে তখন পুরো ছাদ জুড়ে। গাছের ঝোপঝাড়েও অন্ধকার ঘাপটি মেরে বসেছে। সোডিয়াম লাইটের আবছা আলোতে সমস্ত প্রকৃতি যেন নির্জীব হয়ে পড়েছে। সমস্ত কিছুই নিষ্প্রাণ আর নিষ্প্রভ মনে হচ্ছে তার কাছে।
‘কী করছে আমার বার্বি ডলটা?’ শিহরণ প্রশ্ন করল বহ্নির ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে।
বহ্নি সতর্ক হয়ে গেল মুহূর্তেই। নিজের চেহারার সমস্ত বিষণ্ণতা লুকিয়ে হাসি হাসি মুখ করে তাকাল শিহরণের দিকে। সহস্যে বলল, ‘টুন আর মুনের খবর নিচ্ছিলাম।’
বহ্নির চেহারা দেখে শিহরণের বুকটা ধ্বক করে উঠল।
সে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘তাই? কোনো কারণে তোর মন খারাপ নয়তো?’
‘আমার! আমার কেন মন খারাপ হতে যাবে?’ প্রশস্ত হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে পাল্টা প্রশ্ন করল বহ্নি ।
এবার গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল শিহরণ, ‘তুই কি কিছু লুকাচ্ছিস আমার কাছ থেকে?’ বহ্নির গালে হাত দিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘তোর মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন? তোর মন খারাপ কেন বল তো? আর তুই কাঁদছিলি কেন?’ শিহরণ সাবধানী গলায় বলল, ‘খবরদার! আমার কাছে কিছু লুকানোর চেষ্টা করবি না।’
বহ্নি এবার শিহরণের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, ‘ভাইয়া! তুমি কি ছোঁয়া আপুকে এখনও ভালোবাস?’
শিহরণ থমকাল হঠাৎ বহ্নির মুখে এমন প্রশ্ন শুনে। স্তব্ধতা যেন ওকে ঘিরে ধরল হঠাৎ করেই। বহ্নি আবারও প্রশ্ন করল, ‘কী হলো, ভাইয়া? বলছ না কেন?’
‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’ ভারি অবাক হয়ে জানতে চাইল শিহরণ।
‘উত্তর জানতে চেয়েছি। প্রশ্ন শুনতে চাইনি।’ দৃঢ়তার সাথে বলল বহ্নি, ‘ছোঁয়া আপু তো আমাদের অফিসে তোমার সঙ্গেই কাজ করে। তাই জানতে চাইলাম।’
শিহরণ ছোট্ট করে জবাব দিল, ‘হুম।’
‘আপুকে জানিয়েছ?’
শিহরণ বহ্নির প্রশ্নটা শুনে তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে ছাদের মাঝবরাবর রাখা টেবিলের দিকে নিয়ে আসল। তারপর দু’জন দু’টো চেয়ারে বসল। শিহরণ বহ্নির হাত ধরে বলল, ‘কাপকেক! তোকে আজকে কিছু কথা বলব। মন দিয়ে শুনবি। তুই আজকে যখন এই প্রশ্নটা করেছিস তখন আমার মনে হচ্ছে কিছু বিষয় তোকে জানান উচিত।’
বহ্নি একটু নড়েচড়ে বসল। বলল, ‘হ্যাঁ, বলো। আমি শুনছি।’
‘ছোঁয়া আর আমার সম্পর্কটা একদম ভিন্ন, একটু অদ্ভুতও বটে। আমার পক্ষে তা ব্যখ্যা করা সম্ভব নয়। তারপরেও আমি কিছুটা বলার চেষ্টা করব। আমি ছোঁয়াকে পছন্দ করি সেই স্কুল লাইফ থেকে। তবে স্কুলের দিনগুলোতে আমি আমার মনের এই অনুভূতিগুলোকে পাত্তা দিতাম না কারণ আমি জানতাম অতল ছোঁয়ার প্রতি দুর্বল যদিও ছোঁয়া তাকে কখনোই ভালোবাসেনি। তারপরেও আমি সবসময় তাকে এড়িয়ে চলতাম। কিন্তু আমাদের দূরত্ব একটা সময় ঘুচে গেল। মোসাদ্দেক স্যার যখন আমাদের একসাথে পানিশমেন্ট দিলেন তখন আমি আর আমার অনুভূতিগুলো চেপে রাখতে পারিনি। তবে এটাও ঠিক যে আমি আমার অনুভূতি প্রকাশও করিনি।’
