#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
১৩.
ছবির পেছনে দরজা দেখে অহনা অবাক হয়। ময়নাকে ভরসা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ভেতরটা অন্ধকার। কিছুক্ষণ হাতড়ে চলতেই অন্য একটি দরজার সামনে হাজির হয়। বাইরে থেকে আটকানো সেটা। অহনা অনেক চেষ্টা করে খোলার জন্য, বিফলে যায়।
পেছনে তাকিয়ে দেখে সোহেল বুকের সাথে হাত দুটো ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। ময়না ভয়ে অহনার সাথে লেপ্টে যায়। অহনা অভয় দেয়,’ কিছু হবে না ময়না। ভয় পেয়ো না।’
সোহেল কপট রাগ নিয়ে বলল,’ তোমাদেরকে ছেঁড়ে রাখাই আমার উচিত হয়নি। বার বার হতাশ করছ আমাকে। এবার দেখবে আমি কি করি।’
বলেই ক্যাবলাকে ডেকে বলে,’ ময়নারে ধর, আমি এটাকে সামলাই।’
পুনরায় ওদেরকে আগের ঘরটায় নেওয়া হয়। চেয়ারের সাথে দুজনকেই শক্ত করে বাঁধা হয়।
সোহেল অনেকটা হিংস্র হয়ে যায়। অহনার সামনে এগিয়ে আসে। ময়নার দিকে তাকিয়ে বলল,’ তোর সামনেই আজ তোর বোনের এমন হাল করব, পরেরবার আমার উপর কথা বলতেও তার ভয় হবে।’
ময়না কেঁদে উঠে,’ ছেঁড়ে দাও ভাই, আমার বোনকে ছেঁড়ে দাও।’
‘ ধরবো কি ছাড়ার জন্য? আজকে ওকে দিয়েই নাস্তাটা সেরে নেব।’ সোহেল শয়তানি হাসি দিয়ে উঠে।
অহনার দিকে এগিয়ে আসে। অহনা ছোটার জন্য ছটফট করতে থাকে। এই মুহূর্তে তাকে সাহায্য করার কেউ নেই,
‘ দূরে থাক আমার থেকে। তোকে দেখতেও আমার ঘেন্না লাগে।’
‘ এত অহংকার ভালো নয়। তোমার অহংকার যতক্ষণ না ধুলোয় মিশে যাচ্ছে ততক্ষণ আমি শান্তি পাবো না।’
‘ এতো কনফিডেন্স? তাহলে মনে রাখ, আমাকে বাঁচাতে সে আসবেই। তখন কোল কি হাল হবে সেটা নিয়েই ভয়ে আছি আমি।’
‘ দেখিয়ে দিই তাহলে আমার কনফিডেন্সের মাত্রা। দেখি কে বাঁচাতে আসে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি, আর না। কাজ সব শেষ দিতে দিয়ে তোমার কাছেই আসতে পারিনি। এখন তাহলে আর কাজটাই করে নিই।’
সোহেল আরো এগিয়ে আসে। ময়না কেঁদে মরছে, ছুটতে পারছে না। সোহেল অহনার কাছাকাছি এসে শরীরের ঘ্রাণ নেয়,
‘ এত সুন্দর ঘ্রাণ! আমি মুগ্ধ! বিমোহিত! মেয়েদের শরীরের ঘ্রাণ আমার অনেক প্রিয়, তোমারটা আরো প্রিয়।’
‘ কাপুরুষ তুই? অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছিস।’
‘ইশশ! এভাবে বলো না। তবে বলতে ইচ্ছে করলে বলো, আমার এসব গায়ে লাগে না।’
অহনা চোখ মুখ খিঁচে নেয়। সোহেল তার জামায় হাত দিতেই তার চোখ যায় জানালার দিকে। একজোড়া চোখ বাইরে থেকে দেখছে তাদের।
‘কে ওখানে?’ সোহেল হন্তদন্ত হয়ে জানালার কাছে যায়।
ক্যাবলাকে ডেকে বলে,’ বাইরে গিয়ে দেখ, কে ছিল? আমি সিউর কেউ দেখছিল আমাদের।’
পরপরই অহনার দিকে তাকায়। আগুনের সাথে সাথে লালসা ঝড়ছে তার চোখ দিয়ে। অহনার দিকে এগিয়ে আসতেই ফোনে কল আসে। সোহেল ওপাশের কথাগুলো শুনেই অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল,’ তোমার কাছে আসলেই যত বাধা পড়ে। চিন্তা করো না, বিশ মিনিটের মধ্যেই আসছি আমি।’
সোহেল বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে চলে যায়। অহনা কেঁদে উঠে। ময়নার দিকে তাকিয়ে বলল,’ মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু কে জানো?’
