#ছন্দ_ছাড়া_বৃষ্টি
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
#পর্ব-০৪
.
তিহান অফিসে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই তন্ময় হন্তদন্ত পায়ে আমার কাছে ছুটে আসে। আমি ওর প্রতীক্ষায়ই ছিলাম। ও আসার পর সরাসরি ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘প্রমাণ এনেছিস?’
তন্ময় আমার কথার জবাব না দিয়ে বরং একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। তারপর বললো,
‘ভাইয়ার সাথে তো চুটিয়ে সংসার করছিস। আমার কথা তোর একটুও মনে হয় না, তাই না রে মৃদু?’
‘দেখ্ তন্ময় হেয়ালি করিস না। প্রমাণ দেখা তাড়াতাড়ি। আমার এখন এসব একদম সহ্য হচ্ছে না।’
‘দিচ্ছি।’
কথাটা বলেই তন্ময় ওর মোবাইল থেকে আমাকে কয়েকটা ছবি দেখালো। আমি ছবিগুলোর কোনো অর্থ খুঁজে পেলাম না। তন্ময়কে জিজ্ঞেস করলাম,
‘এই ছবি গুলো দিয়ে কী প্রমাণ করছিস? এখানে দু’টো ছেলে-মেয়ে বসে আছে। তো?’
তন্ময় এবার শব্দ করে হাসলো। বললো,
‘তুই সত্যিই আর কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছিস না ছবিতে?’
আমি স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিলাম,
‘না। আর এরাই বা কারা?’
‘এখানে একজন তোর পেয়ারের স্বামী। আর অন্যজন ওর এক্স গার্লফ্রেন্ড।’
‘কীহ্!’
‘অবাক হচ্ছিস? শোন্, আমি তোকে সবটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। ক্যাফেতে ভাইয়া ওর প্রেমিকাকে নিয়ে বসেছিলো। সেটা কোনো সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে ভাইয়া এই মেয়ের সাথে…’
‘এই মেয়ের সাথে কী তন্ময়?’
আমি ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললাম।
‘আহ মৃদু, এখনই এতো উত্তেজিত হচ্ছিস কেন? বলছি তো আমি। নিজের ভাইয়ের নামে, তারই বউয়ের কাছে এসব বলতে রুচিতে বাঁধছে।’
তন্ময়ের প্রতিটা কথায় আমার গা গুলিয়ে আসছে। রাগে শরীর রি রি করছে।
আমি ওকে ধমক দিয়ে বললাম,
‘এখানে ছেলে মেয়ে কারো ছবিই স্পষ্ট না। এই ছবিতে কিচ্ছু প্রমাণ হয় না তন্ময়। তুই আমাকে বোকা বানাতে চাইছিস। আমি বেশ বুঝতে পারছি। আসল কথা, তুই আমার জীবনে সুখ সহ্য করতে পারছিস না। একবার আমাকে তুই নিজেই সুখের সন্ধান দিয়ে আবার নিজেই উধাও হয়ে গেলি।
এখন আমার বিয়ে হয়েছে; তাই আমি যাতে স্বামীর সংসার না করতে পারি তার জন্য এসব আজবাজে কথা বলছিস, তাই না?’
তন্ময় আমাকে শান্ত করার জন্য এগিয়ে আসলো। আমার দুই বাহুতে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো,
‘মৃদু, এমন উদ্ভট কথা বলিস না। তোর সুখ আমি চাইবো না তো আর কে চাইবে হ্যাঁ? আমি তোকে কতোটা ভালোবাসি, তা আজও তুই বুঝতে পারলি না। এই একটা আফসোস আমাকে সারাজীবন কুড়ে কুড়ে খাবে।
মৃদু, তোর মনে আছে কলেজের ফার্স্ট সেমিস্টারের পর আমি তিনদিনের জন্য গায়েব হয়ে গিয়েছিলাম যে? মনে আছে তোর?’
আমি অস্পষ্ট কন্ঠে বললাম,
‘হু।’
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
‘তখন কিন্তু আমি তোকে মিথ্যে বলেছিলাম, যে আমি হঠাৎ করে একটা ফ্রেন্ডের গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিলাম, তাই তোকে জানাতে পারিনি। আসলে, ব্যাপারটা কিন্তু তা ছিলো না। তিনদিনের জন্য ভাইয়া গায়েব হয়ে গিয়েছিলো। পুরো শহর খুঁজেও ওকে আমরা কোথাও পাচ্ছিলাম না। তখন পুলিশের সহায়তায় ওকে হোটেলে একটা মেয়ের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় খুঁজে পাই আমরা।’
তন্ময়ের কথাটা শুনে আমি পুরো স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঘৃণামিশ্রিত কন্ঠে জবাব দিলাম,
‘ছিঃ উনি এমন নীচ মন মানসিকতার মানুষ? আর আমি কিনা উনার সাথেই এই দু’টো দিন একই বিছানায় ছিলাম! ছিঃ!’
তন্ময় ক্ষণকাল নীরব রইলো। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,
‘তন্ময় সব সত্যি বলছিস তো? আচ্ছা ছবিতে উনার মুখ বোঝা যাচ্ছে না। আমার একটা ক্লিয়ার ছবি দেখাতে পারবি?’
