#চোরাবালি
#পর্বঃ২
#আহিয়া_আমান_অণু
৪
“তোমার ভোটের প্রচারের কাজ কেমন চলছে আমান?চারদিকের অবস্থা দেখে কি মনে হয় জিততে পারবা?”
রাতের খাবার টেবিলে বসে বাবার প্রশ্নের সম্মুখীন হয় আমান।ডান পাশে তার বোন উহাশী বসা।উহাশীর পাশে দাড়িয়ে তার মা আমিনা বেগম সবার যখন যেটা লাগছে তুলে দিচ্ছে। আমানের মুখোমুখি বসা তার বাবা ফখরুল মির্জা।বাবার পাশেই বসেছেন তার দাদী রুহিনা বেগম।সবার দৃষ্টি আমানের উপর, মূলত উত্তরের আশায় সবাই তাকিয়ে আছে।আমান খেতে খেতে উত্তর দিলো,
“আপনি দাড়ালেই পারতেন আব্বা;শুধু শুধু আমায় জড়ানোর কি খুব দরকার ছিলো?”
ফখরুল মির্জা ছেলের কথায় অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করেন আমানের দিকে।আমান ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে খেতে থাকলো।তার বাবা বরাবরই রগচটা মানুষ।এটা নতুন কিছু নয়।আমেনা বেগম দাড়িয়ে আল্লাহ আল্লাহ করছেন।আবার না বাপ-ছেলের তর্কাতর্কির দাঙ্গা লেগে যায়।বাপ যেমন রগচটা ছেলে হয়েছে তার দ্বিগুন রগচটা স্বভাবের।আমেনা বেগম ছেলেকে ধমকে বলে উঠেন,
“তুই একটু কম কথা বল বাবু।তোর বাবা যা জানতে চাইলেন তা বললেই তো মিটে যায়।”
“বাবা যেমন আমার কথা উপেক্ষা করে ভোটে দাড়িয়ে দিয়েছে ;তেমন আমিও উনার কথা উপেক্ষা করবো এটাই স্বাভাবিক। ”
আমানের এত গা ছাড়া ভাব দেখে রেগে যান ফখরুল মির্জা।তারপর ঝাঁজালো স্বরে বলেন,
“আমার বয়স হয়েছে সে খেয়াল আছে তোমার?জমিজমা,বাজারের দোকান-পাট এগুলোয় দেখবো নাকি মেম্বার হয়ে গ্রামের দেখাশুনা করবো?কোনটা বলো?তোমার সংসারের দায়িত্ব নিতে মন চায়না তো করবে কি জীবনে?মানুষের উপকার করতে তো ভালো লাগে তোমার,তো করো গ্রামের মানুষের দেখাশোনা।সেজন্যই ভোটে দাড়িয়ে দিয়েছি তোমায়।”
ফখরুল মির্জাকে রাগতে দেখে রুহিনা বেগম ছেলেকে শান্ত হতে বলেন।তারপর ছেলের কাধ বরাবর মুখ নিয়ে ধীর স্বরে বলে উঠেন,
“ছেলের এই অধঃপতনের মূলটা তুই। ভুলে যাচ্ছোস সব?শুনলাম মেয়েটা ফিরা আইছে।এবার যদি সত্যিগুলো সামনে আসে কি করবি?”
মায়ের কথায় চমকে উঠে ফখরুল মির্জা।আদ্রিজা ফিরে এসেছে মানে!বুঝতে পারলেন না তিনি।মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছু সময়।এদিকে উহাশী খেয়ে হাত ধুয়ে উঠে যায়।আমানেরও প্রায় খাওয়ার শেষ।আমেনা বেগম তার শ্বাশুড়িমা আর স্বামীর ফিসিরফিসির করে কথা বলা দেখে বলেন,
“আম্মা আপনার আর কিছু লাগবো?লাগলে কন দেই?”