‘কে আপা?’
‘ তার নিজের শরীর।’
ময়না ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পারেনি সে। উত্তর পাওয়ার জন্য চেয়ে রইল অহনার দিকে।
অহনা নাক টেনে বলল,’ এই শরীরের জন্যই বার বার ঐ নরপশুদের খোরাক হই। এই শরীরের লালসার জন্যই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিজেদের কি রক্ষা করবো? যেখানে নিজের শরীরটাই শত্রু।’
ময়না চুপ করে থাকে। কথাটার সম্পূর্ণ মানে সে এতক্ষণে বুঝে গেছে। সত্যিইতো মেয়েদের দুর্বলতা তার শরীর। এই শরীরের জন্যই সে বাইরে বেরুতে পারে না, সবার লালসার দৃষ্টি থাকে।
ক্যাবলা দেখে নেয় হ্যারিকে। ছয়জন শক্তপোক্ত লোককে ডেকে এনে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয়। হ্যারিকে ডাকতে এসে সবাই বিপদে পড়ে। চারজনকেই বেঁধে নিয়ে যায় তালাবদ্ধ ঘরটাতে।
হ্যারি তখন চিৎকারের শব্দ পেয়েছিল ঘরটিতে তাই জানালায় উঁকি দেয়। সোহেল সেটা দেখে নেয়।
অহনাকে যেখানে রাখা হয়েছিল সেখানে নিয়ে যায়। সবাইকে একসাথে বাঁধে। অহনা আরো অবাক হয় বাকিদের দেখে,
‘ তোরা এখানে আসলি কিভাবে?’
রুমি বলল,’ তোকে খুঁজতে এসেছিলাম। কিন্তু এরা দেখে নেয়।’
‘ কেন করলি এটা? তোরা কেন আসতে গেলি? এবার সবাই বের হব কিভাবে?’
হ্যারি অভয় দেয়,’ সবাই মিলে ঠিক একটা ব্যবস্থা করে নেব। একটা না একটা উপায় বের হবেই।’
ময়না বলে উঠে,’পারবে না। এবার আমরা সবাই শেষ। বাকি মেয়েদের মতো আমাদের অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যাবে সময়ের সাথে সাথে।’
ইরা ভয়ে বলল,’ কি বলছো তুমি? আরো মেয়ে মানে?’
‘ আম ঠিকই বলছি। এসবতো চলছে আরো ত্রিশ বছর আগে থেকেই। আফতাব জহরু, মানে আমার শশুর এই সব করছে।’
অহনা ময়নার দিকে তাকায়,’ পুরো ঘটনাটা আমাদের বলো। এমন কি হয়েছিল, যার জন্য তোমাকেও ছাড় দেয়নি?’
‘শুনো তাহলে!’
ময়না বলতে শুরু করে,’ আমার বাবা একজন সাধারণ মানুষ। বাজারে এইটা দোকান আছে শুধু। মা মা/রা গেছে আমার জন্মের সময়, বাবাই মানুষ করেছে। আমার পনেরো বছর হতেই আফতাব জহরু আমাকে বাবার দোকানে দেখতে পায়, সেখান থেকেই বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। বড় বাড়িতে বিয়ে হবে ভেবে বাবা অনেক খুশি। আমি দেখতে মন্দ ছিলাম না বলে সবাই পছন্দ করে। আমার বিয়ে হয় আফতাব জহরুর মেজো ছেলের সাথে। দিন ভালোই যাচ্ছিল। একদিন আমার দেবর সোহেল বিনা অনুমতিতে আমার ঘরে প্রবেশ করে, আমার সাথে নোংরামি করার চেষ্টা করে। সেটা দেখে নেয় আমার স্বামী রাফিজ। সে তার ভাইকে থাপ্পর দেয়। আমাকে রক্ষা করার জন্য তাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। রাফিজ আমাকে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু গরীব বলে শাশুরী, ননদের অত্যাচার সহ্য করেছি খুব। উঠতে বসতে খোটা দিত। এভাবেই চলছিল দিন। একদিন বাগানে ফুল তুলতে গিয়ে তারা বদ্ধ একটা ঘর দেখতে পাই। দরজাটা খুলে একজনকে বের হতে দেখে অবাক হই। দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ দেখা গেলেও আসলে এটা ভেতর থেকে বন্ধ করা। লোকটা বাইরে আসতেই আমি সুযোগ বুঝে ভেতরে ঢুকে যাই কি আছে দেখার জন্য। এখন মনে হচ্ছে, আমি না গেলেই আমার জীবনটা সুন্দর থাকতো।
