#ছন্দ_ছাড়া_বৃষ্টি
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
#পর্ব-০৩
.
হঠাৎ করে তিহান হাসতে আরম্ভ করলেন। এবার আমি ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলাম,
‘হাসছেন কেন?’
উনি হাসতে হাসতেই জবাব দিলেন,
‘তোমাকে ভয় পেলে বেশ দারুণ লাগে। বড্ড ইনোসেন্ট দেখায়।’
‘ধুর, সবসময় এমন মজা ভালো লাগে না। আমরা কখন যাচ্ছি ও বাড়িতে?’
‘বিকেলে। তবে রাতেই ফিরে আসবো। কাল আমাকে অফিসে যেতে হবে। যদিও আমি এখন ছুটিতে আছি, তবুও বস একবার দেখা করতে বলেছেন।’
তিহানের কথায় আমি গোপনে নিঃশ্বাস ছাড়লাম। শতভাগ নিশ্চিত হলাম, তিহান আমার কথাগুলো সম্পূর্ণ শুনেননি। না হলে এভাবে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতেন না উনি। ছোটো করে জবাব দিলাম,
‘হু, আচ্ছা।’
উনি যতক্ষণ রুমে থাকবেন, আমি স্বস্তি পাবো না। তাই বের হয়ে আসলাম রুম থেকে। তিহান পিছু ডেকে বললেন,
‘মৃদুলা, একটু জুস নিয়ে আসবে? বড্ড গরম লাগছে।’
‘নিয়ে আসছি।’
উনাকে মুখের উপর না করতে পারলাম না। তবে উনার এমন আহ্লাদী আবদারগুলোও সহ্য হচ্ছে না। এমন দোটানা থেকে কবে বের হতে পারবো, উপরওয়ালা জানেন। জুস নিয়ে ফিরে এসে দেখলাম তিহান বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে উনি হাতের সিগারেট ফেলে দিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
‘দিনে কয়টা খাওয়া হয়?’
উনি ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী?’
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
‘এই যে সিগারেট, দিনে কয়টা খান?’
উনি এবার লজ্জা পেলেন। স্বভাবতই কোনো স্ত্রী তার স্বামীর সিগারেট বা নেশা জাতীয় কোনো কিছু পছন্দ করে না। তাই হয়তো এমন লজ্জা পেলেন তিহান। সংকোচ ভরা কন্ঠে বললেন,
‘বেশিরভাগ সময় তিনটা খাওয়া হয়। তবে, মাঝে মাঝে চারটাও হয়ে যায়।’
আমি উনার দিকে জুসটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,
‘তবে যাই বলুন, আমার কিন্তু সিগারেট খাওয়া ছেলেদের হেব্বি লাগে।’
আমার কথা শুনে উনি চোখ বড় বড় করে তাকালেন। আমি নিজেও বুঝতে পারলাম অকপটে এমন ধরনের কথা বলা আমার মোটেও উচিত হয়নি। নিজেও লজ্জা পেলাম, উনাকেও বিভ্রান্তিতে ফেললাম। নিজের ভুল বুঝতে পেরে তিহান কিছু বলার আগেই উনার সামনে থেকে দ্রুত প্রস্থান করলাম।
তন্ময়ের আগমন ঘটে বিকেল তিনটায়। আমি তখন রেডি হচ্ছিলাম। তিহানও রুমেই ছিলেন। তন্ময় আমাদের রুমের দরজায় নক করতেই তিহান বললেন,
‘ভেতরে আয়।’
তন্ময় ভেতরে প্রবেশ করেই আমার দিকে আড়চোখে চাইলো। ওর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বাইরে থেকে কারো সাথে ঝগড়া করে এসেছে। ও এসেই সরাসরি বললো,
‘ভাইয়া তুই একটু রুম থেকে যা। আমার মৃদূর সাথে কিছু কথা আছে।’
ওর এমন কথায় আমি, তিহান দু’জনেই আশ্চর্য হলাম। তিহান আমার দিকে তাকাতেই আমি মাথা নিচু করে ফেললাম।
তিহান তন্ময়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘তন্ময় এসব কী? তুই মৃদুলাকে নাম ধরে ডাকছিস কেন? ও তোর বড় ভাইয়ের বউ, এটা ভুলে গেছিস? আর তোর ওর সাথে কী এমন কথা আছে যে আমার সামনে বলতে পারছিস না?’