রুহিনা বেগম ছেলের বউয়ের কথা শুনে বললেন,
“না মা কিছু লাগবেনা।আমি উঠে যাচ্ছি তুমি খাইতে বও।”
আমান আর রুহিনা বেগম একসাথেই উঠে গেলো।বসে রইলো শুধু ফখরুল মির্জা।আদ্রিজা ফিরে এসেছে এই কথার ঘোর থেকে এখনও তিনি বেরুতে পারছেন না।
‘তবে কি ছেলের জীবন আর নিজের সম্মান বাচাতে গিয়ে যে অন্যায় করেছিলাম;সেটা এবার যদি আবার ঘাটাঘাটি করে সত্যিটা সামনে আনে আদ্রিজা!কি হবে তখন।’ মাথায় এই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে ফখরুল মির্জার।আমেনা বেগম স্বামীকে চিন্তিত অবস্থায় বসে থাকতে দেখে কাছে গিয়ে দাড়ায়।তারপর জিগাসা করেন,
” আপনি আর কিছু লইবেন?খাওন রাইখা বইসা আছেন যে?”
ফখরুল মির্জা স্ত্রীর কথায় ভ্রুক্ষেপ করলেন না।ভাতের থালায় ভাত সহ পানি ঢেলে উঠে যায়।আমেনা বেগম দী্র্ঘশ্বাস ছাড়লেন।বত্রিশ বছরের সংসার জীবনে আজও তিনি স্বামীর মন পেলেন না।সবসময় রাগী ব্যবহার আর এই কাজের আদেশ ঐ কাজের আদেশ ব্যতিত কোনো কথা উনি বলেননি ঠিকঠাক।তাদের মাঝে ভালোবাসা নেই কিন্তু এই সংসারটার প্রতি আলাদা একটা মায়া আছে আমেনা বেগমের।সেই মায়ার টানে হয়তো আজও সংসারে পরে আছেন সব অবহেলা সয়ে।সংসার জীবন সুন্দর হয় যদি স্বামী ভালোবেসে পাশে থাকে;কিন্তু স্বামী বাদ দিয়ে বাকি সবাই ভালো হয়,সেই সংসারে সুখ জিনিস বহমান থেকেও বিষাক্ত বাতাসের ন্যায় সবসময় ছুয়ে যায় মানুষকে।আমেনা বেগমের জীবনেও ঠিক সেই রকম অবস্থা হয়েছে।সবকিছুতেই সুখ উনার;কিন্তু সবকিছু বিষাক্ত লাগে।দুই মেয়ে এক ছেলে শ্বাশুড়ি আর স্বামীকে নিয়ে সুখের সংসার হলেও তার জীবনে ভালোবাসা জিনিসটার বড্ড অভাব।বড় মেয়েটার বিয়ে হয়ে সে শ্বশুড়বাড়িতে আছে এখন।দুটো ফুটফুটে ছেলে মেয়েও আছে।চারদিকে এত সুখের ছোয়া তবুও সেসবের মাঝে এক টুকরো সুখতারা হয়ে এসেছিলো আদ্রিজা।কিন্তু সেও বাকি সব মানুষের মতো তাকে কষ্ট দিয়ে চলে গেলো।আমেনা বেগম খেতে বসে এসব চিন্তা করছিলেন একমনে।উহাশী কলপারে যাবে বলে বাইরে এসে নিজের মাকে ভাতের প্লেট সামনে নিয়ে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে মায়ের কাছে।কাধে রেখে বলে,
“কি হলো মা?খাচ্ছো না যে!”
মেয়ের কন্ঠস্বর পেয়ে চমকে পাশ ফিরে তাকায় আমেনা বেগম।উহাশীকে দেখে বলেন,
“কিছু হয়নি রে মা;এমনিই আজ আদ্রিজার কথা খুব মনে পড়তাছিলো।চারটা বছর হতে চললো,মাইয়াডার কোনো খোজখবর নাই।”
“ভাবী ফিরে এসেছে মা;তার বাপের বাড়িতে আছে এখন।”
“কি বললি তুই?কখন আইছে?তুই কেমনে জানলি?”