দুইটা ঘর পেরিয়ে অনেকগুলো মেয়ের গোঙানির শব্দ পেলাম। আমি উৎসুক হয়ে দেখতে গেলাম। দেখলাম রাফিজ বসে আছে একটা চেয়ারে আর মেয়েগুলো কাতরাচ্ছে। আমাদের দেখে সে এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করলাম এতোগুলো মেয়ে এখানে কেন? আমি জিজ্ঞেস করতে করতেই ক্যাবলা নামক লোকটা এসেই ওকে বলল, মেয়েগুলোকে কেনার জন্য কাস্টমার এসে গেছে, আজ রাতেই নিতে আসবে, বাইরের দেশে পাচার করা হবে তাদের। রাফিজ লোকটাকে আকারে ইঙ্গিতে এসব বলতে না করল, কিন্তু লোকটা বুঝেনি তাই সব বলে দিল। সোহেল চলে এলো সেখানে। আমাকে দেখে রেগে গিয়ে থাপ্পর দিল। রাফিজও তার সাথে রেগে যায়। রাফিজ আমাকে নিয়ে ঘরে চলে আসে। আমাকে বুঝাতে থাকে বিভিন্নভাবে। কিন্তু আমি এমন অন্যায় দেখে চুপ থাকতে পারিনি। আমি আমার শাশুড়িকে সব বলি, ভেবেছি তিনি সাহায্য করবে। অথচ করেনি উল্টো সোহেলকে ডেকে এনে তার দিকে ঠেলে দিল আমাকে। সোহেল আমাকে তার মায়ের সামনেই…..’
এতটুকু বলতেই ময়না কেঁদে উঠে। অহনা কিছু বলার ভাষা পাচ্ছে না। কিছু বলতে যাবে, তখনি শব্দ এলো,’ ওকে কাঁদতে দাও, মনে শান্তি আসবে।’
অহনা খুশিতে গদোগদো করে উঠে। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে,’ মাহতিম!’
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
চলবে…..
#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
১৪
অহনার মুখে হঠাৎ মাহতিম শব্দ শুনে সবাই অবাক হয়ে তাকায়। অহনা সেটা বুঝতে পেরে বলল,’ আসলে… আমি…’
‘ কি আমি আমি করছিস? মাহতিম কে?’ হ্যারি জিজ্ঞেস করল।
‘ কই কেউ না। ময়নার কথা শুনে হঠাৎ নামটা মুখে আসল।’
অহনা দিকে সবাই সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নেয়। ময়নার দিকে তাকিয়ে দেখল সে কাঁদছে। অভয় দিয়ে সবটা বলতে বলল হ্যারি।
ময়না চোখ মুছে আবার যোগ করে,’ সোহেল আমাকে ধ*র্ষণ করে। আমার শাশুড়ি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল শুধু। রাফিজ ঘরে এসে আমাকে না দেখে পুরো বাড়ি খুঁজে। একপর্যায়ে খুঁজে পায়। সেদিন রাফিজ সোহেলকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। আমাকে রাফিজ বলল, এসব থেকে দূরে থাকতে। রাফিজ অনুতপ্ত ছিল, নারী পাচারকারী দলের সাথে সে পরিচিত ছিল না, শুধু মেয়েগুলোকে পাহারা দেওয়াই ওর কাজ ছিল। সোহেলের সাথে খারাপ আচরণ করায় রাফিজের খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে খু*ন করে তাকে। আমি আগে জানলে বাঁচিয়ে নিতাম তাকে।
রাফিজ চলে যাওয়ার পর আমি একা হয়ে যাই। সেদিন বিকেলেই সোহেল আমার সাথে বাজে কাজ করে। নিজেকে বাঁচাতে অনেক চেষ্টা করি। সবশেষে সোহেলের ফোন আসতেই সে বারান্দায় যায়, সে সুযোগে আমি জানালা বেয়ে পালিয়ে এসেছি। নদীর পাড়ে আসতেই অহনা আপার সাথে দেখা হয়।’
অহনা বলল,’ তাহলে সবাই তোমায় মৃ*ত বলছিল কেন?’