শিহরণ একটু থামল। তাকে খুব বিষণ্ন দেখাচ্ছে। বিষাদভরা কণ্ঠে সে বলল, ‘তারপর অতলের সাথে আমার ঝামেলা হলো তোকে নিয়ে। এরপর তোর সাথে আমার দূরত্ব বাড়ল। আমি ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। ঠিক সেই মুহূর্তগুলোতে আমি ছোঁয়াকেও ভীষণভাবে মিস করা শুরু করলাম। এরপর একদিন আমি ভাবলাম আমার অনুভূতিগুলো প্রকাশ করে দিব ছোঁয়ার কাছে ঠিক তখনই আমি ছোঁয়াকেও ভুল বুঝি অকারণে এক অনভিপ্রেত ঘটনার কারণে। অথবা বলতে পারিস আমাকে ভুল বুঝান হয়েছিল। তারপর থেকে আমি আর ছোঁয়ার দিকে চোখ তুলেও তাকাইনি। তারপর একদিন আমি ছোঁয়ার ডায়েরি খুঁজে পাই। স্কুলে ফেলে এসেছিল সে। সেদিন ক্লাসে আমিই ছিলাম তাই আমার হাতে পড়েছিল। ভাগ্যিস! ডায়েরিটা পেয়েছিলাম।
সেই ডায়েরিতে ছোঁয়া তার সমস্ত অনুভূতি লিখে রাখত।’ শিহরণ থামল। চোখ বুজে ফেলল। টেবিলের উপরে রাখা পানির জগ থেকে পানি ঢেলে খেয়ে নিল এক নিঃশ্বাসে।
বহ্নি অধৈর্য গলায় বলল, ‘তারপর কী হলো?’
শিহরণ মৃদু হাসল। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘আমি ছোঁয়ার ব্যাপারে সবকিছু জানতে পারলাম তার ডায়েরিটা পড়ে। ডায়েরিটা এখনও আমার কাছেই আছে। তখন আমার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। আমার ভুলটা ভেঙ্গে যায়। এর মধ্যে মোহনা আমার সাথে যোগাযোগ করে। তারপর আমি আর মোহনা মিলে আমার আর অতলের মাঝে ঝামেলা কে বাঁধিয়েছে তা বের করে ফেললাম। ঝামেলাটা কে বাঁধিয়েছে তা জানার পর আমার নিজের প্রতি খুব রাগ হলো। কিন্তু সেটা ইচ্ছাপ্রণোদিত কাজ ছিল জানার পর থেকেই আমি এক ধরনের চাপা কষ্টে ভুগছিলাম। সবচাইতে বেশি দুঃখ লাগত এটা ভেবে যে সে আমাদেরই বন্ধু ছিল। তারপর থেকে তো আমি অতলের সাথে অনেকবার দেখা করার চেষ্টা করেছি। অগণিতবার তার বাসায় গিয়েছি কিন্তু অতল আমার সাথে আর একটা বারের জন্যেও দেখা করেনি।’
‘কে ছিল?’ বহ্নি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল শিহরণের দিকে।
‘প্রিয়।’ শিহরণের ঠোঁটের কোণে দুর্বোধ্য হাসি। অদ্ভুতভাবে হেসে সে বলল, ‘জানিস? সবাই ভেবেছিল ওটা রাদিদের কাজ! তবে রাদিদ সেদিন কিছুই করেনি। বরং সেদিন রাদিদ অদ্ভুত আচরণ করেছিল। মোহনা বিষয়টা খেয়াল করেছিল। তবে এর পেছনের কারণটা সে জানতে পারেনি। এর পর থেকেই রাদিদ কেমন যেন একটু একটু করে বদলে যেতে শুরু করল। তার পুরো কারণ অবশ্য জানা নেই। তবে তার বাবার প্রথমবার হার্ট এট্যাক হবার পর থেকে সে ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিল। ঠিকমতো হাসতো না, কথাও ঠিকমতো বলতো না। এক পর্যায়ে তো সে তার গ্রামের বাড়ি চলে যায়। এর পর থেকে তো আর কোনো যোগাযোগ হয়নি তার সাথে।’
বহ্নি অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘রাদিদ ভাইয়ার পরিবর্তন চোখে পড়ার মতোই। তবে প্রিয় আপু কেন এই কাজ করেছে তা জানতে পেরেছ?’
