#চোরাবালি
#পর্বঃ৬
#আহিয়া_আমান_অণু
পরেরদিন সকালবেলায় নিজের সিমেন্টের দোকানে চেয়ার টেবিল পাতানো জায়গায় বসে আছেন ফখরুল মির্জা। তখনই তার বড় মেয়ে-জামাই শাহীন তালুকদার উপস্থিত হয় সেখানে।দোকানে আরও দু-চারজন লোকজন বসে ছিলো; ফখরুল মির্জা তাদের যেতে বলেন দোকান থেকে।শাহীন শ্বশুরমশাইকে সালাম দিয়ে হিসাব পত্রের খাতা আর টাকার বান্ডিল গুলো টেবিলে রাখে।ফখরুল মির্জা সালামের উত্তর নিয়ে হিসাবপত্রের খাতাটা খুলে দেখতে থাকেন।শাহীন শ্বশুর মশাইয়ের বসার চেয়ারের ডান পাশে দাড়িয়ে রয়।ফখরুল মির্জা বসতে বললেও বসলোনা।আপাতত তার মনোভাব এখান থেকে যেতে পারলে বাচে সে।হিসাবের খাতা দেখতে দেখতে ফখরুল মির্জা বলে উঠে,
“আদ্রিজা ফিরে আসছে শুনছো এটা?”
শ্বশুড় মশাইয়ের মুখে আদ্রিজার নাম শুনে চমকে তাকায় শাহীন তালুকদার। সে তো এসেছিলো তার শ্বশুরমশাইকে গত একমাসের মুদির দোকানের যাবতীয় হিসেব বুঝিয়ে দিতে। গন্জের বাজারে তার দুটো মুদির দোকান সহ শ্বশুরের গুলোর দেখার দায়িত্বও তার উপর।এটা অবশ্য শ্বশুরবাড়ির লোকজন আর জানেনা আদ্রিজার সাথে ঘটানো ঘটনার পর।কাজের লোক লাগিয়ে দোকানের হিসেবটা নিজেই দেখে শাহীন।মাসশেষে একবার তার শ্বশুরকে বুঝিয়ে দিয়ে যায়।সেটা করতে এসেই এই নিউজ শুনবে ভাবনা কেনো কল্পনাতেও ছিলো না।শাহীন তার শ্বশুরমশাইকে একবার দেখে নিলো।উনি কথাটা বলে নির্লিপ্ত ভাবে টাকার হিসেব দেখছেন হিসাবপত্রের খাতায়।শাহীন বার কয়েকঢোক গিলে উত্তর দিলো,
“দেখুন আব্বা; ফিরে আসছে ভালো কথা।ওকে ওর মতো ছেড়ে দেন।আমাকে আর কিছু করতে বইলেন না।”
ফখরুল মির্জা বড় মেয়ে-জামাইয়ের এমন উত্তরে সহাস্যে তাকালেন শাহীনের দিকে।তারপর বললেন,
“কিছু করতে মানা করছো শাহীন? যদি মুখ খু্লে আমার বিরুদ্ধে? প্রমাণের অভাবে না হয় পার পাবো; কিন্তু ওর কথায় আইনের লোক যদি ক্ষতিয়ে দেখে আমি বাচতে পারবো তো?”
“আপনি অন্যায় কর্ম কেনই বা করেছিলেন আব্বা?নিজে করেছেন ভালো, তবে আমায় কেনো জড়িয়েছেন এসবে?সবই মানলাম না হয় কিন্তু নিজের ছেলের সুখের সংসারটা আমায় দিয়ে কেনো বরবাদ করালেন?আমার তো একটাই দোষ আপনার মেয়েকে ভালোবেসেছি।সেজন্য তাকে ধরে রাখতে জীবনে আমানের ভালোবাসা; তার সুখের সংসার ভেঙে গুড়ো করতে হয়েছে আপনার কথায়।এরপর আর কি চাইছেন? সত্যিটা সামনে আসলে কি করবেন এটা ভাবুন এখন।”
“অতিরিক্ত কথা বলছো তুমি শাহীন।সত্যিটা যেন সামনে না আসে সেই ব্যবস্থা তোমারই করতে হবে।”
হিসাবপত্রের খাতাটা শাহীনের দিকে এগিয়ে দিয়ে কথাটা বলেন ফখরুল মির্জা। শাহীন প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকায় শ্বশুরের দিকে।ফখরুল মির্জা চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বলেন,
“বুঝোনি তো কি বললাম?”