ময়না ঢোক গিলে বলতে শুরু করে,’ মর্গে থেকে একটা ডেড বডি এনে বলছিল, ওটাই আমি। আমি ম*রে গিয়েছি গলায় দঁড়ি দিয়ে।’
মাহতিম অহনার কানের এসে বলে,’ তুমি চাইলে সবাইকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারি।’
অহনা বলল,’ না, এখানে আরো মেয়ে আছে। তাদের খুব বিপদ, আমাদের তাকে সাহায্য করা উচিত।’
‘ কিন্তু তারা কোথায়?’
‘ সেটা দেখার দায়িত্ব তোমার।’
মাহতিম চলে যায়। অহনা দেখল সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। টিকু বলল,’ তুই নিজে নিজে কার সাথে কথা বলছিলি?’
‘ কই, কারো সাথে না তো?’
‘ আমি দেখলাম। কাউকে বললি কিছু দেখে আসার জন্য।’
সবাই বলল,’ হ্যাঁ। এখানে থেকে আবার ভূতে ধরল নাতো?’
এরই মাঝে সোহেল এসে পড়ে। সাথে এসেছে আফতাব জহরু। এতজনকে একসাথে দেখে তার জিভ লকলক করে উঠে। সোহেল সব খুলে বলল। আফতাব বলল,’ তাহলে আর সমস্যা নেই। আজ রাতের মধ্যে আরো দু’টো মেয়ে জোগাড় করার কথা ছিল, এখন আর লাগবে না, ওদের দিয়েই হয়ে যাবে। আজ রাতেই আসছে তারা। তৈরি রাখিস এদের।’ বলেই আফতাব চলে গেল।
সোহেল অহনাকে বলল,’ তোমাকে আমার লাগবেই। তোমাকে ভোগ করে তারপরই পাচার করব। আগে আমি মজা নেব, তারপর টাকা পাব। বিষয়টা দারুণ না?’
অহনা কিছু বলার আগেই তার মুখে রুমাল পেঁচিয়ে দেয়। সবার মুখে একে একে রুমাল বেঁধে দেয়। সোহেল কোমরে এক হাত রেখে বলে,’ তোমাদের কিচিরমিচির আর ভালো লাগছে না। একটু চুপ থাকো।’
মাহতিম অহনার কাঁধে হাত রাখে। ভরসা দেয়,’ একটু অপেক্ষা করো, আমি সবাইকে উদ্ধার করব।’
ভরসার হাত পেয়ে অহনা দমে যায়। সোহেল তার দিকে যেতেই আফতাব ডেকে উঠে। সোহেল বিরক্তিতে দেয়ালের সাথে হাত দিয়ে আঘাত করে,’ শা*লার বাপ শান্তি দিল না। যখনি একটু শান্তি নিতে আসি তখনি কল করবে বা ডেকে নেবে। বাইনঞ্চ* বহুত জালাচ্ছে। ইচ্ছে করছে গলাটা কে*টে দিই।’
সোহেল চলে যায়। মাহতিম অহনাকে বলল,’ প্রায় একশটা মেয়ে বন্দি আছে।’
অহনা মাহতিমের দিকে তাকায়,’ আমরা কিভাবে ওদের উদ্ধার করবো? তুমি কিছু করলেইতো সবাই দেখে যাবে।’
‘ ভাবতে হবে।’
মাহতিম ভাবে। পরক্ষণেই বলল,’ চিন্তা করো না। সারাজীবন গোয়েন্দা হয়ে কাটিয়েছি, এখন এই সামান্য বিষয়টা আমি সামলাতে পারব!’
‘ গোয়েন্দা হয়ে কাটিয়েছ মানে?’
