ছন্দ ছাড়া বৃষ্টি পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব | ইমোশনাল গল্গ

0
3620

#ছন্দ_ছাড়া_বৃষ্টি
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
#পর্ব-০৫ (শেষ পর্ব)
.
তন্ময়, তিন্নি রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। তিহান আমার সাথে এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, এটা মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর তিহানের আগমন ঘটলো রুমে। ও আমায় কান্নারত অবস্থায় দেখে অবাক হলো। দৌঁড়ে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
‘কী হয়েছে মৃদুলা? এভাবে কাঁদছো কেন?’

উনাকে দেখে আমার রাগটা যেন শতগুণ বেড়ে গেলো। আমি এক ঝটকায় উনার হাতটা আমার কাঁধের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
তিহান আবারও আকুতি করে বললো,
‘আমার তরফ থেকে কি কোনো ভুল হয়েছে? ভুল হলে সেটা আমায় জানাও, আমি শুধরে নেবো!’

আমি এবার উত্তেজিত হয়ে বললাম,
‘ভুল? ভুল হলে তো হতোই। কিন্তু আপনি তো ভুল করেননি। আপনি অন্যায় করেছেন। আমার ভালোবাসা আমার থেকে কেড়ে নিছেন। মেয়েদের সম্মান নিয়ে খেলেছেন। আবার জিজ্ঞেস করছেন, আপনি কোনো ভুল করেছেন কিনা? হাহ!’

‘মৃদুলা কী বলছো তুমি এসব? আমি তোমার ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছি? কীভাবে? আর মেয়েদের সম্মান দেই না আমি? তুমি এটা ভাবলে কী করে?’

‘ভাববো কেন? আমি তো নিজ চোখেই দেখেছি আপনি ক্যাফেতে একটা মেয়ের হাত ধরে বসেছিলেন। সেটাও কি মিথ্যে?’

তিহান এবার বেশ চমকালো। উৎকন্ঠা নিয়ে বললো,
‘ওয়েট, ওয়েট! তুমি আমায় ক্যাফেতে দেখেছো মানে? কবে, কোথায় দেখেছো? আমার তো মনে পড়ছে না বিয়ের আগে তোমার আমার দেখা হয়েছিলো কখনো। তাহলে?’

‘নিজ চোখে দেখেছি মানে এই নয় যে আমি সরাসরি দেখার কথা বলছি। আমি ছবিতে একটা মেয়ের সাথে আপনাকে দেখেছি।’

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

‘ওহ আচ্ছা, ছবি? তারমানে আজ তন্ময় এসেছিলো এখানে এসব বলতে, তাই তো?
হা হা হা মৃদুলা তুমি বড্ড ইনোসেন্ট জানো? যে তোমায় যেভাবে যা ইচ্ছে বুঝায়, আর তুমিও তাই বুঝে যাও। এর জন্যই তুমি বারবার ঠকে যাও। মৃদুলা, একটা মানুষ তোমার কাছে এসে একটা ছবি দেখিয়ে বললো, তোমার হাজবেন্ড ভালো না। আর তুমি সেটা বিশ্বাস করে নিলে?’

আমি এবার খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম। আসলেই তো একটা ছবিতেই কি সব প্রমাণ হয়ে যায়? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলাম। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তিহান চেঁচিয়ে বললো,
‘কী হলো বলছো না কেন? তন্ময় আর কী বলেছে আমার বিরুদ্ধে? তুমি সব বলবে? না কি আমিই বলবো?’

তিহানের কথায় চমকে তাকালাম। উনার কথার পিঠে বললাম,
‘আপনার এখনো কিছু বলার বাকি আছে? কোনো কিছু না ঘটলে তা রটে না। আর আমি তন্ময়কে বিশ্বাস করি। ও কখনো আমায় ঠকাতে পারে না। আপনি তো ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে থাকেন। আর মুখোশের আড়ালেই সব জঘন্য কাজকর্ম করে থাকেন।’

তিহান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
‘হায় রে বিশ্বাস! এগুলো হচ্ছে অন্ধ বিশ্বাস, বুঝলে? তন্ময় খুব ভালো, তাই না? ও হ্যাঁ, সে তো আবার প্রেমিক। ভালো তো হবেই। দুনিয়ার সবচেয়ে জঘন্য মানুষ তো আমি। হাহ!’