তিহানের কথায় বোধহয় তন্ময়ের টনক নড়লো। ও মৃদু স্বরে বললো,
‘সরি ভাইয়া।’
কথাটা বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আজব! ও এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন? আর ওর উদ্দেশ্যটা কী? আমাকে তিহানের চোখে খারাপ বানানো নাকি নিজে খারাপ হওয়া? মস্তিষ্ক জুড়ে রাজ্যের প্রশ্ন। অথচ উত্তর নেই। তন্ময় চলে যাওয়ার পর তিহানও বেরিয়ে গেলো। আমি তো ভেবেছিলাম তন্ময় বেরিয়ে যাওয়ার পর তিহান আমাকে প্রশ্ন করবেন। তন্ময় আমাকে নাম ধরে ডাকলো কেন, এই নিয়ে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল; তিহান কিছুই বললেন।
তিহানের এমন চুপচাপ সব সহ্য করে যাওয়াটা আমার নতুন ভয়ের কারণ। কোনো প্রলয়ঙ্কারী ঝড় আসার আগে যেমন সবটা থমথমে হয়ে যায়, তিহানের চুপ থাকাটাও আমার এমন মনে হচ্ছে। কী ঘটতে চলেছে আমার জীবনে?
__________
আমাদের বাড়িতে আসার পর থেকেই তিহানকে কোথাও দেখছি না। এমন নয় উনাকে না দেখে থাকতে আমার কষ্ট হচ্ছে। বরং আমার বেশ লাগছে, উনি সামনে না থাকায়। বেশ কিছুক্ষন পর উনি কোথা থেকে উড়ে এসে বললেন,
‘ মৃদুলা, চলো এখন বাড়ি ফিরতে হবে। বেশি রাত হয়ে গেলে সমস্যা।’
আমি আর আপত্তি জানালাম না উনার কথায়। আমারও ঐ বাড়িতে ফেরাটা জরুরি। আজ প্রমাণ দেখতে পারিনি, কিন্তু কাল নিশ্চয়ই পারবো। ভোরে না পারলেও তিহান অফিসে থাকাকালীন পারবো। মাহি অবশ্য আমাকে নিয়ে অনেক চিন্তিত। ওর ভয়ের কারণ আমার শ্বশুরবাড়ির লোক আমার আর তন্ময়ের রিলেশন ছিলো, এটা জানতে পারলে ঠিক কীভাবে রিয়্যাক্ট করবেন সেটা ভেবে। আমিও যে এই কথাটা ভেবে ভয় পাচ্ছি না, ঠিক তা নয়।
তবুও মাহিকে আশ্বস্ত করে বললাম,
‘চিন্তা করিস না, আমি সবটা সামলে নিবো।’
মাহি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
‘সাবধানে থাকবি। আর আমাকে আপডেট জানাস কী হয়, ওকে?’
‘আচ্ছা।’
মাহির সাথে কথা শেষ করে আব্বু-আম্মু আর ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ঘন্টাখানেকের মধ্যে বাসায় পৌঁছেও গেলাম৷
তিহান এসে ফ্রেশ হয়ে নিলেন। উনার পরে আমিও ফ্রেশ হয়ে বেলকনিতে গেলাম। তিহান পিছন থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। এতে আমি বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ করলাম না। উনি আমার ঘাড়ে উনার নাক ঘষলেন। উনার স্পর্শে আমার সারা শরীরে শিহরণ দিয়ে উঠলো। কেমন এক মিশ্র অনুভূতির সম্মুখীন হচ্ছি আমি! যার মাঝে ভালো লাগা, মন্দ লাগা দু’টোই রয়েছে।
তিহান আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,
‘জানো মৃদুলা, তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম, সেদিনই ভালো লেগেছিলো। এর আগেও আমার জন্য অনেক মেয়ে দেখা হয়েছিলো, আমার পছন্দ হয়নি। কিন্তু তোমাকে দেখার পর থেকেই তোমার প্রতি নামহীন এক মায়া কাজ করছিলো। তারপর ধীরে ধীরে সেটা ভালোবাসায় পরিণত হলো। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি মৃদুলা।
জানো, মানুষের জীবনে প্রেম জিনিসটা আপেক্ষিক। এখন আছে, কিছুক্ষণ পর হয়তো আর থাকবে না। তাই আমি তোমার প্রেমে পড়িনি। আমি তোমায় ভালোবেসেছি। ভালোবাসা আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। শুধু তুমি তোমার হাত দু’টো শক্ত করে আমার হাতের মুঠোয় রেখো। কথা দিচ্ছি, কোনোদিন ছেড়ে দিবো না। জনমভর আগলে রাখবো তোমায়!’