অহনার কথার উত্তর না দিয়েই মাহতিম চলে যায়। সোহেল আর আফতাবের কথোপকথন শুনে। বুঝতে পারে, রাতেই মেয়েগুলোকে পাচার করা হবে। কিন্তু অহনাকে কষ্ট দেওয়ার কারণে মাহতিমের চোখ দুটো রক্তিম হয়ে আছে। সোহেল আর তার বাবার সামনে যায়। সোহেলের হাত দিয়ে আফতাবকে থা*প্পর বসায়। আফতাব রেগে গিয়ে ছেলের কলার চেপে ধরে। সোহেল বলছিল, সে ইচ্ছে করে দেয়নি। কিভাবে হলো বুঝতে পারেনি। তবুও আফতাব কয়েক ঘা বসিয়ে দেয়। হনহন করে বেরিয়ে পড়ে আফতাব। সোহেল ভ্যাবলার মতো বসে থাকে। তখনি পেছন থেকে ধাক্কা দেয় মাহতিম।
সোহেল পড়ে গিয়ে ধমক দিয়ে উঠে,’ কে এখানে? বেরিয়ে আয় বলছি।’ আরো কিছু অশ্রাব্য গালিও দেয়। মাহতিম তাকে দেয়ালের সাথে ছুড়ে মারে। মাথা ফেটে র/ক্ত বের হয়। সোহেল গালিগালাজ করছে, কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছে না। মাহতিম পুনরায় তাঁকে ধাক্কা দেয়। সোহেল হুমড়ি খেয়ে দরজার সাথে পড়ে যায়। কোনরকমে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
রাত হতেই পাঁচটা মালবাহী ট্রাক এসে হাজির হয় সেই গোপন দরজার কাছে। একে একে সবগুলো মেয়েকে আনা হয়। ট্রাকে তোলা হয় তাদের। সোহেল অহনার কাছে এসে বলল,’ কোনো ব্যাপার না, যাওয়ার পথে তোমার সাথে রোমান্স হবে। এখানে তো সুযোগ পেলাম না।’
গা ঘিন ঘিন করে উঠে অহনার। মাহতিম তেড়ে আসতেই অহনা তাকে থামিয়ে দেয়, বলল,’ বুদ্ধি দিয়ে কাজ করা উত্তম। ওদেরকে ওদের স্টাইলেই শাস্তি দিতে হবে।’
সোহেল হেসে উঠে,’ কার সাথে কথা বলছো? মাথাটা গেছে মনে হয়!’
রুমি, ইরা, টিকু, হ্যারিও চিন্তায় পড়ে গেছে। আজকাল কেন অহনা নিজে নিজে কথা বলে।
সোহেল অহনার চুলে ফুঁ দিয়ে চলে যায়। মেয়েদেরকে জোর করে ট্রাকে তুলতে থাকে। অহনাকেও তোলা হয় একটি ট্রাকে।
মাহতিম কিছু করছে না দেখে অবাক হয় অহনা। মাহতিম চুপ করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাকের ডালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর কিছুই দেখতে পায় না অহনা। এভাবে মাহতিমকে কিছু না করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ মুখ লাল হয়ে আছে তার। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রাক চলতে শুরু করবে, কিন্তু মাহতিম এখনো দাঁড়িয়েই আছে।
সকলের মধ্যে আহাজারি। মেয়েগুলো কেঁদে মরছে, অথচ আওয়াজ নেই, মুখ বাঁধা তাদের।
ট্রাক ছাড়ার পজিশন নিতেই অহনা ভয়ে কেঁপে উঠে। মাহতিমকে ডাকতে থাকে।
যখন সব আশা ছেড়ে দিল অহনা, তখন বাইরে থেকে শব্দ পায় গুলির। কান পেতে শোনার চেষ্টা করে। আনন্দে নেচে উঠে সে। পুলিশ ট্রাকগুলোকে ঘিরে ধরেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাইকে উদ্ধার করে।
অহনা দেখল মাহতিম এখনো আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে বাকি রইল না সেই জানিয়েছে পুলিশকে। ইন্সপেক্টর রিজু সেন সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’ এখানে অহনা কে?’
অহনা এগিয়ে আসে। ইন্সপেক্টর বলল,’ আরে আপনি সেই না, যাকে কিছুদিন আগে উদ্ধার করেছিলাম? আপনি কিভাবে এখানে আটকা পড়লেন।’
‘ আমার বোনকে খুঁজতে এসে।’
‘ যাই হোক, আপনি অনেক সাহসী। আপনার জন্যই আজ এই অপরাধীরা ধরা পড়ল। কবে থেকেই এই গ্যাংটাকে খুঁজছিলাম, বুঝতেই পারিনি আমাদের নাকের ডগায় ছিল।’
‘ আমি… মানে, বুঝতে পারছি না।’
‘ আপনিইতো আমাদের কল করে বললেন আসতে।’
অহনার মাহতিমের দিকে তাকায় একনজর, তারপর বলল,’ জ্বী আমিই।’
‘ আপনার হাজবেন্ড কেমন আছেন?’
