#চোরাবালি
#পর্বঃ৩
#আহিয়া_আমান_অণু
৬
“আব্বা আপনার সাইফার কথা মনে আছে? ”
“সাইফা!তোমার সাথে কলেজে যে পড়তো;ঐ মেয়েটা না?”
“হ্যা আব্বা।ওর বিয়ের হয়ে যে ঢাকায় চলে গিয়েছিলো ;আমি ঐ সময়টায় কিছু বুঝার চেষ্টা করিনি। ওর সাথে যোগাযোগ করে ওর কাছে গিয়েছিলাম।তারপর সেখানেই ওর সাথে থাকলাম কিছুদিন।ওর স্বামী ওষুধ কোম্পানিতে জব করে,ওদেরই কোনো রকম দিন যায়।তাই ওর স্বামীকে বলি কোনো কাজের যদি ব্যবস্থা করে দিতে।আমি তো ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশোনা জানতাম।কিন্তু হাই লেভেলের কাজ পাইয়ে দেওয়া উনার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা।একটা টেইলার্স মালিকের সাথে পরিচয় ছিলো উনার;যেখানে সাইফা কাপড় বানাতে দিতো।ঐ টেইলার্স ওয়ালা কাপড় বানাতো সাথে লোকও রাখতো বানানোর জন্য।ট্রেনিংও দিতো।আমাকে সেখানে ট্রেনিং এর জন্য জয়েন করিয়ে দেয়। ফ্যাশন সেন্স ছিলো জানতাম প্রায় সব।এটা তো জানেন।আস্তে আস্তে কাজ শিখে ওখানেই উনার সহকর্মী হিসেবে রেখে দেয় আমায়।কাজ ভালো পারতাম। এরমাঝে তাহিফ হয়;বাচ্চা সামলিয়ে কাজ করা জীবনের উপর দিয়ে যেতো।কিন্তু মালিকটা ভালো ছিলো বলে অনেক সাহায্য করতেন।তিনবছরের মাথায় নিজেই নিজের জমানো টাকা দিয়ে টেইলার্স দেই।প্রথম দিকে আয় ততটা না হলেও তিনমাসের মাথায় ভালো ইনকাম হতে শুরু করে। তারপর নিজেও অনেক মেয়ে শিখার জন্য আসতো।আমিও ট্রেইনিং ফি এর বিনিময়ে শিখাতে শুরু করি।আলহামদুলিল্লাহ এখন আমার টেইলার্সে চারজন মেয়ে কাজ করে আমার সাথে। অনেক মেয়ে ট্রেইনিং নিতে আসে।নিজের পায়ের নিচের ভিদটা যখন শক্ত হয়;তখন কোনো ভয় থাকেনা।সেজন্য আমারও ভয় ছিলোনা আর গ্রামে কে কি বললো।আপনাদের কথা রোজ মনে হতো। কিন্তু ভয় আর লজ্জায় আসতে পারিনি।কিন্তু এখন নিজেকে মানসিক ভাবে শক্ত করে নিয়েছি।আপনার প্রতিও আমি কৃতঙ্গ বাবা।আপনি আমায় পড়াশুনা না করালে হয়তো আজ এতদূর আসতে পারতাম না।আপনি গ্রামের আর বাকি দশটা বাবার মতো মেয়ের বয়স ষোলো হতেই যে আমায় বিয়ে দেননি;এজন্য আজ এতদূর আসতে পেরেছি।”
একদমে কথাগুলো বলে থামলাম।আব্বা এরমাঝে খাওয়া সেরে হাত ধুয়ে নিয়েছেন।তাহিফও আমার উড়ুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে।আম্মাও দেখলাম চোখের পানি ফেলছেন।কিন্তু কাঁদার মতো কিছু হয়েছে নাকি কাদছে।
“যদি বাকি বাবাদের মতো বিয়ে দিতাম;তাহলে পড়তে গিয়ে অন্তত পড়া ব্যতিত অন্য কিছু করে জীবনের এই দুগর্তি আনতে না।নিজে তো পড়তে পারিনি, অনার্সে ভর্তি হতেই বাবা মারা গিয়ে সংসারের দায়িত্ব পড়েছিলো আমার ঘাড়ে।তাই স্বপ্ন ছিলো মেয়েকে পড়ানোর।গ্রামের এই অশিক্ষিত চালচলন,কথাবার্তার আচ যেন আমার পরিবারে না লাগে সেজন্য শিক্ষিত বউ এনেছিলাম বিয়ে করে।উনি উনার শিক্ষা ঠিকই দিয়েছিলেন;কিন্তু আমার বাচ্চাগুলো যে বিগরে যাবে এটা কল্পনা করেননি।মেয়ে আমার পড়তে গিয়ে যে প্রেম করে বিয়ের জন্য লাফাবে এটা জানতাম না।মেনেও নিয়েছিলাম তো।পরিণতিটা কি হলো!যাই হোক নানুভাই ঘুমিয়েছে ঘরে নিয়ে যাও।”