‘প্রিয় তোর উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। এমনকি আমার উপরেও।’ তিক্ত গলায় বলল, শিহরণ।
‘আমার উপর?’ ভীষণ অবাক হয়ে জানতে চাইল বহ্নি।
‘হুম।’ শিহরণ তিরিক্ষি মেজাজে বলল, ‘তুচ্ছ কারণে তার ইগো হার্ট হয়েছিল। যার ফলাফল স্বরূপ অতল আর আমার বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গেল।’
‘তারপর?’ বহ্নি ধৈর্যহীন হয়ে বলল, ‘তোমার আর ছোঁয়া আপুর কী হলো?’
‘একটা অদ্ভুত বিষয় কী জানিস?’ শিহরণ বহ্নির উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই বলতে শুরু করল, ‘ছোঁয়াকে আমার কাছে ভুল প্রমাণিত করতে চেয়েছিল অতল। হয়তো আমার উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। আর এই কাজটা সে কার তাড়নায় করেছে তাও আমি জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু ডায়েরি পড়ে ছোঁয়ার ব্যাপারে সবটা জানার পরে আমার সমস্ত ভুল ধারণা শেষ হয়ে যায়। আমার কাছে একে একে সমস্ত ঘটনা পরিষ্কার হতে থাকল। অতলের এই অন্যায়টা জানার পরেও আমি তাকে মনে মনে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। ওর সাথে বারবার যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে তার চারপাশে এক অভেদ্য প্রাচীর তুলে দেয়। যে দেয়ালটা সে না চাইলে আমার পক্ষে ভাঙা সম্ভব ছিল না। আর হলোও তাই। একদিন শুনলাম ওর বাবা ট্রান্সফার হওয়ায় ওরা সবাই রাঙ্গামাটি চলে গেছে।’
শিহরণের চোখের কোণে অশ্রু হানা দিল। বহ্নি ওর হাতের উপর নিজের একটা হাত রেখে বলল, ‘তারপর কী হলো ভাইয়া?’
শিহরণ পুনরায় বলতে শুরু করেছে, ‘অতলের কাহিনি ওখানেই শেষ। তবে একটা বিষয় কী জানিস?’
বহ্নি বলল, ‘কী?’
‘অতলের ভুল ধারণাটা ভাঙা দরকার। নয়তো সে অযথাই আমাকে ভুল বুঝে যাবে সারাজীবন।’ শিহরণ বলল বিমর্ষ কণ্ঠে।
‘ভাঙবে একদিন। দেখে নিও।’ বহ্নি বলল, শিহরণকে আশ্বস্ত করতে, ‘তারপর কী হলো?’
‘এরপর বেশ কিছুদিন আমি প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে ছিলাম। অতলের মতো বন্ধুকে হারিয়ে ফেলাতে আমার নিজের উপর যেমন রাগ হচ্ছিল। তেমনি আমি চাপা কষ্টে ভুগছিলাম। এই সময়টাতে মোহনা আমাকে সাহায্য করেছিল। একজন প্রকৃত বন্ধু হিসেবে ওকে কাছে পেয়েছিলাম। মায়াও অবশ্য পাশে ছিল। এরপর কষ্টগুলো কিছুটা ম্লান হতেই আমি নিজের আর ছোঁয়ার মাঝে একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিই। কেন যেন সমস্ত অঘটনের জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। ছোঁয়াকে ভুলার চেষ্টা করতে থাকলাম। ব্যর্থ হয়েছিলাম। বারবার ব্যর্থ হয়েছিলাম। মোহনা আর মায়া তখন আমার পাশে এসে দাঁড়াল। তারা আমার মধ্যে জাগ্রত হওয়া গিল্টি ফিলিংসটা দূর করতে সাহায্য করল। আমি নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে মেডিটেশন শুরু করেছিলাম। ওটা অবশ্য বেশ কাজে দিয়েছিল। তারপর আমার চিন্তাশক্তি স্বাভাবিক ফ্লোতে আসার পর আমি ছোঁয়ার বর্তমান অবস্থা নিয়ে ভাবলাম। পুরো এক সপ্তাহ ধরে ভেবেছিলাম।’
‘কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে?’ বহ্নির কণ্ঠে কৌতূহল।
‘আমি আমাদের মধ্যের দেয়ালটাকে দেয়াল হিসেবেই রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’ দৃঢ়তার সাথে বলল, শিহরণ।
বহ্নি চিৎকার করে বলল, ‘কেন?’
‘কারণ আমি চেয়েছিলাম ও যেন নিজ প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হোক। আমি জানতাম ও কখনোই আমাকে ভুলবে না। জানি না কেন! তবে কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমার বিশ্বাস ছিল, সে আমারই থাকবে। আমি ওকে কখনোই হারাব না। তাই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখাটা আমার জন্য কঠিন হলেও অসাধ্য ছিল না। আর সবচাইতে দারুণ ব্যাপার হলো, আমার বিশ্বাস প্রমাণিত হয়েছে।’
শিহরণ উঠে দাঁড়িয়ে তার মাথার ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুলগুলো ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে ব্যাকব্রাশ করল। হাসতে হাসতে বলল, ‘সবচাইতে অদ্ভুত ব্যাপারটা কি জানিস?’