ইন্সপেক্টরের কথা শুনে সবার চোখ ছানাবড়া। হ্যারি এগিয়ে এসে বলল,’ ওর এখনো বিয়ে হয়নি।’
‘ কি বলছেন আপনি? কিছুদিন আগেই ওনার সাথে আমার দেখা হলো। আজ আবার হলো। এই থানায় কালকেই বদলি হয়েছি আমি।’
অহনা হ্যারিকে বলল,’সবাইকে নিয়ে তুই যা। আমার কিছু কথা আছে ইন্সপেক্টরের সাথে। আমি কথা বলেই আসছি।’
হ্যারি যেতে না চাইলেও অহনা তাকে জোর করে পাঠিয়ে দেয়। তারপর ইন্সপেক্টরকে বলে,’ আসলে আমি কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করেছি, তাই এরা জানে না।’
‘ কি বলেন? পুলিশকে বোকা বানাচ্ছেন নাতো আবার?’
‘ সবাই জানে। শুধু বন্ধুরা ছাড়া। আপনিও জানলেন এখন। আমি তাহলে আসি?’
ইন্সপেক্টর গাড়িতে গিয়ে একজন কনস্টেবলকে বলল,’ মেয়েটাকে সন্দেহ হয়। ওর পুরো ডিটেলস্ চাই আমার কালকের মধ্যেই।’
‘ জ্বী স্যার!’
অহনার মাহতিমের কাছে যায়,
‘ কি হলো, বাড়ি যাবে না?’
‘ অবশেষে ধরা পড়ল তারা। যাদের বহুকাল আগেও ধরতে পারিনি আমি।’
‘ বহুকাল আগে মানে? কি বলছ? তুমি কি এদের চিনতে?’
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
চলবে……
#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
১৫.
মাহতিম কিছু বলল না। উত্তর দিতে সে অনিচ্ছুক। অহনার হাত ধরে তাকে বাড়ি নিয়ে গেল।
ক্লান্ত থাকার দরুন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। অহনা এপাশ-ওপাশ করে। ঘুম আসছে না তার। হাজারটা প্রশ্ন মনে। উঠে পড়ে বিছানা থেকে। দরজা খুলে বাইরে বের হয়। মাহতিম তার কাঁধে হাত রাখে,
‘ যাচ্ছ কোথাও?’
অহনার চুপ করে থাকে। মাহতিম পুনরায় প্রশ্ন করে,’ বের হলে কেন?’
অহনা কিছু না বলে হাঁটা ধরল। কিছুক্ষণ পরেই মুখ খুলে,
‘ ভাবছি তোমার মতো কম কথা বলব। কথা কম কাজ বেশি।’
‘ কিন্তু গন্তব্য কোথায়?’
‘ দেখতেই পাবে।’
অহনা নদীর পাড়ে গিয়ে থামে। পূর্ণিমা প্রখর থাকায় চারিদিকটা খুব ভালোই দেখতে পাচ্ছে। নদীতে নেমে পড়ে অহনা। মাহতিম তাকে বাঁধা দেয় না। আপনমনে অহনা পানিতে নিজেকে নিমজ্জিত করে। একটু পর উঠে এসে মাহতিমের পাশে এসে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে,’ কে তুমি?’
মাহতিম দূরে তাকিয়ে বলে,’ মাহতিম।’
‘ আমি তোমার পরিচয় জানতে চেয়েছি। কে তুমি? কোথা থেকে এসেছো? কেন এসেছো? আমাকে কেন সাহায্য করছো? কি সম্পর্ক আমাদের মধ্যে? এসব উত্তর জানতে চাই আমি।’
‘ জেনে গিয়ে কি করবে?’
‘ সেটা তোমার না জানলেও চলবে। আপাতত নিজের পরিচয় দাও।’
‘ এই মুহূর্তে আমার কোনো পরিচয় নেই। না আর কখনো থাকবে!’