শাহীন মাথা নাড়িয়ে হ্যা বুঝায়।ফখরুল মির্জা এবার হাসলেন কিছুটা শব্দ করে।তারপর উত্তর দিলেন,
“আদ্রিজা মুখ খোলার আগেই মুখ বন্ধ করে দাও।আর ওর ছেলেকে মির্জা বাড়িতে পৌছানোর ব্যবস্থা করো।আমার নাতী; আমার বংশের প্রদীপ আমার বাড়িতেই ফিরে আসুক।”
শাহীন বুঝতে পারে এবার ফখরুল মির্জার কথা।মাথাটা ভনভন করছে তার।কখন জানি জ্ঞান হারায় সে।আর কতটা নিচে নামবেন উনি?শাহীন দমে যায়; কিছু বলতেও গিয়েও বলেনা।বাবা তো মাথার উপর ছায়া।অথচ এই লোকটা ছায়া হয়ে পা দিয়ে পিষিয়েও মাড়িয়ে ফেলে। শাহীন হিসাবপত্রটা নিয়ে হনহনিয়ে চলে যায় দোকানের দিকে। ফখরুল মির্জা টাকার বান্ডিলগুলো টেবিলের ড্রয়ারে রাখে।তারপর আনমনে নিজেই নিজেকে বলেন, ‘টাকা থাকলে সুখ এমনিই এসে ধরা দেবে।টাকা থাকলে তো বাঘের চোখও কিনে পাওয়া যাবে।তাই টাকা রোজগারের পথে কেউ বাঁধা হয়ে দাড়ালে তাকে তো মরতেই হবে।সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে তা তো বাকাতেই হবে।কিন্তু তার আগে দেখতে হবে আদ্রিজা কি করে! আমান আর আদ্রিজার তালাকের ব্যবস্থাটা করতে হবে। নয়তো দেখা যাবে কখন জানি নিজের অধিকারের দাবী নিয়ে উপস্থিত হয় মির্জা বাড়িতে।”
ফখরুল মির্জা চেয়ারে গা এলিয়ে দেন।দোকানের কাজের লোকদের কাজের প্রতি নজর বুলাতে থাকেন।
১৪
সকাল দশটা কি এগারোটা বাজে হয়তো।বাড়ির সামনে পুরো উঠোন জুড়ে তাহিফ দৌড়াচ্ছে।তার পিছনে নুডলসের বাটি হাতে দৌড়াচ্ছি আমি।আধাঘন্টা আগে ঘুম থেকে উঠেই বললো নুডলস খাবে।আম্মা আমাকে তাহিফকে ফ্রেশ করিয়ে দিতে বলে নুডলস ভেজে দেন আমায় তাহিফকে খাওয়াতে। কিন্তু নুডলস ভাজার পর তার খাওয়ার নাম নেই। উল্টো দৌড় করাচ্ছে আমায়। আমি দৌড়াতে দৌড়াতে হাপিয়ে উঠোনের এককোণায় বাশের চাড় পেতে রাখা বসার জন্য; সেখানে বসে পড়লাম। তাহিফ আমার থেকে দূরে দাড়িয়ে পড়লো। আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। আম্মা হেঁশেল পাড়ে বসে তাহিফকে বারণ করছে আমায় বিরক্ত করতে। দুপুরের রান্না বসিয়েছেন উনি।আব্বা দুপুরে বাড়িতে খাবেন আজ। প্রতিদিন আলিফ অথবা আমাদের গোমস্তা কাজের লোক গিয়ে দিয়ে আসে। আমি একটু জিরিয়ে নিয়ে তাহিফকে বললাম,
“বাবা তোমার খেতে হবেনা ঠিক আছে?এবার কাছে আসো।”
তাহিফ গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসলো আমার দিকে।আমার কাছে আসতেই ধরে বসিয়ে দিলাম আমার পাশে।তারপর আমার একহাত ওর দুহাত মুঠো করে নিলাম। চামচে নুডলস পেচিয়ে মুখের সামনে ধরে বললাম,
“খেয়ে নাও, তাহলে মাম্মা অনেকগুলো জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাবে তোমায়।”
তাহিফ তবুও নড়াচড়া করে খাবেনা বলে জিদ করলো। পরে যখন বুঝলো না খেলে নিস্তার নাই তাই বাধ্য বাচ্চার মতো খেলো একটু। আমি তাতেই খুশি, জ্বর অনেকটা কমেছে তার। কাল ভাগ্য ভালো ছিলো, সময়মতো রিকশা পেয়ে আমানকে ফেলেই চলে আসছিলাম সেখান থেকে। তাহিফ আমায় হঠাৎই কোলে উঠে চুমু দিলো গালে।আমি হাসলাম, বাচ্চাটা আমার সাথে থাকলে আমি হাসতে পারি। কারণে অকারণে হাসি, এটাই হয়তো মা হওয়ার অনুভূতি। আমি তাহিফকে বললাম,
“কি হয়েছে বাবাইয়ের হুম? হঠাৎ এত আদর করছে যে!”