বাবা কথাটা উঠে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন।আমি ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লাম।জানি আমি ভুল করেছিলাম;সেটার মাশুল তো এখনও দিচ্ছি।আলিফ এসে তাহিফকে কোলে নিলো।মা দেখলাম শাড়ির আচলে চোখ মুছছেন। কথা বলতে বলতে খাওয়া হয়নি তেমন।কিন্তু খেতে আর ইচ্ছে করলোনা।পানি ঢেলে দিয়েছি তাতে।আমি কিছু না বলে চুপচাপ নিজের ঘরের দিকে হাটা ধরলাম।নিজের ঘরে এসে তাহিফের জন্য বিছানা করলাম।মা সব গুছিয়ে দিয়েছে সন্ধ্যায়।তাহিফকে আলিফের কোল হতে নিয়ে শুইয়ে দিয়ে ভাইকে বললাম ঘরে যেতে,গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে।সকালে আবার ওর ক্লাস আছে।অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে এবার ও।আলিফ যেতেই আমিও সটান হয়ে শুয়ে পড়লাম।
৭
রাতের এগারোটা বাজে,চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।পুকুর পারে বসে সিগারেট ফুঁকছে আমান।আপাতত তার মাথায় শুধু আদ্রিজার কথা ব্যতিত কিছু ঘুরছেনা।দেখতে ইচ্ছে করছে তারে খুব করে।কিন্তু মেয়েটা তো বেইমান;ঠকিয়েছে তাকে।কি দরকার ছিলো বিয়ের পর স্বামীকে ঠকানোর।যখন ভার্সিটিতে পড়াকালিন সম্পর্ক ছিলো তখনই না হয় ঠকিয়ে চলে যেতো। অন্তত দুই বছরের প্রেমের মায়া আর একবছরের সংসারের মায়া কাটাতে এতটা সময় লাগতোনা। চারবছর কম তো সময় না মায়া কাটানোর জন্য। কিন্তু তারপরও মনের মধ্যে হু হু করে উঠে মনে পড়লে।শীতের রাতে রিতিমতো কাঁপুনি দিয়ে উঠছে তার শরীর।পড়নে টাউজার আর টিশার্ট তার উপর শাল জড়ানো। মোটা কোনো শীতবস্ত্র পড়েনি বিধায় শীত বেশিই লাগছে আমানের।এমনিই গ্রামে প্রকৃতির বিশুদ্ধ বাতাসে শীতের মাত্রা যেন বেশিই হয়।টাউজারের পকেট থেকে ফোন বের করে আমান।গ্যালারিতে গিয়ে আদ্রিজার ছবি বের নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। সময় যে দ্রুত কোনদিক দিয়ে বয়ে যায় কারোর জানা নেই। বারোটা বাজতেই আমান নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।ঘরে এসে শুয়ে পড়ে লেপ মুড়ি দিয়ে।
পরেরদিন সকালবেলা,
বাড়িতে হইচইয়ের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আমানের।রাতে দেরি করে ঘুমানোর ফলস্বরুপ মাথাটা ব্যাথায় ঝিমঝিম করছে।বিছানায় উঠে বসে চুলগুলো টেনে ধরে।লেপ বিছানায় অন্যপাশে সরিয়ে রেখে চিৎকার করে উহাশীকে হাক ছেড়ে ডাকে।তারপর উঠে শীতের জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে নেয়।নিজের বিছানা নিজেই গুছিয়ে নেয় আমান।উহাশী সেইসময় ঘরে ঢুকে।উহাশীর হাতে চায়ের কাপ।সকালে উঠে আমান আদা আর মধু দিয়ে চা খায় এটা সবারই জানা।তাই উহাশীকে ডাকতেই উহাশী বুঝেছিলো চায়ের জন্য ডেকেছে;তাই চা সমেত ঘরে এসেছে।এমনিতেও পানি গরম করাই ছিলো চায়ের জন্য।ভোটের এই সময়টা সকাল বিকেল নেই গ্রামের মানুষরা এসে বসে থাকে। চা, সিগারেট,পান খায় আর ভোটের আলোচনা করে। উহাশীর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে চুমুক দিয়ে আমান বলে,
“বাড়িতে এত চিল্লাপাল্লা কিসের?কোন ষাড়ের দল সকাল সকাল বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে?”