তন্ময় কিছু একটা ভেবে বললো,
‘পারবো।’
তারপর সত্যি সত্যিই তিহানের সাথে একটা মেয়ের ছবি দেখালো। যেখানে তিহান মেয়েটার হাত ওর হাতের মুঠোয় নিয়ে রেখেছে। ছবিটা দেখামাত্রই আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। এগুলো আমি সত্যিই আর নিতে পারছি না।
ও আবার বললো,
‘তারপর ভাইয়াকে নিয়ে আমরা বাসায় ফিরি। পুলিশ গ্রেফতার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু বাবা ওদেরকে টাকা দিয়ে বিষয়টা ধাপাচাপা দেন। এরপর থেকেই ভাইয়া কেমন অদ্ভুত আচরণ শুরু করে আমাদের সাথে। হুটহাট রেগে যায়। খাওয়া-দাওয়া করে না ঠিকমতো। তিন্নিকে আর আমাকে সারাক্ষণ বকাঝকা করে। মা এসব সহ্য করতে পারে না। স্ট্রোক করেন। ভাইয়া তবুও ঠিক হয়নি। এরপর আরো ভয়ংকর হয়ে উঠে ও। নেশা শুরু করে। আমরা কেউ ওকে থামাতে গেলে মার দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসে। মা তখন কিছুটা সুস্থ। ভাইয়ার এমন অবস্থায় আমার পড়ালেখাতে ব্যাঘাত ঘটতে থাকে। বাবা অফিস আর মাকে সামলান। আর আমি ভাইয়াকে।’
‘কিন্তু এর মধ্যে তুই দেশের বাইরে কেন গেলি? আর আমাকেই বা কেন সবটা বলিসনি? না বলেই হুট করে চলে গেলি। আর তুই ঐ দিন ঐ কথাই বা কেন বললি, আমার দিকে তিহানের নজর ছিলো আর সে জন্যই তোকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে সে।’
আমার প্রশ্ন শুনে অন্যদিকে ফিরে বললো,
‘আসলে ঐদিন তোকে ভাইয়ার বউ রূপে দেখে আমার মাথা ঠিক ছিলো না। তাই বলেছিলাম, ওর নজর ছিলো তোর দিকে। তবে আমার দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পিছনে সত্যিই ভাইয়ার হাত রয়েছে। ও নেশার পরিমাণ বাড়িয়ে দিলো। আমি ওকে বোঝাতে গেলে আমার গলা টিপে ধরে। একটুর জন্য সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম। তখন মা আমাকে ওর থেকে দূরে রাখার জন্য দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে আমার বড়খালা থাকেন। তার কাছেই এই চার বছর ছিলাম। গত বছরের শেষের দিকে ভাইয়া আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। আর তারপরই আমাকে দেশে আসতে বলা হয়। নিজের দেশ, প্রিয়জনদের ছেড়ে একদম নিঃস্ব হয়ে গেছিলাম আমি। তাই ফিরে আসতে বলায় তাড়াতাড়ি ফিরে আসি।’
তন্ময়ের কন্ঠটা কেমন ভেজা লাগছে। বোধহয় কাঁদছে। আমি ধীর পায়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখে চোখ মোছার চেষ্টা করতে লাগলো ও।
‘তুই কাঁদছিস কেন? তোর তো কোনো দোষ ছিলো না।’
‘হুম, কিন্তু তোকে তো আমি চিরকালের মতো হারিয়ে ফেললাম মৃদু। তুই এখন সম্পর্কে আমার ভাবী। হাহ! ভাইয়া আমার জীবনটা তছনছ করে দিলো।’
‘আমি এই চার বছর তোর স্মৃতি নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছিলাম। আমাকে কেন বলে যাসনি তন্ময়? তাহলে হয়তো আজকের এই দিনটা তোকে দেখতে হতো না। কেন বলে যাসনি?’
কথাটা বলেই আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। তন্ময় আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
‘তখন তোকে এসব বললে, তুই আরো ভেঙে পড়তি। আমাকে ছাড়া তো তুই এক মুহুর্তও থাকতে পারতি না। আর তখন আমি নিজেও জানতাম না আমি আবার দেশে ফিরে আসবো। ভাইয়া আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে। সব অগোছালো ছিলো তখন। বড্ড অগোছালো!
আর দেখ্ নিয়তি, সে-ই ভাইয়াকে এখন সব দিলো। আর আমাকে করে দিলো নিঃস্ব। আমি আর পারছি না রে মৃদু। মাঝে মাঝে সব ছেড়েছুড়ে আবারও হারিয়ে যেতে মন চায়।’
তন্ময় আমার হাত দু’টো শক্ত করে ধরে বললো,
‘মৃদু, তুই ভাইয়াকে এসব কিছুই বলবি না, কথা দে? আমি চাই না, সত্যিই চাই না ভাইয়া এসব তোর মুখে শুনতে পাক। তাহলে ভাইয়া হয়তো আবার আগের মতো হয়ে যাবে। তুই ভাইয়াকে কষ্ট দিস না। এতে আমার পরিবার আবারও ভেঙে পড়বে।’
তন্ময়ের হাত থেকে আমি আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
‘না তন্ময়, আমি তোর মতো এতো ভালো মানুষ না। তোর জীবনের সাথে সাথে তোর ভাইয়া আমার জীবনটাও নষ্ট করে দিয়েছে। আমার থেকে আমার ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছে। এর জবাবদিহি উনাকে করতেই হবে।’
আমার কথা শেষ হওয়া মাত্রই তিন্নি রুমে আসলো। আমাকে আর তন্ময়কে এক রুমে দেখে ও গাল ফুলিয়ে বললো,
‘দেবর-ভাবীতে মিলে খোশগল্প করা হচ্ছে। অথচ আমায় একবারও ডাকা হলো না। আমায় ভাবী মোটেও ভালোবাসে না।’
আমি অন্যদিকে ফিরে তাড়াতাড়ি চোখের কোণের পানিটা মুছে নিলাম। তারপর বুকে হাত রেখে শ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললাম,
‘যাক বাবা! তিন্নি আমার আর তন্ময়ের কথা একটুও শুনতে পায়নি। এটাই অনেক।’
.
(চলবে…)