আমি থমকে দাঁড়ালাম। আশ্চর্য! উনি কীভাবে বুঝলেন তন্ময় আমার প্রেমিক? তবে তন্ময় কি উনাকে সবটা জানিয়ে দিছে? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম।

উনি আবারও বললেন,
‘অবাক হলে তো? আমি এতোসব কীভাবে জানতে পারলাম? তুমি তো মুদ্রার ওপিঠ শুনেছো তন্ময়ের কাছে। এপিঠ তো শুনাবো আমি। আর হ্যাঁ, আমার কথার মাঝে একটা কথাও বলবে না তুমি। মাইন্ড ইট!’

তিহান যে এতোটা রাগী এর আগে বুঝতে পারিনি। ওর ধমকের দাপটে আমি বারংবার কেঁপে উঠছিলাম। চোখ দিয়ে তো অঝর ধারায় জল ঝরছিলোই। আমি এখন ভাসমান অবস্থায় আছি। এপাশ থেকে তন্ময় তীরে উঠাতে চাইছে তো ওপাশ থেকে তিহান চাইছে! কোন পাড়ে আমার ঠাঁই হবে সেটা আমি নিজেও জানি না। আমার জীবনের মোড়ও বা কোন দিকে ঘুরে যাবে, সেটাও অনিশ্চিত! তিহান নির্দোষ প্রমাণিত হলে তন্ময় হয়ে যাবে অপরাধী!

তিহান দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালো। চোখ বন্ধ করে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে আরম্ভ করলেন,

‘তন্ময়ের সাথে তোমার রিলেশন ছিলো, সেটা কাল আমায় মাহি জানিয়েছিলো। সেদিন তোমার মাহির সঙ্গে ফোনালাপ গুলো আমি শুনেছিলাম। কিন্তু তোমায় বুঝতে দেইনি। তারপর তোমাদের বাড়ি যাওয়ার প্ল্যানটা আমিই করেছিলাম। যাতে মাহির সাথে সরাসরি আমি কথা বলতে পারি। প্রথমে অবশ্য মাহি এসবের কিছুই বলতে চাইছিলো না, কিন্তু জোর করার পর সবটা বলেছে। তন্ময় নাকি তোমাকে প্রমাণ দিবে আমার বিরুদ্ধে, সেটাও বলেছে। এরপর থেকেই আমি সাবধান হয়ে যাই। তন্ময়ের অতীতটা তোমাকে জানানোর জন্য আজ অফিসে যাওয়ার নাম করে আমি বাসা থেকে বেরিয়ে যাই। কিছু প্রমাণও এনেছি। দেখবে?’

আমি উৎসুক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম। উনি আমার কাছে এগিয়ে এসে ওই মেয়েটার আর উনার ছবি গুলো দেখিয়ে বললেন,
‘তন্ময় এই ছবি গুলো তোমায় দেখিয়েছিল তাই না?’
আমি মাথা ঝাঁকালাম। উনি আবার বললেন,
‘সাইডে ক্লিক করে দেখো তো এই ছবিটা দেখিয়েছিলো কি না?’

আমি সাইডে ক্লিক করামাত্রই ঠিক ঐ মেয়েটার সঙ্গেই তন্ময়ের ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের একটা ছবি দেখতে পেলাম। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। উনি মোবাইলটা আমার হাত থেকে নিয়ে আবার আগের জায়গায় দাঁড়ালেন। পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে রুমে। লজ্জায় আমার মাটি মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। কী করে আমি উনাকে অবিশ্বাস করে তন্ময়ের সব কথা অকপটে মেনে নিতে পারলাম?

তিহান বললেন,
‘তারপর…
আমি উনাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
‘বাকিটুকু আমি বুঝতে পারছি। তন্ময়ের সাথে মেয়েটার ফিজিক্যাল রিলেশন ছিলো, তাই তো?’

উনি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ-সূচক জবাব দিলেন। আমি আবারও বললাম,
‘সেদিন তন্ময় তিনদিনের জন্য গায়েব ছিলো এজন্যই। আর ওর সম্পূর্ণ দোষটা আপনার উপর চাপিয়ে দিয়েছে। যাতে ওকে আমি আবার মেনে নিতে পারি। ছিঃ এখন আমার উপরই ঘৃণা হচ্ছে। আচ্ছা তন্ময় নেশাও করতো, তাই না? আর সেজন্যই মা সেদিন বলেছিলো, ওকে দেশের বাইরে পাঠিয়েও ঠিক করতে পারেননি। তন্ময় এখনও নেশা করে আর মেয়েদের সাথে… ছিঃ’

তিহান আমার কথাগুলো শুনে মাথা নিচু করে ফেললেন। নিচু গলায় বললেন,
‘চার বছর আগে হঠাৎ করেই তন্ময়ের এসবের সাথে জড়িয়ে যায়। মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করা, নেশা করা এগুলো নিত্যদিনের অভ্যাস হয়ে উঠে ওর। তিনদিনের জন্য পুলিশের সহায়তায় ওকে খুঁজে পাই হোটেলে। পুলিশ ওকে গ্রেফতার করতে চাইলে আমি আর বাবা বিষয়টা ম্যানেজ করি। ওকে সঠিকপথে আনার জন্য শত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। তারপর মা ওকে বিদেশ পাঠিয়ে দেয় বড়খালার কাছে। আমার বিয়ে উপলক্ষেই দেশে এসেছে। বাট এই কয়দিনে আবারও ওসবে জড়িয়ে গেছে। আজ দু’টো মেয়ের সাথ তন্ময়ের এসব বিষয় নিয়েই কথা বলতে বাসা থেকে বের হয়েছিলাম আমি। ওরা কাল সকালে আসবে আমাদের বাসায়। আর আমি যে মেয়েটার হাত ধরেছিলাম, ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই ধরেছিলাম। তন্ময় ওর সাথেও ফ্লার্ট করেছিলো।’
কান্নারূদ্ধ কন্ঠে তিহান কথাগুলো বললেন।

আমি ফের প্রশ্ন করলাম,
‘কাল দু’টো মেয়ে আমাদের বাসায় আসবে কেন?’

তিহান কাচুমাচু স্বরে বললেন,
‘সেটা কালকেই বুঝতে পারবে মৃদুলা।’

আবারও নীরবতা। আমি হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলাম। সব কিছু শুনেও মেনে নিতে ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে আমার। তিহান আমার কাছে এগিয়ে এসে আচমকা কোলে তুলে নিলেন। আমি উনার গলা জড়িয়ে ধরে আরো জোরে কেঁদে দিলাম। উনি মৃদু স্বরে বললেন,
‘কেঁদে নাও, এতে মন হালকা হবে। তবে সবসময় মাথায় রাখবে, তোমার স্বামী সবসময় তোমার পাশে আছে। মানুষ মাত্রই ভুল। তুমিও একটা ভুল করে ফেলেছো। কিন্তু সেটা আগলে রেখে বাঁচা যাবে না মৃদু। তোমাকে আরো শক্ত হতে হবে। ভুলকে শুধরে নিয়ে নতুন করে বাঁচতে হবে। আবেগে গা ভাসিয়ে দিয়ে চললে হবে না। বাস্তবতা উপলব্ধি করে সেটার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
একটা কথা সবসময় মনে রাখবে, কাউকে অন্ধ বিশ্বাস করবে না। আমাকেও না। আমি তোমার স্বামী বলেই যে তুমি আমাকে দেবতুল্য মনে করবে, সেটা কিন্তু ভুল। আমিও মানুষ। আমারও ভুল হতে পারে। সেটা তুমি আমাকে ধরিয়ে দিবে। আমি শুধরে নেবো।
আর সবসময় এটা মাথায় রাখবে, পৃথিবীতে তোমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী আছে। সে তোমার ব্যক্তিগত শুভাকাঙ্ক্ষী। তোমার ভরসার জায়গা। আর কোথাও কেউ না থাকলেও সে আছে তোমার পাশে। সবসময়, সর্বদা। যে তোমায় ভীষণ করে ভালোবাসে।’