“বাসস্ট্যান্ডে দেখছি আজ;কলেজ থেকে ফেরার সময় দেখছি।”
“আমারে একবার ওর লগে দেখা করায় দিবি আম্মা?খুব দেখবার মন চাইতেছে আমার।”
“সে অতীতে জড়ানো মানুষগুলোর থেকে দূরে থাকতে চায় মা।তাকে তার মতো থাকতে দাও।”
কথাটা বলেই চলে যায় উহাশী।আমেনা বেগম কথার আগামাথা কিছু বুঝলেন না।খাওয়া আর হলোনা তার;মন টানছেনা খাবারের প্রতি।উঠে দাড়ালেন উনি।সব ঢেকে রেখে হাত ধুয়ে চলে গেলেন ঘরে।”
৫
“বাবা তাহিফ জিদ করেনা সোনা।মাম্মা মাছের কাটা বেছে দিচ্ছি তো!খেয়ে নাও একটু।”
খাবারের ঘরে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে খেতে বসেছি আমি বাবা আর ভাই।মা সামনে পিড়ি পেতে বসে আমাদের খাবার তুলে দিচ্ছেন সাথে নিজেও খাচ্ছেন।কিন্তু ছেলে আমার কিছুতেই খাচ্ছে না মাছ দেখে।আম্মাকে বলতেও পারছিনা ছেলে আমার রাতে ভাত তো খাই-ই না;তাও সেটা যদি হয় মাছ দিয়ে।রাতের বেলা বড়জোড় ডিম সিদ্ধ করে সেটা লবণ মাখিয়ে ভাত দিয়ে দিলে খাবে নয়তো না।আম্মা,আব্বা আর ভাই নিজেদের খাওয়া রেখে তাহিফের কান্ড দেখছে।ছেলেটা খাবেনা বলে মাথা একবার ডান কাত তো আরেকবা বাম কাত ঘোরাচ্ছে।রাত নয়টা মতোন বাজে এখন।আব্বা আরদের থেকে আধাঘন্টা আগে এসেছেন।বাজারে উনার মাছের আরদ আছে,সেটাতেই কাজ করতে সময় যায় পুরো দিন।উনি আসার পর হাতমুখ ধুয়ে আসেন।তারপর সবাই একসাথে খেতে বসা হয়েছে।আব্বা বাড়িতে এসেছেন কিন্তু এখনও আমার সাথে একটা কথাও বলেননি।হয়তো অভিমান কিংবা রাগ হয়ে আছেন আমার উপর।মাকে তবু তখন চাচীরা আর দাদীরা মিলে বুঝিয়ে রাগ কমিয়েছেন।কিন্তু বাবার রাগ কিভাবে কমাবো সেই চিন্তায় খেতেও ইচ্ছে করছেনা বলে ছেলেকে খাওয়ানোর কথা বলে নিজে এখনও খাইনি।সকাল আটটায় খেয়ে সাড়ে আটটার বাসে ঢাকা থেকে এই রংপুর আসছি।গাড়িতেও কিছু খাওয়া হয়নি। ক্ষুধায় অবস্থা জগাখিচুরি;সামনে খাবার তবুও টান নেই খাওয়ার প্রতি।ছেলে খাচ্ছিলো না বলে দিন দুনিয়া ভুলে গালে হাত দিয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে ছিলাম।চোখের সামনে থেকে ছেলেকে উধাও হতে দেখে আমার টনক নড়লো।চোখ তুলো তাকাতেই দেখি আব্বার কোলে আমার ছেলে।আমি কিছুটা খুশি হলাম;কিন্তু সেটা প্রকাশ করলাম না।মায়ের দিকে তাকালাম।দেখলাম মা আমাকে ইশারায় আশ্বাস দিচ্ছেন বাবার রাগ কমে যাওয়ার।কারণ আব্বা বাড়িতে আসতেই মাকে বলেছিলাম আব্বা কথা বলবে তো আমার সাথে!আব্বার রাগ কমছে বলে আমার মনে হলো।কারণ এতক্ষণ না আমি আর না তাহিফ কারোর দিকে উনি ঠিকমতো তাকাননি।তাহিফ নতুন মানুষের মাঝে থাকলেও তেমন কাদছেনা;যেখানে ও ঢাকায় অচেনা কেউ কোলে নিতে গেলে মাম্মা বলে দেয় চিৎকার।