মনোযোগী শ্রোতা হয়ে আমি উনার কথা শুনছি। কী সুন্দর প্রেম, ভালোবাসার বিশ্লেষণ করছেন। আচ্ছা, আমি আর তন্ময় কি একে অপরের প্রেমে পড়েছিলাম না কি ভালোবেসেছিলাম? তন্ময় যদি নিজেকে সত্যিই নির্দোষ প্রমাণ করতে পারে, তাহলে আমার আর তিহানের সম্পর্কটা এমন থাকবে? না কি সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে?
আমাকে এমন নিশ্চুপ থাকতে দেখে তিহান আবার বললো,
‘তুমি কি আমাকে বিয়ে করে খুশি হওনি, মৃদুলা?’
উনার এমন প্রশ্নে আমি ঘাবড়ালাম না। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললাম,
‘ব্যাপারটা তা নয়। আসলে হুট করে বিয়েটা হয়ে যাওয়ায় নিজেকে সবার সাথে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগছে। আমাকে কিছুদিন সময় দিন। আমি ঠিক সবার সাথে মানিয়ে নিতে পারবো।’
‘তুমি যতদিন ইচ্ছে সময় নাও। তবে সবসময় আমার পাশে থেকো। কখনো ভুল বুঝে দূরে সরে যেও না।’
আমি কিছু বললাম না। সব কথার জবাব দিতে নেই। এতে মায়া বাড়ে। আর আমি ততদিন তিহানের মায়া বাড়াতে চাই না, যতদিন না উনি নির্দোষ প্রমাণ হচ্ছেন। যদি সত্যিই উনি তন্ময়কে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে থাকেন, তাহলে এর শাস্তি উনাকে পেতেই হবে।
তিহান আমার উত্তর না পেয়ে ছেড়ে দিলেন। কিছুক্ষণ দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। জীবনে এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হবো কখনো ভাবিনি। সবটা ধোঁয়ার মতো লাগছে আমার কাছে।
রুম থেকে বেরিয়ে ডিনারের উদ্দেশ্যে ডাইনিং রুমে যেতেই তন্ময়ের সাথে সজোরে ধাক্কা খেলাম।
‘সরি আসলে খেয়াল করিনি।’
নিচু গলায় বললাম তন্ময়কে।
‘আরে ভাবী, আপনার সরি বলার কিছু হয়নি। আসলে দোষটা আমার। মোবাইল স্ক্রল করতে করতে হাঁটছিলাম তো।’
তন্ময়ের মুখে ভাবী ডাক শুনে কিছুটা অবাক হলাম। পাশে তাকিয়ে দেখলাম তিন্নি পাশের চেয়ারেই বসে আছে। এবার সবটা পরিষ্কার হলো। তিন্নি সামনে থাকায় ও ভাবী ডাকছে। আমি ভদ্রতাসূচক মাথা নাড়ালাম।
তন্ময় পাশ কেটে যাওয়ার সময় বললো,
‘কাল ভাইয়া অফিসে যাওয়ার পর তুই প্রমাণ পেয়ে যাবি। রেডি থাকিস।’
আমি ওর যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম। তন্ময়কে কেমন জানি অগোছালো লাগছে। কী হয়েছে ওর?
.
(চলবে…)