“সুকনপুকুর গ্রামের মানুষ ভাইয়া।তারা আজ তোমার হয়ে মিছিলে নামবে ;তাই তোমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে এসেছে।”
সুকনপুকুর গ্রামের নাম শুনতেই আমানের জিভে ছ্যাকা লাগে গরম চায়ের।আদ্রিজা যাওয়ার পর সে আর ঐ গ্রামে ফিরেও তাকায়নি।তাই নামটা শুনে তার এই অবস্থা হলো।এখন তো আনার আদ্রিজাও এসেছে;যদি দেখা হয়ে যায়!চায়ের কাপ হাতে নিয়ে খাওয়া রেখে বসে এই চিন্তা করছিলো আমান।উহাশী ভাইকে চিন্তিত দেখে বলে,
“তার কথা ভাবছো ভাইয়া?”
“তুই এখন যা উশু।আর ওনাদের বলে দে বিকেলে যেন শুরু করে; আমি সময় মতো পৌছে যাবো।”
উহাশীর কথায় গম্ভীর হয়ে উত্তরটা দেয় আমান।উহাশী ভাইয়ের কথায় চলে যায় আমানের ঘর থেকে।বারান্দায় তার বাবাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তার দিকে পা বাড়ায়।বাবার পাশে দাড়িয়ে ভাইয়ের বলা কথা বলে দেয় সবাইকে যেন জানায় সেজন্য। ফখরুল মির্জা সেই মতো সবাইকে জানায়।উহাশী রান্নাঘরে পা বাড়ায়।মায়ের সাথে হাত লাগায় রান্নাবান্নার কাজে।সকাল সাতটা বাজে এখন।আটটায় তার বাবা খেয়ে বাজারে দোকানে যাবে।তার বাবার গন্জে চারটা দোকান আছে,দুটো রড-সিমেন্টের দোকান আর দুটো মুদির দোকান।সেগুলোয় দেখাশুনা করে তার বাবা।ভাইকে বললে তো পা মাড়িয়েও দেখে না।সেজন্য বাবা আর ভাইয়ের দ্বন্দ্ব দেখতে দেখতে বিরক্ত উহাশী।মায়ের পাশে বসে কাটা তরকারী গুলো গামলা থেকে পাতিলে তুলতে তুলতে এসব ভাবনায় মত্ত উহাশী।আমেনা বেগম মেয়েকে এত গম্ভীর হয়ে বসে থাকতে দেখে বলেন,
“এই উশু!এত কি ভাবোস তুই?”
মায়ের ডাকে সেদিকে তাকায় উহাশী।তারপর মাথা এদিক-ওদিক কাত করে বুঝায় কিছুনা।আমেনা বেগম হঠাৎই উহাশীর কাছ ঘেষে বসেন।উহাশী মায়ের এরুপ আচরণে অবাক হয়।আমেনা বেগম সেদিকে খেয়াল না দিয়ে বলেন,
“আজ এলা কলেজ থাইকা ফেরুনের সময় তোর বড় আপার বাইত্তে যাবি?কইবি মা দেখবার চাইছে;মেলাদিন অইলো দেহিনা বড় আম্মাডারে।”
উহাশী জানে তার মা তার বড় বোনকে আদর করে বড় আম্মা আর তাকে ছোটো আম্মা বলে।কিন্তু সমস্যা তো অন্য জায়গায়।সেখানে গেলে আমান ভাইয়া জানলে তো অবস্থা খারাপ করে দিবে।এমন কি কলেজেও যেতে দিবে না আর।এই চিন্তা থেকে উহাশী বলে,
“আম্মা তুমি জানো তো ভাই জানলে আমারে আস্তো।রাখতো না।তুমি একটু বুঝো;কেমনে যাইতাম।”
আমেনা বেগম উহাশীর উত্তরে চুপসে যান।সত্যিই ছোটো মেয়ে যা বলেছে সবই ঠিক।কিন্তু মায়ের মন তো মানে না।ছটফট করে খুব।সেই আটমাস আগে তার বড় মেয়ে উষশী লুকিয়ে দেখা করেছিলো উহাশীর মাধ্যমে যোগাযোগ করে।আমান কিভাবে যেন টের পেয়েছিলো;এরপর বাড়িতে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছিলো মায়ের সাথে যে কেনো দেখা করলো!এরপর আর সুযোগ বা সাহস কোনো টাই হয়নি দেখা করার।এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন আমেনা বেগম।
চলবে?