অহনা ভাবে, বলল,’ তোমার কথা কখনোই আমি পুরোপুরি বুঝি না। কি বলতে চাও তা স্পষ্ট করে বলো না কেন? আমার হাঁসফাঁস লাগে, তোমার মধ্যে আমি অন্যরকম কিছু দেখতে পাই।’
‘ সেটাই, যেটা অপূর্ণ ছিল।’
অহনা মাহতিমের কাঁধ স্পর্শ করে। কিন্তু ছুঁতে পারে না। আকুতি জড়ানো কন্ঠে বলে,’ আমি তোমাকে ছুঁতে চাই।’
মাহতিম কিছুটা দূরে সরে যায়। অহনা আবারো এগিয়ে আসে, তুমি কেন এমন অদৃশ্য হয়ে থাকো? পাশে থাকলেও অস্তিত্ব নেই। আমার কেন জানি না ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।’
‘কিসের কষ্ট তোমার?’
‘ জানি না। কিন্তু এই মুহূর্তে তোমাকে আমি স্বশরীরে দেখতে চাই। দেখা দাও।’
অহনার কথায় মাহতিম কোমল হয়ে আসে। দৃশ্যমান হলো আস্তে আস্তে। অহনার কাঁধ স্পর্শ করতেই সে ব্যথায় শব্দ করে উঠে।
‘ ব্যথা হচ্ছে খুব তাই না?’ মাহতিম কোমল স্পর্শে বলল।
‘ এখন ব্যথা নেই।’
‘ আর থাকবেও না। আমি উপশম করে দিলাম।’
মুহুর্তেই সকল ব্যথা উধাও হয়ে যায় অহনার। মাহতিমের স্পর্শের জাদুতে শরীর তার চাঙ্গা হয়ে উঠে।
মাহতিম বলল,’তোমাকে একা রেখে বাইরে যাওয়া উচিত হয়নি আমার। আমি না গেলে এতকিছু ঘটত না।’
‘ নিজেকে দোষ দিচ্ছ কেন? দোষী আমি। আমি রেগে গিয়ে বের করে দিয়েছি।’
মাহতিম আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,’ জীবনটা আরেকটু দীর্ঘ হলে কি হতো?’
অহনা বুঝতে পারে না তার কথা,
‘ তোমার জীবনটা আছে কিনা সেটাও জানি না আমি। তুমি কি? আদৌ মানুষ নাকি অদৃশ্য কিছু? আমি বুঝতে পারি না।’
অহনার মাহতিমের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটাকে তার খুব চেনা মনে হয়, তবুও মনে করতে পারছে না। মনে হচ্ছে এই চোখের দিকে সে আগেও তাকিয়ে ছিল। অনেক কথা জমা রয়েছে এই চোখে। অহনা বলল,’ তুমি কেন সবসময় অদৃশ্য থাকো? কেন লোকের সম্মুখে আসো না? তোমার কি কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না?’
‘ যতবার আমি দৃশ্যমান হব। ততবার আমার শক্তি একটু একটু করে শেষ হয়ে যাবে। দুটো কাজের জন্য আমি এসেছি। সেগুলো শেষ না হতেই শক্তি শেষ হয়ে গেলে দুর্ভোগ নেমে আসবে।’
অহনা প্রশ্ন করে,’ কোন দু’টো কাজ? কেন দুর্ভোগ নেমে আসবে?’
‘ খুব শিঘ্রই জানতে পারবে।’
হঠাৎ বাতাস বইতে শুরু করে। ভিজে থাকার কারণে অহনার শীত করে। আস্তে আস্তে তা আরো জোড়ালো হয়। শীতে দাঁতে দাঁত চেপে আছে অহনা। অহনা মাহতিমের দিকে তাকিয়ে দেখল, সে একমনে নদীর পানির দিকে তাকিয়ে আছে। রাগে ফুঁসে উঠে বলল,’ কখনো কি বাংলা সিনেমা দেখেছ?’
মাহতিম অবাক হয়ে বলে,’ না! আমি পছন্দ করতাম না।’
‘ পছন্দ করতে না মানে? যাই হোক, সেজন্যই এই অবস্থা।’
‘ কি হয়েছে?’
‘ তুমি তো দেখনি, বলে কি করব?’
‘ বলো?’