“মাম্মা আমি চিপস খাবো। আমায় এনে দাও।”
জ্বরের মুখে এসব খাওয়া রুচিকর নয় সেটা বুঝেও আলিফকে ডাকলাম। আলিফ শুয়েছিলো,আজ ওর ক্লাস নেই বিধায় এখনও উঠেনি।ফজরের নামাজ পরে আবার শুয়ে পড়েছে। শুধু শুইনি আমি আর আম্মা।আম্মা আব্বার জন্য নাস্তা তৈরি করতে ঘুমায়নি আর।আমিও তাহিফ তখন উঠেছিলো বলে আর ঘুমানো হয়নি আমার।তাহিফ ঘুমিয়ে পড়লেও আমার আর ঘুম ধরেনি, উঠে এসে আম্মার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করেছি।আলিফ দেখলাম জ্যাকেট গায়ে ঠকঠক করতে করতে বারান্দায় এসে দাড়ালো। শীতের প্রকোপে কম্বল ছেড়ে উঠাই কষ্টসাধ্য। বারান্দায় দাড়িয়েই আলিফ বলে,
“আপা কিছু বলবি?ডাকলি কেনো? ডেকে আবার চুপ করে আছিস?”
আমি আলিফের কথায় উত্তর দিয়ে বললাম,
“দোকানে যা। তাহিফের জন্য পটেটো চিপস আন গিয়ে।”
আলিফ কথা বাড়ালো না; দেখলাম ঘরে গিয়ে টাকা নিয়ে গলায় মাফলার পেচাতে পেচাতে বেরিয়ে পড়লো।তাহিফ খুশিতে আমাকে আরও কয়েকটা চুমু দিলো গালে কপালে। আমিও ছেলের সাথে খুনশুটিতে মেতে উঠলাম।
“বাহ ছেলেকে নিয়ে বেশ খুশি আছিস তো?এতদিন যে আমাদের কষ্ট দিলি তার কি হবে আদ্রি?”
কারোর অভিযোগ পূর্ণ গলার স্বর শুনে উঠোনের গেটের দিকে তাকালাম। বৃষ্টি দাড়িয়ে আছে, নাজমুল চাচার মেয়ে বৃষ্টি। আমি আর ওর সমবয়সী।কিন্তু চাচা যে বললেন শ্বশুরবাড়িতে ও! আসলো কখন? আমি তাহিফকে বসিয়ে ওর সামনে যাই। সামনাসামনি দাড়াতেই বৃষ্টি আমায় জড়িয়ে পিঠে কিল-ঘুষি মারতে শুরু করে নরম হাতে।
“আরে আরে কি করছো বৃষ্টি মা?মেয়েটাকে মেরে ভর্তা করবে নাকি?