এটাই হয়তো আপন মানুষের প্রতি টান বলে।মাম্মা ডাকটা শিখিয়েছে আমার বান্ধবী সাইফা;ওকে বান্ধবী কম বোন বেশি বলা উচিত।আমার দুই বাবাকে একসাথে খুনশুটি করতে দেখে আনমনে এাব ভাবছিলাম। একটু পর দেখলাম তাহিফ খাচ্ছে তাও মাছ দিয়ে।আব্বা গল্প বলছেন আর তাহিফ তা শুনে হাসছে আর খাচ্ছে।আমার ভাই শাহিদও বাবার সাথে মিলে তাহিফকে হাসাতে লাগলো। আম্মা আমার সামনে ভাতের থালাটা দিয়ে খেতে বললেন।আমিও নিশব্দে খেতে শুরু করলাম।
“কে কি করেছিলো সেটার শাস্তি আমাদের না দিলেও পারতে আদ্রি;আমরা বাবা-মা নিশ্চয় সন্তানকে ফেলে দিতাম না লোকের কথা শুনে।যেখানে আমি জানি আমার মেয়ে কেমন।”
তাহিফকে মাছের কাটা বেছে তার মুখে ভাত দিতে দিতে বাবা কথাটা বললেন।আমি ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে তাকালাম।কারণ বাবা এত গম্ভীর হয়ে কথা বলতে দেখিনি।বাবা সবার সাথে গম্ভীর হয়ে কথা বললেও আমার সাথে কখনও এত গম্ভীর হয়ে কথা বলেননি।আমার মুখের আদল নাকি আমার দাদীর মতো;তাই আব্বা নিজের মায়ের মতো আমার সাথেও আদুরে স্বরে কথা বলেন সবসময়।কিন্তু আজ এত গম্ভীর স্বর।আমি মাকে ইশারায় বুঝাতে চাইলাম উত্তর দিবো কি দিবো না!মা চোখ দিয়ে ইশারা করলেন কথা বলতে।আমি ভীতু গলায় বললাম,
“কলঙ্কীনি নামের তকমা গায়ে লাগিয়ে বাচতে পারতাম না আব্বা।তাই চলে গিয়েছিলাম।অবশেষে সবার কথা শুনার মতো মানসিকতা গড়ে নিয়ে ফিরে এসেছি আমি।”
“তা বেশ ভালো।কিন্তু আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখলেও পারতে।”
“আমি জানি আব্বা আমি ভুল করেছি আপনাদের সাথে যোগাযোগ না করে।কিন্তু আমি ধারণা করেছিলাম আপনি আর আম্মা বাকিদের মতোয় আমাকে ভুল বুঝবেন।”
“বাকিরা আমার মেয়েকে বড় করেনি আদ্রি;আমি জানি আমার মেয়ে বাজে কোনো কাজ করার মতো শিক্ষা পায়নি আমাদের থেকে,তাই আমাদের উপর ভরষা রাখতে পারতে।”
আমি আব্বার দিকে তাকিয়ে তপ্তশ্বাস ছাড়লাম।আমার কিছু বলার নেই এই কথার পৃষ্টে।বাবা তাহিফকে খাওয়া শেষ করিয়ে মুখ মুছে দিয়ে আমার কোলে দিলেন।আমি আমার পাশে তাহিফকে বসালাম।আব্বা এবার পুরো খাবার শেষ করতে লাগলেন।আলিফের খাপয়া শেষ বলে সে হাত ধুয়ে বসো থাকলো সেখানেই।কারণ আব্বার কড়া নিয়ম সবাই একসাথে খেতে বসে এলসাথে উঠতে হবে।আব্বা খেতে খেতে প্রশ্ন করলেন,
“ঢাকায় কার সাথে ছিলে?কিভাবে জীবন চালাতে?আর এই যে আমার নাতী;এটা তো আমানেরই ছেলে নাকি?”
আমি আব্বার প্রশ্নে চকিতে তাকালাম উনার দিকে।আমানের নামটা উনার মুখেও শুনবো কল্পনা করিনি।আমি লম্বা একটা দম নিয়ে বলতে লাগলাম
চলবে?