‘ সিনেমায় নাইকার শীত করলে নায়ক তার শার্ট খুলে তার গায়ে জড়িয়ে দেয়। ছেলেদের শীত লাগে না বেশি তাই আরকি।’
মাহতিম হেঁসে উঠল। অহনা বিভোর হয়ে সে হাসি দেখে। গম্ভীর এই লোকটার হাসি তার ভীষণ রকমের ভালো লেগে যায়। অনেকদিন পর বলে হয় সে হাসল। অহনা বলল,’ আমি হাসির কথা বলিনি। তোমার উচিত আমাকে সাহায্য করা।’
‘ তুমি শার্ট চেয়েছো, কিন্তু আমিতো শার্ট গায়ে দেইনি।’
‘ দেখতেই পাচ্ছি। তুমি এমন গাঢ় পাঞ্জাবি কেন পরেছ? বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছ মনে হয়। তুমি কি গোসল করো না? সবসময় এটাই দেখি যে।’
‘ এটা মানুষদের জন্য প্রযোজ্য। ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার। বাড়ি যাওয়া উচিত।’
‘ আমার অনেক শীত করছে। পারব না যেতে।’
মাহতিম অহনার কাছে আসে। তার ভেজা চুলগুলো পেছনে সরিয়ে দেয়। দুই কাঁধে হাত রাখে। অহনা কিছুটা সরে যেতে চাইলেই মাহতিম আরো শক্ত করে নিজের দিকে টেনে আনে। কোমরে এক হাত রেখে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। অহনা শিউরে উঠে। অদ্ভুত এক ভালো লাগা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। ছোটার চেষ্টা করছে না, এই অনুভূতি তার ভালো লাগছে। ঠোঁট দুটো ঝাঁকি দিয়ে উঠে অহনার। কেমন দিশেহারা ভাব তার মধ্যে। চোখ বন্ধ করে নেয়।
মাহতিম অহনাকে শক্ত করে ধরে আছে। অহনা চোখ খুলতেই চোখাচোখি হয় মাহতিমের। লজ্জার ভাব স্পষ্ট। দৃষ্টি দিতে পারছে না। এখন তার ঠান্ডা লাগছে না। মাহতিমের শরীরের ওম তার শরীরে স্থানান্তরিত হচ্ছে। অহনার গরম নিঃশ্বাস বারি খাচ্ছে মাহতিমের চওড়া বুকে।
গ্রামের মোড়লের ছেলে মতি নেশা করে পুরনো পোড়া বাড়িটা থেকে বের হয়। সাথে তার চার সঙ্গি। ড্রাগের নেশায় তারা পাঁচজন ঢুলছে। তাদের মনে হচ্ছে, পিঠে একটা ডানা লাগিয়ে দিলেই হয়তো তারা উড়তে পারবে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে রাস্তায় পা বাড়ায়। ওদের মধ্যে একজন উপরে তাকাতেই অহনাকে দেখতে পায়। চোখ কচলে মতিনকে জিজ্ঞেস করে,’ গুরু! মানুষ কি আকাশে উড়ে?’
মতি হেসে উঠে,’ হ উড়ে। আমার মতো করে।’
‘ না গুরু! তুমিতো নিচে। আকাশেও মানুষ উড়ে।’
‘ শা* আমি উড়ছি দেখে নে।’
‘ তুমি না। একটা সুন্দরী মেয়ে। মেয়েরাও পাখি হয়, উড়ে যায়।’
মতি উপরে তাকায়। অহনাকে দেখেই মুহুর্তেই আরো জোরে হেসে উঠে,’ মেয়েটা উড়ছে দেখ। এটা পাখি, আমার উরন্ত পাখি।’
গান ধরে, এক মুহুর্তের জন্য মাথা ঝাঁকি দিয়ে আবারো দেখে। কেমন সন্দেহ হয় তার। ব্যাগ থেকে বোতলটা বের করে চোখে-মুখে পানি দেয়। ফ্রেস হয়ে আবার দেখতে পায় উরন্ত অহনাকে। মাহতিমকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু দেখতে পাচ্ছে অহনাকে। অহনা উড়ছে দেখে মতি বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। দূরে সরে যাচ্ছে অহনা। আরজ কিছুটা কাছে গিয়ে দেখে নেয়। অদ্ভুত লাগছে তার কাছে। ভাবছে নেশার কারণে এটা হচ্ছে। আবারো পানি দেয় চোখে-মুখে।
না সে সত্যি দেখছে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,’ আমি যা দেখছি তোরাও কি তাই দেখছিস?’
‘ হ গুরু। মেয়েটা উড়ছে। কিন্তু কিভাবে? পাখি উড়তে দেখেছি, আজ প্রথম মেয়ে উড়তএ দেখলাম।’
মতি নিজেকে সামলে নেয়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, বিষয়টা সে জেনেই ছাড়বে…..
Sathi Islam : সাথী ইসলাম
চলবে…..