#চৈত্রের_রাঙায়_রচিত_প্রণয়
#মিমি_মুসকান
#সূচনা_পর্ব
“কি বললে বাবা? আমায় এখন একটা বাচ্চা কে বিয়ে করতে হবে? তাও সবে মাত্র এসএসসি পরিক্ষা দেওয়া বাচ্চা! আর ইউ সিরিয়াস? তোমার কথা আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না!”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল সারফারাজ। তীব্র চোখের পলক ভেবে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করছে। এমন খামখেয়ালি চিন্তা বাবা কখনো নিতে পারেন না। সে শিক্ষিত, শুধু তাই না দেশের একজন রিটেয়ার বিচারপতি ও। তার চিন্তাভাবনা, বিচক্ষণতা বরাবরই সারফারাজ কে মুগ্ধ করত। কিন্তু আজ সে কোনভাবেই মুগ্ধ হতে পারছে না।
রিয়েটার বিচারপতি আরিফ হাসান আজকের খবরের কাগজ মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারছেন না। পারবে না এটাই স্বাভাবিক। “নিকুঞ্জ নিবাসে” আজ প্রচুর শোরগোল। তাদের পৈত্রিক বাড়ি এটা। ঘরভর্তি মেহমান। ঈদ উপলক্ষে মেহমানে পুরো বাড়িতে গুনগুন রব। অথচ ঈদ পেরিয়ে গেছে আজ ৭ দিন। তার বড় ছেলে সারফারাজ শেহদাত! বর্তমানে ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করছে। ছোট ছেলে আরাফাত শেহদাত। এবার এসএসসি পরিক্ষা দিয়েছে। এই তো, দু মাস বাদে তারও রেজাল্ট বেরিয়ে যাবে। সেসব নিয়ে তার চিন্তা নেই। তার মতোই দুই ছেলেও ভালোই মেধাবী। পড়াশোনা নিয়ে কখনো বকতে হয়নি। বড় ছেলে সারফারাজ এসেছিলো বাবার অনুমতি নিতে। সন্ধ্যার ট্রেনে সে ঢাকা ফিরবে। অথচ তার বিয়ের কথা শুনে খানিকটা বিস্মিত আর বিভ্রান্ত। সবচেয়ে বিভ্রান্ত এটা শুনে তার বিয়ে একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে হতে যাচ্ছে। তার বাবা কয়েকমাস আগেই গত হয়েছেন। এই মূহূর্তে এমন একটা সিদ্ধান্ত তাকে কি পর্যায়ে ভাবাবে এটা সে বুঝতে পারছে না। সারফারাজ দ্বিতীয় বারের মতো আবার বলতে আরম্ভ করল,
“বাবা! তুমি যা বলছো ভেবে বলছো কি? তুমি একজন রিয়েটার বিচারপতি। নিশ্চিত জানো, ১৮ বছরের নিচে কোন বাচ্চা কে বিয়ে দেওয়া আই/নত অ/পরাধ। এর পরেও তুমি আমায় বিয়ের জন্য বলছো?”
আরিফ হাসান মনোযোগ দিয়েই কথাগুলো শুনছেন। এর ফাঁকে একবার চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। চোখের চশমা খুলে পাশের টেবিলে রাখলেন। দৃষ্টি রাখলেন ছেলের উপর। বিয়ের কথা শুনে ছেলে যতোটা বিস্মিত হবে ভেবেছিলেন ততোটাই বিস্মিত হয়নি। হয়তো কথাটা সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। অতঃপর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো একজন নারী। পরনে তার হালকা বাদামী রঙের শাড়ি, চোখে সোনালি রঙের চশমা, হাতে চায়ের কাপ। ঘরে আজ প্রচুর কাজ, এতো কাজের চাপে তিনি যেন অস্থির হয়ে উঠেছেন। তার ছাপ চোখে মুখে ফুটে উঠছে। সারাফারাজ মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল গম্ভীর দৃষ্টিতে। মা শাহিনুর বেগম চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন স্বামীর কাছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললেন, “দোকানপাট এখনো ভালো করে খুলেনি। সকাল থেকে ঘুরেও মনমতো একটা শাড়ি পাইনি। ভাবছি আমার বিয়ের শাড়িটাই ওকে পরিয়ে দিই। তুমি কি বলো?”
সারাফারাজ ভেতরে ভেতরে রে/গে যাচ্ছে। তার মা বাবা ভেবেই নিচ্ছে এই বিয়েটা সে করছে। নাহলে এই শাড়ির কথা এখানে তুলবার কোন দরকার ছিল না। কিন্তু যতই রেগে যাক না কেন? মা বাবার মুখের উপর কথা সে বলতে পারে না। তবু শান্ত গলায় শুধালো,
“কাকে বিয়ের শাড়ি পরাবে মা?”
”কেন? অনি কে? ও ভালো কথা! আমি তোর জন্য একটা পাঞ্জাবি আনিয়ে রেখেছি। ঘরে বিছানার উপর রাখা আছে। পরে দেখিস, ঠিক আছে কি না?”
“বিয়ে কখন পড়ানো হবে?”
“এই তো আছরের পরে! কাজী কে বলা আছে।”
সারাফারাজ চোয়াল শক্ত করল। আশ্চর্য! তার আজ বিয়ে অথচ সে কিছুই জানে না। এমনকি কাজী থেকে শুরু করে শাড়ি পাঞ্জাবি সব তৈরি শুধু বর কে জানানো হয়নি তারই আজ বিয়ে। চমৎকার! ইচ্ছে করল কথাটা জোরে বলতে কিন্তু পারল না। তার মন বলছে, এই ঘর ছেড়ে বের হবার পরপরই দেখবে, বাড়ির সব মেহমান তাকে এসে ঘিরে ধরছে। সবাই জানে তার বিয়ের একমাত্র সে ছাড়া। রে/গে ঘর ছেড়ে বের হবার জন্য উদ্বেগ হলো। আরিফ হাসান তাকে থামিয়ে দিয়ে শাহিনুর বেগম কে বলল, “রান্নাবান্না কেমন হচ্ছে?”
“ভালোই এগুচ্ছে। তবে মনে হচ্ছে মুরগির রোস্ট কম পড়ে যাবে।”
“সিধু কে ডেকে আনিয়ে নাও। খেয়াল রেখো, খাবার দাবার নিয়ে কেউ যেন কিছু বলতে না পারে!”
”আচ্ছা!”
বলেই শাহিনুর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। সারাফারাজ শেহদাত ঠোঁট কামড়ে ধরল। বিয়ে নিয়ে বাড়িতে হুলস্থুল কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। অথচ এসব কিছু থেকে সে অনাগত। আরিফ হাসান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “বসো। ঠান্ডা মাথায় কথা বলি।”
”আর কি বলবে বাবা? বিয়ের সবকিছু্ই তো দেখছি তৈরি। শুধু আমিই কিছু জানি না।”
“জানাবার সময় হয়নি। বিয়ে ঠিক হয়েছে গত রাত ১ টার দিকে। ভোর থেকেই সব তোড়জোর শুরু। আর তুমি ঘুম থেকে উঠেছ সকাল ১১ টার দিকে। ফ্রেস হয়ে নাস্তা সেড়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছো। আর এখন বাজে দুপুর ১ টা!”
বিস্তৃত এক বর্ণনা দিয়ে সারাফারাজ এর মুখ বন্ধ করে দিল বাবা আরিফ হাসান। আশ্চর্য কিছু না। তার কথায় এক ধা/রালো অ/স্ত্র লুকিয়ে আছে। সে কথার জোরে কেউ কিছু বলতে পারে না। তবু সারাফারাজ বলল, ”কিন্তু আমায় জিজ্ঞেস করতে পারতে একবার।”
“করার মতো কিছু ছিল না ফারাজ। তোমার পছন্দের কেউ নেই এটা তুমি আমায় দুদিন আগেই বলেছো। দুদিনের মধ্যে পছন্দ হয়ে যাবে এমন কোন মেয়েও আশেপাশে নেই। তাই আমার ধারণা এই বিয়ে হচ্ছে আর তুমি এই বিয়ে করবে। ঠিক তো!”
“তুমি বললে বি/ষ ও খেয়ে ফেলব। তুমি জানো, আমি তোমার কথার অবাধ্য হই না।”
তিক্ত স্বরে কথাগুলো বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো সারফারাজ। রাগে তার সমস্ত শরীর কাঁ/পছে। তার দিকে তা কিয়ে চাপা হাসল চাচাত জমজ দুই বোন রুদমিলা আর শ্রেয়মী। তারা দু’জন বড্ড সুন্দরী আর দেখতে প্রায় একইরকম। নিজেদের সবসময় একরকম তারা আবার সেম পোশাক ও পরে। বড় আশ্চর্য! শুধু সে না, তাদের সব ভাইবোনদের মধ্যে এমন দু একজন আশ্চর্য মানুষ থাকবেই। সারফারাজ কপাল কুঁচকালো। দুজনের হাসি মূহূর্তেই থেমে গেল। তাদের এই ভাইকে তারা প্রচন্ড ভয় পায়। সারফারাজ কঠিন গলায় বলে উঠল,
“হাসছিস কেন দাঁত কেলিয়ে। আর কোন কাজ নেই তোদের।”
শ্রেয়মী বলল, “না ভাই।” রুদমিলা মুখ ফসকে বলে ফেলল, “আছে না, অনেক কাজ! তোমার আর অর্নিলার বিয়ের অনেক কাজ বাকি। একটু পরই অর্নিলা কে মেহেদী পড়ানো হবে!” আরো কিছু বলার ছিল। শ্রেয়মী গুঁতো দিয়ে তাকে চুপ করে দিল। ভাই কে দেখে মোটেও মনে হচ্ছে না তিনি খুশি হচ্ছেন। কেমন গম্ভীর করে রেখেছে মুখটা। দু বোন একসাথে পগাড় পার। ভাই হুটহাট ধমক দিয়ে বসেন, তাদের ধমক খেতে ইচ্ছে না। সারফারাজ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। ডাক্তার হতে হলে ধৈয্য ধরে রাখা বহুত বড় কাজ। সে খুব ছোট কারণেই রেগে যায়, এভাবে রেগে যাওয়া যাবে না। সামলাতে হবে। ঘরের দিকে পা রাখল। বাড়ি ভর্তি মেহমান। তার চাচা, চাচি, চাচাত তিন ভাই বোন। এছাড়া মায়ের তরফ থেকে এসেছে মামা মামী, তাদের বাচ্চার বাচ্চারা। যদিও মামা তাদের আপন নন। মায়ের দিক থেকে কোন ভাইবোন নেই। উনি তার দূরসম্পর্কের মামা। এই মামা বাচ্চার বাচ্চারা ছোটাছোটি করে এসে থামল সারফারাজের সামনে। তাকে ঘিরে দুজনে ছুটতে লাগল। তার সাথে চিৎকার ও করছে। বি/রক্ত লাগছে, ভীষণ বিরক্ত। এক ধম/ক দিয়ে বলল, ”এই চুপ!” দুজনেই চুপসে গেল। হতবাক হয়ে চেয়ে রইল সারফারাজের দিকে। সে হম্ভিতম্ভি করে তার ঘরের দিকে রওনা হলো। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে সামনে ফিরতেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বিস্মিত স্বরে বলল, “অর্নিলা?”
অর্নিলা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হুট করে দরজা বন্ধের শব্দে বেচারি ভয় পেয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে ফারাজ ভাইয়ের গলার স্বর। দিনটাই বুঝি এবার যাবে। ফিরে তাকাল সামনের দিকে। তার গালভর্তি হাসি।
বি/রক্তির শেষ রইলো না। এই মেয়ে শুধু শুধুই হাসে। একে ধমক দিলেও হাসে, বকা দিলেও হাসে। পারে শুধু ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে। বোধহয় কান্না আর হাসি ছাড়া ও কিছুই শিখে নি।
”তুমি এখানে?”
“মামনি বলল পাঞ্জাবি দিয়ে যেতে তাই এসেছি ফারাজ। বলেছে আজ আছরের সময় এটা পরে যেতে। আমার আর আপনার আজ বিয়ে!” বলেই দাঁত বের করে হাসি দিল। এই হাসি লজ্জার হাসি না, মজার হাসি। এ বাড়ির সব মেয়েরাই শুধু হাসে। আশ্চর্য, এদের কি ভূ/তে ধরেছে! সারফারাজ কঠিন গলায় বলল, ”আমার ঘর থেকে বের হ, এখুনি!” অর্নিলা জোরে জোরে মাথা দুলিয়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল। ফারাজ ভাই তুমি থেকে তুই তে চলে গেছে এর মানেই তার রাগ অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে গেছে। এসময় তার সামনে না যাওয়াই ভালো। কিন্তু সে বুঝল না, বিয়ের কথা শুনে ফারাজ ভাই ওমন রেগে গেলো কেন? ভালোই তো হচ্ছে তার বিয়ে হচ্ছে তাও ফারাজ ভাইয়ের সাথে। ইশ কতো মজা, মামনির সাথে এখন সে সারাক্ষণ থাকতে পারবে। এই বাড়িতে ঘুমাতে পারবে। কতো মজা! নাচতে নাচতে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ এক বিকট আওয়াজে থেমে গেল। ফিরে চাইল ফারাজ ভাইয়ের ঘরের দিকে। ভাই বেশি রেগে গেলে চিৎকার করে। ধপাস করে দরজা বন্ধ করে দেয়। এবারও তাই ঘটল। তাতে অর্নিলার কি? সে মুখ টিপে হাসল।
দুই হাত কোমরে রেখে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সারফারাজ। এই পাজি মেয়ের সাথে তার বিয়ে! অসম্ভব। এই মেয়েটিকে একটুও পছন্দ না তার। তার ফুফাতো বোন বলতে শুধু এই। তার ফুফা কেও পছন্দ না আর তার মেয়েকেও না। ফুফু কে দেখেছিলো সেই ছোটবেলায়। তখন তার বয়স খুব বেলি না, এই ১২ কি ১৩ হবে? এই মেয়ে, অনি তখন আসত আর তার সমস্ত খেলনা ভেঙে ফেলত। খুব বিরক্তিকর। যখন তখন তার জিনিসপত্র ভেঙে ফেলে। তার ঘরে এসেছে মানে কিছু একটা ভাঙবে। ছোট বেলায় তার পছন্দের জিনিস ভাঙত। একটু বড় হতেই তার বই খাতা ছিঁড়ে ফেলতো। একবার তো তার প্যার্ক্টিকাল খাতায় তরকারির ঝোল ফেলে দিয়েছিল। কি অদ্ভুত! তার সবকাজে গণ্ডগোল বাঁধায়। এখন বিয়ের পর কি করবে? তার জিনিসপত্র নিয়ে ডাক্তার ডাক্তার খেলবে? অবশ্যই তাই করবে। এ ছাড়া আর কি পারে। দরজায় আবারো কড়া নাড়ার শব্দ। রেগে ফট করে দরজা খুলে বলল, “কে?” অতঃপর সে সহজ হলো। শান্ত কণ্ঠে বলল, “ওহ, তুই!”
#চলবে….