আম্মা তাহিফকে কোলে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে কথাটা বলেন।বৃষ্টি আমাকে ছেড়ে আম্মাকে সালাম করে।আম্মা সালামের উত্তর নিলে আম্মার সাথে কুশল বিনিময় করে বৃষ্টি। তাহিফকে কোলে নিতে চাইলে আসেনা।আমি তাহিফকে বললাম,
” খালামনি হয়, সালাম দাও খালামনিকে।তারপর কোলে যাও উনার।তোমার সাফু আন্টির মতো ইনিও একজন আন্টি।”
তাহিফ আমার কথা শুনলো। বৃষ্টিকে সালাম দিয়ে কোলে গেলো।
“তোমরা আদ্রির ঘরে যাও। আমি নাস্তা নিয়ে আসতেছি। তা বৃষ্টি মা জামাই আসেনি কি?”
আম্মু আমাদের দুজনের উদ্দেশ্যে কথাটা বলেন। বৃষ্টি উত্তর দেয়,
“না বড়আম্মা। তার একটু কাজ পড়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম গেছে। তাই তো আসতে পারলাম, নয়তো আসতে দিতোনা।”
“তোমাদের প্রশ্ন-উত্তরের পর্ব হয়েছে কি? হলে ঘরে যেতাম আমি।”
আমার কথায় বৃষ্টি আম্মার দিকে তাকিয়ে হাসলো। জানিনা এদের হাসির রোগে ধরলো নাকি! অযথায় হাসতে থাকে। বৃষ্টি তাহিফকে নিয়ে ঘরের দিকে হাটা ধরলে আমিও পিছু পিছু যাই।
১৫
মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে আমান। মনের মধ্যে যে অসহ্য দহন হচ্ছে তা মায়ের কোলে মাথা রেখে একটু হলেও কমে যায়। আমেনা বেগম ছেলের এহেন কর্মে অবাক হচ্ছেন বৈকি। আমান এমন করতো আদ্রিজা যাওয়ার পর। তারপর ছেলেটা পাল্টে গেলো হঠাৎই। কথায় কথায় রাগী ভাব আর বেপরোয়া স্বভাব। এই আমানকে চিনতে পারেনা আমেনা বেগম। তবে আজ হুট করেই দুপুরের খাবার আমানের ঘরে দিতে এসে আমান উনাকে খাটে বসিয়ে কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। ছেলের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে এসব ভাবছিলেন আমেনা বেগম।
“আচ্ছা আম্মা যেদিন আদ্রিজা আর দুলাভাইয়ের কথা উহাশী ফাস করে, সেদিন তুমি ফজরে কি উঠো নাই? তোমার তো উঠার কথা! উহাশী কেমনে দেখলো আম্মা?যেখানে ওর ঘুম এত গভীর!”
আমেনা বেগম ছেলের প্রশ্নে চকিতে তাকান আমানের মুখপানে। এই কথা তো তিনিও ভাবেন, কিন্তু কিনারা তো খুজে পাননা এই ভাবনার।
“কি হলো আম্মা? বলো!”
আবারও ছেলের প্রশ্নে আমেনা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,
“আমি জানিনা রে বাজান। আমিও এইডা ভাবি। অইদিন আমার এত ঘুম যে কেমনে ধরছিলো; উশু ডাকছে আমায় তবু্ও আমি জাগনা পাই নাই। মুখের উপর পানির ছিটা দিলে জাগনা পাইছি আমি।”
মায়ের উত্তর শুনে আমানের কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে। সব কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। তার আম্মার তো এতো গভীর ঘুম না যে পানির ছিটা দিয়ে জাগ্রত করতে হবে।এত ধোয়াশা কেনো এই ঘটনার মাঝে? আমান উঠে বসে। উহাশীর সাথে কথা বলতে হবে তার। উহাশীই এসবে উত্তর জানে। আমান উঠে স্যান্ডেল পায়ে ঢুকিয়ে যেতে ধরলে আমেনা বেগম বলে উঠেন,
“কই যাস তুই? খাইয়া লো।”
“আম্মা উহাশীর ঘরে যাই, তারপর খাওয়ার কথা ভাবা যাবে।”
আমান কথাটা বলেই ঘর থেকে বেরোয়।আমানের কথা শুনে আমেনা বেগমও উহাশীর ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
চলবে?
ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।