বহ্নি বলল, ‘কী?’
‘আমি এখনও ছোঁয়াকে বলিনি আমি ওকে, কেবল ওকেই ভালোবাসি। অথচ ও বুঝে, জানে। আমি এটা অনুভব করতে পারি।’ আমুদে গলায় বলল, শিহরণ।
‘তুমি এরকম সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলে? এর পেছনে নিশ্চয়ই আরও যৌক্তিক কোনো কারণ ছিল?’
‘যৌক্তিক কারণ তো অবশ্যই ছিল। আমি তো ছোঁয়ার ব্যপারে সবটা জানতাম। ওর সৎ মা আর সৎ বোনেরা ওকে পছন্দ করে না। ওর উপর নানান অত্যাচার করত। ফিজিক্যালি টর্চার পর্যন্ত করত। আমি নিজেও তো দেখেছি। তাই আমি ওর সাথে নিজেকে জড়িয়ে তাকে দুর্বল করতে চাইনি। আমি ওকে স্ট্রং হিসেবে দেখতে চেয়েছিলাম। ছোঁয়া আবেগে ভেসে যাক তা আমি কখনোই চাইনি। তাই এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমি চাইনি আমার কারণে তার ক্যারিয়ার বাধাগ্রস্ত হোক। তাহলে তো আমি নিজেকে কখনোই ক্ষমা করে পারতাম না।’
শিহরণ থামল। পুনরায় বলল, ‘তবে একটা মজার ব্যাপার কী জানিস?’
‘কী ভাইয়া?’
‘আমার যখনই ওকে দেখতে মন চাইত ছুটে যেতাম ওকে এক পলক দেখার জন্য। কখনো অবশ্য সামনাসামনি দেখিনি। সবসময় লুকিয়ে দেখেছি। আর এক্ষেত্রে অমাকে কে সাহায্য করেছে জানিস?’
‘কে?’ কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইল বহ্নি।
‘মায়া। ছোঁয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড।’
‘ছোঁয়া আপু জানে?’
‘জানে না। আমিই বলতে নিষেধ করেছি। ছোঁয়াকে দূর থেকেই সাহায্য করার জন্য আমার মায়ার সাথে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রাখতে হয়েছে। অবশ্য মায়া তো আমারও বন্ধু। আর তার ঋণ আমি কখনোই শোধ করতে পারব না। ও যখন ভেঙ্গে পড়ত তখন ওকে সান্ত্বনা দেওয়া থেকে শুরু করে ওর অর্জনে ওকে অনুপ্রেরণা দেওয়া সবটা করেছি মায়ার মাধ্যমে।’
‘ছোঁয়া আপুকে জানালে কি সমস্যা ছিল?’ ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল বহ্নি।
‘সমস্যা তো ছিল।’ শিহরণ বার কয়েক লম্বা শ্বাস নিল। তারপর বলল,’ আজকের ছোঁয়া আর দশ বছর আগের ছোঁয়ার মধ্যে যেমন তফাৎ ছিল ঠিক তেমনি তফাৎ ছিল তার পারিপার্শ্বিক অবস্থাতে। আমি তার চারপাশের পরিবেশ তার জন্য জটিল করতে চাইনি। আমি সবসময় চেয়েছি ওর চারপাশের পরিবেশ সহজ স্বাভাবিক হোক।’
‘জটিল বলতে?’ বহ্নি ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল।
‘আমার সাথে সম্পর্ক আছে এই বিষয়টা ওর বাসায় একবার জানতে পারলেই ওর উপর অমানুষিক নির্যাতন হতো। এটা বোঝার ক্ষমতাটা আমার ছিল। তাই ছোঁয়ার কাছ থেকে দূরে থেকেছি অনিচ্ছাসত্ত্বেও।’ শিহরণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
‘ভাইয়া! তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।’ বহ্নি বলল, দ্বিধান্বিত কণ্ঠে।
‘সংকোচ করছিস কেন? যা ইচ্ছে বলে ফেল।’ শিহরণ বলল, স্মিত হেসে।
‘আমি অতল ভাইয়ার সাথে দেখা করেছি।’ বহ্নি বলল, প্রগাঢ় কণ্ঠে।
_____________________________