উনার চোখের দিকে তাকালাম। উনি মুচকি হেসে বললেন,
‘হ্যাঁ মৃদু, আমি তোমায় ভালোবাসি। ভীষণভাবে যত্ন করে ভালোবাসি।’

আমি আবারও ডুকরে কেঁদে বললাম,
‘আমায় ক্ষমা করে দেবেন। আমি আপনার মতো একজন স্বামী পেয়েও এতোদিন মিথ্যে মরিচীকার পিছনে ছুটেছি। এতোদিন আপনার ভালোবাসাকে ছন্দহীন বৃষ্টির মতো মনে হয়েছে আমার কাছে। তাই ভালোবাসা পেয়েও অবহেলা করেছি। আমায় মাফ করে দিবেন।’

তিহান আমার ঠোঁটে ওর আঙুল চেপে ধরে বললো,
‘হুশ! পুরোনো সব ভুলে এখন নতুন করে সবটা শুরু করো। এখন ভালোবাসা বুঝতে পারলেই হবে। এতোদিন ভালোবাসা বুঝোনি, এর জন্য ক্ষমা করে দিলাম। এখন আমার ভালোবাসায় ছন্দ খুঁজে পাচ্ছো তো?’

আমি মাথা নাড়ালাম। উনি কেমন দুষ্টুমির ছলে আমার দিকে তাকালেন। আমি লজ্জায় উনার গলায় নিজের মুখ লুকোলাম। উনি ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলেন। লজ্জায় আমার অবস্থা যায় যায়। ধীরে ধীরে আমায় বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আলতো করে আমার কপালে চুমু এঁকে দিলেন। উনার ভালোবাসার প্রথম স্পর্শ পেলাম। সর্বাঙ্গে শিহরণ বয়ে গেলো আমার। রাত বাড়ছে, আমরাও একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে লাগলাম…

_________
পরেরদিন সকাল দশটা নাগাদ ড্রইংরুমে চেঁচামেচির শব্দ পেয়ে ছুটে গেলাম আমরা। পুলিশ এসেছে, সাথে দু’টো মেয়ে। ওরা তন্ময়ের নামে কমপ্লেইন করেছে। তন্ময় ওদের সাথে জোরপূর্বক ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছিলো। তন্ময়ের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ এসেছে। ও ড্রাগ পাচারে জড়িত। সবকিছুর ভিত্তিতে পুলিশ ওকে গ্রেফতার করেছে। অবস্থাটা দেখে আমার বিচলিত হওয়ার কথা। কিন্তু আজ আমি মোটেও বিচলিত না। খারাপ লাগছে এটা ভেবে, জীবনের অনেক গুলোদিন আমি তন্ময়ের জন্য নষ্ট করেছি। তিহান আমার পাশে এসে আমার হাত শক্ত করে ধরতেই আমি নিজেকে সামলে নিলাম।
আজ তিহান বা পরিবারের কেউ পুলিশকে বাঁধা দিচ্ছে না। কারণ সবাই এটা বুঝে গেছে, ও শাস্তি না পেলে হয়তো কখনোই ঠিক হবে না। তন্ময় শাস্তিযোগ্যই অপরাধ করেছে। পুলিশ ওকে নিয়ে যাচ্ছে। আর আমি সেটা অপলক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। তবে সে দেখার মধ্যে ভালোবাসা বা কষ্ট কিছুই নেই। আছে শুধু ঘৃণা। একরাশ ঘৃণা।

.
(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে