চেয়েছিলাম তো তোমাকেই পর্ব-০৯

0
1795

গল্প:#চেয়েছিলাম_তো_তোমাকেই
লেখিকা:#সুরভী_আক্তার
#পর্ব:০৯

“এই! কিসের এত কথা তোর নাহারের সাথে হ্যাঁ?বলল একটু কথা বলে আসি আর মহারানি গিয়ে এতক্ষণ পর আসছে।বলি কি এত কথা বলছিলি হুম?”

“ওহ আল্লাহ!এত চিল্লাচিল্লির কি আছে? নাহার আপুর সাথে এমনি একটু কথা বলতে গিয়েছিলাম।সে বাদ দাও,কখন বাসায় ফিরে যাবে সেটা বলো। আঙ্কেল তো বাসায় থাকেন না বেশীরভাগ সময়,আন্টি একা আছেন হয়ত।তো আমাদের বিকালের মধ্যেই ফিরে যাওয়া উচিৎ”

“হুম,তা তো অবশ্যই। আমাদের বিকালের মধ্যেই ফিরে যেতে হবে। কিন্তু আসলামই তো মাত্র। আমাদের কোন চেনা পরিচিতও নাই এখানে। কিভাবে সময় কাটাব? হঠাৎ এসে হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়া তো মানায় না”

“পরিচিত নাই কিন্তু পরিচিত হতে কতক্ষন?চলো সবকিছু সম্পর্কে পরিচিত হই এরপর গায়ের হয়ে যাব দুইজন”

“মন্দ বলিস নি, চল বাসাটা ঘুরে দেখি”
____________
বিকালে আসার কথা থাকলেও নিরব এবং অথৈ সন্ধ্যার একটু আগে বাসায় ফিরেছে।

সেখানে তাদের দুজনেরই মন টিকেনি।এক তো অচেনা পরিবেশ তারপর এত অচেনা মানুষ। সবমিলিয়ে অস্বস্তিকর।
তাই তারা আবারো রিকশায় করে বাসায় ফিরার সিদ্ধান্ত নেয় কিন্তু হঠাৎই নিরবের কি হলো কে জানে রিকশাওয়ালাকে অন্য পথে নিয়ে যেতে বলল।
অথৈ জিজ্ঞেস করলে বলল”গেলেই দেখবি কোথায় যাচ্ছি”

কিছুক্ষণ পর রিকশা থামল একটা নদীর পাশের রাস্তায়। ভাড়া মিটিয়ে নিরব অথৈ এর হাত ধরে নদীর দিকে এগিয়ে গেল।
বিকাল তখনও হয় নি। দুপুর সময় পার হয়নি বলা যায়। তবুও নদীর পাশ বলে একটু পরপর শীতল হাওয়া গায়ে লাগছে।
দুই একটা বাদাম বিক্রেতা আর ফুচকাওয়ালা বসে আছে কাস্টমারের আশায়।
ব্যাস্ত শহরে সবসময় মানুষের আনাগোনা। বিকাল হলে হয়ত জায়গাটা এখনকার মত ফাঁকা থাকবে না।এখনও দুই একজনের আশা যাওয়ায় বলে দিচ্ছে কিছুটা একলা সময় কাটানোর আশায় মানুষ এখানে আসে।দালান কোঠার ভিড়ে প্রকৃতির খোঁজে আসে।

নিরব অথৈকে ইট আর সিমেন্ট দিয়ে বানানো একটা বসার জায়গায় বসতে বলল।
তারপর দুজনের জন্য বাদাম কিনল।দুইজনে চুপচাপ চারপাশের প্রকৃতি দেখতে দেখতে খাচ্ছে।
মাঝে মাঝে বাতাসের সাথে গাছের পাতা গায়ে এসে পড়ছে।
পা ভিজিয়ে দুজনে নদীর পাড়ে খানিকটা হেঁটে তারপর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
এই সামান্য কাজেই যে সময় পার হয়ে গেছে তারা টেরই পায় নি।
অথৈ যেন আজ নতুন নিরবকে দেখল।ওর কাছে মনেই হয় নি নিরবের মনে অন্য কারো বসবাস।
মনে হয়েছে অন্য স্বাভাবিক জুটির মত।

নিরব আজ সবটা মন থেকেই করেছে।যদিও ওর বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু সে ভাবল যখন ছুটি নিয়েইছে তাহলে সেটাকে কাজে লাগালেই পারে।আজ তার ইচ্ছার মধ্যে একটা পূরণ করল সে।
“নিজের প্রিয় মানুষের সাথে কিছু সময়”
সে যতটা ভেবেছিল সেরকম খারাপ লাগা তার মধ্যে কাজ করে নি নাহারের বিয়েতে।
কেন জানি তার খুশিই লাগছে।
অথৈ এর সাথে মূহূর্তটা উপভোগ করে তার অধিক ভালো লাগছে।
.
.
.
দুজনে যদিও গোসল করেছিল কিন্তু এখন আবারো ঘামে ভিজে গেছে বলে আবারো দুজনই গোসল করল।

মাগরিবের নামাজ শেষে দুজনেই ছাদে আসল। দুজনের হাতেই চায়ের কাপ।
আকাশ মেঘলা। রাত্রে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এখন বাতাস বইছে বলেই দুজনে ছাদে চা পান করতে এসেছে।
চা শেষে খালি চায়ের কাপদুটো একপাশে রেখে নিরব অথৈ এর দিকে তাকিয়ে বলল”তোর কখনো খারাপ লাগে না?”

অথৈ নিরবের দিকেই তাকিয়ে ছিল।তার প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল”কীসের জন্য?”

“এইযে তোর বিয়ে করা বর অন্য একটা মেয়েকে ভালবাসে, তোকে না”

“আজ বাসে না, একদিন তো বাসবে”

“যদি সে একদিন না আসে?”

“ভালো না বাসুক ঘৃণা তো আর করে না,ডিসরিস্পেক্ট ও করে না তাহলে এভাবেই চালিয়ে দিতে পারব”
বলেই কাপদুটো নিয়ে চলে গেল।
নিরব শুধু তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল”সেই একদিন খুব শিঘ্রই আসবে, অনেক ভালোবাসতে চাই তোকে। তোর চিন্তা ভাবনা বারবারই আমাকে মনে করায় সেদিন বিয়েটা করে ভুল করি নি”
.
.
.
কাঁথা মুড়ি দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে নিরব। নিচে আসার পর থেকে হাঁচি দিয়েই চলেছে সে।
সন্ধ্যায় গোসল করার ফলে এমনটা হয়েছে।
ছোট থেকেই নিরবের ঠান্ডা কাশি সামান্য কারণেই হয় আর তাই সন্ধ্যায় গোসল তার শরীর মেনে নিতে পারে নি বলে এই অবস্থা।

অথৈ বাসায় নেই।সন্ধ্যার পর তার বাসা থেকে ফোন এসেছিল।তার আম্মু খুব অসুস্থ।সেবা করার মত কেউ নেই। চোখ খোলাও রাখতে পারছেন না তিনি।
কয়েকদিন ধরেই কেমন খাওয়া দাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলেন আর তার ফলস্বরূপ তিনি অসুস্থ হয়ে গেছেন।

নিরবই গিয়ে অথৈকে রেখে এসেছে।তখনও দু একবার হাঁচি দিয়েছিল সে।
অথৈ বলেছিল যাওয়ার সময় ঔষধ নিয়ে যেন সে বাসায় ফিরে কিন্তু অতিরিক্ত বিরত্ব দেখাতে গিয়ে সে বলেছিল”অল্প একটু ঠান্ডা লেগেছে,সেরে যাবে।তার জন্য আবার ঔষধ লাগবে কেন?”

কিন্তু সবার শরীর যে একই রকম হয় না, কিছু মানুষ অল্প অসুস্থ হলেই তাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, বেশি হয়ে যায়।নিরব তাদেরই একজন। মিসেস হিয়া তাকে ঔষধ দিয়েছেন।
সে ঘুমিয়ে আছে এখন।আশা করা যায় একদম সকালে ঘুম ভাঙবে তার আর ঔষধ যেহেতু দ্রুত সেবন করা হয়েছে তাই রোগ শরীরে না ছড়িয়ে সুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।

অথৈ তার মায়ের পাশে বসে আছে। অসুস্থ হলে চোখ মুখের অবস্থা প্রচুর খারাপ দেখায়।উনারও হয়েছে তাই।

এদিকে মায়ের জন্য খারাপ লাগছে অন্যদিকে নিরব কি করছে সে চিন্তাও তার মাথায় রয়েছে।

অথৈ যাওয়ার পর থেকেই তার মা একা হয়ে গেছেন। তাকে আর একা একা খেতে ভালো লাগে না। কোন কাজে মন বসে না।
একা বাড়িতে থেকে এই চেনা বাড়িটাও অচেনা মনে হয়।
সঙ্গীহীনতার ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে গেছেন।

এই অবস্থায় অথৈ তাকে কোন কথাও বলতে পারছে না।তার খুব ইচ্ছে করছে কিছু কথা শুনিয়ে দিতে।
সবসময় শুধু তাকে বলত”সময়ের কাজ সময়ে করবি, নিজের যত্ন নিবি”আর আজ নিজের শরীরের প্রতি কোন যত্ন নাই।

চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন তিনি। অথৈ ফোনটা নিয়ে উঠে আসল।
লাইট নেভাতে গিয়েও নেভালো না।
নিরবকে ফোন করল তবে আন্টি রিসিভ করলেন। নিরবের অসুস্থতার খবরও দিলেন।

অথৈ জানিয়ে দিল সে দুই একদিন এখানেই থাকবে কারণ তার আম্মু অনেকটা অসুস্থ।
তার আব্বু কাল আসবে। তিনি আউট অফ টাউন।

কথা বলে ফোন রেখে দিলাম আমি। এদিকে আম্মু অসুস্থ, ওইদিকে নিরব।
আম্মুকে ছেড়ে যেতে পারব না আর নিরবের কাছে যাওয়ার কোন অজুহাতও নেই।
তাই চুপচাপ আম্মুর পাশে শুয়ে পড়লাম।
.
.
.
সকালে নিরবের ঘুম ভাঙল অনেকটা দেরিতে। পাশে কি যেন নেই মনে করতেই তার মনে হলো অথৈ নেই‌।

সে চুপচাপ উঠে হাতমুখ ধুয়ে এসে নাস্তা করে অফিস চলে গেল।
সন্ধ্যায় ফিরতেই তার মা দরজা খুলে দিল।
সে ভিতরে এসে কাপড় চেঞ্জ করে অথৈকে কোথাও দেখল না।
অথৈ বলেছিল কালকের মধ্যে চলে আসবে অর্থাৎ আজ আসার কথা ছিল কিন্তু আসে নাই তাই সে তার মায়ের ঘরে গেল।
গিয়ে দেখল তার মা ঘরে নেই। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে সে দেখল তার আম্মু থালা বাসন পরিস্কার করছেন।
সে তার মায়ের দিকে এগিয়ে গেল।

যদিও সহজ একটা কথা তবুও কিভাবে বলবে সে ভেবে পাচ্ছে না তাই চুপচাপ থাকল।
তার মা তাকে উশখুশ করতে দেখে বললেন”কিছু বললে বলে ফেল”

“অথৈ আসে নাই আম্মু?”

মিসেস হিয়া একবার নিরবের দিকে তাকিয়ে আবার থালা বাসন ধোয়ায় মনোযোগ দিয়ে বললেন”কাল রাতে ফোন করেছিল,তোর আন্টি খুব অসুস্থ তাই অথৈ চাইলেও আসতে পারবে না। ফোন করে জানিয়েছিল দুই একদিন থাকবে। তুই ঘুমিয়ে গেছিলি বলে আমি ধরেছিলাম।চাইলে দেখে আসতে পারিস,আর চাইলে কি? আমাদের দেখে আসা উচিৎ”

নিরব কিছু না ভেবেই বলল তার মাকে রেডি হতে আর সে গেল বাজারে কিছু ফলমূল কিনতে।
তার পাঁচ মিনিট পরই তারা বাসায় গিয়ে পৌঁছালো।
.
.
.
কলিং বেল চাপতেই আমি গিয়ে দরজা খুলে দিলাম।আন্টি আর নিরবকে একসাথে দেখে আমি বেশ অবাক হলাম।
না বলে হঠাৎ আসায় অবাক হয়েছি।
দুজনকেই ভিতরে আসতে বলে কিচেনের উদ্দেশ্য যেতে গেলে নিরব আমার হাতে ফলের ব্যাগটা ধরিয়ে দিল।

তারপর সে ঘরে চলে গেল আম্মুর সাথে কথা বলতে।
কিছুক্ষণ পর সে ফিরে আসল আমার কাছে।আমি তখন নাস্তা বানাচ্ছিলাম।
সে আমার পাশেই দাড়াল।
আমি তার দিকে না তাকিয়েও বুঝলাম।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমি বললাম”আমাকে মিস করো নাই?”

নিরব হালকা হেসে বলল‍”করেছি”

তার হাসি মুখ দেখে অজান্তেই মুখে লজ্জা এসে ভর করল।

“তুই করস নাই?”

“উত্তরটা তো জানেন”

“বাসায় কবে ফিরবি?”

আমি অসহায় মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে চা নামিয়ে বললাম”এখনি যেতে চাই, তবে সম্ভব নয়”

নিরব হালকা শ্বাস ফেলে বলল”আঙ্কেল? আঙ্কেল কবে আসছেন?”

“আজই, দোয়া করো আম্মু যেন জলদি সুস্থ হয়ে যায়। আব্বুকে বলব এবার থেকে যেন এখানে থাকে, আর ব্যবসার কাজে যেন বারবার বাইরে না যায়।তুমিও আঙ্কেলকে বলো যেন তিনিও এখানেই নিজের বাসায় থাকেন‍”

“তাই যেন হয়”

নাস্তা শেষ করে নিরব চলে যেতে চাইলেই আমি আটকানোর জন্য বলি”আন্টি আজ থেকে যাও না!”

আন্টি হেসে বলল”সহজ ভাষায় বল কাকে থাকতে বলছিস”

আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। আম্মু চোখ বন্ধ করে আছেন।
অসুস্থতার জন্য শরীর দুর্বল হওয়ায় একটু পর পর ঘুমিয়ে যান।এখনো তাই,নয়ত আরো লজ্জা পেতে হত।

আন্টি বলল”আমাকে বাসায় দিয়ে আয় তারপর ফিরে আয় আবার”

আমি আর নিরব একসাথে”না”বলে উঠলাম।
কারণ আমরা দুজনেই নারাজ।আন্টি একা থাকবেন এইটা তো মানা যায় না তাই বললাম”আন্টি তুমি আম্মুর পাশে শুয়ে যাও,একা যেও না প্লিজ!”
নিরবও আমার সাথে সহমত প্রকাশ করল।তাই আন্টিও আর “না” করলেন না।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে